তমসার জল পর্ব -০৯

#তমসার_জল
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
।।পর্ব৯।।
(কার্টেসী ব্যতীত কপি নিষেধ)

বিল্ডিংয়ের পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে।ইট ভাঙার বিকট শব্দে যখন আশেপাশের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই ঠিক সেই সময় এই ইট ভাঙার বিকট শব্দকে কাজে লাগায় জল।প্রথমেই এক কো*পে বর্ষণের কঙ্কার থেকে বর্ষণের মা*থা আলাদা করে।কা*টা মাথাটাকে পাশে রেখে একে একে দে*হটাকে আটটি খন্ড করে।র*ক্তমাখা হাতটা দিয়ে নিজের কপালে ঘাম মুছে জল।তারপর হঠাৎই বর্ষণের খন্ডিত মা*থাটার দিকে চোখ পরে জলের।ভীষণ মায়া ভরা চেহারা।মুখ দেখে মনে হবে একটা নিষ্পাপ মানুষ ঘুমিয়ে আছে।অথচ এই নিষ্পাপ চেহারার মানুষটাই নিজের ভেতরে পশুত্বকে ধারণ করে দিনের পর দিন নিজের লালসা মিটিয়েছে।আর তার লালসার বলি হয়েছে আদিবা আর বাসার কাজের মেয়েটা।আসলে চোখ বন্ধ করে ঘুমন্ত থাকলে পৃথিবীর সবচে নিকৃষ্ট মানুষটাকেও নিষ্পাপ লাগে।
বর্ষণের নিষ্প্রাণ কা*টা মাথাটার দিকে৷ জল নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।ঘুমন্ত চেহারাটা র*ক্ত মাখামাখি হয়ে আছে।আলতো করে কা*টা মাথাটার গালে হাত বুলায় জল।নিষ্প্রাণ মুখটার প্রতি এখন জলের মায়া জন্মাচ্ছে।অথচ সব কিছু শেষ। জল বেলকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকায়।নোনাজলে চোখের সামনটা ঝাপসা হয়ে আসে জলের।র*ক্ত মাখা হাতে নোনাজল মুছে বলে,,,

” আমি পেরেছি আদিবা।আমি পেরেছি তোমার প্রতি অবিচার করা মানুষটাকে শাস্তি দিতে।তোমার,আমার,কাজের মেয়ের প্রতি অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে পেরেছি আমি।তোমার মৃত দেহের প্রতি অত্যাচারের শাস্তি আমিও দিয়েছি বর্ষণের দে*হকে।ভেতরে থাকা সমস্ত হিংস্রতা আমি বর্ষণের দেহের প্রতি প্রকাশ করেছি।”

কথাটা বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জল।আজ জল বুঝতে পারছে জলের মনে বর্ষণের প্রতি ভালোবাসা ছিলো এবং আছেও।দীর্ঘকাল ঘৃণার ভারী পাথরে ভালোবাসাটুকু চাপা পড়ে ছিলো।সেই ভালোবাসাটা আজ সর্বস্ব শক্তি দিয়ে সেই ঘৃণার পাথর চূর্ণবিচূর্ণ করে জেগে উঠেছে।কিন্তু এখন সব শেষ হয়ে গেছে। জলের দৃষ্টিসীমা ঘোলাটে কালো হয়ে আসে।চোখের সামনে কল্পনায় বর্ষণকে দেখতে পায় জল। দেখতে পায় বর্ষণ হাত বাড়িয়ে জলকে কাছে নিয়ে বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে ধরছে।কপালে আলতো করে চুমু খাচ্ছে যেটা বাস্তবে কখনো হয় নি।মানুষ আসলেই কল্পনায় সুন্দর।

__________°_°

জলের যখন জ্ঞান ফিরে তখন রাত দশটার কাছাকাছি। শরীরটা বড্ড দুর্বল লাগছে জলের।তারপরও উঠে ফ্রীজ থেকে বর্ষণের মাং*সের প্যাকেট গুলো বের করে জল।খন্ডিত দে*হ,মাং*স,জমানো র*ক্ত,খন্ডিত মা*থা সবগুলো একটা বড় প্লাস্টিকের বস্তায় ভরে থানার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় জল।বিল্ডিং থেকে বের হবার সময় দারোয়ান বর্ষণের কথা জিজ্ঞেস করে।জল মুচকী হেসে বলে,,,,

” বর্ষণ অসুস্থ একটু।তাই দুইদিন হলো অফিসে যায়।বাসায় রেস্ট নিচ্ছে।”

দারোয়ান আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।জল বেরিয়ে গলির মুখ থেকে একটা রিক্সা নিয়ে সোজা থানায় যায়।বেশ রহস্যজনক আচরণ নিয়ে জল থানায় প্রবেশ করে।দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বেশ অবাক হয়ে যায় তরুণীর আচরণ দেখে। দারগার চেম্বারের সামনে গিয়ে রহস্যজনক ভাবে সেই বস্তা থেকে বর্ষণের লাশ বের করে।বরফ জমানো রক্তের দলাটা থেকে টুপ টুপ করে রক্ত ঝড়তে লাগে।সেই রক্ত নিজের সারা মুখে মেখে জল হাসতে হাসতে দারগাকে বলে,,,

” আমি আমার স্বামীকে খুব করেছি অফিসার।এরেস্ট মি।”

কথাটা বলে আবার হাউমাউ করে কেঁদে দেয় জল।থানায় উপস্থিত সকলে নির্বাক হয়ে যায় জলের আচরণে।দায়িত্বরত দুজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা এসে জলকে ধরে।পুলিশ কর্মকর্তারা প্যাকেট খুলে খুলে বর্ষণের দেহাংশ বের করে।সব পেলেও তারা বর্ষণের চোখ দুটো পায় না।জলকে জিজ্ঞেস করা হলে জল পাগলের মতো খিলখিলিয়ে হেসে বলে,,,

” চোখ দুটো তো আমার পেটে।স্যুপ করেছিলাম।চোখ দুটো আর কিছু মাং-স দিয়ে।”

জলের কথা শুনে উপস্থিত সকলের গা শিউরে উঠে।এত ভয়ানক মেয়ে মানুষ হয়?নারী কর্মকর্তারা জলকে লকাপে নিয়ে যান। আর বর্ষণের দেহাংশ* ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়।টানা এক সপ্তাহ জলকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।কিন্তু জল কোনো উত্তর দেয় না।শুধু একটাই কথা তার।নিজের ফাঁসি*
অবশেষে দায়ে পরে ইন্সপেক্টর উপমাকে আনা হয়। ইন্সপেক্টর উপমার কাছেও জলের পাগলামি হার মানে।অনেকটা বিরক্ত হয়েই ইন্সপেক্টর উপমা জলের প্রতি নরম হন।কথায় বলে ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা সম্ভব।

সেদিন রাতে ইন্সপেক্টর উপমা জলের সাথেই জেলের ভেতর থাকেন।ঘুমের ঘোরে হঠাৎ তিনি খেয়াল করেন তার পাশে জল নেই।ঘড়ির কাটা তখন রাত তিনটার ছুঁই ছুঁই। জলকে খুঁজতে গিয়ে তিনি কারও কবিতা আবৃত্তির আওয়াজ পান।

সময় আমার সমঝে চলুক,
মগের মুল্লুক থাক একা!
আমি বরং জোনাকি খুঁজি,
শহর ধূসর পথ ব্যাঁকা।
লাল মাটি লাল কাদা মাখি,
রাতের সাথেই চাঁদের দেখা।
রাতের হাতের স্পর্শে ঘুম,
রাত জেগেই স্বপ্ন দেখা!
আমি বরং আবার জোনাকি খুঁজি!
আর রাতের সাথেই হোক দেখা!

জলের কবিতা আবৃত্তি শুনে উপমা নিজের অজান্তেই বলে ফেলে,,,

” বাহ কি সুন্দর।”

জল থেমে যায়।পেছন ঘুরে ইন্সপেক্টর উপমাকে দেখতে পায়।

” ম্যাম আপনি?”

” বেশ ভালো আবৃত্তি করেন তো আপনি!কন্ঠ বেশ মিষ্টি আপনার।”

জল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,,

” মিষ্টি কন্ঠ দিয়ে কি হবে যদি জীবনটাই তিক্ততায় ভরা থাকে।আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি এই তিক্ত জীবনের সমাপ্তি ঘটবে।”

” আপনি আমায় পুরোটা বললে আমি চেষ্টা করবো আপনাকে নির্দোষ প্রমাণ করার।”

” তার প্রয়োজন নেই।স্বামী হত্যাকারী অলক্ষুণে বিধবা মেয়েকে সমাজ মেনে নেবে না।মেয়েদের জন্য পুরুষশাসিত সমাজটা বড্ড কঠিন। যে পুরুষ অহরহ বউ পে*টায়,বউকে মা*রে, ধ*র্ষণ করে তারপরও সেই পুরুষই সমাজে অবাধে চলাফেরা করে।ধ*র্ষিতা হয় সমাজে অবহেলিত অপমানিত শেষে তার পরিনাম হয় আত্মহত্যা।আপনি শুধু আমার ফাঁ*সির ব্যবস্থা করে দিন। ”

ইন্সপেক্টর উপমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।জল আনমনে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ইন্সপেক্টর উপমা জলের কাছে গান শোনার আবদার করে বসেন।জল আবদার ফেলতে পারে না।তাছাড়া অনেকদিন হলো জলের গান গাওয়া হয় না।জল নিজের কোকিলাকন্ঠে ❝দেহখান❞ গান ধরে।

একা বসে তুমি
দেখছো কি একই আকাশ
দিন শেষে তার তারাগুলো দিবে দেখা
মেঘে ঢাকা তারার আলো
দেখে থাকো তুমি দেখো ভালো
হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়

একা বসে তুমি
দেখছো কি একই আকাশ
দিন শেষে তার তারাগুলো দিবে দেখা
মেঘে ঢাকা তারার আলো
দেখে থাকো তুমি দেখো ভালো
হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়

সেই দিনে এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে
খুঁজে পাবে না সেই গল্পকার
দিনগুলো খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে
শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার

আমার দেহখান, নিও না শ্মশান
এমনিতেও পুড়ে গেছি
আমার সব স্মৃতি ভুলো না তোমরা
যা ফেলে গেছিই

ইন্সপেক্টর উপমা পরম আয়েশে চোখ বন্ধ করে জলের গান শুনে।গানের প্রতিটা লাইন জলের জীবনের সাথে মিলে যাওয়ায় গান গাওয়ার সময় নিজের অজান্তেই জল কেঁদে দেয়।শুধু জল কেন?অনেক মানুষের জীবনের সাথে বোধহয় দেহখান গানের লিরিক্স মিলে যাবে।
গান শেষে জল উপমাকে বলে ঘুমিয়ে যেতে।উপমা পালটা প্রশ্ন করে,,,

” আপনি ঘুমাবেন না?”

জল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,,,,

” নাহ।ঘুম একটা লাক্সারিয়াস জিনিস।যেটা আমার কপাল থেকে অনেক আগেই উঠে গেছে।আপনি ব্যস্ত মানুষ। রেস্টের দরকার আছে।আপনি ঘুমান।আমি না হয় রাতের আকাশ ভরা তারা আর চাঁদের সাথে কথা বলি!”

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here