তমসার জল পর্ব -০৭

#তমসার_জল
#লুৎফুন্নাহার_আজমীন(#কন্ঠ)
।।পর্ব৭।।
(কার্টেসী ব্যতীত কপি নিষেধ)

ডায়েরির পাতা উলটে কিছু পাতা জল ছেড়া অবস্থায় পায়।তারপরে একটা পাতা উলটে আদিবার আরেকটা লেখা পায়।লেখাটা কোন দিনে লেখা অর্থাৎ তারিখ দেওয়া নেই।তবে লেখাটা খুব সুন্দর। জলের আদিবার লেখাটা খুব ভালো লাগে।

❝ জীবনের খারাপ মুহুর্ত গুলো বালিতে বা মাটিতে লিখে রাখতে হয়।যাতে সময়ের সাথে সেগুলো হারিয়ে যায়।আর সুন্দর মুহুর্তগুলো পাথরে যাতে সেগুলো সারাজীবন অক্ষত থাকে।❞

শহুরে জীবনে মাটি,বালির খুব অভাব।স্বভাববশত ডায়েরীর পাতায় লিখে রেখেছিলাম।তাই ছিড়ে ফেললাম।

আদিবার লেখাটা পড়ে জল কেমন যেন কিছু হারিয়ে ফেলার অনুভূতি পায়।ছেড়া পাতা গুলা থেকে হয়তো কোনো ক্লু পেতো বর্ষণ সম্পর্কে।আদিবা কাজটা একদম ঠিক করেনি।মনে মনে আদিবার ওপর খুব রাগ হয় জলের।আদিবার ওই পাতাগুলো ছিড়ে ফেলার জন্যই হয়তো আদিবাকে নির্মম ভাবে ম*রতে হয়েছে।আর জলকে এত পৈশাচিকতা সহ্য করতে হয়েছে।

১৪ই এপ্রিল ২০১৮

রিলেশনের আট মাসের মাথায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ফিজিক্যাল রিলেশনের জন্য বর্ষণের চাপ বাড়তে থাকায় এই সিদ্ধান্তটা নেইই।যদিও আমি নিশ্চিত না এই সিদ্ধান্তটা আদোও সঠিক কি না!তবে বর্ষণকে আমি হারাতে চাই না।হয়তো তাকে না পেলে আমি ম*রে যাবো না।তবে তাকে না পাওয়ার যে একটা আফসোস থাকবে সে আফসোস আজীবন আমাকে জ্যান্ত লা*শ করে রাখবে।আমার পরিবার বর্ষণকে মেনে নেইনি।পালিয়ে বিয়া করছি আমরা।বর্ষণের কাছ থেকে শোনা সে নাকি আমাদের রিলেশন সম্পর্কে জানেন।তারপরও ভয় কাজ করছে।উনি যদি না মেনে নেন!

২৪শে মে ২০১৮

দাম্পত্য জীবনের একমাস হলো।বর্ষণ অনেকটা চ্যাঞ্জ হয়ে গিয়েছিলো।ভেবেছিলাম বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু না। হয়নি।মানুষটা কেমন যেন হিংস্র প্রকৃতির হয়ে গেছে।শারীরিক চাহিদা ছাড়া আমার প্রতি কোনো আকর্ষণ দেখি না তার।

২৮শে মে ২০১৮

আজ আমার জন্মদিন।বাবা-মা কে ছাড়া জীবনে প্রথম কোনো জন্মদিন এসেছে।ভেবেছিলাম বর্ষণ বাবা-মায়ের শূন্যতাকে কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু সেদিকে তার কোনো ধ্যান জ্ঞানই নেই।বার্থডে গিফট হিসেবে একটা কুড়িয়ে আনা ফুল দিলেও হতো! প্রতিটা মেয়েই তার স্বামীর কাছ থেকে বিশেষ দিনগুলোতে কিছু না কিছু তো আশা করেই!

আর ভাল্লাগ্লছে না জলের।দীর্ঘশ্বাস নিয়ে জল ডায়েরীটা বন্ধ করে।সপ্তাহ খানেকের মতো হলো জলের শ্বশুর অর্থাৎ বর্ষণের বাবা মারা গেছেন।প্যারালাইজড হয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন।বর্ষণের কারণেই বলে এমনটা হয়েছিলো! জলকে দেখে এসে বর্ষণ জলকে বিয়ে করার জন্য প্রচন্ড ঝামেলা করছিলো।অফিস শেষে বাসায় যতটুকু সময় থাকতো বাকবিতন্ডা,জিনিস ভাঙচুর করতো।একদিন নাকি প্রচন্ড বাকবিতন্ডা হয় বর্ষণ আর বর্ষণের মায়ের মধ্যে।জলের শ্বশুর শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলেন।তিনি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বর্ষণ বর্ষণের মাকে বুঝাতে যান।ঠিক তখনই বর্ষণ রাগের মাথায় নিজের বাবাকে হাতের কাছে থাকা কাঠের ফুলদানি থেকে আঘাত করে।বর্ষণের বাবা নিচে পরে যান।বর্ষা গিয়ে বাবাকে ঘরে।মাথায় সামান্য আঘাত পান তিনি।বর্ষা প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় তাকে।সেদিন রাতেই বর্ষণের বাবা স্ট্রোক করেন এবং বাম পাশ তার প্যারালাইজড হয়ে যায়।টাংগাইল থাকাকালীন জলই শ্বশুরের যাবতীয় সেবা করতো।জলের শ্বাশুড়ি শরীরে একপ্রকার হাওয়া লাগিয়েই ঘুরতেন। স্বামীর ধারে কাছেও যেতেন না।নিজেও এক গ্লাস পানি ভরে খেতেন না।

জল ঢাকা আসার পর বর্ষা যতটুকু পারে বাবার সেবা করতো।রিশাদ নামের একটা ছেলের সাথে বর্ষার সম্পর্ক আছে।দেখতে শুনতে আচার-আচরণ ভালোই ছেলেটার।তবে মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে।তাই জলের শ্বাশুড়ি সেই ছেলেকে মেনে নিতে পারবে না।তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বড়লোক ঘরে মেয়ের বিয়ে দিবেন। বর্ষা জলকে জানিয়েছে।জলের শ্বশুরের কুলখানি হলেই রিশাদের কাছে চলে যাবে বর্ষা।জাহান্নামে সে আর থাকতে চায় না।
জল তাতে কোনো মতপ্রকাশ করেনি।শুধু তার এক্টাই চাওয়া আদিবার মতো ভুল যেন সে না করে।যদিও হাতের পাঁচটা আঙুল সমান আর সব পুরুষও এক না। তবে এই পুরুষ জাতটাই অদ্ভুত। কোনো পুরুষের কাছে নারী সবচে বেশি সুরক্ষিত আবার এই পুরুষের কাছেই নারী সবচে বেশি নির্যাতিত।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত ন’টার মতো বাজে।বর্ষণের আসার সময় হয়ে গেছে।লোকটার এতই দেহের ক্ষুধা যে বাবার মৃত্যুতেও তার কিছু যায় আসে না।এক ফোঁটাও যদি নোনাজল গড়িয়ে পড়ে সেদিন বর্ষণের!পুরো স্বাভাবিক ছিলো বর্ষণ যেদিন ওর বা*বা মারা যান।এমনকি বাবার লা*শকে কবরে নামাতেও বর্ষণের আপত্তি ছিলো।নোংরা জিনিস সে স্পর্শ করবে না।পারিবারিক শিক্ষা মানুষত্বের কতটা অভাব থাকলে সন্তান বাবার লা*শকে নোংরা বলে!পরে বর্ষণের চাচাতো ভাইরা বর্ষণের বাবার লা*শকে কবরে নামান। আর এদিকে বর্ষণের মায়ের মনে হয় ঈদ লেগেছিলো সেদিন।স্বামীর পেনশনের টাকা,জমানো টাকা সব তার হয়ে গেলো।লোকজনের সামনে ভালোই অভিনয় করেছিলেন তিনি। আর লোক চক্ষুর আড়ালে তার আসল রূপ বেরিয়ে আসে।মৃত্যুর কয়েকদিন আগে নাকি টিপসই দিয়ে স্বামীর ব্যাংকে সব টাকা পয়সা মহিলা নিজের নামে করে নিয়েছেন।টাকা মানুষকে কতটা নিচে নিতে পারে ভাবা যায়? এই জন্যই হয়তো হাদিস আল-কোরআনে বলা হয়েছে জাহান্নামের অধিকাংশ বাসিন্দা হবে নারীরা।আবার জান্নাতেও সর্বপ্রথম নারীরা যাবেন।আল্লাহর মেহেরবানি সত্যিই বোঝা দায়।

জলের মনে হয় বর্ষণ ওর মায়ের মতো আর বর্ষা ওর বাবার মতো হয়েছে।

কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খোলে জল।বিধ্বস্ত অবস্থায় বর্ষণকে পায়।বর্ষণ কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢোকে।জ্বর জ্বর ভাব হচ্ছে কয়েকদিন ধরে জলের।সারাদিন শুয়েই ছিলো সে।খাবারগুলো কোনো রকমে গরম করে দিয়ে জল সোফাতে গিয়ে শোয়।বর্ষণ ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে।জল বর্ষণের দিকে শুকনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মানুষটাকে মানুষের কাতারেই ফেলে না ইদানীং জল।মানুষ হতো যদি তাহলে এসে গায়ে অন্তত আলতো করে হাত দিয়ে দেখতো জলের শরীর ঠিক আছে নাকি?খাওয়ার আগে অন্তত একবার জিজ্ঞেস করতো জল খেয়েছে কি না।নিজেরটাই বুঝে শুধু লোকটা।ভীষণ স্বার্থপর লোকটা।ভীষণ।

” বাসন গুলো ধুয়ে রুমে আসো।”

” শরীরটা ভালো নেই আজ।খুব উইক ফিল করতেছি।আজকের জন্য ছেড়ে দাও।”

” আর মানুষের শরীর খারাপ হয় না?যা বললাম তাই করো।”

জল প্রতিত্তোরে জল কিছু বলে না।কথায় বলে না আশায় বাঁচে চাষা?জল বর্ষণের মানবিকতার আশায় কথাটা বলে ছিলো। কিন্তু মানুষরূপী পশুর তো কোনো মানবিকতা থাকে না।বিশেষ দিনগুলোতেই ছাড় দেয় না আর সামান্য জ্বর।তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে জল।

________′_′

আজ বর্ষণের বাবার কুলখানি হলো।ঢাকা থেকে টাংগাইল এসেছে জল বর্ষণ।ঘরে গিয়ে দেখে বর্ষা জলের শ্বশুরের বিছানায় বাবার ব্যবহৃত শেষ জামা বুকে জড়িয়ে এক ধ্যানে বসে আছে।বাবার মৃত্যুর শোকে বর্ষার মুখ মলিন হয়ে এসেছে।শুকনো মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেনি।

” বর্ষা?”

জলকে দেখে বর্ষা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে।কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,

” জানো ভাবী আব্বুর ফতুয়াটায় না এখনো আব্বুর গায়ের গন্ধ আছে।আব্বু এত তাড়াতাড়ি কেন চলে গেলো।আব্বু বলছিলো যেমনেই হোক সুস্থ হয়ে আমায় রিশাদের হাতে তুলে দিবে।আব্বু তো কথা রাখলো না।”

জল বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,,,

” কান্না করিও না বর্ষা।মানুষ মরণশীল।আব্বুর হায়াত আল্লাহ এই পর্যন্তই লিখে রেখেছিলেন।সে বলতো না তুমি তার দ্বিতীয় মা?এইভাবে কান্না করো না।তোমায় কাঁদতে দেখলে তার রুহ কষ্ট পাবে।আর আব্বু তো তোমার সাথেই আছেন।তার দোয়া তোমার সাথে সবসময় থাকবে।আমায়ও তো আব্বু মা বলে ডাকতেন।সব মেয়ের কপালে কি থাকে শ্বশুরের থেকে মা ডাক শোনার সৌভাগ্য?আমার কষ্ট হচ্ছে না? তাই কি আমি ভেঙে পড়েছি?কান্না কাটি না করে তার জন্য দোয়া করতে হবে।”

বর্ষণের মা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো। সে ভেংচি কেটে বলেন,,,

” একজনের অভিনয় দেখেই কুল পাই না আরেক জন হাজির।”

জল কিছু বলে না।দীর্ঘশ্বাস ফেলে।এই মহিলাকে নিতে জলের শ্বশুর কীভাবে ছিলেন আল্লাহই জানেন।জলের মনে হয়না জলের শ্বাশুড়ি কখনো জলের শ্বশুরকে ভালোবেসেছিলো।ভালোবাসলে এতদিনে স্বামীর শোকে পাগল প্রায় হয়ে যেতেন।

চলবে,,,ইনশাআল্লাহ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here