তার বিকল্পে পর্ব -০১

আমি একটা মেয়ে মানুষ হয়ে নির্লজ্জের মতো পরিবারে নিজের বিয়ের কথা বলেছি। যথেষ্ট অপেক্ষা করেছিলাম তাদের জন্য , কিন্তু কেউ মজার ছলেও আমার বিয়ের উল্লেখ করেতোনা। আমি বলার পরে তারা বাধ্য হয়ে সমন্ধ দেখতে শুরু করেছিলো। আমি অনেক বেশি খুশি ছিলাম, তবুও তো বিয়েটা হচ্ছে!

ছলছল চোখে মেহুলের কথাগুলো শেষ হতেই তার মনোযোগী শ্রোতা প্রশ্ন করলো,
‘ এত সাধনার বিয়ে অথচ বিয়ের আগেরদিন পালালেন? একটু অদ্ভুত না?

‘ আপনি ভালো করেই জানেন বিয়ের বয়সে মেয়েরা তখনি বিয়ে করতে চায়না, যখন বিয়েটা তার প্রিয় মানুষের সাথে হয়না, কিংবা ক্যারিয়ার নিয়ে কোনো চিন্তা থাকে। এছাড়া যেকোনো মেয়েই বিয়ের জন্য প্রস্তুত থাকে৷ আমিও ছিলাম, আমার কোনো প্রিয় মানুষও নেই আবার ক্যারিয়ার নিয়েও মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু সমস্যাটা কি হয়েছে আশা করি আপনিও জানেন। এতটাও পঁচে যাইনি তো! পালানো ছাড়া উপায় কি ছিলো?

শব্দ করে হাসতে লাগলো ছেলেটা। আসলেই সে জানে সবটা। সে জানবেনা তো কে জানবে? মেহুলের বিয়েটা তো তার সাথেই ঠিক হয়েছিলো। আপাতত দুজনে একসাথেই ট্রেনে করে গন্তব্যহীনতায় ছুটছে। অথচ আগামীকাল তাদেরই বিয়ের তারিখ।

একটু পেছনে ,

বিয়ে করবে খুশিতে মেহুল একমাস আগেই হল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।
সব বন্ধু বান্ধবদেরকে বিয়ের আগেই ট্রিট দিয়েছে। তার বিয়ে সমন্ধ চলছে বলে কথা! বেচারির জীবনের একটাই লক্ষ্য ছিলো সেটা হচ্ছে বিয়ে করা৷ সেটা যেখানে পূরণ হয়ে যাচ্ছে সেখানে সবাইকে ট্রিট তো দিতেই হবে! কিছুটা অগোছালো আর তার পুরুষালি চলাফেরার জন্য ছেলেরা তার প্রতি কখনোই আকৃষ্ট হতোনা। জীবনে একটা প্রেম অব্দি করতে পারেনি৷ কোনো ছেলে তাকে আসলে মেয়ে বলেই চিন্তা করতে পারতোনা, তার ব্যাচের সবাই তাকে ‘বেডা’ ছাড়া কিছু সম্বোধনই করেনা ৷ এসব নিয়ে তার ক্ষোভের শেষ নেই। তাই সে যে আট দশটা মেয়ের মতোই একটা মেয়ে সেটা প্রমাণ করার অপেক্ষাতেই দিন গুনে যাচ্ছিলো, সবাইকে চ্যালেঞ্জ করতো বিয়ের পর তাকে যে কেউ এক পলক দেখলেই বলে ফেলবে এটা ঘরের লক্ষী লাজুক বউ এবং প্রথম বিবাহবার্ষিকীটা সে বাচ্চাসহ উদযাপন করবে।
এসব শুনলে তার বন্ধুবান্ধব হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতো।

বিয়েটিয়ের ইচ্ছে খুব আগেও থেকেও ছিলোনা। কিন্তু যখন রাহুল তার প্রেমপ্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলো, আর বলেছিলো প্রয়োজনে সে সারাজীবন একা মরবে তবুও মেহুলকে সঙ্গী করার রুচি হবেনা।
তখন থেকে গত দুই আড়াই বছর ধরে মেহুলেরও খুব ইচ্ছা এই ছন্নছাড়া জীবন থেকে বেড়িয়ে আসবে। অন্য সবার মতো পরিপাটি রুচিশীল একটা মেয়ে হবে। কাজ করবে, সংসার করবে। সবাইকে জিনিসগুলো ভালোভাবে উপলব্ধি করাবে সেও কোনো মেয়ের চেয়ে কোনোদিকে কম নয়। কিন্তু সেই সুযোগটাই যেন তার জন্য বিয়ে ছিলো। এছাড়া তার হঠাৎ পরিবর্তন তাকে উপহাস্য করে তুলবে। এদিকে বিয়েটাই হচ্ছিলোনা তার। সে খুব করে শুধু নিজের বলে একটা মানুষ চাইতো! অবশেষে যখন সেই দিন চলে এলো, সব ছেড়ে বাড়ি চলে আসলো। সবাইকে আড়াল করে এই কয়দিন নিজেকে গুছানো জরুরী তার।

মেহুল পরিবারের ৭ম সদস্য। তার কোনো ভাই নেই, সবার ছোট সে ছিলো। একটা ভাইয়ের অভাব ভুলতে তার পরিবারই ছোট থেকে তাকে ছেলের কায়দায় বড় করছে। ফ্রগ কিনে দেওয়ার বদলে তাকে কিনে দিয়েছে শার্ট, প্যান্ট। মেয়েদের চাকচিক্য জুতোর বদলে তাকে কিনে দিয়েছে ছেলেদের সাদাসিধা চামড়ার জুতো ৷ তার চুলও কখনো ছোট থেকে বড় হতে দেয়নি, সেলুনে নিয়ে গিয়ে ছেলেদের কাট দিয়ে এনেছে । তার বাবা তাকে পুতুল নিয়ে খেলতে পর্যন্ত দেয়নি, তাকে নিয়ে যেতো ক্রিকেট, ফুটবলের মাঠে। সেই সুবাদে সেও এসবে বেশ এগিয়ে। একেকটা ছেলেকে অনায়েসে টক্কর দিতে পারে।

সবাই প্রেম করে, বিয়ে করে, নানান কেচ্ছাকাহীনি শুনে শুনে তারও মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হতো ব্যপারগুলোকে কাছ থেকে দেখার।
কিন্তু সব তো সবাইকে দিয়ে হয়না। তার হুটহাট কিল-ঘুষি, গালিগালাজের জন্য তার ক্লাসের ছেলেরাই তাকে ভয় পেতো।
প্রেমিক হওয়ার সাধ কারোরই জাগেনি, তবে ইউনিভার্সিটিতে তার বন্ধুর সংখ্যা ছিলো অগণিত। যাদের বেশিরভাগই ছেলে।

মেহুল বাড়িতে আসার দুই সপ্তাহ পরে তাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসে। এর মধ্যে সে যথেষ্ট গুছিয়ে যায়। নিয়মিত পার্লারে যাতায়াত, কথাবার্তায় নম্রতা তার মধ্যে স্বইচ্ছাতেই ফুটে ওঠে। তাকে পাত্রপক্ষও এক দেখাতে পছন্দ করে ফেলে। তবে পাত্রকে সরাসরি সে দেখেনি। পাত্রসহ পাত্রের বাড়িঘর দেখেছে তার পরিবারের লোকজন। তারা বলেছে ছেলে দেখতে শুনতে খুবই ভালো। সব শুনে তার আর আপত্তি রইলোনা।

কিন্তু বিপত্তি ঘটলো গায়ে হলুদের দিনের বেলা। হঠাৎই তাকে পাত্র ফোন দিলো। দিয়ে বললো,
‘ আপনি তো আমাকে সম্পূর্ণ অন্ধের মতো বিয়ে করতে যাচ্ছেন, বিয়ের আগে একবার কি আমাকে কি দেখার ইচ্ছে নেই?

মেহুল বলেছে,
‘ সেটা অবশ্যই আছে, আপনি সমস্যা না থাকলে আমাকে ছবি পাঠাতে পারেন।

কিন্তু যখন ছবি পাঠালো, মেহুল দেখলো পাত্রের মাথা টাক। এটাও বড় বিষয় ছিলোনা, যেটা বিষয় ছিলো সেটা হচ্ছে দেখতে তাকে ৪৫-৫০ বছর বয়সী কোনো বৃদ্ধ মনে হচ্ছে৷ বিয়ের জন্য মেহুল পাগল হতে পারে, কিন্তু সে তো এতটাও পাগল না যে এমন বাবার বয়সী কাউকে বিয়ে করে জীবন শেষ করে দিবে! জীবনে যা যা টিপ্পনী শুনেছে তা যে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে তা সে টের পেয়ে গিয়েছিলো। সবাই সত্যিকার অর্থেই তাকে নিয়ে আরো হাসবে৷ বলবে শেষমেষ তাকে কোনো বুড়ার গলায় ঝুলতে হয়েছে।
পরিবারে বলেকয়ে সে বিয়ে করতে যাচ্ছে, তারা যে আসলে তার জন্য এমন কিছু রাখবে সেটা কল্পনাও করতে পারেনি৷ মেহুল তার ছয়বোনের জামাইকেই দেখেছে, সবাই-ই ১০/১০ পাওয়ার ক্ষমতা রাখে৷
সেও তো দেখতে কম সুন্দরী না, শুধু চলাফেরাটাই অসুন্দর ছিলো৷ এসব তো সে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করেই ফেলতো!
পরিবারের সবার উপর তার প্রচন্ড জেদও কাজ করছিলো।

তবে যাই মনে আসুক, সে ইতোমধ্যে তা বুঝে গেছে এই বিয়ে সে ফেরাতে পারবেনা৷ নিজে সব ঠিক করে এখন যদি বিয়ে করবেনা বলে তাকে আস্ত রাখবেনা৷ তার চেয়ে ভালো পালিয়ে যাওয়া৷
এরপর যেভাবে ছিলো সেভাবেই একটা ব্যাগ নিয়ে সোজা রাস্তায়। কোথায় যাবে কি করবে এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তার রাত হয়ে গেলো। টাকাপয়সাও বেশি নিয়ে বের হয়নি। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তার মনে হলো তার কানে তো এক জোড়া সোনার দুল আছে। বাড়িতে আসার পরে পার্লারে গিয়ে কান ফুঁড়ানোর পরে দুলজোড়া তার মা তাকে উপহার দিয়েছিলো।
কিছু না পেয়ে সেগুলোকে বিক্রি করে দিলো। তারপর রিকশা নিয়ে চলে গেলো স্টেশন। তার সিদ্ধান্ত স্টেশনে যে ট্রেন পাবে তাতেই চড়ে বসবে৷ বিয়ে ভেঙে গেলে পরে বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবে। এরপর মেহুল স্টেশনে গিয়ে বসে রইলো। অনেক্ষণ বসে থাকার পরে রাত ৯ টার দিকে একটা ট্রেন এসে থামলো। মেহুল তাড়াহুড়ো করে উঠেই সামনের যাত্রীদের উদ্দেশ্য করে বললো,

ট্রেন কোথায় যাচ্ছে জানেন?
এমন প্রশ্নে আশেপাশের কয়েকজন অবাক হয়ে বললো,
‘ একি আপনি না জেনে উঠে গেছেন?
তৎক্ষনাৎ মেহুলের জবাব,
‘ আসলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। স্টেশনে যে ট্রেন পেয়েছি সেটাতেই উঠে গেছি।

কোথা থেকে যেন একটা ছেলে এসে মেহুলকে বললো,
‘ আপনার কাল বিয়ে তাই পালিয়ে এসেছেন তাইনা?

আমতা আমতা করে মেহুল বললো,
‘ আপনি কীভাবে জানেন?

ছেলে হাসতে হাসতে বললো,
‘ পাত্র তো আমিই ছিলাম। বউ পালিয়ে গেছে শুনে খুশিতে ট্যুরে যাচ্ছি।

মেহুল তার দিকে বড় বড় চোখে বললো,
‘ আপনি ভুল ভাবছেন! হয়তো আপনার পাত্রী অন্য কেউ হবে, আমি পাত্রের ছবি দেখেছি, সে আপনি নন।

কিন্তু ছেলেটা তার ফোন বের করে দেখালো,
‘ দেখুন আমার ফোনে আপনার ছবি। মেহুল দেখলো ছেলেটা সত্যি বলছে। তাকে পাত্রের বাড়ি থেকে যেদিন দেখতে এসেছিলো, ছবিগুলো তখনকার।

মেহুল এবার বুঝতে পারছেনা তাহলে তাকে ওই ছবি কে পাঠিয়েছে! তার পরিবার তো তাকে এক দন্ডও মিথ্যা বলেনি। পাত্র দেখার মতোই নয় শুধু, দেখলে প্রেমে পড়ে যাওয়ার মতো! কিন্তু মেহুলের পরেই মনে হলো ছেলেটা বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় অনেক খুশি, যার জন্য ট্যুরে যাচ্ছে। হয়তো তাকে বিয়ে করতে কোনো কারণে আপত্তি ছিলো তাই এভাবে তাকে বিয়ে ভেঙে পালাতে বাধ্য করেছে।
সে কিছু বলার আগেই ছেলেটা বললো,
‘ আসুন ওখানে একটা খালি সীট আছে, বসে গল্প করি।

মেহুল গিয়ে বসলো। ছেলেটা বসেই বললো,
‘ আমি উদয়, আপনি মেহুল। আমাদের বিয়ের কার্ডে সুন্দর করে লেখা আছে আগামী সোমবার উদয় মেহুলের শুভ বিবাহ। অথচ উদয় আর মেহুল সেদিন থাকবেই না, হাহাহাহা।

মেহুল কিছু না বলে তার দিকে তাকিয়ে আছে। উদয় হাসি বাদ দিয়ে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
‘ তারপর বলুন কেন বিয়েটা করতে চাইলেন না?

এমন প্রশ্নে এক প্রকার বিব্রতই হলো মেহুল, বিয়ে নিয়ে তার বিশদ আগ্রহ শুনে উদয় বেশ মজা করতে লাগলো। এসবের মধ্যেও মেহুল বলে ফেললো,
‘ আপনি চাইলে আমরা কিন্তু ফিরে যেতে পারি, আমাদের বিয়েটা ভালোভাবেই হতে পারে।

মেহুল এই কথা বলার পরেই উদয় এমন করে হাসতে লাগলো যেন মেহুল কোনো জোকস বলেছে। সে সীট ছেড়ে উঠে বললো,
‘ বিয়ে করবোনা বলেই তো রফিক মামার ছবি পাঠিয়েছি। হাহাহা আমি একটা ছেলে হয়ে আরেকটা ছেলেকে তো বিয়ে করতে পারিনা, শত হোক আমি গে তো নই!

চলবে…….

#তার_বিকল্পে (০১)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here