তাহারেই পড়ে মনে পর্ব ১

#তাহারেই_পড়ে_মনে
পর্ব এক
গোলাপি রঙের ডিমলাইটের আলোয় ঘর ভরে আছে। কমনীয়, স্নিগ্ধ, নরম আলো। রাতে সবাই নিল আলো পছন্দ করে কিন্তু এই মেয়েটির সবকিছুতেই গোলাপি রঙ চাই। বিছানার চাদরে গোলাপি, পর্দায় গোলাপি ফুল, রাত্রিপোশাক হালকা গোলাপি রঙ এমনকি মোবাইলটাকেও গোলাপি জামা পরানো। কিন্তু এই শান্ত স্নিগ্ধ আলোও মেয়েটির চোখে ঘুম এনে দিতে পারছে না। গত কয়েকটা মাস মেয়েটা নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। দিনের বেলায় পড়ে পড়ে ঘুমায়, কিন্তু রাতের ঘুম না হওয়া ক্লান্তি সারাদিনের ঘুমেও দূর হয় না। চোখের নিচে ব্যাগ পড়ে গেছে, অর্ধচন্দ্রাকার কালো ছাপ চোখের কোনাঘেষে, মুখ সরু হয়ে গেছে। সারামুখে অসুস্থতার ছাপ। মেয়েটি সন্তানসম্ভবা।

পাগলপারা জোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। এত্তবড় চাঁদ মাঝ আকাশে। ডিমলাইটের হালকা আলো ঠেলে সেই চাঁদ এইঘরে ঢুকতে পারছে না। ঘুমন্ত স্বামীকে পাশে রেখে, মেয়েটি আস্তে আস্তে উঠে গেলো ঝুলবারান্দায়। বড় বড় দালানের এইকোণা, ওইকোণা, ফাঁকফোকর গলে এক টুকরো পুর্নিমা এসে পড়েছে বারান্দায়। হালকা বাতাসে নয়নতারা ফুলের পাতাগুলো দুলছে। দুটো ফুলও আছে গাছের মাথায়। পর্তুলিকাগুলো চুপচাপ। ওদের ফুলতো রাতে গুটিয়ে থাকে। মেয়েটি মাথার চুলগুলো খুলে দিলো। আগেরদিন শ্যাম্পু করেছে। নিজের নরম নরম রেশমি চুলগুলোকে নিজেই আদর করে দিতে ইচ্ছে করছে। চুলের ঘ্রান নাকে আসছে, ভালো লাগছে এই ঘ্রাণ। আজকাল কোনো ঘ্রাণই ভালো লাগে না। ভাতের বলক উঠলে সেই গন্ধে বমি এসে যায়। অবাক ব্যাপার আশেপাশের সব বাড়ির ভাতের গন্ধ ওর নাকে এসে বসে থাকে! ফুলের গন্ধও সহ্য হয় না। তাই নয়নতারা আর পর্তুলিকা বাদে আর সব গাছ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। মেয়েটির মনে হলো কে যেন ফিসফিস করে বলছে ‘চুল খুলে রাখতে নেই, পাগল। চুলের ঘ্রাণে নেশা হয়, জানিস মেয়ে!’ মেয়েটি জানে না। এইকথা আগে কেউ একজন বলেছিলো, কে মনে পড়ছে না। আজকাল মনেও থাকে না কিছু। এখন অগ্রহায়ণ নাকি পৌষ মাস সে হিসাবও নেই। বাড়িগুলোর মাথার উপরে, রাস্তার গাছগুলোতে, ল্যাম্পপোস্ট ঘিরে কুয়াশার কুন্ডলী, ধোঁয়ার মতো জটলা বেঁধে আছে। মেয়েটির পরনে পাতলা কামিজ – ওর শীতগরমের বোধও কমে গেছে। জগতের সকল বোধই ওর কাছে হালকা। গ্রীলের গায়ে হেলান দিয়ে ও চাঁদের আলোয় ভিজছে, হয়তো শিশিরেও। দুহাতে শক্ত করে ধরে আছে লোহার গ্রীল, যেনো খুব বড় কোনো কষ্ট চাপতে চেষ্টা করছে। কেউ যদি খুব কাছের থেকে দেখতো তবে জানতে পারতো, মেয়েটি হালকা হালকা কাঁপছে, মৃদু কাঁপুনির তালে সেই মেয়েটি অল্প অল্প কাঁদছে। রাতের নৈশব্দের মতোই নিঃশব্দ কান্না। চোখের পানি টপ টপ করে পড়ছে আবার চোখেই শুকিয়ে যাচ্ছে। আঙুলের ছোঁয়ায় গড়িয়ে পড়া পানি মুছে নিতেও আলস্য। মেয়েটি এবার পা টিপে টিপে ঘরে আসে। আস্তে করে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা ছেলেটির পাশে বসে। কপালে হাত ছোঁয়ায়। তাতে যেনো ছেলেটার ঘুম আরও গাঢ় হয়ে যায়। একটু নড়েচড়ে পাশ ফিরে আরামে ঘুমায়। শীত এখনো জেঁকে বসেনি, অগ্রহায়ণের শেষ অথবা পৌষের শুরু। কম্বলের নিচে ঘেমে উঠেছে ছেলেটি। কপালজুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। গোলাপি আলোয় স্ফটিকের দানার মতো দেখাচ্ছে। ঘুমন্ত মুখে শান্তি আর স্নিগ্ধতার ছাপ। ঠোঁটের কোণজুড়ে হয়তো হালকা হাসির রেখাও ভাসছে। মেয়েটি এবার আস্তে আস্তে ডাকে ‘এই শুনছো? উঠবে একটু?’ ছেলেটা ধড়ফড় করে উঠে বসে। ‘কি হয়েছে, ঘুম আসছে না? পানি খাবে? ওয়াশরুমে যাবে?’ একরাশ উৎকন্ঠা ছেলেটির কন্ঠ জুড়ে।

মেয়েটার চোখ ছলছল করে ওঠে। এতো কেয়ার করে ছেলেটা ওকে। এতো ভালোবাসে! আর ও কীনা, ঠকাচ্ছে ছেলেটাকে! ছেলেটার হাত ধরে নিজের একটু উঁচু হওয়া পেটে ছোঁয়ায়, তারপর ফিসফিস করে বলে ‘জানো, এই বাচ্চাটার বাবা তুমি নও। এটা অন্য কারো সন্তান!’ ফোঁপাতে থাকে মেয়েটি।

এত ভয়ংকর একটা সংবাদেও ছেলেটার ভিতর কোনো বিকার নেই, উত্তেজনা দেখা যায় না তার আচরণে। সে বরং নির্লিপ্ত গলায় হাই তুলতে তুলতে আস্তে করে বলে ‘আজকে রাতে ওষুধ খাওনি তুমি?’

*****

উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণা, ডাগর চোখ আর পাতলা ঠোঁটের নীচে ডানকোণ ঘেষে লাল রঙের তিল, মাইনাস পাওয়ারের পুরু চশমায় চোখ না ঢাকলে মিষ্টি দেখতে এই মেয়েটির নামও মিষ্টি। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে হাতখোপা করা, আঁচড়ানোর সময় পায়নি, ডানহাতে উচ্চমাধ্যমিক পরিসংখ্যান দ্বিতীয় পত্রের গাইড বই আর বামহাতে একটা বেতের দোলনার সাথে বাঁধা দড়ি। মিষ্টি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে আর দোলনার দড়ি টেনে দোল দিচ্ছে। দোলনায় শুয়ে থাকা পিচ্চিটার বয়স তিন মাস, নাম এখনো ঠিক করা হয়নি। মিষ্টির বোনকে সবাই মিঠি বলে ডাকছে। মিষ্টির সাথে বোনের বয়সের ডিফারেন্স আঠারো বছর। প্রথম প্রথম মিষ্টি খুব লজ্জা পেতো, রাগও হতো মায়ের প্রতি – একে বেশি বয়সের সন্তান তায় মিষ্টির একমাত্র সন্তান পজিশনও হাতছাড়া। কিন্তু একদম প্রথমদিন, পিচ্চিটা যখন বিড়ালছানার মতো ম্যাম্যা করে কেঁদে কেঁদে, তোয়ালের কোণা চুষে নিজের খিদে প্রকাশ করছিলো সেদিন থেকে মিষ্টির পৃথিবীর নাম মিঠি! বড়বোনেরা বুঝি এমনই হয়। বোন থেকে হঠাৎ করেই মা হয়ে যায়। একদম একলাফে! গর্ভকালীন জটিলতা আর বুকের দুধ দেওয়ার অনীহা থেকে মিঠির জন্য খোদা বরাদ্দ আহার বন্ধ হয়ে যায় চল্লিশ দিন না পেরোতেই, তারপর থেকে ও পুরোপুরি মিষ্টির হয়ে গেছে! ওর ফিডার পরিষ্কার করা, পানিতে সেদ্ধ করা, মাপমতো ফর্মুলা আর পানির মিশ্রণ করা মিঠিকে খাওয়ানো, তারপর ঘুম পাড়ানো, সাজিয়ে গুঁজিয়ে কপালে কালো নজরটিকা লাগানো – সবই মিষ্টির কাজ। শুধু গোসলটাই করাতে পারে না, ওর ভয় হয় তাই। এতোটুকু পিচ্চি শরীর, তাকে কীভাবে এক হাতে সুন্দর করে ধরে, প্লাস্টিকের বড় লাল রঙের বোলের ভিতর বসিয়ে আস্তে আস্তে মাথায় পানি ঢালা হয়, মিষ্টি ভাবতেই পারে না। যদি উবু হয়ে মিঠি পানির ভেতর পড়ে যায়, যদি কানে পানি ঢোকে, যদি পিছলে পড়ে যায় হাত থেকে এইসব ভাবনা মনের ভিতর কুটকুট করতে থাকে। মিঠির মুঠোতে আজকাল জোর এসে গেছে, এমন শক্ত করে মিষ্টির চুল মুঠোতে পুরে টানতে থাকে যে মিষ্টির জান যায় অবস্থা কিন্তু ওইটুকু কচি হাত থেকে চুল ছাড়ানোও অনেক শক্ত কাজ। আবার জোরে টান দিতে গেলে কচি আঙুল কেটে যাওয়ার ভয়ও থাকে। ঘুম পাড়াতেও যন্ত্রণা দেয় পিচ্চিটা বড়বোনকে, কাঁধের উপর নিয়ে ঘুম পাড়াতে হবে নইলে দুই পা বিছিয়ে পায়ের উপর শুইয়ে পা নাড়াতে হবে। মিষ্টি যতক্ষণ হাঁটতে থাকে ততক্ষণ ওই দুষ্টুটা ঘুমায় কিন্তু যেই ওকে নামিয়ে বিছানায় দেবে সাথে সাথে জেগে যাবে। যদিবা কোনোভাবে শুইয়ে দেওয়া যায় তো কতক্ষনে মিষ্টি খেতে বসবে সেই অপেক্ষা করে। প্রতিবেলায়ই মিষ্টি প্লেট নিয়ে বসে অর্ধেক খাবার খেতে না খেতেই ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করবে, মিষ্টি হাত ধুয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে আবার খেতে বসতে বসতে সেই ভাত ঠান্ডা হয়ে কড়কড়ে হয়ে যায়। যখন তখন জামাকাপড় ভিজিয়ে মূত্রবিসর্জন তো আছেই পটি করলেও মিষ্টিকেই পরিষ্কার করতে হয়! দারুণ ভালো ছাত্রী হিসেবে সুপরিচিত মিষ্টির পড়াশোনা লাটে উঠেছে, কলেজে কোনোদিন গেলেও বোনকে কে খাওয়াচ্ছে, কে ঘুম পাড়াচ্ছে এই চিন্তায় অস্থির। এককথায় গোছালো, আদুরে, অলস মিষ্টির জীবন পুরো উথাল-পাতাল তাও ওই ছোট্ট মিঠি ওর জান!

বাড়িটার নাম ডেইজি হাউস। যদিও ডেইজি কেন কোনো ফুলেরই বাগান কি একটা টবও খুঁজে পাওয়া যাবে না বাড়িটার কোথাও! একতলা বাড়ি, রেলিঙছাড়া খোলা ছাদ। বাড়ির সামনে সিমেন্ট-খোয়া দিয়ে ঢালাই দেওয়া লন, পানি জমানোর হাউস কিন্তু ঢাকনার অভাবে দুনিয়ার ইট, পাথর, আশেপাশের গাছগুলোর ঝরা পাতা জমা হয়েছে তার ভিতর। গাছগুলো এবাড়ির না। বুকসমান উঁচুপাচিল ঘেরা পাশের বাড়ির। শহর থেকে অদূরে এই আবাসিক এলাকার প্রায় সববাড়িতেই এরকম বুকসমান পাঁচিল দেখতে পাওয়া যায়। কেউ কেউ হয়তো পরে বাড়িয়ে নেয়, ভাঙা কাচ বা লোহার সূঁচালো পেরেক বসিয়ে দেয়, বাদবাকি সবই একইরকম। বাড়ি করতে না পারলেও, সোসাইটিতে জমি কিনলে কোনোরকম হাফবিল্ডিং আর এই পাঁচিল দিতেই হবে। ডেইজি হাউসের সামনের দিকে রাস্তা, পেছনে এইরকম পাঁচিল অলা হাফবিল্ডিং, ডানপাশে চারতলা বাড়ি – ওখানে একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল আর বামপাশের পাঁচিলের ওইপাশে সামনে পেছনে লম্বা লম্বা গাছে ঘেরা দেওয়ান মঞ্জিল। দেওয়ান মঞ্জিলেও সব মেয়েরা। লিপি, পপি, পলি, মিলি চারবোন ওরা। লিপি মাস্টার্স পড়ছে, ওকে নিয়ে দারুণ একটা গল্প আছে। লিপি যখন এস এস সি দেবে, মাসখানেক বা তার একটু বেশি বাকি আছে, ওদের বাবা হজ্বে গেলে বাড়িতে শুধু মেয়েরা। এমনসময় এক সন্ধ্যায় বাড়িতে ডাকাত পড়ে। ডাকাতরা সোনা,গয়না, নগদ টাকা তো নেয়ই সাথে সম্মানটাও লুট করে নিয়ে যায় যেন! দেওয়ান মঞ্জিলের মেয়েদের নিয়ে বাইরে মুখরোচক গল্প শুরু হয়ে যায়, বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রচন্ড জেদ আর অভিমান থেকে সাধারণ মানের ছাত্রি লিপি পড়াশোনায় কোমর বেঁধে লাগে আর মাত্র একমাসের কঠিন পরিশ্রম শেষে তাক লাগানো রেজাল্ট আসে, জেলাফার্স্ট হয়ে বসে! প্রায়ই দেওয়ান মঞ্জিলের গাছঘেরা বাগানে লিপিকে দেখতে পাওয়া যায় বই হাতে মোড়া নইলে চেয়ারে বসা। মিষ্টির খুব আগ্রহ এই রহস্যমাখা চরিত্রের সাথে কথা বলার কিন্তু লিপির কোন সাড়াই পাওয়া যায় না, সাথে চোখে চোখ পড়লেও কথা বলেনা কখনো। ওর বোনেরা এমন না। পলি ওর এক ইয়ার সিনিয়র, আর মিলি ক্লাস টেনে পড়ে, ওদের সাথে খুব ভাব মিষ্টির। পপি আপুকে খুব একটা দেখা যায় না কিন্তু যখনই দেখা হয় সুন্দর হেসে জিজ্ঞেস করে ‘কী খবর মিষ্টি মেয়ে?’ আসলে তো ওরা বোনেরা সবাই এক একটা মিষ্টির ডিব্বা, ডানাকাটা পরীর মতো রূপসী!
মিঠিও মনে হয় এরকমই সুন্দর হবে, মিষ্টি মনে মনে ভাবে, কি সুন্দর পানপাতার মতো মুখ! মনোযোগ অন্যদিকে চলে গেছে, বারবার মন শুধু এদিক ওদিক দুনিয়াদারি ঘুরতে থাকে- কত লাল-নীল চিন্তা যে মাথার ভেতর কুটকুট করে, এত চিন্তার বাড়ি কই? যদি লিপি আপার সিস্টেমটা জানা যেতো, একমাসেই কীভাবে পড়ে স্টান্ড করেছিলো জানা যেতো তবে ওর আর কোন ঝামেলাই ছিলো না। এলোমেলো ভাবনার জগৎ থেকে মনটাকে কষে ধরে নিয়ে এসে বইয়ের পাতায় মন দেয় আবার ‘কোন একটি ঘটনা ঘটবে কি না ঘটবে, এর গাতিতিক পরিমাপকেই বলা হয় সম্ভাবনা । অন্যভাবে বলা যায়, কোন ঘটনার মোট সম্ভাব্য ফলাফলের সাথে এর অনুকূল ফলাফলের অনুপাতই হল সম্ভাবনার গাণিতিক পরিমাপ’ – গুণগুণ করে পড়তে থাকে ও, মুখস্থ করতে থাকে। এমনসময় টুং করে ডোরবেল বাজে আর মিঠি কেঁপে উঠে চারহাতপা দিয়ে লাফিয়ে উঠে কেঁদে দেয়। মিষ্টি তাড়াতাড়ি বোনকে কোলে নেয় আর বেল বাজানো লোকের মুন্ডুপাত করতে থাকে মনে মনে। মিঠির কান্না থামছে না, ওদিকে বেলও বাজছে সমানে। কে বাবা- ভদ্রতাটুকুও জানে না! মিষ্টি গজগজ করতে করতে পিপহোলে চোখ রাখে। দুটো মুখ দেখা যাচ্ছে, দুটো ছেলে- ও চিনতে পারে না। দুজনেরই পিঠের দিক থেকে ব্যাকপ্যাক উঁকি মারছে। মিষ্টি জিজ্ঞেস করে ‘কে?’
‘এটা কি জাফরিন খালার বাসা? আমি প্রিন্স।’ বাইরে থেকে একজন জবাব দিলো। মিষ্টির মায়ের নাম জাফরিন।
কে বাবা এই প্রিন্স, ফ্রিন্স- কোনদিন দেখিওনি, নামও শুনিনি, চিনিও তো না। ডাকাত না তো আবার? এই ভরদুপুরে কেউ কি আসে কারও বাসায়? ভাবতে ভাবতে দরজা না খোলার সিদ্ধান্তই নিলো ও। বোনকে কোলে নিয়ে মায়ের ঘরে এলো। দুপুরের খাওয়ার পর একটা ভাতঘুমের অভ্যাস জাফরিনের বরাবর, সে দশমিনিটের জন্য হলেও। এইটুকু না হলে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকে একদম। মিষ্টি আস্তে আস্তে ভয়ে ভয়ে মায়ের কাছে এসে মাকে ডাকলো। কেউ একজন এসেছে বলতেই জাফরিন ধড়মড়িয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলেই চিৎকার করে উঠলেন খুশিতে ‘ওরে আল্লাহ, আমার আব্বা নাকি!’ মিষ্টির ভুরু কুঁচকে কপালে উঠে। ওর নানাতো কবেই মারা গেছে, মায়ের এই নতুন আব্বা আসলো কোথা থেকে!
আগন্তুক এই ছেলেটা ঘরে ঢুকেই স্লিফ গুটাতে থাকে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে হুমকির স্বরে বলে ওঠে ‘খালা, এখানে কে বলে চলে গেলো কে? ডাকো তারে।সে কি আমাকে চোর-ডাকাত ভেবেছে? তোমার মেয়ে মিষ্টি ওইটা? মাইর আজকে একটাও মাটিতে পড়বেনা।’
মিষ্টি ওর যত স্মৃতি আছে সবকিছু আঁতিপাঁতি করে খুঁজতে থাকে আর ভাবতে থাকে কে এই ছেলে? জাফরিনের গলা শোনা গেলো ‘ওরে আব্বা, ওকি তোমাদের কাউকে চেনে নাকি! কত ছোট থাকতে দেখেছে, আর কত বড় হয়ে গেছো তুমি। সাবিহা আপা ভালো আছে? তোমার আব্বা, সে কেমন আছে? এভাবে খবর না দিয়ে কেউ আসে?’
আচ্ছা,সাবিহা খালার ছেলে এই পটকা! সাবিহা খালাকে ভালো করেই চেনা আছে ওর। কথায় কথায় মুখখারাপ করে আর নিজের কত টাকা আছে, কত বড়লোক সেই দম্ভ করে। মিষ্টির কাছে বিরক্তিকর মনে হলেও টাকাওয়ালা হওয়ার কারণে নানাবাড়ির সবাই ওই মহিলাকে তোয়াজ করে চলে। মায়ের খালাতো বোন হয় এই সাবিহা খালা। তার ছেলে এই ভোম্বল! ‘কথা পরে আগে তোমার মেয়েকে ডাকো, ওকে না মেরে আমি তোমার ঘরে ঢুকবো না। আমি ডাকাত! আগে এসে বলুক সামনে।’ মিষ্টি ভয়ে ভয়ে পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলো। শ্যামলা গায়ের রঙ, হাইট কম- পাঁচ ফিট পাঁচ/ছয় হবে, ব্লু ফেড জিন্স, ডিপ ব্রাউন কালারের ওভারসাইজ ফুলস্লিভ লংশার্ট, শার্ট এত লম্বা যে হাঁটু পর্যন্ত ঢেকে গেছে। মুখে হালকা গোঁফের রেখা, গোলগাল মুখে হালকাপাতলা গড়নের ছেলে।
‘বলে কি এই ছেলে’ মনে মনে আঁতকে উঠে ভেতরের ঘরে চলে গেলো মিষ্টি। আপাতত ভেতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকতে হবে, কিছুতেই এই নমুনাদের সামনে আসা যাবে না। কাভি নেহি!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here