#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৫
ইমা আমতা আমতা করে বললো, কী কথা বলুন ?
আরমান আশেপাশে তাকিয়ে বললো, এখানে না সামনের কফিশপে বসে বলি।
ইমা রিকুর দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কী করবে। রিকু একটু চিন্তা করে যাওয়ার ইশারা করলো।
ঠিক আছে ইমা তুই তাহলে যা, আমিও বাসায় যাচ্ছি ফোনে কথা হবে।
ইমা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালে রিকু একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পড়লো। আরমান আগে আগে গেলো আর ইমা তার পিছনে গিয়ে সামনের কফিশপে ঢুকলো। একদম কর্ণারের একটা টেবিলে চলে গেলো আরমান। ইমাকে বসার জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো।
আরমান ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, কী খাবি বল ?
ইমা দৃষ্টি নিচে রেখে বললো, আমি কিছু খাবো না। যা বলার তাড়াতাড়ি বলুন আমাকে বাসায় যেতে হবে। উনি জানতে পারলে রাগ করবেন।
ইমার কথা শুনে আরমান মাথা নিচু করে মুচকি হাঁসলো আর হাসিটা বজায় রেখে বললো, ইমা ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকাটা জরুরি।
ইমা কিছু বললো না আরমান একটু থেমে বললো, তুই ভালো আছিস তো ?
ইমা এবার চোখ তুলে তাকালো আরমানের দিকে আর চোখে চোখ রেখে বললো, যতটা খারাপ দেখতে চেয়েছিলেন তার থেকে হাজার কোটি গুণ ভালো আছি ভাইয়া।
আরমান মুখটা মলিন করে বললো, আমি তোকে খারাপ থাকতে দেখতে চাইনি রে কখনো।
ইমা এবার কঠিন গলায় বললো, তার জন্যই বুঝি আমার জীবনটা তিক্ত করে তুলেছিলেন ?
আরমান দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, যা করেছিলাম তার শাস্তি এখন প্রতিটা মুহূর্তে পাচ্ছি।
ইমা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো আরমানের কথা শুনে আর বললো, আপনি আজ যেসব বলছেন না ? একে বলে জুতো মেরে গরু দান।
আরমান মাথা নিচু করে বললো, আজ আমি তোর কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি ইমা। আমাকে মাফ করে দে।
এই কথা শোনার পর ইমার চোখ আপনাআপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে গেলো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কানকে। মিস্টার আরমান মাহমুদ তার কাছে মাফ চাইছে ? যে কিনা কখনো তার সাথে ভালো করে দুটো কথা পর্যন্ত বলেনি। ইমা অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে।
আরমান আবার বললো, আমি জানি তোর সাথে একটা দুটো দিন নয়, বেশ অনেকগুলো বছর আমি অন্যায় করে গেছি দিনের পর দিন। কিন্তু বিশ্বাস কর, তুই যেদিন থেকে ঐ বাড়ি ছেড়ে এসেছিল তারপর একটা রাত আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারিনি। প্রত্যেকটা মুহূর্ত অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছি।
ইমা হা করে তাকিয়ে দেখলো আরমানের দিকে। এখন সে যেটা করছে এটা সম্পূর্ণ তার স্বভাবের বাইরে। ইমা কোনটা ঠিক কোনটা ভুল বুঝতে পারছে না।
আরমান খপ করে টেবিলের উপর রাখা ইমার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো আর ধরা গলায় বললো, ইমা আমাকে মাফ করে দে। আমি আর এভাবে বাঁচতে পারছি না। দিনদিন অনুশোচনার পরিমাণ বেড়ে চলেছে। এখন আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে দিন দিন ।
ইমা হতবুদ্ধি হয়ে বসে আছে। একবার আরমানের ধরা হাতের দিকে তাকাচ্ছে তো একবার আরমানের চোখের দিকে তাকাচ্ছে। আরমানের চোখ দুটো টলমল করছে পানিতে, এখনই বৃষ্টি নামবে মনে হচ্ছে। আরমানের চোখের ভাষা বলছে সে মিথ্যা বলছে না। কারণ মানুষের মুখের ভাষা মিথ্যা হলেও চোখের ভাষায় কখনো মিথ্যা হয় না। ইমা এবার এক দৃষ্টিতে তাকালো আরমানের ধরা হাতের দিকে। আরমান সেটা খেয়াল করে ফট করে ইমার হাত ছেড়ে দিলো।
অপরাধীর স্বরে বললো, সরি রে ভুলে গিয়েছিলাম তুই এখন আর আমাদের আগের সেই ইমা নেই। তুই এখন অন্যকারো অধিকার।
ইমা কী বলবে বুঝতে পারছে না। আরমানের এমন আচরণে সে নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
ইমা হঠাৎ বললো, আচ্ছা ভাইয়া আপনি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন ?
আরমান ব্যস্ত গলায় বললো, হ্যাঁ বল।
ইমা আরমানের চোখে চোখ রেখে বললো, আপনার এতো ক্ষোভ কেনো ছিলো আমার প্রতি ? ভার্সিটির সবার সামনে রিজেক্ট করেছিলাম বলে ? আপনি সত্যি করে বলুন তো সেদিন আপনার মনে কোনোরকম অনুভূতি ছিলো আমার জন্য ? আপনাকে ফ্রেন্ডদের সাথে বাজি ধরতে দেখেছিলো আমার ফ্রেন্ড রিকু আর আমাকে আগেই বলে দিয়েছিলো। আমিও দেখেছিলাম আপনার চোখে, আমার জন্য কোনো অনুভূতি ছিলো না। তাহলে রিজেক্ট করে কী ভুল করেছিলাম বলতে পারেন ?
আরমান মলিন চোখে তাকিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে বললো, সেদিনের চোখের ভাষা এতো সহজে বুঝে গিয়েছিলি, তবে আজকের চোখের ভাষা কেনো বুঝলি না ইমা ?
ইমা চমকে উঠলো আরমানের কথা শুনে। কী ছিলো আরমানের ছোট একটা কথায় ইমা জানে না। তবে তার ভেতর নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। ইমা তাকালো আরমানের চোখে কিন্তু আরমান চোখ সরিয়ে নিলো।
ইমা কাঁপা গলায় বললো, মানে ?
আরমান নিজের দৃষ্টি আড়াল করেই বললো, ভালোবাসার মানুষের চোখে নিজের জন্য ঘৃণা দেখার মতো কষ্ট হয়তো এই পৃথিবীর সব কষ্টকে হার মানিয়ে দেবে। আমি আর পারছি না তোর চোখে ঘৃণিত অপরাধী হয়ে থাকতে।
ইমার কথা গলায় আঁটকে গেছে। বেশ অনেকটা সময় লাগলো তার, আরমানের কথা বুঝতে। যখন বুঝতে পারলো তখন কথা বলতে ভুলে গেছে৷ ইমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। আরমান তাকে ভালোবাসে এটা ইমা কল্পনাও করেনি কোনোদিন। তার জন্যই বুঝি আরমানের চোখের ভাষা আজ বড্ড অচেনা লাগছিলো ইমার কাছে।
আরমান মাথা নিচু করে বললো, সামনের সপ্তাহে আমি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি। একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব হয়েছে আমার। সেটার জন্যই অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি আর কবে দেশে ফিরবো বা আদৌও কোনোদিন ফিরবো কিনা জানি না। তাই শেষবারের মতো তোর কাছে নিজের অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে এসেছি।
ইমা একটার পর একটা শক খাচ্ছে। আরমান চলে যাচ্ছে সেটা শুনে আরও বেশি অবাক হলো। কারণ নিজের দেশকে আরমান খুব ভালোবাসে। স্টুডেন্ট ভালো হওয়ায় স্কলারশিপ পেয়েও যায়নি শুধু নিজের দেশ আর আপন মানুষদের থেকে দূরে যাবে না বলে। সবার সাথে জোশে পরে স্কলারশিপে ট্রাই করেছিলো তবে অনেক জোর করেও তাকে পাঠাতে পারেনি আমিনুল মাহমুদ। সেই আরমান কিনা চিরদিনের জন্য চলে যেতে চাইছে এই দেশ ছেড়ে।
ইমা ভাঙা গলায় বললো, আপনি তো বিদেশ যাওয়া পছন্দ করতেন না।
আরমান তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো, জীবনে পছন্দের জিনিসগুলো একসময় হারিয়ে যায় আর অপছন্দের জিনিসগুলো মাঝে মাঝে প্রিয় হয়ে উঠে। তোর হয়তো লেট হচ্ছে তুই চলে যা। তোর কাছে ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হয়তো আমি নই। সারাজীবন তোর চোখে অপরাধী হয়ে থাকতে হবে। তবে বিশ্বাস কর আমি সত্যি অনুতপ্ত।
ইমা চুপ করে কিছুটা সময় বসে রইলো। আরমানও চুপ করে আছে। হঠাৎ একটা জোরা কানের দুল আরমান এগিয়ে দিলো ইমার দিকে। তা দেখে ইমা বিস্ফুরিত চোখে তাকালো আরমানের দিকে। কানের দুল জোড়া চিনতে অসুবিধা হয়নি তার। আজ থেকে প্রায় আরো পাঁচ বছর আগে ইমা আর কথাকে নিয়ে এক বৈশাখী মেলায় গিয়েছিলো আরমান। তখন আরমানের সাথে ইমার কোনো ঝামেলা ছিলো না। সেখানে ইমার পছন্দ হয়েছিলে এই কানের দুল জোড়া। আরমানকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলো কিনে দেওয়ার কিন্তু আরমান তখন বলেছিলো তোর জন্য বাজে খরচ করার টাকা নেই আমার। ইমা মন খারাপ করে আর কিছু বলেনি। আজ পাঁচ বছর পর সেই কানের দুল ইমার সামনে।
আরমান কানের দুল জোড়ার দিকে তাকিয়ে বললো, যদি মাফ করে থাকিস দুল জোড়া নিয়ে চলে যা। আর যদি না করে থাকিস তাহলে একবারের জন্যেও পিছনে ফিরে না তাকিয়ে চলে যা, ভুলেও পিছনে ফিরে তাকাবি না।
ইমা আরমানের দিকে একবার অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের সামনে রাখা কানের দুল জোড়া হাতে নিয়ে নিঃশব্দে পেছনে ফিরে বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সেদিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো আরমান। আরমানের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, পানিটুকু মুছে সামনে তাকিয়ে দেখে ইমাকে আর দেখা যাচ্ছে না। আরমানের ভেতরের কান্নাটা দলা পাকিয়ে বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজের করা কিছু কাজের উত্তর সে নিজেই খুঁজে পায় না। যেমন সেদিন ওদের চোখের আড়ালে দুল জোড়া সে কেনো কিনেছিলো আজও তার উত্তর আরমান পাইনি। আবার যখন কিনেই ছিলো তাহলে ইমাকে না দিয়ে পাঁচ পাঁচটা বছর নিজের কাছে কেনো রেখে দিয়েছিলো। এখন আর এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতেও চায় না সে। পেলে হয়তো বুকের ভেতরের ক্ষতটা আরো গভীর হবে। আরমান এক কাপ কফি অর্ডার করে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
৫১.
তোমার না সামনে এক্সাম এখন পড়াশোনা বাদ দিয়ে এভাবে ঘুরলে পরিক্ষায় বড় একটা রাজহাঁসের ডিম পাবে তুমি।
কথা ভ্রু কুঁচকে তাকায় ইশানের দিকে। ইশানের কথার মানে বুঝার চেষ্টা করছে সে। ইশান কী তাকে ‘হ য ব র ল’ টাইপের স্টুডেন্ট মনে করে ?
কথা চটে গিয়ে বললো, এই আপনি কী কোনো ভাবেন আমাকে। ‘হ য ব র ল’ টাইপের স্টুডেন্ট মনে করেন নাকি ?
ইশান দুষ্টুমি করে বলে উঠলো, আরে আমি তো জানি তুমি নিউটনেরও নানী।
কথা রেগে ইশানকে মারতে শুরু করলো। বেশ জমে গেছে ইশান আর কথার দুষ্টু মিষ্টি প্রেম।
ইশান আবার দুষ্টুমি করে বললো, আরে খুকি তুমি খেয়ে দেয়ে একটু শক্তি বানিয়ে এসো। তাহলে বুঝতে পারবো তুমি আমাকে মারছো নাকি কাতুকুতু দিচ্ছো।
কথা এবার দিগুণ রেগে বললো, এই এই আমাকে আপনার কোনদিক থেকে খুকি মনে হয় ?
ইশান কথার দিকে বিজ্ঞের মতো তাকিয়ে বললো, তোমার বয়স কত এখন ?
কথা বেশ অ্যাটিটিউড নিয়ে বললো, ১৭ বছর ৭ মাস ১৩ দিন।
ইশান অট্টহাসি দিয়ে বললো, এখনো ১৮ বছর হয়নি সে নাকি আবার খুকি না।
কথা রেগে ইশানের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বললো, ঠিক আছে আমি তো খুকি। আপনি বড় বড় মেয়ে খুঁজে তাদের সাথে প্রেম করুন।
ইশান উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, আরে আমি তো একটু মজা করছিলাম। আমার কোনো বড় মেয়ে দরকার নেই। আমার কাছে এই খুকি হাজার গুন ভালো।
আপনি এখনই,,,,,
এই ইয়ার, মেয়েটাকে দেখ কতো কালো আর বয়ফেন্ডটাকে দেখ একদম হলিউড হিরো। কী পছন্দ রে ভাই ?এই ছেলে এই মেয়েকে কীভাবে পছন্দ করলো, আনবিলিভ্যাবল।
ঠিক বলেছিস, কী কালার রে ইয়ার ?
কথা কিছু বলবে তার আগেই পাশের একটা পাঁচ জনের মেয়ে গ্রুপ থেকে বলা এই কথাগুলো দুজনের কানে এলো। কথা ইশানের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে চলে আসতে গেলে ইশান হাত টেনে ধরে। কথা তাকিয়ে দেখে এতোক্ষণ দুষ্টুমি করা হাসিখুশি মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। ইশান কথার হাত ধরে মেয়েগুলোর সামনে নিয়ে গেলো।
ইশান রেগে বললো, কী বললেন আপনি,,,,,
কথা ইশানকে চুপ করতে বলে কথা বলে উঠলো, কী কালার আমার ? আফ্রিকার এক পিচ্চির লেখা একটা কবিতা আছে। ২০০৫ এর শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে নমিনেট করা হয়েছিলো। কবিতাটা সম্পর্কে আপনারা কেউ জানেন ?
কবিতার নাম
কালার (Color)
যখন আমি জন্ম নিলাম, আমি কালো
যখন আমি বেড়ে উঠলাম, আমি কালো।
যখন আমি সূর্যের তাপে অবস্থান করি,
আমি কালো; যখন আমি অসুস্থ, আমি কালো।
যখন আমি মৃত, আমি কালো।
আর তুমি সাদা সহচর,
যখন জন্ম নাও, তুমি গোলাপি।
যখন বেড়ে উঠ, তুমি সাদা।
যখন তুমি সূর্যের তাপে অবস্থান করো, তুমি লাল।
যখন তুমি শীতল আবহাওয়া তে থাকো, তুমি নীল।
যখন তুমি ভীত, তুমি হলুদ।
যখন তুমি অসুস্থ, তুমি সবুজ।
আর যখন তুমি মৃত, তুমি ধূসর।
আর তুমি কিনা আমাকে বল কালারড। (Colored)
এই কবিতাটার মানে যেদিন বুঝতে পারবেন সেদিন আমার মতো কাউকে কালারড বলার আগে নিজেই লজ্জা পাবেন।
কথাগুলো বলে ইশানের হাত ধরে সেখান থেকে চলে এলো কথা। ইশান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কথার দিকে।
কথা সেটা খেয়াল করে বললো, এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো ? আর দশটা কালো মেয়ের মতো আমি নিজের অপমান মুখ বুজে সহ্য করি না। মুখের উপর বরাবর জবাব দিতে জানি। প্রথমে মনে হয়েছিলো আপনি লজ্জা পাবেন, তাদের আমাকে নিয়ে মজা করা দেখে। কিন্তু যখন বুঝলাম আপনি আমার সাথে আছেন আর তখন নিজের আসল রুপে ফিরে এলাম।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, আজ আবার তোমার প্রেমে পড়লাম নতুন করে।
কথা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আর ইশান জিজ্ঞেস করলো, এই কবিতাটা কোথা থেকে জানলে ?
কথা একটু চিন্তা করে বললো, কোথায় যেনো পড়েছিলাম এখন মনে নেই।
ইশান ওহ্ বলে কথার হাত ধরে হাঁটতে লাগলো আর কথা মুগ্ধ হয়ে ইশানকে দেখছে। সত্যি ইশান কোনো হলিউড হিরোর থেকে কম যায় না।
কথা মনে মনে বললো, সত্যি আপনার সাথে আমাকে মানায় না।
ইশান কথাকে অবাক করে দিয়ে বললো, বাজে চিন্তা মাথায় আনলে মাথা কেটে সব বের করে ডিটারজেন্ট পাউডার দিয়ে ওয়াশিং মেশিনে দিয়ে দিবো বলে দিলাম।
কথা ইশানের বাহুতে ছোট একটা থাপ্পড় দিয়ে সামনের তাকালো।
৫২.
ইমা একটা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসলো। কফিশপের কাঁচের দেয়ালের ওপারে এখনো দেখা যাচ্ছে আরমানকে। যতক্ষণ দেখা গেলো ততক্ষণ ইমা সেদিকে তাকিয়ে থাকলো। ইমার কিশোরী মন প্রথম ভালো লাগার মানে বুঝেছিলো আরমানকে দিয়ে। কিন্তু সেই ভালোলাগা ভালোবাসায় রুপ নেওয়ার আগেই আরমান নিজের হাতে তা ঘৃণার রুপ দিয়েছে। আজ কেনো জানি ইমার কষ্ট হচ্ছে, চাপা কষ্ট যার মানে ইমা নিজেই বুঝতে পারছে না। আরমানকে সে কতটা মাফ করতে পেরেছে সেটাও বুঝতে পারছে না। ট্যাক্সি ড্রাইভারের ডাকে ঘোর কাটে ইমার।
ম্যাম চলে এসেছি নামুন।
ইমা হকচকিয়ে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো বাড়ির গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ইমা দ্রুত নেমে এলো ট্যাক্সি থেকে। ভাড়া মিটিয়ে গেইটের ভেতরে যেতেই ইয়াদের গাড়ি থেকে চমকে গেলো। ইয়াদ তো এই সময় বাসায় আসার কথা নয় আজ, তাহলে ? ইমা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে গিয়ে কলিংবেল বাজালে সার্ভেন্ট দরজা খোলে দিলো।
আপনার স্যার এসেছে ?
জী ম্যাম, তবে দেখে কেমন গম্ভীর মনে হলো আজ।
ঠিক আছে আপনি নিজের কাজ করুন।
সার্ভেন্ট ওকে ম্যাম বলে নিজের কাজে চলে গেলো। ইমা ভাবছে ইয়াদের আবার হঠাৎ কী হলো ? ধীর পায়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। একটা একটা সিড়ি উঠছে আর অজানা কারণে ইমার ভয় বাড়ছে। দরজার সামনে এসে একটু ধাক্কা দিতেই দরজা খোলে গেলো। ইয়াদ অফিসের পোশাকে বেডের উপর শুয়ে আছে কপালে হাত রেখে। ইমা হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে ইয়াদের কাছে গিয়ে বসে মাথার চুলে হাত রাখলো। ইয়াদ কপালের উপর থেকে হাত সরিয়ে ইমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো।
ইমা ব্যস্ত গলায় বললো, আপনি এই সময়ে বাসায় কেনো ? শরীর খারাপ লাগছে আপনার ?
ইয়াদ আবার চোখ বন্ধ করে বললো, এক্সাম শেষ হয়েছে সেই কখন, এতক্ষণ কোথায় ছিলে ?
ইমা থতমত খেয়ে বললো, আপনাকে তো বলেছিলাম রিকুর সাথে আজ অনেকটা সময় আড্ডা দিয়ে তারপর আসবো।
ইয়াদ আগের মতোই শান্ত গলায় বললো, কফিশপে তোমার সামনে যে ছিলো তাকে দেখে কোনো দিক থেকে আমার কাছে রিকু মনে হয়নি।
কথাটা শেষ করে গম্ভীর চোখে তাকালো ইমার দিকে। ইমা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইয়াদের কাজে মন বসছিলো না। তাই ভেবেছিলো ইমাকে বাসায় ড্রপ করে দিবে আর হলের সামনে গিয়েছিলো। ইমা বলেছিলো রিকুর সাথে আড্ডা দিবে তাই ইয়াদ ভাবলো ফুচকা স্টল বা কফিশপেই যাবে। এক্সামের জন্য ইমা ফোন নিয়ে যায়নি তাই ইয়াদ ফুচকা স্টলে না পেয়ে কফিশপে গিয়ে দেখে ইমা কোনো ছেলের সাথে বসে আছে। আর দূর থেকে মনে হচ্ছিলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছে তাই চুপচাপ চলে আসে সেখান থেকে।
ইমা মাথা নিচু করে বললো, ওটা আরমান ভাইয়া ছিলো।
ইয়াদ উঠে বসে ইমার দুগাল ধরে নিজের মুখোমুখি করে বললো, আমি আশা করেছিলাম তুমি নিঃসংকোচে নিজের মনের সব কথা আমাকে বলতে পারবে। আমার ব্যর্থতা, হয়তো তোমার ততটা আস্থা আমি এখনো অর্জন করে উঠতে পারিনি।
কথাটা শেষ করে ইয়াদ বেড থেকে উঠে চলে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইয়াদের। ইয়াদ ঘুরে তাকায় ইমার দিকে।
চলবে,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৬
কথাটা শেষ করে ইয়াদ বেড থেকে উঠে চলে যেতে গেলে ইমা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইয়াদের। ইয়াদ ঘুরে তাকায় ইমার দিকে।
কিছু বলবে ?
ইমা মাথা নিচু করে বললো, হুম অনেক কিছু বলার আছে আপনাকে।
ইমা ইয়াদের হাত ছেড়ে উঠে সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললো, সত্যি বলেছেন আপনি, আপনাকে সব বলতে ভয় পাই আমি। কারণটা কী জানেন, আপনার জীবনে আমার জায়গা কতটা সেটা আজও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি আমি। আমার গুরুত্ব কতটা আদৌও বুঝতে দিয়েছেন আমাকে কখনো ? কখনো বলেছেন আপনি আমাকে আদৌও ভালোবাসেন কিনা ?
ইয়াদ ইমার চোখে চোখ রেখে বললো, সব কিছুই কী বলতে হয় ?
ইমা মলিন গলায় বললো, কিছু কথা মুখে বলতে হয় আর আরমান ভাইয়ার ব্যাপারটা ? উনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না কোনোদিন। মণি আর আরমান ভাইয়া মিলে আমার জীবনটা বিষিয়ে তুলেছিলো।
ইমা একে একে ইয়াদকে সব খোলে বললো। যার বেশীর ভাগ ইয়াদের অজানা ছিলো। ইমা এতোটা সহ্য করেছে জীবনে, ইয়াদ সেটা কখনো ভাবেনি। আরমান তাকে ভালোবাসে এই বিষয়টা ছাড়া বাকি সব ইয়াদকে খোলে বললো ইমা। আরমান দেশ ছেড়ে যাচ্ছে সেটাও বললো।
ইয়াদ নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জিত হলো। ইমা তো ভুল কিছু বলেনি। সে ইমাকে কতটা জানতে চেয়েছে আর নিজেকেই বা কতটা জানতে দিয়েছে ইমাকে। ইমা কথাগুলো বলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।
ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, যে কোনো সম্পর্কে বিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরি, বুঝতে পেরেছেন ?
ইমা ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। ইয়াদ সেদিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ইয়াদ বুঝতে পারছে ভুল তারও আছে৷
৫৩.
ইয়ানা রে তোর হলো ? ছেলেটা না আবার হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেয়।
এই তো মা হয়ে গেছে, এখনই আসছি।
ইয়ানা পিংক কালার একটা শাড়ি পরে, মাথায় হিজাব পরে সিড়ি দিয়ে তাড়াহুড়ো করে নামতে লাগলো।
আরে আরে আস্তে নাম, শাড়ীতে পা বেঁধে পরে যাবি তো আবার।
ইয়ানা কোনোমতে শাশুড়ীর সামনে এসে দাঁড়ালো, রীতিমতো হাঁপাচ্ছে সে।
ইয়ানার শাশুড়ী মুচকি হেঁসে বললো, আমি তোকে রেডি হতে পাঠিয়েছিলাম নাকি যুদ্ধ করতে ?
ইয়ানা গাল ফুলিয়ে বললো, যেভাবে তাড়া দিচ্ছিলে তাতে যুদ্ধই মনে হয়েছে আমার কাছে।
রেহেনা পারভিন ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, এতো কষ্ট করে রান্না করলি। এখন যদি গিয়ে দেখিস রেহান খেয়ে নিয়েছে তাহলে ভালো লাগবে তোর ?
ইয়ানা বড় বড় চোখে তাকিয়ে খানিকটা চিৎকার করে বললো, একদম না।
রেহেনা মুচকি হেঁসে বললো, তাই জন্যই এতো তাড়া দিচ্ছিলাম ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||
ইয়ানা জড়িয়ে ধরলো রেহেনাকে আর গালে কিস করে বললো, ইউ আর দ্যা বেস্ট মম ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।
হয়েছে আর পাম দিতে হবে না এবার কিন্তু সত্যি লেট হয়ে যাচ্ছে তোর।
ইয়ানা ব্যস্ত হয়ে বললো, ওকে ওকে যাচ্ছি।
খাবারের বক্সটা নিয়ে ইয়ানা প্রায় দৌড় লাগালো আর চেঁচিয়ে বললো আল্লাহ হাফেজ মা। রেহেনা পারভিন ইয়ানার কান্ড দেখে মুচকি হাঁসলো। আজ রেহানকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ইয়ানা নিজের হাতে রান্না করেছে। সেটা নিয়েই হসপিটালে যাচ্ছে। তবে সব কিছুতে রেহেনা পারভিন হেল্প করেছে।কোনো মতে রান্না শেষ হতেই ইয়ানাকে পাঠিয়ে দিয়েছে রেডি হতে আর নিজের হাতে সব গুছিয়ে দিয়েছে। রেহেনা আর ইয়ানাকে দেখে শাশুড়ী বৌমা নয় বরং মা মেয়ে মনে করে সবাই। এদিকে রেহান হয়ে গেছে নিজের বাবা-মায়ের কাছে মেয়ের জামাই। যাকে বলে বৌমা হয়ে গেছে মেয়ে আর নিজের ছেলে হয়ে গেছে মেয়ের জামাই। এ নিয়ে রেহান প্রায় ঝগড়া করে নিজের বাবা-মায়ের সাথে আর ইয়ানাকে হিংসা করে। ইয়ানার জীবনে যে বাবা-মায়ের অভাব ছিলো সেটা পূরণ করে দিয়েছে এই দুজন মানুষ। রেহানের বাবা মিস্টার গালিব আহমেদ বাইরে থেকে আসলে সবসময় ইয়ানার জন্য চকলেট, আইসক্রিম, মাঝে মাঝে ফুচকাও নিয়ে আসে। ইয়ানা এখন বুঝতে পারে রেহানকে বিয়ে করে সে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। রেহানের সাথে সে জীবনের সব খুশিও পেয়ে গেছে। আর রেহানও ইয়ানাকে খুব ভালোবাসে। এখন তো ইয়ানার সারাদিনে একবার কেনো, সারা সপ্তাহে একবারও আরমানের কথা মনে পড়ে কিনা ইয়ানা জানে না। তবে একটা জিনিস খুব ভালো বুঝে গেছে। মানুষের অতীতটা তখন বেশি মনে পরে বর্তমানে যখন সে খুশি থাকে না।
ইয়ানা নিজের মনে বিড়বিড় করে বললো, কোথায় একটা পড়েছিলাম জীবনে সঠিক মানুষ পেলে শুধু প্রথম ভালোবাসা কেনো পুরো অতীতটাই ভুলা যায়। আপনাকে পেয়ে তার প্রমাণ আমি নিজেকে দিয়ে পেয়ে গিয়েছি রেহান। এখন তো আপনাকে ছাড়া নিজের একটা মুহূর্ত ভাবতে পারি না আমি। এতোটা সুখ, এতোটা ভালোবাসা সব কিছু উপেক্ষা করে মাঝে মাঝে মনের কোণে কোথাও একটা উঁকি দেয় না পাওয়ার কষ্ট। তবে সেটা বেশি সময় স্থায়ী হতে পারে না আপনার ভালোবাসার সামনে।
ম্যাম,,,
ড্রাইভারের ডাকে ইয়ানার ঘোর কাটলো। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে খাবারের বক্সটা নিয়ে বের হলো গাড়ি থেকে। তারপর সোজা ভেতরে চলে গেলো। হসপিটালটা রেহানদের নিজেদের। রেহানের বাবা হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট বিভাগটা দেখে। ইয়ানা দুজনের খাবারই নিয়ে এসেছে৷ প্রথমে শশুরের কেবিনে চলে গেলো।
আসবো বাবা ?
গালিব আহমেদ চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে ইয়ানাকে দেখে বললো, আরে ইয়ানা মা যে, আয় আয় তোর আবার অনুমতি লাগে নাকি।
ইয়ানা হাসি মুখে কেবিনে ঢুকে গালিবের খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বললো, আপনার খাবার নিয়ে এসেছিলাম বাবা।
গালিব ইয়ানার অন্যহাতে তাকিয়ে বললো, ওটা বুঝি রেহানের খাবার ?
ইয়ানা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বললো, হুম।
তাড়াতাড়ি নিয়ে যা, পেটুকটা না আবার ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নেয়।
ইয়ানা ব্যস্ত গলায় বললো, ঠিক আছে বাবা আপনি খান আমি আসছি।
গালিব হেঁসে বললো, হ্যাঁ যা যা।
ইয়ানা তাড়াতাড়ি রেহানের কেবিনে গিয়ে দেখে পুরো ফাঁকা। খাবারটা রেখে বাইরে এসে নার্সকে জিজ্ঞেস করে রেহান কোথায়। নার্স জানায় রেহান একটা আইসিইউ পেশেন্ট দেখতে গেছে, এখনই চলে আসবে। ইয়ানা আবার চুপচাপ কেবিনে গিয়ে সোফায় বসে পড়লো। একটু পর দরজা খোলার শব্দে সামনে তাকিয়ে দেখে রেহান ঢুকলো, গায়ে সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো আর চোখে চশমা। এই লুকে রেহানকে আরো বেশী হ্যান্ডসাম লাগে ইয়ানার কাছে।
রেহান ইয়ানাকে দেখে সারপ্রাইজড হয়ে বললো, আরে আমার ইয়াবা যে ||লেখনীতে তাহমিনা তমা||
ইয়ানা চোখ বড় বড় করে বললো, আবার ইয়াবা ?
রেহান এপ্রোন খুলতে খুলতে বললো, আরে মানুষ ইয়াবা দিয়ে নেশা করে আর আমার তোমাকে দেখেই নেশা হয়ে যায়। নামটাও সেইম সেইম ইয়ানা আর ইয়াবা। তাই আমার জন্য তোমার নামটা ইয়াবাই পার্ফেক্ট।
ইয়ানা উঠে দাঁড়িয়ে খাবার সার্ভ করতে করতে বললো, সবসময় এতো ফানি মুড কোথায় পান বলুন তো ?
রেহান ইয়ানাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে দেখলেই আমার মুখে অটোমেটিক হাসি ফোটে উঠে।
ইয়ানা রেহানের হাত আলগা করে পেছনে ঘুরে রেহানের কাঁধের উপর দিয়ে হাত রেখে বললো, আমাকে দেখলে আপনার আর কী কী হয় ?
রেহান দুষ্টুমি করে বললো, তোমাকে দেখলে তো আমার অনেক কিছু হয় তার মধ্যে,,
থামুন আর বলতে হবে না এবার গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন।
ইয়ানা এক প্রকার ঠেলে রেহানকে ওয়াশরুমে ঠুকিয়ে দিলো আর মুচকি হেঁসে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। রেহান ফ্রেশ হয়ে এসে টেবিলে নিজের পছন্দের খাবার দেখে চটপট বসে এক লোকমা মুখে পুড়ে দিলো। ইয়ানা অধিক আগ্রহে তাকিয়ে আছে রেহানের দিকে খাবার কেমন হয়েছে জানার জন্য।
রেহান একটু সময় নিয়ে বললো, খাবারের টেস্টটা কেমন অন্যরকম লাগছে আজ।
ইয়ানা চিন্তিত হয়ে বললো, কেনো ভালো হয়নি ?
রেহান আবার মুখে দিয়ে বললো, আরে অনেক ভালো হয়েছে কিন্তু টেস্টটা ভিন্ন।
ইয়ানা ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো, সত্যি ভালো হয়েছে তো ?
রেহান খাবার খেতে খেতে বললো, সত্যি বলছি রে বাবা, অনেক টেস্টি হয়েছে।
ইয়ানা মাথা নিচু করে মুচকি হেঁসে বললো, আজ সব রান্না আমি করেছি।
রেহান চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, হোয়াট তুমি রান্না করেছো, তুমি এতো ভালো রান্না করতে পারো তাহলে এতদিন কেনো রান্না করে খাওয়ালে না কেনো ?
এতদিন মায়ের কাছে রান্না শিখেছি ভালো করে।
এবার থেকে কিন্তু মাঝে মাঝে রান্না করে খাওয়াতে হবে বলে দিলাম।
ইয়ানা মুচকি হেঁসে বললো, ওকে।
রেহান দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, এই যা নিজের পছন্দের সব খাবার দেখে তোমাকে খাবারের কথা জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছি, সরি ডিয়ার। তুমি লান্স করেছো ?
ইয়ানা মাথা নিচু করে বললো, না আপনি করে নিন আমি পরে করবো।
রেহান ব্যস্ত গলায় বললো, তিনটা বাজতে চললো তুমি এখনো লান্স করোনি আবার বলছো পরে করবে ?
রেহান বা হাতে ইয়ানাকে টেনে নিজের কোলে বসিয়ে দিলো আর এক লোকমা খাবার মুখের সামনে ধরে বললো, নাও হা করো।
ইয়ানা বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললো, এভাবে ?
রেহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে উঠে, এভাবে আমার কোনো প্রবলেম হচ্ছে না, তোমার কী প্রবলেম ?
ইয়ানা আর কিছু বললো না খাবারটা মুখে নিলো। সত্যি ভালো হয়েছে খাবার, ইয়ানা এতোটা ভালো আশা করেনি৷ পরে বুঝতে পারলো রেহেনা পারভিন তাকে হেল্প করেছে বলেই এতোটা ভালো করতে পেরেছে। ইয়ানাকে কোলে বসিয়ে খেতে রেহানের বেশ অসুবিধা হচ্ছিলো দেখে ইয়ানা উঠে আসতে চায় কিন্তু রেহান জোর করে বসিয়ে রাখে। এভাবেই বাকি খাবারটা শেষ করে দুজনে।
৫৪.
তুই অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছিস আমাদের একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেছিস ?
আমিনুল মাহমুদ গম্ভীর গলায় কথাটা বলে আরমানের দিকে তাকালো। ড্রয়িংরুমে পুরো পরিবার থমথমে মুখ করে বসে আছে আরমানের কথা শুনে। কথা তো বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে।
ছাহেরা বেগম কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, স্কলারশিপ পাওয়ার পর তোর বাবা জোর করে পাঠাতে পারলো না। তাহলে এখন কেনো যেতে চাইছিস তুই ?
আরমান শান্ত গলায় বললো, এর উত্তরটা আমার থেকে ভালো, তুমি জানো মা।
ছাহেরা অবাক হয়ে বললো, আমি জানি মানে ?
আরমান এবার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তোমাদের জানানো প্রয়োজন ছিলো জানালাম। আমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। সামনের সপ্তাহে আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।
আরমান হনহনিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো। আমিনুল মাহমুদ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন, ছাহেরা বেগম আঁচলে মুখ গুজে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলো আর কথা আরমানের পিছন পিছন গেলো। ছাহেরা বেগম হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সে নিজের হাতে নিজেরই সাজানো সংসার ধ্বংস করে দিয়েছে। ইমা এ বাড়ি থেকে যাওয়ার পর তাদের জীবনে শুধু খারাপই হচ্ছে।
কার থেকে পালাতে চাইছো ভাইয়া ?
আরমান বেডে বসে ছিলো মাথা নিচু করে, হঠাৎ কথার আওয়াজ শুনে মুখ তুলে তাকালো। আরমানের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে, তবে রাগে নয় চাপা কষ্টে। তারও ভালো লাগছে না সবাইকে ছেড়ে যেতে, আবার এখানে থাকতেও দম বন্ধ হয়ে আসছে দিন দিন।
আরমান আবার মাথা নিচু করে বললো, কী বলছিস এসব ? ||লেখনীতে তাহমিনা তমা ||
কথা আরমনের সামনে ফ্লোরে বসে বললো, তোমার কী হয়েছে ভাইয়া, আমাকে বলবে না ?
আরমান শান্ত গলায় বললো, কী হবে কিছু না।
আমি জানি এমনই এমনই তুমি চলে যেতে চাইছো না।
ইশানকে ভালোবাসিস ?
আরমানের মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে কথার বুক কেঁপে উঠলো, ভয়ে বুক ধড়ফড় করছে।
আরমান কথার দিকে তাকিয়ে বললো, ভালোবাসা জিনিসটা খুব অদ্ভুত। যখন আমাদের কাছে থাকে আমরা তার গুরুত্ব দেই না কিন্তু যখন হারিয়ে ফেলি তখন জীবন মূল্যহীন মনে হয়। ইশান ভালো ছেলে, কখনো তোকে কষ্ট দিবে না। শুধু হারিয়ে যেতে দিস না, আগলে রাখিস। বড় ভাই হয়ে এসব বলছি বলে অবাক হচ্ছিস ? জীবনে অভিজ্ঞতা খুব মারাত্মক একটা জিনিস রে কথা, অনেক কিছু শিখিয়ে যায়। আমার মাথা ধরেছে তুই এখন যা।
আরমানের কথার মানেগুলো বুঝতে পারলো না, তবে ইশানের কথা জানার পরও কোনো রিয়াক্ট করলো না দেখে কথা বেশ অবাক হলো। আরমান বলতেই তার রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
৫৫.
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গেলো। ইমা প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না ইয়াদের সাথে আর ইয়াদও ইমার রাগ ভাঙায়নি। ইয়াদ এমন একটা ভাব নিয়ে আছে ইমা তার সাথে কথা বলা না বলায় তার কিছু আসে যায় না। এসব দেখে ইমার অভিমান দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইয়াদ কিছু চাওয়ার আগেই সব হাতের কাছে পেয়ে যায় শুধু ইমার দেখা পায় না। সকালে সে ওয়াশরুমে থাকতেই ইমা তার ব্ল্যাক কফি, অফিসের প্রয়োজনীয় সব রেখে উধাও হয়ে যায়। আজ ইয়াদের হাতের কাছে টাই পেয়েও মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললো, আমার টাই কোথায় ?
ইমা ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছিলো টেবিলে তাই ইয়াদের গলা স্পষ্ট শুনতে পেয়ে বিড় বিড় করে বললো, সবই তো রেখে এলাম পাচ্ছে না মানে কী। আর একটা জিনিস না পেলে একটু খোঁজে নিলে কী হয় ?
ইমার চিন্তা ভাবনার মাঝেই ইয়াদ আবার চেঁচাতে লাগলো। ইমা বিরক্ত হয়ে সার্ভেন্টকে সব সাজাতে বলে নিজে রুমের দিকে গেলো। ইমাকে রুমে ঢুকতে দেখে ইয়াদ হাতের টাই পেছনে লুকিয়ে ফেললো আর ইমা বিড়বিড় করে বের করা টাই খুঁজতে লাগলো। শেষে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে কাবার্ড থেকে নতুন আর একটা বের করতে গেলো। ইয়াদ পেছন থেকে টাই ইমার মাথার উপর দিয়ে পেটের কাছে এনে টাইয়ের দুপাশে টেনে ইমাকে নিজের কাছে আনলো।
ইমা টাই দেখে বললো, এটা কী ধরনের ফাজলামো ? টাই আপনার কাছে তবু চেঁচামেচি করছেন কেনো ?
ইয়াদ ইমাকে আর একটু কাছে টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো, ভালো করে ডাকলে তো আসতেই না।
ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের ভয়েস শুনে তবে নিজেকে সামলে কাঠ কাঠ গলায় বললো, কেনো আসবো ?
ইয়াদ ইমার দুবাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে টাই ইমার হাতে দিয়ে বললো, বেঁধে দাও।
ইমা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, পারবো না নিজের হাত আছে, নিজের হাতে করুন।
ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে আর একটু কাছে টেনে বললো, সত্যি পারবে না ?
ইয়াদের ভয়েস শুনে ইমার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে তাই কথা না বাড়িয়ে টাই বেঁধে দিতে লাগলো। ইয়াদ লম্বা বেশি হওয়ায় ইমার অসুবিধা হচ্ছে দেখে ইয়াদ ইমার কোমর জড়িয়ে একটু উঁচু করলো। ইমা শিউরে উঠলো ইয়াদের এহেন কাজে তবে কিছু বললো না, চুপচাপ টাই বেঁধে দিতে লাগলো। বাঁধা শেষে ইয়াদ আস্তে করে ইমাকে নিচে নামিয়ে দিলো।
কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো, আজ রাতে তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।
ইমা অবাক চোখে তাকালো ইয়াদের দিকে আর ইয়াদ টুপ করে ইমার কপালে একটা কিস করলো। ব্লেজার হাতে নিয়ে ইমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে আল্লাহ হাফেজ বলে বের হয়ে গেলো রুমে থেকে আর ইমা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো।
চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৭
ইমা সারাদিনে কাজে মন বসাতে পারলো না ইয়াদ তাকে কী সারপ্রাইজ দেবে সেটা ভেবে। ইয়াদ রাত আটটায় বাসায় চলে আসলো এক গাদা শপিং নিয়ে, ইমা হা করে তাকিয়ে আছে শুধু।
ইমা বিরক্ত গলায় বললো, এটাই কী সারপ্রাইজ ?
ইয়াদ বোকার মতো হাসি দিয়ে বললো, হ্যাঁ এটাই তোমার সারপ্রাইজ। তুমি তো শপিং করতে পছন্দ করো না তাই আমি তোমার জন্য শপিং করে নিয়ে এসেছি।
ইমা শপিং ব্যাগের কাছে গিয়ে বললো, হাসিটা আপনার উপর একদমই মানায়নি। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি আপনার খাবার দিচ্ছি।
কথাটা শোনার সাথে সাথে ইয়াদ হাসি বন্ধ করে দিলো আর বললো, আজকে বাইরে খাবো।
ইমা ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা বাইরে খাবেন, তাহলে আমি যে খাবারগুলো রান্না করলাম সেগুলো ফেলে দিবো ?
ইয়াদ বুঝতে পারলো ইমার একদমই পছন্দ হয়নি ইয়াদের সারপ্রাইজ তাই চটে গেছে।
ওয়াশরুমে যেতে যেতে বললো, এখানে একটা নীল শাড়ি আছে সেটা পড়ে রেডি হয়ে নাও।
ইমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইয়াদ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ইমা একটা একটা প্যাকেট খুলছে আর অবাক হচ্ছে।
একটা লেডিস কোট উঁচু করে ধরে ভ্রু কুঁচকে বললো, বাংলাদেশে আবার এতো শীত পড়তে শুরু করলো কবে থেকে ? আর এই গরমের দিনে এমন শীতের পোশাক আনার মানে কী ? লোকটা নিশ্চিত পাগল হয়ে গেছে।
অবশেষে নীল শাড়ীটা পেয়ে গেলো। শাড়ীটা দেখে ইয়াদের পছন্দের প্রশংসা না করে পারলো না ইমা। তবে শাড়ীটা অনেক বেশি পাতলা, সেটা খেয়াল করে ইমার রাগ হলো।
উল্টে পাল্টে দেখে বললো, এটা পরে আমি বাইরে যাবো খেতে ?
ইয়াদ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ইমার কথাটা শুনতে পেলো আর টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো, যেটা করতে বলেছি সেটা করো বাকিটা আমি বুঝে নিবো। আর হ্যাঁ হিজাব পড়বে না, চুল খোঁপা করবে। একটা বেলি ফুলের মালা আছে দেখো। সেটা দিবে আর যা যা আছে ব্যাগে সব দিয়ে সাজবে।
ইমা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো, ব্যাপার কী বলুন তো ?
ইয়াদ থতমত খেয়ে বললো, বললাম তো বাইরে যাবো খেতে।
ইয়াদ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে লাগলো আর ইমা সেদিকে তাকিয়ে বললো, আপনি এখন আবার শাওয়ার নিয়েছেন কেনো ?
ইয়াদ চুল ব্রাশ করতে করতে বললো, তোমার শপিং করতে করতে ঘাম ছুটে গিয়েছিলো আমার।
আপনাকে কে বলেছে আমার জন্য এমন উদ্ভট পোশাক নিয়ে আসতে।
সময় হলে ঠিক বুঝতে পারবে কেনো এনেছি। এখন বকবক না করে রেডি হয়ে নাও। আমি পাশের রুমে যাচ্ছি রেডি হতে।
ইমা কিছু বলার আগেই ইয়াদ বের হয়ে গেলো। ইমাও বক বক করে রেডি হতে লাগলো। নীল শাড়ি, খোপা করা চুলে সাদা বেলি ফুলের মালা, মুখে হালকা মেকআপ, চোখে গাড়ো কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক, ডায়মন্ডের সিম্পল জুয়েলারি। পুরোপুরি রেডি হয়ে ইমা আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো। কখনো এভাবে সাজা হয়নি ইমার তাই নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না। ইমার ফোনে ম্যাসেজের আওয়াজ আসতেই ইমা পাশে থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইয়াদের ম্যাসেজ।
নিচে আসো আমি গাড়িতেই আছি।
ইমা মুচকি হেঁসে নিজেকে আর একবার আয়নায় দেখে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। এভাবে সেজে বাইরে আসতেই ইমার অস্বস্তি হচ্ছিলো কিন্তু বাইরে এসে বেশ অবাক হলো। একজন সার্ভেন্টও নেই আশেপাশে। বাড়ি থেকে বের হয়ে আরো অবাক হলো বাইরে কোনো গার্ডও দেখা যাচ্ছে না। সামনে তাকিয়ে ইমার চোখ আটকে গেলো। নীল পাঞ্জাবির সাথে কালো জিন্স প্যান্ট, গায়ের সাথে একদম ফিট হয়ে গেছে পাঞ্জাবি, হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা, চুলগুলো বরাবরের মতো জেল দিয়ে সেট করা, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। যে হাসিতে বার বার ঘায়েল হয় ইমা। ছোট খাটো একটা ঢোক গিললো। এদিকে ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে নিজের ভালোবাসাকে।
ইয়াদ মনে মনে বললো, আজ তোমার সেদিনের সব প্রশ্নের উত্তর দেবো আমি।
ইমা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললো, চলুন।
ইয়াদ ইমার জন্য গাড়ির দরজা খোলে দিলে ইমা আস্তে করে উঠে বসলো। ইয়াদ দরজা আঁটকে দিয়ে নিজে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে পড়লো।
ইমার দিকে তাকিয়ে একবার মুচকি হেঁসে বললো, ইউ আর লুকিং হট।
ইমার কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে ইয়াদের কথা শুনে। ইমা যতটা সম্ভব নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করেছে শাড়িটা দিয়ে৷ কিন্তু শাড়ীটা একটু বেশি পাতলা মনে হচ্ছে ইমার কাছে। ইমা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। ইমার এটুকু বিশ্বাস আছে ইয়াদ তাকে এই শাড়ীতে বাইরের মানুষের সামনে নিবে না আর সেই বিশ্বাস থেকেই শাড়ীটা পড়ে বের হয়েছে। এখন পর্যন্ত ইমাকে ইয়াদ ছাড়া কেউ দেখেনি। এতে ইমার বিশ্বাসটা আরো দৃঢ় হয়েছে।
ইমা বাইরে তাকিয়ে বললো, আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন ?
ইয়াদ ইমার দিকে একবার তাকিয়ে বললো, লং ড্রাইভে যাচ্ছি।
না খেয়ে লং ড্রাইভে ?
ইয়াদ ব্যস্ত হয়ে বললো, কেনো তোমার ক্ষুধা পেয়েছে ?
না আমারও তো আপনার সাথে রাত এগারোটা বারোটায় খাওয়ার অভ্যেস হয়ে গেছে।
ইয়াদ ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বললো, মিথ্যা কেনো বলছো ? আমি তো এখন দশটার আগেই বাসায় চলে আসি।
ইমা দাঁত বের করা হাসি দিয়ে বললো, সেটা তো মাঝে মাঝে।
উল্টো কেনো বলছো তুমি ? মাঝে মাঝে একটু বেশি রাত হয়ে যায় আর প্রায় তো তাড়াতাড়ি চলে আসি এখন।
তার মানে আমি মিথ্যা বলছি ?
মিথ্যা না তুমি একটু উল্টো বলছো ?
এটা নিয়ে দুজনের ঝগড়া শুরু হয়ে গেলো আর শেষমেষ ইয়াদ সরি বলে নিজের দোষ মেনে নিলো সবটা। ইমা তো বিশ্ব জয় করা খুশি হলো। ইয়াদ ইমাকে নিয়ে শহর থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে। একটা বড় বীজের সামনে এসে গাড়ি থামলো ইয়াদ। ইমাকে গাড়িতে বসতে বলে নিজে নেমে গেলো আর একটু পর আইসক্রিম নিয়ে ফিরে এলো। ইয়াদ ধীরে ধীরে ড্রাইভ করছে আর ইমার সাথে আইসক্রিম খাচ্ছে। সেদিনের মতো আজও একটা আইসক্রিম দুজনে শেয়ার করে খাচ্ছে। অনেকটা সময় এভাবে ঘুরাঘুরি করার পর ইমার এবার বেশ ক্ষুধা লাগতে শুরু করেছে।
আপনি কী আজকে না খাইয়ে রাখার জন্য বাইরে নিয়ে এসেছেন ?
ইয়াদ ঘড়ি দেখে বললো, আর একটু ওয়েট করো প্লিজ।
ইমা আর কিছু বললো না। ইয়াদ ফার্ম হাউসের দিকে যেতে লাগলো। ইমার কাছে জায়গাটা বেশ নির্জন মনে হচ্ছে। ইয়াদ গাড়ি থামিয়ে ইমাকে নামতে বললো।
ইমা ভয়ে ভয়ে আসে পাশে তাকিয়ে বললো, আমরা এখানে কেনো এসেছি ?
আজ রাতে আমরা এখানেই থাকবো।
ইমা ভয়ে একটু উঁচু গলায় বললো, আমরা এখানে কেনো থাকতে যাবো ?
ইয়াদ দুষ্টুমি করে বললো, তুমি কী ভূতের ভয় পাচ্ছো নাকি ?
ইমা আমতা আমতা করে বললো, ভয় কেনো পাবো আর ভূতে বিশ্বাস করি না আমি।
ইয়াদ ইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, ভূত না থাকলেও জ্বীন কিন্তু আছে আর জ্বীনে তো অবশ্যই বিশ্বাস করো তাই না ?
ইমা ভয়ে ভয়ে বললো, হ্যাঁ জ্বীনে বিশ্বাস করি তো কী হয়েছে ? জ্বিনের কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমাকে ভয় দেখাতে আসবে ?
তাহলে ভয় পাচ্ছো কেনো আসো।
ইমা ধীরে ধীরে গাড়ি থেকে নেমে বললো, এখানে আমরা ছাড়া আর কে কে আছে ?
ইয়াদ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, দারোয়ান আর কেয়ারটেকার থাকে সবসময় তবে আজ কেউ নেই। আমি আজকের জন্য সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছি।
ইমা অবাক হয়ে বললো, কিন্তু কেনো ?
ইয়াদ ফিসফিস করে বললো, আজ এখানে শুধু আমি আর তুমি থাকবো তাই।
ইমা কেঁপে উঠলো ইয়াদের এমন হিম শীতল ভয়েসে। ইয়াদের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভেতরে যেতে লাগলো ইমা। ভেতরে গিয়ে আরো ভয় পেলো কারণ মাঝে মাঝে মোমবাতি জ্বলছে আর কোনো আলো নেই। ইমার এবার একটু বেশি ভয় করতে শুরু করেছে। ইয়াদের হাত এমনভাবে ধরে আছে যাতে হাত ছাড়লেই ইমাকে কেউ টেনে নিয়ে চলে যাবে।
ইমা এবার তোতলাতে তোতলাতে বললো, এটা কার বাড়ি আর এখানে আলো নেই ?
এটা আমাদের ফার্ম হাউস আর আলো আছে তবে আজ এদিকটায় কী যেনো প্রবলেম হয়েছে তাই অফ করে রেখেছে আর জেনারেটর নষ্ট হয়ে গেছে ঠিক করানো হয়নি।
ইমা বিরক্ত হয়ে বললো, সব আজই হতে হলো আর আমাদের আজই এখানে থাকতে হবে ?
ইয়াদ ইমার অবস্থা দেখে শুধু মজা নিচ্ছে।
ইয়াদ হাসি চেপে বললো, চলো ডিনার করে নেই।
এখানে ডিনার আসবে কোথা থেকে ?
ইয়াদ কিছু না বলে ইমাকে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেলে ইমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। মোমবাতি আর ইমার পছন্দের হরেক রকম খাবারে টেবিল পরিপূর্ণ সাজানো।
আজ এখানেই ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করবো আমরা আর এটাই তোমার সারপ্রাইজ।
ইমা অবাক হয়ে বললো, এসব এখানে এভাবে ?
ইয়াদ চেয়ার টেনে ইমাকে বসিয়ে দিলো আর বললো, কথা বাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করে দাও।
দুজনেই খেতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। মোমবাতির আলোয় দুজনকেই অসম্ভব সুন্দর লাগছে। হঠাৎ পায়ে শীতল স্পর্শে ইমা কেঁপে উঠলো আর হাত থেকে চামচটা প্লেটে পড়ে গেলো। একটু সময় লাগলেও ইমা বুঝতে পারলো এটা ইয়াদের স্পর্শ। ইয়াদের দিকে না তাকিয়ে চামচ তুলে আবার খেতে লাগলো। বেশ ধীরে খাওয়া শেষ করলো দুজনে। ইয়াদ বারবার নিজের ঘড়ি দেখছে আর ইমা মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে। এখনো অনেকটা সময় বাকি, ইয়াদ কী করবে ভেবে পাচ্ছে না ? খাওয়া শেষে ইয়াদ ইমাকে একটা রুমে নিয়ে গেলো। ইমার এতক্ষণ ভয় না করলেও এখন আবার ভয় করছে এই আধো আলো আধো অন্ধকারে।
তুমি একটু এই রুমে থাকো আমি আসছি।
ইমা ইয়াদের হাত টেনে ধরে প্রায় চিৎকার করে বললো, আপনি কোথায় যাচ্ছেন ? আমি এখানে কিছুতেই একা থাকতে পারবো না।
ইয়াদ মজা করে বললো, তার মানে তুমি ভয় পাচ্ছো ?
হাত ছেড়ে দিলো ইয়াদের আর আমতা আমতা করে বলল, ভয় কেনো পাবো অচেনা জায়গা তাই বলছিলাম আর কী ?
ইয়াদ বরাবরের মতো হাসি চেপে বললো, ফোনটা ভুলে গাড়িতে ফেলে এসেছি সেটা নিয়ে এখনই আসছি তুমি কোথাও যেও না এখানেই থাকো।
ইমা মনে মনে বললো, কোথাও যাওয়ার সাহস থাকলে তো যাবো।
ইয়াদ বের হয়ে গেলে ইমা পা গুটিয়ে বসে বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলো। এখন ইমার বেশ রাগ লাগছে ইয়াদের উপর। সারপ্রাইজের নাম করে ভয় দেখাতে এখানে নিয়ে এসেছে। হঠাৎ ইমা অনুভব করলো তার ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন কিন্তু ভয়ে বেড থেকে পা নামাতেই পারছে না। মনে হচ্ছে নিচে পা রাখলে বেডের নিচ থেকে কেউ পা টেনে নিয়ে যাবে। ইমা মনে মনে ইয়াদকে বাজে কিছু গালি দিতে লাগলো। একটু পর আসছি বলে ইয়াদ প্রায় আধ ঘণ্টা পর রুমে এলো। এদিকে ইমার ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
ইয়াদকে দেখে রেগে বললো, এই আপনার একটু সময়।
ইয়াদ মাথা চুলকে বললো, একটা কল এসেছিলো তাই কথা বলে তারপর আসলাম, চলো।
কোথায় যাবো এখন আবার ?
গেলেই দেখতে পাবে চলো তো ?
ইমা বেড থেকে নেমে বললো, আগে আমি ওয়াশরুমে যাবো, আপনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকুন চুপচাপ।
ইয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ইমা ওয়াশরুমে চলে গেলো। ইয়াদ ওয়াশরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। ইমা ওয়াশরুমে যাওয়ার সাথে সাথে লাইট জ্বলে উঠলো।
বের হয়ে বললো, এই লাইট আসলো কীভাবে ?
ঠিক হয়ে গেছে হয়তো তাই চলে এসেছে।
ওহ্ চলুন কোথায় যেনো যেতে হবে। যে ভয় পেয়েছি আজ আর ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না।
পরের কথাটা ইমা বিড়বিড় করে বললো ইয়াদ শুনেও না শোনার ভান করে রইলো আর ইমার পিছনে গিয়ে চোখ বেঁধে দিলো।
আরে আরে এটা কী করছেন ?
ইয়াদ লো ভয়েসে বললো, সারপ্রাইজ,,,
ইমা আর কিছু বললো না ইয়াদ হুট করে ইমাকে কোলে তোলে হাটা শুরু করলো। ইমা প্রথমে চমকে গেলেও পরে ইয়াদের গলা জড়িয়ে ধরলো। ইয়াদ মুচকি হেঁসে সামনে আগাতে লাগলো। ইমা কিছু না বলে চুপচাপ ইয়াদের গায়ের গন্ধ নিচ্ছে বুকে মাথা ঠেকিয়ে। ইমাকে নামিয়ে দিয়ে সোজা ইমার পেছনে দাঁড়ালো ইয়াদ। আসতে করে চোখের বাঁধন খুলে দিলো।
কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মিসেস আবরার হামিদ ইয়াদ। আজ আমাদের বিবাহিত জীবনের এক বছর পূরণ হলো। যদিও এই এক বছরে সুখের স্মৃতি খুব একটা পাইনি আমরা।
ইমা পেছনে ঘুরে ইয়াদের দিকে তাকালো অবাক চোখে। ইমা একদমই ভুলে গিয়েছিলো আজ তাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।
ইয়াদ ইমার গাল ধরে সামনের দিকে ঘুরিয়ে বললো, আমাকে নয় সামনে দেখো।
ইমা সামনে তাকিয়ে আরো বেশী অবাক হলো। তার সামনে অসংখ্য মোমবাতি দিয়ে লেখা হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি মাই লাভ।
অসংখ্য মোমবাতির আলোয় অন্ধকার হারিয়ে যেনো হারিয়ে গেছে।
ইমা সামনে দেখতে ব্যস্ত তখনই ইয়াদ ইমার কানে ফিসফিস করে বললো, আই লাভ ইউ ইমা, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
ইমা আবার ঘুরে তাকাতে চাইলে ইয়াদ বাঁধা দিলো আর পেছন থেকে ইমাকে জড়িয়ে ধরলো। ইমার খোলা পেটে ইয়াদের হাত পড়তেই ইমা কেঁপে উঠলো। এর আগে ইয়াদ কখনো তাকে এতোটা গভীরভাবে স্পর্শ করেনি। ইমার মনে হচ্ছে তার প্রতিটা রক্তকণাও ইয়াদের স্পর্শ অনুভব করেছে।
ইয়াদ লো ভয়েসে বলতে লাগলো, তুমি সেদিন জানতে চেয়েছিলে না আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতটা বা আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা। জীবনে প্রথম বার আবরার হামিদ ইয়াদ কোনো মেয়ের চোখের মায়ায় আটকা পড়েছিলো আর সেটা ছিলে তুমি। ঘন পাপড়িতে ঘেরা ভেজা ভেজা দুটি চোখ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। সেই দৃষ্টি আজও ভুলতে পারিনি আমি, চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই। আমি একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবছি সেটা বুঝতে পেরে নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত ছিলাম সেদিন।
ইমার মনে পড়ে গেলো ইয়াদের সাথে তার প্রথম দেখা হওয়ার দিনের কথা।
ইয়াদের কথায় ইমার হুঁশ ফিরলো, আজও বের হতে পারিনি আমি সেই চোখের মায়াজাল থেকে। সেদিন সেই মায়াজাল কাটানোর উপায় খুঁজতে এসেছিলাম এই ছাদেই। কিন্তু তার ফল কী হয়েছিলো দেখবে ?
ইয়াদ এক হাত উঠিয়ে পাশে দেখলো। ইয়াদের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে ইমা একটা ছবি দেখতে পেলো। ইমার চিনতে অসুবিধা হলো না অসমাপ্ত ছবির এই রং তুলিতে আঁকা চোখদুটো তারই। ইমা অবাক হয়ে তাকালো ইয়াদের দিকে। ইয়াদ ইমাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে ছবির কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, ঐখানটায় সেদিন একটা পূর্ণ চাঁদ উঠেছিলো গাছের আড়ালে। তোমার চোখের মায়াজাল থেকে বের হতে, সেই চাঁদটা আমার ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ঐ চাঁদ ফুটিয়ে তুলতে পারিনি আর বদলে নিজের অজান্তে এই নিরব পদ্মের মতো চোখ দুটো ফুটিয়ে তুলেছিলাম। তাই রেগে ছবিটা অসম্পূর্ণ রেখে বের হয়ে যাই। কেয়ারটেকার সব গুছিয়ে রাখার সময় ছবিটাও গুছিয়ে রেখে দিয়েছিলো। তুমি বলেছিলে না আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা ? আমি তো সেদিন থেকেই তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলাম। তুমি বলেছিলে না আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব কতটা ? আমার তো নিজের জীবনেরই গুরুত্ব ছিলো না নিজের কাছে। তবে নিজের জীবনের গুরুত্ব দিতে শুরু করেছি। শুধু তোমার হাত ধরে জীবনের সুখের কিছু স্মৃতি তৈরি করতে চাই বলে। এবার বুঝে নাও আমার জীবনে তোমার গুরুত্বটা।
ইমা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। এতগুলো দিন এক ছাদের নিচে থেকে, এক বেডে ঘুমিয়ে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দুরত্বে থাকা মানুষটার মনের কথা বুঝতে পারেনি সে। এতোটা ভালোবাসে কখনো বুঝতেই দেয়নি। ইমা পুরনো ভাবনায় বিভোর তখনই ইয়াদ ইমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো, হাতে বর্ষার কদম ফুল।
আমার বাকিটা জীবন তোমার হাতে হাত রেখে পারি দিতে চাই। হবে কী তুমি আমার জীবন চলার পথের সঙ্গী ?
ইমা টলমলে চোখে তাকিয়ে ছোট করে বললো, হুম।
ইমা ইয়াদের হাত থেকে ফুলগুলো নিতেই ইয়াদ পেছন থেকে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা বের করে সামনে ধরলো।
জীবনের সব #তিক্ততার_সম্পর্ক পেছনে ফেলে তোমার সাথে একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। যেখানে কোনো তিক্ততার ছায়া থাকবে না। তুমি কী আমার পাশে থাকবে ?
ইমা এবারও মুচকি হেঁসে বললো, হুম।
রজনীগন্ধার গুচ্ছ ইমা নিতেই ইয়াদ এক গুচ্ছ লাল টকটকে গোলাপ ইমার সামনে ধরলো।
আমি নিজেকে তোমার সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মতো উপস্থাপন করতে চাই যার আড়ালে কিছুই থাকবে না। আর তোমাকেও নিজের সামনে স্বচ্ছ কাঁচের মতো দেখতে চাই। তুমি কী তাতে সাহায্য করবে আমাকে ?
ইমা ফুলগুলো নিয়ে বললো, হুম।
ইয়াদ এবার পকেট থেকে একটা ডায়মন্ড রিং বের করে ইমার সামনে ধরলো।
একটা ভালোবাসার খাঁচায় বন্দী রাখতে চাই তোমাকে, থাকবে সারাজীবন ?
ইমা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, হুম।
ইমার বা হাতের অনামিকা আঙ্গুলে রিংটা পড়িয়ে দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে কিস করলো ইয়াদ।
ইয়াদ পিছনে তাকিয়ে কিছু খোঁজে একটা নীল পদ্ম ফুল ইমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আই লাভ ইউ।
ইমা ফুলটা নিয়ে বললো, আই লাভ ইউ টু।
ইমা ফুলটা নিতেই ইয়াদ উঠে দাঁড়ালো। ইমা দু’হাতে ফুল নিয়ে ইয়াদকে জড়িয়ে ধরলো আর ইয়াদও ইমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় কিস করলো।
ভালোবাসার উপর ঘৃণা জন্ম নিয়েছিলো আমার মনে। আবার কখনো কোনো ধোঁকা সহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই ইমা। ছেড়ে যেও না কখনো আমি বেঁচে থেকেও মরে যাবো।
ইমা কিছু না বলে শক্ত করে জড়িয়ে রইলো ইয়াদকে। কতটা সময় এভাবে ছিলো জানা নেই কারো। এই ছাঁদে একটা বড় দোলনা আছে, আজ সেটাকেও বেলুন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে ইয়াদ। ইমাকে কোলে তুলে দোলনায় বসিয়ে দিলো আর নিজেও পাশে বসলো।
ইমা হাতের ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো, সবগুলো আমার পছন্দের ফুল আর শেষটা প্রিয় ফুল। আপনি এসবের কথা কী করে জানলেন ? আমার তো কোনো ডাইরি লেখার অভ্যাস নেই যে সেখান থেকে জানবেন।
ইয়াদ ইমার হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, কথা একদিন বলেছিলো সবাই গল্প করার সময়। তুমি ছিলে না সেখানে।
ইমা ইয়াদের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো আর বললো, দেখতে দেখতে এক বছর কীভাবে কেটে গেলো তাই না ?
ইয়াদ গম্ভীর গলায় বললো, গত এক বছরের প্রত্যেকটা দিন প্রত্যেকটা মুহূর্ত আমার মনে আছে। ভালো স্মৃতির সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমাদের সম্পর্কটা আরো আগেই হয়তো স্বাভাবিক হয়ে যেতো যদি আমাদের জীবনটা এতো কমপ্লিকেটেড না হতো। এতোটা সময় লাগলো না হয়তো।
ইমা ইয়াদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো, পুরনো কথা ভেবে বর্তমান নষ্ট করার মানে হয় না।
ইয়াদ ইমার কপালে কিস করে বললো, হুম।
ইয়াদের কাঁধে মাথা রেখে অনেকটা সময় গল্প করলো দু’জনে। আকাশটা আজ মেঘলা ছিলো হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ চমকে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। ইয়াদ ইমার হাত ধরে কোনোরকমে দৌড়ে চলে আসলো ছাঁদ থেকে। রুমে এসে ইমা ব্যস্ত হয়ে গেলো শাড়ীর আঁচলে ইয়াদের মাথা মুছে দিতে, আবার না জ্বর চলে আসে সেটা ভেবে। আর ইয়াদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ইমার দিকে। সারা মুখে গলায় বিন্দু বিন্দু বৃষ্টির পানি লাইটের আলোতে ডায়মন্ডের মতো চিক চিক করছে। ঠোঁটের উপর একটা পানির বিন্দু ইয়াদকে প্রচন্ড টানছে। ইয়াদ নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে ছুয়ে দিলো পানির ফোঁটা। ইমা কেঁপে উঠলো হঠাৎ ইয়াদের এমন স্পর্শে। ইয়াদের চোখে তাকিয়ে আরো বেশী শিহরিত হলো। কেমন নেশা ধরা চোখে তাকিয়ে আছে। ইমা ইয়াদের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দূরে সরে যেতে চাইলো কিন্তু ইয়াদ হাত ধরে টেনে কাছে নিয়ে আসলো।
কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজকে অন্তত দূরে সরে যেও না।
চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৮
ইয়াদ ইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, আজকে অন্তত দূরে সরে যেও না।
ইয়াদের ধরা হাতটা ইমা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলো কিন্তু ইয়াদের কথা শুনে একদম শান্ত হয়ে গেলো। ইয়াদ এক টানে ইমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসলো, ইমা সোজা ইয়াদের বুকে গিয়ে ধাক্কা খেলো। আস্তে করে ইমার দুবাহু ধরে নিজের থেকে আলাদা করলো। দুগালে হাত রেখে মুখটা উঁচু করে ধরতেই ইমা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইমার নিশ্বাস ভাড়ী হয়ে গেছে। অনেক সময় পরও ইয়াদের কোনো রিয়াকশন না দেখে নিভু নিভু চোখে তাকালো ইমা। চোখ মেলতেই দেখতে পেলো দুটো চোখ তাকে চাতক পাখির মতো দেখছে।
ইমা কাঁপা গলায় বললো, কী দেখছেন এভাবে ?
ঘোর লাগা গলায় উত্তর এলো, অনেক দিনের তৃষ্ণা মেটাচ্ছি। তোমাকে প্রথমদিন দেখার পর সেদিন রাতেই আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। মরুভূমির মাঝে তৃষ্ণায় পাগল হয়ে আমি এদিক ওদিক ছুটছিলাম পানির জন্য। তখনই তোমাকে দেখতে পাই ফুলে ফুলে রঙিন এক বাগানে। তোমাকে দেখে তৃষ্ণার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম আমি। পরক্ষণে তোমার হাতে পানি দেখে তৃষ্ণার কথা মনে পরে গেলো। অনুরোধ করতে লাগলাম তোমার কাছে একটু পানির জন্য কিন্তু তুমি বিনিময় চাইলে আমার কাছে।
ইমা অবাক হয়ে বললো, বিনিময় ?
ইয়াদ নিজের বুকের বা পাশে আঙ্গুল রেখে বললো, এখানে একটু জায়গা চেয়েছিলে আর তার বিনিময়ে মরুভূমির মাঝে সাজানো বাগানটা দিয়ে দেবে বলেছিলে।
ইমা অবাক চোখে তাকিয়ে ইয়াদের প্রত্যেকটা কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, তুমি তোমার কথা রেখেছো। এই বুকের বা পাশের জায়গাটার বিনিময়ে আমার মরুভূমির মতো জীবনটা সবুজ বাগান করে দিয়েছো, তুমি তোমার কথা রেখেছো।
ইয়াদ ধীরে ধীরে ইমার দিকে মুখটা এগিয়ে নিয়ে কপালে গভীর এক কিস করলো। ইমা কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইয়াদ একে একে ইমার দুচোখের পাতা, গাল, থুতনি সব জায়গায় গভীরভাবে ঠোঁট ছোঁয়াতে লাগলো। ইয়াদের প্রতিটা স্পর্শ ইমা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শক্ত করে ইয়াদের শার্টের হাতা আঁকড়ে ধরে আছে। ইয়াদ কিছুটা সময় ইমার গোলাপি ঠোঁটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর ধীর গতিতে আলতো করে ইমার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। ইমা এবার দিগুণ কেঁপে উঠে চোখ খোলে ইয়াদের দিকে তাকালো। কিন্তু ইয়াদের চোখের নেশা তাকে বেশি সময় তাকিয়ে থাকতে দিলো না। বাধ্য হয়ে ইমা আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো। ইয়াদ এবার গভীরভাবে ইমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। ইমা ইয়াদের মাথার পেছনের চুলগুলো শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো। একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগলো একে অপরের ভালোবাসার সাগরে। আজ তাদের মাঝে কোনো তিক্ততার ছায়াও নেই আর কোনদিন হয়তো আসবেও না।
ইয়াদের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে ইমা। অনেক ঝড় ঝাপটার পর নিজের স্থায়ী ঠিকানায় পৌঁছে গেছে সে। ইয়াদের চোখে ঘুম নেই, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে তাকিয়ে দেখছে ঘুমন্ত পরীকে। ঘুমের মধ্যেও হাসছে মনে হচ্ছে। ইয়াদ আলতো করে ইমার কপালে কিস করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো আর ইমাও ঘুমের মাঝে ইয়াদকে আঁকড়ে ধরে ঘুমাতে লাগলো। ফার্ম হাউস তাই আশেপাশে গাছপালা আর পাখির আনাগোনা একটু বেশি। ফজরের আযানের পর থেকে পাখির কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেছে। এখন আর লেট করলে দুজনকেই কাযা নামাজ আদায় করতে হবে, শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়তে সময় লাগবে।
ইয়াদ ইমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ধীর গলায় ডাকলো, ইমা উঠো ফজরের সময় চলে যাচ্ছে আর লেট করলে কিন্তু কাযা হয়ে যাবে।
ইমা ইয়াদের কথায় পাত্তা না দিয়ে আয়েশ করে ঘুমাতে লাগলো। ইয়াদ একটু ভেবে ইমার এলোমেলো চুল ধরে একটু টান দিলো আর ইমা বড় বড় চোখে তাকালো। চুলের টান একদম সহ্য হয় না তার সেটা ইয়াদ জানে।
রাগী গলায় বললো, কী হলো বিরক্ত করছেন কেনো তখন থেকে ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, নামাজ পড়বে না ?
নামাজের কথা শুনে ইমা উঠতে গেলে নিজের অবস্থান বুঝতে পারলো আর লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো। কোনোরকমে পোশাক ঠিক করে এক ছোটে ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলো। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নিলো। ইয়াদ ইমার কান্ড দেখে মুচকি হাঁসলো আর ইমা লাজুক হেঁসে নিজের মাথায় গাট্টা মেরে দ্রুত শাওয়ার নিতে লাগলো। শাওয়ার শেষে খেয়াল করলো কোনো পোশাক আনা হয়নি তার। এতোকিছু না ভেবে দরজা একটু ফাঁকা করে ইয়াদের কাছে চাইলো। ইয়াদ আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। ইমা চাইতেই ইয়াদ তার হাতে পোশাক ধরিয়ে দিলো। ইমা দ্রুত চেঞ্জ করে বের হতেই ইয়াদ চলে গেলো শাওয়ার নিতে। ইমা জায়নামাজ বিছিয়ে ইয়াদের জন্য ওয়েট করতে লাগলো। ইয়াদ বের হলে দুজনে এক সাথে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলো। নিজেদের নতুন জীবনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলো। জায়নামাজ ভাজ করে রেখে ঘুরে দাড়াতেই ইয়াদ ইমাকে কোলে তুলে নিলো।
ইমা চমকে উঠে বললো, এমন ভূতের মতো হুটহাট কোলে তুলে নেন কেনো ? ভয় পাই তো নাকি আর আপনার কষ্ট হয় না এভাবে কোলে নিতে ?
ইয়াদ ভাব নিয়ে বললো, লাস্টবার ১৬০ কেজি ওজন তুলেছিলাম আর তুমি বড়জোর ৫০ কেজি হবে। হাউ ফানি, ৫০ কেজি নিয়ে আমার কষ্ট হবে ?
ইমা আর কিছু বললো না, ইয়াদ তাকে নিয়ে আবার ছাঁদে যেতে লাগলো।
ইমা ভ্রু কুঁচকে বললো, এখন আবার ছাঁদে কী ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো, আজ একসাথে সূর্যদয় দেখবো ?
আপনি এতো রোমান্টিক আগে বুঝিনি কিন্তু।
ইয়াদ চোখ টিপ মেরে বললো, কেবল তো শুরু আরো অনেক কিছু দেখার বাকি আছে মাই লাভ।
ইমা চোখ সরিয়ে নিলো ইয়াদের থেকে। ছাঁদে গিয়ে দেখলো বৃষ্টির জন্য সব সাজানো লান্ড ভন্ড হয়ে পরে আছে।
তা দেখে ইমা হেঁসে বললো, যদি গতরাতে বৃষ্টিটা আগে নেমে যেতো আপনার এতো পরিশ্রমের পরিণাম এমন হয়ে যেতো আমি দেখার আগেই।
ইয়াদ ইমাকে নিয়ে পূর্বদিকটায় নামিয়ে দিয়ে বললো, তা যা বলেছো ?
ইমা সামনে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো আর ইয়াদ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। পূর্ব আকাশটা লাল হয়ে গেছে। একটু পরই সূর্য উঠে যাবে। ইয়াদ ইমার ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাদের জীবনের প্রত্যেকটা সকাল যেনো এমন হয় আজ থেকে।
ইয়াদের কথা শুনে ইমা কিছু বললো না। সময়টা উপভোগ করতে লাগলো দুজনে। রোদ উঠে গেলে ছাঁদ থেকে নেমে এলো। কেয়ারটেকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে টেবিলে। ইয়াদ গতরাতে মিথ্যা বলেছিলো এখানে কেউ নেই। কেয়ারটেকার সব কাজ শেষ করে নিজের রুমে চলে গিয়েছিলো আর দারোয়ানও। লাইটও ইয়াদ ইচ্ছে করে অফ রেখেছিলো। ইমা সব জানতে পেরে ইয়াদকে এলোপাথাড়ি কয়েকটা কিল ঘুষি লাগিয়ে দিলো। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট করে বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে এলো দুজনে।
ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর মাঝে মাঝে ইমাকে দেখছে ইমাও আড়চোখে ইয়াদের দিকে তাকাচ্ছে।
ইমা সামনে তাকিয়ে মনে মনে বললো, মাফ করবেন আমাকে, আরমান ভাইয়ার ভালোবাসার কথাটা আপনার থেকে লুকিয়ে গেছি। যে মানুষটা আমাকে কখনো সহ্য করতেই পারেনি আজ হঠাৎ করে সে এসে বলছে আমাকে নাকি ভালোবাসে। সেটা কীভাবে বিশ্বাস করে নিবো বলুন ? আর যেটা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না সেটা আপনাকে জানিয়ে একটা তিক্ততা বাড়াতে চাই না।
ইমা,,,
ইয়াদের ডাকে ইমার ভাবনার সুতো ছিড়লো আর খানিকটা চমকে ইয়াদের দিকে তাকালো, কিছু বললেন ?
কী ভাবছো তুমি ?
কিছু না, আপনি কিছু বলছিলেন ?
ইয়াদ মুচকি হেঁসে বললো,খুব তাড়াতাড়ি আমরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি।
ইমা বিস্ফুরিত চোখে তাকিয়ে বললো, মানে ?
মানে আমরা সুইজারল্যান্ড যাচ্ছি হানিমুনে।
তাই জন্যই কী আপনি এমন উদ্ভট পোশাক নিয়ে এসেছেন ?
হুম আর যাওয়ার আগে আমাকে অনেক কাজ গুছিয়ে যেতে হবে, কয়েকদিন প্রচুর ব্যস্ত থাকবো। তাই গতকাল সব শপিং করে ফেলেছি। শুধু তোমার না আমার জন্যও করেছি।
সুইজারল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন ইমার অনেকদিন থেকে। মুলত ঘুরাঘুরি খুব পছন্দ ইমার আর সেটা যেখানেই হোক। তবে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যের একটা ভিডিও দেখার পর। স্বপ্নটা সত্যি হবে কখনো ভাবেনি ইমা। খুশিতে ইমা হুট করে ইয়াদের গালে কিস করে দিলো। ইয়াদ অবাক চোখে ইমার দিকে তাকালে ইমা লজ্জায় বাইরের দিকে তাকালো। ইয়াদ মুচকি হেঁসে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো।
৫৬.
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে আরমান। আমিনুল, ছাহেরা আর কথা তাকে ছাড়তে এসেছে। ছাহেরা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। আরমানের লাস্ট মুহূর্তে এসে মনে হচ্ছে যাওয়া ক্যান্সেল করে দিতে কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়।
আমিনুল বললো, আরমান এখনো সময় আছে ভেবে দেখ একবার।
বাবা আমি যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।
আমিনুল ঘুরে চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করলো আর ছাহেরা শব্দ করেই কাঁদছে।
কথা আওয়াজ কিছুটা নিচু করে বললো, এখনো বললে না ভাইয়া তুমি কেনো যেতে চাইছো ?
আরমানও ছোট করে উত্তর দিলো, ভালোবাসা ?
কথা অবিশ্বাসের চোখে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান কাউকে ভালোবাসে এটা যেনো কথা হজম করতে পারছে না। আর এদিকে আরমানের চোখ আসেপাশে একজনকে খুঁজছে। হ্যাঁ সেটা আর কেউ নয় ইমা। লাস্ট বারের জন্য ইমাকে আসতে বলেছিলো আরমান। আশেপাশে দেখতে না পেয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। আরমানের জন্য তার জীবনে সময় কোথায় ? সময় শেষ হয়ে আসছে আরমান আর একবার পেছনে তাকিয়ে কাঁচের দরজা ঢেলে ভেতরে চলে গেলো। চাইলেও এখান থেকে আর ফেরত যেতে পারবে না। সব চেকিং হচ্ছে আরমান আবার কাঁচের দরজার ওপাড়ে তাকাতেই ইমাকে দেখতে পেলো। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ফোটে উঠলো আরমানের। ইমার পেছন থেকে ইয়ানাকেও বের হতে দেখলো। কাঁচের দরজার ওপাড়ে আর এপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একতরফা ভালোবাসার তিনটা পরিণতি। আরমান ইমাকে ভালোবেসেছিলো একতরফা আর ইয়ানা আরমানকে। একতরফা ভালোবাসাগুলো খুব কমই পরিণতি পায়। একমাত্র রেহানের একতরফা ভালোবাসাই পরিণতি পেয়েছে। ইমা আর ইয়ানা দুজনেই আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে একজনের চোখে ভালোবাসা আর একজনের চোখে মায়া। হ্যাঁ আজ আরমানের জন্য মায়া হচ্ছে ইমার। তবে কিছু করার নেই সব শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। এদিকে আরমান বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে তাকিয়ে দেখছে ইমাকে। বুকটা আজ বড্ড বেশি পুড়ছে তার। ইয়ানা তো রেহানকে পাশে পেয়ে নিজের বুকের যন্ত্রণাটা কমিয়ে নেবে কিন্তু আরমানের কোনো উপায় নেই কষ্টটা একটু লাঘব করার। আরমান আর একবার বাবা-মা, বোন আর না পাওয়া ভালোবাসাকে দেখে সবার চোখের আড়ালে চলে গেলো। আরমান আড়ালে চলে যেতেই আজ অজানা কারণে ইমার চোখ থেকে এক বিন্দু পানি গড়িয়ে পড়লো। পানির বিন্দুটা হাতে নিয়ে দেখে নিজেই অবাক হলো। এদিকে ইয়ানার চোখে আজ পানি নেই কারণটা তার অজানা। এভাবে কেটে গেলো বেশ কিছুটা সময়।
ইয়ানা স্থির গলায় বলে উঠলো, চলো ভাবি আমাদের যেতে হবে।
ইমা ছোট করে হুম বলে হাঁটতে লাগলো সামনে। ইয়ানা আর একবার পিছনে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ইমার পিছনে যেতে লাগলে। ইমা ইয়াদকে এখানে আসার কথা বললে সে ইয়ানাকে সাথে নিয়ে আসতে বলে। সে ব্যস্ত আসতে পারবে না আর ইমাকেও একা ছাড়তে পারবে না। তাই ইয়ানাকে সাথে নিয়ে আসতে বলেছে। গাড়িতে গিয়ে বসতেই তাদের মাথার উপর দিয়ে বিকট শব্দে প্লেনটা চলে গেলো৷ দুজনেই সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়।
আরমান তাকিয়ে আছে উইন্ডো দিয়ে বাইরের দিকে, চোখ দুটো টলমল করছে নোনাজলে। আবার কবে এই দেশে, এই মাটিতে আপনজনদের কাছে ফিরে আসবে সেটা তার জানা নেই। এটাও জানে না আদৌও কোনোদিন আর আসা হবে কিনা। বুকের ভেতরটা প্রচন্ড ভাড়ী লাগছে তার। আরমান চোখ বন্ধ করে সীটে হেলান দিলো আর চোখের কোণ বেয়ে নোনাজলের ধারা গড়িয়ে গেলো। আরমানের হঠাৎ অস্বস্তি হতে লাগলো, মনে হচ্ছে তার দিকে কেউ গভীরভাবে তাকিয়ে আছে। আরমান চোখ খুলে চমকে উঠলো। চশমা চোখে একটা মেয়ে তার দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে৷ আমরান প্রথমে শুধু চশমাওয়ালা চোখ দু’টোই দেখতে পেয়েছে।
আরমান চমকে উঠে বললো, Hey, what are you doing here ?
মেয়েটা সোজা হয়ে বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, Hi myself Arisha Rayhan.
আরমান ভ্রু কুঁচকে বললো, So what,,, Why did you look at me like that ?
আরিশা হাত সরিয়ে নিয়ে চশমাটা একটু ঠিক করে নিয়ে বললো, না মানে আপনি আসার পর থেকে কেমন গোমড়া মুখে বাইরের তাকিয়ে ছিলেন, আবার দেখলাম কান্নাও করছিলেন তাই একটু কৌতূহল হয়েছিলো ?
আরমান ভ্রু কুঁচকালো মেয়েটাকে গড়গড় করে বাংলা বলতে দেখে। কারণ চেহারায় অনেকটাই ফরেইনারের ছাপ আর পোশাকেও।
আরমান গম্ভীর গলায় বললো, তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন ?
আরিশা গাল ফুলিয়ে বললো, সরি।
আরমান আবার চোখ বন্ধ করে নিলো আর মেয়েটা একটু উশখুশ করে আবার বললো, আপনি কী আস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন ?
আরমান বিরক্ত গলায় বললো, না আমি আস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটে আমেরিকা যাচ্ছি।
আরমানের উত্তরে আরিশা একটু লজ্জা পেলো, তবে পাত্তা না দিয়ে আবার বললো, না মানে আমি অস্ট্রেলিয়া থাকি তাই বলছিলাম। আপনি আস্ট্রেলিয়ায় কোথায় যাচ্ছেন ?
আরমান বিরক্ত হলেও ভদ্রতার খাতিরে ছোট করে উত্তর দিলো, সিডনি শহরে।
আরিশা উৎসুক গলায় বললো, ওয়াও আমিও সিডনি শহরেই থাকি, আমার জন্ম সিডনি শহরেই। বাবা একটা ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানিতে জব করে সেই সুবাদে সিডনিতেই থাকি আমরা। বাবা-মা দুজনেই পিউর বাঙালি আর রিলেটিভস সব বাংলাদেশে, আমি আমার দাদু বাড়ি গিয়েছিলাম।
আরমানের প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে মেয়েটার কথা কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। এতো ঘণ্টার জার্নি যদি এই মেয়ের সাথে থাকে তাহলে সে নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে। সেটা ভেবে আরমানের মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে। আরমান ছোট ছোট শব্দে মেয়েটার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। কথায় কথায় যখন জানতে পারলো মেয়েটার বাবা আরমানের অফিসেরই সিনিয়র অফিসার তখন বেশ অবাক হলো। তবে মেয়েটাকে বুঝতে দিলো না। এতটুকু সময়ে আরমান এটা নোটিশ করেছে মেয়েটাকে, প্রতি পাঁচমিনিটে একবার তার চোখের চশমাটা নেড়েচেড়ে ঠিক করে নেয়।
আরামন বিরক্ত হয়ে বললো, আপনি কী এবার একটু চুপ করবেন দয়া করে ? আসলে আমার মাথাটা একটু ধরেছে।
আরিশা গোমড়া মুখে বললো, আসলে আমি বেশি সময় চুপ করে থাকতে পারি না। মনে হয় পেটটা ফোলে যাচ্ছে কথায়।
আরমানের ইচ্ছে করছে নিজের মাথা নিজে ফাটাতে। কোনো ফ্যাসাদে পরলো সেটা ভেবে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এই মেয়ের বকবকে সে নিজের কষ্টের কথা প্রায় ভুলেই গেছে।
৫৭.
কথা থেমে থেমে কান্না করছে আর ইশান তাকে শান্তনা দিচ্ছে।
কথা নাক টেনে বললো, ভাইয়া এভাবে কেনো চলে গেলো বলুন তো ? ভাইয়ার সাথে তেমন কথা হতো না, মেশা হয়নি তেমন করে। কিন্তু দিনে কয়েকবার সামনাসামনি হয় যেতাম আর টুকিটাকি কথাও হতো। কিন্তু বাড়িতে গেলে এখন কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। সকালে ভাইয়াকে দিয়ে আসার পর থেকে মা শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
ইশান কী বলবে বুঝতে পারছে না ? সে নিজেও বুঝে উঠতে পারছে না আরমান হঠাৎ করে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেনো নিলো। ভার্সিটিতে তার টিচার ক্যারিয়ার বেশ ভালোই চলছিলো তাহলে হটাৎ এমন সিদ্ধান্ত ?
ইশান ভাইয়া কাউকে ভালোবাসতো।
ইশান চমকে উঠে তাকালো কথার দিকে, মানে ?
হুম ভাইয়া যাওয়ার আগে ছোট্ট উত্তরে এটাই বলে গেছে।
ইশান হিসাব মেলাতে পারছে না। তার জানামতে আরমান ভার্সিটি লাইফ থেকে পিউর সিঙ্গেল। অনেক মেয়ে তাকে প্রপোজ করলেও কখনো একসেপ্ট করেনি। ইশান শুনেছিলো বাজি ধরে কোনো মেয়েকে প্রপোজ করেছিলো কিন্তু সেটা কে তার জানা নেই।
ইশান একটু ভেবে বললো, সেটা কে কিছু বলেছে আরমান স্যার ?
কথা হতাশ গলায় উত্তর দিলো, না তবে আমার মনে হয় মা কিছু জানে। অনেকদিন ধরেই মা আর ভাইয়ার সম্পর্ক কিছু ঠিক নেই।
ইশান কথাকে বা হাতে জড়িয়ে ধরে বললো, এখন এসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই আরমান স্যার তো চলেই গেছে।
কথা বিরক্ত হয়ে বললো, কী সব সময় স্যার স্যার করেন ? ভাইয়া বললেই তো হয়।
ইশান কথাকে একটু কাছে টেনে বললো, আগে স্যার ছিলো তাই স্যার বলেছি। এখন শুধু বউয়ের বড় ভাই তাই ভাইয়াই বলবো।
কথা ভ্রু কুঁচকে বললো, ঢং দেখে বাঁচি না, বিয়ের খবর নেই বউ বউ করতে এসেছে।
ইশান মুচকি হেঁসে বললো, তোমার আঠার হলেই বিয়ে করে নিবো খুকী। ভাইয়াকেও বলতে হবে তোমার কথা।
কথা আর কিছু বললো না দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। তবুও কথার মন ঠিক হচ্ছে না। বারবার আরমানের কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে। আর একটা প্রশ্ন মনে ঘুরঘুর করছে মেয়েটা কে ছিলো আর কী হয়েছিলো ? যার উত্তর হয়তো আর কোনোদিন পাওয়া সম্ভব নয়। সময়ের সাথে সাথে হয়তো প্রশ্নটাও মাটি চাপা পড়ে যাবে।
৫৭.
আরমান এখন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো কারণ মেয়েটা বকবক করে ঘুমিয়ে পড়েছে। আরমান মনে মনে দোয়া করছে জার্নি শেষ হওয়ার আগে যেনো মেয়েটার ঘুম আর না ভাঙে। কিন্তু অনেক লম্বা জার্নি তাই দোয়াটা কবুল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আরমান একবার মেয়েটাকে স্ক্যান করে নিলো। পায়ে হোয়াইট কেডস, ব্লো জিন্স প্যান্টের সাথে ব্লো আর হোয়াইট কম্বিনেশনের একটা লং টপস আর গলায় স্কার্ফ ঝুলানো। এসব পোশাক আরমানের একদমই পছন্দ না। মুখের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই চোখে পড়লো চশমার আড়ালে বন্ধ চোখ জোড়া, চিকন নাকের উপর চশমাটা আলগা হয়ে আছে, ঠোঁট দুটো গাড়ো গোলাপি, এতক্ষণ ননস্টপ নড়লেও এখন চুপ করে আছে। ঝুঁটি করা চুলের কিছু চুল বের হয়ে গালের উপর পড়ে আছে। ধবধবে সাদা মুখে মেক-আপের ছোঁয়া নেই। এতোটাই সাদা মেক-আপের হয়তো প্রয়োজনই পড়েনি। মর্ডাণ হলেও উশৃংখল মনে হচ্ছে না। আরমান আবার উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকালো। এখন কোন দেশের উপরে আছে তার জানা নেই তবে নিজের জন্মভূমি অনেক সময় আগেই পেছনে ফেলে এসেছে সেটা ভালো করেই জানে। আবার বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলো আরমানের। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলো সীটে।
আপনি কী ঘুমিয়ে পড়েছেন ?
আরিশার আওয়াজ কানে আসতেই আরমানের এখন কান্না করতে ইচ্ছে করছে। এখনই তো ঘুমালো আবার ঘুম ভেঙে গেছে মানে এখন আবার আরমানের মাথা চিবিয়ে খাবে।
আরমান চোখ খুলে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো, প্রবলেম কী আপনার ?
আরিশা আবার চশমা ঠিক করে বললো, মানে ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছিল কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে তাই ঘুম ভেঙে গেলো।
আরিশার কথা শুনে আরমান শুকনো মুখে বিষম খেলো।
চলবে,,,,