তিক্ততার সম্পর্ক পর্ব -৪১+৪২+৪৩+৪৪

#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪১

ইশান কথার প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উঠে চলে যেতে নেয় কিন্তু কথা পেছন থেকে হাত টেনে ধরে ইশানের।

ইশান ঘুরে না তাকিয়েই বলে উঠে, কথা হাতটা ছাড়ো কথা।

কথা শান্ত গলায় বলে, হাতটা ছাড়ানোর আগে ভালো করে একবার ভেবে নিন। আজ যদি এই হাতটা ছাড়তে হয় আর কোনোদিন কিন্তু ধরার সুযোগ পাবেন না।

ইশান হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়াচ্ছিল কিন্তু কথার বলা শেষ হতেই ইশান শান্ত হয়ে যায় আর বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায় কথার দিকে। ইশান কথার দিকে তাকাতেই কথা ইশারায় বুঝায়, সে যা বলেছে একদম সত্যি, কোনো মজা করেনি।

কথা ইশানের হাত ধরে রেখেই বললো, উত্তরটা কিন্তু এখনো পাইনি আমি।

ইশান অসহায় গলায় বললো, কাউকে ভালোবাসি বলার অধিকার আমার বাবা-মা আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে। যার প্রতিটা রক্তকণিকায় দুজন খুনীর রক্ত বইছে তার কাউকে ভালোবাসি বলার যোগ্যতা নেই।

কথা ইশানের হাত ছেড়ে দিয়ে ইশানের পাশে দাঁড়ালো আর বললো, বাবা-মায়ের অন্যায়ের শাস্তি সন্তান কেনো পাবে ? তারা পাপ করেছে তাদের পাপের শাস্তি তারা পেয়েছে। তাদের পাপের শাস্তি আপনি কেনো পাবেন ?

খুনী বাবা মায়ের সন্তান হয়ে জন্মানোই আমার অপরাধ।

কথা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, যেমন কালো হয়ে জন্মানোটা আমার অপরাধ ?

ইশান গলার স্বর কঠিন করে বললো, আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাআ’লা সৃষ্টি করেছে। কালো হয়ে জন্মানো তোমার কোনো অপরাধ নয়।

কথা এবার ইশানের চোখে চোখ রেখে বললো, কালো হয়ে জন্মানো যদি আমার অপরাধ না হয় তাহলে খুনীর সন্তান হয়ে জন্মানোটাও আপনার অপরাধ নয়। আপনি নিজের বাবা-মা নিজে ঠিক করেননি। আল্লাহ তাআ’লা যাদের আপনার বাবা-মা ঠিক করেছেন তারাই আপনার বাবা-মা হয়েছে। তারা অন্যায় করেছে, তার শাস্তিও তারাই ভোগ করেছে, এতে আপনার কোনো দোষ নেই।

ইশান আর কিছু না বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলো আর কথা সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো। অনেক বড় আঘাত পেয়েছে ইশান, এতো সহজে সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবে না।

৪৩.
ইয়াদ আর ইমা সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো। দুদিন বেশ ইনজয় করেছে দুজনেই। ইয়াদের জামাই আদর পাওয়ার সখ মিটে গেছে আর এসবে ইমা বেশ মজা নিয়েছে। সারা গ্রাম ঘুরে দেখিয়েছে ইয়াদকে। ইমা তার বাবা-মায়ের পুরনো বাড়িতে গিয়েছিলো। এতো বছরে সব জঙ্গল আর ধুলোবালিতে ঢাকা পরে গেছে। ইমার নানা বাড়ির মালিক এখন অন্য মানুষ তাই সেখানে যাওয়া হয়নি। দুদিন গ্রামে থেকে আজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে ইয়াদ আর ইমা। আসার আগে তৌহিদুর আর তাহেরকে বারবার বলে এসেছে ইয়ানার বিয়েতে আসতে। তৌহিদুর ইমাকে বলে দিয়েছে যখনই ইচ্ছে হয় যেনো তৌহিদুরের বাসায় চলে যায়। সেটাই ইমার বাবার বাড়ি এখন থেকে।

ইয়াদ গাড়ি ড্রাইভ করছে ইমা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, এখন থেকে রাগ করে বাবার বাড়ি চলে যেতে পারবো কিন্তু।

ইয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, বাই চান্স, তুমি কী আমাকে ভয় দেখাচ্ছো ?

ইমা মজা করে বললো, বাবাহ, আমার ঘাড়ে কটা মাথা আবরার হামিদ ইয়াদকে ভয় দেখাবো ?

ইয়াদ কিছু বললো না সামনে দেখে ড্রাইভ করতে লাগলো চুপচাপ। তা দেখে ইমা আবার বললো, আপনি কী ভয় পান নাকি ?

ইয়াদ সামনে দৃষ্টি রেখে বললো, পৃথিবীর সব পুরুষরাই তাদের স্ত্রীকে ভয় পায়। আর কাউকে পাক আর না পাক স্ত্রীকে অবশ্যই ভয় পায়।

ইমা ইয়াদের দিকে হালকা ঘুরে বললো, তার মানে আপনিও আমাকে ভয় পান ?

ইয়াদ ছোট ছোট চোখ করে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কী মনে হয়, আমি তোমাকে ভয় পাই ?

ইয়াদের তাকানো দেখে ইমা নিজেই ভয় পেয়ে গেলো আর সোজা হয়ে বসে সামনে তাকিয়ে বললো, আপনি আর ভয় দুইটা বিপরীত শব্দ মনে হয় আমার কাছে। আপনি ভয় পাবেন আমাকে ? সেটা কোনোদিন হবে না।

ইয়াদ বিড়বিড় করে বললো, হ্যাঁ আমি তো বোকা। তোমাকে বুঝতে দেই আমিও তোমাকে ভয় পাই আর তুমি আমার মাথায় উঠে বসে থাকো।

গাড়ি থামান গাড়ি থামান।

ইমার চিৎকারে ইয়াদ ভয় পেয়ে ব্রেক কষলো আর গাড়ি একটু গিয়ে থেমে গেলো। গাড়ি থামতেই ইমা নিজের সীট বেল খুলে লাভ দিয়ে নেমে গেলো গাড়ি থেকে।

ইয়াদ অবাক হয়ে বললো, আরে আরে কোথায় যাচ্ছো তুমি ?

ইয়াদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ইমা এক দৌড়ে রাস্তার অপর পাশে চলে গেলো ফুচকা স্টলের কাছে। কড়া ঝাল দিয়ে ফুচকা দিতে বললো। ইয়াদ নিজেও নেমে এসে ইমার সামনে দাঁড়ালো পকেটে হাত গুঁজে।

ধমক দিয়ে বললো, এভাবে কেউ আসে ? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

ইমা ফুচকা বানানো দেখতে দেখতে বললো, আমি জানি ফুচকার কথা বললে আপনি জীবনেও গাড়ি থামাতেন না।

ইয়াদ রেগে বললো, তো রাস্তার এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার জন্য কে গাড়ি থামাবে। তুমি জানো এইগুলো কীভাবে বানায় ? কত নোংরা,,,,

ইয়াদকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো, দেখুন ফুচকা নিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলুন, তবু এটা দেখলে না খেয়ে থাকতে পারবো না আমি। তাই শুধু শুধু কষ্ট করে এতো কথা বলে লাভ নেই।

ইয়াদ ফুচকাওয়ালাকে পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে ইমার দিকে তাকিয়ে বললো, যত ইচ্ছে খাও আর খাওয়া হয়ে গেলে গাড়িতে চলে এসো আমি গাড়িতেই আছি।

ইয়াদ হনহনিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লো আর ইমা ইচ্ছে মতো ফুচকা খেতে লাগলো। অতিরিক্ত ঝাল হওয়ায় চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে ইমার। খাচ্ছে আর হাত দিয়ে মুখে বাতাস করে যাচ্ছে। আর না পেরে খাওয়া বন্ধ করে গাড়িতে গিয়ে বসে কোনোমতে ইয়াদকে যেতে বললো। ইমার গলাটা কেমন যেনো লাগলো ইয়াদের কাছে তাই ঘুরে তাকালো। ইমাকে দেখে চমকে উঠলো ইয়াদ। চোখ, মুখ, ঠোঁট টকটকে লাল হয়ে গেছে, যেনো টাচ করলেই রক্ত বের হয়ে যাবে।

এ কী তোমার এই অবস্থা কেনো ?

ইমা ভেঙে ভেঙে বললো, ফুচকা অনেক ঝাল ছিলো।

ইয়াদের ইচ্ছে করছে ফুচকা ওয়ালাকে ধরে মরিচের গুঁড়োয় গোসল করাতে কিন্তু সেটা পারছে না, কারণ দোষ তার থেকে ইমার বেশি। ইয়াদ তাড়াতাড়ি পানির বোতল বের করে দিলে ইমা ঢকঢক করে সবটা শেষ করে দিলো। তবু হু হা করছে ঝালে। ইয়াদ কী করবে বুঝতে না পেরে ইমার দুগাল ধরে কাছে এনে মুখে ফু দিতে লাগলো। ইয়াদের হঠাৎ এমন কাজে ইমা ঝালের কথা ভুলে হা করে তাকিয়ে আছে ইয়াদের দিকে। ফু দিতে দিতে ইয়াদ আর ইমার ঠোঁট দুটো একদম ছুঁই ছুঁই করছে। ইমা পাথরের মতো বসে আছে, হঠাৎ ইমার ঠোঁটে হালকা ছুঁয়ে গেলো ইয়াদের ঠোঁট। তাতে ইয়াদও পাথরের মতো জমে গেলো।

অনেক সময় পর ইয়াদ সরে গেলো ইমার থেকে আর বললো, এখন ঠিক আছে ?

ইমা কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে বুঝালো সে ঠিক আছে। ইয়াদ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। একটু পর দুটো আইসক্রিম নিয়ে এসে ইমার হাতে দিয়ে খেতে বললো। ইমা একটা খোলে খেতে লাগলো। একটু পর আরেকটা খোলে ইয়াদের মুখের সামনে ধরলো। ইয়াদ ইমাকে অবাক করে দিয়ে নতুন আইসক্রিমটা সরিয়ে দিলো, ইমার খাওয়া আইসক্রিমটা টেনে নিলো। তারপর ইমার খাওয়া জায়গায় মুখ লাগিয়ে খেয়ে নিলো। ইয়াদের কাজে ইমা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো আর তা দেখে ইয়াদ মুচকি হাঁসলো। বাকিটা সময় দু’জন মিলেই দু’টো আইসক্রিম শেষ করলো। বাসায় এসে দেখে কথাকে যেতে দেয়নি ইয়ানা। সবাই একসাথে ডিনার করা শেষে কথা চলে যেতে চাইলো। জোর করলেও থাকতে রাজি হয় না তাই ইয়াদ ইশানকে বলে কথাকে পৌঁছে দিতে। ইশানের যাওয়ার ইচ্ছে না থাকলেও ভাইয়ার কথা অমান্য করার সাধ্য নেই।

ইশান ড্রাইভ করছে হঠাৎ কথা বলে উঠলো, ইয়াদ ভাইয়ার রোগ মনে হয় আপনার উপর টান্সফার হয়ে গেছে।

ইশান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললো, মানে ?

কথা ভাবুক ভঙ্গিতে বললো, দেখুন না ইয়াদ ভাইয়া এখন কত সুন্দর হাসি খুশি হয়ে কথা বলে আর আপনি মুখটা বাংলার পাঁচের মতো করে রাখেন।

ইশান না বুঝে বলে, বাংলার পাঁচ মানে কী ?

কথা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, সেটা তো আমিও সঠিক জানি না। যতদূর জানি এটা একটা কথার কথা।

ইশান ভ্রু কুঁচকে বললো, তোমার কথা ?

কথা নাক ছিটকে বললো, নাহ্ এই কথা সেই কথা না। ধূর আমার নামটা বেশ কনফিউজিং।

ইশান কথার অবস্থা দেখে আড়ালে মুচকি হাঁসলো। মেয়েটা বাস্তববাদী হলেও বেশ সহজ সরল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাকিটা পথ কথার বকবক শুনে পার হয়ে গেলো। মাঝে ইশানও দু একটা কথা বলেছে তবে আগের মতো নয়। কথা গাড়ি থেকে নেমে ইশানকে ভেতরে যেতে বললে ইশান না করে গাড়ি নিয়ে চলে আছে। যতক্ষণ ইশানের গাড়িটা দেখা যায় ততক্ষণ তাকিয়ে থেকে কথাও বাসার ভিতরে চলে যায়। কলিংবেলের শব্দে ছাহেরা বেগম দরজা খুলে দেয়।

কথাকে দেখে রাগী গলায় বলে, এটা কী বাড়ি নাকি হোটেল যখন ইচ্ছে যাচ্ছো যখন ইচ্ছে আসছো ? তুমি যাওয়ার আগে আমাকে বলে গিয়েছিলে, নাকি থাকার আগে আমাকে জানিয়েছো ?

কথা ভেতরে যেতে যেতে বললো, আমি ইমা আপুদের বাড়িতে গিয়েছিলাম। এখানে বলার কী আছে ?

ছাহেরা বেগম রেগে বললো, কথা আমি তোর মা, তুই কোথায় যাবি, সেটা আমাকে বলে যাবি না ?

রাগটা দমিয়ে রাখলেও আর পারলো না কথা। রেগে চিৎকার করে বললো, মা কে মা, আপনি ? মা কাকে বলে সেটা আপনি জানেন ?

ছাহেরা অবাক হয়ে বললো, তুই কীভাবে কথা বলছিস আমার সাথে ?

কথা উঁচু গলায় বললো, কেনো কষ্ট হচ্ছে আমার এমন ব্যবহারে ? এর থেকেও অনেক বেশি কষ্ট, তুমি মনিমাকে দিয়েছো, ইমা আপুকে দিয়েছো ? তুমি এতটা জঘন্য মানুষ আমি সেটা ভাবতেও পারিনি আমি। তুমি ইমা আপুর মনে মণিমাকে নিয়ে এতো এতো খারাপ ধারণা তৈরি করেছিলে যে মানুষটা মরার আগেও নিজের মেয়েকে এবার কাছে পায়নি।

ছাহেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে কথার দিকে। মেয়েটা এসব কথা কোথা থেকে জানতে পারলো সেটা বুঝে উঠতে পারছে না।

কথা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, কী ভাবছো, আমি এসব কোথা থেকে জানতে পারলাম ? তোমার কুকীর্তির কথা মণিমা সুন্দর করে চিঠিতে জানিয়ে গিয়েছে আপুকে। আর গতকাল রাতে আমার ফোন খুঁজতে খুঁজতে আপুর রুমের ড্রয়ারে এলবাম আর মণিমার চিঠি পেয়ে যাই। আমার ভাবতে ঘেন্না লাগছে তুমি আমার মা। তবে তুমি এবার বুঝতে পারবে সন্তান থেকেও না থাকার যন্ত্রণা কাকে বলে। তুমি যেমন মণিমার থেকে ইমা আপুকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে আমি নিজেই তোমার থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যাবো। তারপর তুমি বুঝতে পারবে মণিমার কষ্টটা।

ছাহেরা ভয়ে ভয়ে বললো, কথা তুই আমাকে ভুল বুঝেছিস।

কথা কড়া গলায় বললো, হ্যাঁ ভুল বুঝেছিলাম এতোদিন, এবার ঠিক বুঝেছি।

কথাগুলো বলে এক মুহুর্ত ছাহেরার সামনে দাড়ালো না কথা। নিজের রুমে চলে গেলো। পরিবারের ঝামেলা থেকে কথা বরাবরই দূরে থাকে তাই এসবের কিছুই জানতো না। গতরাতে ইমার রুমে ফোন খুঁজতে গিয়ে চিঠিটা পেয়ে যায় আর চিঠি পরে নিজের মায়ের আসল রুপ জানতে পারে কথা। নিজের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পেলো আরমান। সেও ভাবতে পারছে না তার মা নিজের বোনের সাথে এমন জঘন্য অন্যায় করেছে। আরমানও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো মায়রে থেকে। আরমান ইমার সাথে কম অন্যায় করেনি কিন্তু তার জন্য সে প্রতি মুহূর্তে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে এসেছে কিন্তু তার মায়ের মধ্যে কোনো অনুশোচনাও নেই। এতো কিছুর পরও নিজের সাফাই গাইতে চাইছিলো।

ছাহেরা বেগম ঘুরে আরমানকে দেখে বললো, দেখেছিস তোর বোন কতটা বেয়াদব হয়েছে ?

আরমান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, পাপ কাউকে ছাড়ে না মা। যা করেছো তার ফল তো ভোগ করতেই হবে।

আরমানও নিজের রুমে চলে গেলো আর ছাহেরা ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। সে একদিন মেয়ের এমন ব্যবহার মানতে পারছে না আর তাহেরা কতগুলো বছর এসব সহ্য করেছে।

৪৪.
বিয়ের শপিং করতে এসেছে ইয়ানা আর রেহান। ইয়ানার সাথে ঘুরতে ঘুরতে রেহানের মাথা ঘুরছে এখন।

রেহান ক্লান্ত গলায় বললো, ইয়ানা একটা বেনারসি খোঁজার জন্য পুরো মল ঘুরা শেষ তবু তোমার পছন্দ হচ্ছে না ?

ইয়ানা বেনারসি দেখতে দেখতে বললো, দেখুন বিয়ে জীবনে একবারই আসে। তাই সবকিছু মন মতো হওয়া চাই। আপনার কষ্ট হলে বাসায় চলে যান আমি একাই করতে পারবো।

রেহান বোকার মতো হেঁসে বললো, আরে না না কষ্ট হবে কেনো ? তোমার যতক্ষণ লাগে শপিং করো।

ইয়ানা তুমি এখানে ?

আরমানের গলা শুনে চমকে ইয়ানা পেছন ফিরে তাকালো। আরমান কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে। রেহান ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরমানের দিকে।

রেহান একবার আরমানকে দেখে নিয়ে ইয়ানার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ইয়ানা উনি কে ?

ইয়ানা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে আর রেহান তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে।

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪২

রেহান একবার আরমানকে দেখে নিয়ে ইয়ানার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ইয়ানা উনি কে ?

ইয়ানা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে আরমানের দিকে আর রেহান তাকিয়ে আছে ইয়ানার দিকে।

ইয়ানা আলতো করে রেহানের হাত আঁকড়ে ধরে আরমানের উদ্দেশ্যে বললো, আসসালামু আলাইকুম স্যার।

রেহান একবার ইয়ানা ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে ইয়ানার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে বললো, স্যার ?

ইয়ানা হাসি মুখে রেহানের দিকে তাকিয়ে বললো, উনি আমার ভার্সিটির টিচার মিস্টার আরমান মাহমুদ আর রেহান হচ্ছে আমার বাগদত্তা।

ইয়ানা পরের কথাটা আরমানের দিকে মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো। রেহান আরমানের সাথে হাত মিলিয়ে সৌজন্যমূলক কথা বললো। আরমান চলে গেলে রেহান ইয়ানাকে বেনারসি দেখতে বললো কিন্তু ইয়ানার আর কিছুতেই মন লাগছে না।

রেহানকে বললো, আমার এগুলো ভালো লাগছে না, ভাইয়াকে বলে দেবো ডিজাইনার দিয়ে ডিজাইন করে দিতে।

রেহান কিছু একটা ভেবে বললো, ঠিক আছে বেনারসি থাক তুমি জুয়েলারি আর বাকি যা যা লাগে যেসব দেখো।

ইয়ানা মলিন হেঁসে বললো, আমার শরীরটা খারাপ লাগছে অন্যদিন শপিং করবো আজ বাসায় চলুন।

রেহান ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে তোমার, বেশি খারাপ লাগছে ? আমাকে বলো কোথায় কষ্ট হচ্ছে। না চলো হসপিটালে গিয়ে টেস্ট করলেই বুঝা যাবে।

রেহানের ব্যস্ততা দেখে ইয়ানা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

আরে আপনি এতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো ? এমনই ঘুরাঘুরি ভালো লাগছে না আজ আর, অন্যদিন করবো বাকি শপিং।

রেহান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, ঠিক আছে ফুডকোর্টে গিয়ে আগে খাওয়াদাওয়া করে নেই।

ইয়ানা আর কথা বাড়ালো না রেহানের সাথে ফুডকোর্টে চলে গেলো। আরমানের কথা ভেবে নিজেদের স্পেশাল মোমেন্ট নষ্ট করার মানেই হয় না। তাই ঠিক করলো কিছু খেয়ে তারপর শপিং করবে আবার।

৪৫.
আজ কথার ক্লাস নেই, কথা ক্লাসে বসে আছে গালে হাত দিয়ে। ক্লাসে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছে তার কিন্তু বাসায় যেতেও ইচ্ছে করছে না। কী করবে সেটা ভেবে হঠাৎ ইশানের কথা মাথায় এলো। ঝটপট নিজের ফোন বের করে ইশানকে কল দিলো। দুবার রিং হয়ে কেটে গেলো কিন্তু ইশান রিসিভ করলো না। কথাও জেদ ধরে দিতেই থাকলো।

ইশান রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো, হ্যালো,,,

কথা ইশানকে পুরোটা শেষ করতে না দিয়ে অস্থির গলায় বললো, এখনই আমার কলেজের সামনে আসুন প্লিজ। একদম লেট করবেন না এখনই আসুন, লেট করলে কিন্তু অনেক বড় বিপদ হয়ে যাবে।

কথাটা শেষ করে কল কেটে দিলো কথা। অপর পাশ থেকে ইশান ব্যস্ত গলায় হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। ইশান আবার ট্রাই করলে কথার ফোন সুইচ অফ বলছে। ইশান অলরেডি ঘামতে শুরু করেছে টেনশনে। কথা এভাবে কেনো বললো তার কোনো বিপদ হলো নাকি সেটা ভেবে ইশানের চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটলো কথার কলেজে। এদিকে কথা জোশে পরে এভাবে বলে ফেলেছে কিন্তু এখন ভয়ে কাঁপা-কাঁপি করছে ইশান তার কী অবস্থা করবে সেটা ভেবে। দশ মিনিটের মধ্যে ইশান কথার কলেজের গেইটের সামনে গাড়ি থামালো। কথা গেইটের সামনেই দাড়িয়ে ছিলো ইশান দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে কথার সামনে দাড়িয়ে কথার হাত মুখ ভালো করে চেক করতে লাগলো।

ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে এভাবে আসতে বললে কেনো ?

কথা অবাক হয়ে বললো, আরে কী হবে ? এমনই আসতে বলেছি আপনি এমন করছেন কেনো ?

ইশানের মাথা গরম হয়ে গেলো কথার এমন হেয়ালি দেখে আর রেগে ধমক দিয়ে বললো, এমনই এমনই কেউ এভাবে আসতে বলে ? জানো আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কীভাবে ড্রাইভ করে এসেছি তোমার কোনো আইডিয়া আছে ইউ ইস্টুপিট ?

কথা ইশানের ধমক খেয়ে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। মাটির দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইশানের বলা শেষে চুপ হয়ে গেলে কথা ঘুরে কলেজের ভেতরে যেতে চাইলে ইশান হাত টেনে ধরে বলে, কী হলো কিছু না বলে এখন আবার কোথায় যাচ্ছো ?

কথা গাল ফুলিয়ে বলে, আপনাকে আর কিছুই বলবো না আমি। আপনি কতগুলো বকা দিয়েছেন আমাকে।

ইশান এবার শান্ত গলায় বলে, আরে বাবা তুমি ওভাবে ডাকছিলে। আমি ভেবেছি তোমার কোনো বিপদ হয়েছে, তাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

কথা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, আমার বিপদ হলে আপনার কী ?

ইশান বিড়বিড় করে বললো, সেটা যদি বুঝতেই পারতে তাহলে এভাবে কষ্ট দিতে না।

ইশানের কথা বুঝতে না পেরে কথা আবার একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে ইশান জানালো কিছু বলেনি সে। আর জানতে চাইলো ইশানকে এভাবে ডাকার কারণ। কথাও গরগর করে ক্লাসের বিষয়ে সব বলে দিলো। ইশান কিছু একটা ভেবে বললো গাড়িতে উঠে বসতে।

কথা জানলা দিয়ে বাইরে দেখে বললো, কোথায় যাচ্ছি আমরা ?

ইশান দুষ্টুমি করে মুচকি হেঁসে বললো, আজ যেদিকে চোখ যায় সেদিকে চলে যাবো।

কথা মুগ্ধ হয়ে দেখলো ইশানের সেই হাসি আর আনমনে বলে উঠলো, আপনি সবসময় এমন হাসতে থাকবেন। আপনার গম্ভীর মুখ মানায় না এমন হাসি খুশি ভালো লাগে।

ইশান হাসিটা বজায় রেখে কথার দিকে তাকিয়ে বললো, কিছুদিনের জন্য হাসিটা বিসর্জন দিয়ে অনেক মূল্যবান কিছু পেয়ে গেছি।

কথা ছোট ছোট চোখে ইশানের দিকে তাকালে ইশান হা হা করে হাসতে লাগলো আর কথা ইশানকে চড় থাপ্পড় দিতে লাগলো। ইশানের হাসি থামছেই না আর কথা তাকে মেরেই যাচ্ছে।

৪৬.
সারা বাড়ি সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আজ ইয়ানার বিয়ে গতকাল গায়ে হলুদ গেছে। তাকে দেখতে আজ লাল পরীর মতো লাগছে। ইয়াদ আর ইশান খুব ব্যস্ত সময় পার করছে। ইশানের দায়িত্ব পরেছে গেস্টদের এটেন্ড করা আর ইয়াদ সবদিক দেখছে। ইয়ানাকে সাজানো হচ্ছে একটু পরই বরযাত্রী চলে আসবে।

ইয়ানা আপু তোমার হলো, বরযাত্রী চলে আসবে তো।

শাড়ীর আঁচল ঠিক করতে করতে ইয়ানার রুমে ঢুকে ইমা কথাটা বললো। সামনে তাকিয়ে ইয়ানাকে দেখে কথা বন্ধ হয়ে গেলো ইমার।

ইমা ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আজ রেহান ভাইয়ার হুঁশ উঠে যাবে তোমাকে দেখে।

ইমার গলা শুনে ইয়ানা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। পেছনে ঘুরে ইমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো। ইমা প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও নিজেকে সামলে ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরলো।

ব্যস্ত গলায় বললো, কী হয়েছে আপু তুমি কাঁদছো কেনো ?

ইয়ানা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ভাইয়াকে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো ? ভাইয়াকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারবো না।

ইমা কী বলবে বুঝতে পারছে না ? ইয়ানা জ্ঞান হবার পর থেকেই ইয়াদের সাথে থেকেছে সবসময়। ইয়ানা যেমন ইয়াদের জান, ইয়াদও ইয়ানার জান বলা যায়। ইমা শান্তনা দেওয়ার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না। ইমা খেয়াল করেছে গত দুদিন ধরে ইয়াদের মনটাও ভার হয়ে আছে।

ইমা ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আপু তুমি তো দূরে কোথাও যাচ্ছো না, ইচ্ছে করলেই তোমার ভাইয়ার কাছে চলে আসতে পারবে।

ইয়ানা তবু নিঃশব্দে কান্না করতে লাগলো। কথা এতক্ষণ চুপচাপ দেখছিলো, এবার ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এটা কী করছো ইয়ানা আপু ? এতো কষ্ট করে উনারা সাজালো সব কেদে নষ্ট করে দিচ্ছো ? এবার তো তোমাকে দেখে রেহান ভাইয়া ভুত ভেবে ভয়ে পালাবে।

ইয়ানা ইমাকে ছেড়ে কথার দিকে তাকালো কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে। কথা সবকটা দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে লাগলো আর ওর হাসি দেখে ইয়ানা আর ইমাও হেঁসে দিলো। হঠাৎ হুড়মুড়িয়ে চার পাঁচটা মেয়ে ঢুকলো আর ইয়ানার সাথে মজা করতে লাগলো। ইমা তাদের চেনে তারা সবাই ইয়ানার ফ্রেন্ড। নিচ থেকে বর এসেছে আওয়াজ আসতেই সবাই নিচে চলে গেলো শুধু ইয়ানার বেস্টফেন্ড নিধি রয়ে গেলো।

নিধি ইয়ানার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো, তুই কী রেহান ভাইয়াকে ঠকাচ্ছিস না, ইয়ানা ?

নিধির মুখে এমন কথা শুনে ইয়ানা চমকে উঠলো, অবাক হয়ে তাকালো নিধির দিকে।

কীসের ঠকানোর কথা বলছিস তুই ?

নিধি দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, তাকে কিন্তু তুই বলিসনি তুই অন্য একজনকে ভালোবাসিস।

ইয়ানা কাঠ কাঠ গলায় বললো, ভালোবাসি না ভালোবাসতাম।

নিধি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ইয়ানা ভালোবাসার কখনো পাস্ট টেন্স হয় না। ভালোবাসতাম, ভালোবাসি বা ভালোবাসবো বলে কোনো শব্দ হয় না। ভালোবাসার একটাই শব্দ হয় আর সেটা হলো ভালোবাসি। কোনোদিন যদি তুই বলিস তুই আরমান স্যারকে আগে ভালোবাসতি এখন আর বাসিস না। তাহলে বুঝে নেবো তুই কোনোদিন তাকে ভালোই বাসিসনি। যা ছিলো সেটা তোর আবেগ বা মোহ।

ইয়ানা নিধির কথা শুনে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো আর বললো, তুই এখন কী করতে বলছিস আমাকে, তুই বল। যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি তার মনে আমার জন্য ভালোবাসা তো দূর ভালোলাগাও নেই। আর যে মানুষটাকে আমি বিয়ে করছি সে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে।

নিধি ইয়ানার থেকে চোখ সরিয়ে বললো, আমি বলছি না তুই বিয়েটা ক্যান্সেল করে দে। শুধু এটাই বলতে চাইছি রেহান ভাইয়ার থেকে কিছু লুকিয়ে তার সাথে মিথ্যা ভালোবাসার অভিনয় করে তাকে ঠকাস না। মানুষটা সম্পর্কে যতটা জেনেছি সে ধোঁকা ডিজার্ভ করে না।

ইয়ানা বেডে বসে বললো, তাকে আমি কখনো ঠকাবো না। যেদিন সত্যি তাকে ভালোবাসতে পারবো সেদিন তাকে ভালোবাসি বলবো। আমার বিশ্বাস সে আমাকে যথেষ্ট সময় দেবে। আর আমার সামনের জীবনে আমি অতীতের কোনো জায়গা রাখবো না। আমি আরমান স্যারকে কোনো দোষ দেই না কারণ তার মনে অন্যকেউ আছে সেটা জেনেই তাকে ভালোবেসেছিলাম। যে আমার না তাকে জোর করে আমার করতে চেয়েছিলাম।

নিধি বললো, ইয়ানা তুই একবার স্যারকে বলে দেখতে পারতি, তুই তো কোনোদিন তাকে কিছু বলিসনি।

ইয়ানা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, আরমান স্যার ভার্সিটির নতুন ম্যামকে ভালোবাসে।

নিধি অবাক হয়ে বললো, কী সব বলছিস আবোল তাবোল ?

ইয়ানা সেদিন আরমানের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে যা যা দেখেছিলো সব নিধিকে খোলে বললো।

নিধি মাথায় হাত দিয়ে বললো, আরে গাধী তুই পুরোটা না দেখেই ভুল বুঝেছিস। সেদিন তোকে স্যারের কেবিনের সামনে দেখে আমি এগিয়ে আসি কিন্তু তুই ততক্ষণে চলে যাস আর তখনই রুমের ভেতর থেকে স্যারের গলা শুনে আমি তাকিয়ে দেখি স্যার গোলাপ ফুলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে ম্যামকে বলছে দুঃখীত সে অন্যকাউকে ভালোবাসে আর ভদ্রভাবে ম্যামের ফুলগুলো ফিরিয়ে দেয়।

ইয়ানা নিধির কথা শুনে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে বললো, সে অন্যকাউকে ভালোবাসে আর সেটা আমি নই, সেটা কে তুইও জানিস আর আমিও ভালো করেই জানি। ম্যামকে যেমন ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকেও ফিরিয়েই দিতো। তার থেকে কিছু ভালোবাসা অপ্রকাশিত থেকে যাওয়াটাই ভালো নয় কী ?

নিধি এগিয়ে গিয়ে ইয়ানাকে শান্তনা দিতে লাগলো। একটু পরই ইয়ানাকে নিচে নিয়ে যাওয়া হলো। রেহান মুগ্ধ হয়ে দেখছে আজ তার স্বপ্নের রানীকে। ইয়ানাকে দেখে ইয়াদের চোখ ভরে উঠলো পানিতে আর ইশান গিয়ে ইয়াদকে সামলে নিলো। ইয়ানার চোখদুটো আশেপাশে সেই মানুষটাকে খুঁজছে। চিরদিনের জন্য অন্যকারো হয়ে যাওয়ার আগে প্রিয় মানুষটার মুখ একবার দেখে নিতে ইচ্ছে করছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলো সেই কাংখিত মানুষটাকে। যাক ইয়ানা শেষ অনুরোধটা রাখতে এসেছে তাহলে। নীল রঙের পাঞ্জাবির উপর কালো কটি পরা, কুঁকড়া চুলগুলো আজ আরো বেশী কুঁকড়া লাগছে, চোখে সানগ্লাস আর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি। আজ রেহানকেও কিছু কম লাগছে না খয়েরী রঙের শেরওয়ানিতে কিন্তু ইয়ানার সেদিকে খেয়াল নেই। ইয়ানা আরমানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে ইমাকে দেখতে পেলো। কথার সাথে দাঁড়িয়ে কোনো কিছু নিয়ে হাসিতে ঢলে পরছে ইমা আর তার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসছে আরমান আর চোখ ভরা পানি নিয়ে আরমানের দিকে তাকিয়ে আছে ইয়ানা।

সবার চোখের আড়ালে চোখের পানিটুকু মুছে নিলো ইয়ানা আর বিড়বিড় করে বললো, আপনি সত্যি ভালো বেসেছিলেন ইমাকে তবে সেটা বুঝতে অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আমিও আপনাকে সত্যি ভালো বেসেছিলাম। আর সেটা ঠিক সময়ে বুঝতেও পেরেছি কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না কখনো, ভালো থাকবেন স্যার।

একটা সাইন আর পর পর তিনবার কবুল বলে ইয়ানা হামিদ আজ থেকে মিসেস রেহান আহমেদ হয়ে গেলো। রেহানের ঠোঁটের কোণে প্রাপ্তির হাসি আর ইয়ানার চোখের কোণে হারানোর কষ্টের পানি। আরমানের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ইমার হাসিমুখ দেখে, ইমা মুগ্ধ হয়ে দেখছে নিজের ভালোবাসা নিজের স্বামীকে আর ইয়াদও মুগ্ধ হয়ে ইমাকে দেখছে। ইমাকে আজ একদম পরীর মতো লাগছে। একেকটা দৃষ্টির ভাষা আজ এক এক রকম অনুভূতি প্রকাশ করছে।

বেশ রাত হয়ে গেলো ইয়ানার বিদায়ের সময়। ইয়াদ আর ইশানকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ইয়ানা। ইশান শব্দ করে কেঁদে দিলেও ইয়াদ নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। তাদের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভাই বোনের কান্না দেখে ইমা আর কথাও কেঁদে দিলো। ইয়ানাকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে ইয়াদ দ্রুত রুমের দিকে চলে গেলো আর ইশান সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ গাড়ি বাড়ির গেইট পেরিয়ে না গেলো। কথা আজ যাবে না তাই আরমান তাকে রেখে আগেই বাড়ি চলে গেছে। ইয়ানা চলে গেলে ইমা ইয়াদকে খুঁজতে রুমে চলে গেলো। ইমা রুমে গিয়ে দেখে রুম অন্ধকার, লাইটের সুইচ দিয়ে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে এক কর্ণারে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখলো ইয়াদকে। ইমা ইয়াদের সামনে গিয়ে ফ্লোরে বসে ইয়াদের কাঁধে হাত রাখলো। ইয়াদ হুট করে ইমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ইয়াদের কান্না দেখে মনে হচ্ছে অনেকটা সময় চাপা দিয়ে রাখা কান্নাটা ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসছে এখন। ইমা ইয়াদকে বাঁধা দিলো না বরং নিজের দু’হাত ইয়াদের পিঠে রাখলো।

ইয়াদ কাঁদতে কাঁদতে বললো, ইমা আমার ছোট পুতুলটা আজ অন্য কারো হাতে তুলে দিলাম। ইমা আমার ভয় করছে আমার কলিজাটাকে ভালো রাখবে তো রেহান ? আমার কলিজাটা ভালো না থাকলে আমিও যে শান্তিতে থাকতে পারবো না।

ইমা শান্তনা দিয়ে বললো, রেহান ভাইয়া অনেক ভালো মানুষ, আপুকে ভালোবাসে। আপনি চিন্তা করবেন না ইয়ানা আপুকে ভালো রাখবে সে।

ইয়াদ শান্ত হতে পারলো না ইমাকে জড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। এদিকে ছাঁদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে ইশান। বাড়ি এখন প্রায় খালি, নিকট আত্নীয় কেউ না থাকায় বিয়ে শেষেই সবাই চলে গেছে। ইশানের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। কথা গিয়ে নিঃশব্দে ইশানের পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো।

ইশান কথার দিকে না তাকিয়েই বললো, জানো কথা, ভাইয়া যেদিন আপুকে নিয়ে ইউকে চলে গিয়েছিলো সেদিনও আমার খুব কষ্ট হয়েছিলো। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম ভাইয়া আর আপু চলে যাওয়ার পর। অনেকগুলো বছর পর যখন দুজনেই ফিরে এলো তখন আমার মনে হয় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি। আপুটা আজ আবার আমাদের ছেড়ে অন্যের বাড়ি চলে গেলো। সেবার তো ফিরে এসেছিলো কিন্তু এখন ফিরে আসবে না আর কখনো। আসবে দু’এক দিনের জন্য অতিথি হয়ে।

কথাগুলো বলতে বলতে ইশানের চোখ থেকে টপটপ পানি পরতে লাগলো। কথা আলতো হাতে ইশানের চোখের পানি মুছে দিলো। ইশান মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকালো কথার দিকে। সেই দৃষ্টি কথার বুকে বিধলো তীরের মতো। ইশান আর কথা চুপচাপ বসে রইলো ছাঁদে পা ঝুলিয়ে। ইশানের চোখ থেকে মাঝে মাঝে পানির কণা গড়িয়ে পরছে।

৪৬.
ফুলে সাজানো বেডে ফুল পরীর মতো বসে আছে ইয়ানা। নিজেকে এই মুহূর্তে অনুভূতি শূন্য মনে হচ্ছে ইয়ানার কাছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিও মনে হয় শুকিয়ে গেছে। এখন কাঁদলে শুধু চোখ জ্বালা করে পানি বের হয় না। রুমটা তার পছন্দের রজনীগন্ধা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফুলের গন্ধে মনে হচ্ছে কোনো বাগানে বসে আছে সে। দরজা খোলার শব্দেও ইয়ানার কোনো হেলদোল হলো না। রেহান দ্রুত পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো সেটা ভালোই বুঝতে পারলো ইয়ানা। রেহান ইয়ানার হাত ধরে হেঁচকা টানে বেড থেমে নামিয়ে ফেললে ইয়ানা অবাক চোখে তাকালো রেহানের দিকে। হঠাৎ হেঁচকা টান দেওয়ায় মাথার ঘোমটা সরে গেছে। ইয়ানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রেহানের রাগী চেহারা।

চলবে,,,,#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৩

রেহান ইয়ানার হাত ধরে হেঁচকা টানে বেড থেকে নামিয়ে ফেললে ইয়ানা অবাক চোখে তাকালো রেহানের দিকে। হঠাৎ হেঁচকা টান দেওয়ায় মাথার ঘোমটা সরে গেছে। ইয়ানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রেহানের রাগী চেহারা।

ইয়ানা ভয়ে ভয়ে বললো, কী হয়েছে, আপনি এমন করছেন কেনো ?

রেহান ইয়ানাকে আরো অবাক করে দিয়ে হুট করে জড়িয়ে ধরলো। এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছে ইয়ানার মনে হচ্ছে সে রেহানের বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।

রেহান ইয়ানার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, কী হয়েছে সেটা তুমি বুঝতে পারবে না। এখন বলো ভয় পেয়েছো ?

রেহানের কথার উত্তর কী দেবে ইয়ানা। সে বরফের মতো জমে গেছে হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায়।

রেহানও আর কিছু বললো না চুপচাপ ইয়ানাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। বেশ অনেকটা সময় পর রেহান ইয়ানাকে ছেড়ে দুগাল ধরে মুখটা উঁচু করে বললো, ভয় পেয়েছো ?

ইয়ানা কোনোমতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো আর তাতে রেহান মুচকি হেঁসে বললো, ভয় দেখানোর জন্যই এমনটা করেছি। এতো বছর অপেক্ষা করানো আর ভয় পাওয়ানোর শাস্তি এটা। একটা দুটো দিন না, পুরো দশ থেকে বারোটা বছর অপেক্ষা করিয়েছো। আর এই বছরগুলোতে প্রতিটা মুহূর্ত আমি তোমাকে হারানোর ভয়ে ভয়ে থাকতাম। এতোগুলো বছর অপেক্ষা করার পর পেয়েছি তাই জড়িয়ে না ধরে থাকতে পারলাম না। তার জন্য কিছু মনে করো না। এর পর তোমার অনুমতি ছাড়া কখনো কাছে যাবো না।

রেহান হুট করে ইয়ানার কপালে কিস করে বললো, তবে ভেবো না কাছে যাবো না বলে একটু আকটু জড়িয়ে ধরা বা কিসও করবো না। এগুলোর জন্য তোমার অনুমতি নিবো না বলে দিলাম। যখন ইচ্ছে হবে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবো আর কিসও করবো।

ইয়ানা ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রেহানের কান্ড কারখানা দেখছে। লোকটা অতি খুশীতে পাগল হয়ে গেলো নাকি বুঝতে পারছে না।

রেহান ইয়ানার অবস্থা বুঝতে পেরে মুচকি হাঁসলো। সে নিজেও বুঝতে পারছে অতি খুশীতে সে অদ্ভুত আচরণ করছে কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করতেও পারছে না। রেহান ইয়ানাকে ছেড়ে এক হাত পরিমাণ দূরে গিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো ইয়ানার। রেহানের এমন কান্ডে ইয়ানা লজ্জা আর ভয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। রেহান কোমরে হাত দিয়ে ইয়ানার চারপাশে ঘুরে তাকে দেখতে লাগলো। হুট করে ইয়ানাকে কোলে তুলে নিলো পেছন থেকে, ইয়ানা ভয়ে রেহানের শেরওয়ানি খামচে ধরলো।

ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বললো, আরে আরে করছেন টা কী ? নামান আমাকে ফেলে দিলে কোমর ভেঙে যাবে তো।

ইয়ানা মোটেও হ্যাংলা পাতলা নয় আবার খুব বেশি মোটা তাও নয়। ইয়ানা তার হাইট অনুযায়ী পার্ফেক্ট ওজনের অধীকারিনী। তাই রেহানের কষ্ট হওয়ার কথা ইয়ানাকে কোলে তুলে।

কিন্তু রেহান বললো, চুপচাপ দেখো কী করি, নাহলে এমনি না ফেললেও ইচ্ছে করে আছাড় দিবো বলে দিলাম।

ইয়ানা ভয়ে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ থাকলো আর রেহান তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিয়ে নামিয়ে দিলো আর নিজে গিয়ে ইয়ানার পেছনে দাঁড়ালো। পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে ইয়ানার পেটের উপর হাত রাখলো। ইয়ানা কেঁপে উঠলো রেহানের এমন স্পর্শে। কিন্তু রেহানের কথায় তা বেশি সময় স্থায়ী হলো না।

রেহান ইয়ানার কাঁধে নিজের থুতনি রেখে বললো, দেখো তো আমাদের কেমন মানিয়েছে।

রেহানের কথা শুনে ইয়ানা অবাক চোখে মাথা ঘুরিয়ে রেহানের দিকে তাকালো। কিন্তু রেহান একহাতে ইয়ানার গাল ধরে আয়নার দিকে মুখ করিয়ে বললো, এদিকে না আয়নায় তাকিয়ে দেখো তো।

ইয়ানা রেহানের কথা শুনে আয়নায় দুজনকে দেখতে লাগলো। সত্যি খুব সুন্দর মানিয়েছে দুজনকে একসাথে। আজ প্রথম ইয়ানা রেহানকে ভালো করে পরখ করতে লাগলো আয়নায়। রেহান আর ইয়াদের উচ্চতা প্রায় সমান সমান, গায়ের রং ফরেনারের মতো, মাথায় ব্রাউন কালার সিল্কি চুল, চোখ দু’টো অনেকটা ব্রাউন কালার, ডান পাশে ভ্রুঁ তে একটা কাটা দাগ যেটা ইয়ানার দেওয়া বলা চলে। ইয়ানাকে বাঁচাতে গিয়ে একদিন গাছের গুঁড়ির উপর পরে গিয়েছিলো আর কেটে গিয়ে দাগটা রয়ে গেছে। রেহানের ঠোঁট দুটো অনেক চিকন আর লাল রঙের। খয়েরী রঙের শেরওয়ানিতে রেহানকে কোনো প্রিন্সের থেকে কম লাগছে না। ইয়ানার কেনো জানি মনে হচ্ছে রেহানের সাথে তাকে যতটা মানাচ্ছে আরমানের সাথে ততটা মানাতো না।

হঠাৎ রেহান ইয়ানার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, এভাবে তাকিয়ে থেকো না, বুকের ভেতরটা কেমন যেনো করে।

রেহানের এমন ফিসফিস কথায় ইয়ানার গায়ের লোম কাটা দিয়ে উঠলো আর লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো। রেহান টুপ করে ইয়ানার গালে একটা কিস করলে ইয়ানা আবার বড় বড় চোখ করে আয়নায় রেহানের দিকে তাকালো আর রেহান তা দেখে হা হা করে হাঁসতে লাগলো। ইয়ানা আবার চোখ নামিয়ে নিলো লজ্জায়।

রেহান হাসি থামিয়ে বললো, ফ্রেশ হয়ে ওযু করে এসো, একসাথে দু’রাকাআত নফল নামাজ আদায় করতে হবে।

ইয়ানা এবারও বেশ অবাক হলো রেহানের কথায় তবে সেটা প্রকাশ করলো না। দু’হাতে বেনারসি উঁচু করে ধরে ওয়াশরুমের দিকে যেতে গেলে রেহান হাত টেনে ধরলো পেছন থেকে।

ইয়ানা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রেহানের দিকে ঘুরে তাকালে রেহান বললো, আরে এভাবে ওয়াশরুমে যাবে নাকি ? আগে জুয়েলারি খুলে হালকা হয়ে তারপর যাও।

ইয়ানাও বাধ্য মেয়ের মতো ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসে জুয়েলারি খুলতে লাগলো। ইয়ানা হিমসিম খাচ্ছে দেখে রেহান হেল্প করতে লাগলো। ইয়ানা রেহানের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো। শুধু বেনারসিটা পরে একটা সবুজ রঙের জামদানী শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ইয়ানা ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেনারসিটা খোলে শাওয়ারে দাঁড়িয়ে গেলো। এতোক্ষণে বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা আবার উপলব্ধি করতে লাগলো ইয়ানা। বারবার চোখের সামনে আরমানের তখনকার সেই হাসি মুখটা ভাসতে লাগলো।

না না এসব আমি কী ভাবছি ? এখন আমি অন্যকারো স্ত্রী, উনার কথা ভাবাও এখন আমার জন্য পাপ। আমার জীবনে এখন শুধু একজনই আছে আর সে হচ্ছে রেহান।

ইয়ানা নিজের মনকে যতোই বুঝাক চোখ দিয়ে তার নোনাজল গড়িয়েই চলেছে। ইয়ানা চুপচাপ ভিজতে লাগলো। অনেকসময় পরেও যখন ইয়ানা বের হচ্ছে না তখন রেহান ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকতে লাগলো। কিন্তু ইয়ানার কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। রেহান সাড়া না পেয়ে ওয়াশরুমের দরজায় জোরে ধাক্কা দিতেই দরজা খোলে গেলো আর রেহান টাল সামলাতে না পেরে ভেতরে চলে গেলো। ইয়ানাকে দেখে রেহানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। ইয়ানা হঠাৎ রেহানকে দেখে প্রথমে বরফের মতো জমে গিয়েছিলো পরক্ষণে নিজের দিকে তাকিয়ে দু’হাত ক্রস আকারে বুকের উপর রেখে চিৎকার দিলো। ইয়ানার চিৎকার রেহানের হুঁশ ফিরলো, দু’হাতের তর্জনী আঙ্গুল কানে গুঁজে দ্রুত বের হয়ে আসলো। ইয়ানাও এবার দ্রুত শাওয়ার শেষ করে ড্রেস চেঞ্জ করে রাগী ফেস নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।

রেহান বেডে শুয়ে ছিলো, ইয়ানা কোমরে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আপনি এভাবে ভেতরে চলে গিয়েছিলেন কেনো ?

রেহান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো, তোমাকে এখন শাওয়ার নিতে কে বলেছে, যদি ঠান্ডা লেগে যায়, আর তুমি দরজা আটকাওনি কেনো ?

ইয়ানা রাগী গলায় বললো, আমি আটকাইনি বলে আপনি ভেতরে ঢুকে যাবেন ?

রেহান উঠে ইয়ানার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, এমন ভাব করছো, যেনো তোমাকে বিনা বস্ত্রে দেখে নিয়েছি।

ইয়ানা চোখ বড় বড় করে বললো, ছিহ্ আপনি তো দেখছি ভারী অসভ্য।

রেহান ইয়ানার কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বললো, অসভ্যর কিছু নেই তোমাকে সবভাবে দেখার রাইট আমার আছে বুঝলে ?

রেহান কথাটা শেষ করে একটা চোখ টিপ মারলো আর ইয়ানা রেগে রেহানকে মারতে শুরু করলো। রেহান ইয়ানাকে ছেড়ে এক দৌড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। একটু পরই আবার উঁকি দিয়ে নিজের ড্রেস চাইলো। রেগে বকবক করে ইয়ানাও দিয়ে দিলো। রেহান শাওয়ার নিয়ে বের হলো আর দু’জনে একসাথে নামাজ পরে নিলো। তখনকার জন্য ইয়ানার বেশ লজ্জা লাগছে এখন। ইয়ানা বেডে বসে ছিলো রেহান একটা টাওয়েল এনে যত্ন করে ইয়ানার চুল মুছে দিতে লাগলো আর এই অসময়ে শাওয়ার নেওয়ায় বকতে লাগলে। ইয়ানা যখন বললো নিজে কেনো তাহলে শাওয়ার নিয়েছে, তখন রেহান ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।

চুল মুছা হয়ে গেছে এখন লক্ষী মেয়ের মতো গিয়ে শুয়ে পড়ো।

ইয়ানা আমতা আমতা করে বললো, আমার আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।

রেহান খুশি হয়ে বললো, কথা আছে না ? আমারও অনেক কথা আছে কিন্তু তোমার ক্লান্ত লাগছে ভেবে ঘুমাতে বলছিলাম, ওয়েট।

রেহান হুট করে ইয়ানাকে কোলে তুলে বেলকনিতে নিয়ে দোলনায় বসালো। ইয়ানা কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দোলনায় বসে আছে। দোলনাটাও ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে সুন্দর করে।

রেহান ইয়ানার পাশে বসে বললো, নাও এবার বলতে থাকো।

ইয়ানা একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে রেহানকে প্রথম থেকে সবকিছু খোলে বললো। প্রথমে যে হাসি মুখটা নিয়ে এসেছিলো সেই হাসি মুখটা এখন আর নেই রেহানের।

ইয়ানা মাথা নিচু করে বললো, মিথ্যা দিয়ে সম্পর্কটা শুরু করতে চাইনি।

রেহান ইয়ানাকে অবাক করে দিয়ে ইয়ানার মুখটা দু’হাতে তুলে ধরে কপালে কিস করে বললো, ভালোবাসা যদি অন্যায় হতো তাহলে সে অন্যায় আমিও করেছি তোমাকে ভালোবেসে। তবে অন্যায়টা তখন হতো যদি আমার থেকে সত্যিটা লুকিয়ে মিথ্যা অভিনয় করতে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো আমি এতোটাও মহান না, নিজের বউয়ের মনে অন্যকারো বসবাস মেনে নিবো।

ইয়ানা এবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো রেহানের দিকে আর রেহানও অনুরোধের স্বরে বললো, বেশি না ইয়ানা, একটু ভালোবাসলেই হবে,বাকিটা আমার ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দেবো। তোমার মনে একটু জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করো।

ইয়ানা কিছু না বলে রেহানের কাঁধে নিজের মাথা এলিয়ে দিলো৷ রেহান নিজের উত্তর পেয়ে গেছে। আলতো করে ইয়ানার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কেউ আর কোনো কথা বলছে না আকাশের অর্ধচন্দ্রটা আজ একটু বেশি আলো দিচ্ছে সেটাই দেখতে ব্যস্ত দুটো চোখ আর বাকি চোখ দুটো দেখছে সেই ব্যস্ত চোখদুটোকে। ইয়ানা একসময় রেহানের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলে রেহান আলতো করে কোলে তুলে নিলো তাকে। বেডে শুয়ে দিয়ে কপালে আর চোখের পাতায় কিস করলো। নিজেও পাশে শুইয়ে ইয়ানাকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। আজ প্রাপ্তির মাঝেও রেহানের মনের কোণে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে, কারণটা হয়তো আজ আর কারো অজানা নয়।

ইয়ানার মাথায় কিস করে রেহান বিড়বিড় করে বললো, আজ তোমার মনের কোথাও হয়তো আমি নেই তবে একদিন ঠিক আসবে। যেদিন তোমার পুরো মন জুড়েই শুধু আমি থাকবো।

৪৭.
ইয়াদ ঘুমিয়ে পরেছে ইমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে। সত্যি ইয়ানাকে সে কতটা ভালোবাসে হয়তো কাউকে কোনোদিন বুঝাতে পারবে না। ইয়ানার মুখে একটু আঁধার নামলে ইয়াদের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। ভাইদের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। ইমা তাকিয়ে আছে ইয়াদের শুকনো মুখটার দিকে। বোনের বিয়েতে সে পুরো ব্ল্যাক প্রিন্সেস সেজেছিলো আজ। কালো পাঞ্জাবি, কালো জিন্স প্যান্ট, কালো কটি, কালো শো তবে সেইসব সাজের কিছুই এখন অবশিষ্ট নেই তবে ইমার গায়ে কালো শাড়িটা এখনো রয়ে গেছে। ইয়াদ ইমার কোলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে আর ইমা ইয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ইমার মনে হঠাৎ একটা ইচ্ছে জাগলো। সেটা পূরণ করতে টুপ করে ইয়াদের কপালে গভীর একটা কিস করলো। ইমা ভেবেছিলো ইয়াদ গভীর ঘুমে আছে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বাম গালে ইশারা করলো ইয়াদ। ইমা ভয়ে আর লজ্জায় বড় বড় চোখে তাকালো ইয়াদের দিকে কিন্তু ইয়াদ চোখ খুললো না। ইমা তা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। তবে সেটা বেশি সময় স্থায়ী হলো না ইয়াদ আবার নিজের বাম গালে কিস করার ইশারা করলো। ইমা অনেকটা সময় নিয়ে আস্তে করে ইয়াদের বাম গালেও কিস করলো। ইয়াদ এবার ডান গালে ইশারা করলো ইমাও এবার খুব একটা সময় না নিয়ে টুপ করে কিস করে দিলো। ইয়াদ এবার একে একে চোখের পাতা, থুতনি আর মুখের আশেপাশে আঙুল দিয়ে দেখাতে লাগলো আর ইমা জোশে পরে কিস দিয়ে যাচ্ছে। ইয়াদ এবার হুট করে ঠোঁটে ইশারা করতেই ইমা কিছু না ভেবে ইয়াদের ঠোঁটে কিস করে দিলো। দেওয়ার পর ইমার খেয়াল হলো সে কী করেছে ? ইয়াদ ফট করে চোখ খুলে বড় বড় চোখে ইমার দিকে তাকালো। ইমা লজ্জায় দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললো।

ইয়াদ মুচকি হেঁসে একটু উঁচু হয়ে ইমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, তোমাকে লজ্জা পেলে পুরো লাল মরিচের মতো লাগে। লাল মরিচ যেমন খাওয়ার আগে দেখেই ঝালে জিবে পানি চলে আসে তোমার বেলায়ও তেমনি হয়।

ইমা বড় বড় চোখ করে ইয়াদের দিকে তাকালো আর বললো, জীবনে অনেক শুনেছি লজ্জা পেলে নাকি টমেটোর মতো লাগে আর খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ প্রথমবার আপনার কাছে শুনলাম কাউকে লাল মরিচের মতোও লাগে।

ইয়াদ আবার ইমার কোলে শুয়ে বললো, সবার পছন্দ কী আর এক হয় ? সবার হয়তো টমেটো ভালো লাগে তাই টমেটো বলে কিন্তু আমার কাছে ঝাল ঝাল লাল মরিচই ভালো লাগে। দেখো দেখো তোমার ঠোঁট দুটো এখন একদম দুটো মরিচের মতো লাগছে।

ইয়াদের এমন কথায় ইমা নিজের দু’হাতে ঠোঁট ঢেকে ফেললো আর সেভাবেই বললো, আপনি তো ভারী অসভ্য হয়ে গেছেন।

ইয়াদ দুষ্টু হেঁসে বললো, অতি ভদ্রলোক হয়ে লাভ নেই, এতোদিন সেটা ছিলাম বাট কোনো লাভ হয়নি এবার থেকে একটু অভদ্র হবো ভেবেছি।

ইমা হাত সরিয়ে অবাক হয়ে বললো, আপনি না একটু আগে কাঁদছিলেন ? এখনই আবার অসভ্যতামি শুরু করেছেন ?

ইমার কথা শুনে ইয়াদের মুখ কালো হয়ে গেলো। আসলে ইয়াদের চোখ লেগে গিয়েছিলো ইমার কোলে শুয়ে থেকে। হঠাৎ ইমার ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শে ঘুম ছুটে যায়। ইয়ানার ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলো, ইমার কথায় আবার মনে পড়ে গেলো। ইমা নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারলো আর এটাও বুঝলো ভুল সময়ে ভুল কথা বলে ফেলেছে। ইয়াদ শান্ত হয়ে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো।

ইমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, বেডে গিয়ে ঘুমাবেন চলুন। এভাবে সারারাত ফ্লোরে শুয়ে থাকলে শরীর ব্যাথা হয়ে যাবে আর ঠান্ডাও লাগবে।

ইয়াদ কথা না বাড়িয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো আর ইমা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে উঠে একটা সুতি শাড়ী নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে ইয়াদ কপালে হাত দিয়ে শুয়ে আছে। ইমা সব কাজ শেষে ইয়াদের পাশে শুয়ে পড়তেই ইয়াদ তাকে টান দিয়ে কাছে নিয়ে ইমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে পরলো।

মলিন গলায় বললো, আমার ঘুম প্রয়োজন তাই নড়াচড়া না করে চুপচাপ এভাবেই শুয়ে থাকো।

ইমা কিছুই বললো না ওভাবেই শুয়ে রইলো চুপটি করে। ইমার মাঝে মাঝে মনে হয় ইয়াদের একটু ভালোবাসাই তাকে উতলা করে তুলে, তার একটু স্পর্শ ইমার হুঁশ উড়িয়ে দেয়। যেদিন ইয়াদ পুরোপুরি তার হয়ে হয়ে যাবে সেদিন কীভাবে নিজেকে সামলে উঠবে। কথাটা ভাবতেই ইমা লজ্জায় মুচকি হেঁসে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

৪৮.
নিজের ফোনে আরমান ইমার কিছু ছবি দেখছে, প্রত্যেকটা ছবি ইমাকে লুকিয়ে তোলা। আরমান তখন নিজেও বুঝতে পারেনি সে কেনো এই ছবিগুলো লুকিয়ে তুলেছিলো। আজ নিজের মনের কথা বুঝতে পেরেছে তবে সেটা অনেক বেশি লেট করে।

আরমান বিড়বিড় করে বললো, ইমা তোর মুখের হাসিটা দেখার পর আমার আর কোনো কষ্ট নেই। তুই ততটা ভালো আছিস যতটা হয়তো আমি রাখতে পারতাম না। তবে নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি যে ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবার তোর মুখোমুখি আমাকে যে হতে হবে রে ইমা।
#তিক্ততার_সম্পর্ক
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ৪৪

আজ সাতদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো মুশল ধারে আবার কখনো গুড়ি গুড়ি। আরমান ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে তখনই ছাহেরা বেগম দরজায় নক করলো।

আরমান রুমে আছিস ?

আরমান দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ।

ছাহেরা রুমে এসে দেখে আরমান রেডি হচ্ছে। এখন কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে।

আরমান হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বললো, কিছু বলবে ?

ছাহেরা আমতা আমতা করে বললো, একটা কথা বলার ছিলো কিন্তু।

কিন্তুর কী আছে, যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।

তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছিলাম, আজ তারা যেতে বলেছে।

আরমান পারফিউম দিচ্ছিলো মায়ের কথা শুনে তার হাত থেমে গেলো।

ছাহেরা আবার বললো, দেখ তোর বয়স তো আর কম হলো না। পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরিও করছিস এবার বিয়েটাও সেরে ফেলা উচিত।

আরমান কাঠ কাঠ গলায় বললো, আমাকে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।

ছাহেরা অবাক হয়ে বললো, আমি তোর মা, তোকে নিয়ে আমি না ভাবলে কে ভাববে ?

আরমান শান্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, আমার জীবন থেকে খুশির কারণটা সরিয়ে দেওয়ার আগে তোমার মনে ছিলো না তুমি আমার মা। আমি বুঝতে লেট করলেও তুমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলে আমি কী চাই ? আর সেটা বুঝতে পেরেই আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েছিলে তুমি। তখন মনে পড়েনি মা, আমি তোমার ছেলে ?

আরমান কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে গোটা গোটা পা ফেলে বের হয়ে গেলো। ছাহেরা বেগম ধপ করে বসে পড়লো বেডে। আজ কতগুলো দিন হলো ছেলে মেয়েরা তার সাথে ভালো করে কথা বলে না। আমিনুল মাহমুদের চাকরিটাও এখন নেই। দিসারের আর কোনো পাপের সাথী না হলেও তার সাথে মিলে কোম্পানির অনেক টাকা গন্ডগোল করেছিলো। ইমার খালু বলে ইয়াদ কোনো ঝামেলা না করে শুধু কোম্পানি থেকে বের করে দিয়েছে। চাকরি চলে যাওয়ার পর সে এখন কী করে না করে তার কোনো খোঁজ খবর পায় না ছাহেরা। বলতে গেলে মাঝ সমুদ্রে পরে গেছে ছাহেরা। আরমান সত্যি বলেছে, মায়ের মন তো তাই আরমানের রাগের মাঝেই ইমার প্রতি দুর্বলতা ধরে ফেলেছিলো ছাহেরা। ইমাকে দূরে সরাতে গিয়ে নিজের ছেলে দূরে সরে যাবে বুঝতে পারেনি। তবে এখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া কিছুই করার নেই তার।

নিজের বাইক নিয়ে এখন ভার্সিটি যায় আরমান। নিজের বাবার কুকীর্তির কথা জানার পর তার গাড়ি আর ছুঁয়েও দেখেনি। বাইকটা তার নিজের টাকায় কেনা তাই সেটাই ইউজ করে এখন। বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির জন্য অনেকটাই ভিজে গেছে ভার্সিটি পৌঁছাতে পৌঁছাতে। বাইক পার্ক করে নিজের কেবিনের দিকে চলে গেলো। এই ভার্সিটিতে তার দিন একটা একটা করে ফুরিয়ে আসছে। ইয়ানার ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়ে গেছে কিছুদিন হলো। রেহান তাকে নিয়ে আসতো আবার নিয়ে যেতো। ইয়ানা আরমানের সাথে এমন ভাব করেছে যেনো আরমানকে শুধু নিজের টিচার হিসাবেই চেনে। ইয়ানার পরিবর্তনে আরমান প্রথমে অবাক হলেও পরে তেমন মাথায় ঘামায়নি। আরমান ইমার সাথে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলো কিন্তু এতদিন ইমার এক্সাম চলছিলো তাই কিছু বলেনি, যদি পড়াশোনার উপর প্রভাব পড়ে তাই। আজ ইমার লাস্ট এক্সাম তাই আরমান ঠিক করেছে যা বলার আজই বলবে। আরমানের হাতেও খুব বেশি সময় নেই। শুধু ইমার এক্সাম শেষ হওয়ার অপেক্ষায় ছিলো।

৪৯.
ইয়াদ ড্রাইভ করছে আর ইমা পাশে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, তবে মাঝে মাঝে ইয়াদের দিকেও তাকাচ্ছে।

হঠাৎ ইয়াদ বললো, তো আজ তো তোমার এক্সাম শেষ, সামনের কী প্ল্যান ?

ইয়াদের দিকে তাকিয়ে ইমা বললো, মানে বুঝতে পারলাম না।

মানে ফাইনাল এক্সাম শেষ হলে, রেজাল্ট বের হতে আর মাস্টার্সে ভর্তি হতে অনেক সময় পাবে মাঝে। এই সময়টা কীভাবে কাটাতে চাও ?

ইমা মন খারাপ করে বললো, আমার এই ফ্রী টাইম গুলো আগে কোথা দিয়ে চলে যেতো টেরই পেতাম না। ভার্সিটি না গেলে সকাল থেকে রাত দশটা পর্যন্ত বাসার কাজ করেই পার হয়ে যেতো। তবে এবার সময়টা কীভাবে যাবে সেটা আমিও বুঝতে পারছি না। আপনি সারাদিন অফিসে থাকেন, ইয়ানা আপুও এখন চলে গেছে আর ইশান ভাইয়ের তো দেখাই মিলে না।

ইয়াদ সামনের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি বাসায় একা একা খুব বোর হও তাই না ?

খুব বেশি বোর হই, কথা বলার মতো মানুষও নেই। আর এতগুলো সার্ভেন্ট রেখে দিয়েছেন কাজও খুঁজে পাই না।

ইয়াদ গলার স্বর পাল্টে বললো, ইমা তোমার মনে হয় না, এবার আমাদের একজন ফ্যামিলি মেম্বার বাড়ানো উচিত। যাকে নিয়ে তোমার সারাদিন কেটে যাবে।

ইমা বড় বড় চোখে ইয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, ফ্যামিলি মেম্বার বাড়াবেন মানে ? আপনি কী আর একটা বিয়ে করার মতলব করছেন ?

ইয়াদ বিড়বিড় করে বললো, এক বউকেই এখনো ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হলো না আবার আরেকটা।

ইমা রেগে বললো, এই এই কী বললেন আপনি ? দেখুন আমি এক্সাম দিতে যাচ্ছি মাথা একদম গরম করবেন না বলে দিলাম।

ইয়াদ দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, কী কপাল আমার, বউকে বুঝাতে চাই ‘ক’ আর বউ আমার বুঝে ‘ব’।

কী বুঝি না আমি হ্যাঁ ? সব বুঝি আর খুব ভালো করেই বুঝি। তাই আমাকে কখনো বোকা বানানোর চেষ্টা করবেন না।

ইয়াদ হাত জোর করে বললো, ভুল হয়ে গেছে আমার জ্ঞানী বিবি সাহেবা। আমাকে ক্ষমা করে, আপনার যদি মর্জি হয় এবার হলে জান দয়া করে।

ইয়াদের কান্ডে ইমার হাসি পেলেও চেপে গেলো, এখন হাসিটা মানাবে না ভেবে। ইমা টুপ করে ইয়াদের গালে একটা কিস করে গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ইয়াদ অবাক হয়ে তাকাতে তাকাতে ইমা হলের ভিতরের দিকে পা বাড়ালো। ইয়াদ সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে নিজের গন্তব্যে রওনা হয়ে গেলো। ইমা ইয়াদের কথা ভেবে মুচকি হাসতে লাগলো। ইমা বুঝতে পেরেছে ইয়াদ কোন ফ্যামিলি মেম্বার বাড়ানোর কথা বলেছে তবু ইমা এমন উল্টোপাল্টা বলে ব্যাপারটা কাটিয়ে গেছে। ইয়াদের কথায় সে লজ্জায় পরতে চায়নি। এই কয়েক মাসে ইয়াদ তাকে খুব বেশি হেল্প করেছে। মনোযোগ নষ্ট হবে ভেবে সম্পর্কটাকে নতুন মোড় দেয়নি। ইমাকে সাহায্য করেছে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে আর পড়ার ব্যাপারেও অনেক হেল্প করেছে। ইয়াদ ভেবে রেখেছে ইমার এক্সাম শেষ হলে ওকে নিয়ে কোথায় ঘুরতে যাবে। বিয়ের কতগুলো মাস পেড়িয়ে গেছে এখনো কোথাও নিয়ে যায়নি ইমাকে। সামনে ইয়াদ আর ইমার ফাস্ট ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। ইমার জন্য অনেক বড় সারপ্রাইজ রেখেছে সেদিনের জন্য। ইয়াদ অফিসে বসে নিজের কাজে মনোযোগ দিলো তখনই নক করলো রনিত। রনিত এখন আর আগের মতো ভয় পায় না ইয়াদকে, তবু আগের মতোই আচরণ করে মাঝে মাঝে।

May i come in, sir ?

হ্যাঁ রনিত এসো।

রনিত দরজা ঠেলে ভেতরে এসে দাঁড়ালো। কিছু বলছে না দেখে ইয়াদ সামনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো, রনিতের হাতে ট্রে আর হাতে মিষ্টি।

ইয়াদ অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার রনিত, তুমি আবার বিয়ে করেছো নাকি ?

রনিত দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, ছি ছি স্যার, কী বলেন এটা ? মানুষ বিয়ে কয়বার করে ?

ইয়াদ আবার ফাইলের দিকে তাকিয়ে বললো, মানুষ বিয়ে কয়বার করে সেটা ডিপেন্ড করে মানুষটা কেমন তার উপর। আগের বার তো হুট করে বিয়ে করে মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছিলে এবার মিষ্টি আনার কারণ কী তাহলে ?

কয়েকমাস আগেই রনিত হুট করে তার গার্লফেন্ডকে বিয়ে করে ফেলেছে। গার্লফেন্ডের বাবা নাকি জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দিচ্ছিলো রনিতকে সেটা জানাতে আসলে রনিত তাকে গিয়ে কোর্টে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। পরদিন মিষ্টি নিয়ে সোজা ইয়াদের সামনে হাজির।

ইয়াদ পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে রনিতের গলা শুনতে পেলো আবার।

লজ্জা মাখা গলায় রনিত বললো, স্যার এবার বিয়ে না অন্য সুখবর আছে।

ইয়াদ ফাইল দেখতে দেখতেই বললো, তো কী তোমার সুখবর ?

স্যার আমি বাবা হতে চলেছি।

হোয়াট ?

ইয়াদ বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে রনিতের দিকে। ইয়াদের পরে বিয়ে করে সে বাবা ডাক শুনতে চলেছে আর ইয়াদ এখনো নিজের বউয়ের কাছেই যেতে পারেনি, ভাবা যায় ?

রনিত মাথা নিচু করে বললো, জী স্যার, গতকাল ডক্টর রিপোর্ট দিয়েছে। এক মাস চলছে কেবল। অন্য অসুস্থতার জন্য টেস্ট করাতে গিয়ে প্রেগনেন্সির কথা জানতে পেরেছি।

ইয়াদ ছোট করে বললো, ওহ্ কনগ্রাচুলেশন।

স্যার মিষ্টি মুখ করুন, অফিসের সবাইকে করিয়েছি শুধু আপনি বাকি আছেন।

ইয়াদ হাসি মুখে বললো, তুমি তো জানো আমি মিষ্টি পছন্দ করি না।

রনিত ইয়াদের মানা শুনলো না, তাই জোর করায় ইয়াদ একটু মিষ্টি মুখে দিলো। রনিতকে নিজের কাজে যেতে বলে ইয়াদ গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবতে লাগলো।

বিড়বিড় করে বললো, আমার বউটা যে কবে বুঝবে কে জানে।

৫০.
ইমা এক্সাম শেষ করে হল থেকে বের হলো। এবারের সব এক্সাম ইমার অনেক ভালো হয়েছে, তার ক্রেডিট অবশ্য ইয়াদের পাওনা। ইমা রিকুর সাথে ফুচকা খাচ্ছে আজ অনেক সময় আড্ডা দিয়ে তারপর বাসায় যাবে ঠিক করেছে। ইয়াদকে বলে দিয়েছে আসার প্রয়োজন নেই সে নিজেই বাসায় চলে যাবে। আবার কবে রিকুর সাথে দেখা হবে ঠিক নেই তাই আজ ইচ্ছে মতো মজা করবে দুজনে ঠিক করেছে।

রিকু ফুচকা মুখে পুরে বললো, কী রে ইমা, ভাইয়া রাগ করবে না তে আবার ?

ইমা মুচকি হেঁসে বললো, আমি উনাকে বলেই এসেছি তাই রাগ করবে না।

হঠাৎ রিকু গম্ভীর হয়ে বললো, ইমা তুই ভালো আছিস তো ?

ইমা থেমে গেলো রিকুর কথায় আর ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বললো, এতটা ভালো থাকবো জীবনে কোনোদিন হয়তো কল্পনাও করেছিলাম না রে রিকু। এতটা সুখ ছিলো বলেই হয়তো আল্লাহ এতটা কষ্ট আগে দিয়েছিলো। নাহলে এই সুখের মর্যাদা হয়তো দিতে পারতাম না।

রিকু প্রশান্তির হাসি দিয়ে বললো, ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসে না ?

ইমা হাসিটা বজায় রেখে বললো, কোনোদিন মুখ ফোটে বলেনি ভালোবাসি। তবে আমার প্রতি তার প্রত্যেকটা আচরণ বলে দেয় সে কতটা ভালোবাসে আমায়। আর যদি ভালো নাও বাসতো তাতেও আমার আফসোস ছিলো না। একটু ভালো ব্যবহার আমার মতো মেয়ে খুশি থাকার জন্য হয়তো যথেষ্ট ছিলো তখন। তবে এখন আমি তার ভালোবাসা চাই একটু না অনেকটা।

তুই কতটা ভালোবাসিস তাকে ?

সেটা পরিমাণ করার যন্ত্র যদি থাকতো তাহলে হয়তো বলতে পারতাম। তবে এতোটা ভালোবাসি তার জন্য হাসতে হাসতে জীবনটাও দিয়ে দেবো৷ আবার ভাবিস না আবেগের বশে কথাগুলো বলছি। না রে আবেগ না তাকে নিজের মন প্রাণ উজার করে ভালোবেসেছি। শুধু চাই কখনো যাতে আমার দ্বারা কোনো আঘাত সে না পায়। ছোটবেলা থেকে মানুষটা আঘাত পেতে পেতে পাথর হয়ে গিয়েছিলো। সেই পাথরে একটু একটু করে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে কেবল। আমার থেকে আঘাত পেলে সে সহ্য করতে পারবে না কোনোদিন।

রিকু মুচকি হেঁসে বললো, আল্লাহ তোদের সবসময় হ্যাপি রাখুক এই দোয়া করি।

ইমা,,,,

ওদের কথার মাঝে পুরুষালী কণ্ঠে কেউ ইমা ডাকলে দু’জনেই চমকে উঠে পাশে তাকায়। ঘুরে তাকিয়ে দেখে আরমান দাঁড়িয়ে আছে। ইমা বেশ অবাক হলো আরমানকে দেখে। আজ কতগুলো মাস পর সামনাসামনি কথা বললো ইমার সাথে। ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার সময়ও ইমাকে এড়িয়ে যেতো সবসময়। ইমার মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে আরমান আজ হঠাৎ কী বলতে এসেছে।

তোর সাথে কিছু কথা ছিলো, প্লিজ না করিস না আজই শেষবারের মতো কথাগুলো শোন আর কখনো কিছু বলতে আসবো না।

ইমা কী করবে দোটানায় পড়ে গেলো। আরমানকে দেখে সেই আগের আরমান মনে হচ্ছে না ইমার। এ যেনো কোনো নতুন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখেমুখে সেই অহংকারী ভাব আর অ্যাটিটিউড লক্ষ্যে আসছে না আজ।

চলবে,,,,
চলবে,,,,,
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here