তি আমো পর্ব -১৬+১৭

#তি_আমো
পর্ব ১৬
লিখা- Sidratul Muntaz

” কথাডা হইলো আমাগো তারুরে লইয়া। হেই ছুডুবেলা থেকা মাইয়াডারে আগলাইয়া রাখতাসি। বাপ মরা মাইয়া। এতিম। হের প্রতি আমার মুহাব্বত একটু বেশিই আছিল। ওহনো আছে, খুব আদর যত্নে বড় করছি তো!মায়া লাগে বহুত। জীবনে কোনোদিন একটা টুকাও লাগতে দেই নাই শইলে। তারুর বাপে, মরনের আগে আমার কাছেই তারুর দায়িত্ত দিয়া গেছিল। মাইয়াডারে যেন দেইখা রাখি। যে সময় আমার পুতে জিন্দা ছিল হেই সময় বাপের মেলা আদরের মাইয়া আছিল আমগো তারু। যারে কয় বাপের দুলালি। তারু যা কইতো এক কথায় তাই করতো আমার পুত। আহাগো, মনে পরলে এহনো বুকটাত চিলিক দিয়া উডে।”

অত্যন্ত আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে কথা বলছে বুড়ি। চোখের পাতা ভিজে উঠেছে তার। আমি আর ঈশান মনোযোগী শ্রোতার মতো শুনছি। বুড়ি কেঁদে উঠল। আমি হা করে চেয়ে রইলাম। কি এমন হলো? হঠাৎ বুড়ির ওমন ফ্লেশব্যাকে চলে যাওয়ার কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না আমার। এমন আচরণ করতে তো বুড়িকে আমি আগে কখনোই দেখিনি। ঈশান বেশ ইতস্ততভাবে বুড়ির দিকে তাকিয়ে রইল। বুড়ি শাড়ির আঁচল দিয়ে নাকের ডগা মুছতে মুছতে বলল,

” কত স্মৃতি অহনো চোখে ভাসে। তারু যখন ছোডো আছিল, হেরে গল্প শুনাইয়া ঘুম পাড়াইতাম। গল্প না কইলে ঘুমাইতো না। জিদ কইরা বইয়া থাকতো। আমার পানের বাডা লইয়া মাঝে মাঝে সুপারি কাটতো। লুকায় লুকায় আমি না দেখি যেন। এমনে কয়বার যে হাত কাটছে। মেলা দুষ্টামী করতো। আইজকা এলা কথা কিল্লিগা কইতাছি জানো? বোইনডার আমার বিয়া ঠিক হইছে। আর কয়ডা দিনই! তারপর যাইবোগা শশুরবাইত। আর দেখা সাক্কাত কইত্তে? যহন তহন আর ডাকলে ছুইট্টা আইবো না। বুড়ি কইয়া ডাকবো না। তাই আর কি একটু খারাপ লাগতাছে…”

কথাগুলো শুনে আমি যেন হাবা হয়ে গেলাম। নিজেকে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ মনে হলো। আমার বিয়ে ঠিক অথচ আমি নিজেই জানি না? কি আশ্চর্য! ঈশান উৎকণ্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“বিয়ে ঠিক হয়েছে মানে? তারিনের বিয়ে?”

“তোর আর কার? এইহানে বিয়ার উপযুক্ত আর কেডা আছে?”

ঈশান যথেষ্ট বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে চাইল। আমিও চূড়ান্ত অবাক। একে-অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম নির্ণিমেষ। আমাদের সম্বিৎ ফিরল বুড়ির গলা খাঁকারির শব্দে।

” শুনো মাষ্টর, তুমি আমার তারিফের মতো। আমার নাতির বয়সী। তাই তোমারে কইতাছি। আমার বোইনডার আমার বিয়ার বয়স তো হইছে। এই বিশটা বছর ধইরা আমগোর কাছে ছিল। আর অহন যাইবো একটা অপরিচিত জায়গায়৷ একটা অপরিচিত পরিবেশে। তোমার লগে আলাপ করতে আইছিলাম আর কি পোলার সম্পর্কে। তুমি শিক্ষিত মানুষ। ভালো বুঝবা..”

ঈশান প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল,”দাদী এটা তো ঠিক না। যদি আমার অপিনিয়ন চান তাহলে আমি স্ট্রেইট না করবো। মাত্র বিশ বছরই কি বিয়ের বয়স হলো নাকি? এখনও তো লেখাপড়ার সময়! বিয়ের জন্য আরও অনেক সময় পাওয়া যাবে।”

ঈশান কথা শেষ করে শার্টের কলার ঠিক করল। ভীষণ ঘামছে সে। গলাও শুকিয়ে গেছে। মুখের রঙ ফ্যাকাশে বর্ণ।

বুড়ি মাথা নিচু করে হতাশাজনকভাবে উচ্চারণ করল,

“ওইডা তো জানিই। অহন মাইয়ারা অনেক দুর লেখাপড়া করে, চাকরি-বাকরি করে। কিন্তু আমাগো পরিবারটা তো আর হেমন নাই। বুঝোই তো বাপ মরা মাইয়ার বিয়া দেওয়া কি আর সোজা-সাপটা ব্যাপার? এহন একটা ভালা সম্বন্ধ আইছে। সবসময় কি আর এমন আয়ে? এই সুযোগ হাতছাড়া করোন কি ঠিক হইবো?”

ঈশান অবলীলায় বলল,” অবশ্যই ঠিক হবে। ক্যান্সেল করে দিন। কোনো দরকার নেই বিয়ের।”

বুড়ি অবাক হয়ে বলল,” অ্যাঁ! বিয়ার দরকার নাই? ক্যান?”

ঈশান নিচু কণ্ঠে বলল,” মানে আমি বলতে চাইছি যে এখনই বিয়ের কি দরকার? পিচ্চি একটা মেয়ে। ও বিয়ে শাদীর কি বোঝে?”

আমি এই কথা শুনে সরুচোখে তাকালাম ঈশানের দিকে। ঈশান কপালে ভাজ নিয়েই হাসার চেষ্টা করে বলল,

” সময় যখন আসবে, বিয়ে হবে দাদী। যার নেওয়ার সে এখন হলেও নিবে আর পাঁচ বছর পরে হলেও নিবে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তারিনের ফিউচার নষ্ট হয়ে যায়, এমন কিছু করবেন না প্লিজ।”

বুড়ি মুখ মলিন করে বলল,” পাঁচ বছর পর? এমন পোলা কি তামান পিত্তিবিতে আছে? আমাগো মাইয়ার লাইগা পাঁচ বছর অপেক্ষা করবো? কি যে কও না! এমন দরদী কেউ নাইগো!”

ঈশান আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,” থাকবে না কেনো? নিশ্চয়ই আছে। হতে পারে আশেপাশেই আছে। কিন্তু আপনারা নোটিস করছেন না।”

” আশেপাশে আছে? কি কও? আমগোর আশেপাশের সব পোলাপাইন তো দেখি গাঞ্জুইট্টা, নেশাখোর, মদখোর, অশিক্ষিত। হেতেরার লগে আমার নাতনীর বিয়া দিমু নাকি?”

” না,না, আমি তাদের কথা কেন বলব? খারাপ ছেলে যেমন আছে, ভালো ছেলেও তো আছে! আপনারা আরেকটু চিন্তা করুন।”

বুড়ি দুই হাত একত্র করে বলল, ” জানি না তুমি কার কথা কইতাছো।কিন্তু যদি আসলেই তোমার নজরে এমন কেউ থাকে, তাইলে তারে খুঁইজা দাও। কত ভালো পোলা বাইর করতে পারো দেখি। তোমারে এক সপ্তাহের মতো সময় দিলাম। এর মধ্যে যদি উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান দিতে পারো, তয় এই বিয়া বাতিল। নাইলে কলাম তারুর বিয়া আমি এইহানেই দিমু। এইডাই আমার শেষ ফয়সালা। গেলাম ভাই, গেলাম বইন।”

” ক্যান পিরিতি বানাইলারে বন্ধু… ছাইড়া যাইবা যদি..”

বুড়ি গান গাইতে গাইতে ঘর ছেড়ে বের হয়ে গেল।ঈশানকে দেখলাম বড় করে হাঁফ ছেড়ে দুইহাতে কপালে ঠেঁকিয়ে বসে আছে। একটু পর ঘাসের মতো লম্বা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে আমার বিছানার সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিল। ঢকঢক করে গিলে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল এক নিমেষে। তারপর আমার দিকে চেয়ে কঠিন গলায় বলল,

” এসব কি তারিন? বিয়ের কথা আমাকে জানাওনি কেনো?”

আমি রোষপূর্ণ কণ্ঠে বললাম,”আমি নিজেই তো জানতাম না। আপনাকে কি করে জানাবো? আজব!”

ঈশান চিন্তায় অস্থির হয়ে বলল,” এবার কি হবে? সত্যিই কি তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে এরা? তুমি রাজি হবে?”

” ভাইয়া যদি বলে তাহলে তো রাজি হতেই হবে।”

ঈশান আহত দৃষ্টিতে চাইল আমার দিকে। দিশেহারার মতো বলল,” ইম্পসিবল।”

আমি কিছু বললাম না। ঈশান চলে যাওয়ার পাঁচমিনিট পরেই বুড়ি আবার ঢুকল আমার ঘরে। খুশিতে আটখানা হয়ে জিজ্ঞেস করল,” মাষ্টর কি কইল?”

আমি ফ্যাকাশে মুখে জবাব দিলাম,” কি আর বলবে? কিছুই বলল না। শুধু মনখারাপ করল।”

বুড়ি হাসিতে কুটি কুটি হয়ে দুইহাতে একবার তালি বাজিয়ে বলল,” এডাই তো আমি চাইছিলাম।”

আমি চোখমুখ কুচকে উচ্চারণ করলাম,” মানে?”

বুড়ি কেবল হাসতে লাগল। আমি রেগে বললাম,” সত্যি কথা বলো, বুড়ি। আসলেই কি আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে? ভাইয়া আর মা জানে?”

” সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু এই বিয়া আসল বিয়া না। এইডা হইল নাটক। তোর মাষ্টররে ফাঁসানোর ধান্দা। তার চেহারা খানা দেখছোস? বাতাস ছাড়া বেলুনের মতো চিমায় গেছিল তোর বিয়ার কথা শুইন্নাই। কয়বার কইল, না দাদী! তারুরে বিয়া দেওয়ার দরকার নাই। ভালো পোলা আশেপাশে আছে৷ এল্লিগাই তো আমি কইলাম খুঁইজা দেখাইতে। অহন খালি অপেক্ষা কর। বিয়ার প্রস্তাব আইল বইলা। মাষ্টর নিজেই তোরে বিয়ার প্রস্তাব দিব সাতদিনের ভিত্রে।”

বুড়ি পান খাওয়া লাল দাগাঙ্কিত দাঁত বের করে হাসছে। আর আমি তাকিয়ে আছি মুগ্ধচোখে! এতো বুদ্ধি আমার বুড়ির? হায়রে কুচুটে বুড়ি! জানি না ওইসময় আমার কি হলো। আমি বিছানা থেকে উঠেই বুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম। বুড়ির গালে চুমু দিয়ে বললাম,” এতো বুদ্ধি নিয়ে তুমি ঘুমাও কিভাবে বুড়ি?”

বুড়ি বিস্ময়ে তব্দা খেয়ে বলল,” তুই এতো খুশি ক্যারে? মাষ্টরের প্রেমে কি তুইও পড়ছোস?”

আমি লজ্জায় খুব জোরে হাসতে লাগলাম। আমার এই হাসি হুট করেই থমকে গেল যখন দেখলাম ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, সাথে মাও। মায়ের মুখে হাসি থাকলেও ভাইয়ার চেহারা নিতান্তই গম্ভীর। আমি নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। বুড়ি আনন্দভরা কণ্ঠে বলল,”দ্যাখ তারিফ, দ্যাখ। তোর বইন কেমনে বিয়ার খুশিতে চিক্কুর পারতাছে। আমি কইছিলাম না?”

বুড়ির কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। এর মানে কি ভাইয়াও সবকিছু জানে? ঠিক ওইসময় ভাইয়া বলল,” চিঠিওয়ালার ভূত যে ওর মাথা থেকে নেমেছে এতেই আমি খুশি।”

এই কথা বলে ভাইয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে গেল। আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। মা এসে আমার কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আমি খুব খুশি হয়েছি তারু।”

আমি উশখুশ করে বললাম,” এসব কি হচ্ছে মা? ভাইয়াও কি বিয়েতে রাজি?”

মা হাসতে হাসতে বুড়ির দিকে তাকাল। বুড়িও দেখলাম হাসছে। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” তোর ভাইয়ের আদেশেই তো এসব হচ্ছে পাগলি! তুই যখন হসপিটালে ভর্তি ছিলি তখন ঈশান তোর জন্য কত যে পাগলামি করল! খায়নি৷ ঘুমায়নি, কারো সাথে ঠিক করে কথাও বলেনি। সারাক্ষণ শুধু তোকে নিয়ে চিন্তা, তোকে আগলে রাখা। এসব দেখে তারিফ তখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে তোদের বিয়ে দিবে।”

আমার পুরো শরীরে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল। সবকিছু স্বপ্ন মনে হতে লাগল। ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে মানে এই বিয়ে পাক্কা। কিন্তু মুহূর্তেই মনখারাপ হলো যখন মনে পড়ল, ঈশানের আসল পরিচয়ের কথা। যা ভাইয়া এখনও জানে না। যে চিঠিওয়ালাকে ভাইয়া এতো ঘৃণা করছে সেই চিঠিওয়ালাই ঈশান। এই কথা যখন ভাইয়া জানবে তখনও কি বিয়েটা দিতে চাইবে?

আজ অনেকদিন পর ভার্সিটি যাচ্ছি। ভাইয়া আমাকে একা যেতে দিল না। ঈশানের সাথে তার গাড়ি করে যেতে বলল। এতে ঈশান যারপরনাই বিস্মিত। প্রথমত সে জানে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত, ওই এক্সিডেন্টের পরেও যে ভাইয়া আমাকে আবার ঈশানের গাড়ি করে ভার্সিটি পাঠাবে এটা মনে হয় ঈশান আশা করেনি।

সকালের ব্যস্ত রাস্তা। গাড়ি চলছে সরুপথ দিয়ে। ঈশানের চোখ দু’টো লাল টকটকে। দেখে মনে হচ্ছে বেচারা ভীষণ ক্লান্ত। সারারাত ঘুমও হয়নি বোধহয়। আমাকে চেয়ে থাকতে দেখে ঈশান রূঢ় স্বরে বলল,” এভাবে কি দেখছ? তোমার না সামনে বিয়ে? পর পুরুষের দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার হবু বর মাইন্ড করবে।”

আমি ঠোঁটে চওড়া হাসি টেনে বললাম,” আপনি দেখি এখন থেকেই আমার হবু বরকে জেলাস করছেন।”

ঈশান ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল,” হেসো না তারিন, প্লিজ। তোমার এই হাসি আমাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে ফেলছে। এতো কিসের আনন্দ তোমার? সকাল থেকেই দেখছি তুমি খুব খুশি। আমি তোমার খুশিটা সহ্য করতে পারছি না।”

” কি আশ্চর্য! আপনার জন্য আমি খুশিও হতে পারব না? বিয়ে নিয়ে মেয়েদের কত স্বপ্ন থাকে জানেন? অবশেষে স্বপ্নটা পূরণ হচ্ছে। আমার খুশি হওয়া কি জায়েজ নয়?”

ঈশান গাড়ি থামিয়ে আমার দিকে চাইল। কটমট করে বলল,” তুমি কি চাও তারিন? প্লিজ, এভাবে খেলো না আমার সাথে। শুধু একবার বলো তুমি বিয়েতে রাজি না। তারপর দেখো আমি কি করি!”

আমি মুচকি হেসে বললাম,” মিথ্যা কেন বলব? আমি তো বিয়েতে রাজি!”

ঈশানের চিন্তাগ্রস্ত চেহারায় আঁধার নেমে এলো। আহত চোখ দু’টো নিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বলল,” তুমি শিউর?”

আমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে অতি সহজ ভঙ্গিতে বললাম,” নিশ্চয়ই! ”

ঈশান বিষাদময় হাসি দিয়ে বলল,” আর আমি? আমি কি করব?”

” আপনি কি করবেন সেটা আপনার ব্যাপার ঈশান।”

ঈশানের ঠোঁট দু’টো তিরতির করে কাঁপছে। চোখে অশ্রু টলমল। চেহারায় ভয়ানক বিষণ্ণতা। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,” ওকে, ফাইন।”

এই কথা বলেই ঈশান ড্রাইভিং-এ মনোযোগী হলো। সারারাস্তা আমার সাথে আর একবারও কথা বলল না। এমনকি আমার দিকে তাকাল পর্যন্ত না। ভার্সিটির গেইটের সামনে অনেক ভীড়। জুনিয়রদের এডমিশন টেস্ট আছে আজ। সেজন্য অনেকটা দূরেই গাড়ি থামাতে হলো। বাকি পথ হেঁটে যেতে হবে। আমি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার সময় ঈশানকে ” বায়” বললাম। ঈশান আমার দিকে তাকাল না। উত্তরও দিল না। আমি একটা অদ্ভুত কাজ করে বসলাম। ব্যাগের সাইড পকেট থেকে ছোট চিরুনিটা বের করে ঈশানের দুই গাল এক হাতে চেপে তার মাথার চুলগুলো আঁচড়ে দিতে লাগলাম। ঈশান ভ্রু কুচকে তাকাল। আমি দুষ্টু হাসি দিয়ে বললাম,

” মাথায় ওমন ব্ল্যাক ফরেস্ট নিয়ে ঘুরলে মেয়েরা তো ক্রাশ খেতে খেতে মরে যাবে, মিস্টার কিউট! ”

ঈশানকে পুরোপুরি হতভম্ব করে দিয়ে আমি আদুরে ভঙ্গিতে তার নাক টিপে দিলাম। তারপর সে কিছু বলার আগেই চটজলদি নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। দ্রুতপায়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করলম। একবারও পেছন ফিরে তাকালাম না। তবে আমি জানি, ঈশান হা করে আমাকেই দেখছে। তার বিস্ময় এখনও কাটেনি।

আমার একমাত্র উদ্দেশ্য ভার্সিটির গেইট অতিক্রম করা। তবে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হতে পারলাম না। আপনা-আপনি চলার গতি মন্থর হয়ে এলো। আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ব্রিজের সামনে মোটর সাইকেলে বসে আছে নীল জ্যাকেট পরিহিত কালো সানগ্লাসওয়ালা একটা বখাটে ছেলে। ছেলেটার আশেপাশে প্রায় দশ-বারোজন সাঙ্গ-পাঙ্গ। ভার্সিটির প্রায় সব মেয়েদেরই উত্যক্ত করছে, আপত্তিকর ভাষায় বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। এইটা ওদের নিয়মিত কাজ৷ প্রায়শই চোখে পড়তো। কিন্তু এড়িয়ে চলতাম। তবে আজ এড়িয়ে চলার জো নেই। কারণ এবার ওদের সামনে দিয়েই হেঁটে যেতে হবে আমাকে। অন্যান্যদিন বাসে আসতাম বলে ব্রিজের ওই পাড়ে নামতে হতো।আজকে এই পাড়ে নেমেই ফেঁসে গেছি। ইচ্ছে করছে পেছন দিকে ছুটে পালাতে।

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম ঈশানের গাড়ি নেই। ভেতরটা কেঁপে উঠল। শুকনো গলায় ঢোক গিলে ভাবতে লাগলাম, সামনে যাবো, কি যাবো না? না গিয়েও যে উপায় নেই। যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো ততক্ষণ সময় নষ্ট হবে। তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো। ওরা আমাকে যাই বলুক আমি কিচ্ছু শুনবো না। শুধু দ্রুতপায়ে ওভারটেক করবো। তাহলেই তো হলো।

ছেলেগুলো আমায় কিছুই বলছে না। আমি চোখেমুখে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে হেঁটে চলেছি। যেন ওদেরকে দেখতেও পাচ্ছি না। বাইকে বসা ছেলেটা শুধু সানগ্লাস খুলে আমার দিকে তাকালো।কিছু বলল না। আমি আরো সাহস নিয়ে সামনে এগোতে লাগলাম। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় হলো না। পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল,

“এইযে ম্যাম!”

এতো ভদ্র ভাষার ডাক শুনে অটোমেটিক পেছন ফিরে তাকালাম। ওই ছেলেগুলোর মধ্যেই কেউ একজন ডেকেছে। কিন্তু কে ডাকল বুঝতে পারলাম না। মনের মধ্যে একঝাঁক ভয় চেপে বসলেও চেহারায় তা প্রকাশিত হতে দিলাম না। ভ্রু কুচকে বেশ গম্ভীর ভাব নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাতেই নীল জ্যাকেটের ছেলেটাকে খুঁজে পেলাম। ছেলেটাকে দেখে ভয়ে আৎকে উঠে কয়েক কদম পিছিয়ে পড়লাম। ছেলেটা মুচকি হেসে আমার দিকে অগ্রসর হতে লাগল। সানগ্লাসটা টি- শার্টে ঘষতে ঘষতে ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করল,

নাম কি?

আমি হাত ভাজ করে বললাম,” পথ ছাড়ুন।”

ছেলেটা বাঁকা হেসে বলল,” ছাড়বো তো। আগে নাম বলো।”

আমি কড়াভাবে বললাম,” যাকে-তাকে নাম বলে বেড়ানোর অভ্যাস নেই আমার। যেতে দিন।”

আমার কথায় যেন ছেলেটা আরো আগ্রহ পেল। উৎসাহী একটা হাসি দিয়ে বলল,

” খুব সুন্দর! ”

আমি চোয়াল শক্ত করে বললাম,” মানে?”

ছেলেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে কাউকে আঙুলের ইশারায় ডাকল। হলুদ শার্ট পরা ছোট-খাটো একটা ছেলে এগিয়ে এলো, “জী ভাই?”

নীল জ্যাকেটের ছেলেটা কানের পেছনে আটকানো সিগারেটটা বের করে গলায় ঝুলানো লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালো। কয়েক টান একসাথে টেনে কোমরে হাত রেখে মেইন রাস্তার গাড়ি দেখায় মনোযোগ দিয়ে বলল,

“ম্যাডামের ফোন নম্বর নোট কর। নম্বর না দেওয়া পর্যন্ত ছাড়বি না।”

হলুদ শার্টের ছেলেটা অর্ডার পাওয়া মাত্রই পকেট থেকে ছোট সাইজের একটা প্যাট আর পেন বের করল। আমার দিকে দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে বলল,

“ম্যাডাম নাম্বারটা? কইয়া ফালান জলদি।”

চলবে

গ্রুপ Sidrat’s story land❤গল্পের সিড়ি❤#তি_আমো
পর্ব- ১৭
Writer: Sidratul Muntaz

ভয় লাগছে। এই রকম পরিস্থিতে আমি আগে কখনও পড়িনি। হলুদ শার্টের ছেলেটা আমার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ভ্রু কুচকে তার বসের দিকে তাকাল,”ভাই, ম্যাডাম তো কথা কয় না।”
নীল জ্যাকেটের ছেলেটা আঁড়চোখে আমার দিকে হাসল। আমি তপ্ত দৃষ্টিতে চাইলাম। নীল জ্যাকেট উঠে এসে হলুদ শার্টের গালে চড় দিয়ে বলল,
” কথা বলবে কিভাবে? তোকে পছন্দ হয়নি। চল হাট!”
হলুদ শার্ট সরে গেল মাথা নুইয়ে। নীল জ্যাকেটওয়ালা কলার ঠিক করে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমি কটমট করে বললাম,
” আমার পথ ছাড়ুন। বাড়াবাড়ি করবেন না।”

“বাড়াবাড়ি কোথায় করলাম জানেমান? আমি তো তোমার পথ ধরে রাখিনি? অবশ্যই ছেড়ে দিবো। শুধু নম্বরটা.. ”
আমি সুযোগ বুঝে পাশ কাটিয়ে দৌড় লাগাতে চাইলাম। সাথে সাথে ছেলেটা হাত ঠেঁকিয়ে আটকালো। সম্পুর্ণ ডান হাতটা দিয়ে আমার গলা বরাবর আড়াআড়িভাবে ঠেসে ধরল। আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়। কেউ দেখেও কিছু বলছে না কেন? সবাই কি একে ভয় পায়?

হঠাৎ একটি গাড়ি এসে রাস্তার পাশে থামল। সেই শব্দে পাশ ফিরে তাকালাম আমি। গাড়ি থেকে নিহাকে নামতে দেখে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। স্বস্তি নিয়ে ডাকলাম,” নিহা!”

নিহা পেছন ফিরে চাইল। আমাকে এই অবস্থায় দেখে দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,” কি হচ্ছে এইসব? আপনাদের নামে ভিসির কাছে কমপ্লেইন করব। ছাড়ুন আমার ফ্রেন্ডকে। ফালতু!”

ছেলেটা নিহার এক কথাতেই আমাকে ছেড়ে দিল। তারপর নিহা হাত ধরে টেনে আমাকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকল। আমি নিহার কাঁধ চেপে ধরে আর্দ্র কণ্ঠে বললাম,” থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। তুই ঠিক সময় এসেছিস।”

“ছেলেগুলো তোকে কবে থেকে বিরক্ত করছে?”

” এর আগে কখনও করেনি। আজকেই প্রথম।”

” তুই কিছু বললি না কেন? আমি না এলে তো আজ অবস্থা খারাপ ছিল।”

আমি মাথা নিচু করে বললাম,” খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।”

নিহা আমার এই কথায় রাগে ঝনঝন করে বলল,” পাখির মতো আত্মা নিয়ে রাস্তায় চলাফেরা করিস? এদের সাথে বিড়ালের মতো ‘মিয়াও মিয়াও’ করলে তো আরও বেশি পেয়ে বসবে তোকে। প্রতিবাদ করতে যতদিন না শিখবি উত্যক্ত হতে থাকবি। থামবে না এই অনাচার।ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া, মনে রাখিস। এখনও সময় আছে সাহসী হতে শেখ। সবসময় তোর পাশে থাকবো না আমি।”

নিহা কথাগুলো বলে সামনে হাঁটতে লাগল। আমি মাথা নিচু করে তার পেছন পেছন হাঁটছি আর ভাবছি, আজকে যে সাহস নিহা দেখালো সেটা কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব? নিহার মতো রোজ বড় গাড়ি করে ক্যাম্পাসে আসি না আমি।আমার পেছনে ছায়ার মতো শক্ত-সমর্থ ড্রাইভার বা বডিগার্ড থাকে না। নিহার মতো প্রভাবশালী ক্ষমতাবান বাবাও নেই আমার। তাহলে কিসের ভিত্তিতে প্রতিবাদ তুলবো আমি? কার ভরসায়? আজকে নিহার জায়গায় প্রতিবাদটা যদি আমি করতাম, তাহলে হয়তো কালই খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে যেতাম। ধ*র্ষিত কিংবা এ*সিড নি*ক্ষিপ্ত অসহায় এক মেয়ে। যে কিনা প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা নিহা বেশ বলেছে। সবসময় আমার পাশে থাকবে না সে। দিনশেষে আমি একা। আমরা মধ্যবিত্তরা সবসময় বড্ড একা।

ক্লাস শেষ হওয়ার পর নিহা আমাকেও তার সাথে গাড়িতে উঠতে বলল। আমাকে বাড়িতে ড্রপ করে তারপর সে যাবে। কিন্তু ঈশানেরও আমাকে নিতে আসার কথা। আমি ঈশানকে কয়েকবার ফোন করলাম। সে ধরল না। তার জন্য অপেক্ষাতেও ছিলাম। কিন্তু সে এলো না। অবশেষে নিহার সাথে, নিহার গাড়িতেই উঠলাম। যদিও নিহার বাসার রাস্তা আর আমার বাসার রাস্তা সম্পুর্ণ বিপরীত। আমি বাজারের কাছেই নেমে গেলাম। কিন্তু বাড়ি গিয়ে দেখলাম সদর দরজায় তালা ঝুলছে। আমি খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। কোনো এক অবিদিত কারণে মনে শঙ্কা জেগে উঠল। এ সময় তো সবারই বাড়িতে থাকার কথা।ঠিক এই সময় তারিফের ভাইয়াও লাঞ্চের জন্য বাড়ি আসে।
অসময়ে ঘরের দরজায় তালা দেওয়া, বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগল না আমার। আমি পাশের বাসার নাজিফা আন্টির দরজার টোকা দিলাম। মা তার কাছে প্রায়সময় ঘরের চাবি দিয়ে যায়। নাজিফা আন্টি দরজা খুলে আমাকে দেখেই হাসলেন। যেন জানতেন আমি আসব।
“তারিন,এসো ভিতরে এসে বসো।”
” আন্টি আমি বসবো না। বাড়ির সবাই কোথায় গেছে আপনি জানেন?”
” শীঘ্রই চলে আসবে। তুমি ভিতরে আসো।”
” আন্টি কি হয়েছে বলবেন প্লিজ? আমার খুব টেনশন হচ্ছে।”
” টেনশনের কিছু নেই। ছোটখাটো একটা ঝামেলা হয়েছে। তাই সবাই থানায় গেছে।”

আমি বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে চাইলাম,”থানায় মানে? থানায় কেনো গেছে আন্টি?”
“তোমাদের বাসায় একটা ফরসা করে লম্বা ছেলে আছে না? ওই ছেলে আমাদের কমিশনারের ছেলের হাত মুচ*ড়ে ভেঙে দিয়েছে। তাই নিয়ে কমিশনার মামলা করেছে। সেই ঝামেলা মেটাতেই তোমার ভাইয়াসহ সবাই একসাথে থানায় গেছে। আয়েশা আপা বলে গেছে তুমি ভার্সিটি থেকে এলে আমার ঘরে বসিয়ে রাখতে। ”

আমার কাঁধ থেকে অটোমেটিক ব্যাগটা খসে পড়ল। কে এই কমিশনারের ছেলে? ওই নীল জ্যাকেটওয়ালা নয়তো? হে আল্লাহ, রক্ষা করো! আমি নাজিফা আন্টির ঘরের চৌকাঠে পা রাখলাম না। মনটায় অস্থিরতা চেপে বসল। মেঝে থেকে ব্যাগটা তুলে নিয়েই দৌড় লাগালাম। একটা রিকশা নিয়ে পুলিশ স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। ঝামেলাটা দেখতেই হবে। পুলিশ স্টেশনের সামনে প্রকান্ড মাপের ভীড়। যেন মুভির শ্যুটিং চলছে। আমি ভীড়ের ঠেলাঠেলিতে এক প্রকার যুদ্ধ জয়ের মতো ভেতরে প্রবেশ করলাম। পুলিশ ইউনিফরম পরা একজন লোক আমায় আটকালো। ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাধ্য হয়ে বিপরীত পাশের জানালায় উঁকি দিলাম। সেখানেও মানুষের ঠাসাঠাসি। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জানালা ধরে দাঁড়াতেই ঈশানকে চোখে পড়ল। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ঈশান। হাতে ব্যান্ডেজ। ভাইয়া ঈশানের পাশেই দাঁড়িয়ে। দেয়াল ঘেঁষে লম্বামতো একটা বেঞ্চিতে বসে আছেন ভুড়িওয়ালা সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক। মধ্যবয়স্ক। গালে দাঁড়ি নেই তবে মুচ আছে। বিরক্তিকর চেহারা। ভদ্রলোকের পাশেই গলা থেকে হাত পর্যন্ত ব্যন্ডেজ নিয়ে বসে আছে এক যুবক। আমার চিনতে ভুল হলো, এটাই সেই নীল জ্যাকেটওয়ালা ছেলে। কমিশনারের অপর পাশে পুলিশ অফিসার এবং কিছু লোক-জন। আরো একটু ভালোভাবে উঁকি দিতেই মা আর বুড়িকেও খুঁজে পেলাম। তারা চেয়ারে বসে আছেন। মা বোরখা পরা, বুড়ি বোরখার সাথে নিকাবও পরা। কমিশনার সাহেব বেশ গর্জনের সাথে বলে উঠলেন,
” হিরোগিরি দেখাও? সুন্দর চেহারা নিয়া হিরোগিরি৷ তাই না? এই কোন কোচিং এর টিচার তুমি? নাম কি কোচিং এর কও তো?”
তারিফ ভাই বলল, “সেটা মুল বিষয় না। আমাদের এখানে কেনো ডেকে আনা হয়েছে আর ঈশানের বিরুদ্ধে কেনো অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেই অভিযোগ কতটা যৌক্তিক সেটাই আসল বিষয়।”
ভাইয়া ঈশানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” ঈশান, তুমি কি সত্যিই এই ছেলের হাত ভেঙেছো?”
ঈশান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। আমি আতঙ্কে মুখ চেপে। ভাইয়ার চেহারাতেও কাঠিন্য ভর করল। কড়া গলায় ভাইয়া জিজ্ঞেস করল ,
” কেনো করলে এই কাজ?”
ঈশান স্থির তবে ক্রুদ্ধ গলায় বলল,” ক্যাম্পাসের বাইরে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করছিল। বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছিল। আর সবথেকে বাড়াবাড়ি যেটা করেছে, তারিনের গায়ে হাত দিয়েছে।”
ভাইয়া আঁড়চোখে একবার নীল জ্যাকেট মানে এখন যে সাদা ব্যান্ডেজ পরা অবস্থায় বসে আছে তার দিকে চাইল। অতঃপর ভাইয়া স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” হাত ভেঙে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। হারামজা*র হাত কেটে দেওয়া উচিৎ ছিল।”
ভাইয়ার এই কথায় আমিই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ঈশানকে দেখলাম মাথা নিচু রেখেই মুচকি হাসল। কিন্তু কমিশনার সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন।

কমিশনার সাহেব ঈশানকে জেলে ভরে তবেই ক্ষান্ত হলেন। যদিও বেশিক্ষণ ঈশানকে জেলে রাখা সম্ভব হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, এটুকু সময়ের ব্যবধানেই ঈশানের জামিন সম্পন্ন হলো। ঈমান আঙ্কেল স্বয়ং ব্যারিস্টার নিয়ে এসেছিলেন একমাত্র ছেলের জামিনের ব্যবস্থা করতে। ঈশানের জামিনের জন্য বেশ পরিমাণ টাকার প্রয়োজন ছিল। ভাইয়া সেই টাকার ব্যবস্থা করতে ভেবেছিল বাইকটা বিক্রি করে দিবে। ভাইয়ার এমন সিদ্ধান্তে আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। ঈশান, মাত্র কিছুদিনের পরিচিত একটি ছেলের জন্য ভাইয়া তার এতোবছরের সঙ্গী, এতো প্রিয় বাইক বিক্রি করে দিতে চাইল! তবে ঈশান সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসায় ভাইয়াকে আর নিজের বাইক বিক্রি করতে হয়নি। কিন্তু ভাইয়া চূড়ান্ত বিস্মিত হল। ঈশান জামিন কিভাবে পেল? টাকার ব্যবস্থা কিভাবে হলো? এই সকল প্রশ্নের উত্তরে ঈশান তার কাল্পনিক বন্ধুর কথা জানাল। যে বন্ধু ঈশানকে পার্টটাইম জব হিসেবে উবার ড্রাইভিং করার জন্য গাড়ি দিয়েছে, থানায় এসে ঈশানের জামিনও সেই করিয়েছে। আদতে এই বন্ধু অন্যকেউ নয়। স্বয়ং ঈশানের বাবা মহাশয়।

ভাইয়ার খুব মনবাসনা হলো ঈশানের বন্ধুকে একটিবার স্বচক্ষে দেখার। কে সেই ভালোমানুষ? ভাইয়ার মতে এমন বন্ধু পেতে কপাল লাগে। মা আর বুড়ি তো ঈশানের সাহসের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আমাকে বিরক্ত করার অপরাধে ঈশান একদম ছেলেটার হাতই ভেঙে দিল। তাও কোনো সাধারণ ছেলে নয়; একদম কমিশনারের ছেলে! মা আমার মাথায় রেখে বলল,” এখন থেকে আমার আর কোনো চিন্তা নেই। আমার মেয়ের রক্ষাকবচ পেয়ে গেছি।”

আমি দাদী আর মায়ের মাঝখানে বসে লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলাম। এমন সময় নিহার ফোন আমাকে বাঁচিয়ে দিল। আমি ফোন রিসিভ করার বাহানায় একদৌড়ে ঘরে চলে এলাম। কিন্তু নিহার কাছে যে খবর শুনলাম এরপর আমার সমস্ত হাসি ফুড়ুৎ। মনে জন্ম নিল একরাশ আতঙ্ক।

” খুব বড় ঝামেলা হয়ে গেছে তারু। গতকাল তোর বাড়িতে এলাম না? উঠানে দাঁড়িয়ে সাফিনের সাথে কথা বলছিলাম। ফোন রেখে পেছনে ঘুরতেই দেখি তারিফ ভাইয়া। ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। কারণ সাফিনের সাথে আমি ফোনে ঈশান ভাইয়ের ব্যাপারে কথা বলেছি। ঈশান ভাই তোকে চিঠি দিয়েছিল, মেকাপরুমে তোকে স্পর্শ করেছিল এগুলো সাফিনকে ফোনে বলছিলাম তখন। আর তোর ভাই পেছনে দাঁড়িয়ে শুনছিল।”

আমি মাথায় হাত চেপে ধরলাম। রুদ্ধশ্বাসে বললাম,” এসব তুই কি শোনাচ্ছিস নিহা?”

” হ্যাঁ। কিন্তু তখন আমি বুঝিনি। কারণ তারিফ ভাইয়া কথাগুলো শোনার পরেও ওইসময় কোনো রিয়েক্ট করেননি। তাই ভেবেছিলাম উনি হয়তো কিছু শোনেইনি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে তারিফ ভাই আমাকে ফোন করলেন। উনি এখন ঈশান ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাইছেন। অর্থাৎ উনি সবই শুনেছেন।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,” মানে? ভাইয়া তোকে ফোন করে ঈশানের সাথে দেখা করতে চাইবে কেন? ঈশান তো আমাদের বাড়িতেই আছে।”

” আরে গাঁধী, তোর ভাই কি আর এটা জানে যে তোদের বাড়ির ঈশানই আমার কাজিন ঈশান? ভাইয়া তো আমার কাজিনকে ক্রিমিনাল ভাবছে।”

আমি ক্লান্ত স্বরে বললাম,” নিহা, আমার মাথা ঘুরছে। কি হচ্ছে এসব বলতো? দিন দিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। ”

নিহা বলল,” আমার মনে হয় ঈশান ভাইয়া সেদিন ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারিফ ভাইয়াকে সবকিছু জানিয়ে দিলেই ভালো হতো। তুই শুধু শুধু তাকে আটকাতে গিয়ে এতোবড় এক্সিডেন্ট ঘটালি। আমার কি মনে হয় জানিস? এখনি তোর ভাইয়াকে সবকিছু বলে দেওয়া উচিৎ।”

আমি একহাতে মাথা চেপে ধরে বললাম,” এটা সম্ভব না নিহা। তারিফ ভাইয়া এখন ঈশানকে অনেক বেশি বিশ্বাস করে ফেলেছে। যদি ভাইয়া জানতে পারে ঈশান বিশ্বাসঘাতক তাহলে প্রচন্ড কষ্ট পাবে। তুই জানিস ঈশানকে জামিন করানোর জন্য ভাইয়া নিজের বাইক পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে নিয়েছিল। আমি কিভাবে ভাইয়াকে সত্যি কথাটা বলব? এটা আমার দ্বারা সম্ভব না।”

নিহা হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,” তাহলে এখন একটাই উপায় আছে।”

” কি উপায়?”

” অন্যকাউকে ঈশান সাজিয়ে তোর ভাইয়ের কাছে নিয়ে যেতে হবে।”

” ধূর, কি বলছিস? এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।”

” এছাড়া আর কি করার আছে? ভাইয়া তো ঈশানকে দেখতে চায়!”

” ঈশানকে সামনে পেলে ভাইয়া যদি মারধোর করে? শুধু শুধু একটা নির্দোষ মানুষকে মা’র খাওয়াব নাকি?”

” এমন একটা বলির পাঠা আমি রেডি করে রেখেছি৷ তোর জন্য সে মারও খেতে রাজি।”

” কার কথা বলছিস?”

” ফাহিম ভাই।”

সকাল সকাল ঈশানের ফোনে ফাহিম ভাই ম্যাসেজ করল,” যমের দুয়ারে যাচ্ছি ভাই৷ বেঁচে থাকলে দেখা হবে। দোয়া কোরো।”

ঈশান এমন ম্যাসেজ দেখে সাথে সাথে কলব্যাক করল। ফাহিম ভাইয়ের ফোন রিসিভ করল নিহা। ঈশান হকচকিয়ে বলল,” নিহা, ফাহিমের কি হয়েছে? আমাকে এমন অদ্ভুত ম্যাসেজ দিল কেন?”

নিহা পুরো ঘটনা বুঝিয়ে বলল। সে এখন ফাহিম ভাইকে নিয়ে তারিফ ভাইয়ার ওয়ার্কশপে যাচ্ছে। ঈশান এই কথা শুনে প্রথমে খুব রাগারাগি করল। তাকে কেন কিছু জানানো হয়নি? কিছুক্ষণের মধ্যে সেও বেরিয়ে পড়ল। যে অন্যায় সে নিজে করেছে সেই অন্যায়ের জন্য ফাহিম ভাই ফাঁসবে এটা ঈশান মানতে রাজি নয়।

সকাল সকাল ভাইয়ার ওয়ার্কশপে হাজির হলো নিহা এবং ফাহিম ভাই। ভাইয়া থমথমে দৃষ্টিতে ফাহিম ভাইকে কিছুক্ষণ আপাদমস্তক দেখল। তারপর প্রশ্ন করল,” তোমার নাম ঈশান?”

ফাহিম ভাই ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে উত্তর দিল,” জ্বী ভাইয়া। আসসালামু আলাইকুম।”

নিহা ফাহিম ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল,” আসলে ভাইয়া, ও আপনাকে স্যরি বলতে এসেছে।”

তারিফ ভাই লক্ষ্য করল, ভয়ে ফাহিম ভাইয়ের হাঁটু কাঁপছে। তারিফ ভাই মৃদু হেসে বলল,” এই সাহস নিয়ে আমার বোনকে চিঠি লেখো?”

ভাইয়ার কঠিন দৃষ্টির সামনে অসহায় হয়ে ফাহিম ভাই পেছনে ঘুরে দৌড়ে পালাতে চাইল। তখনি ঈশান উপস্থিত হলো। ফাহিম ভাই তাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বলল,” ভাই বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও।”

ঈশান ফাহিম ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,” তোর কিছু হবে না। ”

তারিফ ভাইয়া অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,” তুমি এখানে কি করছ ঈশান? ওকে চেনো নাকি?”

ঈশান স্পষ্ট কণ্ঠে জবাব দিল,” হুম চিনি। ওর নাম ঈশান নয় ভাইয়া। ওর নাম ফাহিম।”

নিহা সাথে সাথে বলল,” ঈশান স্যার আর ফাহিম ভাই হলো ফ্রেন্ডস। কলেজ লাইফ থেকে তারা ফ্রেন্ডস। আপনি যেন ফাহিম ভাইকে কিছু না করেন তাই ঈশান স্যার বাঁচাতে এসেছেন। একেই বলে বন্ধুত্ব।”

ঈশান চোয়াল শক্ত করে তাকাল। বিরবির করে বলল,” নাটক বন্ধ কর নিহা। আমি তোর স্যার না, আমি তোর ভাই।”

নিহা দৃঢ় চিত্তে ফিসফিস করে বলল,” প্লিজ ঈশান ভাইয়া, একটু চুপ থাকুন। যা হচ্ছে সব তারুর সম্মতিতে হচ্ছে।”

তারিফ ভাই বিভ্রান্ত হয়ে বলল,” মানে কি এসবের? ওর নাম ফাহিম হলে প্রথমে ঈশান কেন বললে?”

নিহা জবাব দিল,” কারণ ওর ডাকনাম ঈশান। আর কলেজে নাম ফাহিম ছিল। তাই ঈশান স্যার তাকে ফাহিম নামেই ডাকে। তাই না স্যার?”

নিহা করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশান তৎক্ষণাৎ৷ নিজের উদ্দেশ্য বদলে ফেলল। মাথা নিচু করে বলল,” হুম।”

তারিফ ভাই বিরক্ত হয়ে বলল,” কি আলতু-ফালতু মানুষের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করো। এই ছেলে কি করেছে শুনলে তোমার এখনি ইচ্ছে করবে হাত ভেঙে দিতে। তারুকে চিঠি লিখেছে। শুধু তাই না, নিহার এংগেজমেন্ট পার্টিতে তারুর গায়েও হাত দিয়েছিল।”

ফাহিম ভাই ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কিছু একটা বলতে চাইল। নিহা তার হাত চেপে ধরায় সে চুপ হয়ে গেল। ঈশানও মাথা নুইয়ে চুপ করে আছে। তারিফ ভাই বলল,” কি ব্যাপার? কিছু বলছ না কেন তুমি? তোমার কি রাগ লাগছে না? সেদিন তো কমিশনারের ছেলের হাত ভেঙে দিলে। আর এখন বন্ধুর বেলায় চুপ করে আছো কেন?”

ঈশান কোনো জবাব দিল না। ভাইয়া রেগে বলল,” আমি বলছি ঈশান, তুমি আমার সামনে এই ছেলেকে দু’টো চড় দাও।”

নিহা চোখ বড় করে তাকাল ঈশানের দিকে। ঈশান কিছু বলতে নিলেই নিহা চোখের ইশারায় অনুরোধ জানাল। অতঃপর ঈশান বাধ্য হয়ে ফাহিম ভাইয়ের দিকে ঘুরল। ফাহিম ভাই ভয়ে আগে থেকেই নিজের গাল চেপে ধরে আছে। তারিফ ভাই তাগাদা দিল,” দেরি কোরো না। চড় মারো। গুণে গুণে দুইটা। প্রথমটা চিঠির জন্য, পরেরটা অসভ্যতামির জন্য।”

ঈশান চড় মারার আগে বিরবির করে বলল,” স্যরি ফাহিম। আমাকে ক্ষমা করে দিস।”

আমি একশোবার নিষেধ করেছি। আমার পেইজ ছাড়া অন্যকোথাও তি আমো গল্প দেখলে সেটা পড়বেন না। ওইটা পড়ে কোনো মজাই পাবেন না বিশ্বাস করেন। দয়া করে আমার পেইজ থেকেই পড়ুন। আমি তো বেশি অপেক্ষাও করাচ্ছি না। প্রতিদিন ২ পর্ব করে দিচ্ছি। একটু কি ধৈর্য্য ধরা যায় না? এর আগে কোনো রাইটারকে দেখেছেন এতো দ্রুত গল্প দিতে? অন্তত আমার এইটুকু অনুরোধ রাখেন! প্লিজ, কেউ অন্য পেইজ থেকে তি আমো গল্প পড়বেন না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here