তি আমো পর্ব -৩০+৩১

#তি_আমো
পর্ব ৩০
লিখা- Sidratul Muntaz

মোহনা আন্টি আর ভাইয়া একই সাথে ঈশানকে ফোন করছে৷ দু’জন অবিরত এক নাম্বারে চেষ্টা করার পর মোহনা আন্টি বললেন,” নেটওয়ার্ক বিজি দেখাচ্ছে। ঈশান কোথায়?”

তারিফ ভাইয়া শুকনো মুখে বলল,” এখানেও নেটওয়ার্ক বিজি। ওরা দু’জন কি তাহলে এক জায়গায় আছে?”

মোহনা আন্টি গলা উঁচু করে বললেন,” ওই বদমাইশ আমার ছেলেকে কোথাও নিয়ে যায়নি তো আবার?”

ভাইয়া আঁড়চোখে তাকিয়ে বলল,” আমার ভাইয়ের যদি কিছু হয় আমি কিন্তু আপনার ছেলেকে ছাড়ব না।”

মোহনা আন্টি চোয়াল শক্ত করলেন। দুশ্চিন্তা এবং রাগের সংমিশ্রণে তার চেহারা লাল হয়ে উঠেছে। গজগজ করে বললেন,” ওই বদমাইশের কথা জানিনা।কিন্তু আমার ছেলের গায়ে যদি কোনো ফ্লিপ টেপও লাগে তাহলে খবর আছে।”

ভাইয়া হঠাৎ বেশি চটে গিয়ে বলল,” বার-বার বদমাইশ কাকে বলছেন আপনি? আপনার নিজের ছেলে বদমাইশ। এক নম্বরের বদ।”

মোহনা আন্টি জবাব দিলেন চিবিয়ে চিবিয়ে,”আমার ছেলে বদ? শুনুন, আমার ছেলে যথেষ্ট ভালো। কাকে জিজ্ঞেস করবেন আমার ছেলের চরিত্র সম্পর্কে? এইযে রুবা আপা আছেন, সাফিন আছে, ওদের জিজ্ঞেস করুন। কি আপা? বলেন?”

রুবা আন্টি সম্মতি জানাতে দ্রুত মাথা নাড়লেন,” হ্যাঁ তো। ঈশানকে ছোটবেলা থেকে চিনি না? কত ভালো একটা ছেলে!”

সাফিন ভাইয়া অতি প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন,” ঈশানের মতো ভালো ছেলে হয় নাকি? ও তো কোনো সাধারণ ছেলেই না.. হি ইজ এঞ্জেল!”

মোহনা আন্টি আড়চোখে তাকাতেই সাফিন ভাইয়ের মুখ কাঁচুমাচু হয়ে গেল। মোহনা আন্টি কঠিনভাবে বললেন, “এঞ্জেল মেয়েদের বলা হয়।”

সাফিন ভাইয়া হতভম্ব হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, “ও আচ্ছা। তাহলে বাংলায় বলি, ফেরেশতা। এইবার ঠিকাছে মেইবি।”

তারিফ ভাইয়া সাথে সাথে গর্বের সহিত বুক ফুলিয়ে বলল,” ফেরেশতা তো হচ্ছে আমার ভাই। আমরা যখন সবচেয়ে বিপদে ছিলাম তখন সে ফেরেশতার মতো আমাদের সাহায্য করেছে। কাল আমার বোনের সাথে ফেরেশতার মতো ছিল। সে একদম ফেরেশতার মতোই ভালো মানুষ। ”

সাফিন ভাইয়া মুখ কালো করে বললেন, ” কিন্তু ফেরেশতা মানুষ হয় না।”

তারিফ ভাই বিরক্ত হয়ে তাকালেন। ঝারি দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ জানি। কিন্তু মানুষ তো ফেরেশতা হয়।”

সাফিন ভাই মাথা নাড়লেন। মোহনা আন্টি টিটকিরি মারতে বললেন,” কিছু কিছু মানুষ আবার শয়তানও হয়।”

ভাইয়ার চোখ দিয়ে আবার আগুনের হলকা ছুটে গেল।এতোক্ষণে বুড়ি সামনে এগিয়ে এসে মোহনা আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ” শুনো মাইয়া, একখান কতা কই। আমি তুমার মুরব্বি। জীবনের অবিজ্ঞতা তুমার থেকা বেশি হইছে আমার। এইযে দেহো আমার মাথার সব চুল কলাম সাদা৷ তুমার মাথার চুল আবার সব রঙ্গিন। এইত্তুন বুঝোনই যায় কার মানুষ চেনার খেমতা বেশি।”

মোহনা আন্টি এক ভ্রু বাঁকা করে বললেন, ” চুলের রং দিয়ে মানুষ চেনার ক্ষমতা পরিমাপ করা হয় নাকি?”

বুড়ি হেসে মাথা নাড়িয়ে বলল, “যার নামে তুমি এতো কতা কইতাছো, হেরে কি তুমি দেখছো?”

“দেখা দিলেই না দেখবো! দেখাই তো দিচ্ছে না আপনাদের পাত্র।চোরের মতো পালিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত ছেলেরা চোরের বংশ। ”

ভাইয়া আঙুল উঠিয়ে কিছু বলতে এলেই বুড়ি বাঁধা দিয়ে সরাল,” যা, আমি কতা কইতাছি না?”

তারপর বুড়ি মোহনা আন্টির দিকে চেয়ে নরমভাবে বলল, “শুনো, আগে আমার কতাখান শুইন্না লও। মানুষরে না দেইখা, না জাইনা বিচার করোন ঠিক না। এইযে এতোকিছু মাষ্টরের নামে কইতাছো, তারে যদি একবার নিজে চক্ষে দেখতা তুমার দারনাডাই কলাম বদলায় যাইতো। আমগো মতো তুমিও হেরে সোজা মনে ভরসা কইরালাইতা।”

“কেনো? ছেলে কি জাদু টোনা জানে? এখন বুঝতে পারছি, আপনাদের সবাইকে বশ করে ফেলেছে। এজন্যই তারিনকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। কি যেন বলে? ব্ল্যাক ম্যাজিক!”

ভাইয়া রেগে-মেগে বলল,” অনেক সহ্য করেছি। আর না।”

এই কথা বলেই সে তেড়ে আসতে চাইল মোহনা আন্টির দিকে। মা আর সাফিন ভাই আমার ভাইয়াকে দ্রুত থামাল। আমি আর ঈশান তাদের সামনে যাওয়ার জন্য হাত ধরে যখনি বের হয়েছি তখনি ফাহিম ভাই করিডোরে উপস্থিত হলো। সে হুট করে কিভাবে টপকাল সেটা আমরা কেউই আগে বুঝতে পারলাম না। নিহা তড়িঘড়ি করে আমাকে আর ঈশানকে আবার ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। আমি বিরক্ত গলায় বললাম,” কি করছিস তুই?”

নিহা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,” ঈশান ভাইয়া এখন গেলেই তো ধরা পড়ে যাবে।”

আমি দাঁতে দাঁত পিষে বললাম,” আমরা তো ধরা দিতেই যাচ্ছি গাঁধী।”

নিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” ও আচ্ছা। সেটাই তো! ওকে যা। বেস্ট অফ লাক। ”

আমরা বের হতে নিলেই নিহা আবার বলল,” দাঁড়া, দাঁড়া।”

তারপর সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় শুরু করল। আমি অধৈর্য্য হয়ে বললাম,” করছিসটা কি তুই?”

” আয়তুল কুরছি পড়ি।”

আমি ঈশানের দিকে চেয়ে বললাম,” দেখুন তো, আমরা কি জ্বীনের কাছে যাচ্ছি?”

ঈশান হেসে বলল,” আচ্ছা দাঁড়াও, আয়তুল কুরছি বিপদের সময়ও পড়তে হয়৷ তাছাড়া এখন পরিবেশ অনেকটাই গরম। একটু ঠান্ডা হলে তারপর যাই। সমস্যা কি?”

নিহা চোখ মেলে বলল,” আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে।”

আমি জানতে চাইলাম,” কি আইডিয়া?”

” শোন, তোদের এখন ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। কারণ ওরা দুইজন যেভাবে ঝগড়া করছে, তোরা সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ঝগড়া আরও বেড়ে যাবে। বিস্ফোরণ শুরু হবে। তোর ভাই যদি হয় আগুন তাহলে মোহনা আন্টি বারুদ। এই দু’জনকে একসঙ্গে রেখে কিচ্ছু করা সম্ভব নয়। এর চেয়ে ভালো ঝগড়া থামুক। দুইজন যখন আলাদা থাকবে তখন তোরাও আলাদা গিয়ে সবকিছু বুঝিয়ে বলবি।”

আমি নিহার সাথে একমত হতে পারলাম না। তবে ঈশান মাথা নেড়ে বলল,” দ্যাটস আ গুড আইডিয়া।”

আমি মৃদু প্রতিবাদ করলাম,” ভাইয়ার সামনে একা দাঁড়াতে আমার ভয় লাগবে। ঈশান থাকলে আমি সাহস পাব। তাই একসঙ্গে যাওয়াই ভালো। ”

নিহা তখন চুটকি বাজিয়ে বলল,” আরও ভালো প্ল্যান আছে আমার কাছে। তারু, তুই যাবি মোহনা আন্টির কাছে। মোহনা আন্টিকে তুই সব বুঝিয়ে বলবি। তাহলে তোর আর ভয় লাগবে না। এদিকে ঈশান ভাই যাবে তারিফ ভাইয়ের কাছে। আর তারিফ ভাই তো এখন ঈশানের সব কথা মানে। তাই ঈশানের ব্যাখ্যাটাও মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং বুঝবে!”

আমার এই বুদ্ধিটা খুবই পছন্দ হলো। পুনরায় নিহার মাথায় গাট্টা মেরে বললাম,” গাঁধী একটা। এতো ভালো বুদ্ধি আগে দিলি না কেন?

ফাহিম ভাইকে দেখে ভাইয়া তখন তড়াক করে বলে উঠেছে,” এইতো, পাপী বান্দা হাজির।”

মোহনা আন্টি ভ্রু কুচকে ফাহিম ভাইয়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,” ঈশানকে দেখেছ ফাহিম?”

ফাহিম ভাইয়া ভীতদৃষ্টিতে ভাইয়ার দিকে চেয়ে বলল,” না তো। আমি ঈশানকে চিনি না।”

এই কথা বলে সে পালিয়ে যেতে চাইল। ভাইয়া সঙ্গে সঙ্গে তার উপর সাড়াশি আ/*ক্রমণ করল। তার কলার চেপে ধরে বলল,” এক মিনিট, তোমার মা অনেকক্ষণ ধরে আমার সাথে তর্ক করে যাচ্ছে। মাথা-টাথা একদম গরম হয়ে গেছে। খবরদার জায়গা থেকে নড়বে না। চুপচাপ এখানে দাঁড়াও। আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব।”

ফাহিম ভাইয়ের চেহারার অবস্থা দেখলে মনে হবে এক্ষণি কেঁদে ফেলল। ভাইয়া রক্তবর্ণ দৃষ্টিতে বলল,” পার্টিতে যে আমার বোনের সাথে অসভ্যতা করেছিল সে কে?”

ফাহিম ভাইয়া মোহনা আন্টির দিকে তাকাল। মোহনা আন্টি হাত ভাজ করে বললেন,” সত্যিটা বলে দাও ফাহিম।”

ফাহিম ভাইয়া কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” ঈশান।”

ভাইয়া রাগে ফাহিম ভাইয়ের কাঁধ আরও শক্ত করে চেপে ধরল। মোহনা আন্টি ফটাফট বললেন,” কোন ঈশান? পুরো নাম বলো।”

ভাইয়া হিমশীতল দৃষ্টিতে হুমকি দিল,” মিথ্যা বললে কিন্তু একদম পুঁতে ফেলব।”

ফাহিম ভাইয়া গ্যাঁরাকলে ফেঁসে গেল যেন। চোখ বন্ধ করে বলে উঠল,” পুরো নাম, ঈশান আক্তার ফাহিম।”

তার এমন উত্তরে আমরা সবাই হোচট খেলাম। এতো বুদ্ধু কেউ হয়? ‘ আক্তার’ শব্দটা তো মেয়েদের নামে থাকে। ভাইয়া ফটাশ করে ফাহিম ভাইয়ের গাল চড় দিয়ে বলল,” মশকরা হচ্ছে?”

ফাহিম ভাইয়ের পুরো শরীর কাঁপছে তখন। তড়িঘড়ি করে বলল,” আমি কিছু জানি না৷ আমি কিছু জানি না।”

মোহনা আন্টি অবাক হয়ে বললেন,” ফাহিম তুমি এমন করছ কেন? ভয় পাওয়ার কি আছে? সত্যি বলতে আবার কিসের ভয়? এই বাজে লোক তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। আমি আছি তোমার পাশে।”

তারিফ ভাই বিদ্রূপ করে বলল,” যাও বাবু, মায়ের আঁচলের তলায় লুকাও। এভাবেই ছেলের অন্যায়কে প্রটেস্ট করে যাবেন।”

মোহনা আন্টি বিরক্তি নিয়ে বললেন,” ফাহিম আমার ছেলে না। ও আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে।”

ভাইয়া হাত তালি বাজিয়ে বলল,” দারুণ! নিজের ছেলেকে এখন ধরা পড়ার ভয়ে ভাইয়ের ছেলে বানিয়ে দিলেন? ছি, আপনার মতো মা শত্রুরও না থাকুক।”

মোহনা আন্টি আক্রোশ নিয়ে বললেন,” আপনার সমস্যাটা কি? এতো ফালতু কথা বলছেন কেন? আমার ছেলের নাম ঈশান৷”

ফাহিম ভাই চিৎকার করে বলল,” আমি ঈশান না। আমি ঈশান না। আমি ফাহিমও না।”

এই কথা বলতে বলতে সে দৌড়ে পালালো। তারিফ ভাই ফোড়ন কাটল,” মা যদি হয় সিংহী, ছেলে তাহলে বেড়াল। এই ভীতু ছেলেকে নিয়েই এতো অহংকার করেন?”

মোহনা আন্টি ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তরও দিলেন না। মনে হয় তিনি ধৈর্য্য হারিয়েছেন। ভাইয়া ফোন বের করে বলল,” আপনার মোবাইল নাম্বার দিন।”

মোহনা আন্টি বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,” কেন?”

” ঈশানকে পেলে আপনাকে ফোন করব।”

মোহনা আন্টি হাত পেতে বললেন,” আপনার মোবাইল দিন। আমি লিখে দিচ্ছি।”

ভাইয়া মোবাইল বের করে মোহনা আন্টির হাতে দিল। মোহনা আন্টি নাম্বার টাইপ করতে লাগলেন। ভাইয়াও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে তখন। তারপর কি হলো আমরা কিছুই জানি না। ঝগড়াটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম৷ পরিবেশ এখন বরফের মতো ঠান্ডা। আমি চলে গেলাম মোহনা আন্টির কাছে। সবকিছু স্বীকার করে নিতে। আর ঈশান চলে গেল ভাইয়ার কাছে।

মোহনা আন্টি মাথায় হাত রেখে বিছানার সাথে হেলে বসে ছিলেন। আমি আড়ষ্ট কণ্ঠে ডাকলাম,” আন্টি।”

মোহনা আন্টি নিথর। কোনো কথা বলছেন না। ঝগড়া করে কি বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন? আমি আবার ডাকলাম,” আন্টি।”

মোহনা আন্টি চট করে চোখে হাত দিয়ে বললেন,” কে তারিন? বসো।”

আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হলাম। ভাইয়া আর মোহনা আন্টিকে হয়তো আমরা অনেক বেশি কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মনে মনে অপরাধবোধ তৈরী হলো। আর দেরি নয়, এখনি সব সত্যি বলে ক্ষমা চাইব। আমি উশখুশ করে বলে ফেললাম,” একটা কথা বলি আন্টি?”

” বলো।” মোহনা আন্টির নিস্তরঙ্গ উত্তর। তিনি আমার সাথে এতো ভালো করে কথা বলেন। কিন্তু আজ কেন এমন করছেন? সব কি বুঝে ফেলেছেন? এমন হওয়া অসম্ভব কিছু না। একটু বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলেই পুরো বিষয়টা বুঝে নেওয়া যায়। এই ভেবে আমার বুক কাঁপতে লাগল। গলা শুকিয়ে গেল। ঢোক গিলে বললাম,” অনেক জরুরী কথা।”

মোহনা আন্টি আগের মতোই বিরস মুখে উত্তর দিলেন,” বলো, শুনছি।”

আমি চোখ বন্ধ করে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে বিস্তারিত সবকিছু বুঝিয়ে বললাম। মোহনা আন্টি শুধু শুনেই গেলেন। একবারও আমার কথার মাঝে প্রশ্ন করলেন না। তাই আমার বলতে সুবিধা হলো। আমি কিছুই বাদ রাখলাম না। সবটা গুছিয়ে বললাম। তারপর অনুতপ্ত কণ্ঠে ক্ষমা চেয়ে বললাম,” আমাদের মাফ করে দিন না, আন্টি। আর কখনও মিথ্যা বলব না। কথা দিচ্ছি। আপনাদের কাছে আর কখনও কিছু লুকাব না। ভুল হয়ে গেছে।”

মোহনা আন্টি নাক টেনে মৃদু হেসে বললেন,” আচ্ছা।”

আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, হাসিটা মোহনা আন্টির চোখ অবধি পৌঁছালো না। তিনি জোর করে হাসছেন। আমি বিব্রত হয়ে বললাম,” আপনি কি আমার সব কথা শুনেছেন আন্টি? বুঝেছেন আমি কি বলেছি?”

” হ্যাঁ বুঝেছি।”

” আপনি একটুও রেগে নেই।”

মোহনা আন্টি অতি সহজভাবে বললেন,” একদমই না। এখানে তোমাদের দোষ নেই। জীবনে অনেক কিছু ঘটে যায় যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। জীবনটা কখনও আমাদের ইশারায় চলে না তারিন। সবসময় সেটাই হয়, যেটা আমরা কখনও চাইনি।”

আমি ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম,” এখন কি হবে? আমি আর ঈশান কি এক হতে পারব না?”

মোহনা আন্টি আমার দিকে চাইলেন মায়াভরা দৃষ্টিতে। তার চোখে অশ্রু টলমল। প্রশ্ন করলেন ভারী কণ্ঠে, ” ঈশানকে খুব ভালোবাসো?”

আমার চোখেও অশ্রু চলে এলো। আঙুলের ডগা দিয়ে মুছতে মুছতে বললাম,” হুম।”

মোহনা আন্টি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” তোমরা সবসময় ভালো থেকো।”

আমি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে চাইতেই মিষ্টি হাসলেন মোহনা আন্টি। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। মোহনা আন্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তখন। আমি খুব হকচকিয়ে গেলাম।

ঈশানের সাথে দেখা হলো করিডোরেই। কিছুক্ষণ আগেই এখানে দুনিয়া তোলপাড় করা ঝগড়া হচ্ছিল। আর এখন পরিবেশ কত শান্ত, নিশ্চুপ। বাতাসের শা শা শব্দটাও কানে লাগছে। আমি ঈশানের দিকে ধেঁয়ে যেতে যেতে আনন্দিত কণ্ঠে বললাম,” মিশন সাক্সেসফুল। ইয়েস!”

তারপর জড়িয়ে ধরলাম ঈশানকে। আমার পা অনেকটা উঁচুতে উঠে গেল। ঈশান শুকনো গলায় বলল,” এখনি এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। অর্ধেক কাজ হয়েছে শুধু। ”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,” মানে? আপনি ভাইয়াকে বলেননি?”

” খুঁজেই তো পেলাম না তোমার ভাইকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায় গেছেন কে জানে!”

” আপনাকে খুঁজতে যায়নি তো আবার?”

” হতেও পারে। ফোন করব একটা? ”

” হ্যাঁ করুন।”

ঈশান ফোন করতে নিয়েও থেমে গেল। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,” মম কিভাবে এতো ইজিলি মেনে গেল?”

আমি উত্তেজিত গলায় বললাম,” সেটা তো আমিও ভাবছি। উনি আমাকে একটা ধমক পর্যন্ত দেননি। কিছুই বলেননি। আমি অবাক!”

ঈশান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” আমার মম খুব সুইট। সব মেনে নিবে জানতাম। এখন তোমার খরুস ভাই কি করে সেটাই দেখার বিষয়।”

আমি রাগী গলায় উচ্চারণ করলাম,” আমার ভাইকে খরুস বলবেন না।”

চলবে#তি_আমো
পর্ব ৩১
লিখা- Sidratul Muntaz

চারদিকে বাতাসের শা শা শব্দ এবং পাশাপাশি ঈশানের জোরালো হাসির শব্দ৷ আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম। ঈশান হাসি থামিয়ে বলল,” খরুস না হলে ভাইয়াকে এতো ভয় পাও কেন?”

আমি অবহেলায় অন্যদিকে ঘুরে বললাম,” ভয় পাই না। এটা হলো রেসপেক্ট।”

ঈশান আমার বাহু ধরে সটান তার দিকে ঘুরিয়ে নিল। চোখে চোখ রেখে, মুখের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় করে বলল,” রেসপেক্ট তো আমিও করি। কিন্তু তোমার মতো ভয় পাই না তো। আমি খেয়াল করেছি, তোমার ভাইয়ের সাথে কথা বলার সময় তুমি চোখের দিকে তাকাও না। তোমার পা কাঁপে।”

আমি অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকালাম। ঈশান আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হাসছে। আমি মাথা নিচু করে বললাম জবাবদিহি করার উদ্দেশ্যে বললাম,” ছোটবেলায় ভাইয়ার সাথে একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিল। তখন আমার বয়স মাত্র তিন। আধো আধো শব্দে ভাইয়া ডাকা শিখেছি মাত্র। কিন্তু ভাইয়া কখনও আমাকে আদর করতো না। সবসময় ধমকের উপর রাখতো। সেটাও ওই দূর্ঘটনার জন্যই। ভাইয়ার মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছিল। এখন বয়সের সাথে ভাইয়া কিছুটা নরম হলেও আমার ছোটবেলার সেই ভয়টা রয়েই গেছে। এজন্যই ভাইয়ার সাথে আমি খুব সামলে চলি। আমি চাই না ভাইয়া আবার আগের মতো খিটখিটে হয়ে যাক। কিন্তু যতই রাগী দেখাক, ভাইয়া যে আমাকে মনে মনে খুব ভালোবাসে এই কথা আমি বুঝতে পারি। আমিও আমার ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি।”

ঈশান আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। কথা শেষ হতেই সে আমার গালে হাত রেখে বলল,” আর আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি, এই কথা বুঝতে পারো?”

তার হঠাৎ এমন প্রশ্নে আমি হেসে ফেললাম। তারপর হাত ভাজ করে লাজুক মুখে বললাম,” ভাইয়াকে ফোন করবেন না? কোথায় আছে ভাইয়া?”

” ভুলেই গেছিলাম।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলায় ঈশানের কণ্ঠ অভিমান জমল। আমি অন্যদিকে চেয়ে মুখ টিপে হাসলাম। ঈশান ভাইয়ার নাম্বারে ডায়াল করল। কিন্তু ভাইয়া ফোন ধরছে না। ঈশান ভারী বিরক্ত হয়ে বলল,” তোমার ভাই ফোন কেটে দিচ্ছে কেন, আজব!”

আমি মুখ মলিন করে বললাম,” আপনাকে খুঁজতে গেলে তো আপনার ফোন কেটে দেওয়ার কথা না, তাই না?”

” সেটাই। তাহলে তোমার ভাই গেল কই?”

আমি কাঁধ ঝাঁকালাম। কিছুই বুঝতে পারছি না। তারপর নিজের ফোন বের করে আবার ভাইয়াকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। দুইবার রিং হওয়ার পর ভাইয়া আমার ফোনটা ধরল। আমি তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত গলায় বললাম,” হ্যালো ভাইয়া, কোথায় তুমি?”

ওই পাশে অনেক শব্দ তখন। ভাইয়ার আওয়াজ শোনা গেল আবছা আবছা। যতটুকু বুঝলাম, ভাইয়া কোথায় যেন যাচ্ছে। অবশ্যই শহরের বাইরে। কারণ ভাইয়া এই মুহূর্তে বাসস্ট্যান্ডে আছে। আমাকে বলল মা আর বুড়ির খেয়াল রাখতে। ভাইয়া পরে সব জানাবে। আমি প্রশ্ন করলাম,” কিন্তু ভাইয়া, হঠাৎ করে কোথায় যাচ্ছ? কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।”

ভাইয়া অবজ্ঞার স্বরে বলল,” তারু আমি রাখছি। পরে সব বুঝিয়ে বলব। এখন আর বিরক্ত করিস না আমাকে। আমি ফোন বন্ধ করে দিলাম।”

ভাইয়া এই কথা বলেই ফোনটা বন্ধ করে দিল। আমি হতবাক দৃষ্টিতে ঈশানের দিকে চাইলাম৷ ঈশান গুমোট কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার তারিন? এনিথিং রং?”

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,” এভরিথিং ইজ রং!”

ঈশান কাঁচুমাচু হয়ে বলল,” মানে?”

আমি নখে কামড় দিয়ে দ্রুত এপাশ-ওপাশ হাঁটতে লাগলাম। ঈশান আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করাল। প্রশ্ন করল কঠিন গলায়, ” তারিন আমাকে বলো কি হয়েছে? ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না।”

তখন আমি নিজেই মরে যাচ্ছি দুশ্চিন্তায়। উপায়ন্তর খুঁজে না পেয়ে বললাম,” আমাদের এখন বাসস্ট্যান্ডে যেতে হবে।”

” কোন বাসস্ট্যান্ড?”

আমি দ্রুত কণ্ঠে উচ্চারণ করলাম,” এখানে আশেপাশে কি কোনো বাসস্ট্যান্ড নেই?”

” তোমার ভাইয়া কি বাসস্ট্যান্ডে আছে? কোথায় যাচ্ছে?”

আমি দিশেহারার মতো উত্তর দিলাম,” সেটা জানার জন্যই তো বাসস্ট্যান্ড যেতে হবে!”

” তাহলে এসো।”

এই কথা বলেই ঈশান আমার হাত চেপে ধরে বাতাসের গতিতে ছুটতে লাগল। আমিই ভয় পেয়ে বললাম,” আরে, আস্তে চলুন।”

বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে আমি আর ঈশান এদিক-ওদিক দৌড়ে ভাইয়াকে খুঁজছিলাম। ঈশান দক্ষিণে খুঁজলে আমি উত্তরে খুঁজি। ঈশান ডানে খুঁজলে আমি বামে৷ এভাবে একসময় ভাইয়াকে আমরা দু’জনই দেখে ফেললাম। একটি বাস কাউন্টারের ওয়েটিংরুমে বসে আছে। আমরা একসাথে ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমাদের দেখে ভাইয়া খুব চমকে উঠে বলল,” আরে, তোমরা এখানে কেন এসেছ?”

ঈশান ভাইয়ার পাশে বসতে বসতে বলল,” ভাইয়া, আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে?”

ভাইয়া হেসে ফেলে বলল,” আরে, আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো কেন? আমি যাচ্ছি আমার কাজে। খুব জরুরী কাজ৷ তোমাদের এখানে আসার কোনো দরকার ছিল না। যাও, বাড়ি যাও৷ তারুকে নিয়ে যাও।”

আমি হতভম্ব গলায় বললাম,” তোমার হঠাৎ কি এমন কাজ পড়ল যে এভাবে চলে যেতে হবে?”

ভাইয়া বিরক্তির সুরে বলল,” আমার একটা বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে। ইমারজেন্সী কল দিল। আমি না গেলে হবেই না।”

ঈশান মসৃণ গলায় প্রস্তাব করল,” আমিও তাহলে আপনার সাথে চলি ভাইয়া?”

ভাইয়া কিছুটা ধমকের স্বরে উত্তর দিল,” আরে নাহ, তুমি কেন যাবে? তুমি আমার সাথে চলে এলে আমার পরিবারের খেয়াল রাখবে কে?”

ভাইয়ার এই কথায় ঈশানের চেহারাটা কেমন শুকনো হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম কারণটা। ভাইয়া ঈশানকে মনে-প্রাণে এখনও ভরসা করে তার প্রমাণ এই কথার দ্বারাই পাওয়া গেল। অর্থাৎ ভাইয়ার কাছে এখন সত্যিটা স্বীকার করা ঈশানের পক্ষে আরও একটু কঠিন। তবুও আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে ঈশান বলে উঠল,” যাওয়ার আগে আপনার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল, ভাইয়া। যেটা আপনাকে শুনতেই হবে।”

আমি ইশারায় নিষেধ করছিলাম৷ কারণ এখন ভাইয়া দুশ্চিন্তায় আছে। এই অবস্থায় ভাইয়াকে এসব না জানানোই ভালো। কিন্তু তবুও ঈশান বলবেই। ভাইয়া তাড়াহুড়ো কণ্ঠে জবাব দিল,” পাঁচমিনিটে বাস চলে আসবে। কি বলতে চাও তাড়াতাড়ি বলে তারুকে নিয়ে চলে যাও। তোমরা আমার অপেক্ষায় থেকো না। আজকে তোমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তোমরা কিন্তু বিয়ে করে নিও। আমি দূর থেকে তোমাদের জন্য দোয়া করব। ফিরে এসে না হয় অনেক বড় করে আয়োজন হবে বিয়ের।”

আমি আর ঈশান একত্রে উচ্চারণ করলাম, ” না!” ভাইয়া অবাক হয়ে তাকাল। আমি বললাম,” তুমি চলে গেলে আমি ঈশানকে কেন বিয়ে করব ভাইয়া? কখনোই করব না।”

এবার ঈশান অবাক হয়ে আমার দিকে চাইল,” আসলেই করবে না?”

আমি চোখ রাঙালাম। ঈশান চুপ করে গেল৷ ভাইয়া রেগে বলল,” আমি থাকা আর না থাকায় কি? তোদের বিয়ে তোরা করবি।”

ঈশান অনুরোধ করে বলল ,” তার আগে জরুরী কথাটা যে আপনাকে শুনতে হবে! আর পাঁচমিনিটে বলা হবে না। আরও কিছু সময় লাগবে।”

আমি ‘হ্যাঁ’সূচক মাথা নেড়ে ভাইয়ার দিকে চাইলাম। ভাইয়া চটপট করে বলল,” না,না, এতো সময় আমার কাছে নেই। পাঁচমিনিটেই যা বলার বলো। নাহলে আমাকে টেক্সট করে দিও। আমি পরে চেক করে নিব।”

ভাইয়া উঠে রিসিপশনের কাছে গেল। বাস কেন আসছে না জিজ্ঞেস করতে। আমি আর ঈশান আশাহত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ঈশান বিড়বিড় করে আমার কাছে এসে জানতে চাইল,” কি বলো? টেক্সটে বলব?”

আমি নিষেধ করলাম কঠিনভাবে,” অসম্ভব। ভাইয়াকে সামনে বসিয়ে তারপর ভালোমতো বুঝিয়ে-শুনিয়ে সবকিছু জানাতে হবে। সামান্য একটা ভুল হয়ে গেলেই কিন্তু..”

ঈশান আমার হাত চেপে ধরে ভরসা যোগানো কণ্ঠে বলল,” কিচ্ছু হবে না। আমি এখনি ভাইয়াকে সব বুঝিয়ে বলব। ভাইয়া আমাদের ক্ষমা না করে কোথাও যেতে পারবে না।”

আমি আশা ফিরে পাওয়া কণ্ঠে বললাম,” ইয়েস!”

ঈশান দ্রুত ভাইয়ার কাছে গেল। ভাইয়া তখন রিসিপশনিস্টের সাথে তর্কে লেগে গেছে। রিসিপশনিস্ট রূঢ় গলায় বলছে,” আরে মিয়া, এতো ক্যাঁচাল কইরেন না। দুইমিনিট পর পর আইসা এক কথা! বললাম তো বাস সময়মতো আসব। আপনি গিয়া বসেন।”

ঈশান ক্ষেপে সঙ্গে সঙ্গে রিসিপশনিস্টের কলার চেপে ধরে বলল,” ওই, গলা নামিয়ে কথা বল। জানিস উনি কে?”

ঈশানের এমন আচরণে আমিই ভ্যাবাচেকা খেলাম। দুশ্চিন্তায় সবার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নাহলে হুট-হাট রিসিপশনিস্টের কটূ কথায় কেউ এমন রেগে যায়? নাকি ঈশান আসলেই ভাইয়ার অপমান সহ্য করতে পারেনি! এই ভেবে আমার চোখে জল এলো। ভাইয়া তখন ঈশানকে শান্ত করে বলছে,” আরে ধূর, ছাড়ো, ছাড়ো। কি করছ এসব? তুমি না ভালো ছেলে? আমার ভদ্র-সভ্য ভাই এমন অসভ্য লোকের কথায় কান কেন দিবে? এদিকে এসো।”

ভাইয়া ঈশানকে নিয়ে জায়গাটা থেকে সরে গেল। রিসিপশনিস্ট আগুন গরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ভাইয়া আর ঈশানের দিকে। তারা দু’জন কাউন্টার থেকে বের হলো। আমিও বাইরে এলাম। আর তখনি বাস এসে থামল। ভাইয়া ভ্রু কুচকে বলল,” এইতো, বাস চলে এসেছে। আচ্ছা আমি আসি। এই তারু ভালো থাকিস। ঈশান সবাইকে ভালো রেখো। আমি কিন্তু ফোন করে খোঁজ নিব। তোমরা আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কোরো না আবার।”

ঈশান কিছু বলতে পারছে না। আমিও নিশ্চুপ। ভাইয়া আমাদের বিদায় দিয়ে চলে যাচ্ছে৷ তাকে আটকাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু আটকে রেখে এই কথা বলা সম্ভব নয়। ঈশান আমার পাশে দাঁড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে উচ্চারণ করল,” বলা হলো না তারিন।”

আমি দ্বিগুণ হতাশ কণ্ঠে বললাম,” ভাইয়া আবার কখন ফিরবে কে জানে? নিহার জন্মদিনেও এমন হয়েছিল। ভাইয়া প্রায়ই এমন করে। বন্ধু বিপদে পড়লেই পাগলের মতো সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাবে। তারপর কবে ফিরবে তার কোনো ঠিক নেই।”

” ঠিক নেই মানে?”

” মানে বলা যায় না। হয়তো চারদিন কিংবা চারমাস অথবা চারবছর!”

ঈশান হকচকিয়ে বলল,” ও মাই গড! এর মানে চারবছরেও আমাদের বিয়ে হবে না?”

আমি কিছু বলার আগেই ঈশান বাসের দিকে ছুটে গেছে। ভাইয়া তখনও সিটে বসেনি। কারণ কোনো সিট খালি নেই৷ ভাইয়া কন্ট্রাক্টরের উদ্দেশ্যে বলল,” আমার সিট নেই কেন ভাই?”

কন্ট্রাক্টর বলল,” আপনার টিকিট দেখি।”

তারপর বোঝা গেল টিকিট নকল। রিসিপশনিস্ট ভুঁয়া টিকিট বিক্রি করেছে ভাইয়ার কাছে। হয়তো সে ভাবেনি যে বাসের সব সিট ভর্তি থাকবে। ভাইয়া এই বাসে উঠলে মাঝরাস্তায় বিপদে পড়তো। ঈশান সঙ্গে সঙ্গে বলল,” আসুন ভাইয়া, নেমে যান। এই বাসে যেতে হবে না। আপনার জন্য আমরা এসি বাসের টিকিট যোগাড় করে দিব।”

ভাইয়া দৃঢ়চিত্তে বলল,” আমার এসি বাসের টিকিট লাগবে না। আমি এই বাসেই যাব।”

” এই বাসে কিভাবে যাবেন? সিট নেই তো।”

” না থাকলে নেই। আমি ছাদে উঠে যাবো।”

” আরে ভাইয়া, কি বলেন?”

কন্ট্রাক্টর ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বলল,” আপনি ছাদে উঠে যেতে পারবেন? তাহলে উঠেন। টাকা দিয়ে যেহেতু টিকিট কাটছেন, আপনাকে না নিয়ে যাবো না।”

ঈশান রেগে কন্ট্রাক্টরকে ধমক দিল,” কি বলছেন এসব? ভাইয়া ছাদে উঠে কেন যাবে? রিস্কের ব্যাপার খুব। আমি কোনোভাবেই ভাইয়াকে যেতে দিব না।”

ঈশান ভাইয়ার হাত জাপটে ধরে ফেলল। কন্ট্রাক্টর বলল,” আচ্ছা, আচ্ছা, এখানেই সিট খালি করে দিচ্ছি। বসার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ”

ঈশান প্রতিবাদ করে উঠল, ” দরকার নেই। আপনাদের টিকিট ভুঁয়া, ব্যবস্থা ভুঁয়া, বাসও ভুঁয়া। এই ভুঁয়া বাসে ভাইয়া যাবে না।”

ভাইয়া ভারী কণ্ঠে বলল,” আমি যাব। আমি ছাদে উঠেই যাব। বাসে সিট ফাঁকা থাকলেও আমি বসব না। ছাদেই যাব। আমার ছাদ ভালো লাগে।”

ভাইয়া ছাদে উঠতে লাগল। ঈশান বিপর্যস্ত হয়ে ভাইয়ার কোমর চেপে ধরল। ঈশান যত টানে, ভাইয়া তত উঠে। পাছে যদি আবার কোনো দূর্ঘটনা ঘটে? এই ভেবে আমি আতঙ্কিত হয়ে গেলাম৷ ঈশানকে থামতে অনুরোধ করলাম।

বাসের জানালা দিয়ে সবাই মাথা বের করে তামাশা দেখছে। কন্ট্রাক্টর, ড্রাইভারসহ সবাই হতঅবাক। ভাইয়া একধ্যানে শুধু বলছে,” আমি যাবোই ঈশান।”

ঈশান তেজ নিয়ে বলছে ” আমি যেতে দিবোই না ভাইয়া।”

আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বললাম,” ঈশান থামুন। ভাইয়াকে ছেড়ে দিন।”

ঈশান আমার কথাও শুনছে না। সে ভাইয়ার কোমর ধরে ঝুলেই আছে। ভাইয়া উপরে উঠার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সফল হলো। ঈশান তখনও ভাইয়ার এক পা ধরে রাখল ভাইয়া শক্ত গলায় বলল,” ছাড়ো।”

ঈশান বলল,” যাবেন না।”

” ছাড়ো।”

” যাবেন না।”

তাদের এই কথা কাটাকাটির মাঝেই বাস ছেড়ে দিল। আমি চিৎকার করে বাসের পেছনে দৌড়াতে লাগলাম৷ কন্ট্রাক্টরকে ধমক দিয়ে বললাম,” এটা কেমন ফাজলামি? বাস ছাড়লেন কেন? ঈশান তো এক্সিডেন্ট করবে।”

আমার চিৎকারে বাস থেমে গেল। কন্ট্রাক্টর খুব বিরক্তি নিয়ে ঈশানকে বলল,” এই ভাই,আপনি নামেন তো। আমাদের দেরি হইতাছে।”

ঈশান ফট করে বলল,” আমি মোহনা সরকারের ছেলে।”

ভাইয়া চোখ বড় করে জিজ্ঞেস করল,” মোহনা সরকার মানে?”

” আমি সব মিথ্যা বলেছি। আমি কোনো কোচিং এ ক্লাস নেই না। উবার ড্রাইভিংও করি না। ওই গাড়ি আমার নিজের। আমার বাবার নাম ঈমান জুবায়ের। আমার নাম তারায জোহান ঈশান। তারিন যাকে মোহনা আন্টি বলে, তিনি আমার মম।”

ঈশান যেন এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল। এদিকে আমার শ্বাস তখন আটকে গেছে। ভাইয়াও নিশ্চুপ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঈশান ঢোক গিলে বলল,”আপনি কি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন ভাইয়া?”

ভাইয়া চোয়াল শক্ত করে বলল,”বুঝেছি।”

ঈশান অনুনয় করল,” তাহলে নামুন প্লিজ। আরও বুঝিয়ে বলি।”

” আমি নামব না। তুমি পা ছাড়ো। নাহলে আমি তোমাকে ধাক্কা দিব।”

আমি চেঁচিয়ে বললাম,” না ভাইয়া, ধাক্কা দিও না প্লিজ। ও মরে যাবে।”

তারপর ঈশান ধপ করে নিচে পড়ে গেল। ভাইয়া ধাক্কা দিয়েছে নাকি ঈশানই পা ছেড়েছে? আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। হন্তদন্ত হয়ে ঈশানকে ধরলাম। বাস তখন চলে যাচ্ছে। আমি ঈশানকে রাস্তা থেকে উঠিয়ে টেনে দাঁড় করালাম। ভাইয়া আমাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ গলা উঁচিয়ে বলল,” আমি ফিরে এসে তোমাদের ধুমধাম করে বিয়ে দিব।”

আমি আর ঈশান চমকে উঠলাম৷ ঈশান দৌড়ে বাসের পেছনে ছুটে যেতে যেতে বলল,” আমার আসল পরিচয় জানার পরেও আপনি বিয়ে দেবেন?”

ভাইয়া হাত উঠিয়ে বলল,” তুমি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হলেও বিয়ে দিব। আমার বোনকে সুখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ।”

ঈশান স্তব্ধ চিত্রের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল রাস্তার মাঝে। খুশিতে হয়তো সে বাকহারা। পেছন থেকে বড় একটা ট্রাক আসছে। আমি ঈশানকে দ্রুত টেনে সরালাম,” আপনি কি পাগল? এক্সিডেন্ট করতে নিচ্ছিলেন তো।”

ঈশান ফিসফিস করে বলল,” পাগল তো আমি আগেই ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে হার্ট এটাক করে ফেলব তারিন! ”

আমি নিজের মুখ চেপে ধরলাম। অতিরিক্ত খুশিতে কাঁদতে হয় নাকি হাসতে হয়? এই ভেবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here