#তীব্র_প্রেমের_নেশা (৩)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________
ফারদিন ভাইকে দেখে রীতিমতো ভয়ে ঘামতে শুরু করলাম। তীব্র আমার দিকে তাকিয়ে সামনে তাকালেন৷ ফারদিন ভাই ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে। তীব্র আমার হাত শক্ত করে ধরে সামনে আনলেন। আমি দৃষ্টি এদিক ওদিক করলাম। ফারদিন ভাইয়ের দৃষ্টি তখনো আমার দিকে। তীব্র অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে,
‘আরেহ ফারদিন ভাই যে! আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করে আমাদের বিয়েতে এসেছেন! ওয়াও।’
আমি তীব্রর দিকে তাকালাম। তার মুখে অদ্ভুত এক হাসি। ফারদিন ভাই দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই ওকে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছিস?’
আমি ফাঁকা ঢোক গিললাম৷ আমার জবাব না পেয়ে তীব্র নিজেই পাশ থেকে উত্তর দিলো, ‘দেখতেই যখন পাচ্ছেন তখন জিজ্ঞেস কেনো করছেন শালা সাহেব? উফস মিস্টেক আপনি তো প্রানেশার বড় ভাই!’
ফারদিন ভাই তীব্রর দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকালো। যেনো চোখ দিয়েই তাকে মে’রে ফেলতেছে। তীব্রর ঠোঁটের কোণে তখনো বাঁকা হাসি। ফারদিন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘আজ পর্যন্ত কোনো ছেলেকে তোর পাশে ঘেষতে দেইনি এতো সহজে তীব্রর সাথেও থাকতে দিবো না।’
আমি চোখ পিটপিট করলাম। ফারদিন ভাই কি করতে পারে তা আমার হাড়ে হাড়ে জানা আছে। এই একটা মানুষ আমাকে জীবনে শান্তিতে থাকতে দেয়নি৷ জানি না আমি তার ভালোবাসা নাকি জিদ কিন্তু আমাকে পাওয়াটা যেনো তার কাছে জিদ-ই। একবার কলেজে একটা ছেলে সবার সামনে আমাকে প্রপোজ করেছিলো। ব্যাস! পরেরদিনই তার হাত পা ভেঙে হসপিটালে এডমিট করিয়ে এসেছে। সাথে সেদিন আমার গালে ৫ আঙুলের দাগ পড়ে গেছিলো। এরপর থেকে ভয়ে কোনো ছেলে আমার কাছে ঘেঁষতো না আর আমিও শত হাত দুরে থাকতাম। আমার ভাবনার মাঝেই পলি দৌড়ে এসে ফারদিন ভাইকে বললো,
‘ভাইয়া ওদিকে আব্বু তোমাকে ডাকছে। চলো!’
ফারদিন ভাই গম্ভীর গলায় বললেন,’যা তুই। আসছি!’
পলি চলে গেলো। ফারদিন ভাই কাছে এগিয়ে এসে তীব্রর শেরওয়ানি ঝেড়ে বাঁকা হেঁসে বললেন, ‘প্রানেশা আমার। তোকে এতো সহজে কখনোই জিততে দেবো না তীব্র। প্রানেশা আমার মানে শুধুই আমার।’
বিনিময়ে তীব্র হাসে। হুট করেই ফারদিন ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘বেষ্ট অফ লাক ফারদিন ভাই।’
ফারদিন ভাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যায়। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। তীব্রর মুখের হাসি মিলিয়ে গিয়ে ফুটে ওঠে গম্ভীরতার ছাপ। থমথমে গলায় বলে,
‘আমার সাথে এতো বড় বড় কথা বলো আর ফারিদনকে দেখে এতো ভয় পাও?’
আমি আগে নিজের জায়গায় বসলাম। কয়েক বার বড় বড় করে শ্বাস নিলাম। তীব্রও পাশে এসে বসেছে। আমি ধীর স্বরে বললাম, ‘এই একটা মানুষের কাছে এতোটা অ’ত্যা’চা’রি’ত হয়েছি যতটা কখনো কারোর কাছে হইনি। উনার কথার অবাধ্য হলেও যেখানে আমার জন্য শাস্তি বরাদ্দ ছিলো সেখানে উনাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি। না জানি কি করে!’
ঘামতে শুরু করলাম। তীব্রর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তার দিকে তাকালাম। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে আছে। উনার চোখ দেখেই ভয় পেলাম। অস্বাভাবিক রকমের লাল। মুহুর্তেই ছুটে আসলেন আঙ্কেল আর ইমন ভাইয়া। আঙ্কেল টিস্যু দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে কোনো রকমে বললেন,
‘তীব্র একদম না। এখানে অনেক মানুষ আছে।’
তীব্র ভ’য়ং’কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। আঙ্কেলকে কিছুই বললেন না। আমি উনাদের কান্ডে কিছুই বুঝলাম না। সম্ভবত তীব্র রেগে গেছে। কেনো? কি এমন হলো! হঠাৎ করে তীব্র রেগে কেনো গেলো?
____
সন্ধ্যার দিকে ফুপিরা সবাই চলে গেছে। ফারদিন ভাই আরো আগেই চলে গেছে। আমরা কাল ওই বাড়ি যাবো। শুধু আমি আর তীব্র। পলিকে থাকতে বললেও ফুপি থাকতে দিলেন না। এতোটা সময় পর ছাড়া পেয়ে বড় করে শ্বাস নিলাম। কোনো রকমে আগে চেঞ্জ করে শাড়ি পড়লাম। এতক্ষণে নিজেকে হালকা মনে হলো। চোখ মুখ ভালো করে ধুয়ে সব মেক আপ তুলে ফেললাম। একটু পরই তীব্র চলে আসে। চোখ মুখ তখনও গম্ভীর। ভ্রু কুঁচকে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আয়নার সামনে বসলাম। তীব্র কাবাড থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। ততক্ষণে আমি সব ঠিকঠাক করে আগে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। গত কয়েকদিন থেকে ধকলের শেষ নেই। ঘুমও হচ্ছে না ঠিকমতো। চুপচাপ ব্ল্যাঙ্কেট মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তিতে যখন চোখ বন্ধ হয়ে গেছে তখনই একটা শব্দে চমকে উঠলাম। লাফিয়ে বসে নিজেকে সামলে আশে পাশে তাকালাম। তীব্র ল্যাপটপ হাতে বসে আছে সোফায়। আমি পিটপিট করে তাকাতেই বললো,
‘কি হলো? ভয়ে ঘুম আসছে না? কাল না বললে সজ্ঞানে কোনো রে’পি’ষ্টের সাথে ঘুমাবে না তা আজ কি অজ্ঞানে ঘুমাচ্ছো?’
উনার খোঁচা মা’রা কথায় কপালে ভাজ পড়লো। ক্লান্তিতে মাথা পুরাই ফাঁকা। উনাার সাথে তর্ক করতেও ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। তীব্র বোধহয় অবাকই হলো। কাছে এগিয়ে এসে বললো,
‘তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
অদ্ভুত ভাবে উনার কন্ঠে কোনো রাগ, গম্ভীরতা কিছুই টের পেলাম না। অন্যরকম কিছু ছিলো। চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনার এই টেপ রেকর্ডার বন্ধ করবেন প্লিজ? ক’দিন থেকে একদম ঘুম হয়নি। একটু ঘুমাতে দেন!’
তীব্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে চুপচাপ চলে যায়। আমি নিজের মতো ঘুমিয়ে পড়লাম। মাঝরাতে মনে হলো কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেলাম। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে কেউ। কিন্তু ঘুমের জন্য চোখ খুলতে পারলাম না। উষ্ণ জায়গা পেয়ে গুটিশুটি মে’রে ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরেরদিন সকাল থেকে তীব্র বেঁকে বসেছে কিছুতেই ফুপিদের বাড়ি যাবে না। আঙ্কেল, আন্টি, তিহা বুঝানোর পরও উনাকে রাজি করাতে পারেনি। উল্টো রেগে বাড়ি থেকেই বের হয়ে গেছেন। মন খারাপ করে লিভিং রুমে সোফায় বসে কার্টুন দেখা শুরু করলাম। ফুপিদের বাড়ি যাবো না! এদিকে এই বাড়িতেও আমার ভালো লাগছে না। কার্টুন দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম আন্টি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকাতেই চোখ মুখ কুঁচকে আঙ্কেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘আমার ছেলেটা রেগে না খেয়েই বেরিয়ে গেছে। ঘরে এনেছো এক অ’পয়া মেয়েকে। ছোট বেলায় তো নিজের বাবা মা’কে খে’য়ে এসেছে ৩ বছর থেকে আমার ছেলেকেও খা’ওয়ার জন্য বসে আছে। তার জন্য রেগে যে আমার ছেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে এতে তার হেলদোল আছে? উল্টো নেচে নেচে কার্টুন দেখছে।’
আরো কিছু কথা শোনালেন। আঙ্কেল ধমক দিলেন আন্টিকে। আমি কোনো রকমে নিজের কান্নাটা গিলে টিভি অফ করলাম। তিহা কাছে এগিয়ে আসতেই আমি হাসার চেষ্টা করে রুমে চলে আসলাম। অন্য কথাগুলো যেমন তেমন বাবা মায়ের কথা উঠলে আমার এমনিই খারাপ লাগে। সেখানে উনি কতগুলো কথা শোনালেন! চুপচাপ ব্যালকনির রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে বসে থাকলাম। চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস নিলাম। আমার বাবা মায়ের কোনো স্মৃতিই আমার সাথে নেই। এতোটা ছোট বয়সে তারা মা’রা গেছেন। ফুপির কাছে বাবা মায়ের ফটো দেখেছি। নয়তো তাদের মুখটাও হয়তো ঠিকমতো মনে নেই আমার। কতক্ষণ ওভাবেই বসে ছিলাম মনে নেই। চুপচাপ রেলিং এ হেলান দিয়ে গার্ডেনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই তীব্রকে চোখে পড়লো। আমি তার দিকে একবার তাকিয়ে আবার অন্যদিকে তাকালাম। উনি ধীর কন্ঠে বললেন,
‘সরি!’
আমি চমকে তাকালাম। শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘কেনো?’
‘আমার জন্য তোমাকে এতো কথা শুনতে হলো তার জন্য।’
তাচ্ছিল্যের সুরে বললাম, ‘ইটস ওকে। বড়লোকরা ওমন একটু আকটু অপমান করবে এটাই স্বাভাবিক।’
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘সবসময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা না বললে শান্তি পাও না? বাই দ্যা ওয়ে রেডি হও। যাও!’
‘কোথায় যাবো? ওই বাড়ি?’
‘নাহ গো। হানিমুনে যাবো। যাবে তো বউ?’
আমি থতমত খেলাম। রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উঠে পড়লাম। মুখে তখনো উনার দুষ্টু হাসি। মাঝে মাঝে মন চায় উ’স্টা দিয়া এই ব্যালকনি থেকেই ফেলে দিই। কাপড় গুছিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। তীব্রও রেডি হয়ে নিলো। বের হওয়ার সময় আন্টি আমাকে দেখেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেলেন। আঙ্কেল আর তিহার থেকেই বিদায় নিলাম। পুরো রাস্তা তীব্র মুখ গম্ভীর করে থাকলো। আমিও কোনো কথা বললাম না। বাড়িতে আসতেই ফুপি আর পলি খুব খুশি হলো। ফুপি, ফুপা, কাকি, কাকা, সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন তীব্রকে নিয়ে। আমার সাথে সবাই টুকটাক কথা বললেন শুধু। পলি হাসতে হাসতে বললো,
‘বিয়ে করে তুমি পর হয়ে গেছো আপু। এখন তোমার জামাই আপন।’
পলি হাসতে থাকে। আমি মনে মনে হাসলাম। আমি আর আপন ছিলামই বা কবে! আজাদ শেখের ছেলেকে তারা জামাই হিসেবে পেয়েছে তাকে তো আপন করতেই হবে। কিন্তু এ কথাগুলো না বলে হাসিমুখে পলির গাল টেনে দিয়ে বললাম,
‘তোমার বিয়ে হোক তখন তুমিও পর হয়ে তোমার বর আপন হয়ে যাবে।’
পলি মুখ ভেংচালো। ওকে থাকতে বলে আমি রুমে চলে আসলাম। আসার সময় ফারদিন ভাইকে চোখে পড়েনি। ভাগ্যিস সামনে পড়েনি নয়তো সিউর আমাকে থা’প্প’ড় দিয়েই ক্ষ্যান্ত হতো। রুমে এসে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর একবার ব্যালকনিতে উঁকি দিতেই দরজা খোলার শব্দ পাওয়ায় রুমে ফিরে আসলাম। ভেবেছিলাম তীব্র এসেছে কিন্তু সামনে ফারদিন ভাইকে দেখে গলা শুকিয়ে গেলো। আমতা আমতা করে বললাম,
‘ফ-ফারদিন ভাই আপনি! আ-আমার রুমে?’
ফারদিন ভাই শ’য়তানি হাসি হাসলেন। এগিয়ে আসতে আসতে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘আমার অগোচরে বিয়ে করে নিয়েছিস! তাও আবার আমারই শ’ত্রুকে! তোর কলিজা এতো বড় হয়ে গেছে রে? টেনে কলিজাটা বের করে ফেলি?’
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেলো। পুরো রুমে আমি আর উনি ছাড়া কেউ নেই। মনে মনে হাজার বার চাচ্ছিলাম কেউ আসুক। বার বার দরজার দিকে তাকিয়ে যখন ফারদিন ভাইকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলাম উনি টেনে ধরলেন আমাকে। সামনে এনে গলা চেপে ধরলেন। রাগী কন্ঠে বললেন,
‘তোর আর তীব্রর খুব বড় মাশুল দিতে হবে। আমি হারবো না ওই তীব্রর কাছে। কখনোই না। তোকে আমি না পেলে তীব্রকেও পেতে দিবো না। তীব্রর চোখের সামনে তোকে তিলে তিলে মা’রবো। ওয়েট & ওয়াচ।’
চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। একটা মেয়ে নিশ্চয় অকারণে কাউকে রে’পি’ষ্ট বলবে না! গল্পের মাত্র ৩ পর্ব নিশ্চয় এখনই সব রহস্য শেষ না!)