তুই হবি শুধু আমার পর্ব -২৪+শেষ

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চব্বিশ

‘ অয়ন্তি প্রেগনেন্ট ‘ বাক্যটি খাঁন ম্যানশনে খুশির জোয়ার নিয়ে আসলো। ফারহানের পরিবারও এসেছে অয়ন্তিকে উপহার দিতে ও শুভেচ্ছা জানাতে। অয়ন্তির চোখজোড়া ভিজে আছে। এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না ওর পেটে ছোট্ট একটা প্রাণ আছে। ওর ভেতরে কারোর অস্তিত্ব আছে, ওর বেবি আছে। রেডিও সেন্টারে এক বেলার খাবারের ট্রিট দিয়ে আরশান সবেমাত্র বাড়িতে ঢুকেছিলো। এমন সময় ডেলিভেরি বয় এসে একটা নীল রঙা পার্সেল ধরিয় দিলো ওর হাতে। প্রেরকের নামটা পড়তেই আরশানের দৃষ্টি প্রখর হলো ‘রোজ’। রোজ পাঠিয়েছে? তার মানে রোজ বেঁচে আছে। খুশিতে আটখানা হয়ে আরশান বাড়ির ভেতর ঢুকেই রোজের কথা জানালো। ফারহান নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলো। এ সংবাদ নতুন নয়, যদি রোজ নিজে আসতো তাহলে খুশিটা প্রকাশ করা যেত।

অয়ন্তি পার্সেল খুললো। একটা স্বর্নের বর্ডার দেওয়া আয়না ও চামচ। নীলরঙা চিরকুটে লেখা, “স্বর্ণের চামচ মুখে দিয়েই জন্মাবে সে।তাঁর যেন কোনো অযত্ন না হয়। আমার জাদুর জুটির প্রাণ সে। তাঁর খেয়াল রাখবে। দাদাই কাজ কাম বাদ দিয়ে বউয়ের সেবা করবে। তাকে একা রাখবে না। এ সময় মুড সুইং চলে, কখনও বিরক্ত হবে না হীরামনের ওপর। হীরামন যা চাইবে তাকে তাই দেবে। হীরামন, তোমাকে ধন্যবাদ মিষ্টি জান’টাকে আনার জন্য। ”

ফারহান সরুচোখে তাকালো। আরশান হেসে বলল,
-কি হয়েছে?

-রোজের শো, আমি করবো। আর কোনো কাজ নেই আমার। অভিনয়, দল সব তো বাদ দিয়ে দিলাম।

-রিয়েলি? তুই কথা বলতে পারিস? রোজের শো’য়ের তো বারোটা বাজায় দিবি। তুই বরং তোর এগ্রেশন কি করে কমবে তার উপায় খুজে সেটা প্রাকটিস কর।

-জোক্স ছিল?

-হু! কবে থেকে করবি বল? আজ বুধবার। পরশু রাতে আছে।

-পরশু না। দু একদিন অবজার্ভ করবো তারপর। এটায় কিভাবে কথা বলতে হয়, গান চালানো কিছুই তো জানি না।

-আর ইয়্যু শিওর?অভিনয় একেবারে ছাড়ছিস?গতবার তো না, না করে আবার ঢুকলি।

-এবার কনফার্ম।প্রডিউসারের লস হয়েছে। সেই টাকাটা দিয়ে একেবারে বিরতি নিয়েছি এই জগৎ থেকে।

-গুড!

___________

ডিভানে বসে গান শুনছিল রোজ। পাশেই আগুণ জ্বলছে। আরও একটা বছর পার হয়েছে। রোজের মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। জার্নালিজমে এটাই ওর লাস্ট ইয়ার। পড়া শেষ করে সে দেশের বাইরে চলে যাবে। মুগ্ধতা বা ফারহানের খোঁজ সে রাখেনি। এমনকি ফারহান অভিনয় ছেড়েছে কিনা সেটাও জানে না সে। এতদিন সে শুধু নিজের পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে। চাঁদের কথাও তাকে প্রভাবিত করেনি। ফারহানের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মুগ্ধতার কথা মনে পড়লে সেই প্রবৃত্তি অন্তরেই চাপা পড়ে যায়। মেয়েটা ভালোবেসে ভুল করেনি তাহলে রোজের জন্য সে কেন নিজের ভালোবাসা পাবেনা?

রিমোটটা চিবুকে স্পর্শ করে চ্যানেল পাল্টাচ্ছে রোজ। হঠাৎ ওর চোখে পড়ে একটা নিউজ। মূলত ফারহানের ইন্টারভিউ। যেখানের সারমর্ম হচ্ছে সে আর অভিনয়ের জগতে ফিরবে না। কারন হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ইচ্ছে। ওর আর ইচ্ছে নেই অভিনয় করার তাই গত একবছর ধরে সে নতুন কোনো প্রজেক্টে কাজ করেনি। রোজের কপালে ভাঁজ পড়লো। দৃষ্টি প্রখর হলো। অভিনয় ছেড়ে দিয়েছে ফারহান? আর দল? রোজ সিয়ামকে ফোন করল তৎক্ষণাৎ। সিয়াম ফোন রিসিভ করতেই রোজ কোমল কন্ঠে বলে,

-হ্যালো,আনসারী স্পিকিং, মানে রোজ বলছি। তোমার স্যার কোথায়?

-ম্যাম আপনি? কেমন আছেন? কোথায় আছেন?

-পরে বলছি। আগে বলো তোমার স্যার কোথায়? তাকে দাও ফোনটা।

-আজ সোমবার! স্যার তো রেডিও সেন্টারে।

-রেডিওতে কি করে?

-আপনার শো এখন স্যার করছেন।

-হোয়াট?

-জি ম্যাম। ফারদিন আঙ্কেল বারবার করে বলেছিলেন ওনার ব্যবসায় হাত লাগাতে কিন্তু স্যার ব্যবসা বাদ দিয়ে আপনার শো করার কথা ভেবেছেন।

-হোয়াট দ্যা… অভিনয় ছেড়েছে কেন? অভিনয় ছাড়লে কষ্ট পাবে জানো না?

-আমি কি করবো? স্যারই তো করতে চান না।

-কোথায় তুমি?

-বাড়িতে। ফারদিন আঙ্কেলের সামনে। স্যার তাঁর একটা কাজের জন্য ডেকেছিলেন।

-ফোন দাও বাবাকে।

সিয়াম ফারদিন সাহেবে হাতে ফোনটা দিতেই রোজ বলে ওঠে,
-কি হয়েছে? হঠাৎ উনি সব ছেড়ে দিলেন কেন? মুগ্ধতা কেমন আছে? ওকেও দেখছি না কোনো মুভিতে।

-আমার কথা জিজ্ঞেস কর। আমি কেমন আছি আগে শোন। সব ম্যানারস ভুলে গেছিস?

-ওহ! কেমন আছো?

-ভালো। তুই?

-আমি তো ভালোই থাকি। কিন্তু ওখানে কি হচ্ছে সেটা বলবে?আমি ফিল্ম নিয়ে গবেষণা করিনি এতদিন। তার মধ্যেই এতকিছু হয়ে গেলো? মুগ্ধতাও অভিনয় ছেড়ে দিল কেন? প্লিজ বলো বাবা।

-মুগ্ধতা বেঁচে নেই। তোর সঙ্গে শত্রুতা করেছিল বলে ফালাক ওকে মে’রে ফেলেছে। তুই সব ভুল জানতিস মা। ফালাকের সঙ্গে ওর তেমন কিছু হয়নি। মুগ্ধতা সব বানোয়াট কথা রটিয়েছিল। ছেলেটা একদম বদলে গেছে। অভিনয় ছেড়েছে, ওর কালো দুনিয়াও ছেড়েছে। তোর মতই একাকিত্বকে সঙ্গী হিসেবে বেঁছে নিয়েছে। ওর দিকে তাকানো যায় না। খায় না, ঘুমায় না, ছেলেটা আমার শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আয় না, তুই এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর কতদিনই বা বাঁচবো? ম’রার আগে অন্ততো তোদের একসাথে দেখে ম’রতে চাই। আসবি তুই?

-উনি সব ছেড়েছে?

-বিশ্বাস না হলে, তুই নিজে চেক করে দেখ।

-ছাড়লে আমি ফিরবো বাবা। তোমাদের ছেড়ে আমিও ভালো নেই। তবে কবে ফিরবো সেটা বলতে পারছি না। ভালো থেকো।

_________

অয়ন্তি আর আরশানের ছেলে ‘আরহান খাঁন অনন’। আজ একমাস পূর্ণ হলো ওর বয়স। বাচ্চা হিসেবে কিছু দিক থেকে আলাদা সে। হাসে না, কাঁদে না, সবসময় একটা গম্ভির মুখ করে রাখে। যেন মাত্রই কেঁদে এসেছে বা পেটের গন্ডোগোল হয়েছে। অনেকটা ফারহানের মত স্বভাব। তা নিয়ে সবার হাসিহাসির শেষ নেই। আরশান প্রায়ই অয়ন্তিকে খোঁচায় এটা বলে, ‘আমার বাচ্চা ওর চাচার মত কি করে হল? ‘ অয়ন্তি বরাবরের মতই চটে যায়। ফারহান মাঝে মাঝে আসে, আর অননকে দেখে। রোজ থাকলে ওদেরও হয়তো এমন একটি বেবি থাকত। ফারহান সর্বদা তাকে কোলে কোলে রাখতো। রোজের কাছে একদম দিত না। রাতে সে কেঁদে উঠলে ফারহান নিজে ওর ডাইপার বদলে দিত, ওকে খাইয়ে দিত। রোজকে একদম জ্বালাতো না। কিন্তু রোজ তো সেটুকু করার সুযোগও দিলো না। একা করে দিয়ে চলে গেলো। আগামীকাল শুক্রবার। রোজের জন্মদিনও। সকালে রোজ ফোন দিয়েছিল শোনার পর থেকে সবাই অস্থির হয়ে আছে। ফারহান মনে মনে ঠিক করলো আজ রাতে রেডিওতে সে রোজের কথা বলবে। রোজ নিশ্চই রেডিও শুনবে। এসব ভাবনার মাঝেই অয়ন্তি ডেকে উঠলো,

-ভাইয়া অননকে একটু ধরো না। আমি ছাদে যাচ্ছি। কাপড় তুলতে।

ফারহান অননকে কোলে নিতে চাইলো। কিন্তু বাচ্চাটা এত নরম যে ফারহানের হাত কাঁপছে। যদি পড়ে টরে যায়? অয়ন্তি হেসে বলে,

-তোমার বাচ্চা হলে কি করবে? পড়ে যাওয়ার ভয়ে কোলে নেবে না? নাও, কোলে নাও। ও পড়বে না।

-অনেক নরম অয়ন্তি। আমি ধরতেও পারছি না। তুমি রজনী ভাবির কাছে দিয়ে যাও।

-ভাবি বাড়িতে নেই। অয়নকে নিয়ে স্কুলে গেছে। বুষ্টি পড়ছে আমাকে কাপড় তুলতে যেতে হবে। ওকে একটু নাও না।

-দাদাই কোথায়?

-বাথরুমে। উফ এত কথা বলো না তো। ধরো। আমার ছেলে যেন ব্যাথা না পায়, ওকে বিছানায় শোয়াবে না। কোলেই রাখবা। বুঝেছ?

অননকে ফারহানের কোলে শুইয়ে অয়ন্তি চলে গেলো। ফারহান অননের ছোট্ট ছোট্ট আঙ্গুলের মাঝে নিজের তর্জনি ঢুকিয়ে দিতেই অনন তা শক্ত করে চেপে ধরল। কেঁপে উঠলো ফারহান। এই অনুভূতিটা এত ভালো লাগে কেন ওর? ফারহানের মনে পড়ে রোজও এমন করতো। নিশ্চই ওদের বাচ্চারাও এমন করবে। ফারহান অননকে উঁচু করে ওর কপালে চুঁমু খেলো। বুকের সঙ্গে মিশিয়ে চুপচাপ বসে রইলো।


রাত এগারোটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। রেডিও চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে ফারহান। বারোটা বাজতে যখন দুইমিনিট বাকি তখন ফারহান শো চালু করে।

“হ্যালো ডিয়ার লিসেনার! আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রং মহল। এবং আমি ফালাক আছি আপনাদের সঙ্গে। কেমন আছেন সবাই? নিশ্চই ভালো। আমিও ভালো আছি। আজ আমি আপনাদের একটা গল্প শোনাতে চাই। গল্পটা কার? কেন শোনাচ্ছি এটা নিশ্চই জানতে চান আপনারা,গল্পটা আমার খুব কাছের একজন মানুষের। যার আজ জন্মদিন। বারোটা বাজতে এখনও ত্রিশ সেকেন্ড বাকি। তাই তাকে উইশ করার পূর্বে তাঁর নাম জানিয়ে দেওয়া উচিত। যে নামে আমি তাকে ডাকি সেই ডাকনামটা হচ্ছে চাঁদ। এক অভিশপ্ত রাজকুমারের ভালোবাসার নাম চাঁদ। এই ভালোবাসার রাজ্যের একমাত্র রাজকন্যার নাম চাঁদ। শুভ জন্মদিন চাঁদ! যেখানেই থাকিস, ভালো থাকিস।

ফার্স্ট কলার ‘চাঁদ? ইন্টারেস্টিং নাম। কিন্তু শেষের কথার অর্থ কি? চাঁদ কি আপনার সঙ্গে নেই? ‘

‘আমার পৃথিবি যতদিন থাকবে চাঁদও ঠিক ততদিনই থাকবে। হয়তো কাছে, নয়তো দূরে। ‘

সেকেন্ড কলার ‘গল্পটা বলুন।’

‘গল্পের শুরুটা অনেক বছর আগের। এক রাজার ঘরে এক ছোট্ট, দুষ্টু, মিষ্টি রাজকন্যার জন্ম হয়েছিল। রাজার মিত্র নতুন অতিথিকে দেখার জন্য তাঁর দরবারে হাজির হয় নিজের রানি ও রাজপুত্রের সঙ্গে। ধীরে ধীরে সেই রাজকন্যা আর রাজপুত্রের বন্ধুত্ব হয়। রাজপুত্র বুঝতে পারে এটা শুধু বন্ধুত্ব নয়, তার থেকেও বেশি কিছু। কিন্তু রাজকন্যা তা বুঝতে পারেনা। রাজকুমারের জেদ ও রাগ অনেক বেশি ছিলো। রাজকন্যাকে নিয়ে অনেক পসেসিভ ছিল। রাজকন্যা যদি কারোর সামনে দাড়িয়ে একটু হেসেও কথা বলতো, সেই রাজকুমার তা সহ্য করতে পারতো না। রাজকন্যাকে শাস্তি দিত, ধমকাতো। অথচ রাজকন্যা রাজকন্যা তা বুঝতো না।রাজকুমারের মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করত। রাজকুমারকে শাস্তি দেওয়াতো। কিন্তু বড় হওয়ার পর রাজকন্যাও বোঝে যে সেও রাজকুমারকে চায়। কিন্তু একটা দূর্ঘটনায় ওদের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। রাজকুমার নিজের মাত্রার থেকে অতিরিক্ত রাগ জেদ নিয়ে রাজকন্যাকে ছেড়ে চলে যায়। খারাপ হয়ে যায়, অভিশপ্ত হয়ে যায়। কয়েক বছর পর রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর আবার দেখা হয়। সব ভুল বোঝাবুঝি মেটানোর আগেই নতুন করে ঝামেলা সৃষ্টি হলো। রাজকন্যার আগের অভিমানের সঙ্গে নতুন অভিমান যুক্ত হয়ে তা পাহাড়সম গড়ে উঠলো। সেই এক পাহাড় অভিমান নিয়ে রাজকন্যা পুনরায় ছেড়ে চলে যায় এই অভিশপ্ত রাজকুমারকে। রাজকুমার তাঁর রাগ ভা’ঙানোর সুযোগটুকুও পায়না। কারন সে আগে যেসব ভুল করেছিল তাতে রাজকন্যা কষ্ট পেয়ে ওর সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল। অবশেষে যখন সেই রাজকন্যা রাজকুমারকে ছেড়ে চলে যায় তখন রাজকুমার বুঝতে পারে জীবনের সবথেকে মূল্যবান জিনিসটাই হারিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে অনুভূতি, আর অনুভূতিটা হচ্ছে ভালোবাসা।সে জানে না রাজকুমারের জীবনে তাঁর ভূমিকা কি? রাজকুমার তাকে কতটা চায়, কতটা ভালোবাসে। তাঁর জন্য এখন রাজকুমার নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে। তাকে একনজর দেখার জন্য সবকিছু করতে পারে।নিজের স্বপ্ন-ইচ্ছে জলাঞ্জলি দিতে পারে। রাজকন্যা রাজকুমারের কোনো খবরই রাখে না। রাখলে জানতো তাঁর ভালোবাসার জন্য সেই রাজকুমার কি কি করতে পারে। কি কি করেছে। কি কি বদলেছে। রাজকুমারের এখন বড্ড একা লাগে। সে শুধু রাজকন্যার শূণ্যতা অনুভব করে। রাজকন্যার অভিমান ভা’ঙানোর সময়টার অভাব বোধ করে। রাজকন্যাকে দেখার তৃষ্ণা রাজকুমারের নয়নের কখনও ফুরাবে না। তাঁর মুচকি হাসি, গাল ফুলিয়ে অভিমান জাহির করা, রাগ হলেই জেদ করে বলা, ‘পা ধরে স্যরি বলতে হবে’, কষ্ট পেলে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদা। সবকিছুর শূণ্যতা অনুভব করছে রাজকুমার। অপেক্ষা করছে তাঁর ফিরে আসার। রাজকুমার জানে না সে ফিরবে কিনা, কিন্তু সে জীবনের শেষ সময়পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাবে।’

থার্ড কলার ‘অনেক ভালোবাসেন তাকে তাইনা? সে নিশ্চই ফিরবে। তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাকে বিশেষ কোনো সার্প্রাইজ দিন। মেয়েরা উপহার পেলে খুশি হয়।’

‘তাঁর ঠিকানা জানা নেই আমার। তবে আমার গলার গান তাঁর বড্ড প্রিয়। সে সবসময় বলত অভিনেতা ফারহান মাহতাব থেকে বেরিয়ে যেদিন সাধারণ এক ফালাক হয়ে আসবে আমি সেদিন ফিরবো। ‘

ফোর্থ কলার, ‘আপনি ফারহান মাহতাব? ফারহান মাহতাব ফালাক? সুপারস্টার ফারহান? আই কান্ট বিলিভ ইট। আপনি আপনার ক্যারিয়ার বাদ দিয়ে এই রেডিও শো হোস্ট করছেন?’

‘হুম। চাঁদের ইচ্ছে ছিল এটা।’

ফিফ্থ কলার, ‘মেয়েটা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী যে সে আপনার মত একজনের ভালোবাসা পেয়েছে। তবুও সে চলে গেল কেন? তাঁর আসল পরিচয় কি? কি করে সে?’

‘সে আরজে। ‘

‘আর’জে? সামান্য একটা আর’জের জন্য নিজের সমগ্র ক্যারিয়ার বাদ দিলেন? এটা বোকামি। যে ছেড়ে যায় তাকে ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের পুরাতন আর’জে রোজ বলতো এটা। যে পাখি ভালোবাসে সে নীড়ে ঠিক ফিরে আসে। আর যে বাসে না সে ঠিক মুক্ত আকাশ খুজে চলে যায়। আজ রোজ থাকলে সে এটাই বলতো। ‘

‘আপনাদের রোজ যথার্থই বলে। কিন্তু তাঁর মত একজন খুজে পাওয়া দূর্লভ। এজন্যই তাকে পাওয়ার জন্য এই কষ্টটুকু সহ্য করা যায়। পৃথিবিতে কোনো জিনিসই সহজে পাওয়া যায়না। সেখানে ভালোবাসার মত এক জটিল অনুভূতির মানুষ সহজে পাওয়া যাবে? ‘

‘সে আপনাকে ভালোবাসে?’

‘হ্যাঁ।

‘তাহলে চলে গেল কেন? কি নাম তাঁর? নাম বলতে কি অনেক সমস্যা? তাঁর কি বিয়ে হয়ে গেছে? তাই তাঁর নাম নিচ্ছেন না।’

সিক্সথ কলার, ‘তাঁর নাম কি? সে কেন চলে গেছে? ‘

‘তাঁর নাম সাইরাহ্ আনসারী রোজা ওরফে রোজ। যে ভালোবাসার রংমহলের আর’জে। আর সে অভিমানের কারনে আমাকে ছেড়ে গেছে। ফিরবে বলেছে। কিন্তু যখন আমি বদলে যাবো। আজ হয়তো রোজও শুনছে শো’টা। তাই বলছি।তুই ঠিক যে যে পরিবর্তন চেয়েছিলি সবটা করেছি চাঁদ। যেমন ফালাককে চেয়েছিলি তেমন ফালাক হয়েছি। আমার গান তোর প্রিয় ছিল তাই আজ তোর বার্থডে গিফট হিসেবে গানটাই দিলাম। তোকে বিশেষ কিছু দেওয়ার মত সামর্থ্য আজ সত্যিই আমার নেই। হয়তো তুই নেই বলে মনে হয় আমার কিছু নেই, আমার আমিত্ব নেই, কোনো অনুভূতি নেই, কোনো ভালোলাগা নেই। শুধু এটুকুই বলবো। ফিরে আয়, সব কিছু ছেড়ে শুধু আমার হতে আয়। রাগ, জেদ, অভিমান ভুলে আমার হয়ে যা প্লিজ! শুধু আমার।

♪♪♪♪♪তুই ছাড়া লাগে, শূন্য এ জীবন।
আমার বেঁচে থাকার, শুধু তুই কারণ।
কত চাইলে তোকে বল,
ফিরে আসবি তুই আবার।
কত বাসলে ভালো বল,
#তুই_হবি_শুধু_আমার।

অভিমান যত আছে,
করে নিস ভালোবাসা।
দূরত্ব সব’ই ভুলে,
শুরু হোক কাছে আসা।

তুই বিহীন ভালো নেই,
প্রহরগুলো লাগে একা।
এ মনে তোর তরে,
কত প্রেম আছে যে রাখা।

কত চাইলে তোকে বল,
ফিরে আসবি তুই আবার।
কত বাসলে ভালো বল,
#তুই_হবি_শুধু_আমার♪♪♪♪♪♪♪♪♪♪

নিজের গলায় গানটুকু গেয়ে থামল ফারহান। চোখজোড়া ভিজে উঠলো। ঠিক তখনই ফোন বেজে ওঠে। আননোন নাম্বারের কল। প্রায় দশবার কল দিয়েছে। মিসড কল নোটিফিকেশন জ্বলছে। কে এত বার ফোন দিয়েছে? তাও এত রাতে?
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#শেষ_পর্ব

ফারহান ফোনটা রিসিভ করতেই অয়ন্তির গলা শোনা গেল। চেঁচামিচিতে অস্থির করে তুলেছে বাড়ি। ফারহান হ্যালো বলতেই অয়ন্তি দ্রুততার সঙ্গে বলে,

-দ্রুত ডাক্তার নিয়ে আসো ভাইয়া। রোজের পা বোধ হয় ভে’ঙেই গেছে। এখন কথা বলতে পারছি না, ফোনে চার্জ নেই, রাখছি।

ফারহান হতভম্ব চোখে চাইলো।শ্রবণেন্দ্রিয় কি ঠিকঠাক কাজ করছে না? কি শুনতে কি শুনল? রোজের পা কি করে ভা’ঙবে? আর রোজকে পেলোই বা কোথায় ওরা? ফারহান কল ব্যাক করল, কিন্তু সিম বন্ধ। মেজাজ চটে গেল মুহূর্তেই। এত রাতে কি ইয়ার্কি করার সময়? সত্য না জেনে ডাক্তার ডেকে নিয়ে যাবে? কিন্তু অয়ন্তি মিথ্যা বলবে কেন? তাহলে কি রোজ সত্যিই ফিরেছে? ফিরেই ঠ্যাঙ ভা’ঙলো? নাকি মজা করল? উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো ফারহান। ডাক্তার ডাকেনি কারন সে সর্বপ্রথম অয়ন্তির হাসির শব্দ পেয়েছে তারপর চিন্তিত কন্ঠস্বর।

খাঁন ম্যানশনে পৌঁছাতেই ফারহানের নজর গেল ছাদের দিকে। রোজ ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। দুজনের নজর স্থির ও নিবদ্ধ হতেই ফারহানের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। রোজ এসেছে? ফিরে এসেছে? রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামছে না কেন লোকটা? রোজ আরও একটু ঝুঁকে তাকাতেই দেখলো ফারহান গাড়ি থেকে নেমে দৌড়াচ্ছে। রোজ হা করে চেয়ে রইল। লোকটা কি ম্যারাথন দৌড়ের প্রতিযোগিতায় নাম লেখাচ্ছে?

ভাবতে ভাবতেই ছাদের দরজা শব্দ করে খুলে ফেললো ফারহান।রোজ পেছনে ঘুরে তাকায়। ফারহান হাঁপাচ্ছে। রোজ মৃদু হাসে।ফারহান এগিয়ে এসে রোজকে জড়িয়ে ধরতে গেলে রোজ পিঁছিয়ে যায়।ফারহানের চোখে জল, এই লোকটা শুধু কাঁদে। ছিঁছকাদুনে একটা। ফারহানের হাত রোজের হাত স্পর্শ করতেই রোজ রুদ্ধকন্ঠে বলে,

-বিয়ে করবো। আজ, এখনই। তারপর ছোঁবে আমাকে। আমি চাই না অনিশ্চিত কারোর ছোঁয়া পেতে। যখন জানবো তুমি শুধু আমার। আমাদের মধ্যে কেউ থাকবে না। তখনই পরিপূর্ণ চাঁদকে পাবে ফালাক। তার আগে না।

-এখন?

-হ্যাঁ। এখনই। কাজি নিচে অপেক্ষা করছে। তুমি বলো দেনমোহর, কাবিন এসবের খরচ এখনই বহন করতে পারবে? নাকি গিয়ে আনবে? ওসব ছাড়া তো একসাথে থাকা যায় না।

-তুই সত্যিই আমাকে বিয়ে করবি চাঁদ?

-করবো না? কি চাও তুমি? এবার তুলিকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে দেবো?তোমার আশিকাদের জন্য আমার বাঁচা মুশকিল হয়ে পড়ছে। আমাকে কি মা’রতে চাও তোমরা? বলো!

-মানে? তুলি কে? নামটাই তো প্রথম শুনলাম।

-আমার সহকর্মী। যে তোমার জন্য জান দেওয়ার মতো ফ্যান। সাইমুনের বন্ধু ছিল। তোমাকে অন্ধের মতো ভালোবাসে। মুগ্ধতার কারনে সে ভালোবাসা এক্সপোজ করেনি। বাট আমাকে ঠিকই মহাকাশে পাঠানোর দারুন ব্যবস্থা করেছিলো। বিফল হওয়ার পর আবারও ট্রাই করছে।

-কি বলছিস? এসব তুলি ফুলি তো জীবনেও শুনিনি। মুগ্ধতা বা সাইমুনের মুখেও এর নাম শুনিনি।

-সেদিন লরির কাহিনি তুলি ঘটিয়েছিল। শিওর হওয়ার জন্যই জোর করে আমার সঙ্গে এসেছিলো। মুগ্ধতাকে তুমি মেনে নেবে না কখনও, সেটা জানতো ও।ভেবেছিল আমার পেশা, আমার মত হলে ও তোমার মনে জায়গা করতে পারবে। কারন সাইমুনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল সে আর তুমি সাইমুনের চাচাতো ভাই। আজও আমাকে ও নিজের স্কুটি দিয়ে ধাক্কা মে’রেছে।

-আর তুই ছেড়ে দিলি?

-এমনি এমনি ছেড়ে দেবো কেন? কোমরে আরিফিন ও ইরফানের বন্দুক ছিল। দুটো গুলি চাকায় করতেই ও মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে হাত পা ভে’ঙে ল্যাঙড়া খোড়া হয়ে গেছে। হসপিটালে পাঠিয়েছি, প্লাস্টার করা হচ্ছে। ব্যাস আমার কোনো দোষ নেই, গুলি পেলে ওদের গুলি পাবে।

-কেমন আছিস চাঁদ? (কোমল কন্ঠে)

ফারহানের এমন প্রশ্নে ভড়কে গেল রোজ। এতক্ষণ ধরে সে কি বলল আর ফারহান কি বলছে? রাগে মাথায় আগুন দপদপ করে জ্বলছে।কোথায় বিয়েটা তাড়াতাড়ি করে নেবে তা না। রোজ বুকের সামনে হাত গুজে যেতে যেতে বলে,

-টাকা পয়সা নিয়ে দ্রুত আসো। আমি শাড়ি পড়তে যাচ্ছি।বিয়েটা আজ রাতেই হবেই। আর রেডিওতে তুমি তুলির সঙ্গে কথা বলেছো কেন? আমার মোটেও ভালো লাগেনি ওটা।তুলি তোমাকে ইনডিরেক্টলি আমায় ছেড়ে দিতে বলল।তুমি কি সেসব ভাবছো?ভেবে থাকলে বলে দাও, আমি ফেলনা না। যে ছেলের অভাব হবে। আমি চাইলেই তুরি মে’রে ছেলে জোগাড় করতে পারি । হুহ! তোমার প্রতি আমার কোনো ইন্টেরেস্ট নেই। বুঝেছো?

রোজ একা একাই কথা বলতে বলতে চলে গেলো। ফারহান তখনও নিশ্চুপ দাড়িয়ে। রোজের শো একটা সিজনাল শো। বছরে দুবার শো’টি চালু হয়। বসন্তে ও শরৎ কালে। রোজ প্রথম শুরু করেছিল বসন্তে তাই তিনমাস পুরো চলেছিল শো। কিন্তু এরপর থেকে দুমাস করে চলতো। অর্থাৎ বছরে চারমাস। গত একবছরে ফারহান চারমাস শো করেই কাটিয়েছে। আজ শেষদিন ছিল বসন্তের শো’টির। আপাতত রেডিওতে সে আর যাবে না। বাবা দীর্ঘদিন ধরে তাঁর ব্যবসার কাজে হাত লাগাতে বলেছেন। রোজ ছিল না বলে ওটাতেও মন বসে নি। কিন্তু বিয়ের পর নতুন জীবন নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে গেলে ব্যাবসা’টা জরুরি। রোজ কি সেজন্যই এতটা চাপ দিচ্ছে? নিশ্চই বাবা ওকে বলেছে। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফারহান। বাবার কথা রাখতে বিয়ে করছে রোজ? ওকে ভালোবেসে, ওর জন্য নয়? এতটা অভিমান মেয়েটার? নয় বছর ধরে শুধু অভিমান করেই কাটিয়ে দিল। ভালোবাসাটা দেখলো না।যাক, যে কারনেই হোক! রোজ রাজি হয়েছে এটাই অনেক।

বিয়েটা সম্পন্ন হতেই রোজ সবার সামনে ফারহানের হাত টেনে ছাদে নিয়ে গেল। সবাই ব্যাপারটা পুরো উপেক্ষা করল। কিন্তু কাজি সাহেব ও মৌলবি সাহেব বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলেন। মনে মনে নিশ্চই বলছেন, ‘এ কেমন নির্লজ্জ মেয়ে রে বাবা ‘ আরশান পড়েছে মহা বিপদে। রোজের বাসর ঘর সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে ওর আর অয়ন্তির ওপর। কিন্তু অননকে সামলানো কষ্টকর হয়ে উঠেছে। আগে কাঁদতো না বলে সবাই অস্থির হত। আর এখন কেঁদেকেটে বাড়ি মাথায় করে ফেলছে। রজনী রোশনিকে সামলেই পারছে না, অয়ন অভীও আজ প্রচন্ড চঞ্চলতা দেখাচ্ছে। এদের সামলাবে নাকি অননকে নেবে? ফারিয়া আর ফারদিন ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমীর সাহেবও ঘুমাচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে অয়ন্তি অননকে নিয়ে ছাদে চলে আসে।

ছাদের দুপ্রান্তে দুজন দাড়িয়ে আছে। রোজ রাগি চোখে তাকানো আর ফারহান ভীত চোখে।অয়ন্তির হাসি পেয়ে যায় এদের বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখে। অয়ন্তি সর্বদা ফারহানকে ক্রোধান্বিত আর রোজকে ঠান্ডা দেখেছে। অথচ আজ ভিন্ন। বিয়ের পর ব্যবহার চক্রটাই ঘুরে গেছে। অয়ন্তি কেঁশে সংকেত দিতেই ওদের চেহারা স্বাভাবিক হলো। অয়ন্তি অননকে এনে রোজের কোলে দিতে দিতে বলে,

-একে রাখো। একঘন্টা পর এসে নিয়ে যাবো।

-ওর ঠান্ডা লেগে যাবে হীরামন। বাতাস হচ্ছে অনেক। দেখছ না?

-কাঁথা দিয়ে চাপা দিয়ে রাখো। তোমাদের ঘর সাজাতে হবে না। ওকে নিয়ে সেসব পারছি না।

-চাপা দিয়ে রাখবো? আর ঘর সাজাতে হবে না। নতুন করে কি সাজাবে?

-বাসর ঘর সাজানো থাকা উচিত। তুমি বুঝবে না। তুমি শুধু অননকে রাখো।

অয়ন্তি চলে যেতেই রোজ হেসে বলে,
-আমার গল্পের একটা বোকা চরিত্র কুসুম। বাচ্চাকে চাপা দিতে বলে কোন বুদ্ধিমান? একে নিয়ে যে আমার দাদাই কি করবে! এটাকে বড় না করে আবার আরেক বাচ্চা নিয়ে আসলো। (অননের দিকে তাকিয়ে) তাই না আব্বু? তোমার আম্মুটা বড্ড সহজ-সরল। না? বলে কিনা তোমাকে চাপা দিতে। তোমাকে কি চাপা দেওয়া যায়?

ফারহানও খুকখুক করে কাঁশলো। রোজ ধাঁরালো কন্ঠে শুধায়,
-কি?

-গলার স্বর নরম কর। এখন তোর হাসবেন্ড আমি।

-তো? তোমার কাছে মাথা বেঁচে বসে নেই আমি। হিসেব করো, আমাকে কত কষ্ট দিয়েছো। সেগুলো উসুল করে নেবো এবার।

-মানে?

-আমাদের বাসর, আগামী একমাসের আগে হবে না। সেপারেট থাকবো আমরা।

-হোয়াট? এটা কেমন কথা?এটা কি ধরনের অস্বাভবিক কৌতুক? চাঁদ। এটা সম্ভব না।

-ওকে ফাইন। একমাস সম্ভব না হলে ছ’মাস। এবার ভেবে দেখো একমাস ভালো নাকি ছ’মাস। যা বলবে তাই হবে।

ফারহান এগিয়ে আসতেই রোজ গম্ভির স্বরে বললো,
-চেপে ধরে চুঁমু খাওয়ার স্বভাব বাদ দাও। নাহলে কিন্তু আমিও আমার রাগের বহিঃপ্রকাশ করবো। এবার গেলে ফিরে আসবো না।

-ব্লাকমেল করছিস? এবার এক পা বাড়ির বাইরে রেখে দেখা। ঠ্যাঙ ভে’ঙে বাড়িতে বসিয়ে রাখবো। (স্বল্পস্বরে)

-কি বললে তুমি? (চেঁচিয়ে)

-কিছু না। অননকে দে। তোর হাতে ব্যাথা না? আরও ব্যাথা লাগবে। (ভীত কন্ঠে)

রোজ অননকে ফারহানের কোলে তুলে দিলো।অননকে কোলে নিয়ে রোজের নামে নালিশ করতে শুরু করে ফারহান। অননের ভাব-ভঙ্গি এমন যে সে তা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মাঝে মাঝে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসছে। রোজ ভ্রু কুঁচকে বলে,

-কি বলছো ওকে?

ফারহান ব্যাঙ্গসুরে বলে,
-তোকে বলা লাগবে? আমাদের পার্সোনাল কথা এসব। তুই দূরে গিয়ে দাড়া। যা!

-একমাসের বাচ্চার সাথে পার্সোনাল কথা? আমাকে ভুগোল বোঝাও? আমি কেমিস্ট্রির স্টুডেন্ট ভুলে যেও না। হ্যাঁ হয়তো অফিসিয়ালি পড়া হয়নি, বাট কেমিস্ট্রি আমার প্রিয় বিষয়। আর কেমিস্টও!

-কেমিস্ট? আমাকে বললি চাঁদ?

-কেমিস্ট হতে যোগ্যতা লাগে তোমার তা নেই।

-ঘরটা সাজানো হোক, কি আছে কি নেই তা তোকে প্রাকটিক্যালে বোঝাবো। অনেক জ্বালিয়েছিস। একবার সুযোগ পেয়েছি, সে সুযোগ এত দ্রুত হাতছাড়া করবো না আমি।

-তুমি আমাকে জোর করতে পারবে না।

ফারহান এগিয়ে আসলো। রোজ দু কদম পিঁছিয়ে যায়। ফারহান রোজের মুখের ওপর খানিকটা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-তোর সঙ্গে আমি সবকিছু করতে পারি চাঁদ। সবকিছু! আর আমি একবার অন হলে, আমাকে অফ করার সুইচ তুই খুজে পাবি না। বাধ্য হয়ে হোক বা স্বেচ্ছায়, তোকেও আমার তালে তাল দিতেই হবে। আজ কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।

ফারহানের কন্ঠস্বর রোজের কানে বারি খেলো। ঠোঁট কানের লতি ছুঁয়ে দিতেই রোজ শিউড়ে উঠে জামা চেপে ধরে।ফারহান হেসে সরে যেতেই রোজ ফারহানের হাত টেনে ধরে। ফারহান ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এরপর ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে ‘কি?’। রোজের মুখশ্রীতে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো। গরম হয়ে আসছে কান ও গাল। রোজ জোরে শ্বাস নিয়ে বলে,
-আমি
-তুই?

-তোমাকে
-আমাকে?

-আমি তোমাকে ভালোবাসি ফালাক। (একদমে বলে শ্বাস নিল)

-নতুন কিছু বল। এটা জানি আমি। (কৌতুকের স্বরে)
-ওকে ফাইন। (গম্ভির স্বরে)

-আবার রাগ, বুঝিস না কেন চাঁদ! কোলে অনন আর এমন পরিবেশ ভালোবাসা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত না। ঘরে ঢুকে তোর ভালোবাসার সঠিক প্রত্যুত্তর দেবো। আর আমি তোকে ভালোবাসি এটা সারা দুনিয়ার মানুষ জানে। তোকে নতুন করে, নতুন ভাবে না বললে মজা পাবি না। সুতরাং সবুর কর, সবুরে ভালোবাসার নতুন অধ্যায় উপহার পাবি।

-আমাকে ‘ তুই ‘ সম্বোধন করা যাবে।

-তুমি ডাকা অসম্ভব, আপাতত। এত বছরের অভ্যাস,,

রোজ চোখ রাঙালো,
-ওকে তুমি ডাকবো। তুমি ঘরে চল তারপর তোমার ভালোবাসা পাবি।

-কি বলছো এসব? তুমি তোমার সম্বোধনের সাথে চল, পাবি?

-প্রনাউন্স দেখ। তুমি তোমার ঠিকঠাক আছে। বাকিসব গোল্লায় যাক।

-তুমি একটা এলিয়েন টাইপ প্রাণী।

-থ্যাংক ইয়্যু।

ফারহান রোজের কাধে হাত রেখে ওকে কাছে টেনে নেয়। রোজও ফারহানের সঙ্গে মিশে দাড়ায়। অনন ঘুমিয়ে গেছে। রোজ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। একবছর আগে চাঁদের যে অভিমান দেখেছিল সেটা আজ নেই। চাঁদের শুভ্র স্নিগ্ধ কোমল এসে পড়ছে ওদের ওপর। রোজের মনে হলো আজ ফালাকের চাঁদের মত আকাশের চাঁদও তৃপ্ত, সন্তুষ্ট! ফারহানের শার্ট খামচে ধরে রোজ নাক টেনে বলে,

-আমাকে কখনও মিথ্যে বলবে না।

-বলবো না।

-কোনো কিছু লুকাবে না।

-লুকাবো না।

-শুধু আমাকে ভালোবাসবে।

-শুধু তোকে ভালোবাসবো। তোকে ছাড়া ভালোবাসার মত আর আছে কে আমার?

-আমাকে একা ফেলে কোথাও যাবে না।

-যাবো না।

-ঠিক আছে।

-কি ঠিক আছে? শুধু আমি কেন সব শর্ত মানবে? তুই মানবি না?

-কি মানবো? সবই তো মেনে চলি।

-কাঁদবি না আর।

-তুমিও তো কাঁদো।

-তোকে পাওয়ার জন্য কেঁদেছি। কারন তোর মতিগতি ভালো না। আমাকে পাওয়ার জন্য তোকে কাঁদতে হবে না। ফালাক শুধুমাত্র তোর, আর তোরই থাকবে। বুঝেছিস?

রোজ মাথা দুলালো। ফারহান মুচকি হেসে বলে,
-ভালোবাসি তোকে চাঁদ।সবার তুলনায় বেশি! সবথেকে বেশি। আমাকে আর কখনও ছেড়ে যাস না। কোনো ভুল করলে সরাসরি আমাকে বলবি। তবুও ছেড়ে যাবি না। কথা দে আমায়।

-যাবো না। কথা দিচ্ছি!

_____

বিছানার চাদর উল্টে পাল্টে দেখছে অয়ন্তি। বুঝতে পারছে না ঠিক কোন রঙের চাদর বিছাবে। অবশেষে আরশান নীল রঙের একটা ফুলের চিত্রের মিশেলী চাদর এগিয়ে দেয়। আরশান ফুল দিয়ে ঘর ডেকোরেট করছে। মেঝেতে লাভ সেপের মোমবাতি রেখেছে। অয়ন্তি মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে দেখে আরশান হা হুতাশ করে বলে,

-আমাদের বাসরে কি হয়েছিল মনে আছে? তোমার ওই দ’জ্জাল বোনেরা আমাকে আধমরা বানিয়ে দিয়েছিল গিলিয়ে গিলিয়ে।

-বেশ হয়েছে। আপনি যেমন, ওরাও তেমন। ওদের পাওনা টাকা ঘুরিয়েছিলেন বলেই তো ওমন করেছে।

-তাই নাকি? আমি কি জানতাম তোমার বোনেরা সব টাকার কুমির। প্রতি কাজে দশ পনেরো হাজার করে টাকা চাইলে দেওয়া সম্ভব? বিয়ে করতে গিয়েছিলাম নাকি আমার সব টাকা ঢালতে? সামান্য হাত ধুইয়ে দিয়ে পিচ্চি একটা মেয়ে পাঁচ হাজার টাকা চায়। এতো টাকা করবে কি?

-এটা শালিদের হক।

-অতিরিক্ত।

-আমার বোনদের নিয়ে কিছু বলবেন না। খবরদার!

-সে আর বলতে, তোমার অরুপি যে খেলা দেখালো। তোমার সব বোনের নজর খারাপ। পরের জামাইয়ের দিকে নজর দেওয়া স্বভাব। তুমিও ফালাকের দিকে নজর দাও, কি ভেবেছো আমি বুঝিনা?

-বেশ করি! উনি দেখতে সুন্দর তাই নজর দেই। আপনি ওনার মত সুন্দর না তাই আপনার দিকে নজর দেইনা। বুঝেছেন?

-খুব বুঝতে পারছি। এক অননে আটকানো যাবে না।আরও দু একটা লাগবে।

-অসভ্য লোক।

রোজ আর ফারহান সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওদের কথা শুনে থম মে’রে দাঁড়াল। পরক্ষণেই হেসে উঠলো দুজন। অনন ঘুমিয়ে পড়েছে এবার ওদেরও ঘুমানোর প্রয়োজন। আরশানের আবার সকালে শো আছে। অয়ন্তির কলেজ আছে। রোজ ঘরে ঢুকে বলল,

-অনেক সাজানো হয়েছে। এবার নিজেদের বাচ্চা নিয়ে ঘরে যাও।

অয়ন্তি সকৌতুকে বলে,
-আজ নেবো না। ওকে বরং রেখেই যাই। কি বলো?

ফালাক কৌতুক বুঝতে পেরে বলল,
-শুধু ওকে রাখবে? তুমিও থেকে যাও। কি দাদাই, তোমার কি মত? চাঁদ তোমার বাচ্চাকে সামলাবে আর আমি তোমার কুসুমকে।

– কি সাংঘাতিক মানুষ। রোজ দেখলে তো, এভাবেই আমাকে সবসময় হ্যারাস করে। তুমি কিছু বলবে না?

রোজ কিছুসময় ভেবে বলে,
-অনন থাকুক। আমরা দুজনেই টায়ার্ড! ঘুমাবো। দাদাই নিজের বউকে নিয়ে যাও। তবে রয়েসয়ে, মাত্রই অনন আসলো। এত দ্রুত আরেকজন আসলে সামলাতে পারবে না।

আরশান লজ্জায় পড়ে যায়। রোজ’রা সবটা শুনে ফেলেছে। অয়ন্তিরও লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। অয়ন্তি দ্রুত অননকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই আরশান মাথা চুলকে লাজুক হেসে চলে গেল। রোজ নিজের ডায়েরি খুলে লিখল,

“অসমাপ্ত কাহিনিটি পরিশেষে সমাপ্ত হলো। শুধু জাদুর জুটি নয়, আমার জীবনটাও পরিপূর্ণ আজ।”

ফারহান উঁকি দিয়ে ডায়েরি দেখার চেষ্টা করে। রোজ মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
-এটা আমার পার্সোনাল ডায়েরি।

ফারহান সে কথা পাত্তা না দিয়ে ডায়েরি কেড়ে নিয়ে পড়লো। রোজ গাল ফুলিয়ে বসে আছে চেয়ারে। হাতে কলম, কলমের খাপটা রোজের ঠোঁটের ভাজে। রোজ সেটা টেবিলের ওপর রাখতেই ফারহান আচমকা এসে রোজকে পাঁজকোলা করে তুলে নিয়ে রোজের ঘাড়ে মুখ গুজে ঘ্রাণ নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে,

-আর এটা আমার পার্সোনাল ওয়াইফ! একান্তই আমার। শুধুমাত্র আমার। তোকে বলেছিলাম না চাঁদ? #তুই_হবি_শুধু_আমার। দেখ, আজ তুই শুধু আমার। আমি তোকে আর একমুহূর্তও ছেড়ে থাকতে পারবো না। কিছুতেই না। ভালোবাসি চাঁদ, তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি আমি।

ফারহানের অঁধরের বিচরণ রোজের সমস্ত মুখে চলতেই রোজও অস্ফুটকন্ঠে বলে,
-আমিও।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here