তুই হবি শুধু আমার পর্ব -২০+২১

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_বিশ

গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রোজ। চোখের পাপড়ি ভার হয়ে আছে। পায়ের ব্যাথাটা সকাল থেকে বেড়েছে। ফোনের চার্জ শেষ। তবুও এলার্মের শব্দ কানে বাজছে। বিরক্তি ও রাগে রোজের মস্তিষ্ক সজাগ হতে থাকলো। চোখ খুলে গেল মুহূর্তেই। রোজ উঠে সোজা হয়ে বসে। চোখ ডলে। এরপর ঘুম ঘুম নজরেই পাশে তাকায়। একটা বাটন ফোন অনবরত বাজছে। কার ফোন এটা? ওর ঘরে কোথ থেকে আসলো? রোজ পুরো ঘরে চোখ বুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-কাম আউট সিয়াম!

খাটের নিচে লুকিয়ে থাকা সিয়াম কেঁপে উঠলো। রোজ জানলো কি করে সিয়ামই এসেছে?রোজ তো সিয়ামকে আগে দেখেনি ইভেন সিয়াম নিজেই তো রোজকে এই প্রথম দেখলো। তাহলে চিনলো কি করে? রোজ উঠে ড্রয়ার থেকে নিজের লাইসেন্স করা পি’স্ত’ল বের করে পি’স্ত’লের অগ্রভাগ দিয়ে গলা চুলকিয়ে বলে,

-তুমি নিজে বের হবে? নাকি আমি বের করবো? সকাল সকাল র’ক্ত ভালো লাগবে না আমার। সো কাম আউট ফাস্ট সিয়াম।

সিয়াম বেরিয়ে আসলো। ধুলোবালির সাগরে ডুব দিয়ে উঠেছে যেন। রোজ কঠিন গলায় বলে,

-ফালাক ভাইয়া ফোন দিচ্ছে? রিসিভ করো। কিন্তু এটা বলবে না যে আমি জেগে আছি প্লাস তোমার সামনেই দাড়িয়ে আছি। যদি কোনো চালাকি করতে যাও তাহলে এই পি’স্ত’লের একটা বুলেটই তোমার হৃদয়ের কৌতুহল মেটানোর জন্য যথেষ্ট।

-ম্যাম!

-নো মোর ওয়ার্ড সিয়াম, রিসিভ দ্যা কল। এ্যান্ড অন দ্যা স্পিকার।

সিয়াম স্পিকার অন করে হ্যালো বলতেই ফালাকের কন্ঠ শোনা গেল।
-কোথায় তুমি? চাঁদ ঘুমাচ্ছে তো? ওকে যে ঔষধটা দিতে বলেছিলাম দিয়েছো?

-জ,,জি স্যার।

-ওকে নজরে রাখবে। কোথাও যেন একা না যায়। শ্যুটিং অলমোস্ট শেষ। আমি ফিরে আসবো, যতদিন না আসছি ততদিন ওর খবরাখবর তুমি আমাকে দেবে। তুমি সামনাসামনি থাকলে ও সন্দেহ করবে না। আর যে ছেলেগুলোকে বলেছিলাম চাঁদের ওপর নজর রাখতে তাদের মধ্যে একজনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি হয়েছে ওর? জেনে আমাকে ইনফর্ম করো।

-আসলে স্যার ম্যাম তো,,

রোজ পি’স্ত’ল তাক করতেই সিয়াম কাঠ কাঠ গলায় বলে,
-জি স্যার। আমি জেনেই বলছি।

-ওকে। ও যেন টের না পায় ওর ওপর নজর রাখছি আমি। সো বি কেয়ারফুল।

ফারহান ফোন রাখতেই রোজ পি’স্ত’ল কোমরে গুজে ফেলল।সিয়াম ভয়ে কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে। রোজ হেসে বলে,

-নজর রাখছো আমার ওপর? গুড, ভেরি গুড। কিন্তু ও তো গাঁধা না, তাহলে তোমার মত গাঁধাকে আমার খোজ রাখতে বলল কেন? লোকের অভাবে? ও এখানে নেই তাই? ইশ! সব প্লান ভেস্তে গেল তাইনা?

-ম্যাম!!

-যা জিজ্ঞেস করবো সব টা সত্য এবং সরাসরি বলবে সিয়াম। কারন, আমার কাছে এখন শুধু সত্য জানাটা জরুরি। মানুষ নয়। (কঠিন গলায়)

-জি বলুন ম্যাম, কি জানতে চান? স্যার লাস্ট নাইটে চা বাগানের একটা শ্যুটে গেছে। মাসের শেষে ফিরবে তাই তিনি চাচ্ছিলেন আমি যেন আপনার খেয়াল রাখি, ঔষধের ওপর নজর রাখি, আপনি টাইম টু টাইম খাচ্ছেন কিনা। বিশ্বাস করুন আর কিছু না।

-ওহ প্লিজ! সিয়াম। মিথ্যা বলে না, মিথ্যা বললে পাপ হয় জানো না? আমি চাইনা তুমি পাপ করো। সুতরাং যা যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দাও। বাড়তি একটা কথা না। অতিরিক্ত কিছু পছন্দ না আমার।

-কিন্তু ম্যাম,

-মুগ্ধতার সঙ্গে ফালাকের বিয়ে ঠিক হয়েছিল?

-ওটা ম্যাম

-হ্যাঁ, কি না। (চেঁচিয়ে)

-হ্যাঁ।

-গুড। মুগ্ধতার বাবা কে? ইশতিয়াক ইরফান? খোজ খবর নিশ্চই রেখেছো। বিয়ের মত কথা যেহেতু চলেছে সেহেতু এসব তুমি জানো।

-জি ম্যাম।

-ভেরি গুড। এভাবেই ভালো মানুষের মত উত্তর দেবে। সাইমুন কি মুগ্ধতার ভাই? দেখো আমি জানি তুমি সব জানো, আমিও সব জানি। শুধু কনফার্ম হতে চাই। তাই ভণিতা না করে জবাব দেবে।

-হ্যাঁ, সাইমুন মুগ্ধতার ভাই। কিন্তু এটা কেউ জানে না। পারিবারিক ব্যাপার তো তাই।

রোজ স্মিত হেসে বলে,
-পারিবারিক? পরিবারেরও কানেকশন আছে, তা ঠিক কি কানেকশন সিয়াম?

-আমি জানি না ম্যাম।

রোজ সিয়ামের পায়ের ঠিক পাশের চেয়ারটায় গু’লি করতেই সিয়াম ভয়ে লাফ দিয়ে ওঠে। রোজ কৌতুকের স্বরে বলে,
-বললাম না, মিথ্যা বলতে হয়না।

-আপনি আমার সঙ্গে এমন কেন করছেন?

-কারন তুমি আমাকে কোনো মেডিসিন দিচ্ছিলে। আমার হাতে কি পুশ করেছ? যার জন্য আমার মাথা ঝিমঝিম করছে। যাক সেসব পরে জানা যাবে, আগে এটা বলো ইরফান কি হয় ফালাকের? চাচা?

সিয়াম বাকরুদ্ধ দাড়িয়ে রইলো। রোজ সবকিছু জানে? তাও জিজ্ঞেস করছে কেন? দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছে? সিয়াম যদি সব বলে দেয় ফারহান প্রচন্ড রেগে যাবে।এমনিতেই ভুল করে ধরা খেল। এখন যদি সব বলে দেয় ফারহান সহ ফারদিন সাহেবও রেগে যাবেন। সিয়ামকে কিছু বলতে না দেখে রোজ নিশ্চিত হলো ওর কানে যেসব খবর এসে তা পুরো সত্য। রোজের হাত পা জ্বলে উঠল রাগে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে সে সামনে তাকায়। এরপর কঠিন গলায় বলে,

-তোমার স্যার স’ন্ত্রাস ছাড়েনি?

-ছেড়ে দিয়েছে ম্যাম।

-মেহমেদকে চেনো?

-জি ম্যাম। মারাত্মক কিলার।

-তোমার স্যার তাঁর থেকেও বেশি মারাত্মক সিয়াম। ফালাকের জীবনে ওর মা বাবা ছাড়া আর একটা মানুষ সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তুমি জানো, সেটা কে? সেটা সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে সাইরাহ্ আনসারী রোজা। কিন্তু তোমার স্যার তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করে এটা সুনিশ্চিত করেছে যে সে বিশ্বাসের যোগ্য নয়। আমার বিশ্বাস নিয়ে যে খেলতে পারে সে তোমাকে ভাই মনে করে কোলে তুলে রাখবে?

-স্যার ভালো হয়ে গেছেন ম্যাম। বিশ্বাস করেন উনি আর ওসব করেন না। শুধু অভিনয় করেন।

-হতে পারে। কিন্তু আমি ওকে বিশ্বাস করিনা। তোমাকে গাঁধা পেয়ে আমার ওপর নজরদারির আদেশ দিয়েছে। সে ভেবেছে তুমি বোকা তাই তোমার ওপর আমার সন্দেহ হবে না। আসলেই হত না। তোমার মত ভীতুর ডিম যে আমাকে ঘুমের ঔষধ দিতে পারে তা ভাবিওনি। কিন্তু দিন কে দিন তোমার সাহসের উন্নতি হয়েছে। সেটা ভালো লক্ষণ। তবে আমার সঙ্গে এমনটা না করলেও পারতে ডিয়ার!

-স্যার আপনাকে ভালোবাসেন ম্যাম।

-জানি সেটা। নতুন কিছু শুনতে চাচ্ছি। ফালাকের গ্যাং কোথায়? সে কি এখনও যুক্ত আছে? ইরফানের কাছে ও মাথা বেঁচে বসে আছে কেন? কিসের জন্য?

-আপনার জন্য।

-আমার জন্য?

-আর কিছু বলতে পারবো না ম্যাম। কিছু জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।

রোজ মৃদু হেসে বলে,
-ওকে করলাম না। ফিরে গিয়ে তোমার স্যারকে বলবে তুমি সব কাজ ঠিক ঠিক করেছো। আর আজকের এই কথাগুলো বলার দরকার নেই, সময় সুযোগ বুঝে আমি নিজেই জানিয়ে দেবো। মনে থাকবে?

-জ..জি ম..ম্যাম।

সিয়াম চলে যেতেই রোজ আইডি কার্ড নিয়ে বেরিয়ে গেল। সাইমুন কল দিচ্ছে। ছেলেটার কাজে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে রোজের। এত বিরক্তি সহ্য করা যাচ্ছে না। একটা ক্যাফে রোজকে ডেকেছে সাইমুন।রোজ উপস্থিত হতেই দেখলো ক্যাফ পুরো ফাঁকা।সাইমুন একা একটি চেয়ারে বসে কফি পান করছে। রোজকে দেখে সে এগিয়ে এসে কুর্নিশ করে স্বাগত জানালো। রোজ গায়ের জ্যাকেট খুলে সাইমুনের হাতে দেয়। বাইরে ঠান্ডা পড়লেও ভেতরে বেশ গরম। রোজ বসতে বসতে বলল,

-কফি উইথআউট সুগার। হট চকলেট এ্যান্ড পেস্ট্রি।

সাইমুন অর্ডার কনফার্ম করে সামনে বসলো। রোজের ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম হাসি ঝুলে আছে। সাইমুন হেসে বলে,

-চিনি ছাড়া কফি? গলা মিষ্টি করার নতুন ট্রিক নাকি?

-হতে পারে। তুমি তোমার কথা বলো। কেন ডেকেছ?

-তুমি কি ফারহানকে ভালোবাসো?সত্যিটা বলবে প্লিজ। বাসো কি বাসো না?

-কি মনে হয়?

-জানি না। তুমি বলো।

-তোমার ফ্যামিলি সম্পর্কে বলো। ইউ নো হোয়াট, আ’ম কোয়াইট ইন্টারেস্টেড টু ইয়্যু।

-আমারও ফ্যামিলি নেই। একা একাই বড় হয়েছি।

-তাই? (সন্দিহান কন্ঠে)

-হ, হ্যা। তা ছাড়া কি? তুমি জানো না? সবাই তো জানে। (তোতলানো কন্ঠে) এবার বলো ফারহানকে কি তুমি এখনও ভালোবাসো?

-এক্চুয়ালি হ্যাঁ। বাসি, আজীবন বাসার চিন্তাও করে রেখেছি। ওর কোনো ফল্ট না পেলে তো ওকে ছাড়তে পারবো না। যেহেতু ও এত ভালোবাসে আমাকে।

-তুমি অপছন্দ করো কি?

-অপছন্দ! প্রতারণা, ধোকা, বিশ্বাসঘা’ত’কতা। কিন্তু তুমি জানো,আমি এগুলোও ভালোবাসি। কারন এগুলো ভিন্নস্বাদের অনুভূতি।

-যদি কখনও জানো ফারহান তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে? আর একজন তোমাকে নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে। তখন কাকে বেঁছে নেবে?

-সেকেন্ড অপশন। যে নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে। কিন্তু সে যে নিঃস্বার্থ হয়ে ভালোবেসেছে এটার কি প্রমাণ? আর আমি তা মানবো কিভাবে?

-ফারহান তোমাকে আঠারো বছর ধরে চেনে।তুমি তাকে ছাড়তে পারবে তো?

-আমাকে তুমি ঠিক চেনো নি সাইমুন। আমি মানুষটা কিছুটা হলেও স্বার্থপর। আমি যা চাই তা পেয়েই ছাড়ি। জেদের কমতি নেই আমার মাঝে। তাই যদি টের পাই এমন কিছু হয়েছে, আমি ফালাক কেন? তোমাকেও ছেড়ে দিতে পারি। সো বি কেয়ারফুল। আমার জীবনে আসার আগে এসব জেনেই আসবে।

-আমি রাজি।

-রাজি? আমাকে পাওয়া কিন্তু এতটা সহজ হবে না।

-যেটা সহজেই পাওয়া যায় মানুষ তাঁর মর্ম বোঝেনা। তুমি বলেছিলে এটা।

-আমি তো অনেককিছুই বলি। সবটা সিরিয়াসলি নিতে হবে নাকি?তাছাড়া আমি তোমার কেন হবো? কি আছে তোমার? না ফ্যামিলি, না ফেম!

-তুমি আমার হবে কারন আমার কাছে সেসব আছে যা তোমার চাই।

-কি?

-সত্য!

-বলে ফেলো। শোনার পর ভেবে দেখবো তোমার হতে চাইবো কিনা।

-আমি তোমাকে ভালোবাসি রোজ।

রোজ বিরক্তি নিয়ে তাকালো। সাইমুন বলতে শুরু করে।
-আশা করবো তোমাকে না ঠকালে তুমিও আমাকে ঠকাবে না। তোমাকে ভালোবাসি তাই বিশ্বাস করে সব বলছি।

-তোমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবো আমি।

-আমার সঙ্গে চলো। এখানে এসব বলা যাবেনা।

-কপালের ব্যান্ডেজটায় ব্যাথা করছে অনেক। পাল্টানো হয়েছে একটু আগে। বুঝতে পারছি না কি হয়েছে। খুলে দেবে একটু। যন্ত্রণা হচ্ছে খুব।

-দিচ্ছি।

রোজের ব্যান্ডেজ খুলে সাইমুন তা ড্রেনে ফেলে দিলো। রোজ মৃদু হেসে বাইকে উঠলো। সাইমুন রোজকে নিয়ে ওর অতি পরিচিত ও গোপনীয় একটি জায়গায় এলো।রোজ চারপাশে চোখ বুলিয়ে যা বুঝলো তা হচ্ছে এটা জঙ্গলের মধ্যে এক শিকারির বাসা। সাইমুন রোজকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে রোজের জন্য খাবার তৈরি করে। তখন কিছু খাওয়া হয়নি। এখন খাওয়া প্রয়োজন তার ওপর রোজ অসুস্থ। রোজ খেতে শুরু করলো। সাইমুন আতঙ্কিত চোখে চেয়ে আছে। সত্যাটা কিভাবে বলবে সে? খাওয়া শেষ হতেই রোজ কৌতুহলী কন্ঠে বলে,

-এবার বলো। ফালাক কি করেছে? তোমার কি আছে?

-আমার মা আর ভাই বাদে সবাই আছে।

-কি?

-এ্যন্টি টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত ডিআইজি ইশতিয়াক ইরফান আমার বাবা। আর মুগ্ধতা মেহরীম আমার আপু। ফারহান আমার চাচাতো ভাই।

-কি বলছো এসব? (অবাক কন্ঠে)

সাইমুন রোজের কাছে এসে রোজের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। রোজ অগোচরে স্মিত হাসে। সাইমুন বলতে শুরু করে।

-ঠিক সাত বছর আগে থেকে তোমাকে চিনি আমি।তবে তোমাকে ভালোবাসি তোমার পরিচয় না জেনেই। আমি আর’জে রোজকে ভালোবাসি। আমি জানতাম না তুমি সাফোয়ান আনসারীর মেয়ে। ট্রাস্ট মি রোজ, আমি কিছু জানতাম না।

-মজা করছো তাইনা?

-না। আজ তোমাকে আমি সব সত্য বলবো। বাবা বোন সবার বিপক্ষে গিয়ে সবটা বলবো আশা করবো তুমিও আমার পক্ষে থাকবে।

-বলো।

-আমার বাবার চোরাচালানের ব্যবসা ছিল। ইউনিটের আরও কিছু সদস্য এর সঙ্গে যুক্ত ছিল। তোমার বাবা সব জানতেন। ফারদিন চাচ্চুও জানতেন। চাচ্চুর সঙ্গে তোমার বাবার ঝগড়াও হয়েছিল কারন চাচ্চু তাকে নিষেধ করেছিলেন আমার বাবার সঙ্গে ঝামেলা করতে। কিন্তু তোমার বাবা সৎ ছিলেন তাই তিনি সে বারণ শোনেননি। ফারহান তখন সবে সবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে ঢুকছে। বাবার কথাতেই আগ্রহবোধ করে সে এসেছিল এই কালো দুনিয়ায়। ফারহান জানতো বাবা সাফোয়ান সাহেবকে মা’রার পরিকল্পনা করছে। চাচ্চুও জানতো। তারা চেষ্টা করেছিলো তোমার বাবাকে বাঁচানোর কিন্তু বিষয়টা গোপন ছিল বলে কেউ জানে না। সবাই জানে তারা জেনেও তাকে আটকায়নি। এমনকি চাচ্চু স্পটেও চলে গিয়েছিল। কিন্তু বাবা তাকে দেখে নিজের প্লান বদলে চাচ্চুর হাতেই তোমার বাবাকে মা’রে। আর বলে তোমাকেও মে’রে ফেলবে যদি তুমি বুঝে যাও এসবের পেছনে বাবা আছে। তারপর তোমার আর ফারহানের ঝামেলা হয়। ফারহান তখন তোমার বাবার কথা জানতো না। তাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে নিজের আধিপত্য বিস্তারের নেশায় বুদ হয়ে গেল।চাচ্চু ধুকে ধুকে ম’রতে থাকলো অপরাধবোধে। ফারহান সবটা জানার পরও তোমার কাছে আসেনি কারন ও তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। ও ভেবেছিল তুমি ওকে ঠকিয়েছো। তাই পাঁচবছর সে জমিয়ে রাজত্ব করলেও সবার সামনে বলেছে দুবছর সে ওসব করতো। আসলে তা ঠিক নয়। ফারহান এখনও এই জগতে আছে। এই জগতে একবার ঢুকলে ফেরা কঠিন, অন্ততো বেঁচে ফেরা। কেউ ভালো হতে চাইলেও এই জগত তাকে ভালো হতে দেবে না। ফারহানও আড়াইবছর ধরে চেষ্টা করছে এই জগত ছাড়তে কিন্তু পারবে না । কারন ওর দল বিপদে পড়ে যাবে যদি ও এসব ছেড়ে দেয়। তাই ও তোমাকে কালোজগত ছাড়ার যে কথা বলেছে তা মিথ্যা। তোমার পেছনে ও সর্বদা নজর রেখেছে কারন তোমাকে পাওয়ার নেশা ওর জেদ, ওর স্পৃহা। তোমাকে ও নিজের করেই ছাড়বে। অথচ সবার সামনে দেখাচ্ছে সে তোমার খোঁজও জানে না। চারবছর আগে আমার আপুকে বিয়ে করার প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে আপুকে ছেড়ে দেয়। আমার আপু ওর জন্য কি করেনি? পাগলের মত ভালোবেসেছে, ফারহান ওকে ছুঁয়ে দেখেছে আর বিয়ের সময় আসতেই পাল্টি খেল। বিয়ের দিন ওর তোমার কথা মনে পড়লো, আর আগের দিনগুলো? আমার আপু তবুও ওকে ভালোবেসেছে।

তোমার বাবার নামে যে একশ কোটি টাকা আছে সেটা চায় সবাই। আমার বাবা, তাঁর দল। আর ফারহান চায় তোমাকে নিজের করতে।

রোজ হাই তুলে বলে,
-মেইন পয়েন্ট বলো।ফালাক ও তাঁর বাবা কেন কিভাবে দোষী সেসব কারন শোনায় আমার আগ্রহ নেই, তোমার খু’নি বাবার কথা বলো তুমি।

-বললাম তো। আর জানি না।

-প্লিজ বলো সাইমুন। আমার মা’কে কেন মা’রলো তোমার বাবা? তাঁর তো কোনো দোষ্ ছিল না। আমাকে প্লিজ সবটা বলো। তোমার বাবা এখন কি চায়? আমার পেছনে পড়ে আছে কেন?

-জানি না আমি।

রোজ কোমরে গুজে রাখা পি’স্ত’ল বের করে সাইমুনের বুক বরাবর দুটো গু’লি করে বলে,
-শু***** বাচ্চা! কোনো কিছুই যখন বলবি না তখন আমাকে নিয়ে আসলি কেন? তোর বাপটা দেখছি তোর জীবনেরও তোয়াক্কা করেনা। তো আমার কি এমন ঠেকা পড়ছে তোকে বাঁচানোর?

রোজ সাইমুনের ফোনটা বের করে কললিস্ট চেক করে সেটা আইজি সাহেবের অফিসে পাঠিয়ে দিলো।আইজি সাহেব সবটা শুনে বললেন,
-ওদের দুজনের কল রেকর্ডিং পেয়েছি। ইরফান প্লান করে তোমার টাকার খবর জানার জন্য সাইমুনকে তোমার কাছে পাঠিয়েছে। তুমি এখন কোথায়? সাইমুন কোথায়? ঠিক আছো তো?

-সাইমুন, আমার সামনেই মেঝেতে পড়ে আছে।

-জীবিত?

-না।

-চলে আসো। লা’শের ব্যবস্থা আমি করছি। কিন্তু আমি ভাবছিলাম তোমার নিরাপত্তার জন্য,,

-ইউনিটে বাবার পরে আপনি আছেন। আমি চাইনা বাবার প্রিয় ইউনিট অসৎ লোকে পূর্ণ হোক। ওরা যে আপনার ওপর আমার থেকেও বেশি নজর রাখছে এটা আপনার অজানা নয়। আর আপনার কিছু হলে আমি একা সবটা সামলাতে পারবো না চাচ্চু। আপনার ওপর ভরসা করেই তো এত বড় একটা পদক্ষেপ নিলাম।

-তাহলে তৈরি হও, ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। আমি খুব দ্রুতই ওদের এ্যাগাইন্সটে এ্যাকশান নিবো। ওদের ঠিক সেভাবেই শেষ করতে হবে যেভাবে আনসারী শেষ হয়েছে। তখন না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশুরি।

-শুভকাজটা আমি নিজহাতে করতে চাই। তার আগে টাকাগুলো আপনি ইউনিটের ইউনিট এাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিন। কারোর পার্সোনাল এ্যাকাউন্টে যাবে না টাকা। আগামীকাল বা পরশু এসে অফিসিয়াল কাজগুলো করে দিয়ে যাবো।

__________

রোজের জন্য সার্প্রাইজ পার্টি এ্যারেঞ্জ করছে অয়ন্তি। ওর জন্মদিন ও সুস্থতা উপলক্ষে। অয়ন্তির বেলাতেও অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। রোজ মানা করেনি বলে এবার ওর জন্যও করা হচ্ছে। অয়ন্তি নিজে কেক বেক করছে। বাড়িতে আজ কেউ নেই, ওরা দুজন বাদে। সবাই গ্রামে গিয়েছে। আরশান রান্নাঘরের দরজার কোনায় দাড়িয়ে আছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে অয়ন্তিকে দেখার পর ও এগিয়ে আসে। অয়ন্তি আটা গুলাচ্ছিল রুটি বানানোর জন্য। আরশানকে আসতে দেখে সে দ্রুত সরে দাঁড়াল।
-একদম আসবেন না। এখন কিছু হবে না। কোনো চুঁমু টুমুও না।

আরশান পানি পান করার জন্য গ্লাস নিতে নিতে বলে,
-তোমার মনে দেখছি সবসময় ওসব নাচছে। মনটাকে পবিত্র করো।

-আমার মন ঠিকই আছে। আপনি আমাকে জ্ঞান না দিয়ে নিজের স্বভাব বদলান।

-বদলাবো না। কি করবে কুসুম?

-আটায় গোসল করাবো। করবেন নাকি?

-না।

অয়ন্তি ঠোঁট টিপে হাসে।
-আজকে তাহলে আটাতেই গোসল সাড়তে হবে মাই ডিয়ার হাসবেন্ড। আপনার অত্যাচার অনেক সহ্য করেছি আজ আমার পালা।

অয়ন্তি দুহাতে আটা নিয়ে তেড়ে আসতেই আরশান ভ্রু কুচকে তাকালো। অয়ন্তি সত্যি সত্যি আসছে নাকি? আরশান দূরে সরে দাঁড়ালো।
-এমন করবে না কুসুম। ঠান্ডা লেগেছে আমার।

-লাগুক।

-ওকে। আমিও আটায় ডুবাবো তোমাকে।

অয়ন্তি আরশানের মুখের ওপর আটা ছুড়ে দিতেই আরশানও আটা এনে অয়ন্তির চুলে ঢেলে দিলো। রোজ এসে ওদের রান্নাঘরে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে সোজা নিজের জন্য বরাদ্দ ঘরটাতে চলে গেলো।দরজা আটকে দিয়ে সে ইয়ারফোনে গান শুনছে। দরজা সে সন্ধ্যার আগে খুলবে না। বলা যায় না এরা ওকেও আটার ভুত বানিয়ে দিতে পারে।

অয়ন্তি দৌড়ে হাঁপিয়ে গেছে। পুরো রান্নাঘর আটায় মাখামাখি। আরশান মেজাজ দেখিয়ে বলে,
-চলো। গোসল করে নেবে। এভাবে থাকলে এলার্জি হবে তোমার।

-এগুলো কে ঠিক করবে?

-পরে দেখছি। তুমি চলো।

-কিন্তু,,

-কোনো কথা না কুসুম। চলো।

আলামারি থেকে জামা বের করে বিছানার ওপর রাখে অয়ন্তি। আরশান আগে গোসলে ঢুকেছে। অয়ন্তি চুলের শুকনো আটাগুলো ঝেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। একেবারে ভুত বানিয়ে দিয়েছে। চুলের আটা ছাড়াবে কি করে?
-ইশ! চুলগুলো বোধ হয় গেল এবার। অত্যাচারী বর!

আরশান বাথরুমের ভেতর থেকে ডাকে,
-কুসুম আমার তোয়ালে দাও। নিতে ভুলে গেছি।

-পারবো না। আমার কি হাল করেছেন? নিজের তো কদমছাট চুল। একটু শ্যাম্পুতেই উঠে যাবে। আমার তো এক বোতলেও কাজ হবে না। বোতল বোতল ঢাললেও আমার চুল ঠিক হবে না। চুল থেকে এসব ছাড়াবে না।

-আসো ছাড়িয়ে দেই।

-থাক, অসংখ্য ধন্যবাদ।আপনার ছাড়ানোর মানে ভিন্ন। দরকার পড়লে এই চুল নিয়েই থাকবো। তবুও আপনার কাছে গিয়ে চুল থেকে আটা ছাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

আরশান শব্দ করে হেসে বলে,
-আনরোম্যান্টিক বউ! ভালো হয়ে যাও।

রোজ আইজি আরিফিনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আবারও বাইরে যাচ্ছিলো। অয়ন্তি আর আরশানের কথা শুনে সে মুচকি হাসে। ঘরে ঢুকে অয়ন্তিকে টানতে টানতে সে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিলো। তোয়ালে কাপড়ও অয়ন্তির হাতে করে পাঠিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

-দাদাই, তোমার বউ তোয়ালে সব দিয়ে গেলাম। জমিয়ে রোম্যান্স করো। আমার টিমে রোশনির মত আরও কিছু সৈন্য চাই। তাদের আনার ব্যবস্থা করো জলদি। আমি কলেজে যাচ্ছি। ফিরতে সাত-আটটা বেজে যাবে। চিন্তা করো না।

-আমারটা তো চলে আসবে। তোর নিজের দায়িত্ব নেই? বিয়েশাদী করে মামা ডাক শোনা। কতদিন চাচ্চু আর আব্বু ডাক শুনবো?

সর্বনাশ! মুখ ফসকে কি বলল আরশান? রোজ যদি এটা মজার ছলে নিয়ে ফেলে? নির্ঘাত ফাঁসিয়ে দেবে।রোজ যেতে যেতে দুষ্টু হেসে বলে,

-ভাবি, তোমার জামাইকে আব্বু ডাকে কার বাচ্চারা? ভালো করে জেনে নিও। কোথাও কিছু ঘটিয়ে ফেলেছে কিনা। ইদানিং রেডিও সেন্টারেও তাকে খুব একটা দেখা যায়না। সারাদিন, রাতের অর্ধেক সময় সে থাকে কোথায়?

অয়ন্তি চোখ রাঙিয়ে আরশানের দিকে তাকালো।পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আরশান বুঝলো সে ফাঁসিয়ে দিয়ে কে’টে পড়েছে। আরশান সামাল দেওয়ার জন্য বলে,

-স্লিপ অফ টাং কুসুম। আমি ওটা মিন করিনি। আমি তো রোজকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য বলছিলাম। ট্রাস্ট মি আমি ঠিক টাইমে অফিসে যাই।

-এমনি এমনি এত বড় একটা কথা বলবেন? নিশ্চই কিছু আছে। আপনি আমাকে বাদ দিয়ে,

-একদম না। ট্রাস্ট মি, রোজ আমাকে ফাঁসানোর জন্য বলেছে। তুমি বিশ্বাস করলে ওটা?

-করলাম।

-কি জ্বালা।

-পানিশমেন্ট স্বরূপ আমার চুলের আটা ছাড়িয়ে দেন। তবে শর্ত আছে। শর্ত হচ্ছে চুল ছাড়া আপনার হাত আর কোথাও যাবে না। না ঘাড়ে, না গলায়, না গালে।

-তোমরা দুটোই ব’জ্জা’ত। রোম্যান্টিক মুডটাই খারাপ করে দিলা। (বিরবির করে)

-কি বললেন?

-বলছি কি, রোজের টিমমেম্বার আনার প্রয়োজন আছে তো। বোন’টা আমার কত করে চাচ্ছে। আমার একদম ইচ্ছে নেই, শুধু ওর জন্য? তুমি তো ওকে অনার স্থান দিয়েছো। অনা যদি চাইতো খালা ডাক শুনতে তুমি শোনাতে না?

-ওসব চালাকি আমার সামনে না।

-খ’চ্চ’র।

-কে?

-আমি। আবার কে? আসো আটা ছাড়িয়ে দেই।

রাতে ছাদে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করল রোজ। আরশানদের একান্ত কিছু সময় কাটানো দরকার। ঝামেলা দিয়েই বিয়ের দেড়বছর কাটিয়ে দিল। এখন যখন কুসুম সুস্থ তখন ওদের বৈবাহিক জীবনটাও স্বাভাবিক হওয়া প্রয়োজন। রোজ ছাদ ডেকোরেট করে ছাদের দরজায় তালা দিয়ে নিচে নেমে আসে। অয়ন্তি কেক সাজিয়ে রেখেছে। রোজ দ্রুত কেক কে’টে খাওয়া সম্পন্ন করলো। এরপর ওদের দুজনকে টেনে ছাদে নিয়ে আসলো। ছাদ পুরো অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। রোজ লাইট অন করে মোমগুলো জ্বালিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো আরশান অয়ন্তি হা করে চেয়ে আছে। রোজ এগুলো কখন করলো? সফেদ টেবিল, রেলিঙ-য়ে ফুলের সাঁজ, রঙবেরঙয়ের মরিচবাতি। আবার টেবিলের ওপর চাইনিজ ডিশ। রান্নাঘরও ক্লিন ছিল বিকেলে। তার মানে রোজ রান্নাঘর পরিষ্কার করে নিজে রান্না করেছে? অয়ন্তি টেবিলের সামনে আসতেই রোজ কঠিন গলায় বলে,

-ছোঁবে না। আমার হাতের সুস্বাদু খাবার তুমি ততক্ষণ খেতে পারবে না যতক্ষণ না তুমি দাদাইকে ভালোবাসার কথা বলো। তাও তুমি সম্বোধনে। আমার সামনে তুমিতে বলতে হবে। বাকি সময় নিজেদের ইচ্ছেমত ডাকবে। আমার আপত্তি নেই। কি দাদাই? তোমার আপত্তি আছে?

-না, না আমার আপত্তি কিসের। আমার হৃদয় কত বড় তা তো তোদের জানাই আছে। তোদের যা ইচ্ছে বল, আমি না শুনেই সব মেনে নেবো। তোদের সুখই আমার সুখ।

-মেলোড্রামাটিক দাদাই! বেয়াদব। এখানে আমার সুখ কোথায়? নিজের কথা নিজের মত করে বলবে। তোমারই তো বউ, নাকি পরের বউ? যে সরাসরি কথা বলতে পারো না।

-বুঝিস না ক্যান? রাত হচ্ছে। চেতালে বালিশ বিছানা আলাদা করে ফেলবে রাগে।

-তুলে আনবা। আমার ফুল সাপোর্ট আছে। তবে বালিশ আমার ভাইয়ের বক্ষস্থল হলে অন্য হিসেব। এবার দ্রুত বলো ভাবি।

ওদের কথা শুনে অয়ন্তি ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। রোজ অস্থিরচিত্তে উত্তেজিত হয়ে বলে,
-বলো ভাবি। আমি টয়লেটে যাবো। ইট্স আর্জেন্ট। কুইক ভাবি।

রোজ পেট ধরে দাড়িয়ে ছটফটানি শুরু করতেই অয়ন্তি চিন্তিত হয়ে আরশানের সামনে গিয়ে রোজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি। এবার যাও তুমি।তোমার কষ্ট হচ্ছে।

-উফ! আমার দিকে না। দাদাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলো। আমি তোমার ভালোবাসা দিয়ে কি করতাম? আমার জামাই ফিক্সড আছে। আমি সুদর্শন এক যুবক না মানে অভিনেতার ভালোবাসা অলরেডি পেয়ে গেছি। তাই সামনে তাকাও, দাদাইয়ের চোখে চোখ রেখে বলো, আমি তোমাকে ভালোবাসি আরশান। কুইক বলো। আমাকে যেতে হবে। কুইক ভাবি, জোর চেপেছে!

অয়ন্তি আরশানের চোখে চোখ রাখলো। নীলচোখে এই প্রথম দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে। আরশানের চোখমুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে রঙবেরঙ আলোর ঝলকানিতে আরও মোহনীয় হয়ে উঠছে সে হাস্যজ্জ্বল চেহারা। অয়ন্তি ধীর কন্ঠে বলে,
-আমি তোমাকে ভালোবাসি আরশান!

রোজ মৃদু হেসে বলে,
-ওয়ান মোর টাইম।

অয়ন্তি ঘোর লাগা কন্ঠে আবারও বললো। আরশান জবাবে নিজের ভালোবাসার কথা বলে অয়ন্তির কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। রোজ পুরোটা ভিডিও করে খাবারগুলো বেড়ে দিল। অয়ন্তি লজ্জা পেয়ে দ্রুত সরে দাঁড়ালো। আরশান বা’হাতে মাথা চুলকে লাজুক হাসে।অয়ন্তি প্রশ্ন করে,
-আমি করে নেবো। তুমি টয়লেটে যাও।

অয়ন্তির কথা শুনে আরশান রোজ দুজনেই শব্দ করে হেসে ওঠে। রোজ আরশানের ফোনে ভিডিও সেভ করে টেবিলের ওপর রেখে বলে,
-ওহ হ্যাঁ মনে ছিল না। যাচ্ছি আমি। খেয়ে নিও অনেক কষ্টে বানিয়েছি। কেমন হয়েছে জানি না, তবে একটু কম্প্রোমাইজ করো। নতুন নতুন চাইনিজ রান্না শিখছি তো। ওকে টাটা।

রোজ চলে যেতেই অয়ন্তি ভাবুকদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-এই না, ওর জোরে চেপেছিল? তাহলে সেটা ভুলে গেল কি করে?

আরশান বাঁকা হেসে বলে,
-বেবিও টের পেয়ে গেছে তুমি মহা বিরল জাতের বোকা। তাই তোমাকে বোকা বানিয়ে অভিনেতার প্রিয় নতুন অভিনেত্রী বউ ড্রামা করে তোমার মুখ দিয়ে এই দূর্ভাগা প্রেমিক বরটাকে ভালোবাসার কথা শোনার সৌভাগ্য করে দিল। এর জন্য ওকে দুটো সৈণ্য প্রদান করবো। এটা আমার প্রমিজ!

অয়ন্তি এবার বুঝলো রোজের নাটক। মেয়েটা এতো ফাঁজিল? আরশানের কথা শুনে সে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। আরশান তা দেখে আবারও বাঁকা হেসে বলে,

-অবশ্যই তা তোমার সম্মতিতে কুসুম। সো ডোন্ট ওয়ারি মাই লাভ।
#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_একুশ

সবার সামনে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে রোজ। আজ সে অফিসিয়ালি মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। ফিরে আসতে পারবে কিনা জানে না ও, তাই সবার সঙ্গে দেখা করে যেতে চায়। আরশানদের বাড়িতেই এসেছে সবাই। আরশান, আরসালান, ফারহানসহ ফারদিন, আমীর ও ফারিয়া আন্টি সোফায় বসে আছেন। বাকিরা দাড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। সবার একটাই কথা রোজ যেন থেকে যায়। রোজকে সুন্দর জীবন এরা উপহার দেবে। নষ্ট হয়ে যাওয়া বছর ও সবার সব ভুলের মাশুলও দেবে সবাই। রোজ সবার বক্তব্য শুনে ফিচেল হাসে। ফারহান এই হাসি আগেও দেখেছে। পরিচিত এই হাসিটা বিদ্রুপ করে হাসে রোজ। যখন মনে অনেক কষ্ট থাকে কিন্তু সে কষ্ট হেসে উড়িয়ে দিতে হয় তখন এভাবে হাসে রোজ। ফারহানের ভয় শুরু হয়ে গেলো। একজন চামচা যে সেবার নিখোঁজ হলো সে রোজের কাছে নয় তো? সব বলে দেয়নি তো? রোজ নিজেও সোফায় বসে বলতে শুরু করল,

-সবাই আমাকে কেন অনুরোধ করছো? এই কাজটা তো বাবা আমাকে দিয়ে গিয়েছেন। তাঁর অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দায়িত্ব তাঁর মেয়ের নয়?

ফারদিন সাহেব কোমল কন্ঠে বলল,
-সব বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি এভাবে যাবে না রোজ। দরকার হলে ফালাককে সঙ্গে নিয়ে যাও।

-কেন? ফালাক ভাইয়ার এ ব্যাপারে অনেক বেশি জ্ঞান আছে নাকি? গ্যাংস্টার, টেরোরিস্ট, ডিটেক্টিভ এগুলোর ওপর সে কি পি.এইচ.ডি করেছে?

-না করলেও নিয়ে যাও।তুমি একা গেলে আমাদের চিন্তা হবে।

-নিজের ছেলেকে কেন মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাচ্ছো আঙ্কেল? অপরাধবোধ, অনুশোচনা থেকে? তাহলে বাদ দাও সেসব। তোমাদের ওপর আমার কোনো অভিযোগ নেই।

ফারদিন সাহেব কেঁপে উঠলেন।রোজ ঠিক কি বোঝাতে চাইলো? ফারহানের চোখাচোখি হতেই বাবাছেলের দশা বেহাল হলো। দুজনেই ঘামছে। আরশান নিজেও কেমন নড়েচড়ে বসলো। অতিত বর্তমান জীবনের সকল কথা মনে পড়লো। অনুধাবন করতে পারলো সেই মেয়েটির কথা সে ছোট থেকেই ত্যাগ করা শিখেছে, অন্যকে কি ভাবে ভালো রাখতে হয়, ভালোবাসতে হয় শিখেছে। কি ভাবে সবাইকে এতগুলো বছর এক সুতোয় বেঁধে রেখে নিজেকে দূরে রেখেছে। আরশানের মনে পড়লো রোজ সবসময় ডায়েরি লিখতো আর বলতো,

”””’এই গল্পটা আমার দাদাই। কারন যে লেখে, যে সৃষ্টি করে সেটা তো তাঁরই হয়। তাইনা?কিন্তু গল্পটার হিরোইন বোধ হয় আমি নই। আমার গল্পে সর্বদা তুমি ও কুসুম লিড রোলে থাকবে। ফালাক ভাইয়া তো আমার সঙ্গে থাকার মানুষ। আমি হিরোইন না হলে সে এই গল্পের হিরো কিভাবে হবে? বাস্তবে সে অভিনেতা হলেও এই অসমাপ্ত গল্পের হিরো সে হবে না। কিছু না পাওয়া হিসেবের পাওনা পূর্ণতা পাবে তোমার জীবনে। আমার বা ওর জীবনে না। আমি না থাকলে তুমি আর কুসুম এই গল্পটা চলমান করে রাখবে। গড়িয়ে চলতে থাকবে গল্পটা যেমন গড়িয়ে যায় সময়। তোমার কুসুমকে আমি চিনি না। কিন্তু তোমাকে চিনি খাঁটি স্বর্ণ চিনতে ভুল হবে না তোমার। তাই আবারও বলছি আমাকে গুরুত্ব দিতে হবে না। এই গল্পের হিরোইন কুসুম, তাকে গুরুত্ব দাও। আমি নাহয় বিশেষ এক চরিত্রে থাকবো। বোন, বন্ধু, আনসারী ও রেণুর মেয়ে, ফালাকের চাঁদ, আঙ্কেলদের মেয়ে, অভীদের ফুপি হিসেবে। এতগুলো সম্পর্ক পেয়েছি আমি। এসবের সামনে সামান্য হিরোইন হতে চাইবে কে? আমি এটা ভেবেই শান্তি পাবো আমি না থাকলেও আমার রেখে যাওয়া গল্পটা থাকবে। তাঁর মূল চরিত্রগুলো থাকবে। তাদের স্মৃতি থাকবে, তাদের সকল কথা থাকবে। কিন্তু আমার এই গল্পে আমার, একান্তই আমার কাহিনিগুলো কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? যদি গল্পটা আমার হয় নিশ্চই পাবে। এই গল্পের শুরুটা যেমন তোমাকে, তোমাদের দিয়ে শুরু হবে তেমন শেষও তোমাদের দিয়ে হবে। আমি ডায়েরিতে লিখতে শুরু করেছি। শেষ হলে সবাইকে দেবো সেটা পড়তে। পড়বে তো তোমরা? নাকি ভুলে যাবে আমাকে? ‘হিরোইন ও হিরো পেলে কারোর তো এই রোজ বা ফালাককে মনে থাকবে না তাইনা? তাই ভাবছি আমি আমার ঘটনাও লিখবো। সবটা হিসেব করে লিখবো। পড়লে পড়বে না হলে রেখে দেবে স্মৃতি হিসেবে।”””

রোজের হাতে সেই ডায়েরিটা রয়েছে এখন। আরশান অয়ন্তির কানে ফিসফিসিয়ে ঘটনা’টা বলতেই অয়ন্তি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। নীল রঙয়ের কভার এই ডায়েরিটির। তার ওপরে গোটা অক্ষরে লেখা “আনসারী”। সম্ভবত এটা রোজের বাবার ডায়েরি যেটা আনসারী সাহেবের পর রোজ লিখতো। রোজ মৃদু হেসে বলে,

-আমাকে কি এমন দুঃখি মুখে বিদায় জানাবে তোমরা? তোমাদের এমন কষ্টে জর্জারিত মুখ দেখে গেলে আমার ফেরার ইচ্ছেটাই যে থাকবে না। তোমরা কি এটাই চাও? যদি চাও, রোজের ফেরার দরকার নেই। রোজ ফিরবে না।

ফারহান উঠে দাঁড়ালো। রোজ ভ্রুকুটি করে তাকায়। এই পাগল মানুষটাকে সামলানো কঠিন। আরশানের মতো সে হিসেব করে চলতে পারে না, ভদ্রতা, নম্রতা জানে না। লজ্জাশরমও নেই। সবার সামনে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরলে ওর থেকে নিজেকে কিভাবে ছাড়াবে রোজ? যে অভিমানগুলো সবার জন্য জমা হয়ে আছে তা সে সঙ্গে নিয়েই যেতে চায়। মনে কষ্ট থাকলে মনোবলটাও বাড়ে। ফারহান রোজের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে পড়লো শব্দ করে। আরশান আরসালান শব্দে উঠে পড়ে। এগিয়ে এসে ফারহানকে ধরারও ঝোঁক নেয়। কিন্তু তা ফারহান উপেক্ষা করে রোজের পা ধরতে যায়। রোজ দ্রুত পা টেনে নিলো। ফারহানের চোখ ভিজে আসে। সে কেঁদে উঠে বলে,

-তুই আমার ওপর অভিমান করে আছিস চাঁদ। আমি জানি, তুই আমি আমরা সবাই বদলে গেছি।কিন্তু এতটাও বদলে যাইনি যতটা বদল হলে তুই আমাকে তোর পা ধরতে দিবি না। তোর পা আমি এমনিও ধরতে পারি চাঁদ, এতে পাপ হবে না। তুই জেদ করে বলতিস তোর পা ধরে যেন মাফ চাই আমি। তখন আমি বলতাম, এতে পাপ হবে। আজ বলছি, পাপ হবে না। আমি নিজ থেকে তোর কাছে মাফ চাচ্ছি। তোর পা ধরছি, ছেড়ে যাস্ না আমাকে। আমি বাঁচবো না। তোর কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। তোর ওপর রাগ অভিমান করে ভুল করেছি আমি। সব ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করবো। যা বলবি তাই করবো। অভিনয় ছেড়ে দেবো। সকল প্রকার বিলাসিতা ছেড়ে দেবো। আমি শুধু তোকে নিয়ে থাকবো, তোকে নিয়ে থাকতে চাই। দেখ আমি আগের মত রাগ করিনা, রাগ করার মানুষটা তো থাকেইনা রাগ করবো কার ওপর? বাবা তুমি ওকে বলো না, আমার কাছে থাকতে। ও তোমার কথা ঠিক শুনবে।

রোজের চোখে পানি চলে আসলো। মানুষটা এভাবে কথা বললে রোজের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সব রাগ, অভিমান মিটে যায়। কিন্তু এবার তা হবে না। অভিমান জমা হতে হতে তা পাহাড় সমান হয়ে গেছে। এত সহজে তা মিটবে না। রোজ কানের ব্লুটুথ অন করে কাঠ কাঠ গলায় বলল,

-জি চাচ্চু। আসছি আমি, জিপ পাঠিয়ে দিয়েছেন তো? ওকে। না, আসেনি এখনও চলে আসবে, হয়তো রাস্তায় আছে। উহু, চিন্তা করবেন না, আমি টাইমেই চলে আসবো।

আমীর সাহেব নিজেও রোজের পাশে এসে বসলেন। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-আমাদের ওপর তোর এত অভিমান? কি করেছি সেটা তো বল। কোন কাজে কষ্ট পেয়েছিস? যে সবাইকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিস।

-আমি কাউকে ছেড়ে যেতে চাইনি আঙ্কেল। এমনও সময় এসেছে যখন সব ভুলে তোমাদের কাছে থাকতে চেয়েছি। ভেবেছি আমার বাবা-মামনি নেই তাতে কি? তোমরা আছো। কিন্তু সেখানেও আমি ব্যর্থ! আমার জীবন ব্যর্থতায় পূর্ণ আঙ্কেল। সুখ আমার জন্য যতটুকু বরাদ্দ ছিল আমি তা পেয়ে গেছি।এবার অসুখের ডাকে সাড়া দিতে হবে। তোমরা জানো আমি ভিন্নস্বাদের অনুভূতি ভালোবাসি। এটুকু ভালোবাসা নিয়ে যেতে দাও।

-আমরা কি তোকে ভালোবাসি না?

-ভালোবাসলে বিশ্বাস করতে হয়। ভরসা করতে হয়। আফসোস! আমি সবাইকে বিশ্বাস, ভরসা করলেও কেউ আমাকে করেনি। পৃথিবিতে প্রতিটা মানুষ স্বার্থপর এটা মানো বা না মানো। আমিও স্বার্থপর তাই তো শুধু নিজের সুখের জন্য চলে যাচ্ছি।

জিপগাড়ির আওয়াজ আসতেই রোজ ফোন ও পি’স্ত’ল হাতে উঠে দাড়ালো। চোখের পানি মুছে ডায়েরিটা সে আমীর সাহেবের হাতে তুলে দেয়। ফারহানের দিকে সে একনজর তাকিয়ে বলে,

-আমাকে যদি ভালো রাখতে চাও, তাহলে তোমার ওই আঁধারে নিমজ্জিত দুনিয়া ছাড়তে হবে। আমার কসম ভাইয়া! তুমি কখনও হাতে অস্ত্র তুলে নেবে না। কখনও না। জানি কসম দিতে হয়না, কিন্তু এটাও জানি আমার কসম তুমি অগ্রাহ্য করবে না। আমি ফিরে আসবো কিনা জানি না, তবে তোমরা যদি আমাকে দেওয়া কথা রাখো তাহলে ফিরে আসার চেষ্টা অন্ততো করবো। বিধাতাকে বলবো সে যেন আমাকে তোমাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়। নতুবা মৃ’ত্যুই সই।

রোজ চলে যেতে থাকলে ফারহান বার কয়েক চেঁচাল। রোজ পেছনে ফিরলো না।কারন যদি পেছনে একবারও তাকায় তাহলে সে যেতে পারবে না। রোজ জিপে উঠে চলে গেল। ফারহান মূর্তির ন্যায় বসে রইলো । আমীর সাহেব ডায়েরি খুললেন। কিন্তু কৌতুহলী অয়ন্তি ধৈর্য ধরে রাখতে না পেরে নিজেই নিয়ে পড়তে শুরু করে।

”বাবার প্রিন্সেসের জন্য বাবার তরফ থেকে ছোট্ট একটা গিফট”

”’ব্যাংকের কোড, টাকার হদিশ, মিশনের বর্ণনা, কে কেমন তাঁর বর্ণণা।”’

”’কখনও মন খারাপ করবে না। সর্বদা জানবে তোমার তিনটে বাবা, তিনটে মামনি। আমি যাচ্ছি তাতে কি? ওরা তো থাকবে। ওরা তোমাকে নিজের মেয়ের চেয়েও ভালোবাসে। ওদের কষ্ট দেবে না।ছোট থাকতে তুমি কত ভুল করেছো, অন্যায় করেছো। ওরা তা আপন ভেবে নিয়েছে তাই কখনও ওদের কাছ থেকে কষ্ট পেলে তা মনে রাখবে না। ওরা যা বলবে তাই শুনবে। ওকে?”’
‘ঠিক আছে বাবা’—রোজ💙

”’কষ্ট পেলে প্রকাশ করবে না। কারন কেউ একবার তোমার দূর্বলতা জানলে তোমাকে নিঙড়ে ফেলতেও দু বার ভাববে না। এ জগৎ ভীষণ অদ্ভুত! তাই সর্বদা সচেতন থাকবে। কষ্ট পেলে রেণুকে অথবা ফালাককে বলবে। কষ্ট ভাগ করে নিলে তা কমে যায়। ”’
‘কেউ তো নেই বাবা। আমি তো বড্ড একা।’—-রোজ💙

”’বড় হয়েছো। সময় পাল্টাচ্ছে। চোখের সামনে যেসব ভাসমান আবেগ, রঙিন দুনিয়া দেখতে পাচ্ছো তার ঠিক ভুল বুঝতে শেখো। কারো দুটো মিষ্টি কথা শুনেই গলে যাবে না।রেণু অবশ্য এসব বলতো তোমাকে। কিন্তু আমি নিজেই বলে রাখছি, তুমি তো জেদি অনেক যদি মামনির কথা না শোনো? আমার কথা তুমি ফেলতে পারবে না আমি জানি। ”’
‘জেদ নেই বাবা। আমি এখন খুব করে মামনিকে চাই। তাঁর বকা খেতে চাই, দুষ্টুমি করতে চাই। কিন্তু দায়িত্ব ও একাকিত্বের বেড়াজালে আমার সেসব ইচ্ছে চাপা পড়ে গেছে। আমি খাঁচার বন্দি পাখি হয়ে গেছি যেটা আমি কখনও চাইতাম না। ‘—-রোজ💙

এমন আরও ছোট ছোট কথোপকথন আছে আনসারী সাহেব ও রোজের। কয়েকপৃষ্ঠা সামনে যেতেই ছেড়া পাতার আভাস পাওয়া গেলো। এই কাগজগুলো রোজ ছিড়ে ফেলেছে। শেষের দিকে আবারও লেখা।

💙আমীর আঙ্কেল💙
তোমার ব্যাপারে যত বলবো ততই কম। শুধু এটুকুই বলবো, ইউ আর দ্যা বেস্ট চাচ্চু! তোমাকে কখনও চাচ্চু বলে ডাকিনি । ভেবেছিলাম ফিরে এসে ডাকবো। কিন্তু আমার ভাগ্য মনে হয় ওতটাও ভালো নয়। যাই হোক লাভ ইয়্যু চাচ্চু!

💙দাদাভাই💙
তুমি বড্ড খারাপ দাদাভাই। ভাবিকে শুধু রাগিয়ে দাও। জানো না, ভাবি তোমার থেকে কষ্ট পেলে কাঁদে। আমার মিষ্টি ভাবিটাকে কাঁদিয়ে তুমি অন্যায় করো। তাকে আর রাগাবে না। আজই অতিতের সকল ভুলের জন্য মাফ চাইবে। ঠিক আছে? অভী অয়নকে একদম বকবে না। ওরা এখন দুষ্টুমি করবে না তো কখন করবে? আমি চাই না আমার মত কেউ ছেলেবেলার আনন্দ হারাক। ওদের পড়া ওরা ঠিক করবে। ওদের সঙ্গে তেমন ডিল হয়েছে আমার। তাই ওদের বকাবকি করবে না, আমি দেখেছি তুমি ওদের খুব বকা দাও, এভাবে বকলে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে অসুবিধা হয়। ওদের সঙ্গে ঠান্ডাভাবে কথা বলবে। অফিসের কাজ অফিসে ফেলে আসবে। সেটা টেনে বাড়িতে আনবে না। চাচ্চুর খেয়াল রাখবে, চাচ্চু রাতে অতিতের কথা মনে করে কাঁদে, আমি প্রায়ই রাতেই চাচ্চুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছি। তাকে কখনও একা রাখবে না, একাকিত্ব মানুষের সকল অনুভূতিকে গ্রাস করে ফেলে। অসহায় করে তোলে। রজনী ভাবির ফুল পছন্দ। রোজ রাতে ফেরার পথে তাকে রোজ দেবে উপহার স্বরূপ। তিন বাচ্চার বাপ হয়েছো বলে স্বামীর রোল থেকে বেড়িয়ে গেলে চলবে না। বুঝেছ? তোমাকে মিস করবো খুব দাদাভাই। লাভ ইয়্যু!

💙রজনী ভাবি💙
আমার বোনের থেকেও বেশি তুমি। মামনির পরে তুমি আমাকে যতটা স্নেহ দিয়েছো তেমনটা সবাই পারেনা। অনেকে ননদকে পছন্দ করে না। চোখের বালি ভাবে। সেখানে তুমি সর্বদা দাদাই, ফালাকের থেকে আমাকে বেশি ভালোবেসেছো। এমন অনেক সময়ও দেখেছি তুমি নিজের সন্তানদের থেকে আমাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছো। কিভাবে মায়ের ভূমিকা পালন করতে হয় তা তোমার থেকে শেখা উচিত। আমার গল্পে তুমি একটা দায়িত্বশীল, মমতায় ঘেরা চরিত্র! তোমার তেমন কথা লেখা নেই গল্পে তবে জ্বরের রাতের আবছা ঘটনাগুলো লিখেছি। অভীকে ধমকানোর মুহূর্তটুকুও লিখেছি।মূলত তোমাদের সবার কথাই কিছু কিছু লিখে রাখলাম।যখন পড়বে তখন আমার কথাও মনে পড়বে। পড়বে তো? তোমার স্নেহময় ভালোবাসার কথা মনে পড়বে আমার। সবাইকে নিয়ে ভালো থেকো, ভালোবাসি ভাবি।

💙ফারিয়া আন্টি💙
তোমাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাইনা? তবুও মুখ বুজে আমার সব জ্বালাতন সহ্য করেছো। ভেবেছিলাম মামনি ডাকটা তোমার জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু সময় সুযোগ হলো না। তোমার ছেলের বউ না হয়ে কি তোমাকে মামনি ডাকা যাবে না? আমি জানি তোমার উত্তর। তুমি মেয়ে হিসেবেই চাও আমাকে। ছেলের বউ হিসেবে না। তাই মেয়ে হয়েই বলছি। মামনি হিসেবে তোমাকে পেয়ে তৃপ্ত আমি। লাভ ইয়্যু মামনি।

💙দাদাইয়ের কুসুম💙
তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সময়কাল অতিস্বল্প। তবুও তোমার সঙ্গে আমার ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে সাধারনত সবার সঙ্গে আমি মিশতে পারিনা। ভালো লাগে না। তবে তোমার সঙ্গ আমার ভালো লাগতো। আমাকে তুমি তোমার অনাপির জায়গা দিয়েছো তার জন্য কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। জানো আমি ছোটবেলায় বলতাম আমার শুধু ভাই (দাদাই, দাদাভাই) আর বন্ধু আছে। কোনো আপু নেই। আমার আপু থাকলে তাকে আমি হীরামন বলে ডাকতাম। রূপকথার হীরামনকে জানো? যে সুখের সংবাদ নিয়ে আসতো, বিপদ থেকে রক্ষা করতো। অবশ্য তুমি তেমনটাই, আমার দাদাইয়ের বিপদের ঢাল। তার সুখ, ভালোবাসা। আমার গল্পের প্রধান চরিত্রের একটা ডাকনাম থাকা উচিত। দাদাই তো তোমাকে কুসুম ডাকে। আমি না’হয় হীরামন দিলাম। মিস ইয়্যু হীরামন। অল্পদিনেই ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। সাবধানে থাকবে, নিজের যত্ন নেবে আর আমর দাদাইকে অনেক অনেক ভালোবাসবে।

💙দাদাই💙
তোমাকে কি লিখবো? বউ পেয়ে যে বোনকে ভুলে যায় তাঁর মত মানুষকে নিয়ে রোজ লিখতে পছন্দ করে না। তবে পুরো দোষটা তোমারও না। কুসুমকে এতো কষ্টে পেয়েছো তাই ওকে নিয়ে তোমার বেশি ভয় থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার গল্পের হিরোগুলো কেন এত স্বার্থপর? ফালাকের কথায় পরে আসছি। আগে তুমি বলো, সেদিন এক্সিডেন্টে যদি আমি টপকে যেতাম? তোমার বউয়ের জন্য, তোমার বউকে সুস্থ করার জন্য এত বড় একটা রিস্ক নিলাম আর তুমি? শেষে কিনা আমাকেই দোষারোপ করলে? খুব খারাপ এটা। আমি তোমার আর কুসুমের সব কথা শুনতে পাই কারন কি জানো?কুসুমের কানের দুল আর তোমার ঘড়ি যেগুলো আমি গিফট দিয়েছিলাম, যেগুলো তোমরা সারাক্ষণ পড়ে থাকো তাতে ছোট্ট ছোট্ট দুটো চিপ আছে যার শব্দতরঙ্গ আমার ফোনে প্রতিটা মুহূর্তে সাপ্লাই হতো। ওর মাধ্যমেই তোমাদের ভালো মন্দের খোঁজ রাখতাম আমি। দূরে গিয়ে একা থাকলেও তোমাদের চিন্তা বেশি বৈ কম হতো না। তাই স্যরি! গোপন অনেক কথা জেনে গেছি। সেগুলো আমার গল্পে আছে। ডায়েরি পড়লে জানবে। তোমাদের ক্যাফের দেখা, বাসর ঘরের ফার্স্ট সীন, গাড়িঘোড়ার সিন, বাথরুমের সিন! তোমরা যখন অনেক বছর পর এগুলো কিছু কিছু ভুলে যাবে তখন সবটা মনে করানোর জন্য লিখে রাখলাম। তোমাদের কথাগুলো ভোলা যাবে না, ভুলতে দেওয়া যাবে না। কারন তো জানোই, আমার গল্পের সবথেকে প্রিয় ও জাদুর জুটি তোমরা। প্রণয়ের পূর্ণতার দর্শন তোমরা। আমার অসমাপ্ত জীবনের পরিপূর্ণ কাহিনি তোমরা। তবে তোমার কিছু কিছু কথা আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে, যেমন রেডিও সেন্টারের ঘটনা, হসপিটালের ঘটনা। তবে সেটা ধরার মধ্যে পড়ে না। সব প্রিয়দের ওপর অভিমান করতে নেই। লাভ ইয়্যু দাদাই, সবাইকে বিশেষ করে কুসুমকে ভালো রেখো। ভালোবেসো।

💙বাচ্চারা💙
আমি যে ফ্লাটটা কিনেছি সেটা আর আমার স্কুটার, বাইক অভী অয়নকে দেবে। অভীরা ট্রাভেল পছন্দ করে।
বাবা আমার জন্য প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জমিয়ে রেখে দিয়েছিলেন ব্যাংকে। আমি না থাকলে টাকাগুলো শুধু ইন্টারেস্ট পেয়ে বৃদ্ধি পাবে। আমি চাই ট্রাভেলের খরচ ওখান থেকে হোক। আর বাকি টাকা দাদাইয়ের বেবি ও রোশনির জন্য।
আমার আমানতগুলো ওদের বুঝিয়ে দেবে।

💙ফারদিন আঙ্কেল💙
তোমার কথা মনে পড়লে কেন জানি না বুক চিরে এক বিশ্রি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে আঙ্কেল। তুমি আমাকে কখনও মেয়ে মনে করোনি। আমাকে ঠকিয়েছো তুমি। তোমাকে আমি বাবা মনে করতাম। ইভেন বাবা বলেও ডেকেছি। সেই তুমি আমাকে বিশ্বাস করলে না, ভরসা করলে না।তোমার মনে হয়? আমি তোমাকে খু’নি ভাববো? যে যা বোঝাবে তাই বুঝবো? তুমি দিনের পর দিন ফালাকের মত অভিনয় করে গেছো। এসব করে কি পেয়েছো? যদি একবার আমাকে কাছে ডেকে সবটা বলতে আমি টু-শব্দ করতাম না। সেই তুমি আমার থেকে সত্য গোপন করে দিনের পর দিন নতুন নতুন মিথ্যে বলেছো। একটা মিথ্যে ঢাকতে কতগুলো মিথ্যে বলেছো, এটা ঠিক না। তুমি জানো আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু মিথ্যে? বাবা আমাকে মিথ্যে বলার বা প্রশ্রয় দেওয়ার শিক্ষা দেয়নি। তোমার ওপর আমি রাগও করতে পারিনা। তবে দূরে যেতে নিশ্চই পারবো। নিজেকে অপরাধি মনে করে চলাটা তোমার বোকামি। আমি জানি আমার বাবা আমার পরিবার কাউকে তুমি সামান্য কষ্টটুকুও দিতে পারবে না। এজন্যই মিথ্যে বলেছো। ইরফান তোমার ভাই সেজন্য কথা লুকিয়েছো। ইরফান বাবাকে মে’রেছে জানার পরও তুমি আমার সুরক্ষার জন্য আমার থেকে দূরে থেকেছো। এটা কতটুকু যুক্তিসংগত? আমার নিরাপত্তা তোমাদের কাছে ছিল, তোমাদের থেকে দূরে নয়। যাক বিষয়টা জটিল নয়, তাই আমি এটা পেঁচিয়ে জটিল করতে চাইনা। ইরফান আমার বাবাকে মে’রে ভুল করেছে সেই ভুল আমি সংশোধন করবো। তোমার ওপর আমার কোনো রাগ, অভিমান বা অভিযোগ নেই। তোমাকে আগে যেমনটা ভালোবাসতাম এখনও তেমন ভাবেই ভালোবাসি। শুধু একটু মন খারাপ ছিল কিন্তু তোমার পয়েন্ট অফ ভিউ বুঝতে পেরে সেটাও মিটে গেছে। তোমরা খুব ভালো বাবা! খুব ভালো! আমাকে মিস করবে না, ফালাক ভাইয়ার ওপর নজর রাখবে সে যেন কোনো খারাপ কাজ আর না করে। বুঝেছ? মনে রাখবে,রোজ কিন্তু বড্ড জেদি আর অভিমানি। রোজের কথা না শুনলে রোজ কষ্ট পাবে।

💙সবার উদ্দেশ্যে💙
আমি ছোট, অনেক জ্বালিয়েছি তোমাদের। অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার ভুলগুলো, আমার দেওয়া কষ্টগুলো মনে রেখো না। আমি নিজের কথা ভেবেই চলে যাচ্ছি। স্বার্থপরের মত কাজ করছি। এছাড়া উপায় ছিল না। ইরফান আমাকে চায়,আমি ধরা না দিলে ওরাও সামনে আসবে না।আর ওরা সামনে না আসলে আমি নিজেকে তিল তিল করে যে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তৈরি করেছি তা পূর্ণতা পাবে না। সবাই যেমন আমাকে ভালোবাসো আমিও তোমাদের ভালোবাসি, বড্ড বেশি ভালোবাসি। নিজেদের খেয়াল রাখবে, শরীরের যত্ন নেবে। আমি যদি বাবার মত পরিণতি পাই তাহলে আমার লা’শটা বাবা আর মামনির মাঝে দেবে। আমি জায়গা ঠিক করে রেখেছি।

অয়ন্তি পড়া থামালো। আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলল,
-এরপর?

অয়ন্তি ডায়েরি বন্ধ করে ফারহানের হাতে দিল। মুখে বলল,
-“এবার শুধু ফালাকের উদ্দেশ্যে লিখছি।এটা শুধু তাকে পড়তে দিও। এটা শুধুমাত্র তাঁর জন্য। অন্যকেউ এটা পড়ুক সেটা চাইনা আমি। নিজের একান্ত কথাগুলো শুধু তাকেই জানাতে চাই।”

💙ফালাক💙

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here