তুই হবি শুধু আমার পর্ব -১৮+১৯

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_আঠারো_ও_উনিশ

-কুসুম আমার টাই কোথায়? ওয়ালেট পাচ্ছি না। আমার মোজা কোথায়?

চেঁচামিচিতে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলল আরশান। নিচে রান্নাঘরে রান্না করছিল অয়ন্তি। আরশানের চেঁচামিচি শুনে সবাই মিটিমিটি হাসছে। অয়ন্তি তো সব খাটের ওপরই গুছিয়ে রেখে এসেছে। তাও চেঁচাচ্ছে কেন? ভারি অদ্ভুত তো। রজনী ঠোঁট টিপে হেসে বলল,

-দেবর আমার ভারি অলস অয়ন্তি। তাকে শুধু দেখিয়ে দিলে হয় না। পড়িয়েও দিতে হয়। তুমি যাও আমি বাকি রান্নাগুলো করে নিচ্ছি।

অয়ন্তি চোখ বড় করে তাকাল। কথার অর্থ বুঝতে ওর কিছুটা সময় লেগে গেলো। লোকটা ভারি অসভ্য। কি মনে করল সবাই? লজ্জায় অয়ন্তি নড়তেও পারছে না। বুয়ারাও হাসছে। এমন সময় অভি এসে দরজার পাশে দাড়িয়ে বিজ্ঞ গলায় বলে,
-চাচ্চু ডাকছে। তাঁর বোধ হয় মন টাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।

কি সাংঘাতিক বাচ্চা। দশ বছরের বাচ্চা এত পাঁকা হয়? রজনী চোখ রাঙালো ছেলেকে। কিন্তু অভী তা পাত্তা না দিয়ে বলে,
-চিল মামনি! ফুপি আমাকে গ্রুম করেছে। এসব বোঝা আমার কাছে ডালভাত।

-ফুপি গ্রুম করেছে? ভুগোল বোঝাচ্ছিস? মেরে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো। আজ থেকে তোর টিভি দেখা বন্ধ। পড়া শোনায় তো পাওয়া যায় না, অথচ পাঁকা পাঁকা কথায় ঠিক আগে চলে আসিস। যা টেবিলে গিয়ে বস।

-ছোটমা লজ্জা পাচ্ছে বলে আমাকে ঝারছো? ইটস নট ফেয়ার মামনি।

-যাবি নাকি খুন্তিপেটা করবো?

-যাচ্ছি, যাচ্ছি। কিন্তু ছোটমা তুমি যেন চাচ্চুর ঘরে যেতে ভুলে যেওনা।

অভী চলে যাওয়ার পর অয়ন্তি লজ্জায় আরও নুইয়ে পড়লো। রজনী হেসে বলে,
-অয়ন্তি রোশনির ফিডারটাও নিয়ে যাও। ওর গালে তুলে দিলেই ও একা একা খেতে পারবে।
-জি ভাবি।
-লজ্জা পেতে হবে না। আমি তোমার বড়বোনের মত। বাঁদরটা তোমাকে অনেক জ্বালাচ্ছে তাইনা? ও কিছু ভুল করলে আমাকে বলবে। আম্মা আমাকে ওর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন। প্রয়জনে মে’রে সিধে করে দেবো।
-আচ্ছা।
-যাও।

রোশনিকে ফিডার দিয়ে ঘরে আসলো অয়ন্তি। আরশান আয়নার সামনে চুল ঠিক করছিল। অয়ন্তিকে আয়নার মাঝে দেখে সে দুষ্টু হাসে। অয়ন্তির চেহারায় কপোট রাগ ফুটে আছে। অয়ন্তি তেড়ে এসে আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বলল, ‘এই, কি সমস্যা আপনার? সব তো গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। তবুও চেঁচালেন। সবাই কিসব ভাবছে। অভিটাও ‘ আরশান অয়ন্তির আঙ্গুলে টুপ করে চুঁমু খেয়ে বলে,
-অভীকে তো আমিই পাঠালাম। যাক, ছেলে কাজের আছে।
-আপনি?
-হ্যাঁ।
-মহাঅসভ্য।
-ধন্যবাদ। এবার টাই বাঁধো জলদি।
-এতদিন কে বেঁধেছে?
-আমি। কেন?
-তো আজও নিজে বেঁধে নিন।
আরশান অয়ন্তির কোমর পেঁচিয়ে ধরে ফিসফিসিয়ে কলল,
-এতদিন বউ ছিল না বলে নিজে বেঁধেছি। এখন বউ আছে। তাহলে কষ্ট করতে যাবো কেন?
-কখন ফিরবেন?
-কেন মিস করবে? তুমি বললে আমি আজ বাড়িতেই থাকতে পারি। যাওয়ার মুড নেই।
-মোটেও না, আমি একটু বাড়িতে যাবো। বিকেলে ফিরে আসলে ভালো হয়।
-চলে আসবো। রেডি হয়ে থেকো।
-বলছি, অরুপির মেয়ের জন্মদিন। গিফট নিতে হবে।
-কি আনবো?
-খেলনা, জামা-কাপড়, চকলেট।
-ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তুমি গিয়ে নিয়ে এসো। ওসব পছন্দ করতে পারিনা আমি। আর হ্যাঁ সাবধানে যাবে। ওকে?
-হুম।
আরশান এগিয়ে এসে অয়ন্তির কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
-আসার সময় ডক্টরের সঙ্গে মিট করে আসতে হবে।ফ্যামিলি প্লানিং , তোমার হেলথ কান্ডিশন নিয়ে কথা বলতে হবে। হসপিটালে চলে যেও।
-আপনি আসবেন না? আমি একা যাবো?
-তুমি গিফট কিনতে কিনতে চলে আসবো আমি।
-ঠিক আছে।

_________

সোনালী ব্যাংকের সামনে দাড়িয়ে আছে রোজ। লকারে বাবার গুরুত্বপূর্ণ কাগজ আছে সেগুলো নিতেই এসেছে ও। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো অন্য জায়গায়, ডি.আই.জি ইরফানের চামচাগুলো রোজকে খুজে বের করে নজর রাখতে শুরু করেছে। ব্যাংকে ঢুকলেই বুঝে যাবে কিছু একটা আছে ব্যাংকে। রোজ ব্যাংকের সামনে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। ফারহানের সঙ্গে সেদিনের পর আর কথা হয়নি। সাতমাস হয়ে গেল। ফারহানের নতুন মুভির শ্যুটিং শুরু হয়েছে। রোজ ফোন বের করে সেলফি তুললো বেশ কয়েকটা। যারা ওর ওপর নজর রাখছিল তারা থতমত খেয়ে একে অন্যের দিকে তাকায়। কি করছে রোজ? সেলফি তুলে রোজ পকেট থেকে টাকা বের করে পথের ভিখারিদের দিয়ে চলে গেল। চামচাগুলো ভাবল ওদের সঙ্গে রোজের লিংক আছে। তাই ছুটে এসে ওদের জেরা করতে থাকে। কিন্তু কিছু জানতে পারলনা। জানবে কি করে? রোজের সঙ্গে তো ওদের কোনো সংযোগ নেই। রোজের সংযোগ তো ব্যাংকের সাথে। তাই সামনের গেটে গন্ডোগোল করে রোজ পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে গেলো। লকারের পাসওয়ার্ড জানে রোজ। তাই ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলেই সে লকার থেকে সকল জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পথে সে দেখলো, চামচাগুলো এখনও ভিখারিদের মা’রছে। রোজ পুনরায় গিয়ে ধমকিধামকি দিয়ে উঠতেই ভিখারিরা বলে দিল ওরা রোজের খোঁজ করছে। রোজ ভ্রু কুঁচকে বলে,
-আমার খোঁজ করছিলেন কেন? আর ওনার সঙ্গে কি কাজ থাকবে আমার? আমি তো যাস্ট টাকা দিলাম। কিন্তু কথা সেটা না,কথা হচ্ছে আপনারা আমাকে ফলো করছেন কেন? কিসের জন্য? কার কথায়?

-স্যার আপনার নিরাপত্তার জন্য আপনার ওপর নজর রাখতে বলেছে ম্যাডাম।

-নিরাপত্তা? তাহলে এদের জেরা করছেন কেন? কাহিনি কি? কোন স্যার?

-স্যরি ম্যাডাম।

লোকগুলো দ্রুত বাইকে উঠে পড়তেই রোজ অসহায় ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে ডাকে,
-আরে কি অদ্ভুত! বলে যাবেন তো কোন স্যার? কে আমার নিরাপত্তার জন্য পাঠিয়েছে? এই যে…

ওরা দ্রুতবেগে চলে যেতেই রোজ স্মিত হাসে। পাশের ভিখারিদের সামনে গিয়ে দশ হাজার টাকার দুটো বান্ডিল দিয়ে বলে,
-ধন্যবাদ। আপনাদের জন্য আমার কাজটা হয়ে গেছে। এটা রাখুন, ভালো পোশাক কিনবেন, জুতো কিনবেন, খাবেন। ঠিক আছে?

-আল্লাহ তোমার ভালো করুক মা। তুমি যা চাও তিনি যেন তোমাকে তাই দেয়।

-দোয়া করবেন চাচা।

রোজ উঠে পকেটে হাত গুজে দাড়ায়। পেনড্রাইভটা সে পকেটে রেখেছে। এটা খুব শীগ্রহই আই.জি সাহেবের কাছে পাঠাতে হবে। উনি ডিপার্টমেন্টের একজন সৎ ও বিশ্বস্ত মানুষ। বাবার মুখে তাঁর প্রশংসা অনেক শুনেছে রোজ। কিন্তু এখনই পেনড্রাইভটা পাঠালে টাকাগুলো তোলা কঠিন হয়ে যাবে।যে একশকোটি টাকা আনসারী সাহেবের নামে আছে সেই টাকার হদিশ এই পেনড্রাইভে আছে। রোজকে সেটা খুজে টাকাগুলো ট্রান্সফার করে নিতে হবে নিজের এ্যাকাউন্টে তাহলে টাকাগুলো অন্য হস্তে চালান হতে পারবে না। কিন্তু এতগুলো টাকা তো ট্রান্সফার করাও কঠিন। যেহেতু রোজের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তাই ট্রান্সফারের সময় কাজে বিঘ্ন ঘটবে। রোজ নিজের পরিচয়ে আনবে টাকা? না, তাতে ইরফান সাহেবের নজরে পড়ে যাবে টাকা। আর উনি তো লালা ফেলে টাকার প্রত্যাশায় আছেন। টাকাগুলো রোজ বেহাত হতে দেবে না।

আড়াই বছর হতে চললো রোজের এই গোপনীয় জীবনের। টাকাগুলোর জন্য হলেও এবার ওকে সামনে আসতে হবে। কিন্তু জকি হিসেবে নয়, নতুন কোনো পরিচয়ে। আর পরিচয়টা জনপ্রিয় হতে হবে। কি পরিচয়? অভিনয় রোজের দ্বারা হবে না, হলে ফারহানের সাহায্য নেওয়া যেতো। রেডিও সেন্টারে রোয়েন তালুকদার এসেছিল, উনি রোজের কন্ঠ শুনে প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন অনুশীলন করলে সে গান গাইতে পারবে। রোজের কি এটা ভাবা উচিত? কিন্তু পরিচিতি পেতেও তো সময় লাগবে। রোজের কন্ঠ সুস্পষ্ট, টিউন, কথাগুলোও দারুন। এজন্যই তো জকি হিসেবে দারুন পাবলিসিটি পেয়েছিল। রোজের কি উচিত হবে এই প্রফেশনে আসা? রোজ রাগে থরথর করে কাঁপছে। এই প্রফেশনে আসলেও তো দশকোটির উপরে ইনকাম হবেনা তাহলে বাকি নব্বই কোটির হিসেব কিভাবে মেলাবে? হাতে তো বেশি সময়ও নেই। আর রোজের দ্বারা গান হবে কিনা সে ব্যাপারেও তো রোজ নিশ্চিত না। যদি গান না হয়? প্লান বি রেডি করে রাখতে হবে। নাকি কোনো হ্যাকার এ্যাপোয়েন্ট করবে। কিন্তু এটা তো বেআইনি! ধরা খেলে টাকাও যাবে, আর ওরাও।

রোজ বাড়ি ফিরে দেখলো সোফার কোনায় রাখা ছোট এ্যাসিডের শিশিটা পড়ে সোফা পুড়ে গেছে। রোজ হাতে গ্লাভস পড়ে পড়ে শিশিটা উঠিয়ে বন্ধ করল। এমনিতেই ওর মাথা কাজ করছে না টেনশনে, তার ওপর এমন বিরক্তিকর ঘটনা। রোজ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে গ্লাসে পানি ঢালে। পানি খেতে খেতে সে ভাবছে কি করা যায়। টার্ম এক্সাম সামনে মাসে। পড়া সব শেষ হলেও চিন্তা একটা থেকেই যাচ্ছে। পাঁচ বছরের কোর্স শেষ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ওকে। তিনবছরের কোর্সটা করতে পারলো না স্নাতক পাশ না করার জন্য। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে অনার্সে চার বছর প্লাস জার্নালিজমে তিন বছর, মোট সাত বছরের চেয়ে পাঁচ বছরের কোর্স বেশি উপোযোগী। রোজ ফোন ঘাটতে ঘাটতে টিভির দিকে তাকালো। দেশে নির্বাচন নিয়ে ঘটা সমাবেশের আয়োজন চলছে।রোজের সব চিন্তা নিমিষে মিটে গেল। পত্রিকা থেকে রোজকে রিপোর্ট তৈরি করতে বলা হয়েছিল। সেটা তৈরির করার সময় এসেছে। রোজ আজই ফিরবে ঢাকায়। আড়াই বছরের অপেক্ষার ফল যে মিষ্টি হতে চলেছে।

_______________

হসপিটালের সকল চেক আপ শেষ করে বাড়ি ফিরছে আরশান’রা। অয়ন্তি ঘুমাচ্ছে ওর কাঁধে মাথা রেখে। আরশান ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ির ধাক্কায় অয়ন্তির ঘুম ভেঙে যায়। খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছে সে। অস্পষ্ট পুরোনো স্বপ্নটা। যেটা মনে পড়লে অয়ন্তির শরীর খারাপ করে। মাথা যন্ত্রণায় ছিড়ে যায়। অয়ন্তি হাউমাউ করে কেঁদে উঠতেই গাড়ি থামাল আরশান। অয়ন্তির সমস্যা বুঝতে পেরে সে অয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে অয়ন্তির মাথায় হাত বুলাতে থাকে।
-কিচ্ছু হয়নি কুসুম, দেখো কোনো র’ক্ত নেই। কেউ নেই। আমি আছি তো। ভয় পায় না, কাঁদে না। কান্না থামাও কুসুম। কষ্ট হবে পরে।

-অনাপি, অনাপি।

-হু, হু।কথা না। চুপ করো। কিচ্ছু হবে না তোমার। কিচ্ছু না। আমি আছি না? তোমার কিছু হতে দেবো না আমি।

অয়ন্তি আরশানের শার্ট খামচে ধরে। আরশান এসি অন করে দিল। গরমে, ভয়ে ঘামে-নেয়ে একাকার মেয়েটা। আরশানের ফোনে ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজটা চেক করতেই শুনলো পরিচিত কন্ঠটি। রোজের কন্ঠ। অয়ন্তি কান খাড়া করে শোনে,
-কেমন আছো? ভাবি কেমন আছে? বাড়ির সবার কি খবর? রোশনির ঠান্ডা কমেছে? ভাবির পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু না?তাকে আমার হয়ে অল দ্যা বেস্ট বলে দিও দাদাই। টাটা!

আরশান ম্যাসেজের রিপ্লাই দিয়ে যখন নতুন ম্যাসেজ লিখবে তখনই দেখলো ম্যাসেজ সেন্ট হচ্ছে না। যার অর্থ রোজ সিম বন্ধ করে ফেলেছে।কিন্তু রোজ জানলো কি করে রোশনির ঠান্ডা লেগেছে? এমনকি ওদের প্রতিটা খবর রোজের কাছে যায়। কিভাবে? অয়ন্তির কান্না থেমে গেল। প্রশ্নসূচক দৃষ্টিপাত করে সে বলে উঠল,

-রোজ সব খবর পাচ্ছে কি করে? আমাদের আশেপাশে কি থাকে ও? আমরা পাইনা কেন ওকে?

আরশান নিজেও জানে না এই প্রশ্নের উত্তর। কিন্তু এই মুহূর্তে এসবের থেকে অয়ন্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাই সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে,
-এখনও কষ্ট হচ্ছে? শ্বাস নাও। কথা বোলো না। (বেবির টাইম সেন্স এত ভালো? ঠিক টাইমে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে নাহলে কুসুমকে সামলানো কঠিন হতো। কিন্তু সবকিছু টের পাচ্ছে কিভাবে ও? আমাদের বৈবাহিক জীবন থেকে শুরু করে, আশাপাশের সকল ঘটনা সম্পর্কে ও অবগত। কে দিচ্ছে খবরাখবর?)

অয়ন্তি চুপচাপ আরশানের বুকের মাঝে ঘাপটি মে’রে পড়ে রইলো। কিন্তু রোজের কাহিনিগুলো একটু অদ্ভুত ধাঁচের। অয়ন্তির মাঝে মাঝে রোজকে প্রহেলিকা মনে হয়। কেমন জটিল ধাঁধার মত! ওদিকে আরশানের মনে অয়ন্তির চিন্তা। অয়ন্তির মাথার স্কান পাওয়া গেছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ওর স্মৃতিতে। অয়ন্তির মন মস্তিষ্কে দূর্ঘটনার স্মৃতি চেপে বসেছে। সেটা দূর করতে হবে। কিন্তু এর প্রপার সলুশনও তো নেই। ডাক্তাররা যা বলছে তা করা অসম্ভব। দ্বিধা-দোটানা নিয়ে আরশান অয়ন্তির প্রাণের ঝুঁকি নেবে না। বাড়ির সবারও একই মত। কেউ সাহস পাচ্ছে না, কারোর সাহস নেই অয়ন্তিকে নিয়ে ভয়ঙ্কর কাজটা পরীক্ষা করা।

___________

শ্যুটিং শেষ করে বিশ্রাম নিচ্ছিলো ফারহান। ঠিক তখন রোজের ভয়েস ম্যাসেজ আসলো। ফারহান ম্যাসেজ চেক না করেই সরাসরি কল দিল। রোজ রিসিভ করে মুচকি হাসে। মানুষটা অতিমাত্রায় চালাক। ও জানে যে ম্যাসেজের সিন করা আর রিপ্লাই দেখলে রোজ সিম চেঞ্জ করে ফেলবে। তাই সময় নষ্ট না করে কল দিয়ে বসেছে। ফারহান বলল,
-কেমন আছিস?
-ভালো। তুমি দেখছি পুরোদমে অভিনয়ে লেগে পড়েছ।গুড, ভেরি গুড। তুমি কেমন আছো?
-ভালো। তুই’ই তো বললি অভিনয়ে ফিরতে। তাই তো।
-হুম। তবে সাধারণ হওয়ার কাজগুলো কি করেছ? কি কি করেছ বলো তো একটু।
-এই প্রফেশনে থেকে মুখ খোলা রেখে বাসে ট্রেনে চলা অসম্ভব চাঁদ।গতকাল রাস্তায় বের হয়েছিলাম। আর সব হুমড়ি খেয়ে পড়লো। পাবলিকের হাত থেকে ওভাবে বাঁচা মুশকিল।
-জামা-কাপড়? (কৌতুক করে।)
-শ্যুটিং টাইম বাদে, সিম্পিল। খাওয়াও সিম্পিল।
রোজ হেসে ফেললো। ফারহান রোজের হাসি শুনে বলে,
-ভিডিও কলে আয়। তোকে একটু দেখি।
-না।
-সাত মাস কোনো কল নেই ম্যাসেজ নেই। আমার কথা কি তোর মনে পড়ে না চাঁদ?
-যারা আমার কথা শোনেনা তাদের কথা মনে পড়বে কেন?
-কোনটা শুনিনি?
-ভেবে পরে বলবো। তুমি একটা গান শোনাও, আমার মুড অফ এখন।
-সামনে আয়। নেচেও দেখাই।
-হু, যা নাচো! শুধু ধরাধরি। রিসেন্ট তোমার যে গানের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে তা দেখেছি আমি।
-রিয়েলি? কেমন লাগলো? রিভিউ দে একটা।
-সত্যি করে বলো তো, ওদের ছোঁয়ার সময় কেমন লাগে তোমার? সত্যি বলবে কিন্তু।
-সত্যি বললে তোর খারাপ লাগবে না তো? (দুষ্টু হেসে)
-জানতাম! ক্যারেক্টারলেস হিরো! (রেগে)
-তুই কি আমাকে পুরুষ ভাবিস না চাঁদ? এটা সিম্পিল একটা ম্যাটার।
-সিম্পিল? তুমি অন্য মেয়েকে চুঁমু খাবে, পেটে ধরবে, যেখানে সেখানে টাচ করবে। মোট কথা ওসব উপভোগ করবে। এটা সিম্পিল? আমিও করে দেখাবো?
-আয়। করে দেখা, ওসব ফিবিং এক্সপ্রেশনের বদলে আমার সত্যিকারের এক্সপ্রেশন দেখতে পাবি।
-যাবো না। তোমার চরিত্র ভালো না।
-সেটা তো একমাত্র তুই জানিস। বাকিরা জানে আমার চরিত্র একদম ফুলের মত পবিত্র। সামান্য একাটা দাগও লাগেনি।
-রেকর্ড করে রাখলাম। ভাইরাল করে সেলিব্রিটি হয়ে যাবো।
-খুব শখ?
-বহুতততত!
-আমাকে বিয়ে করলেই হয়ে যাবি।
-ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের ফায়দা আদায়! শেয়ানা লোক।এবার গান শোনাও, কুইক। আমার ঘুম আসছে না।

♪♪কেন! কাছে তুই এলি, যদি আবার চলে যাবি!
বল কেন! তাহলে স্বপ্ন দেখালি।
আমি জানি কোনো একদিন,
কোনো এক নতুন ভোরে।
দেখা হবে আমাদের আবার এক স্বপ্নের শহরে।

তোর সাথে ছিল বাকি,
কত কথা বলব একদিন।
একাকি নিজের সাথে,
করেছি তোর গল্প সারাদিন।
তোর কথা আসে ফিরে ফিরে,
পথ হারানোর সব কবিতায়।
আমি তোকে নিয়ে যাব আবার।
রূপকথার সেই বাড়িতে,, আয় ফিরে!!♪♪

গানের শেষটুকু গেয়ে ফারহান রোজকে ডাকলো। কিন্তু সাড়া পেলনা। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে পড়ল? ক্লান্ত থাকলে ওর ঘুম আসেনা, আবার ঘুমিয়ে পড়লে সহজে ভা’ঙেনা তাই ফোন রেখে দিল ফারহান। ঘুমাক মেয়েটা। আজ নিশ্চই বড্ড বেশি ক্লান্ত সে। ফারহান ফোন রাখতেই রোজ ফোনটা পকেটে ভরে রাখলো।ঠোঁটে বিস্তর হাসির রেখা।

#পর্ব_উনিশ

পরীক্ষা দিয়ে সবেমাত্র বের হয়েছে অয়ন্তি। কলেজের আনাচে কাঁনাচে মিছিলের ছাঁপ। কোথায়, কিভাবে, কে কাকে ভোট দেবে, কার পক্ষে কতজন? কে কি মার্কায় দাড়িয়েছে এসবেরই গুঞ্জন। অয়ন্তির বিরক্ত লাগলো ব্যাপারটা। এসব নির্বাচনে ওর তেমন আগ্রহ নেই। এই রাজনীতি বিষয়টা ওর দু চক্ষের বিষ। কোনো এক অজ্ঞাত কারনেই সে রাজনীতি পছন্দ করেনা। কলেজ গেটের বাইরে হট্টগোলের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কি হয়েছে বাইরে? ভাবতে না ভাবতেই অয়ন্তির পাশ ঘেসে কয়েকটা ছেলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে যেতেই ভয়ে ঘেমে উঠলো অয়ন্তি।পরিবেশ গরম হয়ে উঠছে। অয়ন্তি দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এসে গাড়ির খোঁজ করতে থাকে। ওর গাড়ি কোথায়? ড্রাইভার কোথায়? চিৎকার চেঁচামিচিতে রাস্তা ভরে উঠলো। কোনো এক প্রতিনিধির মাথায় ঢিল মা’রা হয়েছে, তাকে হ’ত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এমন কাহিনি ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি কয়েকজনকে চরম ভাবে আঘাত করা হয়েছে। কয়েকজনের হাতে ছু’রি, রাম দা। অয়ন্তির মাথা ঘুরছে। রাস্তার ওপর পাশে চলে এসেছে পুলিশের গাড়ি, সাংবাদিক।

গাড়ির ভেতর চুপ করে বসে আছে রোজ। ওর সহকর্মী তুলি আর সাইমুন বের হওয়ার কথা ভাবছে। এই গরম মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দি করাটা জরুরি। কিন্তু রোজের অনুমতি ছাড়া বের হওয়াও সম্ভব না। কারন স্যার রোজকে লিড করতে বলেছেন। রোজ নিজে এই দায়িত্ব যেচে নিয়েছে। তাহলে বের হচ্ছে না কেন? ওদিকে স্যার বারংবার কল করছেন পরিস্থিতি জানার জন্য। গন্ডোগোল বিরাট আকার ধারন করতেই রোজ বলল,

-নাও গো। তুলি তুমি পেছনের দিক কভার করবে আর সাইমুন সামনে। বাকিরা তোমাদের সঙ্গে থাকবে।

সাইমুন বলে, ‘আর তুমি?’

-আমি এখানে কাজের সূত্রে আসিনি। ব্যক্তিগত কারনে এসেছি। তোমাদের তো বলেছিলাম, এখানে আমি আসবো ঠিকই তবে কোনো কাজ করতে পারবো না।যা করার সব তোমাদেরই করতে হবে। সবটা জেনেই তোমরা আমার সঙ্গে আসতে চেয়েছিলে। আমি কিন্তু তোমাদের ডাকিনি।

সাইমুন রেগে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তুলি সাইমুনের হাত চেপে ধরে ওকে চুপ থাকতে বললো। রোজ সেটা স্পষ্ট দেখে। সাইমুন চুপ হয়ে গেলে তুলি বলে,
-আমরা তোমার সঙ্গে কাজ করতে চেয়েছি কারন তুমি সবার থেকে কিছুটা আলাদা। আর স্যারদের গুডবুকে আছো। তোমার সঙ্গে থাকলে আমাদের সুবিধা হবে।

-যখন নিজেদের প্রয়োজনেই এসেছো, তখন প্রয়োজন মিটিয়ে নাও। আমিও আমার কাজে যাচ্ছি। বেস্ট অফ লাক, অল অফ ইয়্যু। আর হ্যাঁ, আমি গুডবুকে আছি এটা কিছুটা ভুল, আমি কাজের কদর করি, সময়ের মূল্য দেই বলে স্যার আমাকে পছন্দ করেন। তোমরা লেট করে আসো, মাঝে মাঝে প্রেজেন্টেশন দাও না, অনেক সময় তাদের কথা অমান্য করো সেজন্য স্যার তোমাদের বকাবকি করে। তোমরা নিয়ম মেনে চললে তোমাদেরও সমান গুরুত্ব দেবে।

তুলি হাসার চেষ্টা করে বলে ‘হুম, বুঝেছি। সাইমুনটাই একটু ইয়ে। ‘

-ওকে। থাকো তোমরা।

রোজ গাড়ি থেকে নেমে যেতেই সাইমুন রাগে চেঁচিয়ে ওঠে। তুলি থতমত খেয়ে তাকায়। সাইমুন রাগ নিয়েই বলল,
-দেখলি, দেখলি কি ভাব? আমি তো ভালোভাবেই প্রশ্ন করেছিলাম। ভাব জমানোর চেষ্টা করছিলাম আর দেখ, এই মেয়ের এ্যাটিটিউড। ঘাউড়া, দজ্জাল। যার কপালে পড়বে সে তো মনে কর, শ্যাষ!

-কার ব্যাপারে বলছিস জানিস?

-কার ব্যাপারে?

-আরে ভাই এটা তোরই ক্রাশ! আমি সকালেই নিউজটা শুনলাম। এটা সেই আর’জে। আড়াইবছর আগে যার উপ্রে ক্রাশ খাইয়া মুখ থুবড়ে পড়ছিলি।এটা সেই রোজ।

-ওরে আল্লাহ! কি শুনাইলি? মিথ্যা কথা কইস না দোস্ত। মিষ্টি আর’জের ওপর নাহয় আমার দূর্বলতা আছে তাই বলে এই জাঁদরেল মেয়ের সঙ্গে মিলিয়ে ক্রাশ দূর করার চেষ্টা করবি? কোথায় ভালোবাসার রংমহলের মিষ্টি ভালোবাসাময় আর’জে। আর কোথায় এই খাঁটাশ মেয়ে। ওর কথা শুনছোস? কি সুন্দর, আর এর কথা? বাপ রে!

-সত্যি বলছি। এটা সেই রোজ। স্যার নিজে বলেছেন।

তুলি সাইমুনসহ আরও চারপাঁচজন খবর তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেই রোজ ফোন বের করে কাউকে কল দিল। এরপর মাথার স্কার্ফ টেনে হাতে ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। রোজের ঠিক পেছন বরাবর দুটো ছেলে যারা রোজের দিকে একধ্যানে চেয়ে আছে। রোজ মৃদু হাসে। অয়ন্তি রাস্তার ওপরেই বসে পড়েছে ভয়ে। নড়ার ক্ষমতা নেই। দেখার ক্ষমতা নেই। শুনতেও যেন পাচ্ছে না সে। রোজ জোরে কথা বলতে বলতে ওর সামনে দিয়ে যেতেই অয়ন্তি চোখ তুলে তাকায়।রোজকে দেখে, হঠাৎ একটা ছোট ইটের টুকরো রোজের কপাল বরাবর লাগতেই অয়ন্তি আতকে ওঠে। চিৎকার করে রোজকে ডাকে। রোজ ডাক শুনেও না শোনার ভান করে নিজের কাজ করতে থাকে। পেছনের ছেলেদুটোর একজন লরি নিয়ে আসলো। রোজ মানুষজন দেখে সাইড হয়ে দাড়ায়। অন্যছেলেটা অয়ন্তির পেছনে দাঁড়ালো। রোজ ইশারা করতেই লরিটা এসে ধাক্কা দিল রোজের শরীরে। অয়ন্তি উঠে কোনো দিকে না তাকিয়েই রোজের দিকে ছুটলো। রাস্তার ওপর র’ক্তাক্ত শরীর নিয়ে পড়ে আছে রোজ। চোখে বিস্ময়, ঠোঁটে হাসি! লরি নিয়ে যে ছেলেটা এসেছিল সে থামেনি। চলে গেছে। আর বাকি একজন দ্রুত এগিয়ে আসে। অয়ন্তির গাড়িটাই সে ব্যস্ত হয়ে চালিয়ে অয়ন্তির ঠিক সামনে নিয়ে আসতেই অয়ন্তি আবার চেঁচালো।কাঁদতে কাঁদতে সে আরশানকে ফোন দিল। বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় ফোনটা। রোজ স্বল্পস্বরে বলে,

-কিছু হয়নি আমার ভাবি।

-কিছু হয়নি মানে? অনাপিকে হারিয়েছি আমি। কিন্তু তোমাকে হারাতে পারবো না রোজ। ঠিক এমন করেই অনাপি চলে গিয়েছিল। ঠিক তোমার মত স্কার্ফ, এমন পরিবেশ, এমন দৃশ্যপট।

-তোমার সব মনে পড়েছে তাইনা ভাবি?

অয়ন্তি আতঙ্কিত চোখে তাকালো। হ্যাঁ, সব মনে পড়ছে। সেদিনের এক্সিডেন্টের পুরো ঘটনা মনে পড়েছে। কিন্তু রোজের চিন্তায় সেসব স্মৃতির প্রভাব অয়ন্তির মগজে পড়লো না। ঠাই পেল না স্মৃৃতিচারণ। সে এখন শুধুমাত্র রোজকে নিয়ে ব্যস্ত। রোজ শ্লেষাত্মক হেসে ছেলেটিকে দূর্বল কন্ঠে বলে,

-টাকা তোমাদের এ্যাকাউন্টে,,

বাকিটুকু বলার আগেই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসলো। গাড়ির গতি পরিকল্পনা অনুসারে আসেনি। বেগ বেশি ছিল যার দরুন রোজ আ’ঘা’তটাও বেশি পেয়েছে। ছিটকে রাস্তার ধারে পড়ে, ইটে বারি খেয়েছে মাথায়। র’ক্তক্ষরণ হচ্ছে। হাতে পায়েও বেকায়দা চোট লেগেছে। এমন হওয়ার তো কথা ছিল না। তাহলে কি এখানেও প্রতারণা করা হলো? আর কিছু ভাবতে পারলো না রোজ।নিস্ক্রিয় হয়ে আসলো মস্তিষ্ক।অসার হয়ে আসলো শরীর। কানে অয়ন্তির অস্পষ্ট কন্ঠস্বর ভাঁসা ভাঁসা এসে ধাক্কা খাচ্ছে। কিন্তু যতটুকু বুঝতে পেরেছে তা হচ্ছে রোজের পরিকল্পনা সফল হয়েছে।

অপারেশন থিয়েটারে প্রায় আধঘন্টা কেটে গেল। কিন্তু এখনও কোনো ডাক্তার বা নার্সের খোঁজ নেই। আরশান এসেছে মিনিট দশেক হলো। ড্রাইভারের সাহায্যেই অয়ন্তি রোজকে নিয়ে এসেছে এখানে। অয়ন্তির ভাব ও বচনভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে রোজের অতিমাত্রায় চিন্তা করছে। অনার কথাগুলো আওড়ে চলেছে। কিন্তু অনার ড্রেসআপ আর পরিস্থিতির বর্ণনা এত সূক্ষ্ম করে দিচ্ছে কিভাবে অয়ন্তি? তবে কি ওর সব মনে পড়ে গেছে? সেই দূর্ঘটনার রিক্রিয়েট করেছে রোজ? নাকি সবটাই কাকতালীয়? আরশান অয়ন্তিকে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে চেপে ধরে দাড়িয়ে আছে। অয়ন্তি ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর নার্স এসে জানালেন,

-পেশেন্টের বাড়ির মানুষ কে?

আরশান এগিয়ে গিয়ে বলে,
-আমি।

-অনেক র’ক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই Ab- র’ক্তের প্রয়োজন। আপনাদের কারোর কি এই গ্রুপের র’ক্ত আছে? রেয়ার ব্লাডগ্রুপ হওয়ার কারনে আশেপাশের কোনো ব্লাড ব্যাংকেও এই র’ক্ত নেই।

আরশান হা করে চাইলো।এবি নেগেটিভ ব্লাডগ্রুপ নাকি রোজের?সবথেকে রেয়ার ব্লাডগ্রুপ। এই র’ক্ত তো হাতে গোনা কয়েকজনের হতে দেখেছে। এই সময় র’ক্ত পাবে কোথায়? যার তার র’ক্তও তো দেওয়া যাবে না। আগে তো শুনেছিল রোজের A+ ব্লাডগ্রুপ। সেটা ভুল ছিল? এদিকে অয়ন্তিরও ভয়ে জ্ঞান যায় যায় অবস্থা। একেই বা কোথায় রেখে যাবে আরশান? র’ক্তের ব্যবস্থা করার জন্য যেতে হলে আরশানকে তো একাই যেতে হবে। নার্সকে অন্য এক নার্স ডেকে বললেন,

-র’ক্ত পাওয়া গেছে।

নার্স চলে যেতেই আরশান অয়ন্তিকে নিয়ে বেঞ্চে বসে। অয়ন্তি অতিতের কথাগুলো আওড়াচ্ছে। আরশানের দৃষ্টি শিথিল হয়ে আসে। এতদিন ডাক্তাররা বলছিলেন পাস্ট রিক্রিয়েট করতে। কিন্তু কেউ সাহস পায়নি। আর রোজ সেটা এমন সময় হুট করে করল? নাকি অয়ন্তির যন্ত্রণা সে শুনেছে? কোথ থেকে? কার কাছ থেকে শুনেছে? আর রিক্রিয়েট করবে ভালো কথা। কিন্তু এই ভাবে? নিজেকে মৃ’ত্যুর মুখে ঠেলে দেয় কোন পাগল?

ফারহান এসেছে রাত একটার পর। আরশান বলেছিল আগামীকাল আসতে কিন্তু রোজের কথা শোনার পর সে কোনোকিছু না ভেবেই ফ্লাইট ধরে চলে এসেছে। রোজকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে, হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ, কপালের সফেদ ব্যান্ডেজটা রোজের চেহারার সঙ্গে মিলে গেছে নিদারুণভাবে। ফারহান রোজের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। আরশান অয়ন্তি বাইরে চলে যায়। ফারহান স্তব্ধচোখে চেয়ে আছে। রোজকে আড়াইবছর পর এভাবে দেখবে ভাবেনি ও। হঠাৎ রোজ চোখ মেলে তাকালো। ফারহান হতবিহ্বল দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রোজ বলল,

-মনোযোগ দিয়ে শুনবে।আমাকে কে র’ক্ত দিয়েছে আর লরিতে কে ছিল সেটা জানতে হবে। ইরফান এমন কাঁচা কাজ করবে না। আমাকে মা’রতে হলে সে অনেক আগেই মা’রতো। এটা অন্যকেউ। তাকে খুজতে আমার মেহমেদ ভাইয়াকে প্রয়োজন। তুমি এসবে জড়াবে না। সো ওনাকে বলো খোঁজ লাগাতে।

ফারহান নিশ্চুপ থেকে তাকিয়ে রইলো। রোজ বিরক্তি নিয়ে বলে,
-তুমি কি বলবে ভাইয়া? না বললে আমার ফোনটা দাও আমি ফোন করে বলছি।

-ব্যাথা কেমন?

-নেই। হাত-পা একদম ঠিক শুধু মাথায় একটু ব্যাথা। মানে ঘুরে উঠছে, প্রপার রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।

-কেন করতে গেলি এমন? অয়ন্তির জন্য? ওরাই তোর সব তাইনা? একবারও আমার কথা ভাবলি না। তোর কিছু হলে আমি কি করতাম চাঁদ?

-কিছু হত না। তেমনভাবেই প্লানিং করেছিলাম। কিন্তু ওদের মধ্যেও একজন বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে।

-এসবের থেকে ফিরে আয় চাঁদ। এসবের কি দরকার? কেন করছিস এমন? আঙ্কেল তোকে ঝুঁকি নিতে বলেছে এমন কপটতা কেন? এসবে একবার কেউ জড়িয়ে গেলে ফিরে আসার পথ থাকে না। তুই এখনও পুরোটা জানিস না। তাই ওদের সঙ্গে শত্রুতা করিস না চাঁদ, প্লিজ! তোর অভিমান আমার ওপর তো? আমি তো সব ছেড়েই দিচ্ছি। তবুও জেদ পুষে রাখছিস কেন?

-যদি বলি,সবাই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘা’ত’কতা করেছে, সেজন্য।

ফারহান কম্পিত কন্ঠে বলল,
-ম..মানে?

-নিজে খুজে বের করো মানে। বাই দ্যা ওয়ে কল করবে নাকি?

ফারহান কল করে রোজের হাতে ফোন দিয়ে দিল। ঘাম কপাল গড়িয়ে শার্টের ওপর পড়ছে। বুক কাঁপছে ভয়ে। রোজ কিসের ইঙ্গিত দিল? সবাই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে মানে? ও কার কথা বলছে? কি কি জেনেছে? রোজ কি ওর কথাও জেনে গেছে? ফারহান কি করেছে সেটাও? ফারহান শার্টের হাতা দিয়ে কপাল মুছতেই রোজ তা দেখে তাচ্ছিল্য হাসে। ভুল করলে অটোমেটিক ভয় চলে আসে, চিন্তা হয়, ছটফটানি ভাব আসে। এই মুহূর্তে ফারহানের সেই ভীত দশা রোজকে চিন্তিত করল না, কষ্টও দিল না। বরং ওকে উপহাস করার সুযোগ তৈরি দিল। কিন্তু রোজ এখন সেটাও করতে চায়না। কি লাভ ফারহানকে উপহাস করে? মানুষটাকে তো নিজের মনে করে রোজ।আর রোজ নিজের মানুষ বা অন্যকেউ কাউকে তাঁর দুর্বলতা নিয়ে উপহাস করতে শেখেনি।

______________

অয়ন্তিকে খাইয়ে দিয়ে ওকে বসিয়ে রেখেছে আরশান। ডাক্তারের সঙ্গে একটু আগেই কথা বলে এসেছে সে। কিছুদিন রেস্ট নিলে অয়ন্তি একদম সুস্থ হয়ে যাবে।মগজের চাপ কমে যাবে। শক্ডের কারনে সব স্মৃতি ফিরে এসেছে ঠিক তবে এসব হৃদয় বিদারক স্মৃতিগুলো ভুলতে ও মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হবেই। অয়ন্তি আরশানের দিকে চেয়ে বলে,

-আমার সব মনে পড়ে গেছে। আ’ম স্যরি!

-কেন?

-আসলে, আপনার সঙ্গে আমি মজা করেছিলাম। মানে, দেখতে চেয়েছিলাম নীলচোখের মানুষটা আমাকে দেখলে অদ্ভুত ব্যবহার কেন করে। তাই আরকি ওমন বিহেভ করেছি। আর আপনি ভেবেছেন আমি আপনার ভালোবাসায় সায় দিয়েছি।

-এখন এসব বলার সময়?

-না, কিন্তু বলে রাখা ভালো। ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না।

-হুম তা ঠিক।কিন্তু অতিতে কি করেছো তা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ বা আপত্তি নেই কুসুম। আমি বর্তমান নিয়েই খুশি। আর তোমাকেও খুশি রাখতে চাই।

-আমিও খুশি। এভাবেই থাকতে চাই সারাজীবন। এখন রোজকে থ্যাংকস বলবেন না?

-সুস্থ হলে ওকে নতুন করে পেটাবো। এমন কাজ কেউ করে? যদি উনিশ বিশ হত তাহলে তোমাদের দুজনের জীবন ঝুঁকিতে পড়তো। এসব ভাবলোও না? এই ধাক্কাটা তুমি সহ্য করতে না পারলে তোমা,,, (রেগে)

-কিছু তো হয়নি! রাগ হচ্ছেন কেন?

-কিন্তু ওর অবস্থা দেখেছ? পায়ের হাড় নড়ে গেছে। হাত ছি’লে অবস্থা খারাপ। মাথার আ’ঘা’তের কথা না’হয় বাদই দিলাম।

-ও সুস্থ হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। ফালাক ভাইয়া ওর পাশে আছে। ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে সুস্থ হওয়ার ঔষধ বেশি কাজ করে।

-ফিলোসফিক্যাল কথাবার্তা কোথ থেকে শিখেছো? আমি তো শেখাইনি।

অয়ন্তি মুখ বাঁকিয়ে অন্যপাশে তাকাতেই আরশান হেসে ফেললো। অয়ন্তির জন্য আলাদা কেবিন নেওয়া হয়েছে তাই অয়ন্তিকে বেডে ঘুমাতে বলে আরশান কফি নিতে চলে গেল।

__________

আসসালামু আলাইকুম। হ্যালো ডিয়ার লিসেনার আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রংমহল, এবং আমি আর’জে রোজ আছি আপনাদের সঙ্গে। প্রায় আড়াই বছর পর আবারও আপনাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে যাচ্ছি। একটু নার্ভাস লাগছে। আপনাদের প্রশ্নের বাণে ঝাঝড়া হওয়ার জন্য। সোশাল মিডিয়ায় বেতারের কথাটা পাবলিশ হওয়ার পর সবার একটাই প্রশ্ন ‘রোজ কোথায় ছিল এতদিন?’ আসলে আমার পড়াশোনার জন্য হুট করেই চলে যেতে হয়েছিল। কি পড়াশোনা তা না হয় ধীরেসুস্থে জানলেন। কিন্তু এত শত কথার মাঝে যে কথাটা চাপা পড়ে গেছে সেটা হচ্ছে ‘কেমন আছেন সবাই?’

প্রথম কলার ‘আলহামদুলিল্লাহ। উই মিস ইয়্যু রোজ ‘

‘আই অলসো মিস অল অফ ইয়্যু। ‘

দ্বিতীয় কলার, ‘আবার হারিয়ে যাবে না তো? ‘

‘সেটা তো এখন বলতে পারছি না। তবে চেষ্টা করবো যেন হারিয়ে যেতে না হয়। ‘ মৃদু হেসে।

তৃতীয় কলার, ‘ঠকে যাওয়ার পরও কি বিশ্বাস করতে হয়? তোমার কি মতামত? ‘

‘মতামত! বেশ কঠিন প্রশ্ন করেছেন। ঠকে গেলে আবার বিশ্বাস করা কঠিন, তবে কার কাছে কিভাবে ঠকছেন সেটা বিবেচনা করে পুনরায় বিশ্বাস করার ভাবনায় আসতে হয়। যেমন ধরুন, কোনো দোকানদার একবার ঠকালো, আপনি নিশ্চই পরবর্তীতে ওই দোকানে যেতে চাইবেন না। কিন্তু পরে দেখা গেল সে আর ঠকালো না। আপনাকে ঠিক মূল্যে ঠিক জিনিসটা দিল। এখন হিসেব করলে দেখবেন দোকানদার আসলে নিজের মুনাফার কথা চিন্তা করেছে। প্রত্যেক দোকানদার সেটাই করে। যদি কেউ ভালো কোনো ক্রেতা পায় তাহলে বিক্রেতা চাইবে নিজের মুনাফা বাড়াতে, তাই এ ব্যাপারে কৌশল অর্থাৎ ঠকানোর পথ অবলম্বন করা তেমন খারাপ নয়। সেও নিশ্চই এমন পরিস্থিতি পার করেই এসেছে। তাই কে কিভাবে ঠকাচ্ছে সে সম্পর্ক হিসেব করে বিশ্বাসের ভিত ঠিক করতে হবে।
তবে মানুষটা যদি খুব কাছের হয় তাহলে সেটা একান্তই নিজের ব্যাপার হবে। কারন মানুষের মন বোঝা বেশ কঠিন। যদি আপনার মন চায় তাকে বিশ্বাস করতে, করবেন। আর যদি মনে হয় সে বিশ্বাসের অযোগ্য তাহলে করবেন না।’

চতুর্থ কলার, ‘আচ্ছা তুমি কখনও কাউকে ভালোবাসো নি কেন? ‘

‘কে বলেছে ভালোবাসিনি? ভালোবাসা কি শুধুমাত্র নর-নারীর মধ্যে হয়? ভালোবাসতে জানলে সবকিছুই ভালোবাসা যায়। আমিও সেভাবেই ভালোবাসি। ‘

‘কি ভালোবাসো? ‘

‘আমি যেগুলো ভালোবাসি সেগুলো একটু অদ্ভুত! এই ধরুন আমি ধরণী কাঁপিয়ে তোলা নীরদগর্জন, আঁধার, সকল প্রকার অনুভূতি, । ‘

‘সকল প্রকার অনুভূতি বলতে?’

‘সকল প্রকার অনুভূতি বলতে, শুধু আবেগ, অনুরাগ, ভালো লাগা নয়। রাগ, জেদ, প্রতারিত হওয়া, বিশ্বাস ঘা’ত’কতা, কষ্ট, খারাপ সময়, ভয়, একাকিত্ব, শত্রুতা বলতে চেয়েছি।’

‘তোমার জীবনে এসেছে এগুলো? তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি এগুলো ফেস করেছো। ‘

‘অনুভূতি জানতে হলে ফেস করা কি জরুরি? জরুরি হলে আমার উত্তর, হতে পারে আবার নাও হতে পারে। ‘

নেক্সট কলার, ‘আই লাভ ইয়্যু রোজ।’

‘থ্যাংকইউ। ‘

‘থ্যাংকইউ,কেন?তুমি তো বললে সবাইকে ভালোবাসো তাহলে। ‘

বোকা বাচ্চাসূলভ প্রশ্নটা শুনে তাজ্জব বনে গেল রোজ।
‘ভালোবাসা হয়তো জাহির করে বেড়ানো বা লোক দেখানোর কোনো জিনিস না। আর মানুষ হিসেবে তো সবাইকে ভালোবাসি, কিন্তু আপনার এই ভালোবাসা প্রকাশের মূল কারন জানি না, কোন সম্পর্ক হিসেবে ভালোবাসেন সেটাও জানি না। সেজন্য ধন্যবাদ! ‘

‘বন্ধু হিসেবে।’

‘বন্ধু? তাহলে হ্যাঁ বলা যেতেই পারে। কিন্তু বন্ধুর থেকে আমি শত্রুকে বেশি ভালোবাসি, হেটার্সদের ভালোবাসি। কারন তারা চোখ বন্ধ করে শুধু আমাকে ভালোবেসে যায় না। আমার মন্দগুলোও প্রকাশ করে, যার সাহায্যে আমি নিজের ব্যর্থতা বা ভুলোগুলো সংশোধন করার সুযোগ পাই। ‘

‘ধন্যবাদ রোজ।’ (বুঝতে পেরে।)

রোজ মৃদু হাসে। সাইমুনের কন্ঠ সে চেনে। কিন্তু সাইমুন হঠাৎ রেডিওতে এভাবে এমন কথা বলে বসবে সেটা ভাবেনি। ও একই রোজকে দুটো কিভাবে ভাবছে? খারাপ চাইছে আবার ভালোবাসাও দেখাচ্ছে।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here