#তুই_হৃদহরণী – ২১
“পুরুষের চোখে সবচেয়ে সৌন্দর্যময় হচ্ছে একজন নারী। হৃদহরণী কে দেখার তৃষ্ণা কখনো প্রেমিক পুরুষের শেষ হয়না।” আহরার ও তার ব্যতিক্রম নয় একই দলে অন্তর্ভুক্ত। ফোনের স্ক্রিনে একনাগাড়ে তাকিয়ে আছে হৃদহরণী কে দেখে। স্কিনের মাঝে জ্বলজ্বল করছে তুরফার একটা পিক। তুরফা আজ যখন লজ্জা আতঙ্কে দরজার সাথে মিশে রয়েছিল মুখ ঘুরিয়ে তখন আহরার চুপ করে একটা পিক তুলে নিয়েছিল ফোনে। পরে হাসি মাখা মুখে ফোন হাতে নিয়ে চলে এসেছিল। অপলক দেখে চলছে তুরফা কে। মুচকি হাসি দিল। ফোন রেখে ব্যালকুনি থেকে বের হয়ে তার সেই গোপন রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
সকাল সকাল তুরফা ঘুম থেকে উঠে পরল। কাঁচা হলুদ বেটে মোনতাহ্-র রুমে গেল। ঘুমের মাঝেই তার গালে ছুঁয়িয়ে দিয়ে খিলখিল করে হাসল। তারপর তাকে ডাকল। মোনতাহ্ ভ্রু কুঁচকে চোখ ঢলতে ঢলতে বিছানা থেকে উঠল। তুরফা কে এভাবে হাসতে দেখে অবাক হলো।
“তুই এভাবে হাসছিস কেন?”
“….
“বলবি নাকি হেসেই যাবি?”
“বলছি বলছি চল।”
তুরফা মোনতাহ্ কে ধরে আয়নার সামনে নিয়ে গেল। মোনতাহ্ দেখে অবাক হলো।
“হলুদ?”
“নয় তো কি মরিচ?”
“হলুদ কেন?”
“বারে আজ তোর বিয়ে হলুদ দিব না?”
মোনতাহ্-র মনে হলো কালকের কথা।
“কিরে চুপ কেন?”
“….
“মোন?”
“হ্যাঁ?”
“মন খারাপ?”
“….
“আঙ্কেল কে আসতে বল।”
মোনতাহ্-র ঝটপট জবাবা
“না।”
“কিন্তু কেন?”
“ইচ্ছা হচ্ছে না। শুধু মার জন্যে খারাপ লাগছে।”
“মন খারাপ করিস না। কেউ স্থায়ী নয়। সব কিছুর অন্তঃ হয়। শুধু স্মৃতি নিয়ে থাকতে হবে আমাদের।”
“….
“যাই হোক চল তোকে গোসল করিয়ে দেই। আয় আয়।”
তুরফা চোখের পানি টা মুছে মোনতাহ্ কে টানতে টানতে ওয়াশরুম নিয়ে গেল। মোনতাহ্ এক চিলতে হেসে ওর সাথে গেল। তুরফা মোনতাহ্-র হাত পায়ে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে গোসল করিয়ে দিয়ে চলে এলো। মোনতাহ্ চেঞ্জ করে এসে দেখল তুরফা ঘরে নেই। একটু এগিয়ে গিয়েই দেখল ফিরাত কে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে তার ঘরের দিকেই এগিয়ে আসছে। মোনতাহ্-র গা থেকে হলুদ আভা আসছে কেমন। চুল টাওয়াল দিয়ে বাঁধা। ফিরাত গাল ভর্তি হেসে তার দিকে এগিয়ে এলো।
“হবু বউ কে বিয়ের আগে গোসল করে আসা অবস্থায় দেখলে কি ঠিক থাকা যায় বলো? তার উপর যদি হয় চাঁদ।”
“কি কি বলছেন এসব? আর আপনি এখানে কেন?”
“নিতে এসেছি।”
“মানে?”
“মানে বউ আর বোন মানে শালি, শালি মানে বোন কে নিতে এসেছি।”
“মানে কি সব বলছেন এসব?”
“আরে কাল আহরার বলল না? বিয়ে ওর বাড়ি তে হবে। রেডি হয়ে নাও যেতে হবে ওখানে।”
“….
“যাক বিয়ের দিন সকাল সকাল তবে হবু বউয়ের হলদে মাখা মুখে দেখা মিলেই গেল বলো। আজ চাঁদ থেকে সাদা নয় হলুদ আভা দিচ্ছে।”
মোনতাহ্-র মরখ লজ্জায় লাল হয়ে আসছে।
“আরে এই এই এখন তো লাল আভা দিচ্ছে। লাল হলুদ এক সাথে রং দিবে নাকি?”
ফিরাত হাসতে লাগল। মোনতাহ্ রাগে ওর দিকে রাগি চোখ নিয়ে তাকাল।
“ওকে ওকে আর লাল হতে হবে না। মরিচ ভেবে শরীর গরম হয়ে যাবে। তা আমার বোন কোথায়?”
“আসলেই তুরি কোথায়? আমি এসেও দেখলাম না।”
“দেখো গিয়ে আমার বোন কোথায়।”
“আপনি তো দেখছি উড়ে এসে জুরে বসছেন।”
“চুপচাপ যাও স্বামীর হুকুম মানো।”
এ বলে ফিরাত গম্ভীর এক ভাব মুখে আনার চেষ্টা করে গিয়ে বিছানার উপর বসল। মোনতাহ্ দরজার পাশ থেকে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভুলে যাবেন না বিয়ে টা কিন্তু হয় নি। স্বামী তো দূরের কথা যদি রাজি না হই না..”
“আরে আরে আমি তো মজা করছিলাম। যান মহারানী তুরফা কে দেখুন গিয়ে।”
ফিরাতের চুপষে যাওয়া মুখ দেখে মোনতাহ্-র বড্ড হাসি পেল। কিন্তু মুখে শক্ত এক ভাব এনে বের হয়ে গেল। দরজার বাহিরে গিয়ে না পেরে হেসেই দিল মেয়ে। তুরফার রুমে গেল। রুমে নেই তুরফা। মোনতাহ্ জানে তুরফার হয়তো মন খারাপ। আর তা হলে কোথায় যায় তাও তার জানা। এদিক ওদিক না তাকিয়ে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। তুরফা ওখানেই আছে। মোনতাহ্ এগিয়ে গেল তার দিকে। মোনের হাতের স্পর্শ পেয়ে তুরফা চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মোন জোর করে তার দিকে মুখ ফিরায়। তুরফা পানি চোখ নিয়ে একবার তাকাল মোনের মুখের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়ে তুরফা তাকে জড়িয়ে ধরল। মোনের ভেতর থেকে কান্না আসছে। তুরফা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল,
“আ আমি আবার একা হয়ে যা যাবো।”
“….
“কে বলেছে একা হবি? তুই আমার সাথেই থাকবি।”
তুরফা উঠল। চোখের পানি মুছে নাক টান দিল।
“তা হয় না।”
“সব হয়।”
“দেখ..”
“কি তুরফা তোমার এত কাঁদার কি আছে? কেঁদো না। তুমি তোমার বান্ধবীর বাড়িতেই থাকবে।”
সিঁড়ির দিকে দুজনে তাকাতেই দেখল ফিরাত এগিয়ে আসছে।
“না ভাইয়া।”
“কোনো না নেই। সেসব না হয় পরে হবে আগে যাও তৈরি হয়ে নাও ও বাসায় যেতে হবে।”
“কোথায়?”
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল তুরফা।
“আহরারের বাসায়। আজ না তোমার বান্ধবীর বিয়ে।”
“আল্লাহ ওই লোকটার বাসায়? যাবো না আমি ওই ডেভিলের বাসায়।”
“কিরে কি বিড়বিড় করছিস?”
“এ্যাঁ? না কিছু না। তুই রেডি হয়ে নে যা।”
“ওকে।”
ফিরাত মাঝে বলল,
“এক কাপ কফি হবে?”
তুরফা ঝটপট উত্তর দিল।
“আপনি ওয়েট করুন ভাইয়া আমি আনছি।”
তুরফা হাসি মুখে চলে গেল। মোনতাহ্ যাওয়ার সময় ফিরাতোর গলা পাওয়া গেল।
“চাঁদ রাতের জন্যে অপেক্ষা করছি।”
মোনতাহ্ ঘাড় ফিরিয়ে ফিরাতের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরাত এদিক ওদিক তাকিয়ে পিছন ফিরে গেল। মোনতাহ্ মুচকি হাসি দিয়েও সাথে সাথে মিলিয়ে নিয়ে পা বাড়াল। মনে মনে ভাবল,
“লোকটা খুব বেশি ফ্রী মাইন্ডের।”
তুরফার মন কচকচ করছে, অস্থিরতা বাড়ছে। গাড়িতে বসে আছে। চোখ মুখ কুঁচকে রয়েছে। সামনে বসে আছে ফিরাত আর মোনতাহ্। আর সে পিছনে। ফিরাত ওর অবস্থাটা বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল।
“তুমি কি চিন্তিত তুরফা?”
“….
“তুরফা?”
“জ্বি?”
“কি নিয়ে চিন্তা করছো?”
“না আসলে আমি ওখানে..”
“আমি ভুল না করলে তুমি ওবাড়িতে যাবে আহরার থাকবে এই নিয়ে চিন্তা করছো তো?”
“…
“কি হলো?”
“ইয়ে আসলে না মানে..”
“তুরফা আহরার কিন্তু আগের মতো নেই। আর ও ওমন ভাবে থাকত শুধু নিজের রাগ আর কষ্ট দমিয়ে রাখতে। ওর ভয়াবহ অতীতের জন্যে। তবে আহরার আগের থেকে খুব ভালো হয়ে গেছে। আগের কিছুই নেই ওর মাঝে। আর এটা শুধু হয়েছে তো..”
“আচ্ছা ভাইয়া উনার কি এমন অতীত? কিসের কষ্ট? এত রাগ? বলবেন আমায়?”
“….
“ভাইয়া।”
“সরি তুরফা। আহরার নিজের লাইফ নিয়ে কাউকে কিছু বলতে পছন্দ করে না। কেউ বলুক তাও পছন্দ করে নয়। সে চাইও না কেউ তার অতীত জানুক। আর তার উপর করুণা করুক। আহরার খুব জেদি। আমিও তোমাকে বলতে পারব না কিছু। হয়তো আমাদের বন্ধুত্ব টা নষ্ট হয়ে যাবে ছোটবেলার। তাই দুঃখিত। তোমার জানতে হলে নিজের থেকেই জেনে নিতে হবে তুরফা।”
ফিরাত ড্রাইভ করতে করতে কথাটা বলে চুপ করল। ওদিকে তুরফা ভাবছে। গভীর চিন্তা করছে। আশপাশের কোনো আওয়াজ আসছে না তার কানে শুধু ভাবছে। কি কষ্ট? কি অতীত?
মোনতাহ্ কিছু বলতে যাবে তার আগে ফিরাত তাকে থামিয়ে দিল। চোখ দিয়ে ইশারা দিল আস্থার। একটু পর অতি নরম গলায় বলতে লাগল।
“আহরার আমার বন্ধু। তুরফা যে কোম্পানিতে কাজ করে সেটা ওর। প্রথম দেখায় তুরফার সাথে একটু ভুল হয়ে গিয়েছিল। আসলে আহরার একটু অন্যরকম ছেলে। বাজে রাস্তায় চলে যাওয়া কিছু টা। কিছু জিনিসে ঝুঁকে গিয়েছিল। যদিও ওসবের পিছনের ওর কালো একটা অতীত আছে। যা আমি তোমাকে বলতে পারব না। আশা করি এ বিষয় নিয়ে আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না। তবে আগের সেই আহরার আর এখনের এই আহরারের মাঝে অনেক তফাৎ। কারণ তুরফা ওর মন চুরি করেছে।”
বলতে বলতে চলে এসেছে বাসায়। অনেক বড় এক গেইট দিয়ে বিশাল বাড়ির সামনে গাড়ি থামাল ফিরাত। মোনতাহ্ অবাক হয়ে দেখছে। আর ওদিকে তুরফা তখনো চিন্তায় মগ্ন। ফিরাতের কয়েক বার ডাকে তুরফা নিজের মাঝে ফিরে এলো। ফিরাতের দিকে তাকাল তারপর চোখ গেল আশেপাশে। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। মুগ্ধ হয়ে দেখছে। ফিরাত মোনতাহ্ কে নিয়ে ভেতরে গেল। তুরফা গাড়ি থেকে নেমে আশপাশ দেখল। কি সৌন্দর্য, কি বিলাশবহুল বাড়ি। সামনের অনেক টা জায়গায় ফাঁকা। নানা গাছ সেখানে। গেইট দিয়ে সোজা এক রাস্তা বাসার দরজা পর্যন্ত। তুরফা মাথা উঁচু করে দেখল বাসাটা। সাদা রং করা। কখনো কোথাও কোথাও হাল্কা আকাশীরং। এ যেন এক মেঘের রাজ্য। তুরফা মুগ্ধ চোখে সব কিছু দেখছে। না চাইতেও মুখ ভর্তি হাসি তার। হাটতে আর দেখতে দেখতে হঠাৎ শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেলো। তুরফা ভ্রুকুটি করে মাথায় হাত দিয়ে সামনে তাকাল। আহরারের গায়ে কালো একটা শার্ট। হাতা কনুই পর্যন্ত উঠানো। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। আহরার ঠাই দাঁড়িয়ে দেখছে তুরফা কে। হঠাৎ ফিক করে হেসে দিল আহরার। তুরফার ওই মুখ দেখে। তুরফা যেন অবাক হয়ে দেখছে। কি মিষ্ট সে হাসির রেশ। লম্বা করে চোখের পলক ফেলল। আহরার মোহময় দৃষ্টি দিয়েছে তার উপর। ঠোঁটে খানিক বাঁকা হাসি লাগিয়ে রেখে এগুলো তুরফার দিকে। তুরফা তো চুপ করেই দাঁড়িয়ে কয়েক বার ঘন চোখের পাতা ফেলল। বিষয় টা বুঝে উঠে তাড়াতাড়ি আশপাশ দেখল। আহরারের দিকে তাকিয়ে পিছনে যেতে যেতে কিছুর একটার সাথে আটকে যায়। তুরফা পাশ ফিরল দেখার জন্যে ওমনি আহরার একদম তার দিকে এগিয়ে এলো। তুরফার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বোরকার নিচে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে মুখ ঘুরিয়ে। আহরার পিলারের উপর হাত রাখল। তুরফা কে ওভাবে থাকতে দেখে আনমনে মুচকি হাসল আহরার। মুখ আরো এগিয়ে দিল তুরফার দিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসানি ঘোর লাগানো কন্ঠে বলল,
“হৃদহরণী আপনায় সুস্বাগত আমার মনের অন্দরমহলে।
আমার খাসমহলে শুধু আপনি-ই বিচরণ করুন তুর।”
চলবে….
#সাদিয়া