তুই হৃদহরণী পর্ব শেষ

#তুই_হৃদহরণী – ৩০

“কি হলো চুপ করে আছেন কেন আপনি? বলুন। বলুন না।”

“….

“প্লিজ চুপ করে থাকবেন না বলুন।”

“লিনা শুধুই আমার ফ্রেন্ড। খুব ক্লোজড ফ্রেন্ড। বিদেশে এক সাথে পড়াশুনা করেছি আমরা। লিনা ইয়োকের ফিওন্সি। ওদের আঙ্গটি বদল আগেই হয়ে গিয়েছে। কিছু দিনের মাঝে বিয়ে হয়ে যাবে। ও আমায় কল করেছিল বিয়ের দাওয়াত দিতে। ওর কথা মনে হতেই সব কিছু মাথায় সাজিয়ে নেই আমি। লিনা আর ইয়োক কে দেশে আসতে বলি। ওরা আসে। তুরফা আমি জানি তোমাকে বিয়ের কথা বললে তুমি রাজি হতে না। বা আমাকে যদি তুমি ভালো না বাসো তবে জোর করে বিয়ে করেই তোমার জীবন টা কেন শেষ করব আমি? যদিও আমি তোমাকে অন্য কারো হতেও দিতাম না। কিন্তু জোর করে বিয়েও করতাম না। চাইলে আমি জোর করতে পারতাম কিন্তু এই কারণেই করি নি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমার জন্যে তোমার মনে কোনো অনুভূতি আছে কি না। প্রথম দিনই আমি প্রমাণ পেয়ছিলাম। লিনা কে প্রথম অফিসে দেখে তুমি কি কি করছিলে আশা করি ভুলো নি। আমি কিন্তু ঠিকি আড়চোখে তোমাকে লক্ষ্য করেছি সবসময়। বারবার তুমি আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছো। আগুনের মতো জ্বলছিলে আমার কাছে লিনা কে দেখে। আমার প্রতি অনুভূতি না থাকলে এমন হতোই না। আমেরিকা যাওয়াটা প্লেন ছিল বিয়ের। তবে এটা আমি লিনা আর ইয়োকই জানতাম। তোমাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানানোর জন্যেই এসব করা। পাগলি তোমাকে বিয়ের করব বলেই সেদিন আমি তোমায় লিনা কে আনতে বলেছিলাম। জানি কষ্ট পেয়েছিলে কিন্তু করতেই হতো। আর লিনা ইয়োকের ঘরের দরজা তোমাকে দেখাবে বলেই খোলা রেখেছিল। তাই রুম বুক করার সময় ওমন ভাবে ধাপেধাপে বুক করা হয়েছে। পরে যখন তোমাকে বিয়ের অফার করলাম তখন তুমি না করলে। বিশ্বাস করো ১ সেকেন্ডের জন্যে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই মোনতাহ্-র কথাটা বলেই জোর করেছি। এখন হয়তো এটা বলতে পারো এত কিছু করার কি দরকার ছিল? আগেই কেন জোর করলাম না? মাই কুইন আগেই বলেছি তোমার মনে আমার জন্যে অনুভূতি অনুভব না করে জোর করে বিয়ে করব না। যখন সেটা অনুভব করেই নিলাম তখন জোর করে কেন যেকোনো উপায়েই বিয়ে করতাম আমার নূর কে। সব টাতে অন্তত এটা ক্লিয়ার হয়েছো তোমার যে আমি ওসব ইচ্ছা করে করেছি তোমার মনের অনুভূতি টা জেনে তোমাকে বিয়ে করে নিজের কাছে পাওয়ার জন্যে তুরফা।”

তুরফা কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। কথাও আসছে না মুখ দিয়ে। কাঠ গলায় শুকনো একটা ঢোক গিলল। আহরারের দিকে তাকালে দেখতে পেল আহরার মায়াভরা করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তুরফা রাগ করবে নাকি খুশি হবে তা বোধগম্য হচ্ছে না তার। মাথার ভেতরে সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

কিন্তু আহরারের ওই মুখ টা তাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছে বারবার। যাই হোক আহরারের বাস তো তার মনেই। কাঁপা ঠোঁটে বলল,
“ছবি আঁকা হারাম। কেয়ামতের ময়দানে এর জবাব দিহি করতে হয়। না জেনে থাকলে আল্লাহর কাছে মাফ চেয়ে নিন। নিশ্চয় আল্লাহ পরম দয়ালু, ক্ষমাশীল। ইনশাল্লাহ আল্লাহ আপনায় মাফ করবেন।”

তুরফার কোমল কথা শুনে আহরার ঝাপটে ধরল তুরফাকে। মনে খুশির বন্যা বইছে। ঠোঁটের কোণে হাসি। তুরফা টলমল চোখে স্লান হেসে আগলে নিল আহরার কে।

আহরার তুরফার নরম গালে নরম করে হাত দিয়ে বলল,
“ভালোবাসো আমায়?”

“….

“হৃদহরণী বলো।”

“উত্তর টা তোলা থাক।”

আশ্চর্যান্বিত হয়ে আহরার জিজ্ঞেস করল।
“কেন? বলো না প্লিজ তুর।”

“সময় হলে বলব।”

“আমার কথা আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছো তো?”

“আপনি যেমন করেছেন আমার সাথে।”

“প্লিজ তুরফা বলো না প্লিজ।”

“আপনি যেদিন আমার মনের মতো হবেন ঠিক সেদিনই বলব।”

“তার মানে আমি তোমার মনের মতো নই?”

“না।”

“….

“আপনাকে আমার মনের মতো হতে হবে। একদম আমার মনের মতো। আপনাকে তওবা করতে হবে। আল্লাহর পথে হাটতে হবে।”

“তুমি হাত ধরে নিয়ে গেলে সব সম্ভব হবে।”

“ছাড়ব না হাত। পারবেন তো?”

আহরার চোখ দিয়ে ইশারা করল। আলতো করে তুরফা কে নিজের বুকে নিয়ে বুক শীতল করল। তুরফা তার জন্যে নূর। সম্পূর্ণ এক আলো। জীবন টা অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় তুরফা। মেয়েটা কে জড়িয়ে ধরলেই তার বুকে অদ্ভুত এক শান্তি আসে। শরীর বুক মন সব শীতল হয়ে আসে।

আস্তে আস্তে তুরফা আহরার কে নতুন আহরারে রূপান্তর করে নিচ্ছে। এখন আহরার আগের আহরার নেই। তার মাঝে এক শুভ্রতা দেখা যায় সবসময়। মুখের মাঝে কেমন একটা নূরের আভাস। তুরফা নামাজে সব দোয়া নিজ হাতে শিখিয়ে দিচ্ছে আহরার কে। এমন কি তুরফা নিজেই আহরার কে কোরআনের শিক্ষা দিচ্ছে। দুজনে এক সাথে নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে তুরফা নিজের স্বামী কে দোয়া কালাম পড়ে ফু দেয়। তারপর কপালে আলতো করে চুমু দেয়। প্রতিদিনকার রুটিন এটা।

সেদিনের কথা। তুরফার ডাকে আহরার ঘুম থেকে উঠে পরল। ফজরের আজান দিয়েছে। দুজনে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নামাজে দাঁড়াল। আজ তুরফা অনেক সময় নিয়ে দোয়া পরছে। আহরার নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে আছে। তুরফার মোনাজাত এখনো শেষ হয় নি। আহরার বসে অপেক্ষা করছে তার জন্যে। বউয়ের ফু আর চুমু খাবে বলে।

তুরফা মোনাজাত শেষ করে আহরারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। কিছু সময় ধরে দোয়া পড়ে আহরার কে ফু দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ দিল। আহরারের গালে আলতো করে স্পর্শ করল।
“আপনি বলেছিলেন না আমি আপনাকে ভালোবাসি কি না? শুনবেন না?”

আহরার বিস্মিত হওয়ায় কথা বলতে পারছে না। চোখে খুশির ঝিলিক।
“ভালোবাসি আমি আপনাকে। খুব ভালোবাসি। নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি আপনাকে। আপনি আমার সব। আমার একটা পৃথিবী আপনি। আপনাকে ছাড়া আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। আমি ভালোবাসি আপনাকে।”
আহরারের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছে। তার ক্ষুদ্র জীবন টা সার্থক।

“আপনি কাঁদবেন না। আপনার একটু কষ্ট আমার বুকের ভেতরটা পুড়িয়ে দেয়। আমার খুব কষ্ট হয়। আপনাকে আমি কষ্ট পেতে দিব না ইনশাল্লাহ। আপনি সবসময় ভালো, হাসিখুশি আর বিপদ মুক্ত থাকুন এই দোয়াই করি আল্লাহর কাছে। কাঁদবেন না আমার প্রিয়।”

আহরার জড়িয়ে ধরল তুরফা কে। কাঁদছে সে। প্রাপ্তির খুশির কান্না কাঁদছে।
“তুই আমার জীবনের যে কি তা বলে বুঝাতে পারব না তোকে তুরফা। আমার জীবন টাই তুই বউ। তোকে ছাড়া এখন একটা নিশ্বাসও নিতে পারব না আমি। আমি আল্লাহর কাছে শুধু এটা বলি ‘আল্লাহ তোমার কাছে কিছু চাই না তুমি শুধু আমার তুরফা কে ভালো রেখো আর আমার সাথে রেখো সবসময়।’ তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না বউ। তুই আমার জীবনে না এলে আমি বুঝতেই পারতাম না জীবনের মানে। জীবন এত সুন্দর হয় জানতামও না। আল্লাহর পথে কি শান্তি আছে তাও বুঝতাম না। তুরফা তুই আমার সব। তোকে ছাড়া আমি প্রাণহীন দেহ। আমার কিছু না থাকলেও চলবে শুধু তুই হলেই হবে আমার। খুব বেশি ভালোবাসি তুরফা।”

“আপনাকে কান্না করতে বারণ করছি না?”

“….

“ওকে আপনার সাথে আজ কথাই বলব না।”

“ওই না পাগল হয়ে যাবো আমি তাহলে।”

“পাগলই তো আপনি।”

“আমি শুধু আমার তুরের পাগল।”

তুরফা হাসল। আহরার তুরফার ঠোঁটে ছোট একটা চুমু দিল। ভিজে চোখেও ভালাবাসা দিল।

বিকেল বিকেল আহরার বাসায় ফিরাল। ফ্রেশ হয়ে এসে ছাঁদে গেল দুজন। এক ডিভানে বসে আছে দুজনে। পিছন থেকে আহরার তুরফা কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।
“তুর কি চেয়েছিলাম মনে আছে তো?”

“কি?”

“আমার বেবি।”
লজ্জামিশ্রিত হাসল তুরফা।

“কি বললাম?”

“শুনলাম তো!”

“জবাব দিলে না?”

“আল্লাহ যখন চাইবে এমনিই হবে।”

“আল্লাহ তুমি তাড়াতাড়ি আমায় একটা বেবি দাও।”
তুরফা খিলখিল করে হাসল। আহরার তার ঘাড়ে নাক নেড়ে সেও হাসতে লাগল। সময় অনেকক্ষণ পের হয়ে গেল। এক কাপ কফি তে চুমুক লাগল দুজোড়া ঠোঁটের।

রাতের দিকে তুরফার ফোনে একটা কল এলো আননোন নাম্বার থেকে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে এক মহিলার মোটা এক কণ্ঠস্বর বের হয়ে এলো।
“কেমন আছো মা?”
তুরফা অবাক হলো। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল কে?
“আমাকে তুমি চিনবে না। তোমার স্বামী কেমন আছে মা?”

“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ তিনি ভালো আছেন।”

“সামলে রেখো মা একটু যত্নে নিও ওর। ভালো থাকো তোমরা। রাখছি।”
তুরফা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি কল কেটে দিলেন। বিষয়টায় খুব বেশি অবাক হয় তুরফা। কে কল দিল? আহরার রুমে ঢুকলে তুরফা তাড়াতাড়ি ডাকল,
“শুনছেন আপনি?”

“আহ মাই কুইন। তুমি যখন আদর আর লজ্জামাখা গলায় আপনি বলো না। তখন কত যে কিউট লাগে। ইচ্ছা হয় মিষ্টির মতো গোল করে গিলে ফেলি।”

“আমি কিন্তু সিরিয়াস মুডে আছি।”

“আরে আরে আমার বউয়ের কি হয়ে গেলো?”

“দেখুন আমি কিন্তু..”

“তুরফা কিছু হয়েছে কি?”

“….

“কি হলো এখন বলছো না কেন?”

“কেউ একজন কল দিয়েছিল।”

“কে কল দিল? তুরফা বলো।”

“আগে আপনি আপনার অতীত বলুন। কেন আপনি ওমন বাজে হয়ে গিয়েছিলেন? কেন আপনার বুকে এত কষ্ট? কেন বাবা মার থেকে দূরে থেকেছেন?”

“….

“কি হলো বলুন।”

“তুরফা আমি ওসব বলতে চাই না।”

“আপনি আমাকে বলবেন না তো? ওকে আপনি আমার কাছে যা চেয়েছেন তা আমি দিব না।”

“তুরফা তুমি কিন্তু আজকাল খুব জেদ করো।”

“করি তো? বলবেন?”

“….

“অপেক্ষা করছি বলুন।”

“তুরফা সব কিছুর কারণ থাকে। ওটারও কিছু কারণ ছিল নিশ্চয়।”

“কারণ টাই জানতে চাই।”

“….

“বলবেন না তো? ওকে আমি..”

“বলব। আজ সব বলব তোমায়।”

“….

“উচ্চ পরিবারের সন্তান আমি। দেশে নাম ডাক আছে বাবার। সবাই বাবা কে চিনে। আমার মা কেও অনেক মানুষ চিনে। তবে সেটা বাবার স্ত্রী হিসেবে নয়। মায়ের নিজ পরিচয়ে।”

তুরফা ভ্রু কুঁচকাল। কিসের পরিচয়?

“আমার মা রাজনীতি তে যুক্ত ছিলেন। মানুষকে সেবা সাহায্য করার খুব ইচ্ছা দেখতাম উনার মাঝে। মা দল করতেন। নিজের ক্লাব অনেক মানুষ ছিল উনার। এক ডাকে অনেক মানুষ চলে আসতো। অল্প সময়েই সবার পরিচয়ে চলে এসেছিলেন। বাবা না করতেন এসব করতে। কিন্তু মা শুনতেন না। ছোট থেকে মা কে কঠিন হতেই দেখেছি আমি। মা আমাকে আর বাবা কে সময় খুব কম দিতেন। সারাক্ষণ দেশ সমাজ, ও সব মানুষ নিয়ে ভাবতেন। বাবা হয়তো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি কষ্ট পেতাম। একা সময় গুলি ফিরাতের সাথে কাটত আমার। মা আমায় নিজ হাতে কখনো খাওয়ায় নি। বাবা অফিস থেকে এসে যত টুক পারতেন আমায় সময় দিতেন, যত্ন করতেন। বাবাই আমাকে খায়িয়ে দিতেন। মা যেন আমার থেকেও ছিল না। মনের কোণায় এই একটা কষ্ট ছিল আমার। বড় হতে হতে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করতাম। কিন্তু মায়ের অভাব থেকেই যেত আমার। একদিন মা বললেন আমাকে কাল বিদেশ চলে যেতে হবে। সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে। আমি সেদিন রাজি ছিলাম না। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। এমন কি মায়ের পায়ে পরে কান্না করে বলেছিলাম আমি কোথাও যাবো না এখানেই থাকব। বাবা কে বলেছিলাম। বাবা প্রথম দিকে না করলেও পরে আর কিছু বলেন নি। চুপ ছিলেন। মা এমনিতেই কঠিন। জানতাম মন গলবে না তবুও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছু হলো না। সেই একা কাটল আমার দিন। আমার শৈশব কেটেছে একা। আমি প্রতিদিন ঘর বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতাম। আমার বুক টা ফেটে যেত কষ্টে। জানো আমি যখন অসুস্থ থাকতাম তখন একাই থাকতে হতো আমার। খুব জ্বর হলে নিজের কপালে নিজে জলপট্টি দিতাম। একদিন হাত কেটে গিয়েছিল। রাতে খাবার সময় খেতে পারছিলাম না। এত টা জ্বলছিল। খাবার মুখ পর্যন্ত নিতেই পারছিলাম না ব্যথায়। সেদিন আর খাওয়া নি আমার। খুব কেঁদেছিলাম ফ্লোরে পড়ে।”

তুরফার বুক টা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। একটা মানুষ ছোট থেকে কত কষ্ট পেয়েছে। কষ্টে কষ্টে বড় হয়েছে মানুষটা। ভেবে ভেতর আত্মা কষ্টে খাঁখাঁ করছে তার। মনে হচ্ছে বুক টা কষ্টে দুই ভাগ হয়ে যাবে। চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। তুরফা ঝাপটে ধরল আহরার কে। শক্ত করে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল। আহরারের চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি বের হলো। আবার বলল,
“সেদিন কাঁদতে কাঁদতে আমি সেখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এর পর থেকে বাবা মার প্রতি ক্ষোভ টা ঘৃণায় পরিণত হলো। এর পর থেকে উনাদের আর সহ্য হয় না আমার। যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি আমি। এখন আর বছরেও একবার কথা হয় না। এবার খুশি তো? সব জেনেছো তুমি।”

“….

“ওই পাগলি কাঁদছো কেন?”

“….

“দেখো আমার শার্ট ভিজিয়ে নিচ্ছে। প্লিজ পাগলি কেঁদো না। এখন তুমি আমার সব। তোমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হলে আমার কলিজা টা ফেটে যায়। প্লিজ কান্না থামাও।”

“আপনার এত কষ্ট ছিল বুকের ভেতর?”

“ছিল। ছিল বলেই আমি ওমন বাজে কাজে নিজেকে ডুবিয়ে ব্যস্ত রাখতাম। কিন্তু এখন নেই। আমার জীবনে যখন তুমি এলে কষ্ট দূর হয়ে গিয়েছে। তুমি আমার ভালো থাকার মেডিসিন হৃদহরণী।”

“….

আহরারের বারণ শুনেও তুরফা অনেকক্ষণ কাঁদল তাকে জড়িয়ে ধরে।
“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে।”

“বলো পাগলি।”

“রাখবেন তো?”

“কেন না? বলো।”

“আমি চাই আপনি বাবা মার সাথে দেখা করুন।”

“সেটা সম্ভব নয় তুরফা। এ ছাড়া অন্য কিছু চাও।”

“প্লিজ না করবেন না। প্লিজ।”

“দেখো তুরফা..”

“দেখুন আপনি না ইসলামের পথে হাটুন? সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হারাম। সেখানে উনারা আপনার বাবা মা। আপনি তো এখন জানেন ইসলামে বাবা মার জায়গা টা কোথায়? এমন করবেন না প্লিজ। দেখুন আপনার কাজ করার পিছনে যেমন কারণ থাকে উনারও নিশ্চয় ছিল। উনি রাজনীতি তে যুক্ত ছিলেন নিশ্চয় বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতেন। একবার দেখা করুন না প্লিজ।”

আহরার কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। এখন তার আগের মতো মন নেই। ইসলামের পথে হাটতে হাটতে মন অনেক টা নরম হয়েছে। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গিয়েছে তুরফা কাছ থেকে। বাবা মা কে মনে করে না এমন না। কিন্তু..

“তুরফা আমার এত বছরের একা কাটানো? এত কষ্ট তার কি হবে? তারা কি সেটা আমায় ফিরিয়ে দিতে পারবেন বলো।”

তুরফা আহরারের গালে কোমল হাত রাখল।
“দেখুন যা চলে গিয়েছে তা শেষ। যা আছে আর হবে তা নিয়ে ভাবতে হয়। দেখুন হয়তো উনারা আপনার কষ্ট টা ফিরিয়ে দিতে পারবেন না। কিন্তু এর থেকেও বেশি আনন্দ সুখ দিতে পারবে উনারা। আমার যতটুক মনে হয়েছে উনারা আপনার অপেক্ষা করছে আর আপনার জন্যে কষ্টও পান খুব। প্লিজ একটা বার। প্লিজ শুধু একবার।”

সকালে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পরে তারা রওনা দিল।
মিসেস মিলিফা চৌধুরী কলিংবেলের আওয়াজে এগিয়ে গেলেন। দরজা খুলে চিনা কাঙ্ক্ষিত মুখ টা এত বছর পর দেখে মিলিফার কলিজা চিঁপা দিয়ে উঠল। শরীর কেমন কাঁপছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে উনার। হয়তো পানি তে। তিনি ভাবছেন এটা কল্পনা। কারণ এমন টা হবে না তিনি জানেন। তবুও মনে কত আনন্দ জাগছে উনার। কত বছর পর দেখছে নিজের গর্ভজাত সন্তান কে। সেই ছোট দেখেছিলেন তিনি। এর পর শুধু ছবি দেখেছিলেন। চোখ বেয়ে উনার পানি পরছে। উনার অবচেতন মন বলছেন এটা উনার ভ্রম। কিন্তু আহরার ঠাই দাঁড়িয়ে দেখছে মা কে। আগের মিলিফা এখন নেই তিনি। মুখে বয়সের ছাপ পরেছে কেমন পাণ্ডুর দেখায় সবসময়। আগের সেই কড়া কঠিনও তিনি নেই। চোখে চশমা। মুখ টা কেমন মলিন দেখাচ্ছে। আহরারের ভেতরে খুব কষ্ট লাগছে। পুড়োনো ক্ষতে আঘাত তোলপাড় করে দিচ্ছে বুকটা।

আরমান চৌধুরী যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছেন চোখের চশমা মুছে দরজায় তাকালেন। তখন চমকে গেলেন। তিনিও প্রথমে ভুল ভেবেছেন। তাড়াতাড়ি চশমা পরে বিস্মিত নয়নে তাকালেন। আহরারের সাথে তার বউ। সবাই টিভিতে দেখেছিলেন বিয়েটা। তাই সেদিন কল দিয়েছিলেন। কিন্তু আহরার ফোন টাই বন্ধ করে দিয়েছিলো। খুশির কান্না কেঁদেছিলেন উনারা সেদিন।

মিলিফা চশমা খুলে চোখের পানি মুছলেন।
“ইসস ভ্রম হলেও তো দেখতে পারছিলাম। কিন্তু চোখের পানি গুলি কেন বিরক্ত করছে।”

আহরারের বুক কেঁপে উঠল। না পেরে মা কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। মিলিফা বিশ্বাসই করতে পারছেন না এটা তার ভুল নয় বাস্তব কি করে সম্ভব? মিলিফা অঝরে চোখের পানি ফেলছেন ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। আরমান দৌড়ে এসে ছেলেকে ধরলেন। তিনিও কাঁদছেন।

তুরফার চোখে পানি চলে এসেছে এসবে। সে ভেতরে গেল। মিলিফা মন ভরে কেঁদে তুরফার দিকে তাকালেন। এগিয়ে গেলেন সেদিকে।
“আসসালামু আলাইকুম মা।”

“ওলাইকুম আসসালাম।”

“কাল আপনিই তো কল দিয়েছিলেন আমায় তাই না?”

“তুমি বুঝলে কি করে মা?”

“এমনি তেই।”

মিলিফা জড়িয়ে ধরে তুরফা কে কাঁদলেন।
“তুমি আহরার কে এখানে নিয়ে এসেছো তাই না?”

“…..

আহরার কে অনেক চুমু দিল নিজের মা। এত বছরের স্নেহ সব যেন উজাড় করে দিচ্ছেন একে বারে।
“বাবা আমি তোর ভালোর জন্যে কঠিন হয়েছিলাম। আমারও কষ্ট হয়েছিল তোকে বিদেশ পাঠাতে কিন্তু এটা দরকার ছিল। তোর জীবন সুরক্ষিত রাখতে করতে হয়েছিল আমাকে ওটা। রাজনীতি সহজ না বাবা। ওখানে অনেক বিপদ থাকে। চঞ্চল মনে তখন সেবা করার ইচ্ছা টা দমিয়ে রাখতে পারি নি। কিন্তু এত বাজে মাও আমি না নিজের সন্তান কে জেনে শুনে বিপদে ফেলব। জীবন বিপন্নে রাখব। এলাকার বাজে কিছু লোকদের নজরে পরে গিয়েছিলাম আমি। আশঙ্কা করেছিলাম তোর ক্ষতির তাই বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। এতে তোর লেখাপড়ারও ভালো হবে ভেবেছি। কিন্তু তুই একেবারে দূরে চলে গেলি আমাদের থেকে।”

আহরার কাঁদার কারণে কিছু বলতে পারছে না। ঝাপসা চোখে তুরফার দিকে তাকায়। মেয়েটা তার জীবনের নূর। সবসময় পথ দেখায় নিজের আলো দিয়ে। আজ আবারও তাকে বাবা মা কে ফিরিয়ে দিল। আর তুরফারই জিতলো আজো। আহরার তুরফার দিকেই তাকিয়ে আছে। বউ হলে তো ওমনি হওয়ার উচিৎ। একদম নূরের মতো। নিজের আলো দিয়ে সবাই কে আলোকিত করবে।

আহরারের জীবন টা রঙ এ রঙ্গিন হয়ে গিয়েছে। তুরফা তার অস্বাভাবিক জীবন টা কে স্বাভাবিক করে দিয়েছে। কি সুন্দর আলোর পথে হাটিয়েছে তাকে। সুন্দর একটা জীবন উপহার দিল তাকে তার অর্ধাঙ্গিনী।

চাঁদের আলোয় বসে আছে দুজন ছাদে। মা বাবার সাথে তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে আজ এত বছর পর। মা নিজ হাতে রান্না করে নিজ হাতে খায়িয়ে দিয়েছেন তাকে। উনারাও ইচ্ছা পুষন করেছে নাতিনাতনির।
“তুরফা তুমি আমার জীবনের আলো। তুমি আলো দিয়ে পথ না দেখালে এমন হতোই না।”

“এটা আমার দায়িত্ব প্রিয়। নিজের স্বামী কে খুশি করা প্রতিটা স্ত্রীর প্রথম দায়িত্ব।”

“আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শুকরিয়া তোমাকে আমার করে পাঠানোর জন্যে। আমি চাই পরকালেও যেন আমি আমার স্ত্রী কে নিয়ে বেহেশতে যেতে পারি।”

“তার জন্যে আমল কিন্তু করতে হবে।”

“ইনশাল্লাহ নূরী বউ। আমার ভালোবাসা একটা।”

“আমিই একমাত্র নারী যাকে আপনার ভালোবাসতেই হবে।”

“জানি তো বউ টা আমার।”

আহরার একটা চুমু দিয়ে কোলে তুলে নিল তুরফা কে।
“আরে কোলে তুললেন কেন?”

“বাবা মার ইচ্ছা টা পূরণ করতে হবে না জান?”

“দেখুন ভালো হবে না কিন্তু।”

“খুব ভালো হবে।”
বলে আহরার তুরফার নাকে নাক ঘসল। ঘোর লাগানো চোখের দৃষ্টি দিয়ে সিঁড়ি নামতে লাগল আহরার। তুরফা তার কোলে থেকে লজ্জার হাসি দিচ্ছে।

বিছানায় কোমল ভাবে রাখল তুরফাকে। নেশাভরা চোখে তুরফার দিকে চেয়ে নিজের শার্টের বোতাম খুলল। তুরফার দিকে ঝুঁকল সে। গালে নরম করে হাত রাখল। আঙ্গুল দিয়ে তুরফার গাল স্লাইড করছে নাগাতার। একদম ঝুঁকে কপালে চুমু দিল। তুরফা মুচকি হাসল।
“তুর আমার ছোট্ট একটা বেবি চাই। যার বাস তোমার মাঝে হবে। আর তোমার মতোই যেন হয় সেই দোয়া করি। আজ ভালোবাসার এক পূর্ণ রাত উপহার দিব তোমায়। আহরারের চাওয়া পূর্ণ করার রাত হবে এটা হৃদহরণী।”
আহরার আবার তুরফার কপালে চুমু দিল। গালে চুমু দিল। নাকে নাক ঘষল। চোখ বন্ধ করে চুলের সুভাস নিল। সেটাই যেন আহরার কে আরো নেশা লাগিয়ে দিচ্ছে। মাতাল করে তুলছে তাকে। মুচকি হেসে আহরার তুরফার গলায় নাক ডুবাল। গলার পাশে ছোট্ট ছোট্ট চুমু দিতে লাগল। প্রতিটা ছুঁয়ায় তুরফা কেঁপে কেঁপে উঠছে। শিউরিয়ে উঠছে দেহ। শরীরে হীম শীতল হাওয়া বইছে। আহরার তুরফার কাঁধে নিজের নাক দিয়ে স্লাইড করছে। চোখ বন্ধ করে একের পর এক ভালোবাসার শীতল পরশ দিতে লাগল। আহরার ঘরের মৃদু আলোয় খেয়াল করল তুরফার ঠোঁট কাঁপছে। মুচকি হাসল সে। আহরার সেই কাঁপা ঠোঁটে নিজের অধর বুলাল। অধরে অধর স্পর্শ করল আহরার আর তার হৃদহরণীর। ঘোর লাগানো পরিবেশে আহরার বিড়বিড় করা অস্পষ্ট কন্ঠে বলল,
“তুই হৃদহরণী।”

সমাপ্ত।😍
#সাদিয়া

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here