তুই হৃদহরণী পর্ব ২৭

#তুই_হৃদহরণী – ২৭

আহরারের কথামতো হোটেল সাজানো হচ্ছে। সকাল থেকে ইচ্ছা করেই আহরার তুরফার সামনে যায় নি। তুরফার চোখ দুটি আনমনে না চাইতেই আহরার কে খুঁজচ্ছিল। কিন্তু তবুও নিজ থেকে যায়নি আহরারের সামনে। দুপুরের খাওয়ার সময় সবাই এক সাথে খেলেও আহরার আর লিনা ছিল না। তারা নাকি অন্য জায়গায় খেয়েছে। এটা শুনার পর তুরফা ভেতর থেকে একদম ভেঙ্গে পরে। ভেবে নেয় ‘এটাই তো হওয়ার ছিল।’ তবুও ভেতরে একটা ফুঁপানো কষ্ট হয়েই যায় তার।

সন্ধের দিকে তুরফা ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ভেতরে কি যে অসহনীয় এক কষ্ট হচ্ছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না। অস্থিরতার রেশ এক পলশাও কাটছে না। শুধু ইচ্ছা হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। ভেতরে মনে হচ্ছে পাহাড় সমান এক পাথর চাঁপা আছে। তুরফার কি করতে ইচ্ছা হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না। একটু আগে দুই ঘন্টার মতো শাওয়ার নিয়ে এসেছে তবুও ভেতরের জ্বলুনি গরম টা কমছে না। ভেতর থেকে গরম নিশ্বাস বের হয়ে আসছে বারবার। শরীর মন সব কিছু আগুনের মতো লাগছে। বড় বড় নিশ্বাস পরছে শুধু। দম টা তার আটকে আসছে। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখল। আজ নিজেকে তার বড্ড একা লাগছে। মূল্যহীন জীবন মনে হচ্ছে। নিজের অজান্তে কখন লোকটা তার মনে গিথে গিয়েছে সে নিজেও তা জানে না। মনের মানুষটা কে চোখের সামনে অন্য কারো সম্পদ হয়ে যাওয়া দেখাটা যেন মৃত্যুর সমান কষ্ট লাগে। মনে হয় এর থেকে মরণ খুব সহজ। ভেতরের ভয়ংকর চাঁপা কষ্ট টা কিছুতেই দূর করতে পারছে না তুরফা। চোখ বন্ধ অবস্থাতেই টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরল। হঠাৎ তুরফা ফুঁপিয়ে কান্না করা শুরু করল। অথচ যার জন্যে চোখের পানি ফেলা সে দেখছেও না আর জানেও না। হঠাৎ দরজায় কেউ ডাক দিল। তুরফা নাক টেনে চোখ মুছে। তারপর এগিয়ে যায়।

মোনতাহ্ আর ফিরাত দাঁড়িয়ে আছে। তুরফা মুখ লুকিয়ে ভেতরে চলে এলো।
“কাঁদছিলি তাই না?”

“….

“চোখ মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে।”

“ন না।”

“আমার থেকে লুকিয়ে লাভ নেই তুরি।”

“….

“তুরফা সত্যি তুমি কাঁদছিলে?”

“না ফিরাত ভাইয়া। এ এমনি কিছু না।”

“আহরার কে পছন্দ করে নিয়েছো তাই না?”

তুরফা কিছু না বলে তাচ্ছিল্যের একটা হাসি হাসল। যেন এমন কিছুই না।

“তুরি আমি জানি না তোর মনে আহরার ভাইয়ার জন্যে কি অনুভূতি আছে। তবে তোর মুখ দেখে আমার মনে হয় তুই ভেতরে কষ্ট পাচ্ছিস খুব। কিন্তু আহরার ভাইয়া হঠাৎ কেন এমন করার সিদ্ধান্ত নিল তা বুঝতে পারছি না।”

তুরফা মোনতাহ্ কে হুট করে জড়িয়ে ধরল। চোখ দিয়ে তিন চার ফোঁটা পানি চলে এলো। চোখের পানি আড়াল করে মুছে ফেলল তুরফা। মোনতাহ্-র দিকে তাকিয়ে বলল,
“বাদ দে। কেন এসেছিস?”

“এই গুলি দিতে।”

“কি এই গুলি?”

“খুলে দেখ।”

“….

শপিং খুলে দেখল গাউনের মতো এক বোরকা হিজাব। সাদার মাঝে সাদা স্টোনের ঝিলমিল কাজ। ভ্রু কুঁচকে তুরফা মোনতাহ্-র দিকে তাকায়।
“পরে নে এগুলি। আমাদের সবার জন্যে আহরার ভাইয়া শপিং করে দিয়েছে।”

“মানে।”

“হুম। রাগ করিস না পরে নে।”

“কিছুতেই না আমি কিছুতেই পরব না এগুলি।”

“দেখ তুরি আহরার ভাইয়া কিন্তু রাগ করবে।”

“রাখ তোর রাগ। উনার রাগের ধার ধারব আমি? পরব না এসব।”

আহরার এসে ফিরাত আর মোনতাহ্ কে যেতে বলল।

“চুপচাপ পরে রেডি হয়ে নিচে চলো।”

“না একদম না। আমি এসব কখনোই পরব না। মানে না।”

আহরার কথা না বাড়িয়ে তুরফার হাত শক্ত করে ধরে নিল। দেয়ালে দুই হাত চেঁপে ধরেছে। লাল লাল চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরুবে।
“চুপ করে রেডি হয়ে নাও এগুলি পরে। আমি তো তোমার অপেক্ষায় এনাউনস্টমেন্ট দেরি করব না।”
তুরফার চোখ দিয়ে টুপটুপ করে দুই ফোঁটা পানি পরল। আর সে গুলি আহরারের হাতেই পরেছে। মুহূর্তে আহরারের শরীর যেন কাটা দিয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে নিল সঙ্গেসঙ্গে। বন্ধ হওয়া দমের ফাঁপা নিশ্বাস ফেলল। তুরফা করুণ চোখে তাকিয়ে আছে আহরারের দিকে। তুরফার ওই চোখ দেখে আহরারের ভেতরে ঝড় উঠল। কিন্তু সব কিছু পাশে রেখে শান্ত গলায় বলল
“তুরফা একটুক্ষণের মাঝে রেডি হয়ে নাও। নয়তো আমি নিজে তোমায় রেডি করাব।”

তুরফা কিছু না বলে কান্না করছে। আহরার ছেড়ে দিল তুরফার হাত।

“১০ মিনিট পর যদি এসে দেখি রেডি হওনি তবে যা বলেছি তাই হবে। বাকিটা তোমার উপর তুরফা।”

তুরফা রেডি হয়ে নিচে যাওয়ার সময় আহরার কে সামনে পেল। কালো তে সেজেছে আহরার। সব কিছু কালো। শুধু দেহটা ছাড়া। কি যে সুদর্শন মোহময় লাগছে লোকটাকে তা বুঝানোর মতো নয়। আর সাদা বোরকায় তুরফা কে চমৎকার লাগছে। আহরার মুগ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। প্রথম দিন তুরফাকে বোরকা পরা অবস্থায় দেখার সময়টা মনে পরছে আহরারের। রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি হলো ভেতরে। তীক্ষ্ণ গলায় আহরার বলল,
“লিনা কে ডেকে নিয়ে আসো।”

“….

“তুরফা তোমাকে বলছি।”

“আ আমি?”

“প্লিজ যাও তাড়াতাড়ি করো। ওদিকে সবাই ওয়েট করছে।”
ভেতরে কষ্ট নিয়ে তুরফা এগিয়ে গেল। একেকটা পা ফেলছে আর মনে হচ্ছে ধারালো কোনো পথে এগিয়ে যাচ্ছে সে। প্রতিটা পা ফেলায় পা গুলি কেটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। লিনার ঘরের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছে তত দম বন্ধ হয়ে আসছে। লিনার ঘরে যাওয়ার আগে একটা ঘরে চোখ আটকে গেল তুরফার। থমকে দাঁড়াল ভ্রুকুঞ্চন করে। দরজা হাল্কা ফাঁক। ফরেন্সিদের মতো সেই ধবল লোকটা যার সাথে লিনা ফ্লাইটে বসেছিল। হেসে হেসে কথা বলছিল। লোকটা একজন কে জড়িয়ে রেখেছে। পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটার মুখ টা। তবে খুব চেনা লাগছে। একটু দাঁড়িয়ে থেকে তুরফা ভাবল এভাবে দেখাটা অন্যায়। তাই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক তখনি একটা চেনা কন্ঠের ডাক শুনল “ইয়োক।” তার ধারণা একদম ঠিক। এটা লিনা-ই। তুরফা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। আহরারের কথা চিন্তা করে মাথায় কিছুই আসছে না তার। ওদিকে লিনা ইয়োক কে জড়িয়ে ধরে বলছে “আই লাভ ইউ হানি।” তুরফা যেন মারাত্মক রেগে গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে গেল। লিনার বাহু শক্ত করে ধরে তার দিকে ফিরায়। কাজল রাঙ্গা চোখ গুলি লাল হয়ে উঠেছে। খানিক চমকাল লিনা। বলল
“তুরফা তুমি?”

“ছি লিনা ছি। একটু পর যার সাথে আপনার সারাটা জীবন কাটাতে হবে তাকে ঠকাচ্ছেন আপনি? ছি। তাকে রেখে অন্য একজনের কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করছেন আপনি? প্রেম নিবেদন একে করছেন উনাকে রেখে ছি?”

“….

“যে মানুষটা অবশেষে ঠিক করেছে আপনাকে বিয়ে করবে সেই মানুষটার সাথে প্রতারণা করছে আপনি? ছি লিনা ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।”

লিনা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

“কি কি হয়েছে এখানে? তুরফা আমি তোমাকে বলেছিলাম লিনা কে ডেকে আনতে। আর তুমি, লিনা ইয়োকের ঘরে কি করছো? তোমার দেরি হচ্ছে বলে লিনার ঘরে যাওয়ার সময় তোমার কথা শুনে এখানে এলাম। তুরফা তোমার দ্বারা কি একটা কাজও হবে না? আর লিনা তুই এখানে কেন?”
তুরফা কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে বলতে গিয়ে। তবুও বলতে তো হবে। কারণ এটা উনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হচ্ছে।

“কি হলো লিনা?”

“….

“আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে। আপনার কষ্ট হলেও এটা সত্যি লিনা ইয়োক কে ভালোবাসে। হ্যাঁ। আমি লিনা কে ডাকতে এসে ইয়োকের সাথে দেখেছি। ইয়োক কে সে ভালোবাসে এটা বলতেও শুনেছি আমি।”

আহরার অবাক চোখে তাকাল লিনার দিকে।
“লিনা তুই….”

কথা শেষ না করে আহরার রুম থেকে বের হয়ে গেল। তুরফা খুব ভয় পেল এতে। কিছু আশঙ্কা করল। একবার লিনা আর ইয়োকের দিকে তাকিয়ে আহরারের পেছন পেছন ছুটল।

আহরার হঠাৎ দাঁড়াল। উপর থেকে দেখাই যাচ্ছে অস্বস্তি হচ্ছে তার। তুরফা লম্বা পায়ে গিয়ে ধরল আহরার কে।
“আপনি ঠিক আছেন?”

“….

“পানি দিব কি? ঠিক আছেন তো আপনি?”

আহরার তুরফার বাহু ধরে নিল। খানিক ক্রুদ্ধ হয়েই বলল
“আমি ঠিক থাকলেও আমার প্রেস্টিজের কি হবে?”

“ছাড়ুন লাগছে আমার।”

“…

“কি কি হয়েছে?”

“ছেলে মেয়ে হয়নি এনাউনস্টমেন্ট হয়েছে।”

“এখন কি হবে?”

“যা হবার তাই হবে।”
বলেই আহরার তুরফার হাতের কব্জি শক্ত করে ধরল। ভীষণ ভয় পেল সে। লেগে আসা গলায় আমতাআমতা করে বলল,
“মা মানে?”

“মানে আজ ওখানে আমার সাথে তোমার বিয়ে হবে।”

“কি?”

“জ্বি।”

“আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”

“তোমার কি মনে হয় তুমি বললেই আমি শুনছি? আর তুমি নিশ্চয় চাইবে না তোমার জন্যে তোমার বান্ধবীর সংসার নষ্ট হোক। এটা হয়তো ভালো করেই বুঝেছো আমি ফিরাত কে যা বলব ও তাই শুনবে। ইচ্ছে না থাকা সর্তেও শুনবে। তুমি বিয়েতে রাজি না হলে মোনতাহ্-র বিয়ে টা টিকবে না।”

তুরফার চোখে হঠাৎ-ই রাগের দেখ মিলল। রাগে কিটকিট করছে। শরীর রিরি করছে তার। আহরারের জন্যে যে টুক ভালো লাগা ছিল সেটাও উবে গেল।

“আপনি এমন মানুষ ছি। এত টা নিচ? আপনার জন্যে একটু আগেও মায়া হচ্ছিল আমার। আর এখন শুধুই ঘৃণা। এতটা নিচ মনমানসিকতা আপনার? আপনি এসব কি করে বলতে পারছেন মিস্টার আহরার?”

“মানে টা খুব সহজ। আমি সামান্য কারণে আমার মান সম্মান নষ্ট করতে পারি না। এত এত লোক, প্রেস মিডিয়া সবার সামনে নিজের মান সম্মান টা শেষ হয়ে যাবে আর আমি বসে বসে দেখব তা? আহরার এমন নয়। তোমাকে একবার সুযোগ দিয়েছি মেনে নেওয়ার নাও নি। অমত করেছো। তাই আমার সম্মান বাঁচাতে আমাকে এটা করতে আর বলতেই হলো। কিছু করার নেই আমার। নিজের সম্মান নষ্ট করতে পারি না আমি। এটা আমাকে করতেই হবে। আর তুমি বাধ্য হৃদহরণী। আমাকে তোমার বিয়ে করতেই হবে তুর।”

চলবে….
#সাদিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here