তুই হৃদহরণী পর্ব ২৬

#তুই_হৃদহরণী – ২৬

সকালে তুরফার ঘরের দরজা অনেক ডেকেও তাকে বাহিরে আনতে পারল না। আহরার নিজেও গিয়েছিল ডাকতে। ভেবেছিল যাবে না কিন্তু মেয়েটা না খেয়ে থাকবে ভেবে পরে গেল। দরজা ধাক্কাল কিন্তু খুলল না তুরফা।
“তুরফা দরজাটা খুলো বলছি।”

“….

“তুরফা সকালের নাস্তা টা খেয়ে ঘরে বসে থাকো। তুরফা।”

“….

“দরজা কিন্তু আমি ভেঙ্গে ফেলব।”

“আপনার কাছে আমার অনুরোধ দয়া করে, দয়া করে আমাকে একা থাকতে দিন। যান এখন।”

আহরার কিছু বলতে চেয়েও বলল না। চলে গিয়েছিল।

তুরফা সময় মতো বোরকা পরে নিচে নামল। মুখটা শুষ্ক। আহরার তার নেকাবের নিচেও যেন সে পাণ্ডুর মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। কিছু বলল না। মোনতাহ্ আর ফিরাতও নিচে এলো নিজেদের লাগেজ নিয়ে। তুরফা মোনতাহ্ কে দেখে বলল,
“তোরা ইয়ারপোর্ট চলে যা আমি বাসা থেকে কাপড় নিয়ে আসছি।”

“সে কি কাল আনিস নি তুরি?”

তুরফা আহরারের দিকে রাগি চোখ নিয়ে তাকিয়েই জবাব দিল।
“তা আর পারলাম কই? তোরা যা আমার বেশি সময় লাগবে না।”

“তার দরকার নেই এই লাগেজ তোমার। তোমার কাপড় আছে কিছু নতুন। আর এমনিতেও বেশি সময় নেই। চলো সবাই।”

“তার দরকার নে..”

“চুপচাপ চলো।”

আহরার লিনা আর তুরফা বসেছে এক গাড়িতে আর ফিরাত ও মোনতাহ্ যাচ্ছে আরেক গাড়ি তে। আহরারের সাথে লিনা বসেছে। ফোন ঘাঁটছে সে। আর তুরফা পিছনে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। চরম বিরক্তি আর বিব্রতকর সময় যাচ্ছে তার। মনে হচ্ছে হয় গাড়ি এখানেই থেমে যাক আর নয় তাড়াতাড়ি ইয়ারপোর্ট যাক। তুরফা বলেছিল মোনতাহ্-র সাথে গাড়িতে যাবে। আহরার ওর হাত ধরে বলেছিল “নতুন বিয়ে ওদের। প্রাইভেসি টা এখন ওদের সবচেয়ে বেশি দরকার। বোকার মতো কথা বলো না চলো।”

সব কাজ শেষ করে অবশেষে তারা ফ্লাইটে গিয়ে উঠল। আহরার দুই সিটের একটায় গিয়ে বসল। লিনা কে ডাকল তার সাথে। তুরফা বিষয়টায় রাগ করল না কষ্ট পেল বুঝল না। হয়তো দুটোর সংমিশ্রণ। ভেতরে ধড়ফড়ানি এক কষ্ট লাগছে। আহরার তুরফার টলমল চোখের দিকে চেয়ে নামিয়ে নিল চোখ। লিনা সাথে গিয়ে বসল আহরারের। তুরফা গিয়ে মিহিরের সাথে বসল। মিহির অল্প হাসল তুরফার দিকে তাকিয়ে। তুরফা কিছু না বলে মুখ ঘুরাল। মাথা উঁচু করে আহরার তা দেখেও চুপ রইল। ছটফটানি ভাব দেহে আসলেও দমে রইল। ভেতরের নরম মাংসপিণ্ড টা অনবরত উঠানামা করার ধুকবুক শব্দ আসছে স্পষ্ট। হঠাৎ লিনা সিট থেকে উঠে গেল। ইয়োকের সাথে বসবে বলে।
“কোথায় যাচ্ছিস লিনা?”

“ইয়োক এসেছে। আমার সাথে ওর দরকার আছে। তুই থাক আমি ওর সাথে গিয়ে বসি। প্লিজ প্লিজ।”

“ওকে যা।”
লিনা নিজের বন্ধু ইয়োকের সাথে গিয়ে বসল। ঘাড় ঘুরিয়ে তুরফা বিষয়টা দেখেও কিছু বুঝল না। ভ্রুকুটি করে বসেই রইল। তার মধ্যেই আহরার এলো ওর সিটে।
“উঠো।”

“তোমায় বলছি তুরফা। উঠো।”

“….

“তাকিয়ে থাকতে বলিনি উঠতে বলেছি উঠো।”

“কেন উঠব?”

“বসবে তাই।”

“আমি তো বসেই আছি।”

আহরার হাত টা ধরল তুরফার। হেঁচকা টানে উঠাল তাকে কে।
“তুমি এখানে নয় আমার পাশের সিটে বসবে। নাও গো।”
তুরফা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে সিটের উপর নিয়ে ধাক্কা দিয়ে বসিয়েই সিট বেলটা লাগিয়ে দিল।
“যদি মাছের মতো এত ছটফট আর পাখির মতো ডানা ঝাপটিও না তবে এই ফ্লাইট থেকেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব। তখন যত ইচ্ছা ডানা ঝাপটিও। কেমন?”

আহরার বই পড়ছিল। হঠাৎ চোখ গেল তুরফার দিকে। ঘুমে বিহ্বল হয়ে আছে। কাঁধের পাশ দিয়ে বারবার তুরফার মাথা ঘেঁষে যাচ্ছে। আহরার নিজের কাঁধ ওর দিকে এগিয়ে নিল। তুরফার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলে শরীর কেমন শিউরে উঠল। তুরফার দিকে চেয়ে প্রশান্তির হাসি টানল।

ফ্লাইট ল্যান্ড হলে সবাই এক গাড়ি করে একটা হোটেলে চলে যায়। এখানে সে খুব এসেছে। তাই সার সাথে বেশ পরিচিত। হোটেলে পৌঁছে সবাই সবার রুমে গেল। মোনতাহ্ ফিরাত একটা কোণার রুমে। তার পাশে আহরারের। তার পাশের রুমটা তুরফার। লিনা কে অপর দিকের একটা রুমে দেওয়া হয়েছে। বাকি চারজন অফিস স্টার্ফের জন্যে দুইটা রুম দেওয়া হয়েছে।

তুরফা নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পরল। শরীর টা বড্ড ক্লান্তি লাগছে। ফ্রেশ হয়ে এসেই ঘুমাবে একটু। কিন্তু পরবে টা কি? চোখ লাগেজের উপর যেতেই মনে হলো খোলে দেখবে কি আছে। বিছানা থেকে উঠে লাগেজ খুলল। অনেক গুলি ড্রেস দেখল। আহরারের কথা চিন্তা না করে ড্রেস নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। এক ঘন্টার মতো শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেই বিছানায় গা বুলাল। বাহির থেকে খাবারের জন্যে অনেকে ডাকলেও ঘুম থেকে উঠল না। শরীর এমনি তেই নিস্তেজ ঘুম না হলে তো বোধহয় প্রাণ টাই বের হয়ে যাবে।

লিনা ফ্রেশ হয়ে অনেকটা চুপিচুপি পায়ে কয়েকটা রুমে এগিয়ে গেল। যেন খুব সাবধানতা অবলম্বন করল নিজের এই ছোট কাজে। দরজার সামনে কলিংবেল চাঁপতেই ওপাশের লোকটা দরজা খুলে দিয়ে মুচকি হাসল। লিনাও মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরল লোকটি কে।

ফিরাত ফ্রেশ হয়ে এসে মোনতাহ্ কে জড়িয়ে নিল পিছন থেকে।
“হচ্ছে কি?”

“আদর।”

“ছাড়ো তো।”

“একদমই না।”

“দেখো বেশি হচ্ছে এখন।”

“হোক তাতে তোমার কি?”

“আজব তো। ছাড়বে নাকি এই ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে ভূত নামব।”

“ছি চাঁদ তুমি তোমার স্বামী কে, নিজের স্বামী কে এমন একটা কথা বলতে পারলে?”

“….

“ছি।”

“হয়েছে এখন ছাড়ো।”

“এখন তো একটুও ছাড়ব না।”
বলে ফিরাত শক্ত হাতে ধরল মোনতাহ্ কে।

“ইউ নো চাঁদ এখানে আমি অফিসের কাজে আসিনি এসেছি তোমার সাথে হানিমুন করতে। গট ইট?”
হুট করে মোনতাহ্ কে কোলে তুলে নিল সে।

“আরে আরে কি…”

“কিছু করিনি এখনো। কিন্তু করব। আদর। আজ চাঁদ কে নিয়ে নতুন অন্যরকম এক আলো দেখাব। আদর সোহাগের রাতে চাঁদ কে আলোকিত করব।”

আহরার ব্যালকুনিতে বসে আছে। উপর তলা থেকে নিচের হাল্কা মৃদু আলো আসছে। ব্যালকুনির ডিভানে আনমনে বসে ভাবছে। সেই স্বপ্নের কথা মনে যতবার হচ্ছে ততবারই যেন সে বিচলিত হচ্ছে। আর আগামীকাল কি হবে তা মনে করে সে বিব্রতবোধ করছে। অস্থিরতা তাকে পরম আদরে জড়িয়ে নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে নিল। হাতে থাকা নিকোটিনের ধোঁয়া আপন মনে উপরে উঠে যাচ্ছে। টান দিতে চেয়েও যেন কিছুর কারণে ঠোঁট পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে না তার। অল্প আগুনের ফুলঙ্গি হাতে লাগতেই আহরার খানিক শব্দ করে আঙ্গুলের ফাঁক থেকে ফেলে দিল সিগারেট টা। নিজ নিজেই বলতে লাগল।
“রাত কখন শেষ হবে? কখন অন্ধকার গুঁজবে তোমার? কখন তোমায় ঠেলে দিয়ে আলোর আগমন হবে? এই টুক সময়ও যেন ধৈর্য নিয়ে থাকতে পারছি না আমি। আলো কখন আসবে তুমি? আমার ছটফটানি হয়তো তোমার আগমনেই অন্তঃ হবে। দিনের আলো ফুটলে হয়তো আমার জীবনের অন্ধকারটাও শেষ হওয়া শুরু হবে। স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে আহরার চৌধুরী জানে। আর বড় ও বিরল কিছু পেতে ছোট ত্যাগও স্বীকার করতে জানি আমি। কালকের আলোর জন্যে অধীর অপেক্ষা করছি। যা করেছি তুর তার জন্যে দুঃখিত। আর যা হবার তাও কাল হবে তুর।

চলবে….
#সাদিয়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here