তুই হৃদহরণী পর্ব ২০

#তুই_হৃদহরণী – ২০

“অপছন্দের মানুষেরও কষ্টের কথা শুনলে বুকের ভেতর রু রু করা অনুভূতি হয়। মন অনেক খানি গলেও যায়।”
তুরফার ভেতরে আজ অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে। বুকে ধুকবুক করা অনুভূতি হচ্ছে। অফিসের ভেতর যেতেও পা কাঁপছে থরথর করে। অথচ সে সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অফিসের। পিটপিট পায়ে তুরফা ভেতরে গেল। কেবিনে গিয়ে দেখল আহরার আসে নি। মনের কোণে কেমন মন মরার আভাস পাচ্ছে সে। আহরারের সিটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পর্দা অল্প সরিয়ে নিজের টেবিলে চলে গেল। বারবার দুটো করুন চোখে তাকালো আহরারের টেবিলের দিকে।

আজ আহরার বেশ সময় করে এসেছে অফিসে। নিজের সিটে বসতেই তুরফা এগিয়ে এলো পর্দা ঠেলে। জিজ্ঞেস করল
“আপনি ঠিক আছেন?”
আহরার স্লান দৃষ্টিতে তাকালো তবে কোন জবাব দিল না।
“কি হলো? বলুন?”

“…..

“কাল কি হয়েছিল? কেন কষ্ট..”

“তুরফা আমি কারো করুণা চাইনা।”
আহারার এর কথায় থমকে গেল তুরফা। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না। তাই চুপচাপ নিজের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। যাওয়ার সময় একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল আহরার কে। অস্থির দেখাচ্ছিল তাকে খুব। মুখ নেতিয়ে গেল তুরফার। ফাইলে মনোযোগ দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। চোখ দুটি বারবার ওপাশের দিকে যাচ্ছে। একটু পর আবার উঠে গেল আহরারের সামনে।
“আপনার কিছু লাগবে চা বা কফি?”
আহরার মাথা তুলে তাকালো তুরফার দিকে ভ্রুকুটি করে।
“কি হলো? কি লাগবে বলুন?”

“আমার কিছু লাগবে না।”

“….

“মিস তুরফা আপনি গিয়ে কাজ করুন।”

“কিছু লাগবে না আপনার?”
মন মরা হয়ে বলল তুরফা।
“আমার কিছুই লাগবে না আপনি গিয়ে ফাইলগুলো দেখুন।”
বেশ ধমকের সুরেই বললো আহরার। তাতে তুরফা অনেকটা থমথমে হয়ে গেল। চুপচাপ নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল মুখ গোমড়া করে। আরহারের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ভেংচি কাটলো তুরফা। খানিক রাগও উঠছে তার উপর তুরফার। একটু একটু ফুসছে ভিতরে ভিতরে। সেও নাছোড়বান্দা নয় কিছু একটা করবে। রাগী চোখ নিয়ে পর্দার ওপারে আহরার কে দেখলো আর মনে মনে কিছু একটা ভাবল। দুপুরে খাবার জন্যে ক্যান্টিনে না গিয়ে তুরফা আহরারের টেবিলে গেল।
“সেদিন আপনি আমার টেবিলে খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন আজ আমি আপনার টেবিলে খাবার নিয়ে বসব।”
আহরারের মেজাজ গরম হলো। তবুও শান্ত থেকে বলল,
“তুরফা তুমি গিয়ে খেয়ে নাও নিজের টেবিলে আমার ভালো লাগছে না। বড় কথা কাজ আছে। যাও।”

“না যাবো না। সেদিন আমিও আপনাকে যেতে বলেছিলাম কিন্তু আপনি শুনেন নি। তাই আমিও শুনব না। আজ আপনার টেবিলেই খাওয়া হবে। ব্যস।”

“তুরফা যা বলছি তাই শুনো।”

“না মানে না বললাম তো না। আজ এখানেই খাবো।”

“শাট আপ ননসেন্স। জাস্ট শাট আপ।”
চেঁচিয়ে বলল আহরার। তুরফা ভয় পেয়ে গেল। ভেতরে গুটিয়ে গেল একেবারে। চোখের সামনে আগের সেই রুক্ষ আহরার কে দেখে আগের মতোই সে ভয় পেতে লাগল। মুখ টা পানসে করে আনল। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
আহরার বেশ জোরে জোরেই বলতে লাগল।
“কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না কি বলছি তোমায়? কখন থেকে বলছি যাও যাও যাও তুমি যাচ্ছই না। কি হয়েছে তোমার আজ? অন্য সময় তো আমি তোমার কাছে যাই কিন্তু তুমি? তুমি কি করো বলতো একটু চিন্তা করো তো। অন্য সময় তো তোমার বাহানা শেষ হয় না। এই কাজ আছে, এই ফাইল আছে, সরুন, ছাড়ুন, আরো কত কি! আজ আমি বলছি তুমি যাও তুমি কেন শুনতে পাচ্ছ না আমার কথা? বুঝতে পারছো না আমি কি বলছি? আমি তোমাকে গিয়ে তোমার কাজ করার কথা বলছি। কি এমন হলো আজ? একটু পর পর আসছো? না হলে তো আমার ছায়া টাও সহ্য করতে পাড়ো না। দেখছ কাজে আছি ব্যস্ত আছি। তোমায় যেতে বলছি আর তুমি শুনছোই না? যাও নিজের কাজ করো গিয়ে। আর প্লিজ ফের আমায় বিরক্ত করতে এসো না। Now go back.”
এক নাগাড়ে বলে আহরার দম নিল। অন্য দিকে মুখ নিয়ে জোরে নিশ্বাস ফেলল। তুরফা ঠাই দাঁড়িয়ে। টলমল চোখ তার। সামনের মানুষটাকে ঝাপসা দেখছে। ভেতরে প্রচন্ড কষ্টের জ্বালা হচ্ছে। কিছু বলতে পাড়ল না কারণ গলা আটকে আসছে। ভেতরের সব কষ্ট দলা পাকিয়ে বসেছে গলায়। পা গুলি এগুচ্ছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরে কেমন এক কষ্ট হচ্ছে তা নিজের বুঝতে পারছে না। খুব দরকার ছিল মানুষটার এই ভাবে কথা বলার? কাল রাতের কারণেই তো এসেছিল কথা বলতে। কষ্ট হচ্ছে বলল কেন তখন? এটা না বললে কি আর সে আসত? ভেবেছিল মানুষ টা কষ্টে আছে তাই একটু লাঘব করার চেষ্টার জন্যে এসেছিল। মায়াও হচ্ছিল খুব। কিন্তু কি ব্যবহার দিল লোক টা? তুরফার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছু চিন্তার করতে পারছে না। টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি পড়ে গেল চোখ দিয়ে। তুরফা মাথা নুয়িয়ে চলে এলো ওখান থেকে। তুরফা যাওয়ার পরই আহরার দপ করে নিজের নরম চেয়ারে বসে পড়ল। খুব রাগ হচ্ছে। ভেতরে শান্তি পাচ্ছে না তুরফা কে কথা গুলি বলে। বাহিরে তাকিয়ে জোরে জোরে কয়েক বার নিশ্বাস নিল। তারই বা কি করার আছে? সে নিজেও কষ্টে আছে। একে তো জীবনের এত কষ্ট তারপর আরেক জন এসে হাজির হচ্ছে। কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। লিনা আসছে যে।

আনমনে তুরফা কেঁদেই গেল। অনেকক্ষণ কাঁদল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। চোখ গুলি প্রায় ফুলে উঠেছে। নাকের ঢগা লাল হয়ে আছে। চোখ মুছে উঠল তুরফা। এত কিছুর পরেও আবার গেল আহরারের টেবিল। গিয়ে নিরব হয়ে দাঁড়াল। আহরার তীক্ষ্ণ গলায় বলল,
“আবার কি? কেন এসেছো আ..”

“ছুটি চাই। বাসায় যাচ্ছি আমি। কাজ না হয় কাল করে দিব।”
তুরফা আর দাঁড়াল না চুপ করে বের হয়ে গেল কেবিন থেকে। আহরার শুধু তাকিয়ে দেখল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনমনে বলল “সরি তুর।”

তুরফা বাসায় গিয়ে বোরকা খুলে কান্না করতে লাগল। খুব কষ্ট হচ্ছে। কেঁদে কেঁদে বলল “আল্লাহ যদি পাড়তাম আজি চাকরি টা ছেড়ে চলে আসতাম। ওমন মানুষ মনে হয় না আর আছে দুনিয়াতে।” তুরফা নাক টেনে কাঁদছে। বাসায় একা। মোনতাহ্ স্কুলে। চোখ মুখের অবস্থা দেখে শাওয়ার নিতে চলে গেল তুরফা। না খেয়ে চুপ করে এসে শুয়ে পড়ল। চোখ গুলি জ্বলছে। খুব ঘুমঘুম পাচ্ছে। বিছানায় গা দিতেই শান্তি তে ঘুমিয়ে গেল।

আহরারের ফোনে কল আসল। তার বাবা কল দিয়েছেন। ফোন দেখে একবার ধরতে চেয়েও ধরল না। অফ করে রেখে দিল।

সেই যে তুরফা ঘুমিয়েছে বিকাল বিকাল আর উঠে নি। হাল্কা কথার আওয়াজ আসছে কানে যার ফলে ঘুম হাল্কা হচ্ছে। তুরফা আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠল। মাথায় উড়না দিয়ে হাই তুলতে তুলতে সিঁড়ি দিয়ে নামল। নিচের দিকে তাকালে দেখতে পেল মোনতাহ্, ফিরাত আর আহরার কথা বলছে। আহরার বিস্মিত কোমল নয়নে দেখছে সদ্য ঘুম থেকে উঠে আসা ঘুমপরী হৃদহরণী কে। ভেতরে ধুকবুক বাড়ছে তার। রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। তুরফার ওমন চোখ মুখ। মাথায় ঘোমটা টানা, গালের দুপাশে কপালের কিছু ঝুলছে ওড়না দিয়ে উঁকি দিয়ে। অদ্ভুত মোহনীয় লাগছে তাকে। আহরার হতবাক হয়ে দেখছে তুরফা কে। তুরফা মাথার কাপড় টেনে তাড়াতাড়ি আবার উপরে চলে গেল। আহরার এক গালে হাসল। চোখের সামনে এখনো সেই মুখ টাই ভাসছে।
“তো এটাই ঠিক হলো। কাল কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হবে। সব ব্যবস্থা আমি করে নিব। আপনারা কথা বলুন আমি একটু আসছি।”
আহরার তাড়াতাড়ি করে সেখান থেকে উঠে উপরে গেল। তুরফা ওয়াশরুমে গিয়েছে। বের হয়ে দেখতে পেল আহরার তার রুমের দিকেই এগিয়ে আসছে। গিয়ে দরজা বন্ধ করার আগেই সে ভেতরে ঢুকে গেল। পিছন ফিরে দরজা ধপাস করে লাগিয়ে দিল। তুরফার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল। তুরফা ভয়ে পিছিয়ে গেল টাওয়াল হাতে। মাথায় কাপড় নেই। তারই ভুল দরজা বন্ধ করে যাওয়া উচিৎ ছিল। ভয়ে পা পিছনে ফেলতে শুরু করল তুরফা। ভেতর শুকিয়ে আসছে। আহরার কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখল তুরফা কে। তারপর মোহিত নয়নে এগিয়ে আসতে লাগল ওর দিকে। কি রুপ মোহমতীর। যেন উপচে পড়ছে রূপেরমোহ। আশ্চর্যান্বিত নয়নে বিমুগ্ধ হচ্ছে আহরার। তুরফা হন্তদন্ত হয়ে বিছানা থেকে ওড়না টা টেনে কোনো রকম ঢেকে নিল। চুপষে যাওয়া মুখে বিড়বিড় করে বলল,
“আ আপনি এ এখানে?”

“….
আহরার বিমোহিত নয়নে পা বাড়াচ্ছে। তুরফা যেতে যেতে একসময় বিছানার পায়ায় লেগে পড়ে গেল বিছানায়। চোখ বন্ধ করে খিঁচে বসে আছে। আহরার একদম এগিয়ে এলো তুরফার দিকে। ওর দিকে একটু ঝুঁকে ওড়নায় হাত দিল আহরার। তুরফা চোখ বুজেও বুঝতে পাড়ল তা। ভয়ে কলিজা চিঁপা দিয়ে উঠল। শঙ্কায় আত্মা কাঁপতে শুরু করেছে। ভিজে ঠোঁট অনবরত কাঁপছে। আহরার সেদিকে নজর দিল এক ধ্যানে। মনে হচ্ছে দুটি কোমল গোলাপ নড়ছে। এক গালে একটু হেসে ওড়না তুরফার ঘাড়ের দিকে তুলে ভালো করে ঢেকে দিল। এর জন্যে এভাবে আসছিল সে। আহরারের খুব হাসি পাচ্ছে ভেতরের হাসি কষ্টে চেঁপে রেখে বলল,
“তখনের জন্যে সরি। I was worried. কিছু নিয়ে চিন্তায় ছিলাম তখন। সরি।”

“….

“চুপ কেন এখন? তখন তো খুব বকবক করছিলে?”

“একটু স সরুন।”
তুরফার মুখে এহেন কথায় আহরার নিজের দিকে তাকাল। তার আর তুরফা মাঝে অল্প একটু ব্যবধান। আহরার বাঁকা হেসে আরো একটু ঝুঁকল তুরফার দিকে।
“কেন? আরো কাছে আসলে কি এমন হবে? না হয় আরো একটু কাছে এ..”

“মা মানে? কি বলছেন আপনি এসব?”
কথা শেষ করার আগেই তুরফা আহরার কে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে তা খুলে দিয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়াল। আড়চোখে দেখল আহরার কে। সে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবেই ঘাটের কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। বাঁকা হাসছে তুরফার ভয় দেখে। মনে মনে কিছু ভেবে আবারও মুচকি হাসল।
“এ সবই বৃথা হৃদহরণী।”
আহরার তাকাল তুরফার দিকে। আহরারের চোখে চোখ পরতেই তুরফা মাথা নুয়িয়ে নিল। ওড়না টা ভালো করে ঠিক করে নিল। বড্ড হাসি পাচ্ছে তুরফার এমন বোকা মুখ দেখে। চেয়েও যেন হাসি আটকাতে পারছে না আহরার। খানিক বাঁকা হেসে তুরফার দিকে এগিয়ে গেল। আহরার কে এগিয়ে আসতে দেখে তুরফা দুই পা পিছিয়ে যায়। দরজার সাথে পিট আটকেছে। আহরার মুচকি হেসে একহাত দরজায় রাখে। তুরফার মুখের দিকে অপলক তাকায়। তুরফা ভয়ে জমে গিয়েছে। পারলে যেন দরজার সাথেই মিশে যায়। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ধম মেরে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বুজে। নিশ্বাস ঘন হচ্ছে। পা এগিয়ে চলছে না। হৃদহয়ের স্পন্দন বাড়ছে। আহরার তুরফার ওমন মুখ গভীর চোখে মন দিয়ে দেখল। নেশাভরা কন্ঠে নরম হয়ে বলল,
“কাল মোনতাহ্ র বিয়ে চলে এসো। জানো তো বিয়ে টা আমার বাড়িতে হচ্ছে। আর কাল ওখানেই থাকা হবে হৃদহরণী। কি জানি কি হয়? কে বলতে পাড়ে ভাগ্য কখন ঘুরে যায়? আকস্মিক কিছু না হয়ে যায়।”
আহরার থামল। তুরফার মুখের দিকে তাকিয়ে মুক্তঝরা হাসি দেয়। ঠোঁট কামড়ে ধরল আহরার নিজের তুরফার ভয় মাখা মুখের দিকে চেয়ে। আহরার মুচকি হেসে হাল্কা ফুঁ দিল তুরফার মুখে। এবার তুরফা বরফের মতো জমে গেল। আগের মতো নিশ্বাস নিতে পারছে না বরং দম বন্ধ হয়ে আসছে। এখনি বুঝি প্রাণপাখী বের হবে দেহ পিঞ্জিরা থেকে। আহরার মুচকি হেসে ফোন নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। তুরফা পিনপিন করে চোখ খুলে দেখতে পেল আহরার চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে আহরার ঘাড় ফিরিয়ে এক গালে হাসি দিল তুরফা কে। তুরফা বিস্মিত চোখে হতভম্ব হয়ে দেখল সেই মন্ত্র মুগ্ধ হাসি। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তুরফা বিমুঢ় হয়ে কয়েকবার চোখের পাতা ফেলল।

চলবে….
#সাদিয়া
(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here