#তুই_হৃদহরণী – ২৩
আহরার টানতে টানতে তুরফা কে নিয়ে বাগানের কাছে গেল। তুরফা কে দাঁড় করিয়ে নিজের মতো ফটোশুট করতে লাগল। তুরফা কে বিব্রত অবস্থায় দেখে আহরার রাগল খানিক। ছবি তেমন ভালো আসছে না। রেগে আহরার বলল,
“তুরফা ঠিক করে ছবি না তুললে না ওই সুইমিংপুল দেখছো না? পানির মাঝে ডাবিয়ে ধরে রাখব। তাহলে ভালো লাগবে।”
আহরারের এমন কথায় তুরফা থমথমে হয়ে গেল। ভয়ও পেল অনেক টা। তাই আহরার যেভাবে বলছে তুরফাও সেভাবে ছবি তুলার চেষ্টা করছে। হাল্কা বাতাসে যখন তুরফার চুল দুলছিল তখন সে নিজ মনেই হেসে উঠে। তুরফা কে ওমন অবস্থায় দেখে আহরারের ভেতর মুচড় দিয়ে উঠল। কি যেন ছুটে গেল সারা শরীর দিয়ে। আহরার চোখের সামনে থেকে ক্যামেরা সরাল। এগিয়ে গেল তুরফার দিকে। তুরফা কে কিছু বুঝে উঠার সময় না দিয়ে আহরার তার কোমর পেঁচিয়ে আনে। আরো মিশিয়ে নেয় নিজের সাথে। সামনের উড়তে থাকা চুল গুলি সরিয়ে দেয়। তুরফার ভেতর কাঁপছে। টলমল চোখে আহরার কে দেখছে। আহরার ওর দিকে মুখ বাড়িয়ে দেয়। তুরফার চিন্তা ভাবনা সব কিছু লোপ পেয়েছে। ভেতরের কাজ বন্ধ হয়ে আসছে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল চোখ মুখ খিঁচে। আহরার খুব কাছ থেকে তুরফা কে দেখল। তারপর মুখ বাড়িয়ে দিল তুরফার মুখের পাশ দিকে। আহরার চোখ বন্ধ করে তুরফার সুস্নিগ্ধ চুলের সুভাস নিতে থাকে। আহরার যেন ঘোর রাজ্যে চলে গিয়েছে। কি মারাত্মক ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে কাউ কে বুঝাতে পারবে না সে। আহরার মনে হচ্ছে প্রশান্তি রাজ্যের রাজা। শরীর শীতল হয়ে আসছে সেই সুঘ্রাণে। আহরার চোখ বন্ধ রেখে অনুভব করছে ঠোঁটে কোণে প্রশান্তির হাসির রেখা এঁকে।
উপর থেকে ফিরাত জোরে কেঁশে উঠল।
“বলছিলাম একটু উপরে আসা যাবে? সন্ধে হয়ে আসছে তো।”
আহরারের ঘোর তাতেও কাটল না। তুরফা চোখ মেলে নিজের সাথে আহরার কে দেখে বিচলিত হয়ে উঠে। আচমকা ধাক্কা দিয়ে সরায় আহরার কে। আহরার একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। রাগি চোখে ফিরাতের দিকে তাকালে সে ভ্যালকানি হাসি দিয়ে ছুটল নিজের বউয়ের কাছে। আহরার আকাশের দিকে তাকাল। গোধূলির লগ্ন চলছে। আবার তুরফার দিকে তাকাল।
“তুমি হলে মোহমীয়সুন্দরি। যা সবার পছন্দের এই গোধূলিরও উর্ধ্বে।”
আহরার হাসতে হাসতে চলে গেল। তুরফার মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে আসছে। ভেতরে কেমন উপলব্ধি হচ্ছে নিজেও বুঝতে পারছে না। কেমন একটা রেশ লাগানো ঘোর কাজ করছে তার মাঝে। যা আহরার আর তার কর্মকাণ্ড গুলি কে ভাবাচ্ছে। ভীষণ ভাবে ভাবাচ্ছে।
রাতের খাওয়ার টেবিলে বসে খাচ্ছে আহরার তুরফা মোনতাহ্ আর ফিরাত। সার্ভ করছে দুজন। খাওয়ার ফাঁকে আহরার হঠাৎ বলে উঠল।
“সারপ্রাইজ আছে সবার জন্যে। এখানে সবার কি না বলতে পারি না তবে ফিরাত তোর আর ভাবির জন্যে এটা সারপ্রাইজ। বাকি রইল তুরফা। ওর জন্যে যে হবে না তা বেশ জানি। ওর জন্যে সারপ্রাইজ না বোম ফাটতে পারে।”
আহরার আবার খাওয়া শুরু করল। ওর কথা শুনে ফিরাত আর মোনতাহ্ একে অপরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ঠোঁট চেঁপে হাসছে। আর তুরফা ফুসফুস করছে। কিন্তু সবাই ভাবছে কি সারপ্রাইজ?
ফিরাত কিছু বলতে যাবে তার আগে আহরার বলে উঠল,
“সেটা কি তা এখনি জানতে হবে না কাউকে দু এক দিনের মাঝেই হবে।”
কেউ আর কথা না বাড়িয়ে খেয়ে নিল। আহরারের কথায় তুরফা মোনতাহ্ কে নিয়ে ফিরাতের ঘরে গেল। রুম টা ফুল দিয়ে বেশ না সাজালেও বিছানায় ফুলের মেলা। সুভাসে ঘর মো মো করছে। তুরফা মোনতাহ্ কে ধাক্কা দিয়ে শয়তানি হাসি দিচ্ছে।
“ইশশ আজ তো তুই….”
“চুপ করবি তুই।”
মোনতাহ্ লজ্জায় লাল হয়ে আসছে।
“আমি কিন্তু কাল শুনব। যদি না শুনাস তবে ঘাটের তলায় লুকিয়ে থাকব।”
“তুরি।”
“লজ্জায় তো লাল নীল হয়ে যাচ্ছিস। ফিরাত ভাই কে ডাকব নাকি?”
“তুরি বেশি হচ্ছে কিন্তু।”
মাথা নিচু করল মোনতাহ্ আর তুরফা হাসতে লাগল খিলখিল করে।
আহরার ডেকে নিয়ে গিয়েছে ফিরাত কে। কিছু কথা বলে দেওয়ার জন্যে। দরকারের কিছু কথা বলে আহরার মুচলি হাসল।
“যা বলেছি মনে রাখিস।”
ফিরাত পুরুষ হলেও খানিক লজ্জা পেল। মুচকি হাসল আহরারের দিকে তাকিয়ে।
“ভাই আহরার তোর জন্যে মোনতাহ্ কে এত সহজে নিজের কাছে পেয়ছি।”
“তুই না আমার ভাই? এসব বলতে নেই। যা ঘরে। শুভকামনা রইল।”
ফিরাত মুচকি হাসল। আহরার এগিয়ে গেল ফিরাত কে নিয়ে। ঘরের ভেতর দুই বান্ধবী কে এভাবে হাসতে দেখে ভালো লাগল দুজনের। আহরার গিয়ে তুরফার হাত ধরল।
“ভুলে যেও না ওদের আজ বাসর রাত। নিজের হবে না বলে ওদের টাইম ওয়েস্ট করো না। চলো এখান থেকে। শুভকামনা দুজনের জন্যে।”
আহরার কথা শেষ করে টান দিল তুরফা কে। নিয়ে গেল ঘরের বাহিরে। ফিরাত মুচকি হেসে দরজা বন্ধ করল। এগিয়ে গেল মোনতাহ্-র দিকে।
“এখন কোথায় পালাবে চাঁদ? এত দিন তো খুব ঘুরিয়েছ। এখন?”
“দে দেখুন ভালো হবে না কিন্তু..”
“এত দিন খুব জ্বালিয়েছ এখন এক সাথে সব ঝাঁঝ তুলব আমার চাঁদ।”
খপ করে ধরল মোনতাহ্ কে। জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিল। এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
“কোথায় পালাবে চাঁদ? এত দিন যা এটিডিউট নিয়ে থেকেছ আজ যদি না ভাঙ্গতে না পারি না তবে আমিও ফিরাত না।”
আহরার টানতে টানতে অনেক টা দূরে নিয়ে গেল তুরফা কে। তুরফা ঝাঁটকা দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
“হয় গারমি। এত গরম রাখো কি করে শরীরে? পুড়ে যাও না?”
“আপনি এমন অসভ্য কেন?”
“তাহলে দেখাবো নাকি?”
“কি কি?”
“অসভ্যতামি?”
“দে দেখুন..”
“তোমায়?”
“আপনি কিন্তু..”
“আমি তোমার কি জানি না তবে তুমি আমার হৃদহরণী।”
তুরফা থমকে গেল। কথা বের হলো না আর মুখ দিয়ে। লোক টা কথার জালে মানুষ কে কিভাবে বশে নিয়ে আসে বুঝা মুশকিল। তুরফা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আহরারের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। ওই তীক্ষ্ণ মোহময় দৃষ্টি এখন সহ্যও হবে না। আহরার মুচকি হেসে তুরফার হাত ধরল আবারো। টেনে নিয়ে একেবারে উঠল ছাঁদে। তুরফা বিরক্তি ছাপা মুখে হাত সরিয়ে এনে বলল,
“আপনি কি হ্যাঁ? যখন তখন হাত ধরে ফেলেন আমি কি আপনার বউ নাকি যে..”
আচমকা মুখ দিয়ে কি কথা চলে এলো ভেবেই তুরফা একদম থমকে গেল। কি বলল এটা সে? লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে। কথার ছুটে হুট করে বের হয়ে এসেছে এমন একটা কথা। তুরফা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা উঁচু করে দেখল আহরার তার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে কোণায় হাসির রেখাও দেখা যাচ্ছে। তুরফা তাড়াতাড়ি করে চোখ নামিয়ে নিল। বিচলতা আর উদ্বিগ্নতা ক্রমশ বাড়ছে। আহরার কিছু বলল না। মুচকি হাসল। গতিহীন পায়ে ছাঁদে থাকা টেবিলের উপর থেকে দুই মগ কফি নিয়ে আবার পা বাড়াল তুরফা দিকে। কিছু না বলে ঠোঁট টিপে হেসে এগিয়ে দিল কফির মগ তুরফার দিকে। কফি দেখে তুরফা অবাক চোখে তাকায় আহরারের দিকে। তার চাউনির ভাষা বুঝে আহরার নিজ থেকেই বলল,
“সার্ভেন্ট কে আগেই বলেছিলাম কফি রেখে যেতে। বেশি দেরি হয়নি দেখো তোমার ভেতরের গরম ধোঁয়ার মতো কফির মগ দিয়েও বের হচ্ছে।”
তুরফা কিছু বলতে চেয়েও বলল না। চুপ করে রইল।
“ধরো এটা।”
“আ আমি খাবো না।”
“তবে হাতে নাও আর ওখানে রেখে দিয়ে আসো।”
আহরার কফির মগ তুরফার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ছাঁদের রেলিংয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদু বাতাস বইছে চারিদিকে। ভাবনায় ডুব দিয়ে আহরার কফির মগে চুমুক দিল। ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি।
তুরফা মগ হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মৃদু স্বরে বলল,
“আসছি আমি।”
আহরার নিজের আগের অবস্থানে থেকেই বলল
“একেবারেই নয়। কোথাও যাবে না। এখানে চুপ করে হলেও দাঁড়িয়ে থাকো।”
তুরফা বিস্মিত হলো। কি জোর তার উপর। যেন.. বিরক্ত লাগছে তার। তবুও কোথাও যেন কিছু একটা থেকেই যায় এসবে। তুরফা আরো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইচ্ছে না থাকা সর্তেও কফির মগে বার কয়েক চুমুক লাগিয়েছে। কিন্তু এখন আর ভালোও লাগছে না ইচ্ছেও হচ্ছে না। কারণ হাতের কফি এখন ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। তাই ভালো লাগছে না। নীরবে দাঁড়িয়ে আছে দুজন দূরে দূরে।
আচমকা প্রবাল হওয়ার মতো আহরার মৃদু আওয়াজে ডাকল।
“তুরফা।”
সে কন্ঠে ছিল এক বুক মায়া আর এক সাগর মোহ। তুরফার শরীর শিহরণে ছেয়ে গেল। ভেতরের ধুকবুক আপনাআপনি বেড়ে গেল।
“একবার পাশে এসে দাঁড়াবে?”
তুরফা আবারো ঝাঁটকা খেলো সেই কন্ঠ শুনে। নিবে আসা প্রদীপের মতো কোমল মন্থন গতিতে ছিল কন্ঠের সুর। আর তুরফার সে শক্তি নেই এই কন্ঠ উপেক্ষা করার। ভেতর শিউরিয়ে উঠে। কানের কাছে ছন্দের তালে সে সুর বারি খাচ্ছে বারবার। শিহরণ লাগানো হৃদয় নিয়ে তুরফা এগিয়ে গেল আহরারের দিকে। নীরবে পাশে দাঁড়াল। আহরার আর কিছু বলছে না। চুপ থেকে মুহূর্ত টা অনুভব করছে। যেন তৃষ্ণার্ত পথিকের পানি খাওয়ার মতো সময়ের অনুভূতি টা গ্রহন করছে। নীরবতায় কেটে যায় অনেক টা সময়। তুরফার সে রেশটাও অনেক টা কেটে গেছে। আহরার কে শান্ত আর নীরব থাকতে দেখে তুরফা সুযোগ পেল। কালো অতীত নিয়ে জানার কৌতূহল টা ঝেঁকে বসল। অতি সাহস নিয়ে বলল,
“একটা কথা জানার আছে।”
আহরার চমকে তাকাল ওর দিকে। তুরফার কথা? অবাক হলো। ভ্রুকুটি করে তুরফার দিকে তাকায়। আবার আগের মতো আকাশের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল।
“আপনার অতীত নিয়ে জানতে চাই।”
আহরার থমকে যায় একথা শুনে। বিরক্তবোধ খনিকে চলে এসেছে তার মাঝে। রেলিংয়ে দুই হাত শক্ত করে চেঁপে ধরল। চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত কাটল।
“বলবেন আপনার কালো অতীত নিয়ে? জানাবেন সে কথা?”
“….
“কি হলো বলবেন?”
“…
“আমি সত্যি জানতে চাই আপনার সেই অতী..”
“তুরফা তুমি এখন যাও।”
নিজের কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হঠাৎ এমন এক কথায় তুরফা থেমে গেল। বুঝল না কিছু। মাথায় কিছু আসল না। বিরক্ত নিয়ে আবার বলল,
“বললে কি এমন হয়? প্লিজ বলুন না আপনার অতীত টা আমি শুন..”
“আমি এখন এখান থেকে তোমায় যেতে বললাম তুরফা। যাও।”
আহরার বেশ চেঁচিয়ে বলল কথাটা। হঠাৎ এমন রেগে যাবে আহরার ভাবেনি তুরফা। থমথমে হয়ে গেল। কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আহরার এবার চিৎকার করে উঠল।
“I’m telling you to go, Turfa. Now please hurry up.”
তুরফা আর কিছু বলার সাহস পেল না। ব্যথিত মন নিয়ে আস্তেআস্তে চলল তুরফা।
আহরার আকাশের দিকে চেয়ে বুক চিঁড়া ক্ষতের কালো দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে দিল।
চলবে….
#সাদিয়া