তুই হৃদহরণী পর্ব ২৪

#তুই_হৃদহরণী – ২৪

অফিসে গিয়ে তুরফা যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। এত তাড়াতাড়ি আহরার আজ অফিসে? নাকি সে দেরি করে এসেছে? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দুটোই। বড় কথা আহরারের সামনে একটা মেয়ে বসা। অন্যসব মেয়েদের মতোই এ। ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরনে। তুরফা মুখ মুচড়াল। কিন্তু এ মেয়ে কে এর আগে আর দেখেনি সে। এই প্রথম। ঠোঁট উল্টে চুপচাপ পর্দা সরিয়ে নিজের টেবিলে চলে গেল। আড়চোখে একবার দেখে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আহরার তখন ডাকল তাকে।

“তুরফা।”

“বলুন।”

“এদিকে এসো।”

“এখানে বলু..”

“এদিকে আসতে বলছি তোমায়।”

তুরফা চুপচাপ এগিয়ে গেল আহরারের দিকে।
“লিনা এ তুরফা। আমাদের কোম্পানি তে নতুন। আর তুরফা ও লিনা। আমার ফ্রেন্ড। এর বেশি কিছুও বলতে পারো। ও এখানে থাকবে। একটু দেখে রেখো।”
তুরফা রাগে ফেটে যাচ্ছে। একে তো কোম্পানির স্টার্ফ বলে চিনাল তারপর এই মেয়ে কে দেখে রাখার কথা বলছে? শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। এত দিন কি রসের আলাপ করত, হৃদহরণী হৃদহরণী। কোথায় গেল হৃদহরণী? আর ফ্রেন্ড তার থেকেও বেশি কিছু। এসব দেখলে গা একদম জ্বলে যায়। তুরফা মনে মনে ভাবছে আর রাগি চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে আহরারের দিকে। “ঠিক আছে” বলেই তুরফা গটগট করে চলে গেল। রাগে শরীর এতটা জ্বলছে মনে হচ্ছে ফ্রিজের ভেতর গিয়ে ঢুকে পরতে। তাহলেও বোধ হয় শান্ত হবে না আইসল্যান্ডে গেলে বোধ হয় জ্বালা কমবে একটু। রাগে ফুসফাস করে তাকাল ঘাড় ফিরিয়ে। দেখতে পেল মেয়েটার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। তুরফার রাগে কি করতে মন চাইছে কিছু বুঝল না। মুখ ফিরিয়ে আনল।

একটু পর ফাইল নিয়ে গেল আহরারের কাছে।
“এই ফাইল গুলি দেখে সাইন করে দিন।”

“ব্যস্ত আছি ফিরাতের কাছে নিয়ে যাও।”

“কোথায় ব্যস্ত আছেন? আপনি তো কথাই বলছেন ফাইল গুলি সাইন করে দিলে..”

“এখন আমি কি করব না করব তা তুমি ঠিক করে দিবে নাকি? যা বলছি তাই করো যাও।”

তুরফার যেমন টা না রাগ হচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। রাগে শরীর জ্বলছে আর কষ্টে মন। মনে মনে ভাবছে ‘আগে তো কাজ না থাকলেও ফাইল দিয়ে দিত। নিজের টেবিলে এসে জোর দেখিয়ে বসিয়ে কাজ করাত। আজ আমি দরকারি ফাইল গুলি নিলাম আর কি করল উনি? মেয়ে টা এতটাই ইম্পরট্যান্ট যে ফাইল দেখা তো দূর একবার তাকালও না। দূর আমি এসব কেন ভাবছি? কি হয় উনি আমার? যা ইচ্ছা তাই করুক আমার কি?”

“কি হলো যাবে নাকি এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিরক্ত করবে?”
তুরফা আর একটুও না দাঁড়িয়ে টলমল চোখ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। একটু এগুতেই মনে হলো আজ তো ফিরাত আসেনি। মোনতাহ্-র সঙ্গে। কিন্তু লোকটা জেনেও কেন ফিরাত ভাইয়ার কাছে আসতে বলল? ভুলে গিয়েছিল নাকি? দাঁড়িয়ে ভেবে গেলেও ইচ্ছা হচ্ছে না আবার কেবিনে যেতে। ওদের দেখলেই কেমন শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ভেতরে অদ্ভুত একটা কষ্টের যন্ত্রণাও হয়। খানিক দাঁড়িয়ে তুরফা আবার গেল। বনিতা না করে সরাসরি বলল,
“আপনি এতটাই ব্যস্ত যে ফিরাত ভাইয়ার কাল বিয়ে হয়েছে উনি অফিসে আসেনি জেনেও ভুলে গেছেন। ফাইল গুলি রেখে গেলাম সাইন করে দিবেন।”
শক্ত মুখে তুরফা নিজের টেবিলের দিকে চলে যাওয়ার সময় আহরার তাকে ডাকল।
“তুরফা।”
তুরফা তা না শুনেই হাটছিল।

“তুরফা দাঁড়াতে বললাম।”

“বলুন।”

“বড্ড বেশি কথা বলো তুমি।”

“….

“আমি ফাইল গুলি সাইন করে দিচ্ছে দাঁড়িয়ে থেকে নিয়ে যাও।”

“তার দরকার নেই। সাইন করে রেখে দিন আমি পরে ব্যাংকে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।”
তুরফা আহরারের কথা পাত্তা না দিয়ে আবার পা চালাল। ওদিকে লিনা মুখ ফুটে বলেই ফেলল।
“কে এই মেয়ে তোর কথা না শুনেই এতটা এটিডি..”
আহরারের চোখ রাঙ্গানো তে লিনা চুপ করে যায়। তুরফা পর্দা সরিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। আহরার আড়চোখে তুরফা কে দেখে মনে মনে আওড়াল
“ও বড্ড জেদি। বিরল বস্তু কি আর এমনি এমনি বলা? হয়তো শরীর আরো জ্বলে যাচ্ছে। হায় গারমি।”

কাজ করতে করতে হঠাৎ তুরফার চোখ আহরারের দিকে যায়। মেয়েটা একদম ঘেঁসে আছে আহরারের কাছে। যেন শরীরের উপরে উঠে গেলে বাঁচে। কি নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। তুরফার শরীর জ্বলে গেল এমন দৃশ্য দেখে। ইচ্ছে হচ্ছে আহরারের মাথায় গিয়ে ধরাম করে একটা বাড়ি মারতে। আগের সেই বেহায়া নির্লজ্জতার রূপটা বের হয়ে গেছে মনে হচ্ছে ভেতর থেকে। মেয়েটার শরীরের সাথে ঘেঁষেঘেঁষে ফোনে কিছু দেখাচ্ছে। আহরারও হাসি মুখে তা দেখছে। তুরফার শরীরে কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। রাগের চুটে এগিয়ে গেল ফের।
“সাইন করা ফাইল গুলি দিন।”

“….

“কি হলো?”

“আচ্ছা তুরফা তোমার সমস্যাটা কি? তখন বললাম দাঁড়িয়ে থেকে ফাইল গুলি নিয়ে যাও যেন এটার বাহানায় আবার না আসতে পারো। আমাদের ডিস্টার্ব না করতে পারো। কিন্তু তখন তো নিলে না। জ্বালানোর মতলব তো তোমার আছেই। এখন যখন দেখছো দুজনে একটু টাইম পাস করছি তখনি ফাইল নিতে এসে বিরক্ত করতে হচ্ছে তোমার? তোমার জন্যে কি একটু শান্তিতে দুজনে সময়ও কাটাতে পারব না? জাস্ট ইম্পসিবল।”
তুরফার চোখ টলমল করছে। মিনমিন করে বলছে।
“আমি রিজাইন নিতে চাই।”

“ভুলে যেও না তুরফা কোম্পানির সাথে তোমার কন্ট্রাক্টের কথা। এখন যাও বিরক্ত করো না।”
তুরফার চোখ টলমল করছে পানি তে। একটু সুযোগ পেলেই বের হয়ে আসবে। আহরার স্পষ্ট দেখল। ভেতর টা কেমন করে উঠল তার। করুণ চোখে তাকাল। তুরফা আর কিছু না বলে চলে গেল। যাওয়ার সময় চোখের কোণায় জমে থাকা পানি গড়িয়ে পরল। আহরারের দৃষ্টি অগোচর হলো না। তুরফা গিয়ে নিজের ফাইল, সব কিছু এক সাথে জড়ো করতে লাগল। কেন তা আহরার বুঝল। দৌড়ে গেল সেখানে।
“আরে আরে কি করছো?”

“….

“তুরফা।”

তুরফা কোনো জবাব না দিয়েই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সব জিনিস এক সাথে করতে লাগল। আহরারের ডাক শুনছেই না সে। নিজের মতো করে বলল,
“আমি এই রুমে থাকব না। আমার আগের ডেক্স ঠিক আছে।”
এবার আহরার রেগে যায়। তুরফার দুই বাহু চেঁপে ধরে দেওয়ালে ঠেকায়।
“কি হচ্ছে টা কি এসব?”
তুরফা চুপ থাকে। পানিতে চিকচিক করা চোখ নিয়ে আহরারের দিকে করুণ দৃষ্টি দেয়। আহরারের ভেতরটা খনিকে হাহাকারে ভেসে উঠে।

“হৃদহরণী।”

“একদম না। ভুলেও আপনি আমাকে এসব বলে ডাকবেন না। একটুও ডাকবেন না। আর এভাবে ধরে রেখেছেন কেন? ছাড়ুন, ছাড়ুন আমায়। আপনার উনি দেখবে। ছাড়ুন আমায়। আর আমাকে এভাবে ধরবার অধিকার আপনি পান কোথায়?”
আহরারের চোখ আগুন হয়ে উঠে প্রায়। দাঁতে দাঁত চেঁপে বলে,
“এসব তোমায় বলার প্রয়োজন বোধ করি না। এত কথা বলছো কি করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে? এখনো মুখে কথা ফুটছে তুরফা।”
তুরফা কিছু না বলে ছটফট করতে থাকে নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে। চোখ দিয়ে টপটপ করে কয়েক ফোটা পানি এসে পরল আহরারের হাতে। আহরারের শরীর যেন আগুনের পুড়ার মতো অসহনীয় যন্ত্রণা হতে শুরু করল। ভেতরটা যেন ক্ষতবিক্ষত হতে লাগল। তুরফার ওই মায়া করুণা দৃষ্টি দেখে আহরার যেন চুপষে গেছে। লেগে আসা গলায় বলল,
“এইটুকে এত কষ্ট পাচ্ছো? যখন আরো বড় একটা কথা শুনবে তখন কি করে আটকাবে নিজেকে তুর?”
তুরফার বুক ছেত করে উঠে এ কথা শুনে। আরো বড় কথা? কি এমন কথা যে নিজেকেই সহ্য করা যাবে না? ভাবান্বিত চোখে তুরফা আহরারের দিকে তাকিয়ে আছে। আহরার সেই চাউনিতে তার সব পাওয়া খুঁজে চলছে। কিন্তু কোথায় সেসব?

হঠাৎ লিনার ডাক শুনা গেল। আহরার কে ডাকছে। তুরফা ঠেলে সরিয়ে দিল আহরার কে। অন্য দিকে ফিরে চোখের পানি মুছে নিল।
“কিরে লাঞ্চ টাইম তো হতে চলল। তুই না বললি এক জায়গা..”

“হ্যাঁ। তুই গাড়িতে যা আসছি আমরা।”

“তাড়াতাড়ি আয়।”
মুচকি হাসি দিয়ে চলে গেল লিনা।

আহরার তুরফার দিকে তাকায়। শান্ত গলায়,
“ফিরাতের বাসায় আজ আমাদের যেতে বলেছে। মোনতাহ্ রান্না করে রেখেছে আমাদের জন্যে চলো।”

“….

“কি হলো চলো।”

“যাবো না আমি।”

“যাবে না মানে?”

“যাবো না মানে যাবো না। মোনতাহ্ বিয়ের একদিনে এমন পরিবর্তন হয়ে গেল যে আমার যাওয়ার কথা আপনাকে দিয়ে বলাতে হবে? আপনি কে আমার? যে আপনাকে দিয়ে বলাতে হয়। আর বড় কথা আমার যাওয়ার হলে আমি নিজে যাবো। আপনাদের যাওয়া আপনারা যান।”

আহরার দাঁত কটমট করে বলল,
“প্রথমত তোমার এমন ধাতের কথা আমার একদমই সহ্য হয় না। আমি শুনতে চাইও না। আর দ্বিতীয়ত মোনতাহ্ তোমায় বলতে চেয়েছিল আমিই মানা করে দিয়েছিলাম। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার।”
কথা শেষ করে আহরার শক্ত হাতে ধরল তুরফার হাত। টানতে টানতে নিয়ে গেল অফিস থেকে।

তুরফা গাড়ির পিছনে বসে আছে। আর সামনে লিনা আর আহরার। তুরফা পিছনে বসে রাগে ফুসফুস করছে। আহরার সামনের গ্লাসে তুরফার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে।
“লিনা একটা সেলফি নে তো।”

“ও শিওর।”
লিনা ফোন নিয়ে সেলফি তুলতে লাগল নিজেদের মতো। তুরফার গা পিত্তি জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। এমন আধিখ্যেতা দেখার চেয়ে চলে যাওয়া ভালো। তুরফা গাড়ির দরজা ঠেললে দেখতে পায় গাড়ি লক করা। রাগটা দ্বিগুণ হয়। গম্ভীর গলায় বলল,
“গাড়ির লক টা খুলে দিন।”

“….

“আপনাকে গাড়ির লকটা খুলে দিতে বললাম।”

“তোমার কথাতে নাকি? গাড়িটা আমার তোমায় নয়। তাই লক করব না কি করব তা আমি বুঝব।”

“আপনার গাড়ি আপনি কোলে নিয়ে বসে থাকুন আমাকে শুধু এখান থেকে নামতে দিন।”

“…..

“আমি নামব।”

“জায়গা মতো নামিয়ে দিব।”
আহরার আবার গাড়ি স্টার্ট দেয়। লিনার সাথে কথা বলছে হেসে হেসে। মাঝে মাঝে গ্লাস দেখছে। তুরফা রাগে উসপিস উসপিস করছে। ভেতরে কেমন জ্বলনও হচ্ছে। স্বস্তি পাচ্ছে না কিছুতে। ছটফট করছে শুধু ভেতরে ভেতরে।

তুরফা গাড়ি থেকে নেমে আগে আগেই চলে গেল ভেতরে। অথচ এই প্রথম সে এখানে এসেছে। যেতে যেতে মোনতাহ্ কে দেখতে পেল। জড়িয়ে ধরল ওকে। ইচ্ছা হচ্ছে মন ভরে কান্না করতে কিন্তু পারল না। নাক টেনে গাল ফুলিয়ে মোনের দিকে তাকায়।
“একদিনেই আমি পর হয়ে গিয়েছি যে আমাকে আসার কথাটাও তোর ওই লোকটা কে দিয়ে বলাতো হয়?”

“আরে না ফিরাত ভাইয়া-ই বলেছিল তোকে বলবে আর নিয়েও আসবে।”
তুরফা মুখ ফুলিয়ে দিল।
“ওকে উপরে যা গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয় খাবার দিবো।”

খাবার টেবিলে সবাই বসে নিজেদের মতো খাচ্ছে। আহরারের এক পাশে ফিরাত আর অন্যপাশে লিনা বলেছে। ফিরাতের পাশে মোনতাহ্ আর তার পাশে তুরফা বসেছে। খাওয়ার মাঝে হঠাৎ আহরার বলে উঠল,
“পরশু আমরা সবাই আমেরিকা যাচ্ছি। সবাই বলতে এখানের সবাই আর অফিসের কয়েকজন। বিজনেসের জন্যে যাবো সবাই। মোনতাহ্ একা থাকবে তাই নিয়ে নিচ্ছি। ফিরাত আর মোনতাহ্ একা কিছুটা সময় কাটাতে পারবে। ওদের হানিমুন টাও হয়ে যাবে। তুরফা আর লিনাও যাচ্ছে। সব রেডি। শুধু দিনের অপেক্ষা। আরেকটা কথা জানিয়ে দিচ্ছি। ডিল ডান করার পর লিনা আর আমার বিয়ের কথাটাও এনাউনস্ট করে দিবো।”
আহরারের এই কথায় চারিদিক স্তব্ধ হয়ে গেল।

চলবে….
#সাদিয়া

(হুট করে কাল একটা সারপ্রাইজ নিয়ে আসব ইনশাল্লাহ। ততক্ষণ অপেক্ষায় থাকুন। কি হতে চলছে তাতে কোনো ধারনা আছে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here