তুমিই আমার প্রিয় নেশা পর্ব ৪৩+৪৪

#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:43
#Suraiya_Aayat

পাশ ফিরে ঘড়ির দিকে তাকালো নূর, ঘড়ির কাটা রাত 8টা ছোঁব ছোঁব, সেই দুপুরে আয়াশ বেরিয়েছিলো তারপর এখনো ফেরেনি ৷নূর জিজ্ঞাসা করলেও আয়াশ কখনও ঠিকঠাক উত্তর দেয় না তবে নূর আয়াশের এমন ব্যাবহারে কষ্ট পায় শুধু কখনো প্রকাশ করে নিজের অভিযোগটা আয়াশের কাছে জানান দেয় না ৷ একরাশ বিরক্তি নিয়ে পিছু ঘুরলো নূর, পুনরায় পাশ ফিরে শুয়ে পড়তেই হঠাৎ বমি আসতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে গেল, আজকে সারাদিন বমির প্যারায় ও কুপোকাত ৷ তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে ঢুকলো নূর, হড়হড়িয়ে বমি করলো, সারদিন ধরে যা খাচ্ছে সব ই বমি হয়ে শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে ৷ভীষন রকম অসস্তি কাজ করছে শরীরের মাঝে ৷ মুখটা ধোঁয়ার জন্য বেসিনে থাকা ট্যাপটা অন করতে গেলেই হঠাৎ করে ট্যাপটা খুলে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল ৷ হঠাৎ করে এমন কিছু হওয়াতে নূর ভয় পেয়ে গেল ৷ রাতের বেলা এমন কিছু একটা সাধারন বিষয় ঘটলেও তা নিয়ে ভয় পাওয়া খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু না ৷ নূর ভয় পেয়ে সরে গেল ৷ আর একটু হলেই কলটা খুলে ওর পায়েই পড়তো ৷ নূর পাশের হ্যান্ড শাওয়ারটা অন করে মুখটা পরিষ্কার করতে নিলেই হঠাৎ ফরমালিন এর গন্ধে ওর শরীর তিরতিরিয়ে উঠলো ৷ নূর বিদঘুটে ফরমালিন এর গন্ধ পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো , বুঝতে পারছে না হঠাৎ ওয়াশরুমে ফরমালিন এর গন্ধ কোথা থেকে আসবে ৷ নূর সহ্য করতে না পেরে তাড়াতাড়ি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো ৷ শাড়ির আঁচলটা দিয়ে মুখ মুছে আবার বিছানায় শুয়ে পড়লো ৷ এপাশ ওপাশ করছে ঘুম আসছে না বরং ফরমালিন এর গন্ধটা আরও বেশি ছড়াচ্ছে ৷ খানিকখন দীর্ঘ বিরতি নিয়ে শ্বাস নিতে লাগলো নূর যাতে গন্ধটা কম আসে নাকে ৷ ইতিমধ্যে ফরমালিন এর সাথে আরও অনেক রকম গন্ধ ভেসে আসছে ওর নাকে ৷ নূর দেখলো যে ওয়াশরুমের দরজাটা খোলায় আছে আর সেদিক থেকেই গন্ধটা বেশি ছুটছে তাই নূর আবার উঠে দরজাটা বন্ধ করে দিলো ৷ বিছানায় শুয়ে পড়তেই আয়াশের কথা মনে পড়লো, আবার ঘড়ির দিকে তাকালো, ঘড়ির কাঁটা থেমে নেই, থেমে আছে হয়তো ওর নিজের সময় ৷ চোখ বন্ধ করতেই খট করে একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো তা হলো
” আয়াশ সায়েন্টিস্ট ৷”
নূর চোখ খুলে উঠে বসলো , ভাবনা আসছে অনেক রকম
” আচ্ছা উনি সত্যিই কি সায়েন্টিস্ট?”
প্রশ্নটা নিজে নিজে করার পর ই আবার নিজে বলে উঠলো যে
” না হওয়ার কি আছে উনি তো অনেক পড়াশোনা করেছেন ৷”
আবার প্রশ্ন জাগলো
” আচ্ছা উনি আমার মতো এতো কম পড়াশোনা জানা মেয়েকে কেন বিয়ে করলেন? ওনার তো সায়েন্টিস্টের সাথেই বিয়ে হওয়ার কথা ৷ উনি কেমন সায়েন্টিস্ট? ওনার গবেষনার বিষয় কি ? ”
সবশেষে যে প্রশ্নে এসে নূর থেমে গেল
“ওনার না একটা গোপন কক্ষ আছে , সেটা কোথায়?”

কথাটা ভাবতেই নুর তাকালো ওয়াশরুমের দিকে, দ্বিতীয় বার আর কিছু ভাবলো না, জলদি ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিকে ৷ ওয়াশরুমে ঢুকে ভিতর থেকে নূর দরজা বন্ধ করে দিলো ৷ ওয়াশরুমের ভিতর গন্ধে ভরে গেছে, ল্যাবে যেমন বিভিন্ন কেমিকেলের গন্ধ থাকে ঠিক তেমনটাই ৷ শাড়ির আঁচলটা হলো ভরসা সেটা দিয়েই নাকের কাছে শক্ত করে চেপে ধরলো নাহলে ওর ক্লান্ত শরীর বেহুশ হওয়ার জন্য যথেষ্ট ৷
নূর এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো কোথা থেকে গ্যাস আসছে তা খুজতে লাগলো ৷ না পেরে নূর এবার একটা দেওয়ালে ধাক্কা মারলো , কিছুই হলো না উল্টে ব্যাথা পেলো ৷ হাতে লেগেছে বেশ ৷ বিরক্ত হয়ে আর একদিকে তাকালো ও ৷ বেশ কিছুখন খোঁজাখুজি করেও লাভ হলো না, বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসতে নিলেই দেখলো দেওয়ালে একটা জায়গাতে একটা স্ক্সু দিয়ে আটকানো, উপেক্ষা করতে চেয়েও পারলো না নূর ৷ স্ক্সুটাতে হাত দিয়ে টানতেই সেটা আরও দেওয়ালের ভিতর ঢুকে গেল, নূর বুঝলো আদতেও এটা কোন স্ক্সু না , এটা বোতাম জাতীয় ৷ স্ক্সু টাতে হাত দিতেই নূর দেখলো যেখানে জলের ট্যাপটা ছিলো সেখানের একটা সুড়ঙ্গ থেকে আপনা আপনিই ছোট্ট একটা চাবি বেরিয়ে এলো ৷ আচমকায় এমন আশ্চর্য কিছু হওয়াতে নূর বেশ অবাক হলো ৷ চাবিটা নিতে গিয়ে হাত কাঁপছে , কি করবে বুঝছে পারছে না , অনেক ভয়ে ভয়ে চাবিটা হাতে নিতেই সেটা আপনা আপনি আবার ভিতরে ঢুকে গেল ৷ চাবিটা নিয়ে এবার কোথায় কি করবে নূর বুঝতে পারছে না ৷চাবিটা নিয়ে ওয়াশরুমের এদিক ওদিক তাকালো, কিছু বুজছে না, যেখানে থেকে চাবিটা বেরিয়ে এলো সেই জায়গাটা একটু ভালো করে দেখতে লাগলো , ভয় ও লাগছে যদি আয়াশ চলে আসে তো ৷ নূর জায়গাটা দেখতে দেখতেই হঠাৎ দেখলো সেখানে তবে খুব ভিতরে একটা চাবি রাখার জায়গা, নূরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো ৷ ঝটপট চাবিটা রাখতেই দওয়ালটা হঠাৎ একটা দরজার মতো খুলে গেলো ৷ নূর ভয়ে চমকে এলো ৷ এতোদিন যেটা দেওয়াল হিসাবে ভাবতো আর আজকে সেটা দেখছে একটা দরজা ৷ নূর ভয়ে ভয়ে সেদিকে উঁকি দিলো,দেখলো লিফটের যেমন ছোট কুঠুরি হয় ঠিক তেমনই একটা কুঠুরি ,সেখানে নূর ঢুকবে কি না ভাবছে, ঢুকতেও বেশ ভয় পাচ্ছে কারন ভিতরে কোন আলো নেই , যদি সেটা না চলে নূর যদি ওখানেই বন্দী হয়ে থাকে তো ৷
সেদিকে তাকাতেই দেখলো হঠাৎ সবুজ রঙের একটা আলোয় লেখা ভেসে উঠলো
” WELLCOME”

নূর ওর পেটের দিকে তাকিয়ে বললো
” আমাকে ক্ষমা করিস পুচকু, অনেক রিস্ক নিয়ে যাচ্ছি,ফিরবো কি জানিনা তবে তোর মাম্তাম তোকে অনেক ভালোবাসে ৷”

কথাটা বলে নূর ভিতরে ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল , ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার ,নূর ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছে ৷ হঠাৎ তীব্র গতিতে লিফট চলতে শুরু করলেই নূর আআআআ করে চেঁচিয়ে উঠলো ৷ কয়েক সেকেন্ড পর হঠাৎ লিফটটা থেমে গেল আর দরজাটাও আপনাআপনি খুলে গেল ৷ নূর বেরিয়ে এসে দেখলো,বিরাট একটা হল ঘর, চারিদিকে আলোয় পরিপূর্ণ , চারিদিকে এই সেই কতো অ্য৷সিড, আশেপাশে বেশ কয়েকটা কঙ্কাল দেখে নূর কেঁপে উঠলো, চলে এসেছে কিন্তু ফিরবে কি করে সেটা ও জানে না ৷ সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো একটা কফিন জাতীয় জিনিস ৷ নূর সেদিকে এগিয়ে গেল দেখার জন্য যে কি আছে, কফিনটা খুলতেই দেখলো অনেক ওষুধ দিয়ে প্রিজার্ভ করা ডেডবডি, নূরের মাঝে যেন কোন ভয় কাজ করছে না…..কাপড়টা সরিয়ে মুখটা দেখতে যাবে তখনই কেউ একটা গাঢ় কন্ঠে বলে উঠলো….
” নূর…….”

নূরের কলিজা কেঁপে উঠলো ,হাত কাঁপতে লাগলো, পা দুটো আর স্থির নেই ৷ সামনে ঘুরে তাকাবে সে শক্তি ওর মাঝে নেই ৷ আর একবার আওয়াজ কানে এলো
” নূর……”

নূর এবার ঝটপট সোজা হয়ে সামনে তাকালো, দেখলো ওর আম্মু ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে,আর মুখে আছে এক অদ্ভুত হাসি ৷ নূর সামনের দিকে তাকিয়ে সবকিছু ঘোলাটে দেখলো, জ্ঞান হারালো নূর,সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারলো না ও, এতোকিছু দেখার জন্য ও প্রস্তুত ছিলো না ৷
#তুমিই_আমার_প্রিয়_নেশা
#পর্ব:44
#Suraiya_Aayat

জ্ঞান হারালো নূর আর বেশি কিছু দেখার আর ভাবার সুযোগ পেলো না,তারপর কখন ওর জ্ঞান ফিরলো মনে নেই তবে যখন চোখ খুললো তখন পাশে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে অনেক বেশি অবাক হলো ও , ওর মা বসে আছে ওর পাশে, ওর হাতে হাত রেখে ৷ কিছুখনের জন্য নূর স্তব্ধ হয়ে গেল বুঝতে পারছে না এটা কি কোন মিরাক্কেল নাকি মরীচিকা ৷ আশেপাশের কাওকে দেখছে না ও , কারোর উপস্থিতিও ওর জানান দিচ্ছে না ওর মা ছাড়া ৷ মা মেয়ে কিছুখন নিজেদের দিকে চাওয়া চাইয়ি করতে লাগলো, একটা সময়ে নূরের মায়ের চোখ থেকে জল গড়াতে দেখেই নূরের বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো তাহলে এটা কি সত্যি ?
নূর ওর মাকে হঠাৎই জাপটে জড়িয়ে ধরলো , হাপাচ্ছে নূর, বিশ্বাস ই হচ্ছে না যে ওর মা এর কাছে ৷ আশেপাশে সবাই ওদেরকে ঘিরে রয়েছে ৷ নূর ওর মাকে জড়িয়ে ধরে এবার কেঁদে ফেলল , নূরের মা ও নূরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন , মা মেয়ের এই হৃদয় ভাঙা কান্না সকলের মনকে মোমের মতো গলিয়ে দিলো ,প্রিয়ন্তি মোস্তাফাও কেঁদে ফেললেন, শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছলেন ৷ নূর ওর মায়ের দিকে তাকালে ওর মা নূরের চোখটা মুছিয়ে দিয়ে নূরের কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিলেন ,নূর এখনো কেঁদেই চলেছে ওনার দিকে তাকিয়ে দূর থেকে সবটা দেখছে আয়াশ ৷ নূরের মা ওনার ভাঙা কন্ঠে বললেন
” আমার মেয়েটা এতো বড়ো হয়ে গেল আমি তো জানতেই পারলাম না হ্যাঁ ! ”

নূর এবার দ্বিগুন স্বরে কান্না করে উঠলো
” আম্মু ৷”

উনি নূরকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন,সকলেই চুপচাপ ৷ দূরে দাঁড়িয়ে আছেন আরাফাত সাহেব ওনার চোখ থেকেও আজ জল ঝরছে, ভীষন রকম খুশি তিনি তবে ভয় পাচ্ছে অপমানিত হওয়ার আর তীব্র ঘৃনা পাওয়ার জন্য,যদি সবাই ওনাকে দূরে সরিয়ে দেয় তাহলে উনি কিসের ভিত্তিতে বাকিটা জীবন পার করবে ? রেদোয়ান থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ছেলেরা এতো সহজে ভেঙে পড়ে না, কঠিন সময়েও নিজেদেরকে পাথরের মতো শক্ত করে রাখে তাই রেদোয়ান ও হয়তো এখনো ঠিক তাই করছে ৷
নূরের মা নূরকে ছাড়িয়ে বললেন
” কি হয়েছে নূর এতো কাঁদে কেউ? তুমি কাঁদলে তোমার বাচ্চাটাও যে কষ্ট পাবে ৷”

নূর কান্নার বেগ কমিয়ে বলল
” তোমাকে আমি কতোদিন দেখিনা আম্মু তার হিসাব নেই ৷ তুমি কি আমাকে একটুও ভালোবাসতেনা বলোতো? এমন কেন তুমি , আমাকে ছেড়ে কেন চলে গিয়েছিলে?”

কথাটা শোনার সাথে সাথে আয়াশ রূম থেকে বেরিয়ে গেল ৷ নূরের মা আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকালেন তারপর নূরের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললেন
” সময় ও ধৈর্যের পরীক্ষা নেই নূর , আমিও যে সেই পরীক্ষা দিচ্ছিলাম আর দেখো পরুক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমি ফিরে এসেছি তুমি কি খুশি না বলো?”

নূর ওনাকে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন ৷ রেদোয়ান বলে উঠলো
” আম্মু তোমার মেয়েই কি সব ? আমি কি তোমার চোখে পড়িনা বলো?”

কথাটা শুনতেই সবাই হেসে ফেলল ৷ নূরের মা রেদোয়ানকে হাত দিয়ে ইশারা করতেই রেদোয়ান ছুটে গেল,উনি আর এক হাত দিয়ে রেদোয়ানকে জড়িয়ে ধরলেন ৷ উনি ওনার দুই ছেলে মেয়েকে সমান ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিলেন ৷
মায়ের ভালোবাসা হলো সবচেয়ে খাঁটি যার মাঝে নেই কোন খাদ……৷

____

রাত 3টে,,,,
হঠাৎ করে নূরের ঘুম ভেঙে যেতেই নূর দেখলো ঘরটা অন্ধকার ৷ অন্য দিন ঘরের মাঝে ডিমটাইট টাও জ্বলে আর আজ তাও জ্বলছে না ,ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর,কিছু বোঝার উপায় নেই…..বিছানা থেকে নামলো নূর , ফ্লোরে পা রাখতেই মনে পড়লো ওর আম্মু ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো তারপর কখন যে ওর দু চোখ ভরে ঘুম চলে এলো তা মনে নেই ৷ একপা বাড়ালো নূর, আয়াশ এই রূমে আছে কি তার ও কোন খেয়াল নেই ৷ ঘরের লাইট টা জ্বালাবে, অন্ধকারে হাটতে গিয়ে হালকা হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েও সামলে নিলো ৷ অন্ধকারে খানিকটা হলেও ভয় লাগছে,লাইটটা জ্বালাতে যাওয়ার জন্য সুইচ বোর্ডের দিকে যেতে গেলেই ব্যালকনির দিকে নজর গেলো ওর,,,,আগুনের ফুলকি জ্বলছে অল্প পরিমানে, দূর থেকে তা জোনাকি পোকার মতো লাগলেও তা নয় এটুকু নূর বুঝলো ৷ নূর সেই আগুনের ফুলকিকে লক্ষ করে এগোতে গেলেই হঠাৎ আগুনের ফুলকিটা অদৃশ্য হয় গেল , থেমে গেল নূর ৷ হঠাৎ পিছন থেকে ওকে কাছে টেনে নিতেই ক্ষনিকের জন্য চমকে গেল,পেটে হাতের আলতো স্পর্শে নূরের শরীরে শিহরন বয়ে গেল…..বুঝে গেল যে সেটা আয়াশ ৷ খানিকটা কম্পমান কন্ঠে বলল
” আপনি…..”

নূরের কথাটা শেষ হতেই পাশ থেকে বিদঘুটে এক ধোঁয়া বয়ে গেল,ধোঁয়াটা নাকে যেতেই নূর কেশে উঠলো, এটা হলো সিগারেটর বিদঘুটে গন্ধ যা নূর একদম পছন্দ করে না ৷ নূর একটু ভয় পেয়ে বলল
“ছাড়ুন ৷”

হুঠ করেই নূরের অনুভূতি জাগলো যে নূর হাওয়াই ভাসছে ,বুঝতে অসুবিধা হলো না যে আয়াশ ওকে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে ৷ নূর চুপটি করে আয়াশের গলাটা জড়িয়ে ধরলো,নূর আগে কখনও আয়াশকে সিগারেট খেতে দেখেনি তবে আজকে সিগারেট খেতে দেখেও খুব একটা,অবাক হলো না বা চমকালো না কারন পুরুষ মানুষরা একটু আধটু খেয়ে থাকে কখনও তা নিত্য৷ন্তই শখের বশে বা কখনো কষ্ট লাঘব করতে৷ হঠাৎ নূরকে একটা চেয়ার বসালো তারপর ই অন্ধকারের মাঝে লাইটারের আগুনটা দিয়ে সিগারেটটা জ্বলে উঠলো,নূর একটু চমকে গেল ,সিগারেটের আগুনটা কালো রঙের মোমবাতিটাতে ধরতেই মোমবাতিটা জ্বলে উঠলো ৷

নূর শুকনো একটা ঢোক গিললো, ক্যানডেল লাইট ডিনারে মানুষ এমন একটা রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি করে কিন্তু এটা তো তেমনটা নয়,এই নিশি রাতের কি নাম হওয়া উচিত তা নূর কেন আয়াশের ও হয়তো জানা নেই ৷ হঠাৎই সিগারেটের ধোঁয়া বাতাসে ছুটে চলার সাথে সাথে বিপরীত দিক থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে এলো
” কেমন আছো নূর ?”
কথাটা শোনার সাথে সাথে নূরের কলিজা কেঁপে উঠলো…..শাড়ির আঁচলটা খামচি মেরে ধরলো নূর, মানুষটা ওকে নূর বলে ডাকলো কিন্তু তার বলার ভঙ্গি তো এমন নয় ,সে তো ডাকে আফু সোনা ! নূর নিজেকে সামলে নিয়ে খানিকটা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল
” ভালো ৷”

কথাটা বলে নূর থেমে গেল ৷ আয়াশ খানিকটা নিস্তব্ধতা বজায় রেখে বলল
” জিজ্ঞাসা করবে না আমি কেমন আছি ?”

নূর খানিকটা অবাক হলো , তবুও এখনই হতাশ হলো না, সাহস নিয়ে বলল
” কেমন আছেন আপনি?”

হঠাৎই হো হো করে খানিকটা উন্মাদনার সুরে আয়াশ হেসে বলল
” ভালো নেই আমি !”

নূর অবাক হলো এমন কথা শুনে, তার তো ভালো থাকার কথা, সে তো তার মাকে ফিরে পেয়েছে, এতোদিন পর নিশ্চয়ই তার ভালো থাকা উচিত ৷

” কেন?”

আয়াশ মুখের মুচকি হসিটা মেলে দিয়ে বলল
” আজ আমার আফু সোনার মৃত্যু বার্ষিকী তাই !”

কথা শোনা মাত্রই নূর কেঁপে উঠলো, হাত পা কেমন যেন হয়ে গেল ৷ মুখ দিয়ে কথা বার হচ্ছেনা,ও একটা জলজ্যান্ত মানুষ বসে অছে আর লোকটা বলে কি না তার আফু সোনা মরে গেছে ৷ নূর কথা বলার সাহস পাচ্ছে না, খানিকটা রাগ ও হচ্ছে ৷

” জানো তো আমি একটা পাগল…..বদ্ধ পাগল ৷ বলতে পারো মেন্টাল ৷”

নূর চোয়াল শক্ত করে আছে, সত্যিই পাগলের প্রলাপ পড়ছে৷ রেগে গিয়ে বলল
” কি বলছেন কি এসব !”

আয়াশ সিগারেটটা আর এক বার টেনে বলল
” এই দেখো নূর তুমি বিশ্বাস করছো না, আমি তো বলছি আমি পাগল ৷ সায়ন্টিস্ট হয়ে আরও পাগল হয়ে গেছি ৷ সারাদিন মাথার ভিতর কতো সূত্র , কতো থিওরি কিলবিল করে ,রাতে আমি কখনও ঘুমাতেই পারি না, ওরা আমাকে ঘুমাতেই দেই না,শুধু বারবার বলে আয়াশ কিছু তো আবিষ্কার কর, ইউ আর সাচ আ লুজার ৷”কিন্তু আমি লুজার না, আই এম নট আ লুজার ,আই এম নট ৷ আমি জিনিয়াস , জিনিয়াস আমি ৷”

নূর চুপ করে রইলো,আয়াশের এমন কথা শুনে ওর আর কিছু বলতে ইচ্ছা করছিলো না ৷
আয়াশ আবার বলতে শুরু করলো….

” সালটা 2012 তখন আমি সবে 22 বছরের একটা ছেলে ৷”

কথাটা শুনতেই নূরের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম ,কি বলছে এসব উনি ? এটা 2021…আর উনি 2012 র কথা বলছেন , তখন ওনার বয়স যদি 22হয় তবে এখন ওনার বয়স 31 কিন্তু উনি তো এখন 28….
কথাটা নিজের মনে মনে ভেবে নূর থেমে গেল ৷

আয়াশ বললো
” 22 বছরের একটা ছেলে যার মাথায় ছিলো ঝাকড়া ঝাকড়া কোঁকড়া চুল,মুখে কোন দাঁড়িই ছিলো না, চোখে পরতো মোটা ফ্রেমের চশমা ৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ পেয়ে পাড়ি দেই উঃ আমেরিকার সবচেয়ে বড়ো দেশ নিউ ইয়র্কে , সেখানকার টপ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয় ৷ প্রথমে তো একটা বাংলাদেশি ছেলে সেখানে গিয়ে একা থাকতাম, ragging হতো অনেক, কখনো বা বলতো 45 তলা উঁচুর বিল্ডিং এর ছাদের ধার দিয়ে হাটতে, কখনও বা বলতো ব্লেড দিয়ে হাত কাটতে , স্বভাবে বড্ড শান্ত শিষ্ঠ ছিলাম তাই কখনও কিছু বলতে পারতাম না…..মনে মনে ভীষন কষ্ট হতো,ইচ্ছা হতো বেরিয়ে চলে আসি, মা ছিলোনা আমার বাবা ঠিক করে কথা বলতো না , ঘরবন্দী থাকতেন, ছোট ভাই আহান সে তার নিজের মতো ব্যাস্ত থাকতো ,সবাই তাকে বড়ো ভাবতো আর আমাকে ছোট, হাহাহাহাহ ‌৷ রাগ করে আর দেশে ফিরতে ইচ্ছা হয়নি , সব সহ্য করতাম ৷ ক্লাস টেস্টে টপ করতে লাগলাম তাই হিংসার জন্য রুম মেটরা পড়তে দিতো না ৷ ঠিক করলাম আলাদা বাসা ভাড়া নেবো তাতে রুমমেটরা তীব্র আপত্তি জানালা তবুও অনেক চেষ্টায় বাসা ভাড়া নিলাম , প্রতি মাসের ভাড়া হতো কয়েকশো ডলার ,খানদানি পরিবার আমার টাকা পয়সা অঢেল, ছোট বেলায় দাদানের কাছে শুনেছিলাম যে এই টাকা নাকি সাতটা পুরুষ খেয়েও শেষ হবে না, এটা তারপর মনে হলো যে সত্যিই ৷

এটুকু শুনতেই নূরের চোখ মুখ ছোট হয়ে গেল, অনেক কিছু বলছে আয়াশ,এগুলোর সত্যতা নূর জানে না তবুও জানতে ইচ্ছা করছে ভীষন ৷

যেই বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম সেই বাড়িতে একটা মেয়ে থাকতো নাম ছিলো এনিরা আফসানা…..মেয়েটাকে আমি চিনতাম না ৷ সে ছিলো আমার সিনিয়ার 3 বছরের ৷ একদিন কলেজ থেকে ফিরছিলাম হঠাৎই মেয়েটাকে দেখে চোখ আটকে যাই আমার তার ওপর….ওতো লাভ টাভ বুঝতাম না তাই লাভ এট ফাস্ট সাইডে বিশ্বাস করিনি আমি সেদিন…বাট ইট ওয়াজ ৷ যাই হোক , কলেজে কোন ফ্রেন্ড ও ছিলোনা আমার , একাই এর ওর কাছ থেকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম তার নাম এরিনা আফসানা , একদিন কলেজ শেষে তার পিছু ও নিলাম দেখলাম সেও সেই বাড়িতে থাকে যেখানে আমি থাকি, ভেবে খুশি হয়েছিলাম যে আমরা একই বাড়িতে থাকি, সে থাকে নীচের তলায় আর আমি ওপর তলায় ৷ তার বাবা ছিলো বাড়ির ওনার…বিশ্বাস করো ওকে দেখে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যেতো ৷ তার প্রতি attraction বাড়তে লাগলো, আমি যে ছেলে নিজের ঘর থেকে বার হতাম না সে তার পাল্লায় পড়ে না খেয়ে না ঘুমায়ে সারাদিন তাকে ফলো করতাম ৷ strange না ?”
নূরের দিকে ইশারা করলো ৷ নূরের চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে ৷নূর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সম্মতি জানালো ৷

আয়াশ আবার হো হো করে হেসে বললো
” অভিয়েসলি strange…..”

নূর কৌতুহল নিয়ে বলল
” তারপর !”

আয়াশ দীর্ঘশ্বাস টেনে বলল
” তারপর ! শুনবে ?”
নূরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ৷

#চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here