তুমিময় বসন্তে,পর্ব:১

0
632

নিধির অস্বস্তিজড়িত মুখ দেখে আয়মানের ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠেছে একটা সুক্ষ্ণ হাসি। সে খানিকটা ঝুকে এলো নিধির দিকে। অতঃপর জড়ানো কন্ঠে বললো,

‘দোষটা কিন্ত তোমারই ছিলো নিধি। তুমি যদি এভাবে ব্যাঙের মতো না লাফাতে তাহলেই তো আমার সাথে আর ধাক্কা খেয়ে এভাবে পড়ে যেতে না।’

আয়মানের কন্ঠে দমে গেলো নিধি। কি মিষ্টি ছেলেটার কন্ঠ……….চোখে মুখে কোনো সংকোচ নেই। তাকালেই শুধু অজস্র ভালোবাসা যেন উপভোগ করা যায়।

‘আয়মান! আল্লাহর ওয়াস্তে আমার ওপর থেকে সরুন । ভারে আমি চ্যাপ্টা হয়ে যাচ্ছি।’

মিনমিনিয়ে কথাটি বলার চেষ্টা করলো নিধি। আয়মান এবার উঠে দাঁড়ালো নিধির ওপর থেকে। নিধির প্রচন্ড লজ্জা লাগছে। ইসসস! উঠোনে এভাবে না লাফালাফি করলেই তো পারতো। তাছাড়া আয়মান যে এ পড়ন্ত বিকেলে ওদের বাসায় আসবে এটা রীতিমতো ভুলে গিয়েছিলো সে। আয়মান ঠোঁট চেপে হাসতে থাকলো নিধিকে দেখে। হাত দুটো আয়েশ করে পকেটে গুজে নিধির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে রেখেছে। নিধি তাই হাত কচলাচ্ছে আনমনে। একনয়নে নরম ঘাসের দোল খাওয়া অনুভব করতে থাকলো সে।

আয়মান খানিকটা কাছে এসে নিধির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললো,

‘এই নরম ঘাসগুলোর মতো তুমিও নরম গো নিধিপরী ! একমুহূর্ত তো ইচ্ছে হয়েছিলো তোমাকে নিজের মাঝে লুকিয়ে ফেলি…………..সময়টা একবার হোক! তখন ঠিকই এই বুকে তোমায় রেখে দেবো।’

বলেই স্মিত হেসে ভেতরের দিকে চলে গেলো আয়মান। নিধি এখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়মানের ফিসফিসানো কথাগুলো স্মৃতিচারণ করতেই শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেলো ঠান্ডা একটি স্রোত। কি দুর্দান্ত একটা অনুভূতি। এই মেঘলা আকাশের শীতলতার মতোই আয়মান যেন ওকে আবিষ্ট করে ফেলেছে। এমন মানুষটাকে কি আর না ভালোবেসে পারা যায়?
.
.
.
ঢাকা ভার্সিটর কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের ছাত্র আয়মান। মাস্টার্স শেষ করে চাকরিতে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন হলো। এমন একটা ছেলেকেই তো নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে চেয়েছিলেন নিধির মা রাবেয়া বেগম। সেদিন পাশের বাড়ির ভাবি যখন এই সমন্ধ নিয়ে এসেছিলেন নিধির জন্য তার যেন খুশির সীমা রইলো না। কিন্ত নিধি এ ব্যাপারে খুশি ছিলো না। সবে মাত্র ইন্টার প্রথম বর্ষ শেষ করেছে এর মধ্যেই বাবা-মা’র বিয়ের জন্য জোড়াজোড়িতে কান্না এসে পড়ছিলো মেয়েটার। কিন্ত বাবা-মা এমনভাবে জোড়াজোড়ি করলো যে সে আর না করতে পারলো না অত্যন্ত বাবার কথা ভেবে। উনি অসুস্থ মানুষ। রিটায়ার্ড হয়েছেন বছর পাঁচেক ধরে। এর মধ্যে মেয়ের ভবিষ্যত তিনি অনিশ্চিত রাখতে চান নি। তাছাড়া আয়মান সম্পর্কে পুরো খোঁজ খবর নিয়েই সে কথা এগিয়েছেন।
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। বিকেলের পশ্চিম আকাশের উদয়মান সূর্য এবার নেমে যাচ্ছে ধীর গতিতে। বয়ে চলছে নির্মল হাওয়া, সেই সাথে চাপা ফুলের একটা ভ্যাপসা গন্ধে পুরো ছাদে যেন নতুনত্বের সমারোহ।
নিধি খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে ছাদে ছেলেটার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে ফুপির পছন্দ মতো হলুদ শাড়ি আর হাল্কা সাজে দেখতে অপরূপা থেকে কম মনে হবে না। ছেলেটার সাথে যে ঠিক কি ভাবে কথা শুরু করবে এটা যেন ও ভেবেই পাচ্ছে না।

‘টেনশন ভর করেছে?’

হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠে কানে ভেসে আসাতে চমকে ওঠলো নিধি। টান টান উত্তেজনা নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয় দুজনের। ছেলেটা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।এই হাসি দেখে আরও বিব্রত হলো নিধি। বোঝাই যাচ্ছে যে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা সহজ ভঙ্গির কিন্ত নিধি এমন না। সে সবার সাথে এতটাও সহজ হতে পারে না। অতঃপর গলা খাকারি দিয়ে বললো,

‘একটু………………’

‘জীবনের এই প্রথম হয়তো আমিই তোমাকে দেখতে এসেছি। সুতরাং এ অভিজ্ঞতাটি তোমার প্রথম! তাই না?’

আরও বিব্রত হয়ে পড়লো নিধি। কোনো ছেলে যে এমন প্রশ্ন করতে পারে নিধির তা ধারনা ছিলো না। এর থেকেও আরও বেশি অবাক হলো যখন ছেলেটা ওকে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে।নিধি আবারও মৌনভাবে প্রতিউত্তর দিলো,

‘জ্বি। এটাই আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।’

‘তো আমি শুনেছিলাম যে তুমি নাকি এখন বিয়ে করতে চাও না?ব্যাপারটি কি সত্যি!’

িনিধি শুকনো কাশি দিলো। এই ছেলেটার সাথে যতই সহজ হওয়ার চষ্টা করছে তই যেন জটিল হয়ে যাচ্ছে। আবারও নিধি বললো,

‘আমি আরও পড়ালেখা করতে চাই। তাই একটু সময় চেয়েছিলাম।’

‘আচ্ছা যদি এমন হয় এক জন সাধারন মানুষ তোমায় নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখতে চায়? চায় তোমার সাথে ছোট একটি পৃথিবী গড়ে তুলতে? এমনকি তোমার কোনো স্বপ্নপূরণেও সে বাধাঁ দিবে না তবে তোমার উত্তর কি হবে? তুমি কি রাজি হবে?’
ছেলেটার আড়ষ্ট কন্ঠ। নিধি একটা তপ্তশ্বাসছেড়ে বললো,

‘আমার জীবনে এমন কেউই নেই।’

‘আগে ছিলো না…………তবে এখন আছে।’

‘কে সে?’

‘এইযে আমি !’

ছেলেটার কথায় নিধির চোখ বড় বড় হয়ে আসলো। অবাকমিশ্রিত গলায় কিছু বলতে যাবে তখনই ছেলেটা আবার বললো,

‘চাকরি পাওয়ার পরই মা আমার জন্য মেয়ে খোঁজার অভিযান শুরু করেছে। কোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই আমায় বলতো ‘আয়মান এই মেয়েকে বিয়ে কর!’ আমায় মায়ের ভাষ্যমতে পৃথিবীর সব মেয়েই মিষ্টি। কিন্ত আমি কখনোই কোনো মেয়ের প্রতি টান অনুভব করিনি। সেদিন রাতে মা যখন আমায় তোমার ছবি দেখিয়েছিলো, বিশ্বাস করো , একমুহূর্তের জন্য আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। তুমি বইমেলার বাংলা একাডেমিতে মাথায় ফুলের মুকুটটি পড়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। হাতে একগুচ্ছ বই। ইসস! জানো তোমায় কতটা মোহনীয় লাগছিলো? তখনই মাকে আমি বলে দেই ,আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করবো না।’

লজ্জায় পড়ে গেলো নিধি। ছেলেটার আড়ষ্ট কথাবার্তার ভঙ্গিতে ওর রুদ্ধশ্বাসে শুধু ছেলেটার কন্ঠ অনুভব হচ্ছে। আধ ঘন্টার পরিচয়ে কেউ কি এত সহজে কাউকে কাবু করতে পারে? হয়তো আয়মান পেরেছিলো। নিধির মনে হঠাৎ ভালোলাগার নির্মল প্রবাহ বয়ে যেতে শুরু করলো। ঠোঁট কামড়ে পশ্চিম আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখা সন্তর্পণে। আয়মান তা দেখে কিঞ্চিত হেসে বললো,

‘আমি এক বইয়ে পড়েছিলাম……………..যে মেয়েরা ঘনঘন ঠোঁট কামড়ায় তারা নাকি অনেক রোম্যান্টিক হয়!অবশ্য তোমার কথা জানিনা তবে তোমার থেকেও হয়তো আমি দ্বিগুন হবো।’

হেসে দেয় নিধি। আয়মান ছেলেটাকে প্রথম দেখাতে যতটা শান্ত মনে করেছিলো অতটাও সে শান্ত না। দুজনের অবচেতন মনই বারবার বলছে ওদের বিয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। তাই হয়তো আয়মান তার সুপ্ত গুণগুলো নিধির সামনে প্রকাশ করে চলছে।নিধি এবার মৃদু কন্ঠে বললো,

‘আমি কিন্ত আপনার মতো সবার সাথে এত সহজ হতে পারিনা। আমার হয়তো আরও অনেক খারাপ গুণ আছে। রান্না তেমন পারিনা, সাজগোজে অনীহা………..সবকিছুতেই অভিজ্ঞতা কম তবুও আপনার আমাকে পছন্দ হয়েছে। পরে বউ হিসেবে সামলাতে পারবেন তো?’

‘বউ হিসেবে সামলাতে পারবো কিনা জানিনা তবে একজন ভালো হাজবেন্ট হওয়ার চেষ্টা অবশ্যই করবো।’

আয়মানের মৃদু কন্ঠে একরাশ স্নিগ্ধতা অনুভব করলো নিধি। ছেলেটার কথাবার্তা আচার আচরণ অবশ্যই চোখে পড়ার মতো যা নিমিষেই মনে অনুভূতির আদান-প্রদান শুরু করে। নিধির মায়াবী মুখে আয়মান এক নয়নে তাকিয়ে থাকলো মোহনীয়তার সাথে।

——————

পরবর্তীতে দু পরিবারই এ সম্পর্ককে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে নেয়। হ্যাঁ, বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে নিধি আর আয়মানের। তবে ওদের বিয়েটা এখন হবে না। আপাতত এনগেজমেন্ট করে রাখবে এটাই দু পরিবারের সিদ্ধান্ত। আর তাই আজ বিকেলের দিকে আয়মান ওর মায়ের সাথে নিধির বাড়িতে আসবে বলেছিল যা নিধি একপলক ভুলেই গিয়েছিলো।তাই বাগানে একা একা ঘুরোঘুরি করতে করতে হুট করে যে আয়মানের মুখোমুখি হয়ে যাবে এ নিয়ে ওর বিন্দুমাত্র ধারনা ছিলো না।
কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে করতেই মুখে এক রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়লো নিধির। তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো বসার ঘরের দিকে।

আয়মানের মা আর রাবেয়া বিবি বসে আছেন বসার ঘরে। নিধিকে দেখে মুচকি হাসলেন আয়মানের মা। নিধি বিনয়ী সুরে বললো,

‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি !’

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা? পড়ালেখার কি অবস্থা?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

‘আমার পাশে একটু বসো তো!’

নিধি কথামতো বসে পড়লো মোনা বেগমের পাশে। তিনি এবার নিধিকে টেবিলের দিকে ইশারা করে বললো,

‘দেখো তো ! এখান থেকে কোনো আংটি পছন্দ হয় তোমার?’

নিধি তাকালো টি টেবিলের দিকে। সেখানে তিন চারটি বাক্স খোলা আছে যেখানে আংটিগুলো দেখা যাচ্ছে। নিধির চোখ গেলো একটি ছোট্ট পাথরের কারুকাজ করা আংটির দিকে। ওটা ওর চোখে যেন বারবার তাক করছে। নিধি মিহি কন্ঠে বললো,

‘আন্টি ওই আংটিটা সুন্দর !’

আংটির দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের স্মিত হাসি প্রসারিত করলেন মোনা বেগম।তারপর খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে বললেন,

‘আয়মান তোমার জন্য এই আংটিটাই পছন্দ করেছিলো ।এমনকি দৃঢ় গলায়ও বলেছিলো যে এই আংটিটাই নাকি তুমি পছন্দ করবে। ব্যাপার কি মামণি ! দুজনে আগেভাগেই পছন্দ করে রেখেছিলে নাকি!’

লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেললো নিধি। আয়মান মায়ের এক পাশে আয়েশ করে নিধির লজ্জামিশ্রিত মুখ দেখতে মগ্ন। অতঃপর নিধি মিশ্রিত গলায় বললো,

‘না আন্টি।’

ব্যাপারটা আসলেই সত্যি। আয়মানের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে দু সপ্তাহ হতে চললো এর মধ্যে ওদের দুজনের ফোনের যা কথা হয়েছে বললে ভুল হবে ! আয়মানই কথা বলেছে । নিধি বিনিময়ে হু হা ছাড়া কিছুই বলতো না। তবুও আয়মানের কথা শুনতে ওর ভালোলাগত। কিছু কিছু সময় শোনার মধ্যেও তো প্রেম প্রকাশ পায়। এভাবেই না হয় ওদের বিনাবাক্য প্রেমালাপ চলুক!
.
.
নিধির জন্য আংটি নির্বাচন করে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন মোনা বেগম আর আয়মান। নিধি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আয়মানের যাওয়া দেখছে। বাইরে মৃদু ঠান্ডা বাতাস। হয়তো কিছুক্ষণ পরই আকাশ চিরে বৃষ্টি ঢলে পড়বে। আয়মান মাথা উচিয়ে একপলক শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো নিধির দিকে। নিধি আশা করেনি যে আয়মান বারান্দায় ওর উপস্থিতি বুঝে যাবে। মুচকি হাসলো আয়মান। তারপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো নিধিদের বাসা থেকে।

কিছুসময় যেতে না যেতেই নিধির ফোনে একটি মেসেজ এলো। যা দেখে স্মিত হাসি ফুটে ওঠলো ওর ঠোঁটকোলে। আয়মান মেসেজ দিয়েছে,

‘নিজের খেয়াল রেখো প্রাণোসী!’
.
.
.
.
#তুমিময়_বসন্তে
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব_১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here