তুমিময় বসন্তে,পর্ব:৩

#তুমিময়_বসন্তে
#কায়ানাত_আফরিন
#পর্ব_৩

সকালটা আজ ভারী সুন্দর লাগছে নিধির । ঘুম যেন কেটেই ওঠছে না গতরাত আয়মানের সঙ্গে মোবাইলে সারারাত যে গল্পের আসরে মেতে ওঠেছিলো সেই সাপেক্ষে এবার ঘুম ভাঙবে কিভাবে? বাহির থেকে অল্পবিস্তর চিৎকার হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। অতিথির রাঙাবেশে বেষ্টিত চারিপাশ। এসময় ঘুমে মজে যাওয়াটা কোনো ভদ্রতার খাতিরে পড়েনা। অগত্যাই আধভেজা ঘুম নিয়ে উঠে পড়লো সে।

জানালা দিভে স্বচ্ছ নীলাভ আকাশ দেখা যাচ্ছে। হাওয়ার তালে রেশমের ন্যায় উড়ে চলছে সেখানকার পর্দা। আহা! কি মনোরম দৃশ্য। পাশে ক্যালেন্ডারের পাতা দেখে মুচকি হাসলো সে। দিন কত দ্রুতই না বয়ে যায়। মনে হচ্ছে এইতো কিছুদিন আগেই আয়মান নামক মানুষটার সাথে ওর প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তার কথার ভাজে অল্পবিস্তর হাসি , বন্ধুসুলভ আচরণ সব শেষে নিধির প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা……….সবকিছুই মায়াজালে ফেলে দিচ্ছিলো নিধিকে।দেখতে দেখতেই ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে ঘনিয়ে এলো বিয়ের প্রহর। আজ নিধির গায়ে হলুদ। আজ রাত পেরিয়ে পরের দিনই তাকে এই বাড়ি ত্যাগ করে চলে যেতে হবে। এটাই তো নিয়ম।

ভাবতেই খুশির সাথে দুঃখও জমলো একরাশ। সে তো বাবার চোখের মণি। একমাত্র সন্তান হওয়াতে বাবা ওকে পরম আদরে বড় করেছিলো। সেই বাবা বৃদ্ধ বয়সে কিভাবে থাকবে নিধিকে ছাড়া?

হঠাৎ দরজায় টোকার আওয়াজে ওর চিন্তার রেশ কাটলো। তুলি ডাকছে খানিকটা বিরক্তির স্বরে। আক্ষেপসুরে বলছে……..

-এই নিধি? তাড়াতাড়ি ওঠ। বেলা পেরিয়ে যাচ্ছে আর এই মেয়ে ঘুমে মগ্ন। এটা কোনো কথা?

-উঠছি।

এটা বলে দরজা খোলার জন্য উদ্যত হলো সে। দরজা খোলতেই দেখা পাওয়া গেলো তুলির। কোমড়ে হাত দিয়ে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে আছে। নাকের ডগায় সামন্য ঘামের কণা। মৃদু কন্ঠে সে বললো,

-তোর কি এদিকে কোনো খবর আছে? মামি তো আমায় কামলার মতো খাটাচ্ছে আর তুই? জলদি ফ্রেশ ট্রেশ হ। মেহমান এসেছে আর মামি তোকে বলছে সবার সাথে দেখাসাক্ষাৎ করতে। বিকেলে পার্লারের লোক তোকে সাজাতে আসবে।

-আচ্ছা আমি তাহলে গোসল সেরে আসি।

বলেই ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো নিধি। আজ ওকে ঘিরে অনেক আয়োজন। তাই দ্রুত গোসল সেরে ফেলাটাই শ্রেয় হবে।

———————

ক্লান্ত দুপুর। এতক্ষণের জমজমাট কোলাহলটা দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর কেমন যেন নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।নিধি সবার সাথে লম্বা সময় আড্ডা চালিয়ে পরিশ্রান্ত ভঙ্গিতে ঝাপ দিলো বিছানায় । সকালের বাকি রয়ে যাওয়া ঘুমটা এখন পুষিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ ওর মোবাইলের কথা মনে পড়লো। গতরাত আয়মানের সাথে কথা হওয়ার পর মোবাইলটা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে চার্জে বসিয়েছিলো। পরে মোবাইল আর অন করা হয়নি। তড়িঘড়ি করে বেডসাইট টেবিলে হাত দিলো নিধি। লম্বা সময় চার্জে থাকার ফলে মোবাইল কিছুটা গরম হয়ে আছে। ফোনটা অন করতেই নিধি হতবাক। ৩০+ মিসড কল তো আছেই সাথে মেসেন্জারেও একসাথে টেক্সট আর কল এর হামলা চালিয়েছে আয়মান। যেন এই মুহূর্তে সে কল না ধরলে অভিযান শুরু করবে। ঠোঁট কামড়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলো নিধি। এখন কি কল ব্যাক করা উচিত?

আয়মানের বাসাতেও হলুদের কার্যক্রম চলছে তাই হয়তো এই দুপুরে কল দেওয়াটা ঠিক হবে না। পরক্ষণেই নিধি মত পাল্টে নিলো। কেননা নিধির কাছে আয়মানের সাথে কথা বলার এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। কল দিতেই দু বার রিং হওয়ার পর অপরপাশ থেকে কেউ চিন্তিত স্বরে বললো,

-হ্যালো নিধি। আর ইউ ফাইন? সেই কখন থেকে তোমায় কল করছি কিন্ত তোমার ফোন বন্ধ ছিলো। কোথায় ছিলে তুমি?

আয়মানের কথায় ঠোঁট কামড়ে হাসলো নিধি। ছেলেটা অল্পতেই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আড়ষ্ট কন্ঠে তাই নিধি বললো,

-এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।

আয়মান বিদ্রুপ হাসে। আজকাল এই মেয়েটা ওর সাথে বড্ড রসিকতা শুরু করেছে।

-তো দেখা করে ফিরে আসলে এত জলদি? আমি আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের কাছে গেলে তো ৬ ঘন্টার আগে ফিরে আসতাম না।

-আবার গিয়ে দেখেন। ঠ্যাং ভেঙে ফেলবো।

সশব্দে হেসে ওঠলো আয়মান। অপরপাশে নিধি নিশ্চুপ। মৌনতার সাথে সে আয়মানের মোহনীয় হাসি উপভোগ করে চলছে।

-তো আজ কি প্ল্যান আছে তোমাদের?

-জানি না। বিকেলের দিকে পার্লারের মেয়েরা আমায় সাজাতে আসবে । তারপর বাকি সব পরিকল্পনা করেছে আমার কাজিনরা।

-বুঝতে পারলাম………….তো একটু পরেই তো ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাই না?

-উমমম…..বলতে পারেন।

স্মিত হাসলো আয়মান। তারপর মিহি গলায় বললো,

-আমায় মিস করবে না?

মিহিয়ে গেলো নিধি। অপরপাশে আয়মান নিধিকে চুপ থাকতে দেখে বললো,

-থাক। আর কিছু বলতে হবে না। কল রাখছি নিধি। নিজের খেয়াল রেখো।

-আপনিও খেয়াল রাখবেন।

বলেই কল কেটে দিলো নিধি। দুপুরের নিভৃত নিস্তব্ধ প্রহর। আয়মানের ছোট ছোট কথার আদলে বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দ তৈরি হচ্ছে। আর মাত্র একদিন। এই সময়টুকু কেটে গেলেই সে আয়মানের সাথে একটা নতুন অধ্যায়ে পাড়ি দিবে।

————————

হলুদের কার্যক্রম ইতিমধ্যে শেষ। সেই সন্ধ্যে থেকে শুরু হওয়া অনুষ্ঠান শেষ হলো মধ্যরাতে। নিধির সকল কাজিন ক্লান্তিতর সাথে ডেকোরেটর চেয়ারে হেলে পড়ছে। সকাল থেকে ব্যস্তময় রাবেয়া বানুর চোখে মুখেও ক্লান্তি। নিধি তুলির সাহায্য নিয়ে শাড়ি পাল্টে পুনরায় গোসল করে নিলো। হলুদের সংস্পর্শে ওর গায়ে হলুদাভ আভা নিদারুনভাবে ফুটে ওঠা।নিধি হেলেদুলে বিছানায় শুয়ে পড়বে তখনই হঠাৎ মনে পড়লো বাবার কথা। আজ একটা ব্যস্তময় দিন কেটেছে বিধায় বাবার সাথে দুদন্ড কথা বলার সময় পায়নি নিধি। আজ রাতটা ওর কেমন যেন মনে হাহাকারের সঞ্চার করছে। হয়তো আগামীদিন জীবনের কিছু মহামূল্যবান মানুষের থেকে দূরত্বে চলে যাবে তাই।

গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিধি চলে গেলো বাবার কাছে। ঘড়ির কাটা তখন দেড়টায় ছুইছুই।এসময় বাবা ঘুমিয়ে পড়লেও নিধি জানে আজ তার বাবা ঘুমাতে পারবে না। হলোও তাই। উনি বারান্দার রকিং চেয়ারে মাথা এলিয়ে রেখেছেন আনমনে। নিধি মলিন গলায় বললো,

-বাবা !

নিধির বাবা মাথা উঠালেন।

-কিরে মামণি? এখনও ঘুমাসনি? আয় । আমার কাছে বস।

নিধি কথামতো বসলো। আজ সে নিজের বাবাকে প্রাণভরে দেখে রাখছে। আগামীকাল যে এই মানুষটার থেকে দূরে চলে যাবে। মা হয়তো এখনও অতিথিয়তায় ব্যস্ত নাহলে আড়ালে হয়তো তিনিও মেয়ের জন্য কাদছেন। নিধি আজ নিজের বাবাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। সেই প্রাণোজ্জল মুখখানার পেছন চাপা দুঃখ। তবুও মুখে প্রশান্তির হাসি। হয়তো মেয়েকে যোগ্য পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে পেরেছেন তাই। নিধির সময়টা ভালোলাগছে । এককথায় অনন্য লাগছে। কাল হয়তো এসময়ে সে একজন প্রেমিক পুরুষের বাহুবন্ধনে থাকবে তবে আজ এই সময়টা বাবার সাথেই নাহয় কাটাক। মন্দ কি?
.
.
.
.
#চলবে……….ইনশাআল্লাহ!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here