তুমিময় বসন্তে,পর্ব:২

#তুমিময়_বসন্তে❤
#পর্ব_২
#কায়ানাত_আফরিন
কলেজ স্ট্রিটে হঠাৎ আয়মানকে দেখে চমকে ওঠলো নিধি। আজ বৃহস্পতিবার। ফলে রাস্তাঘাটে ভিড়ভাট্টা খানিকটা বেশি। রৌদ্রজ্জল দিন হওয়াতে গাছের ফাঁকফোকড় দিয়ে সুন্দর রশ্নি রাস্তার বুকে আছড়ে পড়ছে। এক কথায় দুর্দান্ত একটি সময়। তবুও সেদিকে নিধি খেয়াল করলো না। কাধে কলেজের ব্যাগ আর হাতে আচার দিয়ে ড্যাবড্যাব করে সে তাকিয়ে আছে আয়মানের দিকে।

আয়মান খানিকটা এগিয়ে এলো নিধির কাছে। নিধির পাশে ওর সমবয়সী ফুপাতো বোনও যে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নিধিকে বললো,

‘কেমন আছো নিধি?’

আয়মান হঠাৎ বলা এই ক্ষুদ্র বাক্য যেন কাপিয়ে তুললো নিধিকে।এতদিনের জমানো আবেগটা হঠাৎ অবাধ্য হৃদয় চিরে বেরিয়ে যেতে চাইছে।আজ কতদিন পর মানুষটাকে দেখলো নিধি? এইতো……..হয়তো চার-পাঁচ দিন। এই চার-পাঁচদিন যে আয়মানকে দেখার জন্য ওর ছোট্ট মন আনচান করছিলো সেদিকে এই মানুষটার কি কোনো খেয়াল আছে?

‘কি হলো নিধি? কিছু জিজ্ঞেস করছি।’

আয়মানের কন্ঠে ধ্যান ভাঙলো মেয়েটার। ফলে ইতস্তত করে বললো,

‘আলহামদুলিল্লাহ্। ভালো আছি।আপনি হঠাৎ এখানে?’

আয়মান স্মিত হাসলো। কিন্তু এই হাসির ভাবাবেগ নিধির দৃষ্টিগোচর না হলেও এর অর্থ সে বুঝতে পারলো না। নীরবতা কেটে আয়মান বললো,

‘এইতো ! তোমার সাথে একটু দেখা করতে এলাম।’

পাশ থেকে গলা খাকারি দিলো নিধির ফুপাতো বোন তুলি। দুজনেই কলেজ শেষ করে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো। তুলি শুকনো কন্ঠে বললো,

‘আমি তাহলে একাই বাড়িতে গেলাম নিধি। তুই আর ভাইয়া নাহ ধীরগতিতে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে আস। আফটার অল মনে তোর কত কথা জমা হয়ে আছে, এখন না বললে তো পেট ফেটে মরে যাবি।’

লজ্জায় পড়ে গেলো নিধি। তাই মাথাটা একটু নিচু করে ফেলেছে। আয়মান বিস্ময় নিয়ে তুলিকে প্রশ্ন করলো,

‘কথা জমা হয়ে আছে মানে?’

দুষ্টু হাসলো তুলি। অতঃপর ঠোঁট কামড়ে বললো,
‘সেটা নাহয় আপনার হবু বউকেই জিজ্ঞেস করুন। আমি এসবে নেই বাপু!’

বলেই দ্রুতপায়ে পা চালিয়ে তুলি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এখন এখানে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আয়মান আর নিধি। কলেজ ছুটি হয়েছে তো অনেকক্ষণ হলো তাই লোকসমাগমও সময়ের প্রবাহে কমে গিয়েছে। আয়মান প্রসন্ন গলায় বললো,

‘সামনের রাস্তায় যাবে নিধি?’

‘কি-কিন্ত আপনার অফিস নেই?’

‘লাঞ্চ ব্রেক চলছে ম্যাম। একটু আধটু অফিস ফাঁকি দিয়ে হবু বউয়ের সাধে ঘোরাঘুরিতে মন্দ হয় না।’

নিধি কিঞ্চিত হাসলো বিনিময়ে। তারপর প্রতিউত্তরে বললো,

‘চলুন তাহলে যাওয়া যাক !’

___________

দমকা বাতাসের তালে উড়ে চলছে গাছের শুষ্ক পাতাগুচ্ছ। আকাশের সাদা মেঘের সৌন্দর্যে দূর দূর মনোমুগ্ধকর লাগছে। একটি সরু পিচঢালাই রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলছে আয়মান আর নিধি। দুজনের মধ্যে স্বাভাবিক দুরত্ব। এই রাস্তায় দালানকোঠার সংখ্যা কম। যা আছে সবই সর্বোজোড় দুতল বিশিষ্ট পুরোনো ধাঁচের। কেমন যেন একটা রাজকীয় ভাব ফুটে ওঠে এ ঘরগুলোতে। নিধি একপলক তাকিয়ে নিলো আয়মানের দিকে। আয়মানের পরনে কালো শার্ট, সাদা প্যান্ট। নিধির কাছে আসবে বলে অফিসের আইডি কার্ড পকেটে গুজে রেখেছে।
নিধি একপলক নিজের দিকে তাকালো। পরনে সাদা রঙের কলেজ ইউনিফর্ম , পায়ে কালো জুতা। চুলগুলো বেণী করে একপাশে এনে রেখেছে। দেখে মনে হবে নিতান্তই বাচ্চা। তা দেখে নিধির স্মিত মুখ নিমিষেই বির্বণে ছেয়ে গেলো। আয়মান তা দেখে বললো,

‘এভাবে মুখ কালো করে রেখেছো কেনো?’

‘কোথায় মুখ কালো করে রেখেছি?’

ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো নিধি। আয়মানের কপাল ভাজ পড়ে গেলো নিধির কথায়।তারপর বলে ওঠলো,

‘তোমার মুখ দেখে আমি স্পষ্ট তোমার মনের কথা পড়তে পারি গো নিধিপরী ! এতটুকু গুণ না থাকলে তো তোমার প্রেমিকপুরুষ হওয়ার যোগ্যতাটিই হয়তো আমার হবে না।’

তপ্তশ্বাস ছাড়লো নিধি। এই মানুষটা যতটা সহজ , তার কথাবার্তা ততটাই জটিল। কেমন যেন নেশা ধরে যায় কথাগুলো শুনলে । শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। আয়মান আবারও ধরা গলায় বললো,

‘কলেজ ইউনিফর্মে যে তোমায় এতটাও সুন্দর লাগবে আজ না দেখলে তো আমি ভাবতেই পারতাম না। ভাবছি যে বিয়ের পর তোমায় শাড়ি না পড়তে দিয়ে ইউনিফর্মই পড়তে বলবো।’

আয়মানের অসংলগ্ন কথাবার্তায় নিধির চোখ আপনাআপনি বড় বড় হয়ে গেলো। এই মানুষটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি? কি সব যাচ্ছে-তাই কথা বলছে? নিধি কিছু বলতে যাবে তার আগেই আয়মান বল ওঠলো,

‘ঝালমুড়ি খাবে?’

‘হ্যাঁ?’

‘বললাম ঝালমুড়ি খাবে?’

আয়মানের চোখদৃষ্টি অনুসরণ করে নিধির চোখ গেলো সামনে ঝালমুড়িওয়ালা মামার দিকে। সেখানে তিন চারজন যুবক-যুবতী আর স্কুলে পড়ুয়া মেয়ে সমাগম করে রেখেছে। আয়মান নিধির মৌনতাকে সম্মতি ভেবে নিজের একহাতে নিধির কব্জি চেপে ধরে নিয়ে গেলো সেদিকে। ফুলের একটা সুন্দর সুঘ্রাণে কেমন যেন পরিবেশটা মন কাড়ার মতো। আয়মান ঝালমুড়িওয়ালাকে বলে ওঠলো,

‘মামা ! ১০ টাকার দুইটার ঝালমুড়ি দেন তো?’

‘ঝাল ছাড়া দিবো নাকি কড়া ঝাল দিয়ে দেবো?’

আয়মান নিধির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো.
‘ঝালদিয়ে খাবে?’

‘উমমম! খাওয়া যায়।’

‘তাহলে মামা। একটা ঝালদিয়ে আর একটা ঝালছাড়া বানান।’

আয়মানের কথা শুনে নিধি বুঝে নিলো যে মানুষটা ঝাল খেতে অভ্যস্ত না। বৃদ্ধ মামা আয়মানের কথায় মুচকি হেসে ঝালমুড়ি বানাতে মগ্ন হলো। দিন যত এগোচ্ছে ততই আয়মান মানুষটার জন্য মনে ভালোলাগার পরিমাণটা চক্রবৃদ্ধিহারে যেন বেড়ে যাচ্ছে। ছেলেটার মধ্যে নুন্যতম দাম্ভীকতা নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকপ্রাপ্ত এই ছাত্র একটি ভালো জায়গায় চাকরি করছে। চাইলেই সে তার হবু বউকে নিজের অর্থের গরম দেখাতে পারতো , বিভিন্ন বড় বড় রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে নিয়ে যেতে পারতো। সুযোগ পেলে অশ্লীল স্পর্শ করতেও হয়তো হাত কাপতো না কিন্ত আয়মান এমন না। সে অল্পতেই সন্তুষ্ট হতে পারে। ছোট ছোট জিনিসের ভীড়েই আনন্দ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে।
মানুষটার দিকে লম্বা কিছুক্ষণ তাকিয়ে অন্যদিকে তাকালো নিধি। সামনেই তিনচারজন স্কুল পড়ুয়া ছাত্রী আয়মানকে দেখছে আর ফিসফাস করে কিছু বলছে। নিধির চোখদুটো আপনাআপনি ছোট হয়ে গেলো। কি এমন কথা বলছে ওই মেয়েগুলো?

‘এই নাও নিধি।’

আয়মানের কথায় ধ্যান ভাঙলো ওর। আয়মান কিছুটা অবাক হলো নিধির কুচকানো মুখ দেখে। কোনো কারনে নিধি বিরক্ত । এককথায় প্রচুর পরিমাণে বিরক্ত। নিধি কাগজের ঠোঙায় মোড়ানো ঝালমুড়ি নিয়ে আনমনে খেতে লাগলো। আয়মানও কিছু বললোনা। নিধি বারবার মেয়েগুলোর দিকে তাকাচ্ছে আর ঝালমুড়ি খাচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ গভীর পর্যবেক্ষণের পর আয়মান বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ওর ঠোঁটের কোলে ফুটে ওঠেছে এক দুষ্টু হাসি। আয়মান তাই ওর হাত আকড়ে ওই জায়গাটি থেকে সরে নিয়ে এলো…………………নিধি বিনিময়ে কিছুই বলেনি আয়মানকে।

বাতাসের গতি বাড়ছে। নিদারুন শীতল স্পর্শে নিধির উষ্ণ দেহ আচমকাই শীতল হয়ে এলো। সারাদিনের ক্লান্তিটা কেমন যেন হারিয়ে গেছে বাতাস আর পাশে থাকা মানুষের উপস্থিতিতে। পাশে থাকা অভিনব মানুষটা নিজের আদ্র কন্ঠে বলে ওঠলো,

‘আমি না কেমন যেন বাতাসের সাথে হিংসুটে হিংসুটে গন্ধ পাচ্ছি। তুমি কি পাচ্ছো?’

নিধি চোখ সরু করে আয়মানের দিকে তাকালো। সে যে ঢপ মারছে তা বুঝতে বাকি নেই। নিধি এবার সরু কন্ঠে বললো,

‘আপনি থাকেন আমি গেলাম!’

‘আরে…………….সরি বলছি তো। এভাবে রেগে গেলে এই মানুষটার কষ্ট হয়না বুঝি?’

বলেই নিধির পাশাপাশি হাঁটতে থাকলো আয়মান। ঠোঁটের কোণে ছেলেটার প্রাণোচ্ছোল হাসি। আয়মান এবার একটি রিক্সা থামিয়ে উঠে পড়লো সেটাতে। ইশারায় বললো নিধিকে উঠে বসতে। শুকনো ঢোক গিললো নিধি । জড়ানো গলায় বললো,

‘আমি……………হেঁটে যাই?’

‘রিক্সাটা তোমার জন্যই কিন্ত নিয়েছি।’

নিধি আর কিছু বললো না এতে। এই সময়টাতে রিক্সা দিয়ে বাসায় যাওয়াটাই হয়তো শ্রেয়। এতক্ষণের রৌদ্রজ্জল আকাশটি হঠাৎ ছেয়ে গেলো কালো মেঘের আলতো আবরণে। দমকা বাতাসে মুখরিত সর্বত্র। ফুটপাতের অস্থায়ী দোকানগুলো চুটিয়ে বন্ধকরার চেষ্টায় রয়েছে দোকানদাররা। খালি রাস্তাঘাটে কেবল দু-চার জোড়া রিক্সা আর অটোগাড়ি ছাড়া কিছুই নেই। এই রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসলে মন্দ হতো না। তাই নিধি আয়মানকে বললো,

‘আপনি এভাবে রিক্সা ডাক দিলেন কেনো?’

পাশের মানুষটা নিধির কথায় স্মিত হেসে ওঠলো। এক হাত দিয়ে অবাধ্য চুলগুলো ঠেলে দিলো পেছনের দিকে। অতঃপর কিছুটা ভেজা গলায় সে বললো,

‘তোমার হিংসুটে মুখটার রূপে মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম প্রাণোসী।চাইনি এই সৌন্দর্যের জালে অন্যকাউকে হারিয়ে দিতে। তাই তো ফট করে রিক্সায় চড়ে গেলাম যাতে কেউ তোমায় না দেখতে পারে। তোমার রূপের মায়ায় শুধু আমি পড়তে চাই নিধিপরী , চাই না অন্য কেউ পড়ুক !’
.
.
.
.
#চলবে…………..ইনশাআল্লাহ

ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here