#তুমি_আমার
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
ভর সন্ধ্যায় উবু হয়ে শুয়ে পা নাচিয়ে ফেইসবুকিং করছে সিরাত।এখন এটাই তাঁর নিত্য দিনের সাথী।অবসর সময়ে একটি গার্লস গ্রুপে চ্যাটিং করে।ফেইসবুকে অহরহ মানুষের সান্নিধ্যে এসে সকলের দুঃখ কষ্টগুলো শুনে নিজের কষ্টকে তুচ্ছ মনে হয় তাঁর।সবার জীবন আর ওর জীবনে অনেক ফারাক।সার্চ লিস্টে সবার উপরে আবরার আবেশ নামটা জ্বলজ্বল করে।কারণ দিনে অনেকবার এই আইডিতে ঢুকে সে।কি পোস্ট হলো কয়টা মেয়ে লাইক দিলো কয়টা মেয়ে কমেন্ট করলো সবকিছুর হিসেব আছে তাঁর কাছে।কমেন্ট বক্সে কিছু কিছু মেয়েদের ন্যাকামি দেখে রেগেও যায়।আবার নিজেই নিজেকে ঠান্ডা করে।ফোন টিপাটিপি করছে হঠাৎ হুড়মুড় করে ওর মা রুমে এসে ছোঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলেন হাতে।ঘটনায় আকস্মিকতায় হতবাক সে।অবাক চোখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো মায়ের দিকে।ওর মা আলমারি থেকে সুন্দর একটি থ্রি পিস হাতে ধরিয়ে তাড়াতাড়ি চুল ঠিক করে বাহিরে আসতে বললেন।সিরাত হতভম্ব কেন কথাটি জিজ্ঞেস করে কোনো জবাব পেলো না।হতাশ হয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে জামাটা পরে চুলগুলে বেনি করে বেড়িয়ে এলো।ড্রয়িংরুমে এসেই শক খেলো খান বাড়ির সবাই বসে আছে।তিন্নি ভাবী, আরু,আবিদ ভাইয়া,আঙ্কেল আন্টি শুধু মিঃ আবেশ নিঁখোজ।তাছাড়া রিয়া আর আয়েশাও আছে।ওকে দেখে মিঃ খান ডেকে তার পাশে বসালেন।মাথায় হাত বুলিয়ে নানা বুঝবাক্য শুনালেন তিনি।সেও ভদ্র রমনীর ন্যায় মাথা নেড়ে গেলো একাধারে।এক পর্যায়ে উনি সিরাতের বাবাকে বললেন,
-‘তা শুভ কাজে দেরী কেন আর?মেয়ে হাজির এবার আংটি পরিয়ে দিক।আর পরের সপ্তাহে বিয়ে’।উনার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো সিরাত।সামনের সপ্তাহে বিয়ে মানে!সিরাতের আব্বু বললেন,
-‘কি বলছো এত তাড়াতাড়ি বিয়ে এটা হয় না।অন্ততপক্ষে ওর এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হউক।তারপর ভাববো’।বাবার কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো সিরাত।কিন্তু উনি মানতে নারাজ।তবুও জোরপূর্বক এক মাসের সময় নিয়েছেন তিনি।
পাশাপাশি বসে আছে সিরাত আর আবেশ।আবেশের হাতে একটি ডায়মন্ড রিং ঝলমল করছে।আবেশ হাতের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক্ষণ হলো।আরু পাশ থেকে বললো,
-‘ভাইয়া আংটি টা পরাও।এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে বুঝিনা আমি’।তিন্নি বললো,
-‘আরে বাবা বিয়ে করা বউকে আংটি পরাতে এত সময় নিচ্ছ তবে বিয়ের আগে হলে কি করতে’।সকলে হাসতে শুরু করলো।গলা পরিষ্কার করে আবেশ বললো,
-‘কাকে পরাবো আর কোথায় পরাবো সেটাই বুঝতে পারছি না।ওর হাত পা কিছুই দেখা যাচ্ছে না।এই সিয়াম তোর বোনের কি হাত নেই নাকি?শেষমেশ বন্ধু হয়ে একটা প্রতিবন্ধীকে আমাকে গছিয়ে দিচ্ছিস’।সিয়াম ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে বললো,
-‘দেখ ভাই আমার বোনের হাত পা সবই আছে। এখন তোর বউয়ের হাত পা না থাকলেও থাকতে পারে সেটা আমি জানি না।তবে কি শেষ পর্যন্ত তুই একটা লোলা মেয়ের স্বামী হলি বলে হাসতে লাগলো সবাই।সিরাত চোখ গরম করে তাকালো ভাইয়ের দিকে।সামনে গুরুজন আছে তাও কেউ মানছে না। তবুও হাসছে সবাই।এদিকে আবেশকে চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে ওর।ওড়নার নিচে হাত লুকিয়েছে বলে এত বড় অপমান।আবেশ একটু ভেবে বললো,
-‘তোর বোনের না থাকলেও আমার বউয়ের সবই আছে।লজ্জায় লুকিয়ে রেখেছে ব্যাপার না।বউ তো আমারই’। ওড়নার নিচ থেকে হাত টেনে বার করে ফট করে আংটি পরিয়ে দিলো।আবেশের আজকের ব্যবহারে হতবাক সিরাত।এই কেমন আবেশকে দেখছে সে।নিজের হাত এগিয়ে দিয়ে বসে আছে আবেশ।তিন্নি সিরাতকে দিয়ে ওর হাতে পরিয়ে দিলো।আবেশের বাবা আর সিরাতের বাবার মুখে এখন তৃপ্তির হাসি।তাঁর মেয়ের বিয়ে এবার সে নিজের স্বপ্ন অনুযায়ী দেবে।
সিরাতের রুমে বসে আছে আবেশ।মুখে তাঁর এক চিলতে হাসি।এই মেয়েটার রুম বরাবরই সুন্দর গুছানো আর পরিপাটি থাকে শুধু আজকেই ভিন্ন।অগোছালো এলোমেলো।কোথাও কোনো কিছুই ঠিক নেই।মুখ গোমড়া করে রুমে ঢুকলো সিরাত।বাইরে থেকে ঠেলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে তিন্নি আর রিয়া।আবেশের সাথে কিছু কথা বলতে চায় সে।রুমে ঢুকেই আবেশের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দূরুত্ব নিয়ে দাঁড়ালো।আবেশ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।সিরাতকে দেখে বললো,
-‘কথা গুছানো শেষ এবার বলে ফেলো’।সিরাত আমতা আমতা করতে লাগলো।ওড়নার কোণায় হাত পেঁচিয়ে বললো,
-‘একচুয়েলি এভাবে এই বিয়েটার খুব কি প্রয়োজন ছিলো’?
-‘প্রয়োজন নেই বলছো’।সাবলীল ভাষায় জবাব দিলো আবেশ।সিরাত স্পষ্ট ভাষায় বললো, ‘ নাহ নেই’।বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে। নিজের শার্ট টেনে ঠিক করতে করতে বললো,
-‘তাহলে এক্ষুণি চলো।আমিও সেটাই চাই।কি দরকার সবাইকে এত খাটানোর।নিজেও খাটলাম না অন্যকেও কষ্ট দিলাম না।জামা কাপড় লাগবে না ওগুলো তোমার বর কিনে দেবে চলো’।আবেশের কথায় চোখ আপনাআপনি বড় হয়ে গেলো সিরাতের।এই লোক বলছে টা কি।আজকে কি পাগল টাগল হয়ে গেলো নাকি।নিজেকে স্বাভাবিক করে বললো,
-‘আমি এটা বলিনি।বলতে চাইছি আর মাএ কয়েক মাস পর আমার ফাইনাল এক্সাম।এখন এসব বিয়ে সংসার ঝামেলা না বাড়ালে কি নয়।এসবে তো আমার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।তাছাড়া আপনিও তো মন থেকে।বাকীটা শেষ করার আগে আবেশ বললো,
-‘এর কোনোটাতেই আমার হাত নেই।সবটাই তোমার বাবা আর আমার বাবার ইচ্ছা।তোমার মত আমিও আজকে সবটা জেনেছি।আর পড়াশোনা সেটা এখানে থেকে উফ তাহলেই হয়েছে।তারচেয়ে ওখানে ভালো হবে।আমার কথা বাদ দাও তুমি বলো তুমি কি চাও।মানতে পারো নি নাকি পেরেছো’।ফেঁসে গেলো সিরাত।এবার কি জবাব দেবে সে।কি করে বলবে এটা মেনে নিয়েছে আর না মানারই বা কি আছে এটা তো ওর অনেক দিনের ইচ্ছা।আবেশের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে ভুলে গেলো সে।আজ ওই চোখে কিছু একটা আছে এক্সট্রা কিছু।আবেশের দৃষ্টিও স্থির। চুপ করে রইলো সে আবেশ বললো,
-‘মৌনতা সম্মতির লক্ষণ।তাও যদি তোমার কোনো আপওি থাকে সেটা তোমার বাবাকে বলো আমি কিছু জানিনা’।ফট করে জবাব দিলো,
-‘আপনার কথা তো বললেন না।আপনি কি চান’?
-‘আমার চাওয়া পাওয়া নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।আমার টা আমি দেখে নেবো’।বাঁকা হেসে বললো আবেশ।
-‘দেখে নেবো বললে তো হবে না।সময় থাকতে দেখে নিন।পরে বউ রেখে বাইরে পরকিয়া করে বেড়ালে তো আমি মানবো না’।নিমিষেই চোখ মুখের অবস্থা বদলে গেলো আবেশের।চোয়াল শক্ত হয়ে এলো তাঁর।রাগে ফুঁসে উঠলো সে।আচমকা সিরাতকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘তোমার আমাকে কি মনে হয় মিস সিরাত আমি ক্যারেক্টারলেস।মেয়েদের পেছনে ঘুরা ছাড়া আমার কোনো কাজ নেই।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য তখন ওইভাবে কথা বলেছিলাম আর তুমি কি ভাবলে ছিঃ।এতদিনে এই চিনলে আমায়’।হনহন করে বেরিয়ে গেলো আবেশ।এখানে থাকলে আরো ভয়ংকর কিছু ঘটিয়ে ফেলবে সেই আশংকায় দ্রুত প্রস্থান করলো।সিরাত হ্যাবলার মতে তাকিয়ে রইলো।আজ বোধহয় একটু বেশিই বলে ফেলেছে সে।এভাবে ঘুমন্ত বাঘকে খোঁচা মারা উচিৎ হয়নি তাঁর।
🍁🍁🍁
কয়েকদিন হলো গভীর রাতে সেই মাস্ক পরা লোকটা আর আসে না।আরু এখন নিশ্চিন্তে থাকে।তবে রাতে ঘুমাতে পারে না।বারবার রাদিফ নামক লোকটা মাথায় ঘুরপাক খায় তাঁর।সামনাসামনি ভালোবাসি বলার সাহস নেই তাঁর।কারণ তাঁর মতো একজন মানুষ কেন ভালোবাসবে এই কলেজ পড়ুয়া মেয়েটাকে।যেখানে তাঁর পুরো ক্যারিয়ার সেট।অনায়াসে তাঁর সমকক্ষ কোনো স্মাট সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করতে পারে সে।তবে এত কিছুর পরও নিজের উছাতন মনকে বুঝাতে অক্ষম সে।মুখে কথাগুলো আওড়ালেও মন কেনো বাধা মানতে নারাজ।সে ভালোবাসে এটাই ঠিক।
আগামী সোমবার টেস্ট এক্সাম শুরু সিরাতের।চলছে লাস্ট সময়ের প্রস্তুতি।সেদিনের পর কেটে গেছে দুদিন।আবেশ আগের মতোই গম্ভীর মুখে কোনোকথা নেই।ক্লাস নেয় চলে যায়।তবে মাঝেমধ্যে দুষ্টামির জন্য আরু সিরাতকে কথা শুনিয়ে দেয়।গতকাল ক্লাসে আরু আর সিরাত ফিস ফাস কথা বলছিলো সেজন্য দুজনকে আলাদা আলাদা সিটে বসে ক্লাস করতে হয়েছে।সকলের বেলায় একটু আধটু ছাড় দিলেও শুধু মাএ ওরাই আছে কড়া শাসনে।সেদিনের ব্যাপারটা যে এখনও আবেশের মাথায় গেঁথে রয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছে সিরাত।কিন্তু তবুও সে চুপ।কাঁজলের সাথে মেলামেশা একটুও কমেনি তাঁর।আগের মতোই ওদের সম্পর্ক।দেখলেই রাগে গা পিওি জ্বলে যায়।তবুও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে চলেছে।মাঝেমাঝে ইচ্ছে করে কলার ধরে গুন্ডি মেয়েদের মতো বলতে,
-‘ওই আর যদি তোকে এই মেয়ের সাথে দেখি তাহলে হা পা ভেঙ্গে ঘরে বসিয়ে রেখে দেবো।ভালোয় ভালোয় বলছি ভালো হয়ে যা নইলে খবর আছে’।কিন্তু সাহস হয়ে উঠে না তাঁর।টিফিন টাইমে ক্যান্টিনে না গিয়ে কলেজ প্রাঙ্গণে হাঁটছে সিরাত।দূর থেকে আবেশ কাঁজলকে দেখে ওখান থেকে না খেয়ে সরে এসেছে সে।কিছুক্ষণেই আবেশের রুমে ডাক পরলো সিরাতের।একজন পিয়নের মাধ্যমে খবর পাঠিয়েছে সে।এই প্রথম আবেশ ওকে তার কক্ষে ডেকে পাঠালো ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত রহস্যজনক ঠেকলো তাঁর কাছে।কপালের ঘামগুলো মুছে হাত ঘড়িতে টাইম দেখে ছুটলো ওর কেবিনের দিকে।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিরাত আর আরু।ও একা আসতে ভয় পাচ্ছে বিধায় আরুকে সাথে নিয়ে এসেছে।দুই মিনিট হলো দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু ভিতরে ঢোকার বা নক করার সাহস হয়ে উঠছে না কারো।সিরাত লম্বা একটা দম নিয়ে দরজায় হাত দিতে দরজা খুলে গেলো।ভিতরে পা রাখার আগেই পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনে থেমে গেলো সে,
-‘তোমাকে একা আসতে বলেছি সাথে কোনো সাঙ্গু পাঙ্গু আনতে বলি নি’।ব্যাস হয়ে গেলো।দুজনে হা হয়ে গেলো।সিরাত একটা ঢোক গিলে আরুর দিকে তাকালো।আরু ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে হেসে হেসে প্রস্থান করলো।আজ কি আছে তাঁর ভাগ্যে কে জানে।সেদিনের কথাগুলোর জন্য কোনো শাস্তি দেবেন নাকি।শাস্তি কথাটা ভেবে হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো তাঁর।
#তুমি_আমার
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_নাজিফা_সিরাত
আবেশের সামনাসামনি বসে আছে সিরাত।আবেশ এক ধ্যানে ল্যাপটপের স্কিনে তাকিয়ে কি যেন করছে।পাঁচ মিনিট হলো সিরাত বসে আছে এবার বিরক্তি লাগছে বেশ।সামনে বসা রমনী তাঁর কাজেকর্মে চরম বিরক্ত সে সম্পর্কে অবগত সে।তবুও কাজ করে চলেছে একনাগাড়ে।মূলত তাঁর ওই বিরক্তিমাখা মুখ দেখে মজা পাচ্ছে।কাজ শেষ করে বাক্য ব্যয় না করে হাত ধুয়ে খেতে বসলো আবেশ।সিরাত বসে বসে শুধু দেখে যাচ্ছে তাঁর কান্ডগুলো।আবেশ খাচ্ছে আর আড়চোখে সিরাতকে দেখছে।সিরাত রাগে ফুসফুস করছে।ক্যান্টিনে খেয়ে এসে এখানে চেটেপুটে খাওয়া হচ্ছে।আর ওদিকে ও অভুক্ত আছে এখনও।সিরাত দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-‘আমাকে নিশ্চয় এখানে আপনার খাওয়া দেখানোর জন্য ডেকে পাঠান নি।কেন ডেকেছেন তাড়াতাড়ি বলবেন প্লিজ’।
-‘উফফ!সিরাত খাওয়ার সময় বিরক্ত করো না তো।খাওয়া শেষ হোক তারপর বলবো’।মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বললো আবেশ।
-‘তাহলে এত আগে ডেকে পাঠানোর মানে কি!খেয়ে দেয়ে ডাকলেই তো পারতেন’?দাঁত চিবিয়ে বললো কথাটি।
-‘কেন?তোমার সমস্যা হচ্ছে।খেতে ইচ্ছে করছে।দেখো আবার আমার খাবারে নজর দিও না।আমার আবার কারো নজর সহ্য হয় না তাড়াতাড়ি ইফেক্ট পরে আমি অসুস্থ হয়ে যাই’।চোখ বড় বড় করে তাকালো সিরাত।কি বলে এই ছেলে।রাগ দেখিয়ে ক্রোধ নিয়ে বলে,
-‘খবরদার আবোল তাবোল কথা বলবেন না।আপনি খেতে থাকুন আমি আসছি’।উঠতে উদ্যত হলেই ধমক দিয়ে কর্কশ কন্ঠে বললো,
-‘এক পাও নড়বে না।এখানে চুপচাপ বসে থাকো নইলে’।ভয়ে চুপসে গেলো সিরাত।মেজাজ দেখিয়ে বললো,
-‘আমি এখানে অন্ততকাল বসে থাকার জন্য এসেছি নাকি।প্রয়োজন থাকলে ফটাফট বলবেন নইলে যেতে দিন’।
-‘কুল সিরাত হাইপার হচ্ছ কেন?পাঁচ মিনিট বসো’।শান্ত কোমল কণ্ঠস্বর শুনে ইচ্ছা না থাকা স্বও্বেও বসে পরলো সিরাত।এখন গিয়েও লাভ নেই আবার আসতে হবে।আর পাঁচ মিনিটই তো।সিরাত বসে বসে আড়চোখে আবেশকে দেখে চলেছে।এ্যাশ কালারের শার্ট গায়ে দারুন মানিয়েছে তাঁকে।দেখলেই কেমন প্রেম প্রেম অনুভূতি জন্ম নেয়।হঠাৎ এক লোকমা ভাত সিরাতের মুখের সামনে ধরলো আবেশ।সিরাত হতভম্ব আবেশ তাঁকে খাইয়ে দিচ্ছে।আবেশের মুখে মৃদু হাসি।সিরাতকে অবাক হতে দেখে বললো,
-‘আজ মা খাবার পাঠিয়েছে।তখন দেখলাম সবাই খাচ্ছে তুমি কিছু খাও নি।টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছ। তাই ভাবলাম শেয়ার করি’।
সিরাত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আবেশের দিকে।এটা আদৌ সম্ভব।তাঁর কল্পনা নাকি সত্যি।মুখের সামনে কিছু শব্দ পেয়ে হুশ ফিরলো সিরাতের।রিনরিনে বললো,
-‘আমি খাবো না।আমার ক্ষিধে নেই আপনি খান’।
-‘তুমি কোনোদিনও এগুতে পারবে না সিরাত।তলানিতে পরে থাকবে।আমারই বুঝার ভুল।আবারও বলছি খেয়ে নাও।মায়ের হাতের রান্না নষ্ট করতে ইচ্ছুক নই আমি’।সিরাত আবেশের চোখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলো না।এতক্ষণের খুশিতে চিকচিক করা চোখগুলো যেন এবার রাগ মিশে একাকার হয়ে গেলো।আবেশের হাত থেকে খেয়ে নিলো সিরাত।এ যেন অন্যরকম ভালো লাগা।আবেশ খাইয়ে দিচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে।সিরাত অনুভূতির সাগরে ডুবে যাচ্ছে।হৃদস্পন্দন বাড়ছে মনের ভিতর উথাল পাতাল শুরু হয়ে গেছে এও সম্ভব।সিরাতের কাছে ক্যামেরা থাকলে এই সুন্দর মূহুর্ত টাকে ক্যামেরা বন্দি করে রাখতো সে।কিন্তু সেটা সম্ভব নয়।তাই মনের মণিকোঠায় রং তুলি ছাড়া ছবি এঁকে নিলো সে।
🍁🍁🍁
আরুর মুখোমুখি বসে আছে রাদিফ।রাস্তায় দেখা হয়েছিলো তাঁদের।এখন ক্যাফেতে কফি খেতে এসেছে তাঁরা।আরু মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে রাদিফের পানে।যতই দেখে ততই মুগ্ধতা বাড়তে থাকে তাঁর।দিনকে দিন তাঁকে মোহনীয় আকর্ষণীয় লাগে তাঁর কাছে।রাদিফ আরুর তাকানো দেখে মৃদু হাসলো।আরু সেটা বুঝতে পেরে নিজের করা কর্মকান্ডে লজ্জিত হয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো।রাদিফ গলা ঝেড়ে বললো,
“এক্সাম শেষ”?আরু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।তারপর কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটলো দুজনার।রাদিফ কিছু বলার জন্য উশখুশ করছিলো সেটা বোধগম্য হতেই আরু বললো,”আপনি কিছু বলতে চাইছেন”?থতমত খেয়ে গেলো রাদিফ।বোকা বোকা চাহনী নিক্ষেপ ফিচেল হেসে বললো,
“না তেমন কিছু না।আচ্ছা আপনার ফ্রেন্ড সিরাতের সমস্যা কি?উনি এত টেন্স থাকেন কেন?”দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরু।সিরাতের ব্যাপারে সবটাই অবগত সে।কিন্তু এই মূহুর্তে তাঁকে বলাটা কতটা মানান সই সেটা অজানা তাঁর।তাই জোরপূর্বক হেসে বললো,
“কই না তো তেমন কিছু নয়”।সন্দিহান চোখে তাকালো রাদিফ।কপালে ভাঁজ পরলো তাঁর।আরু সত্য বলছে না সেটা জানে সে।তাই বললো,”না বলতে চাইলে থাক।আচ্ছা আমার মনে হচ্ছে প্রেম ঘটিত কিছু”।
“সময়মত সবটা জানতে পারবেন।আর মাএ কদিনের অপেক্ষা মাএ।আচ্ছা আসছি”।নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত রাদিফ।কি বলতে চাইলো আর বললো কি।এখন পর্যন্ত সঠিক বাক্যটি সঠিক ব্যাক্তিটির নিকট ব্যক্ত করতে ব্যর্থ সে।
____________
সিরাতকে পৌঁছে দিতে কলেজে এসেছে সিয়াম।আজ ওদের ফার্স্ট এক্সাম।তবে আজকে আসার কারণটা শুধু সিরাত নয়।আজ নিজের তাগিদে এসেছে সে।এ কদিনে বুঝে গেছে সেদিনের সেই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি দুর্বল সে।অন্যরকম কিছু ফিলিংস হয় তাঁর।প্রথমে এসব ভাবনায় পাওা না দিলেও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আজ অনুভূতিরা বাধাহীন।সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ সে।সকল বাধা বিধির গন্ডি পেড়িয়ে সেই পিচ্চি মেয়েটাকে নিয়ে মনের কোণে ভালোবাসা নামক অনুভূতি জন্ম নিয়েছে।আজ তাঁর সাথে দেখা করতেই হবে তাঁকে।এতদিন না দেখে থাকতে কষ্ট হয়েছে খুব। মনের সাথে যুদ্ধ করে থেকেছে কিন্তু আজ নিরুপায় সে।সিরাতকে নামিয়ে দিয়ে কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে রইলো।সিরাতের কাছ থেকে জেনে নিয়েছে রিয়া এখনও কলেজে ঢুকে নি।তাই অপেক্ষায় আছে রিয়ার।রিয়ার অপেক্ষারত অবস্থায় আছে তখন কলেজে ঢুকে আবেশ আর আরু।সিয়ামের সাথে কথা বলে ভিতরে চলে যায় আরু।আবেশ আর সিয়াম দাঁড়িয়ে আছে।আবেশ বললো,
“তুই এখানে”?
“প্রেমে পরেছি বস।তাই তোর কলেজে এসে পিয়নের অপেক্ষা করছি”।অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
“সত্যি”।
“হুম”
“সোভাগ্যবান মেয়েটি কে?মেয়েটিকে না বলে পিয়ন লাগিয়েছিস কেন”?আনন্দে বললো আবেশ।
“কে বললো তাঁকে বলব না।পিয়নের থেকে তাঁর নাম্বার নিয়ে মেয়েটাকে সামনাসামনি প্রপোজ করবো।একটু ওয়েট কর সব বলছি”।আবেশ যেন ওর কথায় আকাশ থেকে পরলো।সিয়ামের সাহস যেখানে আকাশচুম্বী সেখানে ওর সাহস হাঁটুর নিচে।এখন ওর নিজেকে সিয়ামের বন্ধু মানতেও কষ্ট হচ্ছে।রিয়াকে দেখে ইশারায় ডাকলো সিয়াম।আবেশ চোখ কুঁচকে তাকালো।রিয়াকে সিয়াম ডাকছে দেখে মনে মনে খুশি হলো।তাহলে কি সিয়াম তাঁর মতই তাঁকে নিয়ে ফিল করতে শুরু করে দিয়েছে।নইলে গেইটে দাড়িয়ে সিয়াম তাঁকে ডাকবে কেন।ধীর পায়ে সামনে গিয়ে সামনে আবেশকে দেখে আনইজিও লাগছে তার।সে দাঁড়াতেই সিয়াম ভালো মন্দের খোঁজখবর নিয়ে সোজাসাপ্টা বললো,
“তোমার সাথে ওই দিন যে মেয়েটা ছিলো তাঁর নাম কি?আর ওর ফোন নাম্বার কি পাওয়া যাবে”?রিয়ার মাথায় বাজ পরলো এবার।তাহলে কি ওর ভাবনাই সত্যি।কিন্তু মিনার আর তিহানা তো দুজন দুজনকে ভালোবাসে।
“ওর নাম তিহানা কিন্তু কেন কি প্রয়োজন বলুন তো”?
“একচুয়েলি আমি তিহানাকে ভালোবেসে ফেলেছি।এবার ওকে আমার মনের কথাটা জানাতে চাই।তুমি আবার আমাকে খারাপ মনে করো না প্লিজ”।রিয়া ফুস করে একটি শ্বাস ছাড়লো।নিজের পছন্দের মানুষটা তার পছন্দের মানুষের সাথে ভাব জমানোর জন্য তাঁকেই খুঁজে পেলো।এখন সত্যিটা বলা কি ঠিক হবে।কারণ সত্যিটা শুনলে উনি তো কষ্ট পাবেন কিন্তু না জানালেও তো হয় না।ওকে চুপ থাকতে দেখে আবেশ বললো,
“কি হলো রিয়া চুপ করে আছো কেন?বলো।
রিনরিনিয়ে বললো,
“কথাটা কীভাবে বলবো বুঝতে পারছিনা। ও তো অন্য একজন মানে মিনার আর তিহানা দুজন দুজনকে ভালোবাসে”।
হলে এসে পুরো দাঁড়িয়ে গল্ল করছে আয়ান,মিনার,আয়েশা আরু আর সিরাত।রিয়া এখনও ভিতরে আসে নি।আজ সিট বের করতে হিমশিম খেয়েছে তারা।আরু সিরাতের মধ্যখানের বেঞ্চে আছে এলিনা।ক্লাস টেস্টের রেজাল্টের পর মাটিতে যেন পাই ফেলছে না সে।এমন ভাব যেন এবার ফুল মার্কস থাকবে তাঁর।এসব দেখে আরু ভেংচি কেটে দিলো।যথারীতি সবাই সবার জায়গায় বসে পরলো।এক্সাম শুরু দু তিন মিনিট পূর্বে হলে ঢুকলো রিয়া।তবে মুখে হাসি নেই।মুখভার তাঁর।ও বসতেই হলে ঢুকলেন স্যার।স্যার খুব কড়া নজর রাখেন সবার উপরে।কারোর সাহস নেই টুকলি করার সবাই চুপ।সিরাত লেখায় এতটা মনযোগী যে তাঁর সামনে পিছনে কি ঘটছে সে সম্পর্কে অবগত নয় সে।হঠাৎ কানের কাছে ফিসফিস আওয়াজ শুনে চমকে তাকালো।আবেশ খানিকটা ঝুকে আছে তার দিকে মুখে মৃদু হাসি।
“অল দ্যা বেস্ট মিসেস সিরাত”।এই কথাটাই ওর হৃদস্পন্দন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।কানে এসে বারবার বারি খাচ্ছে কথাটি।মিসেস তাও আবেশের মুখে শুনেই সুখের সাগরে ভাসতে লাগলো সে।অদ্ভুত লজ্জা এসে ঘিরে ধরলো তাঁকে।কেন এত লজ্জা পাচ্ছে সে।সে সম্পর্কে কিছুই জানে না।কলম থেমে লিখতে ভুলে গেলো সে।আবেশ সরে দাঁড়ালো।তবুও মনযোগী হতে পারছে না।হাত যেন চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।কর্তব্যরত টিচার ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য দশ মিনিটের জন্য আবেশকে এখানে রেখে ওয়াশরুমে গিয়েছে আবেশ।এখানে এসে সিরাতকে এতটা মনযোগী দেখে খুশী হয় সে।আরুর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
“এইবার তুই ডাব্বা মারবি এটা তোর ভাইয়ের অভিশাপ”।আরু হাসলো তৃপ্তির হাসি। কারণ এই কথাটাই এত বছর ধরে এই ভাই নামক প্রাণীটি বলে এসেছে তাঁকে।আরুর ধারণা এই কথাটি বললে ওর এক্সাম ভালো হয়।আবেশ ফোনে বারবার সিয়ামকে কল দিচ্ছে কিন্তু পাচ্ছে না।তখন ওই কথাটি শোনার পর কোনো বাক্য ব্যয় না চুপচাপ ওখান থেকে চলে গেছে সে।আবেশ স্পষ্ট ওর চোখে পানির আভাস পেয়েছে কিন্তু কিছু করতে পারে নি।কলেজ রেখে যাওয়া অসম্ভব ছিলো।পিছু ডেকেছে অনেক কিন্তু লাভ হয় নি।বাইক স্টার্ট দিয়ে কয়েক সেকেন্ডে উধাও সে।কিছুক্ষণ পর আবেশের ফোনে ম্যাসেজ আসলো,
“আই এম ওকে!ডোন্ট ওয়্যারি মিটিংয়ে আছি আর এসব যেন সিরাত ঘুণাক্ষরেও না জানে।রিয়াও যেন ওকে না জানায় বারন করিস।পরে কথা হবে”।
❤️❤️❤️
আজ আবেশদের বাসায় এসেছে সিরাত।এক্সাম শেষ হয়েছে গতকাল।এই কদিন মন দিয়ে এক্সাম দিয়েছে সিরাত।আবেশের সাথে খুব একটা দেখা হয়নি তাঁর।মিঃ খান কল করে আসতে বলেছেন সিরাতকে।কিন্তু কেন আসতে বলেছেন সেটাই অজানা তাঁর।তবে তিন্নি ভাবী খুবই উৎফুল্ল।আজকে তাঁর ভাই বোন আসছে সে কারণে।ড্রয়িংরুমে এসে উনার সাথে কথা বলে বুঝা গেলো তেমন কোনো কারণ নেই।তার কথা এমনই ছিল
“আমার পূএবধু আমার বাড়িতে আসবে তাঁর কারণ লাগবে কেন?আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়েছে তাই আসতে বলেছি”।
“মেয়ের ত বাবা মায়ের কথা মনে পরে না কিন্তু এই বুড়ো বাবা মায়ের তাঁর কথা খুব মনে পড়ে সেজন্য এভাবে ডেকে আনা”।অভিমানী কন্ঠে বললেন মিসেস খান।বাবা মা শব্দটি শুনে লজ্জায় নুইয়ে গেলো সিরাত।আমতা আমতা করে বললো,”আসলে এই ক’দিন এক্সাম ছিল তো তাই আসা হয় নি”।তিন্নি ভাবি বললেন,
“আর তো কিছুদিন তাঁরপর দেখবো কীভাবে পালাও তুমি।আমার জা হওয়ার পর বাহানাগুলো কোথায় থাকে”।এই পরিবারের মানুষগুলো আজ লজ্জায় সাগরে ডুবিয়ে মারতে উদ্যত হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে লজ্জা রাঙা মুখ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মিনমিনিয়ে বললো,
“আরু কোথায়”?
“ও নিজের ঘরেই আছে।তা বর কোথায় জিজ্ঞেস করলে না তো”?সোজাসাপ্টা প্রশ্ন আবিদের।এবার আরুর মরে যেতে ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করে সবাই এমন করছে।লজ্জায় মাথা নুইয়ে সামনে পা বাড়াতেই তিন্নি হাস্যজ্জ্বল মুখে সামনে এসে দাঁড়িয়ে এক কাপ কফি হাতে ধরিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,”তোমার বর ঘরেই আছে।এই ভর সন্ধ্যায় বউয়ের হাতের কফি ইসস জমে ক্ষীর”।কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মূহুর্তেই উধাও হয়ে গেলেন তিঁনি।সিরাত এখন মহাবিপদে আছে।এনগেইজমেন্টের পর থেকে আবেশ কেমন পাল্টে যেতে শুরু করেছে।আগের মতো গম্ভীর ভাবটা চলে যাচ্ছে আস্তে ধীরে।সিরাতের প্রতি ওর ব্যবহার অন্যকিছুর আভাস দিচ্ছে।জানান দিচ্ছে নতুন প্রণয়ের।
#চলবে
[
#চলবে