#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_০৯
আবিরের হাতে মেহেদী লাগানো শেষ করে কোনোমতে সেখান থেকে উঠে আসে প্রিয়তা।সৌরভ প্রিয়তার কাজকর্ম সব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছে।বর্তমানে প্রিয়তাকে চোখে চোখে রাখতে খুব ইচ্ছা করে সৌরভের।খারাপ দৃষ্টিতে কখনো না তাকালেও নজরদারির দৃষ্টিতে সে ঠিকই মেয়েটার খেয়াল রাখে।কারণ বাই হুক ওর ক্রোক প্রিয়তা একমাত্র তারই অর্ধাঙ্গিনী হবে।
প্রিয়তাকে নিজের করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবে না সে।এবং যখন পুরোপুরি নিজের করে পেয়ে যাবে সেদিন থেকে প্রিয়তাকে একবারে কলিজার গভীরে ঢুকিয়ে রাখবে সৌরভ।মেয়েটাকে খুব আদরে আদরে নিজের কাছে জড়িয়ে রাখবে।কখনো দূরে যেতে দেবে না।জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোলাগা,ভালোবাসা হতেও বেশি সময় লাগবে না।প্রিয়তাকে নিয়ে এসব কথা ভেবেই আনমনে মুচকি হাসলো সে।
প্রিয়তা স্পিকারে রোমান্টিক গান শুনে শুনে হাতে মেহেদী পড়ছে।তার পাশে জুই ডলিকে ও তানিয়া এশার হাতে মেহেদী লাগিয়ে দিচ্ছে।প্রিয়তা মিসেস জেসমিন,মিসেস মিনা,মিসেস প্রমি ও মিসেস শিলার হাতে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছে আগে।বয়স হয়েছে দেখে কী শখ থাকতে নেই কারও?ওনারা লাগাতে চান নি কিন্তু প্রিয়তা জোর করে লাগিয়ে দিলো তাদেরকে।
প্রিয়তা একহাতের দু পিঠে মেহেদী পড়ে শেষ করে নিজের রুমে চলে গেল।মি.মুজাফফর আদরের মেয়েকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিয়েছেন।তাই আর কষ্ট করে তাকে নিজের হাতে খেতে হয় নি।অনুষ্ঠান শেষে সোজা রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।যদিও অনুষ্ঠানের রেশ এখনও কিছুটা রয়ে গেছে।ছেলেরা বেশিরভাগ বাইরে আড্ডা দিচ্ছে।মেহমান বেশি হওয়ায় সৌরভদের বাসার এক্সট্রা গেস্ট রুমগুলো খুলে দেয়া হয়েছে।সৌরভ রাত একটা পর্যন্ত সজাগ থেকে তারপর নিজের রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।তার আবার এত বাজে আড্ডা দেয়ার অভ্যাস নেই তাও এত রাত জেগে না ঘুমিয়ে।আবিরকে আকিল ও তূর্য একপ্রকার জোর করে ঘুমাতে নিয়ে গেছে।বেশি রাত জাগলে পরে কালকে দেখা যাবে ছবি সুন্দর ওঠছে না,বরের মুখ মলিন।
🖤
পরদিন,,
সকাল থেকে প্রচুর ব্যস্ততা বিরাজ করছে সবার মাঝে।আজকে আবিরের বিয়ে।শুক্রবার বাদ জুমা সিলেটের বৃহত্তম কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হলে বরপক্ষের সবার যেতে হবে।সৌরভও খুব ব্যস্ত সময় পার করছে।
প্রিয়তা সকালে ঘুম থেকে ওঠে টুকটাক প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করে তারপর রুমে চলে এলো তৈরি হতে।পার্লার থেকে একজন মেয়ে এসেছে জুই,ডলি,তানিয়া ও পান্নাকে এবং সৌরভদের আরও কয়েকজন কাজিনদের সাজিয়ে দেয়ার জন্য।প্রিয়তা সাজবে না বলে মানা করে দিয়েছে তাদের।পার্লারে সাজের প্রতি তার মারাত্মক বিরক্তি রয়েছে।কারণ তারা এত পরিমাণ হাবিজাবি মুখে লাগিয়ে দেয় যে পরে আর নিজের চেহারাটাও চেনা যায় না।একবার সে সেজেছিলো তাকে পুরো অন্যরকম লাগছিলো দেখতে,প্রিয়তা বলে চেনাই যাচ্ছিলো না।এজন্য কেঁদেকেটে পরে আর বিয়েতেই যায় নি।তারপর থেকে পার্লার তার জানের দুশমন।
ডলির রুমে সবাই সাজতে ব্যস্ত।আর এদিকে প্রিয়তা রুমে এসে বিয়েতে পড়ার জন্য কাপড় বের করে গোসল করতে চলে গেছে।গোসল শেষে কাপড় চোপড় সব পড়ে চুল ভালো করে মুছে হেয়ার ড্রায়ার চালিয়ে শুকিয়ে নিলো।ইতিমধ্যে ডলি এসে জানিয়ে গেল মিসেস মিনা বলেছেন সব মেয়েদেরকে শাড়ি পড়তে।তাই বাধ্য হয়ে প্রিয়তা ড্রেস পাল্টে একটা পিচ কালার স্টোনের কারুকাজ করা শাড়ি পড়ে নিলো।তার আম্মু তাকে শাড়ি পড়তে সাহায্য করলেন।শাড়ি পড়া শেষে মুখে হালকা করে ক্রিম ঘষে চোখে মোটা করে আইলাইনার,কাজল ও মাশকারা লাগালো।আর ঠোঁটে দিলো রেড ভেলভেট কালার এর ম্যাট লিপস্টিক।তারপর সুন্দর করে হিজাব বেঁধে মাথার একটা পাথরের কারুকাজ করা চিকন চেনের টায়রা লাগালো।দুহাত ভর্তি ম্যাচিং চুড়ি,গলায় একটা সিম্পল লম্বা চেনের লকেট।তাকে দেখতে অনেক মায়াবতী লাগছে।মিসেস প্রমি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন;
মিসেস প্রমি:-মাশাআল্লাহ,আমার মেয়েটাকে দেখতে পুরো মায়াপরীর মতো লাগছে।কারও নজর যেন না লেগে যায়।
প্রিয়তা তার মাকে আহ্লাদিত হয়ে দুহাত দিয়ে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বললো;
প্রিয়তা:-তোমাকেও তো ভীষণ কিউটিপাই লাগছে আম্মু।আমার আব্বু তোমায় দেখে আবারও ক্রাশ খাবে নিশ্চিত।(দুষ্টু হেসে)
মিসেস প্রমি মেয়ের মাথায় আলতো চাপড় মেরে বললেন;
মিসেস প্রমি:-যাহ দুষ্টু মেয়ে,মায়ের সাথেও ফাইজলামি করতে ছাড়ে না।
প্রিয়তা:-তুমি তো জানো যে আমি সবসময়েরই ফাজিল।
মিসেস প্রমি এবার কিছুটা শাসানি দিয়ে বললেন;
মিসেস প্রমি:-বেশি বেয়াদবি করলে ধরে বিয়ে দিয়ে দিবো।তোমার বাপকে বলতে হবে পাত্র দেখার জন্য।
প্রিয়তা:-আমি রাজী।বিয়ে করতে চাই।জলদি পাত্র খুঁজো।
প্রিয়তা দাঁত কেলিয়ে হেসে কথাটা বলেই ফোন হাতে নিয়েই একছুটে পগারপার।কারণ জানে এখন থাকলেই মায়ের হাতের গাট্টা খেতে হবে।মিসেস প্রমি মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হেসে উঠলেন আনমনে।মেয়েটা এখনো পাগলাটেই রয়ে গেল।
সৌরভ ও বাকি ছেলেরা জুমার নামাজ আদায় করে বাসায় ফিরলো।পাত্র ব্যতিত বাকি সবাই তৈরি হয়েই আছে আগে থেকে।সৌরভ ও আকিল মিলে আবিরকে তৈরি করলো।মুসকান ও তূর্য,কে কোন গাড়িতে করে যাবে তা ঠিক করছে।সবকিছু সেটিংয়ের দায়িত্ব দুজনের ওপর।সবাই আনন্দ ফুর্তিতে ব্যস্ত।মিসেস শিলা যাবেন না বলেছিলেন কিন্তু সৌরভ ও প্রিয়তার ঠেলাঠেলিতে তিনি রাজী হয়েছেন,আবিরও সোজা কথায় বলে দিলো মা ব্যতিত সে বিয়ে করতে যাবে না।অগত্যা কী আর করার রাজী হতেই হলো।তবে বাসায় আসা কিছু মুরব্বি গোছের মহিলা মিসেস শিলার ছেলের বিয়েতে সেন্টারে যাওয়ার বিষয়টা সহজ ভাবে নিলেন না।এ নিয়ে ওনারা কানাঘুষা শুরু করে দিলেন।তবে ওনাদের কথায় কেউ পাত্তাও দিলো না।
সৌরভ আজকে কালো রঙের সুট পরিধান করেছে।কালো শার্ট,কালো কোট,কালো প্যান্ট,কালো সানগ্লাস,কালো শু,কালো ঘড়ি,এমনকি ফোনের কাভারও কালো।ঘন চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করা।তাকে এত পরিমাণ হ্যান্ডসাম লাগছে যে প্রিয়তা তাকে দেখে পুরোপুরি হা হয়ে গেছে।এতদিন শুনে এসেছে ছেলেরা মেয়ের রূপে পাগল হয়,আজ প্রিয়তার ক্ষেত্রে তার উল্টোটা ঘটলো।আজ প্রিয়তা সৌরভের রূপে মুগ্ধ।এত সুন্দর ছেলে,হয়তো এত আহামরি ফর্সা নয় কিন্তু তাও এত হ্যান্ডসাম লাগছে যে বলার বাইরে।
সৌরভও প্রিয়তাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছে,তবে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকে নি তার দিকে।যতই হোক,বিয়ের আগে নিজেকে সংযত রাখতে হবে কোনোমতে।বিয়ের আগে এভাবে তাকিয়ে থাকাটা ঠিক শোভা পায় না।
বাসার ভেতরের দরজা জানালা সব লাগিয়ে ঠিকঠাক মতো তারপর বাসার সদরদরজা বড় তালা দিয়ে লক করা হলো।
বাইরে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে।সবার আগে বরের গাড়িটা নজর কাঁড়ছে।গোলাপ ফুল দিয়ে অনেক সুন্দর করে সাজানো হয়েছে কালো রঙের কারটা।ছেলেরা সবাই যে যার বাইকে করে যাবে।মেয়েরা আবার গাড়িতে করে যাবে।
সবাই ঠিকঠাক মতো গাড়িতে উঠে বসলো।যে গাড়ি গুলো ফুলফিল হয়ে গেছে সেগুলো সৌরভের নির্দেশে সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।মুসকান প্রিয়তাকে গাড়িতে করে যেতে দেয় নি।কারণ যে গাড়িতে প্রিয়তা উঠতে যাচ্ছিলো সে গাড়িতে ডলি,তানিয়া,জুই,পান্না থাকলেও তাদের এডাল্ট ছেলে কাজিন ছিলো কয়েকজন।মুসকান তো আবার তার বোনকে নিয়ে অভার পসেসিভ তাই তাদের সাথে আর যেতে দেয় নি।অগত্যা কী আর করার মুসকানের সাথে তার বাইকে ওঠে বসলো।
বেশিরভাগ ছেলেরা তাদের বাইকে করেই রওনা হয়েছে।এলাকার বড় ভাই,নেতা ও কমিশনার থেকে শুরু করে সবাই ছিলো সাথে।
বোনের প্রতি ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে সৌরভ মুচকি হাসলো।তাদের ভাই বোনের জুটিটা একদম অন্যরকম।সৌরভ প্রিয়তার ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে মুসকান তার প্রতি একটু বেশিই যত্নশীল।এমন কী প্রিয়তা যখন একদম নবজাত শিশু তখন থেকেই মুসকান অতিপরিচিত ছাড়া অন্য কারও কোলে প্রিয়তাকে দিতো না।ছায়ার মতো পিছে পিছে থাকতো।একটু ফুলের টোকা অবধি লাগতে দেয় নি।এত যত্নশীল ভাই সৌরভ নিজে ছিলো কী না সন্দেহ!মুসকানের এমন পাগলাটে ভালোবাসার সাথে প্রিয়তা পরিচিত।তাই কখনো তার বিরক্ত লাগে না।সে উল্টো গর্বিত যে তার এমন একটা ভাই আছে।
মুসকান:-প্রিয়ু,ঠিক মতো ধরে বসিস কিন্তু।শাড়ি সামলে রাখিস।
প্রিয়তা:-আচ্ছা ভাইয়া।
একটা ছেলে এতক্ষণ তাদের দুজনকে লক্ষ্য করছিলো।সে হঠাৎ মুসকানকে জিজ্ঞেস করলো;
~আপনার বোন হয় বুঝি?
মুসকান:-হ্যা।
~ওহহ,বোনকে মনে হয় অনেক ভালোবাসেন আপনি!না আসলে অই গাড়িতে বসার জায়গা ছিলো তাও তাকে বসতে দিলেন না তো তাই বলছিলাম।
মুসকান এবার পাল্টা প্রশ্ন করলো ছেলেটিকে;
মুসকান:-আপনার বোন আছে?
~হ্যা ছোট বোন আছে একটা।
মুসকান:-আপনি ভালোবাসেন তাকে?
~হ্যা বাসি তো।কিন্তু ভাই আপনার মতো এত পসেসিভ নই।
মুসকান:-বোনকে ভালোবাসতে কোনো ভাইয়েরই স্বার্থ থাকে না।আমারও নেই।এই বোনটাকে আমি আল্লাহর কাছে বহুত চেয়ে তারপর পেয়েছি।ছোট থেকেই আব্বু আম্মুর চাইতে আমিই তার বেশি দেখভাল করেছি।সেও আমাকে ছাড়া বুঝতো না কিছু।আমি এখন থেকে নই,ও যখন একদম একদিনের শিশু ছিলো তখন থেকেই আমি ওর প্রতি পসেসিভ।একটামাত্র বোন আমার।সব ভালোবাসা,আদর,যত্ন,শাসন,বকা সবকিছু একমাত্র তার জন্যই বরাদ্দ।
প্রিয়তা মুসকানের কথা শুনে দুহাত দিয়ে ভাইকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী কন্ঠে বললো;
প্রিয়তা:-আমি আমার ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসি।লাভ ইউ ভাইয়া।আমাকে আচার কিনে দিও প্লিজ।
মুসকান হেসে ফেললো প্রিয়তার আবদার শুনে।তার সাথে অই ছেলে আর সৌরভও হেসে ফেলে।ছেলেটা ভীষণ অনুপ্রাণিত হলো মুসকানের বোনের প্রতি এত ভালোবাসা দেখে।মনে মনে চিন্তা করলো সেও এখন থেকে তার ছোটবোনটাকে আদরে আদরে রাখবে।
আগে আগে সকল বাইক,বাইকের মধ্যমণি হলো আবিরের সাজানো কার এবং তার পিছনে অন্যান্য গাড়িগুলো।সব কিছু সিরিয়াল মেইনটেইন করে হচ্ছে।এরও সামনে একটা বাইকে করে ফটোগ্রাফার একজন ভিডিও করছে।
বেশ অনেকক্ষণ পর, সব বাইক ও গাড়িগুলো সেন্টারের ভেতর উল্লাস নিয়ে প্রবেশ করলো।কনে পক্ষ আগেই চলে এসেছে।বিশাল বড় এরিয়া ও রাজকীয় প্যালেস নিয়ে গঠিত কুশিয়ারা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন হল।এত আকর্ষণীয় ভাবে সবকিছু ডেকোরেশন করা যে দেখলেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে যায়,সাথে ফটোগ্রাফি করার জন্য স্পেশাল প্লেস এই সেন্টারটা।আবিরদের সাথে আসা ফটোগ্রাফার তো ড্রোন উড়িয়ে ভিডিও করছে।
সেন্টারের ভেতর থেকে অনেক ছেলেমেয়েরা বর এসেছে বলে চিৎকার করে বেরিয়ে এলো।কয়েকজনের হাতে ফুলের পাপড়ির থালা।একজনের হাতে মিষ্টি ও দুধের গ্লাস।আকিল বাইক থেকে নেমে আবিরের গাড়ির ডোর খুলে দিলো।সৌরভও বাইক একপাশে পার্ক করে আবিরের পাশে এসে দাঁড়ালো।বাইরে একদফা ফটোগ্রাফি চললো।
বিরাট বড় সিড়ি পেরিয়ে সেন্টারের সদরদরজার কাছে যেতেই আটকে গেল সবাই।আবিরের শালা শালী গেট আটকে বসে আছে।টাকা দিলে তবেই গেট ছাড়বে।তারা ৫০ হাজার টাকা চাইলো।অবশেষে বহুত দর কষাকষি করে ২০ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দিলো তূর্য।টাকা দিতেই গেট ছাড়লো ওরা।জারা একটা মিষ্টি ঢুকিয়ে দিলো আবিরের মুখে।মিষ্টি খাইয়ে দুধের গ্লাস হাতে দিলো খাওয়ার জন্য।আবির নাকমুখ কোঁচকে একঢোক খেয়ে গ্লাস ফেরত দিলো।অতঃপর সবাই সেন্টারের ভেতর প্রবেশ করার সুযোগ পেল।প্রিয়তারা অনেক আগেই ঢুকে গেছে ভেতরে তাদেরকে জারা আটকায় নি।
চারপাশ থেকে ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ছে আবির ও তার পেছনে এবং পাশের ছেলেদের ওপর।সাউন্ড বক্সে চার্লি পাথের এটেনশন গানটা বাজছে।পরিবেশটা খুবই মনোরম।একদম রাজকীয় পরিবেশ।মাথার ওপর বড়সড় ঝাড়বাতিগুলো চারিদিকে দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
এমনসময় আকস্মিকভাবে কানাডা থেকে আসার সময় জেসিয়া নামক যে মেয়েটি তাকে জ্বালিয়ে খেয়েছে তার সাথে দেখা হলো।মেয়েটা সৌরভকে দেখেই ছুটে আসে তার দিকে।ভীষণ স্টাইলিশ ভাবে শাড়ি পড়েছে সে।মুখে মেকআপের স্তুপ।এসেই সৌরভের হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল সে।সৌরভ তো মাইনকার চিপায় পড়েছে।চাইলেও মেয়েটিকে এড়িয়ে যেতে পারছে না।বাধ্য হয়ে কুশল বিনিময় করলো মেয়েটির সাথে।
জেসিয়া:-হোয়াট এ সারপ্রাইজ সৌরভ।ভাবি নি এত জলদি আপনার সাথে দেখা হবে।
সৌরভ:-হুম আমিও ভাবি নি।
জেসিয়া:-বাই দ্যা ওয়ে,আপনার পরিচিত কারও বিয়ে মনে হচ্ছে।
সৌরভ:-আমার কাজিনের বিয়ে।তা আপনি এখানে কীভাবে?
জেসিয়া সৌরভের মামা অর্থাৎ সারার বাবাকে দেখিয়ে জবাব দিলো;
জেসিয়া:-যার মেয়ের বিয়ে তিনি আমার পাপার পরিচিত বিজনেসের খাতিরে।ওনার দাওয়াত গ্রহণ করতেই আমাদের আসা।ভালোই হলো এখানে এসে আপনাকে পেয়ে গেলাম।
ওরা কথা বলছে আর এদিকে ওদের এভাবে একসাথে এত হাসাহাসি করে কথা বলতে দেখে প্রিয়তার মাথায় আগুন জ্বলে যাচ্ছে।প্রিয়তার কেন জানি মনে সন্দেহ হলো এই মেয়েটাকেই বোধহয় সৌরভ পছন্দ করে।নয়তো এখানে এত মেয়ে থাকতে ওই মেয়ের সাথেই কেন এত ঘেঁষাঘেঁষি!
এদিকে সৌরভ কোথাও কারও সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না।যেখানে যাচ্ছে সেখানেই আঠার মতো চিপকে আছে জেসিয়া নামক মেয়েটা।মুসকান তার ডিএসএলআর ক্যামেরা দিয়ে প্রিয়তাকে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে দিচ্ছে।প্রিয়তা যতই অন্যদিকে মনোনিবেশ করুক না কেন তার মন মস্তিষ্ক সব সৌরভের কাছেই পড়ে রয়েছে।
আবির আর সারার ফটোসেশান চলছে সারা হলজুড়ে।কিছুক্ষণ আগে বাইরে ও দুতলা থেকে এবং অন্যান্য আকর্ষণীয় প্লেস থেকে ফটোগ্রাফি শেষ করে আবারও হলের সামনে স্টেজে গিয়ে বসেছে ওরা দুজন।পরিবারের সবার সাথেও চললো একের পর এক ফটো তোলা।জেসিয়া গিয়ে মিসেস মিনা ও মিসেস শিলার সাথে ভাব বিনিময় করে ফেললো।ওনাদেরও খুব ভালো লেগেছে মেয়েটাকে।মেয়েটা আকার ইঙ্গিতে তাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে সৌরভকে তার পছন্দ।জেসিয়া সৌরভের সাথে কিছুটা জোরপূর্বক অনেকগুলো কাপল পিক তুললো।প্রিয়তা পারে না সবার সামনে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলতে।তার এত অসহ্য লাগছে মেয়েটাকে সৌরভের সাথে এত চিপকাতে।
কাজিন সবাই একটা বড় টেবিল জুড়ে খেতে বসেছে।ওয়েটাররা খাবার দিয়ে গেল।প্রিয়তা বসেছে মুসকানের পাশের চেয়ারে।সৌরভ অপজিটে বসেছে।তার পাশেই জেসিয়া বসে গেছে।সৌরভ ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো।জীবনে বহুত মেয়ে দেখেছে কিন্তু জেসিয়ার মতো ছ্যাসড়া কাউকে দেখে নি।
জেসিয়ার এত আহ্লাদীপনা সৌরভের প্রতি এত কেয়ার মনে হচ্ছে সে সৌরভের বউ।প্রিয়তা তেলেবেগুনে জ্বলছে শুধু।মুসকান পাশে না থাকলে রোস্টের চামচ ছুড়ে মেরে এতক্ষণে মাথাটা ফাটিয়ে দিতো মেয়েটার।মাংস যেমন ভাবে চিবোচ্ছে মনে হচ্ছে মাংসের জায়গায় জেসিয়াকে চিবিয়ে খাচ্ছে সে।সৌরভ প্রিয়তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখছে।সে মনে মনে ভয় পাচ্ছে যে প্রিয়তা না আবার উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে।
খাওয়া শেষে হাত ধুয়ে প্রিয়তা সৌরভের সামান্য কাছে গিয়ে আস্তে কন্ঠে বললো;
প্রিয়তা:-আপনার সাথে আমার কথা আছে,একটু এদিকটায় আসবেন প্লিজ আমি অপেক্ষা করছি।
প্রিয়তা দাঁড়ায় না,কথাটা বলেই চঞ্চল পায়ে হেঁটে প্রস্থান করে।প্রিয়তা কথাটা বলার সাহস পেয়েছে কারণ মুসকান তার ফ্রেন্ডদের নিয়ে বাইরে গিয়েছে ফটো তুলতে।
প্রিয়তার কথায় সৌরভ সরলমনে একটু নির্জন জায়গার দিকে গেল।যেখানে প্রিয়তা তাকে যেতে রিকোয়েস্ট করেছে।সৌরভ সেখানে যেতেই আচমকা প্রিয়তা কোত্থেকে উদয় হয়ে সৌরভের ব্লেজারের কলার চেপে ধরে টেনে পিলারের পিছনে লাগিয়ে ফেললো।সৌরভ কিছুটা ভরকে গেল যেন।সে কখনো ভাবেই নি যে প্রিয়তা এমন কিছু করতে পারে।প্রিয়তার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে।সৌরভ আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো;
সৌরভ:-এসব কী প্রিয়?কেউ দেখে ফেলবে তো!আমি বয়সে তোমার থেকে অনেক বড়।বেয়াদবি করতে নেই।
প্রিয়তা:-রাখেন আপনার বেয়াদবি।ওই মেয়েটা কে যার সাথে এত ঢলাঢলি করছিলেন?(কৈফিয়ত চাওয়ার সুরে)
সৌরভ:-কোন মেয়েটি?জেসিয়ার কথা বলছো?(জানতে চেয়ে)
প্রিয়তা:-জেসিয়া না কেসিয়া সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করছি না।মেয়েটি কী হয় আপনার?এত কথা কীসের তার সাথে?
সৌরভ:-সে যেই হোক,তোমাকে কেন বলবো?হো আর ইউ?এত অধিকার কীসের ভিত্তিতে দেখাচ্ছো?
প্রিয়তা কথাগুলো শুনে একমুহূর্ত থমকে গেলেও দমলো না।আরও নিবিড়ভাবে সৌরভের কলার চেপে ধরে তার চোখে চোখ রেখে মৃদু কন্ঠে জবাব দিলো;
প্রিয়তা:-এই আপনিটার ওপর আমিই অধিকার ফলাতে চাই।অন্য কেউ আপনার কাছে ঘেঁষলেই তাকে আমার শত্রু মনে হয়।বিক্ষিপ্তভাবে জ্বলতে থাকে মনটা!জানি না এটা ভালোলাগা নাকি ভালোবাসা,তবে এটা যদি ভালোলাগা হয়ে থাকে তবে আমি তাকে স্থায়ীভাবে ভালোবাসায় রূপ দিতে চাই।আর যদি ভালোবাসা হয়…তো!বাকিটা আর না-ই বা বললাম।
সৌরভ:-মানলাম তুমি আমাকে পছন্দ করো!কিন্তু আমি যে তোমাকে পছন্দ করি তার গ্যারান্টি কী?আমি কখনোই তোমার দিকে এমন নজরে তাকাই নি।তবে কীভাবে কী,বুঝলাম না কিছু!
প্রিয়তা কিছুক্ষণ চুপ থেকে সৌরভের থুতনিতে টুপ করে একটা চুমু খেল।সৌরভ হতভম্ব হয়ে গেছে প্রিয়তার কর্মকাণ্ডে।সে কল্পনাও করে নি প্রিয়তা এমন কিছু করতে পারে।
প্রিয়তা:-আপনি আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য।আই থিংক আমিই একমাত্র মেয়ে যে আপনাকে এমনভাবে চুমু খেয়েছে।তাই আপনি আমাকেই ভালোবাসবেন এবং আমাকেই বিয়ে করবেন।দরকার পড়লে জোর করে ছিনিয়ে নিবো আপনাকে।জীবনের প্রথম কোনো ছেলেকে মনে ধরেছে।তাকে না পেলে তো পাগল হয়ে যাবো আমি।
সৌরভ ধাতস্থ হয়ে কিছুটা কঠিন কন্ঠে জবাব দিলো;
সৌরভ:-তুমি আবেগের ওপর ভাসছো প্রিয়।এসব ঠিক নয়।তোমার এখনো এসব করার বয়স হয়নি।তাই আজেবাজে চিন্তা সব মাথা থেকে বের করে দাও।
প্রিয়তা:-প্লিজ,আমি আপনার মনমতো মেয়ে হয়ে দেখাবো।আপনি যা বলবেন তাই করবো।আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবো।সবসময় কোরআন তেলাওয়াত করবো।পরিপূর্ণ পর্দা করবো।আমি সম্পূর্ণ দ্বীনের পথে চলে আসবো,তাও আমাকে রিজেক্ট করবেন না প্লিজ।রিকোয়েস্ট করছি,আমার দমবন্ধ লাগে আপনাকে অন্য কোনো মেয়ের সাথে দেখলে।সহ্য হয় না।প্লিজ একটু বুঝতে চেষ্টা করুন আমাকে।(অসহায় কন্ঠে)
সৌরভ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো প্রিয়তার থেকে কিন্তু পারলো না।সর্বশক্তি দিয়ে ধরে রেখেছে তাকে।সৌরভ শান্ত কন্ঠে বললো;
সৌরভ:-দেখাে পাগলামো করো না,কেউ আমাদের এভাবে এত ক্লোজ দেখতে পেলে খারাপ ভাববে।ছাড়াে আমাকে।
প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে এমনসময় দেখলো জেসিয়া এদিকেই আসছে।প্রিয়তা একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে জেসিয়ার দিকে তাকালো।জেসিয়াও কাছে এসে দুজনকে এত ক্লোজ দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে।সৌরভ এখনও জেসিয়াকে দেখে নি।প্রিয়তা হুট করে সৌরভের গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলো।জেসিয়া হতভম্ব,সৌরভ কিংকর্তব্যবিমূঢ়।প্রিয়তার তুলতুলে নরম ঠোঁট জোড়া সৌরভের গলা বারবার টাচ্ করছে।সৌরভ ফাঁকা ঢোক গিললো কয়েকবার।প্রিয়তার ঠোঁট সৌরভের কন্ঠনালির ওপর ঘুরছে।সৌরভ প্রিয়তাকে সরাতে ভুলে গেছে।সে একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে বর্তমানে।বুঝতে পারছে না আসলে তার সাথে হচ্ছেটা কী!জেসিয়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সব।সদ্য ছ্যাঁকা খাওয়া মাইয়া।
প্রিয়তা নিজের সাহস দেখে নিজেই অবাক।এসব করার চিন্তা কখনোই তার মাথায় ছিলো না।কিন্তু কীভাবে কী হলো সে নিজেও বুঝতে পারলো না।প্রিয়তা শার্টের কলার সরিয়ে সেখানে একটা কামড় বসালো।একদম দাগ করে ফেললো গলার কাছটায়।সৌরভের সম্বিৎ ফিরলো কিন্তু জোর করেও সরাতে পারছে না সে তাকে।প্রিয়তা আরও দুটো কামড় দিয়ে নিজেই ছেড়ে দিলো।সৌরভ হতবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো প্রিয়তার দিকে।প্রিয়তা মুচকি হেসে বললো;
প্রিয়তা:-আমার সম্পদের ওপর ট্যাগ লাগিয়ে দিলাম।আশা করি এই মুহুর্তটা আপনার সারাজীবন মনে থাকবে।আপনি চাইলেও কখনো ভুলতে পারবেন না আজকের দিনটা।উম্মাহ আমার জামাইটা।
লাস্টের লাইনটা যাতে জেসিয়া শুনতে পায় এমন ভাবে বললো প্রিয়তা।জেসিয়া গটগট শব্দে হেঁটে চলে গেল এখান থেকে।জেসিয়ার যাওয়ার শব্দ কানে যেতেই সৌরভ নিজেকে সামলে নিলো।অতঃপর প্রিয়তাকে কিছু না বলেই প্রস্থান করলো।প্রিয়তাও মুচকি হেসে জনসমাগমে চলে গেল। #তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_১০
সৌরভ একটা চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে আছে।এখনো সে ঘোরের মধ্যে রয়েছে।একটু আগের ঘটনাটা তার মনে এক অন্যরকম প্রভাব ফেলেছে।জীবনের প্রথম কোনো নারী তাকে এত ক্লোজ ভাবে স্পর্শ করেছে।ভাবতেই তার মাথাটা আউলিয়ে যাচ্ছে।
প্রিয়তা প্রফুল্লচিত্তে এর সাথে ওর সাথে ফটো তুলছে।যেন একটু আগে কিছুই হয় নি।প্রিয়তাকে আগের তুলনায় এখন অনেক বেশিই হাসিখুশি দেখাচ্ছে।সলজ্জ দৃষ্টিতে সৌরভের দিকে তাকাচ্ছে মাঝেমধ্যে যেন সে নতুন বউ।জেসিয়া গোমড়া মুখে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে।লুক লাইক সর্বহারা।
জেসিয়া সৌরভের পাশে গিয়ে বসলো।সৌরভ যেন দেখেও দেখে নি এমন একটা ভাব ধরে বসে আছে।আচমকা জেসিয়ার করা প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো সৌরভ।
জেসিয়া:-কিছুক্ষণ আগে ওই কর্নারে যে মেয়েটি আপনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো সে কে হয়?
সৌরভ বুঝতে পারলো যে আগে যার পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলো সে জেসিয়া ছিলো।সৌরভ খানিক চুপ থেকে জবাব দিলো;
সৌরভ:-গার্লফ্রেন্ড সাথে হবুবউও।
জেসিয়া উত্তরটা শুনে হতাশ হয়ে গেছে পুরোপুরি।সে সত্যিই সৌরভকে অনেক পছন্দ করতো।ইচ্ছা ছিলো আজকে সৌরভের ফোন নাম্বার চেয়ে নিয়ে তার সাথে রেগুলার কন্টাক্ট করার।যাতে সৌরভও তার প্রতি উইক হয়ে যায়।কিন্তু তার আশায় একবালতি পানি ঢেলে দিলো প্রিয়তা।
জেসিয়া:-ওহহ,আগে কখনো বলেন নি তো যে আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে!
সৌরভ কাটখোট্টা জবাব দিয়ে দিলো;
সৌরভ:-গার্লফ্রেন্ড কোনো শো অফ করার বস্তু নয় যে জনে জনে সবাইকে বলে বেড়াবো।আমি তা পছন্দ করি না।
জেসিয়া কিছুক্ষণ নিরব ভূমিকা পালন করলো।সৌরভের কথা শুনে তার ইগো হার্ট হয়েছে।সৌজন্যতার খাতিরে বললো;
জেসিয়া:-প্রে করি আপনারা দুজন অলওয়েজ হাসিখুশি থাকুন।আপনাদেরকে দেখলেই মনে হয় মেইড ফর ইচ আদার।
সৌরভ:-থ্যাংকস।খুব জলদিই বিয়ে করে ফেলবো।অগ্রিম দাওয়াত রইলো।বিয়েতে আসবেন।
জেসিয়া:-আচ্ছা আসবো।
এই বলে জেসিয়া বসা থেকে ওঠে অন্য দিকে চলে গেল।সৌরভ প্রিয়তাকে লক্ষ্য করছে।মেয়েটার কী সাহস বাপরে!একটু আগে কী কান্ডটাই না করলো।সৌরভ ছেলে হয়েও জীবনে এমন কিছু করতে পারবে না।
আবির আর সারার শরীয়ত মোতাবেক ও রেজিস্ট্রি করে বিয়ে সম্পন্ন হলো।অতঃপর দুজন মালাবদল করলো।মালা বদল করতে গিয়ে প্রচুর দুষ্টামি করেছে ওরা।তারপর দুজনের আবারও রোমান্টিক পোজে ফটো তোলা হলো।
সন্ধ্যার একটু পর বিয়ের সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলো।এখন কনে নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার পালা।শুরু হলো কান্নাকাটির পর্ব।সারা তার মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কান্না করছে।সারার বাবা কান্না আটকে রেখেছেন কোনোমতে।মেয়েটা ওনার বড়ই আদরের।আজ মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে তাদেরকে ছেড়ে।বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে তা তত সহজ নয়,বরং খুবই হৃদয় বিদারক।একটা মেয়েই শুধু বুঝতে পারবে নিজের পরিবার ছেড়ে অন্য কোনো নতুন পরিবারে যাওয়ার কষ্ট।
মিসেস মিনা ও মিসেস শিলা সারার বাবা মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।সারাকে তানিয়া আর প্রিয়তা ধরে ধরে কারে বসালো।সে কান্না করতে করতে কাহিল হয়ে গেছে।আবির সারার বাবা মাকে তাদের মেয়েকে আগলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গাড়িতে সারার পাশে ওঠে বসলো।সারার সাথে জারাও যাচ্ছে আজ।জারা,ডলি আর তানিয়াদের সাথে অন্য গাড়িতে বসেছে।
সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে,ঠান্ডার প্রকোপও ততোই বাড়ছে।প্রিয়তা ফুলহাতা ব্লাউজ পড়লেও তার ঠান্ডা লাগছে।মুসকান আসার সময় তার জন্য একটা চাদর নিয়ে এসেছিলো।সেটা ভালো করে প্রিয়তার গায়ের ওপর জড়িয়ে দিলো।সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা দিয়েছে।দূরাত্মীয়রা যে যার বাসায় চলে গেছেন।নিকটাত্মীয়রা সৌরভদের বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন।সৌরভ সে তার বাইকে করে রওনা হয়েছে।
আবির সারাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো।সারার কান্না কিছুটা থামলো আবিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে।
বাসায় পৌঁছে গেলো সবাই।আবির সারার হাত ধরে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।প্রিয়তা আগেই ঢুকে গেছে বাসায়।কীসব নিয়ম নীতি পালন করলেন বাড়ির বয়স্করা।সৌরভের কাছে তা আজাইরা কাজ বলে মনে হলো।
প্রিয়তা শাড়ি পাল্টে একটা ড্রেস পড়ে নিচে এসেছে।সৌরভ নিচে একটা সোফায় বসে কয়েকজন ছেলের সাথে কথা বলছে।জুই আর তানিয়া মিলে সবার জন্য চা নাস্তা তৈরি করছে রান্নাঘরে।প্রিয়তা ভাবীদের সাথে সব তদারকি করছে।ডলি আর জারা সারার কাছে বসে আছে।
একটু পর সারাকে আবিরের রুমে নিয়ে গিয়ে রেখে আসলো সব মেয়েরা।প্রিয়তা সারাকে চেঞ্জ করতে সাহায্য করলো।সাথে তো অফুরন্ত গল্প গুজব চলছেই।
সৌরভ নিজের রুমে প্রবেশ করে ওয়ারড্রব থেকে কাপড় চোপড় বের করে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে।পরণের শার্ট আর ব্লেজার খুলে বালতিতে রাখলো।উদোম গায়ে ওয়াশরুমের আয়নায় যেই না তাকালো ঠিক তখনই তার নজর গেল গলার কোণে লাল দাগগুলোর পানে।বুঝতে পারলো এই খরগোশের দাঁতের কামড়গুলো প্রিয়তার দেয়া।ফার্স্ট টাইম কারও দেয়া লাভবাইট গুলো জ্বলজ্বল করে তার অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।
সৌরভ দাগগুলোর ওপর আঙ্গুল বোলালো আলতো ভাবে।প্রিয়তার পাগলামির কথা মনে পড়তেই আনমনে হেসে ফেললো।আর বেশি দেরি করা ঠিক হবে না।আজকেই জানাতে হবে আম্মুকে,ভাবলো সৌরভ।নয়তো প্রিয়তা আবার কোন অঘটন ঘটাবে বলা যায় না!সৌরভও যেন প্রিয়তা কাছে এলে সম্মোহিত হয়ে যায়,কোনো হুঁশ থাকে না।
🖤
প্রিয়তা বেশ কিছুক্ষণ জারার সাথে গল্প করলো।সৌরভের সাথে আজকে কী করেছে তা কাউকে জানালো না।এমনকি নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড মিশিকেও না।মিশি তো ফোলা মেরে বসে আছে।কথা বলে না প্রিয়তার সাথে।বিয়ে বাড়িতে গিয়ে প্রিয়তা নাকি তাকে ভুলে গেছে।
আজকে বাসায় মেহমান প্রচুর তাই প্রিয়তা,জারা,তানিয়া,ডলি,জুই,পান্না ওরা সবাই একসাথে একরুমে থাকবে।বিছানা যথেষ্ট বড় আছে তাদের হয়ে যাবে অনায়াসে।ডলি তাদের স্টোর রুমের আলমারি থেকে এক্সট্রা লেপ কম্বল ও বালিশ নিয়ে এসে যাদের দরকার তাদেরকে দিলো।রিসিপশন পরে সব মেহমান চলে যাবেন তাই এই এক-দুইদিন একটু কষ্ট করতে হবে আরকি।
সৌরভের রুমে তূর্য আর মুসকান থাকবে।সৌরভ একটা হুডি পড়ে বিছানায় শুয়েছে।এমনিতেও শীতকাল,সাথে কেউ যাতে ঘুনাক্ষরেও কামড়ের দাগগুলো দেখতে না পায় তাই এই সুব্যবস্থা।
রাতের খাবার রাত বারোটাতে সেরেছে ওরা।তারপর যে যার রুমে চলে গেছে ঘুমাতে।সারাদিনে প্রচুর ধকল গেছে।এখন না ঘুমালেই নয়।
সৌরভ প্রিয়তার কথা না চাইতেও ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা তার রাতের ঘুম খুব ভালো করেই কেঁড়ে নিয়েছে।এখন ঘুমের ছিটেফোঁটাও চোখের পাতায় ধরা দিচ্ছে না।উফফ,অসহ্য একটা অনুভূতি!
প্রিয়তা বিছানায় শুয়ে মনে মনে আজকের ঘটনা স্মরণ করে লজ্জায় গুটিয়ে গেল।যখন কান্ড ঘটিয়েছে তখন লজ্জা করে নি,অথচ এখন লজ্জায় বিছানার সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।না জানি সৌরভ তাকে কী ভেবেছে!ফালতু মেয়ে না ভাবলেই হলো!এসব আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই রাত পার করলো সে।
🖤
আজ প্রিয়তার কী হলো কে জানে!খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে অনেকদিন পর ফজরের নামাজ আদায় করলো।নামাজ সে মাঝেমধ্যে পড়ে ঠিকই।তবে তেমন একটা টান নেই বললেই চলে।এজন্য মায়ের কাছ থেকে অনেক বকা খেয়েছে।প্রিয়তা প্রায় সবসময়ই নিজের মর্জি মতো চলতে চাইতো।কিন্তু মুসকানের কারণে তা হয়ে উঠতো না।মুসকান বাসায় থাকলে নামাজ কালাম সব করতো।বাসায় না থাকলে তাকে আর পায় কে?মিসেস প্রমি চিৎকার চেঁচামেচি করে অহেতুক গলা ব্যথা করতেন কিন্তু সে ওনার কথায় থোড়াই কেয়ার করে।দুনিয়াবি কাজকর্মে এতটাই মত্ত ছিলো যে নামাজের প্রতি তার অনীহা চলে আসে।
কিন্তু গত রাতে প্রিয়তা একদম সূক্ষ্মভাবে গভীর থেকে গভীরে গিয়ে চিন্তা করে দেখলো যে এখন যদি সে মারা যায় তবে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে জবাব দেয়ার মতো তার কোনো আমল নেই।কথায় আছে না রাতের গভীর নিরবতায় মনে মৃত্যু ভয় হানা দেয়,প্রিয়তার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।সৌরভ তো সত্যি কথাই বলে।দুনিয়ার সুখ তো ক্ষণস্থায়ী,পরকালের শান্তিই হচ্ছে আসল শান্তি।এবং পরকালের শান্তি লাভের জন্য নামাজ রোযা ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সকল কাজ করতে হবে।প্রিয়তা মনে মনে ঠিক করে,এখন থেকে সে যথাসময়ে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে।অন্যের সন্তুষ্টির জন্য নয়,স্বয়ং মহান আল্লাহ তায়া’লার সন্তুষ্টির জন্য।
ফজরের নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে যাবতীয় সকল গোনাহর মাফ চাইলো,সাথে সৌরভকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে মনেপ্রাণে চাইলো।দেয়ার মালিক তিনি,তিনি যদি উদার হস্তে দান করেন,তবে কেউ তা আটকাতে পারবে না।
সৌরভ সবসময় বাসার সবাইকে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করে।সাথে দলিলসমেত হাদিস শোনায়।কেউ তার কথা না শুনলেও সে দায়ী নয় কারণ তার দায়িত্ব ছিলো উপদেশ দেয়া এবং সে তাই দিয়েছে।আসার পর থেকে ডলি,তানিয়া সাথে প্রিয়তাকেও নামাজ পড়ার জন্য তাগিদ দিয়েছে কিন্তু ওরা পড়ছি পড়বো বলে আর পড়ে নি।প্রিয়তা তাও হয়তো পড়তো না কিন্তু মালাকুল মউতের আগমনের ভয়ে সঠিক রাস্তায় ফিরে আসছে।রাতের আঁধারে ও নিরব নিস্তব্ধতায় যখন মৃত্যুর ভয় মনে হানা দেয় তখন কিন্তু যে কারোই কলিজা কেঁপে ওঠতে বাধ্য।
🖤
সবাই সকালের নাশতা করছে ডাইনিং টেবিল ও ড্রয়িং রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে।আজকের সকালের নাশতা হলো মুরগির তেহারি,গরুর মাংসের কষা ভুনা,রুটি-পরোটা,ডাল,ভাজি,মুরগির তরকারি,হরেক রকমের পিঠাপুলি।সাথে চা কফি ও জুস।যার যা খেতে ভালো লাগছে সে তাই নিয়ে খাচ্ছে।মাছের বাজারে যেমন শোরগোল থাকে,সৌরভদের বাসাটাও সেরকম পরিবেশে পরিণত হয়েছে বলা যায়।সবাই একসাথে কথা বলছে,একসাথে হাসাহাসি করছে,এ যেন এক অদ্ভুত গুঞ্জন।
সৌরভ হাসিমুখে সবার সাথে নাশতা করছে।প্রিয়তা মিসেস মিনার কথায় সৌরভকে মগে করে কফি ঢেলে দিলো।কফির মগ হাতে নেয়ার সময় সৌরভ শান্ত দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকালো।সৌরভের চাহনিতে প্রিয়তার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা পানির স্রোত বয়ে গেল যেন।কেমন একটা নাম না জানা শিরশিরে অনুভূতি।যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
সারা সকালে ঘুম থেকে ওঠে এই কনকনে ঠান্ডায় গোসল করে নতুন একটা জামদানী শাড়ি পড়েছে।আবিরও গোসল করে ভালো মতন ফ্রেশ হয়ে বউকে সাথে নিয়ে নিচে নেমে এসেছে নাশতা করতে।পাড়া প্রতিবেশী মহিলারা বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন ঠিকই,তাও সকাল সকাল নতুন বউ দেখতে এসেছেন।তবে প্রতিবেশীদের সাধারণত যেরকম খোঁচা খোঁচির স্বভাব থাকে উনাদের মধ্যে তা নেই।দেখেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা ওনারা।সারাকে গিফট দিতে দিতে বোঝাই করে ফেললেন সবাই।সারাও সবার সাথে খুবই মার্জিত ভাবে কথা বলেছে।
(আমি জানি না আমার কী হয়েছে,বাট যখনই ফোন হাতে নিই তখনই ঘুম চলে আসে।সরি ফর বিয়িং লেট,এবং আমি ট্রাই করবো অনেক বড় করে দেয়ার।কেউ কিছু মনে করবেন না প্লিজ।হ্যাপি রিডিং গাইজ।)
চলবে…