তুমি আমার প্রিয়তমা পর্ব ১৫+১৬ ও শেষ

#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#পর্ব_১৫

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে সৌরভ ও প্রিয়তা দুজন রুমে চলে এলো।প্রায় সব মেহমানরাই চলে গেছেন।রয়ে গেছেন শুধু প্রিয়তার পরিবার ও জুইয়ের পরিবারের সদস্যরা।সৌরভ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে কাপড় চোপড় পাল্টে এলো।প্রিয়তা তার গহনাদি সব খুলছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বসে।সৌরভ এসে প্রিয়তাকে হেল্প করতে লাগলো,কারণ প্রিয়তা একা এসব খুলতে পারবে না।

সব ছোটানো সব শেষ করে প্রিয়তা ওয়াশরুমে গেল মেক-আপ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসতে।সৌরভ বারান্দায় তার বন্ধুর সাথে ফোনে কথা বলতে গেছে।প্রিয়তা ফ্রেশ হয়ে কাপড় পাল্টে এসে সৌরভকে রুমে না পেয়ে বারান্দায় গেল।সৌরভ ইজিচেয়ারে বসে দোলে দোলে কথা বলছে।প্রিয়তা চুপচাপ গিয়ে সৌরভের কোলের উপর বসে পড়লো।সৌরভ একহাতে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তার কোমড়।প্রিয়তা সৌরভের বুকে মাথা রেখে তার বুকে আঙ্গুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর সৌরভ ফোন কাটলো।প্রিয়তা তখনও সৌরভের বুকে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে।সৌরভ প্রিয়তার মাথায় চুমু খেয়ে চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলো।সৌরভ আদুরে কন্ঠে প্রিয়তাকে ডাকলো;

সৌরভ:-প্রিয়,

প্রিয়তা:-হুম!

সৌরভ:-কালকে রাত থেকে পড়তে বসবে কেমন?

প্রিয়তা সৌরভের বুক থেকে মাথা তুলে করুন কন্ঠে বললো;

প্রিয়তা:-এত পড়াশোনা করে কী হবে বলুন তো?আমার তো এখন বিয়ে হয়ে গেছে।এখন আমার সংসার করার সময়।ছেড়ে দিই পড়াশোনা প্লিজ!আমার একটুও ভাল্লাগে না পড়তে।

সৌরভ:-এটা কোনো কথা হলো প্রিয়?পড়াশোনা করতে তো কারোরই ভালো লাগে না,তারমানে কী সবাই পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে বলো?পড়াশোনা আমারও ভালো লাগতো না,তারপরও পড়েছি।কানাডাতে একা একা পড়েছি,চিরপরিচিত বেস্ট ফ্রেন্ড কেউ ছিলো না,আম্মু,আব্বু কেউ সাথে ছিলো না,তারপরও পড়াশোনা কমপ্লিট করে দেশে ফিরেছি।দেখাে প্রিয়,মেয়েদের জন্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।সবাই এমন চান্স পায় না।কিন্তু তুমি লাকি এজন্য পেয়েছো।ঠিক আছে তোমার বাইরে চাকরি করতে হবে না।কিন্তু পড়াটা তো এটলিস্ট কন্টিনিউ রাখাে!

প্রিয়তা চুপ করে সৌরভের এডভাইস শুনে যাচ্ছে।কিছু বলছে না।সৌরভ আবারও বলে উঠে;

সৌরভ:-আমি যা বলছি তা তোমার ভালোর জন্যই বলছি বাবু,কে কখন কোন পরিস্থিতিতে পড়বে তা সে জানে না,আল্লাহ না করুক কখনো যদি কোনো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ো তুমি তখন কী করবে?এমনও হতে পারে আমি তখন থাকবো না,

প্রিয়তা আঁতকে উঠল সৌরভের শেষের কথা শুনে।হড়বড় করে বুক থেকে মাথা তুলে দ্রুত সৌরভের মুখ চেপে ধরলো।ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললো;

প্রিয়তা:-আল্লাহর দোহাই লাগে এমন কথা বলবেন না।আপনি যতোটুকু চান আমি ততোটুকু পড়ালেখা করবো।ট্রাস্ট মি,একটুও বিরক্ত হবো না।কালকে থেকে পড়তে বসবো আপনার কথামতো।একটুও নড়চড় হবে না কথার।তাও এমনকিছু বলবেন না যেটা শুনলে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।আমি কোনোকিছুর বিনিময়েই আপনাকে হারাতে পারবো না।আপনার কিছু হওয়ার আগে আল্লাহ যেন আমাকে নিয়ে নেয়।

সৌরভ প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে নিজের একদম কাছে টেনে নিয়ে সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো।প্রিয়তা যে সৌরভের বলা কথাটা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছে তা বুঝতে পেরেছে সৌরভ।প্রিয়তার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো যে দুফোঁটা অশ্রু ঝরেছে তা সযত্নে মুছে দিয়ে ফিসফিস করে বললো;

সৌরভ:-এই কাজল রাঙা চোখ জোড়ায় যে অশ্রু মানায় না বউ!ডোন্ট বি সিরিয়াস,জাস্ট ফিল দিস মোমেন্ট।ওকে?

প্রিয়তা হালকা মাথা ঝাকালো।সৌরভ মুচকি হেসে প্রিয়তার কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট মেলায়।তাদের বাসার পর দুই বাসা বাদে ছোটখাটো একটা খোলা জায়গায় বেশ কতজন ছেলেরা মিলে ব্যাডমিন্টন খেলছে।সাথে স্পিকারে গানও বাজাচ্ছে ওরা।ওখান থেকে গানের সাউন্ড শুনতে পাচ্ছে সৌরভ ও প্রিয়তা।গানটাও যেন তাদের ডেডিকেট করে বাজানো হচ্ছে।

হার দোয়া মে শামিল
তেরা পেয়ার হে,
বিন তেরে লামহা বি
দুশওয়ার হে!
ধারকানো কো তুজছে
হি দারকার হে,
তুঝছে হি রাহাত হে
তুঝছে হে চাহাত হে!
তুঝো মিলি,ইকদিন মুঝে
মে কাহি হগায়া লাপাতা,
ও জানে যা,দোনো জাহা
মেরি বাহোমে আ
আবি জা,আ,আ
বেবি আই লাভ ইউ,,

সৌরভ প্রিয়তাকে কোলে নিয়ে রুমের ভেতর চলে গেল।প্রিয়তাকে বিছানার ওপর শুইয়ে রেখে বারান্দার দরজা ও রুমের দরজা লক করে লাইট নিভিয়ে বিছানার ওপর এসে দু পা তুলে বসলো।বাহিরের করিডরের আলো আবছা ভাবে রুমে প্রবেশ করছে।সেই আলোয় প্রিয়তা ও সৌরভ দুজন দুজনার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সৌরভ প্রিয়তার গালে গলায় আঙ্গুল ছুঁইয়ে দিয়ে কন্ঠে মাদকতা এনে বললো;

সৌরভ:-বিয়ে করা প্রিয়তমা স্ত্রীকে হালাল ভাবে স্পর্শ করতে চাইছি।পারমিশন পাবো কী?

সৌরভ কথাটা বলে শেষ করতে পারলো না তার আগেই প্রিয়তা সৌরভকে টান দিয়ে নিজের ওপর নিয়ে গেলো।তারপর দুজনের ওপর কম্বল টেনে দিয়ে প্রিয়তা নিজে থেকেই সৌরভের গালে গলায় চুমু খেতে লাগে।সৌরভের কানের লতিতে আলতো ভাবে কামড় দিয়ে বললো;

প্রিয়তা:-আমাকে স্পর্শ করতে আপনার কোনো পারমিশনের প্রয়োজন নেই।আমি পুরোটাই আপনার,তাই যখন ইচ্ছা তখনই আমাকে স্পর্শ করতে পারেন আপনি।বুঝেছেন?

সৌরভ ঠোঁট এলিয়ে হেসে বললো;

সৌরভ:-হুম বুঝলাম।এবং এখন শুধুই ভালোবাসা বিনিময় চলবে মাই ডিয়ার ওয়াইফি।গেট রেডি ফর মাই লাভ টর্চার।

দুষ্টু হেসে সৌরভ ডুব দিলো প্রিয়তার মধ্যে।দুজনেই অথৈ ভালোবাসার গভীরে হাবুডুবু খাচ্ছে।আজ দুজন দুজনাতে মত্ত হয়ে গেছে পুরোপুরি রূপে।ভালোবাসাময় একটি আদুরে রাতের সূচনা করলো ওরা।

❤️

পরদিন,,
সকালে সৌরভের আগে প্রিয়তার ঘুম ভেঙে গেছে।সৌরভ তখনও ঘুমোচ্ছে প্রিয়তার বুকের ওপর মাথা রেখে।প্রিয়তা সৌরভের মাথায় চুমু খেয়ে তাকে বুকের ওপর থেকে নামিয়ে ওর বালিশের ওপর শোয়ালো।অতঃপর পাতলা একটা ওড়না শরীরে জড়িয়ে ওয়ার্ড্রোব থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।

গোসল শেষ করে বেরিয়ে দেখতে পেল সৌরভ ঘুম থেকে ওঠে গেছে।সৌরভ প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা চমৎকার একটা হাসি দিলো।প্রিয়তা চুল মুছতে মুছতে সৌরভের কাছে গিয়ে সৌরভের এলোমেলো চুল হাত দিয়ে আরও এলোমেলো করে দিয়ে বললো;

প্রিয়তা:-গুডমর্নিং জামাই,,যান গিয়ে গোসল করে আসুন।আমি রুম গুছিয়ে নিচে যাচ্ছি।

সৌরভ:ওকে বাবু।

সৌরভের কাপড় বের করে দিতেই সৌরভ চলে গেল গোসল সারতে।প্রিয়তা বিছানা গোছালো।রুম ঝাড়ু দিলো।ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে গহনাগুলো সরিয়ে বক্সের ভেতর রাখলো।আরও টুকটাক কিছু কাজ করে চলে গেল নিচে।

সৌরভ আসতেই দুজন মিলে নাশতা করে নিলো একসাথে।আজকে প্রিয়তার আব্বু আম্মু ও ভাই চলে যাবেন ওনাদের বাসায়।সাথে প্রিয়তা ও সৌরভও যাবে।

দুপুরের খাবার খেয়ে ওরা তৈরি হয়ে প্রিয়তাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো।সৌরভ প্রিয়তার হাত ধরে রেখেছে।সৌরভের বাইকে করে দুজন ও বাসায় যাচ্ছে।

বাসায় পৌঁছে প্রিয়তা ও সৌরভ কিছুক্ষণ রেস্ট নিলো প্রিয়তার বেডরুমে।মিসেস প্রমি তো জামাই আপ্যায়নের জন্য হরেক রকমের রান্না বান্না করছেন আসার পর থেকেই।মি.মুজাফফর তো ব্যাগভর্তি বাজার করে নিয়ে এসেছেন।মুসকান কাজে বেরিয়েছে।

বিকালে প্রিয়তা সৌরভকে মসজিদে পাঠিয়ে নিজেও আসরের নামাজ আদায় করে নিলো।সৌরভ আসার পর দুজন মিলে কিছুক্ষণ রোমান্স করে তারপর সন্ধ্যায় সবাই একসাথে আড্ডা দিয়ে নাশতা করলো।

❤️

রাতের খাবার খেয়ে দুজন রুমে চলে এসেছে।সকলেই ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে এখন।প্রিয়তাও তাই।ওরও আজ ভীষণ ঘুম পেয়েছে।হামি দিতে দিতে শহীদ হয়ে যাচ্ছে বেচারি।সৌরভ প্রিয়তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে মাথায় বিলি কেটে দিতে লাগলো।আরাম পেয়ে প্রিয়তা ততক্ষণে ঘুমের দেশে পগারপার।সৌরভ প্রিয়তার কপালে আলতো ভাবে চুমু খেয়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে ঘুমিয়ে গেল।যে-ই তাদেরকে একসাথে দেখছে সে-ই বলছে মাশাআল্লাহ দুজনকে একসাথে ভীষণ মানিয়েছে।খুবই কিউট একজোড়া কাপল।

শ্বশুর বাড়িতে মোট ২ দিন থাকলো সৌরভ।এই দুটো দিন সে খুব ভালো করে টের পেয়েছে যে জামাই আদর ঠিক কী জিনিস!এরকম আপ্যায়ন সৌরভ আশা করে নি।ওনারা একটু বেশিই খাতিরযত্নে ব্যস্ত ছিলেন।বিদায়ের সময় প্রিয়তা এতবেশি কান্না না করলেও,কষ্টে কয়েক ফোঁটা চোখের পানি পড়েছে তার।মুসকান আর সৌরভ অবশ্য সামলে নিয়েছে ওকে।

দুজন বাসায় চলে এসেছে।আসার সময় প্রিয়তা বই খাতা সব সাথে করে নিয়ে এসেছে।আজকে থেকে পড়া শুরু করতে হবে।বিয়ে শাদির প্যারায় পড়ে হুদাই একমাস কেটে গেছে।এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা।তাই এই ক’মাসে একটু ভালো করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।

আর কয়েকদিন পর থেকে সৌরভেরও অফিসে জয়েন করতে হবে।দুজনেরই ব্যস্ততায় সময় কাটবে।

এভাবেই দুজনের টোনাটুনির সংসার চলতে থাকে।চুঁইয়ে চুঁইয়ে যেন সময় যেতে লাগে তার আপন গতিতে।ফেব্রুয়ারীর একতারিখে সৌরভ তার অফিসে জয়েন হয়েছে।সৌরভ সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে যায়,এবং বাসায় আসে রাত ৮ টায়।প্রিয়তাকে একজন মেয়ে টিউটর রেখে দিয়েছেন মিসেস মিনা যে দুপুরের দিকে বাসায় এসে তাকে পড়িয়ে দিয়ে যায়।

প্রিয়তা সারাদিন শুধু পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকে।রাতে পড়তে ভালো লাগলেও রুটিন চেঞ্জ করে ফেলেছে সে।কারণ সারাদিন কাজ করে রাতে বাসায় ফিরে সৌরভ।তখন যদি পড়তে বসে সে তাহলে সৌরভকে একটুও সময় দিতে পারবে না।তাই এমন ব্যবস্থা।দিনে সকল পড়া তৈরি করে রাতে সৌরভের সাথে সময় কাটায়।সৌরভের সারা দিনের শ্রান্তি চলে যায় প্রিয়তাকে একবার দেখলেই।এই মেয়েটা যে তার চোখের মণি।একবার না দেখলে মনটা খালি ছটফট করে।

প্রিয়তা বাপের বাড়িতে যেমন নবাব ছিলো,শ্বশুর বাড়িতেও সে তেমন নবাবই আছে।কেউ তাকে কোনো কাজ করতে বলে না।মিসেস মিনা ও মিসেস শিলা তো মাঝে মধ্যে তাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেন।আগে যেমন সবার আদরের ছিলো,এখনও তেমনই আছে সে।জায়েরা সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকে।কারও মধ্যে কোনো ধরনের মনোমালিন্যের ছিটেফোঁটাও নেই।সুখের সংসার গঠনে তাদের সবার ভূমিকা রয়েছে।

প্রিয়তা সৌরভের সান্নিধ্যে থেকে থেকে পুরোপুরি নামাজী হয়ে গেছে।সাথে পর্দাশীনতা তো রয়েছেই।দুজনের মধ্যে অনেক ভালো একটা বন্ডিং আছে।কেউ কারও মনের কথা না বলতেই অপরজন বুঝে যায়।প্রিয়তা হাজার দুষ্টামি করলেও সৌরভের সামনে সে ভীষণ বাধ্যগত একটি মেয়ে।সৌরভ যা বলে তাই শুনে।সৌরভ আর প্রিয়তার ভালোবাসা এ ক’দিনে অনেক গুণ মজবুত হয়েছে।কেউ কাউকে ছাড়া বুঝে না।প্রতিটি রাত কাটে দুজনের আদর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে।

দেখতে দেখতে এপ্রিল মাস চলে এসেছে।প্রিয়তা ধুমসে পড়াশোনা করছে।ভাই মুসকান ও অনেক খেয়াল রাখছে তার।সৌরভ অফিসে নতুন তাই বেশিদিনের ছুটি নিতে পারে নি।মাত্র দুদিনের জন্য ছুটি মঞ্জুর করেছে বস।এজন্য প্রথম দিন সৌরভ প্রিয়তাকে নিয়ে তার কলেজ হলে,যেখানে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে সেখানে নিয়ে এসেছে।রাতে প্রিয়তা যখন পড়তে ব্যস্ত ছিলো তখন সৌরভ তাকে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিয়েছে,ইমপোর্টেন্ট পড়া দেখিয়ে দিয়েছে।প্রিয়তাকে নিজে দুধ ডিম,স্যান্ডউইচ এসব রান্নাঘর থেকে এনে দিয়েছে খাওয়ার জন্য।যত্নের অন্ত নেই তার।

সৌরভ প্রিয়তাকে পরীক্ষার হলে পড়ার জন্য কয়েকটি দোয়া শিখিয়ে দিয়েছে।নার্ভাসনেস কাটানোর জন্য মোটিভেট করেছে।পানির বোতল হাতে ধরিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বেস্ট অব লাক বলেছে।প্রিয়তা স্বপ্নীল চোখে সৌরভের দিকে তাকালো।তার মতো ভাগ্যবতী মেয়ে দুনিয়ায় ক’জন আছে সে তা জানে না।এত এত ভালোবাসা ও কেয়ার করে তার সৌরজগত তাকে যে সে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে,অভিব্যক্তি দেখানোর জন্য কিছু খুঁজে পায় না।প্রিয়তা মুচকি হেসে সৌরভকে ফ্লাই কিস ছুঁড়ে দিয়ে হলের ভেতর চলে যায়।সৌরভ বাইকের ওপর ঠায় বসে থেকে অপেক্ষা করে তার প্রিয়তমার।

পরীক্ষা শেষে বের হয় প্রিয়তা।পরীক্ষার প্রশ্ন তার জন্য সহজ হয়ে এসেছে।আশানুরূপ ভালো হয়েছে তার পরীক্ষা।সৌরভকে আগের জায়গায় বসে থাকতে দেখে অবাক হয় সে।মানুষটা একটু রেস্ট করারও সময় পায় না কাজের চাপে অথচ তার জন্য কেমন দাঁড়িয়ে আছে ক্লান্তিহীন ভাবে।প্রিয়তার চোখে পানি চলে আসে।দ্রুত গিয়ে সৌরভের হাত ধরে সে।জিজ্ঞেস করে;

প্রিয়তা:-আপনি বাসায় যান নি মনে হয়!এতসময় ধরে কী এখানেই বসে ছিলেন?

সৌরভ:-আমার বউটা হলে খেটে পরীক্ষা দিবে আর আমি বাসায় গিয়ে আরাম করবো তা কী করে হয় বলো?মাত্র দুটো দিন ছুটি পেয়েছি।এই দুটো দিন অন্তত আমার বউকে সময় দিই।পরে তো মুসকান তোমায় নিয়ে আসা যাওয়া করবে,আমি সময় পাবো না।

প্রিয়তা সৌরভের দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো;

প্রিয়তা:-কিছু খান নি এখনো মনে হয়?মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে।

সৌরভ:-বাসায় গিয়ে দুজন একসাথে খাবো বুঝছো!এখন বলো তোমার পরীক্ষা কেমন হলো?কমন পড়েছে তো সব?

প্রিয়তা হাসিমুখে জবাব দিলো;

প্রিয়তা:-হ্যা পরীক্ষা অনেক ভালো হয়েছে।সবগুলোই কমন পড়েছে প্রায়।একটাও ছাড়ি নি।যতটা দেয়ার কথা ততোটাই লিখেছি।

সৌরভ:-গুড গার্ল।এখন বাইকে ওঠে বসো।বাসায় যাই।

প্রিয়তা সায় জানিয়ে বাইকে ওঠে বসলে সৌরভ সেটা স্টার্ট করলো।সারা রাস্তা দুজনে গল্প করে করে এসেছে।

বাসায় এসে দুজনে একসাথে খাবার খেলো।নামাজ পড়লো।দুজনে কিছুক্ষণ প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করলো।রাতে পরবর্তী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো প্রিয়তা।সৌরভ তাকে হেল্প করছে।

যে দুদিন সৌরভের ছুটি ছিলো সেই দুদিন সে-ই প্রিয়তাকে কলেজ নিয়ে আসা যাওয়া করেছে।ছুটি শেষ হয়ে যাওয়ার পর মুসকান প্রিয়তার দায়িত্ব নিয়েছে আগের মতো।

এভাবেই খুব ভালো ভাবে প্রতিটি পরীক্ষা দিলো প্রিয়তা।প্রতিটি পরীক্ষাই আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো হয়েছে।পরীক্ষা শেষে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল বেড়াতে।একসপ্তাহের মতো ঘোরাফেরা করার পর সবাই বাসায় ফিরে আসে।

পরীক্ষা শেষে ফ্রী হলেও সৌরভ প্রিয়তাকে ফ্রী থাকতে দেয় নি।তাকে IELTS কোর্সে ভর্তি করে দিয়েছে সৌরভ,যাতে ইংরেজিতে তার স্কিলটা মজবুত হয়।এদিকে বাসায় রাতে কম্পিউটারের যাবতীয় ব্যবহার সব শেখায় তাকে সৌরভ।এভাবেই দুজনের দিনগুলো খুব সুন্দর ভাবে কাটতে লাগলো।দুজন দুজনকে এত ভালো বুঝে যে মনে হয় তাদের দুটো শরীর ঠিকই কিন্তু একটাই আত্মা।ভালোবাসায় ভরপুর দুজনের মধ্যকার সম্পর্কটা।তাদের ভালোবাসা পরিবারে সবার জন্য দৃষ্টান্ত মূলক উদাহরণ।#তুমি_আমার_প্রিয়তমা
#লেখিকা_Amaya_Nafshiyat
#অন্তিম_পর্ব

এরপর কেটে গেছে প্রায় ৩ টা বছর,
সময় যে কারও জন্য কখনো থেমে থাকে না তা আবারও প্রমাণিত হলো।

১০ মাস বয়সী বাচ্চা মেয়ে সুরভী দোকানের এটা ধরবে ওটা ধরবে বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে।বেচারা সৌরভ একটা চিপসের প্যাকেট ও দুটো চকো চকো ওই ছোট ছোট হাতটিতে ধরিয়ে দিলো।সুরভী তাও আরও মজা কিনতে চায় দোকান থেকে।এতটুকুতে তার মন ভরছে না।যদিও পিচ্চিটা এগুলো তেমন একটা খায় না।শুধু কিনে দেয়ার জন্যই এত বাহানা।ছোট বাচ্চারা মূলত এমনই হয়ে থাকে।সুপরিচিত পাড়ার দোকানদার বাপ বেটির কান্ডকারখানা দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে।

সুরভী বাবা বাব্বা বলে নিজের ভাষায় কতকিছু বলার চেষ্টা করছে সৌরভকে।সৌরভ দোকানদারকে মেয়ের জন্য কেনা চকোলেট চিপসগুলো ব্যাগে ভরে দিতে বললো।সুরভীর হাতে যেগুলো রয়েছে সেগুলো যদি পিচ্চিটা নিজে থেকে না দেয় তাহলে তা কেউ জীবনেও নিতে পারবে না।তাই সৌরভও ঘাটালো না তার জেদি মেয়েকে।তাও তার আম্মুটা খুশি থাকুক।

সৌরভ:-আমার আম্মুজান,এবার খুশি তো তুমি?

সুরভী বাপের দিকে তাকিয়ে প্রাণখোলা এক হাসি দিলো তার ইঁদুরে দাঁত চারটা বের করে।মেয়ের হাসি দেখে সৌরভও হাসলো।মেয়েটাকে হাসলে পুরোই প্রিয়তার মতো লাগে।দোকানদার সবকিছু প্যাকেট করে দিতে দিতে বললো;

দোকানী:-ভাতিজী তো দেখা যায় আমাদের সারা দোকান তুলে নেয়ার ধান্দা লাগিয়েছে।হে!কী গো ভাতিজী,এই বয়সে চিপস চকোলেটের জন্য পাগল হলে চলবে বলো?দাঁতে পোকা ধরবে না?

সুরভী আবারও তার চমৎকার দাঁত ক’টি দেখিয়ে দিলো দোকানীকে।চিপসের প্যাকেট বুকের সাথে চেপে ধরে ছন্দে ছন্দে বাব্বা বাব্বা বলতে লাগলো।সৌরভ মেয়ের গালে চুমু খেলো একটা।চিপসের প্যাকেটসমেত বাপের গলা জড়িয়ে ধরলো পিচ্চিটা।দোকানি সৌরভকে হাসিমুখে বললো;

দোকানী:-ভাইজানের তো এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডিউটি তাই না?আমাদের মামণিকে নিয়ে এখন নিয়মিত দোকানে আসতে হবে,বুঝলেন ভাই!নয়তো আপনার লগে ঘোষা করবো আম্মাজান।

সৌরভ:-হ্যা ভাই,এই ডিউটি আমি অনেক আগে থেকেই করে আসছি।এককালে মেয়ের মাকে কোলে নিয়ে দোকানে আসতাম চকোলেট চিপস কিনে দেয়ার জন্য।এখন মেয়েকে নিয়ে আসি।মা যেমন মেয়েও তেমন হয়েছে।

দোকানী:-আল্লাহ আপনার এত সুন্দর পরিবারে রহমত দান করুন।

সৌরভ আমিন বলে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে আদুরে কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-আম্মু চলো আমরা এখন বাসায় যাই।তোমার আম্মু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

সৌরভ দোকানীর টাকা মিটিয়ে বিদায় দিয়ে পলিথিন হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো।সারা রাস্তা মেয়ের সাথে কথা বলে বাসায় এলো সৌরভ।বাসায় ঢুকতেই মিসেস মিনা নাতনিকে নিজের কোলে নিয়ে নিলেন।সুরভী তার মজা আর কাউকে না দিলেও দাদীকে সে সব দিয়ে দেয়।দাদী যেমন নাতনীর জন্য পাগল নাতনীও তেমন দাদী বলতে অজ্ঞান।সুরভী মুখ দিয়ে বু বু শব্দ করে চকো চকো গুলো দাদীকে দিয়ে দিলো।

মিসেস মিনা:-ওরে আমার সোনা বোনটা রে।দাদীর জন্য কত ভালোবাসা আমার বোনটার!এখন আসো দাদু তোমাকে গোসল করিয়ে দিই আমি।

মিসেস মিনা সুরভীকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন গোসল করাতে।সুরভীকে গোসল করাতে পারে না প্রিয়তা।তার ভয় লাগে বাচ্চা কাচ্চা গোসল করাতে।মনে হয় এই হাত পিছলে পড়ে যাবে।তাই এই দায়িত্ব সুরভী হওয়ার পর থেকে মিসেস মিনাই পালন করে আসছেন।

সৌরভ নিজের রুমে প্রবেশ করে দেখতে পেল,সুরভীর কাপড় চোপড় সব ভাজ করে পরিপাটি ভাবে র‌্যাকে তুলে রাখছে প্রিয়তা।সৌরভ পলিথিন ব্যাগটা বিছানার ওপর রেখে গিয়ে পিছন থেকে প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিলো।প্রিয়তা সৌরভের চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো;

প্রিয়তা:-চলে এসেছো?মেয়েকে কার কাছে রেখে এলে?

সৌরভ:-আম্মু গোসল করাতে নিয়ে গেছে।মেয়েটা বড্ড চঞ্চল হয়ে গেছে এই বয়সেই।হুবহু তোমার ফটোকপি।ছোটবেলায় তুমিও এমন ছিলে।

প্রিয়তা দাঁত বের করে হেসে জবাব দিলো;

প্রিয়তা:-দেখতে হবে না কার মেয়ে!আই উইশ আমার একটা ছেলে হোক ঠিক তোমার স্বভাবের, তোমার মতো।তাহলে আমি সবদিক দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবো।

সৌরভ দুষ্টু হেসে বললো;

সৌরভ:-ছেলেকে আনতে হলে তো আমাদের কিছু প্ল্যানিং ট্যানিং করতে হবে।কী বলো সুরভীর আম্মু?

প্রিয়তা:-তুমি দিন দিন বড্ড বেয়ারা লোক হয়ে যাচ্ছো!মুখে কিছুই কী আটকায় না তোমার?

সৌরভ প্রিয়তার ঘাড়ে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে প্রতুত্তরে বললো;

সৌরভ:-এত সুন্দরী বউ কাছে থাকলে মনটা ও মুখটা সত্যি সত্যিই অনেক বেয়ারা হয়ে যায় গো।কী করবো বলো,আমার বউটা যে মারাত্মক আকর্ষণীয় ও সুন্দরী।যার প্রেমে আমি হাজার রকমে হাজার ভাবে প্রতিনিয়ত পড়ি।এই ভালোবাসার কোনো শেষ নেই গো প্রিয়তমা।

প্রিয়তা:-হয়েছে গো আমার কবিস্বামী!প্রেমের কবিতা না আউড়িয়ে এবার আপনি যান গিয়ে গোসল করে আসুন।একসাথে দুপুরের খাবার খাবো।

সৌরভ:-আমার আনরোমান্টিক বউ একটা।যাচ্ছি গোসল করতে।

সৌরভ মুখ গোমড়া করে বিছানার ওপর রাখা কাপড় চোপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল গোসল করতে।প্রিয়তা আগেই গোসল করে নিয়েছে।সে এখন ঘরদোর গোছগাছ করতে ব্যস্ত।সৌরভ ও প্রিয়তার সম্পর্ক আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে বেবি হওয়ার পর।

আজ থেকে প্রায় ২০ মাস পূর্বে,অর্থাৎ ১ বছর ৮ মাস আগে প্রিয়তা কন্সিভ করে।যেদিন সৌরভ ও প্রিয়তা জানতে পারে যে তাদের এই ছোট্ট সংসার আলো করে একটা কিউট বেবি আসবে পূর্ণতা দিতে সেদিন ওদের খুশি দেখে কে!সৌরভ এই প্রথম অতি আবেগে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলো।বাসার সবাই খুব খুশি নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে।এলাকার পরিচিত সবাইকে মি.শফিক ও মি.সালাম মিষ্টি খাইয়েছেন সেই খুশিতে।মুসকান তার এরিয়ায় মিষ্টি বিতরণ করেছে মামা হওয়ার আনন্দে।

◑এ ক’বছরে সবার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে।মুসকানেরও বিয়ে হয়ে গেছে।তার বউ মিহুও মুসকানের মতো প্রিয়তাকে অনেক পছন্দ করে।ডলি এবং তানিয়ারও বিয়ে হয়ে গেছে।আর আকিল এখনও পড়াশোনা করছে।প্রিয়তাও বাচ্চা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা কন্টিনিউ করছে।সে চাকরি বাকরি করবে না ঠিকই কিন্তু স্টাডি কমপ্লিট করবে।◑

এটা একদম আকস্মিক ছিলো তাদের জন্য।সৌরভ বা প্রিয়তা কেউই বেবি নেয়ার প্ল্যানিং করে নি।অজান্তেই কন্সিভ করেছিলো সে।কিন্তু তারপরও তাদের সবার মনেই খুশির বন্যা বইছিলো।

সৌরভ অফিস করে বাসায় এসে সারাটা সময় প্রিয়তার পিছনে ছায়ার মতো কাটিয়ে দিতো।দুতলার রুম থেকে নিচতলায় একটা রুমে শিফট করে সৌরভ একমাত্র প্রিয়তা ও তার অনাগত সন্তানের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য।সৌরভ অফিস থাকাকালীন সময়ে মিসেস মিনা ও মিসেস শিলা তারপর তিন জায়েরা তার পরিপূর্ণ খেয়াল রাখতো।[সারা আর আবির আরও দুয়েক বছর পর বেবি নেয়ার প্ল্যানিং করেছে।তাই ওদের বেবি নেই]।

আগে এমনিতেও রাজকন্যার মতো সবার আদুরে ছিলো সে,বেবি পেটে আসার পর এমন হয়েছে যে তাকে তখন প্রতিবেলা মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দেয়া হতো।একা একা কোথাও যেতে দেয়া হতো না কাজকর্ম তো বহুত দূরের কথা।এমন আদুরে বউমা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না,আর এমন শ্বাশুড়ি ও জা তো কল্পনাতেও না।প্রিয়তার ভাগ্য বরাবরই সুপ্রসন্ন।

প্রিয়তার যখন ৭ মাস তখন সৌরভের প্রমোশন হয়।কাজেকর্মে অধিক দক্ষ থাকায় প্রমোশন পেতে দেরী হয় নি।এখন সে সবচেয়ে বড় পদে জব করে।আগে যেমন ছুটি পেত কম,এখন তেমন নয়।এখন ইচ্ছা করলেই ছুটি পেয়ে যায়।বাসায় বসে ল্যাপটপের মাধ্যমে কাজ করলেও চলে।আগের তুলনায় কাজের চাপ অনেকটাই কমে গেছে।

প্রিয়তার শরীরে প্রচুর পানি এসেছে।নড়তে চড়তে কষ্ট হয় তার।আগের তুলনায় প্রচুর গুলুমুলু হয়ে গেছে সে।সৌরভের তো টেককেয়ারের কোনো সীমা নেই।প্রতিমাসে নিয়মিত চেকআপ করানো,ঔষধ খাওয়ানো সব দিকে খেয়াল রাখে সে।প্রিয়তার মুড এই ভালো তো এই খারাপ।সবদিকে নজর রাখতো সৌরভ।প্রিয়তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করতো সর্বস্ব দিয়ে।একজন আদর্শ স্বামী ও বাবা হিসেবে যা যা করার দরকার সব করেছে সে।পেটে কান পেতে বাচ্চার সাথে কথা বলতো।সৌরভ বলতো তার একটা মেয়ে হবে,আর প্রিয়তা বলতো তার একটা ছেলে হবে।এই নিয়ে দুজন মধুর ঝগড়া করতো প্রতিদিন।

প্রিয়তার যখন ৯ মাস ১৮ দিন তখন তার ভীষণ পেইন শুরু হয়।সঠিক সময়ের ৩ দিন আগে ব্যথা ওঠেছে।এমন এক সময় যে বাসায় মহিলা ছাড়া ছেলেমানুষ কেউ নেই।ওইদিন সবারই কাজ ছিলো।সৌরভ তো কল্পনাও করে নি যে ওইদিনই প্রিয়তার পেইন ওঠবে।সৌরভকে যখন জানানো হয় তখন সে দিশেহারা অবস্থায় অফিস থেকে বের হয়।

মিসেস মিনা,মিসেস শিলা ও এশা মিলে নিজেরাই ডেলিভারির কাজ শুরু করে দেয়।এশা নার্স ছিলো,কিন্তু ২ বছর জব করে আর করতে পারে নি আবিদের জন্যে।আবিদ চায় না সে হসপিটালে গিয়ে নার্সগিরী করুক।তাই বাধ্য হয়ে জবটা ছেড়ে দেয় এশা।আর আজ সেই বিদ্যা কাজে লেগে গেল।

সৌরভ ঝড়ের গতিতে বাসায় এসেছে ততক্ষণে প্রিয়তার ডেলিভারিও হয়ে গেছে।এবং তাদের একটা পুতুলের মতো মেয়ে হয়েছে।প্রিয়তাও আল্লাহর রহমতে ভালো আছে।সৌরভের যেন ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসতে চাইলো।সর্বপ্রথম সোফায় বসে পানি খেয়ে নিজেকে স্থির করলো সৌরভ।কিছু মুহূর্ত রিল্যাক্স থেকে অতঃপর দ্রুত রুমে প্রবেশ করে।প্রিয়তা তখন বাচ্চাকে কোলে নিয়ে শুয়ে আছে।প্রিয়তার চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে একদম।সৌরভ খুশিতে আরেক দফা কান্না করলো প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে।সেটা ছিলো সুখের কান্না।

প্রিয়তার পরিবারের সবাই চলে এসেছে খবর শোনামাত্রই।মুহূর্তেই বাসাটা মেহমানে ভরে গেছে।বাচ্চার জন্য সবাই কাপড় চোপড়,খেলনা,বালিশ,কাঁথা,কম্বল,মশারী,তোষক,বেবি লোশন,শ্যাম্পু,পাউডার,তেল,টাওয়েল ন্যাপি,স্বর্ণের চেইন,স্বর্ণের নুপুর,রুপার চেইন,রুপার নুপুর,মানে কোনো কিছু বাদ রাখে নি কেউ কিনে আনতে।

সাতদিনের দিন বিরাট বড় করে আকিকা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হলো।বাপ মায়ের নামের সাথে মিল রেখে মেয়ের নামকরণ করা হলো,সুরভী তালুকদার প্রিতি।

মেয়ে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠতে লাগলো।ছোট থেকেই বাপের পাগল সুরভী।সাথে অধিক পছন্দের লিস্টে দাদীও আছেন।বাকিদের সাথেও তার অনেক ভালো বন্ডিং।কিন্তু এই দুজনের মধ্যে তার জান প্রাণ সব।প্রিয়তাকে দুধ খাওয়ার সময় আর ঘুমানোর সময় প্রয়োজন পড়ে তার।নয়তো সারাদিন দাদীর কাছে নয়তো সৌরভ বাসায় থাকলে বাপের কাছে থাকবে।পিচ্চিটা সবার আদরের।এমনকি জিহান এবং সিমি ওরা দুজনও ছোট হওয়া সত্ত্বেও তাকে আগলে রাখে।এতকিছুর মধ্যে সৌরভ আর প্রিয়তার ভালোবাসা যেন মেয়ে হওয়ার পর আরও হাজার গুণ মজবুত হয়েছে।তাদের ভালোবাসার গভীরতার কথা আর না-ই বা বললাম।

অতীতের সব ঘটনা রোমন্থন করছিলো প্রিয়তা বিছানার ওপর বসে।এমনসময় মিসেস মিনা টাওয়েল দিয়ে প্যাচিয়ে উদোম অবস্থায় সুরভীকে নিয়ে এলেন।

মিসেস মিনা:-প্রিয়ু,তোর মেয়েকে কাপড় চোপড় পড়িয়ে খাইয়ে ঘুম পাড়া তো মা।এখন তো ওর ঘুমের সময়।সকালে কী সেরেলাক খেয়েছিলো সে?

প্রিয়তা বসা থেকে ওঠে সুরভীকে কোলে নিয়ে জবাব দিলো;

প্রিয়তা:-হ্যা মা সকালে খেয়েছে।

মিসেস মিনা:-আচ্ছা আমি যাই,তোর বাবা বাসায় এসেছে।দেখি তার কী লাগে!

প্রিয়তা:-আচ্ছা মা।

মিসেস মিনা চলে গেলেন।প্রিয়তা সুরভীকে বিছানার ওপর শুইয়ে রেখে তেল লোশন কাপড় ও ন্যাপি নিয়ে এলো।সুরভী বিছানায় শুয়ে হাত পা নাচাচ্ছে।প্রিয়তা মেয়ের সাথে আদুরে কন্ঠে কথা বলে তেল লোশন মাখাচ্ছে।

প্রিয়তা:-আমার আম্মুটা এত নাচানাচি কেন করে রে?হুম?কী হয়েছে আমার মা টার?আমার মা টা এত দুষ্টুমি কেন করে?

প্রিয়তার কথা শুনে খিলখিল করে হাসছে সুরভী।প্রিয়তাও হাসছে মেয়ের হাসি দেখে।কাপড় ও ন্যাপি পড়িয়ে তাকে কোলে নিয়ে ব্রেস্ট ফিডিং করাতে লাগে প্রিয়তা।

কিছুক্ষণ পর সৌরভ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো গোসল সেড়ে।দেখলো প্রিয়তা মেয়েকে খাওয়াচ্ছে।সৌরভ টাওয়েল দিয়ে মাথা মুছে প্রিয়তার পাশে এসে বসলো।কিছুটা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো;

সৌরভ:-ঘুমিয়ে গেছে তাই না?

প্রিয়তা:-হুম,এইমাত্র চোখ বন্ধ করলো।

সৌরভ:-বেডের মধ্যখানে শুইয়ে রেখে নিচে আসো।আমিও নিচে যাচ্ছি।

প্রিয়তা:-আচ্ছা যাও তুমি।আমি আসছি।

সৌরভ সায় জানিয়ে প্রিয়তার গালে ও বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।প্রিয়তা বাচ্চাকে খাইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মশারী টাঙিয়ে নিচে চলে আসে।
অতঃপর দুজনে একসাথে বসে খাবার খায়।

বিকেলে সৌরভ প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে।পিচ্চিটা তার দাদা দাদীর কাছে।সারা এবার কন্সিভ করেছে,সে ৪ মাসের প্রেগন্যান্ট।সেও এখন প্রিয়তার মতো কন্ডিশনে আছে।

রাতের খাবার খেয়ে প্রিয়তা আজ আগেই রুমে চলে এসেছে।সৌরভ মেয়েকে কোলে নিয়ে ভাইদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে ড্রয়িং রুমে।

প্রিয়তা আজ সৌরভের জন্য সাজতে লাগলো।আজকে সে নেভি ব্লু কালার ও গোল্ডেন পাড়ের একটা সুতির শাড়ি পড়েছে।দুহাত ভর্তি চুড়ি।চুল হাত খোঁপা বেঁধে তাতে কাঠগোলাপের গাজরা লাগালো।চোখে গাঢ় করে কাজল টানলো।ঠোঁটে চেরি কালারের হালকা করে লিপস্টিক দিয়েছে।কানে টানাদুল।আঙ্গুলে সৌরভের দেয়া আংটি।গলায় সেই স্বর্ণের চিকন চেইন।পায়ে রুপার নুপুর।সবকিছু মিলিয়ে তাকে দেখতে পুরো মায়াবতী পরীর মতো লাগছে।আজকে নির্ঘাত সৌরভ হার্ট অ্যাটাক করবে প্রিয়তাকে দেখে।

রাত প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।সৌরভ সুরভীকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।ঘুমে ঢুলছে সুরভী।বাপের বুকে মাথা রেখে নিভু নিভু চোখে আশপাশে তাকাচ্ছে।সৌরভ রুমে ঢুকে প্রিয়তাকে দেখেই পুরোপুরি থমকে গেল।তার প্রাণপ্রিয়া প্রেয়সী ও প্রিয়তমাকে দেখতে এত সুন্দর লাগছে যে তা বলার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সৌরভ।

সৌরভ প্রিয়তার কাছে গিয়ে একহাত দিয়ে তার থুতনিতে ধরে মুখটা উঁচু করলো।কাজলরাঙা চোখ জোড়া মেলে সৌরভের দিকে তাকালো প্রিয়তা।মুখে তার একরাশ লাজ এসে ভির করেছে।সৌরভ প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বললো;

সৌরভ:-ইশশ,চাহনিটা একদম বুকে এসে লাগলো।তোমার প্রেমে মেরে ফেলার ধান্দা লাগিয়েছো বুঝি বউ?আজ এত আকর্ষণীয় লাগছে কেন তোমাকে?

প্রিয়তা লজ্জা পেয়ে মুখ ঢাকলো।সৌরভ হেসে দিয়ে প্রিয়তার দুই চোখের পাতায় চুমু খেলো।সুরভী মায়ের কোলে যাওয়ার জন্য হাত বাড়ালো।প্রিয়তা মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো;

প্রিয়তা:-একটু অপেক্ষা করো প্লিজ।ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আসি!

সৌরভ:-আচ্ছা।আমি বারান্দায় অপেক্ষা করছি।তুমি এসো।

প্রিয়তা:-আচ্ছা।

সৌরভ বারান্দায় চলে গেল।প্রিয়তা মেয়েকে খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।বেশ কিছুক্ষণ পর মেয়ে ঘুমিয়ে যেতেই ওকে তার জায়গায় শুইয়ে রেখে গায়ে কাঁথা দিয়ে বারান্দায় চলে এলো।দেখলো সৌরভ বারান্দার রেলিঙে হাত রেখে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে।প্রিয়তা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সৌরভ তাকে নিজের কাছে আগলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো।প্রিয়তা সৌরভের বুকে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকালো।আজকে আকাশে বিরাট একটা থালার মতো চাঁদ উঠেছে।সৌরভ আর প্রিয়তার প্রেমের পূর্ণতার জানান দিতেই যেন আজকে এই চাঁদের আগমন।আশপাশটা চাঁদের আলোয় ভরে গেছে।সৌরভ নেশালো কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-আজকে আমার সোনা বউটাকে দেখেই বোধহয় এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে!আকাশ যেমন তার চাঁদের আলোয় আলোকিত,আমিও তেমনি আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর রূপের আলোয় আলোকিত।আহ কত মিল আমাদের মধ্যে তাই না?

প্রিয়তা:-যাহ,খালি ফাও কথা বলো!

সৌরভ:-উহুম,মোটেও না।জানো আমি প্রচুর সুখী একটা মানুষ।আমি এতটা কখনো আশা করি নি।আমার জীবন রাঙিয়ে দিতে তোমার আগমন।আমার জীবন পরিপূর্ণ করতে আমার মেয়ে সুরভীর আগমন।আর কী চাই বলো?আমি তো এতেই অনেক সুখী।জীবনকে উপভোগ করতে আর কী লাগে?

প্রিয়তা:-আমার তো কোনোকালেই বিয়ের প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট ছিলো না।কিন্তু জানি না তোমাকে দেখার পর থেকে আমার মনটার কী যে হলো!তোমাকে না পেলে ডেস্পারেট হয়ে যাবো এমন একটা কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেত সবসময়।তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটা এত সুন্দর হয়েছে যে আমি বলে বোঝাতে পারবো না।তোমার প্রতি আমার ফিলিংসটা অনেক বেশি।আমার মতো ভাগ্যবতী কজন আছে বলো?আমার স্বামীর মতো স্বামী দুনিয়ায় এক পিসই আছে।আমার পুরো দুনিয়া তুমি।অনেক ভালোবাসি গো তোমায়।অনেক বেশি ভালোবাসি।

প্রচন্ড রকমের আবেগময় কন্ঠে কথাগুলো বললো প্রিয়তা।সৌরভের কণ্ঠনালীতে দুটো চুমু খেয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।সৌরভও প্রিয়তার মাথায় চুমু খেয়ে বললো;

সৌরভ:-আমি আমার আবেগ ও ভালোলাগাটুকু সুন্দর করে সাজিয়ে বলতে পারি না কিন্তু জানো তো,আমার বুকের ভেতর যতটুকু ফিলিংস লুকিয়ে আছে তার সবগুলোই তোমার জন্য।অন্যান্যদের মতো ছন্দ মিলিয়ে হয়তো বলতে পারবো না,তবে আমি তোমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসি তার কোনো পরিমাপ করা যাবে না।আমার সবকিছুই তুমি।হৃদয় উজার করে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি বউ।

এই মুহুর্তে দুজন দুজনকে অনুভব করতে ব্যস্ত।দুজন দুজনার চোখের দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সৌরভ প্রিয়তার কপালের সামনে আসা চুলগুলো সযত্নে কানের পিছে গুঁজে দিলো।ঘোরলাগা কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-আনাড়ি কন্ঠে আজ একটা গান শোনাই তোমাকে বউ?গানটা অনেক আগের,বাট আমি আমার অনুভূতিটা এই গানের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তুলতে চাই।শুনবে?

প্রিয়তা জবাব দিলো;

প্রিয়তা:-হুম শোনাও।

তোমার চোখে আকাশ আমার
চাঁদ উজার পূর্নিমা,
ভেতর থেকে বলছে হৃদয়
তুমি আমার প্রিয়তমা!
পথের শুরু থেকে শেষে
যাবো তোমায় ভালোবেসে,
বুকে আছে তোমার জন্য
অনেক কথা জমা!
ভালোবাসি তোমায় কতো
দেখাে হৃদয় খুলে,
রাঙিয়ে দেবো তোমার পাজর
মনের রঙিন ফুলে।
তোমায় দেখার শেষ হবে না
দু চোখ বুজার আগে,
আকাশ হয়ে জড়িয়ে রবো
গভীর অনুরাগে।

সৌরভের খোলাকন্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেছে প্রিয়তা।সৌরভ প্রিয়তার ঠোঁটে চুমু খেয়ে আদুরে কন্ঠে বললো;

সৌরভ:-আমার প্রিয়তমাকে আমি অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।এই ভালোবাসার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই।মৃত্যুর আগ অবধি এই ভালোবাসার বন্ধন অটুট থাকবে।এভাবেই আমার কলিজাকে আমার বক্ষপিঞ্জরে আটকে রাখবো।এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়বো না।

প্রিয়তার চোখ থেকে দুফোঁটা খুশির অশ্রু ঝরে পড়ে।আবেশে দু চোখ বন্ধ করে সৌরভের বুকের সাথে লেপ্টে যায় সে।একদম যতটা টাইট করে জড়িয়ে ধরা যায় ততোটাই জড়িয়ে ধরেছে সে।সৌরভ প্রিয়তাকে বুকের সাথে আগলে রেখে মাথায় চুমু খেলো।ফিসফিসিয়ে বললো;

সৌরভ:-আমার প্রিয়তমা স্ত্রী।আই লাভ ইউ!❤️

প্রিয়তা:-আই লাভ ইউ মোর দ্যান ইন মাই লাইফ সৌরজগত!আই লাভ ইউ সো মাচ!এন্ড আই স্টিল লাভ উইথ ইউ মাই ডিয়ার হাবি!স্টিল লাভ উইথ ইউ!❤️

রাতের এই নিস্তব্ধতায় দুজন মানুষ নিজেদেরকে অনুভব করতে ব্যস্ত।ওরা নিজেদের মধ্যে প্রেম বিনিময় করছে এই চন্দ্রপূর্ণিমার রাত্রিতে।এভাবেই ওদের দুজনের মধ্যকার সম্পর্ক ও ভালোবাসা চির অটল থাকুক।এই দোয়াই করি!

__________________সমাপ্তি___________________

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here