তুমি আমার প্রেয়সী ৩ পর্ব -০৯

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#সিজন ৩
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
#পর্ব_৯

আমি ছিলাম শান্ত শিষ্ট আর ও ছিল উড়নচন্ডী, অভদ্র। তাই বাবা আমাকে একটু বেশিই ভালোবাসতো। যার কারণে আমি ওর চোখের বিষ হয়ে যায়। মেহের বড় হতে থাকে আর তার অভদ্রতামো বাড়তে থাকে। পার্টি করা ড্রিংকস করা ওর রোজকার রুটিন হয়ে যায়। রাত করে বাড়ি ফেরা। কখনো কখনো তো বাড়ি ফিরতোও না। অনেক ছেলের সাথে সম্পর্কে জড়ায় তার সাথে বিভিন্ন ধরনের খারাপ কাজে লিপ্ত হয়। তাই তো বাবা ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিল। মেহের ভেবেছিল বাবা আমার জন্যই ওকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। আমার প্রতি ওর আরো ক্ষোভ জন্মে।

এরপর কেটে গিয়েছিল বহু বছর ওর সাথে আমাদের কারো যোগাযোগ ছিল না। এমন নয় যে আমরা ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি ওকে খোঁজার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু ও নিজে থেকেই আমাদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এর মাঝে আমি বিয়েও করি ফেলি। মেহের ফিরে আসে বাবা মারা যাওয়ার তিন বছর পর। তখন তোর বয়স ছিল ৪ বছর। মেহের আমার হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চায় এবং এটাও বলে সে পাল্টে গেছে। সে আর আগের মেহের নেই। আমিও ওকে বাড়িতে থাকতে দেই। বাবার সম্পত্তির ওপর তো মেহেরেরও অধিকার আছে। বেশ ভালোই চলছিল আমাদের দিন। আমরাও বুঝতে পারি মেহের সত্যিই পাল্টে গেছে। কিন্তু আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ছিল। মেহের আমাদের সামনে শুধু ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে ছিল। আমাদের আড়ালে তার কাজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিল। যেটা আমরা টেরও পায়নি। মেহেরের সাথে অমিতের একটা ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। অমিত মেহের আসার পর থেকেই মেহেরকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না। সবকিছু বেশ ভালোই কাটছিল। বিপত্তি ঘটল তাহসিনকে নিয়ে। তাহসিন আর আমি একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম। আমি তাহসিনের সিনিয়র ছিলাম। তবুও আমাদের মাঝে একটা বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি ভার্সিটি থেকে চলে আসি আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। তাহসিনও নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। আমাদের যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হঠাৎই একদিন তাহসিনের সাথে দেখা হয়ে যায় আর আমি জোড় করে তাহসিনকে বাসায় নিয়ে আসি। তাহসিনকে বাসায় নিয়ে আসায় হয়তো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তাহসিনকে দেখেই মেহেরের ভালো লেগে যায়। কিন্তু তাহসিন ছিল বিবাহিত এবং ওর স্ত্রী তখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। আমি মেহেরকে বলি। কিন্তু মেহের মানতে নারাজ। আমি মেহেরকে এটাও বলি যে, তাহসিন তার স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মেহেরের এক কথা একটা ছেলে চারটা বিয়ে করতে পারে। আর তাহসিন যদি তাকে একবার দেখে তাহলে তাহসিন তাকেই বিয়ে করবে। আমি ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করি কিন্তু বোঝার চেষ্টায় করেনি। মেহের আমার কাছে তাহসিনের নাম্বার চায়, ঠিকানা চায়। কিন্তু আমি দেয়নি। মেহের দিন উগ্র আচারণ করতে শুরু করে।

হেলাল রহমান একটা লম্বা শ্বাস নেয়। একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে। আবার বলতে শুরু করে।

ও আমি একটা ভুল করেছি। তাহসিন মেহেরকে দেখেছিল একবার কিন্তু চিনতো না। আসলে বয়স হয়েছে তো সব কথা মনে থাকে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তাহসিনের সাথে আমার একদিন হসপিটালে দেখা হয়ে যায়। সেদিন আমার সাথে মেহেরও ছিল। অমিত অসুস্থ থাকায় আমি আর মেহের অমিতকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিলাম। তাহসিনও তার স্ত্রীকে নিয়ে হসপিটালে আসছিল চেকআপ করানোর জন্য। হসপিটালেই মেহের তাহসিনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দেয়। তাহসিন সাথে সাথেই প্রত্যাখান করে দেয়। মেহের তাহসিনের প্রত্যাখান সহ্য করতে পারেনি। পাগলের মতো আচারণ শুরু করে। তাহসিনের স্ত্রীর ওপর এ্যাটাক করতে যায়। এতে তাহসিন বেশ রেগে যায়। জনসম্মুখে তাহসিনকে থাপ্পড় মেরে চলে যায়। এর কিছুদিন পরে হঠাৎই খবর পাই মেহেরের এক্সিডেন্ট হয়েছে এবং মারা গেছে। অবৈধ কার্যকলাপ করতে গিয়ে ধরা খায় আর পুলিশের তাড়া খেয়ে ট্রাকের নিচে পড়ে। মারা যাওয়ার আগে নিজের বিশ ঠিকই ছড়িয়ে গেছে। আমার ছোট ছেলের মাথা বিগড়ে দিয়ে গেলো।

অমিত মাথা নিচু করে ফেলে। মিন মিন করে বলে, ফুফি আমাকে স্বার্থের জন্য ইউজ করলো।

ঐশি অমিতকে উদ্দেশ্য করে বলে, আপনার ফুফি যখন মারা গিয়েছিলেন তখন আপনার বয়স ছিল ৪ বছর। নিতান্তই আপনি। এতোদিন আগের কথা আপনার কী করে মনে রইল।

আমার তো মনে ছিল না। ৭-৮ বছর আগে ফুফির লেখা চিঠি পাই সেখানেই এসব লেখা ছিল।

হেলাল রহমান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাহসিনের পরিবারের ক্ষতি করতে চাওয়ার কারণটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু তোমার এই বিপথে যাওয়ার কারণটা তো বুঝতে পারলাম না? আর তুমি চিঠির বিষয়টা আমাকে জানালে না কেনো? তুমি যদি আগে বলতে তাহলে আজকে এই দিন দেখতে হতো না।

তোমাদের কারণেই আজকে আমার এই অবস্থা। নিঃসঙ্গতা আমাকে বিপথে নিয়ে আসতে বাধ্য করছে। তোমাকে আমি কীভাবে জানাতাম? তোমার কী সময় ছিল আমার কথা শোনার?

আমাদের কারণে কীভাবে! আমি আর তোমার মা তোমার পাশে কী ছিলাম না?

ছিলে বুঝি? কিন্তু আমি তো দেখতে পাইনি। আমার ভালো সময় বা দুঃসময় কখনোই তোমাদের পাশে পায়নি। আগের কথা না হয় বাধ দিলাম। আজকের দিনটার কথা ভাবো। আজকে আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন ছিল। আমার বিয়ে ছিল। কিন্তু আমার মা কোথায়? কোথাও দেখতে পাচ্ছি না তো। এখানে উপস্থিত থাকলে তো আমি উনাকে দেখতে পাব। উনি তো উনার বিজন্যাস মিটিং নিয়ে ব্যস্ত। আমার থেকেও উনার কাছে উনার বিজন্যাস মিটিং বেশি জরুরি। এটাই হচ্ছে তোমাদের আমার পাশে থাকে। টাকা দিয়েই সন্তানের সব চাহিদা পুরণ করা যায় না। সন্তানরা তাদের মা-বাবার ভালোবাসা চায়। যেটা আমি বা ছোঁয়া কেউই পায়নি। আমরা দুজন আমাদের আনন্দের দিন অথবা মন খারাপ দিন কখনোই তোমাদের পাশে পায়নি।
তোমরা তো তখন টাকার পিছনে ছুটতে ব্যস্ত। নিজেদের বিজন্যাস মিটিং, পার্টি এসবে মত্ত্ব ছিলে। আমাদের খোঁজ নেওয়ার সময় কী ছিল তোমাদের? হাতে শুধু টাকা দিয়ে দিতে কখনো ভালোবাসা দাওনি। কখনো কী খোঁজ নিয়ে দেখেছিলে আমরা সেই টাকা দিয়ে কী করেছি? দেখনি। কলেজে ওঠে বন্ধু নির্বাচনে একটা বড় ভুল করি। তাই আজকে আমার এই অবস্থা। আমি রাত করে বাড়ি ফিরলেও তোমরা কখনো জানতে চাওনি আমি কোথায় ছিলাম বা তোমরা নিজে থেকেও খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করনি আমি এত রাত পর্যন্ত বাসার বাহিরে কী করতাম? থাক পুরোনো কথা। আমার আজাইরা কথা শুনিয়ে তোমার মুল্যবান সময় নষ্ট করবো না। যা চলে গেছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। সাফাত, কণা তোমাদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই। যদি পারো তাহলে এই পাপিকে ক্ষমা করে দিয়ো। অফিসার আমাকে নিয়ে চলুন।

অমিত যেতে যেতে বলে, মি. হেলাল রহমান আপনি আপনার মিটিংয়ে চলে যান। আমার জন্য আর আপনার মুল্যবান সময় নষ্ট করতে হবে না। আপনাদের দুজনের আর কোনো পিছুটান নেই। যত ইচ্ছা টাকা ইনকাম করেন। আজকে আপনাদের কাজে আর কেউ ডিস্টার্ভ করবে না। এক মুঠো ভালোবাসার জন্য আর কেউ আপনাদের পিছু পিছু ঘুরবে না। আজকে থেকে আপনারা মুক্ত। আমি আর আমার বোন জেলেই ভালো থাকব।

পুলিশের সাথে অমিত চলে যায়। এতক্ষণ যাদের চোখে অমিতের জন্য ঘৃণা দেখা যাচ্ছিল। এখন তাদের চোখেই অমিতের জন্য সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে। বাবা-মার জন্যই অনেক সন্তান বিপথে যায়। অমিতের বাবা-মা যদি টাকার পিছনে না ছুটে অমিত আর ছোঁযাকে একটু সময় দিতো। তাহলে আজকে তাদের এই দিনটি দেখতে হতো না। সন্তানের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্কে গড়ে তুললে অবশ্যই তাদের সবকিছু বলতো।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here