তুমি আমার প্রেয়সী ৩ পর্ব -১১ ও শেষ পর্ব

#তুমি_আমার_প্রেয়সী
#সিজন ৩
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
#অন্তিম_পর্ব

সারাদিন অনেক লাফালাফি করেছ। এখন চুপচাপ ঘুমাবে। উল্টা পাল্টা আবদার করলে খবর আছে।

কণা শুতে না চাইলেও আদিয়াত জোড় করে কণাকে শুইয়ে দেয়। আদিয়াত কণাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই কণা আদিয়াতের হাত সরিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে গিয়েই হড়হড় করে বমি করে দেয়। আচমকা কণার এমন ব্যবহারের আদিয়াত চমকে ওঠে। আদিয়াতও কণার পিছু দৌড়ে যায়। বমি করে কণা ক্লান্ত হয়ে যায়। সামনে এক পা রাখতেই কণা পড়ে যেতে নেয়। আদিয়াত পিছন থেকে কণাকে ধরে নেয়। কণা আদিয়াতের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়।

আদিয়াত কণাকে কোলে তুলে নেয়। কোলে করে এনেই বিছানায় শুইয়ে দেয়। আদিয়াত ভেবেছিল ভীষণ করে বকে দিবে কণাকে। কিন্তু কণার মলিন মুখ দেখে আদিয়াতের আর সাহস হলো না কণাকে বকার। শুধু কঠিন সুরে বলে,

আমি তোমার আর কোনো বাহানা শুনবো না। তোমার শরীর নিয়ে তোমাকে আর আমি হেলাপেলা করতে দিব না। আগামীকালই আমার সাথে ডক্টরের কাছে যাবে।

কথাগুলো বলেই আদিয়াত কণার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে কণার পাশে শুয়ে পড়ে।

৮৪

কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। সবাই নিজ নিজ সংসার কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। আভিয়ান, ঐশি ; আর নিতু, আসিফের ও বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই নিজ নিজ জীবন নিয়ে সুখেই আছে। বেশ কয়েক বছর হলো আদিয়াত আর কণা বিদেশে আছে। তাদের একটা ছেলেও আছে। আজকে কণা আর আদিয়াত দেশে ফিরবে। আদিয়াতের বাবা-মা আর তিশান আহম্মেদ এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছেন কণা, আদিয়াত আর উনাদের নাতির জন্য।

____________

হসপিটাল থেকে বের হয় বন্য আর নোমান। বন্যা ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বন্যা দ্বিতীয় বারের মতো মা হতে যাচ্ছে। তাদের আগেরও একটা মেয়ে আছে। স্বাভাবিক তুলনায় বন্যার পেট একটু বেশি উচু হওয়ায় চলতে ফিরতে একটু কষ্ট হয়। চেকআপ করার জন্যই নোমান বন্যাকে নিয়ে হসপিটালে এসেছিল। নোমান এক হাতে বন্যাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আরেক হাতে রিপোর্ট। বন্যা পেটের ওপর এক হাত রেখে খিলখিলিয়ে হাসছে।

নোমান বন্যাকে গাড়িতে বসাতে গিয়েও কারো ডাক শুনে থেমে যায়। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়। তাদের থেকে একটু দুরেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন মানুষ। মানুষ দুজন একটু বেশিই দূরে দাঁড়িয়ে থাকায় বন্যা বা নোমান কেউই চিনতে পারছে না। দুজন মানুষের মাঝে একজন পুরুষ আরেকজন মহিলা। দুজন এসে বন্যা আর নোমানের সামনে দাঁড়ায়।

দুজনেরই চিনতে বেগ পেতে হলে যে দুজন আনজুম বেগম আর তার স্বামী। আগের সেই রূপ নেই। পোশাকেও আভিজাত্য নেই। দুজনেই চেহেরায় মলিন আর ক্ষীণ। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। পোশাক-আশাক পুরোনো। রুক্ষ এলোমেলো চুল। বন্যার বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে যে এটা আনজুম বেগম। আনজুম বেগমের কী অবস্থা? কোথায় সেই অহংকারী, দাম্ভিক অনজুম বেগম।

আনজুম বেগম তার রুগ্ন হাতটা বন্যার দিকে বাড়িয়ে দিতেই নোমান বন্যাকে নিয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। আনজুম বেগম নিজের মুখটা মলিন করে হাতটা নামিয়ে ফেলে। তারপর বন্যার পায়ের কাছে বসে পড়ে। বন্যা শুধু হাসফাস করছে। তার অস্বস্তি হচ্ছে। আনজুম বেগম কেঁদে ওঠে। কান্না মিশ্রিত গলায় বলে,

মারে আমাকে ক্ষমা করে দে। তোর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। সেই অন্যায়ের শাস্তি আমি হারে হারে পাচ্ছি। তুই আমাকে ক্ষমা না করলে যে আমি মরেও শান্তি পাব না।

প্লিজ আপনি ওঠুন। আমার অস্বস্তি হচ্ছে। আপনি আমার থেকে বয়সে বড়। আপনি এভাবে পায়ের কাছে বসে থাকলে বিষয়টা ভালো দেখায় না

বন্যার অনেক বলার পরে আনজুম বেগম কণার পায়ের কাছ থেকে ওঠে দাঁড়ায়। বন্যা ফুঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে।

আপনি হঠাৎ করে আমার কাছে ক্ষমা কেনো চাইছেন? আমার মতো একটা মেয়ের কাছে কী আপনার ক্ষমা চাওয়া সাজে? আপনাদের এই অবস্থা কেনো? সেই অহংকারী, দাম্ভিক আনজুম বেগম আজ কোথায় হারিয়ে গেলো?

মারে এমন করে বলিস না। আমি তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি তা আজকে আমি বুঝতে পারছি। আমার ছেলে মেয়ে আমার সব অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে। আমার মেয়েটা নোমানকে ভালোবাসতো। আমি ওর সেই ভালোবাসাকে পাত্তা না দিয়ে টাকার লোভে নোমানের কাছে তোকে বিক্রি করে দেই। আমার মেয়েটা যে রাগ করে বিদেশ গিয়েছিল আর এই দেশে ফিরে আসেনি। এমনকি আমাদের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দেয়, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। আসিফ আর নিতুর বিয়ের পর ওরা আমাদের বাসা থেকে বের করে দেয়। মারে আমাদের ক্ষমা করে দে। আমরা এখন একটা বৃদ্ধা আশ্রমে থাকি। আমাদের তোর বাড়িতে একটু জায়গা দিবি।

আপনাদের প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আপনারা আমার খারাপ করতে গিয়েও ভালো করে দিয়েছিলেন। আপনাদের জন্যই আমি নোমানের মতো একটা স্বামি পেয়েছি। এর জন্য আমি আপনাদের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু আপনাদের আমার সাথে নিয়ে যেতে পারবো না।

কথাটা বলেই বন্যা গাড়িতে ঔঠে বসে। বন্যার পিছু পিছু নোমানও গাড়িতে ওঠে বসে। নোমান গাড়ি স্টার্ট দিতেই বন্যা চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দেয়।

তুমি তো উনাদের আমাদের সাথে নিয়ে গেলেই পারতে। আমাদের বাসাটা যথেষ্ট বড়। উনারা থাকতেই পারতেন।

বন্যা এক পলক সাফাতের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।

জেনে বুঝে কেউ দুধ কলা দিয়ে কাল সাপ পোষে না। উনারা হচ্ছেন কাল সাপ। যারা কারো ভালো চায় না। টাকার লোভে উনারা ছেলের বউ আর নাতিকে মারতে দ্বিধা বোধ করে না। তাদের বিশ্বাস করা যায় না। তারা যে আমাকে মারার চেষ্টা করবে না। তার কী গ্যারান্টি আছে?

মানে?

আসিফ আর নিতু উনাদের এমনি এমনি বাসা থেকে বের করে দেয়নি। আসিফকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য উনারা নিতুকে তাড়ানোর অনেক চেষ্টা করেন।তাড়াতে না পেরে মারার চেষ্টা করেন। তখন নিতু দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। আসিফকে আবার বিয়ে করানোর কারণ ছিল ঐ মেয়ের বাপ অনেক টাকা অফার করেছিল। তারা নিতুকে মারতে সফল হয়নি। কিন্তু আসিফ সব জেনে যায় আর বাসা থেকে বের করে দেয়।

নোমান আর কিছু না বলে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে।

৮৫

আভিয়ান ঐশি মাথার পিছনে বসে চুলের বেনি করে দিচ্ছে। হঠাৎই ঐশি প্রশ্ন করে ওঠে,

এতো বছরে তোমার ভালোবাসা একটুও বদলাইনি কেনো? সবাই তো বলে সময়ের সময়ের সাথে সাথে নাকি ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। কিন্তু তোমার ভালোবাসা দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না।

তুমি আমার ভালোবাসা মোহ না যে, সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যাবে।

__________________

অহি বেড শিটটা ঠিক করে পিছনে ঘুরতেই সাফাতের বুকের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নিলেই সাফাত অহির কোমড় জড়িয়ে ধরে।

আরে কী করছো?

আদর করছি। সারাদিন শুধু মেয়েকে সময় দিলে মেয়ের বাপকে সময় দিবে কে? মেয়ের বাপের দিকেও একটুও তাকাও। তোমাকে কাছে না পাওয়ায় যে মেয়ের বাপ দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে।

সাফাতের রোমান্টিক মুডের বারটা বাজিয়ে দৌড়ে আসে তাদের মেয়ে সাবা। সাবাকে দেখেই দুজন দুজনের কাছ থেকে ছিটকে সরে যায়। সাবা এসে তার মাকে রেজাল্ট দেখাতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সাফাত অসহায় মুখে অহির দিকে তাকিয়ে আছে আর অহি মুখ টিপে হাসছে।

৮৬

আদিয়াতের কাধে মাথা রেখে ছাদে বসে আছে কণা। আনুমানিক এখন রাত বারটা বাজে। আজকে আকাশে রুটির মতো গোলাকার চাঁদ ওঠেছে। সেই চাঁদের আলো এসে পড়ছে আদিয়াতের প্রেয়সীর মুখশ্রীতে ।আদিয়াতের অনিমেষ তাকিয়ে আছে কণার দিকে।

কতোগুলো বছর কেটে গেলো আমাদের একসাথে পথচলার।

হুম।

সময় বদলেছে বদলেছে মানুষ। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বদলায়নি।

হুম।

কণার এবার সন্দেহ হলো আদিয়াত তার কথা শুনছে কী না। যা বলছে তাতেই শুধু হুম বলছে। কণা পরীক্ষা করার জন্য বলে,

আপনার বাবার নাম কী?

হুম।

আপনার মায়ের নাম কী?

হুম।

কণার এবার রাগ হলো। আদিয়াতকে একটা জুড়ে ধাক্কা দেয়। এবার আদিয়াতের হুশ আসে।

আপনার মন কোথায় থাকে? হ্যাঁ? আমি কখন থেকে কথা বলছি আপনি কিছুই শুনছেন নাহ।

আমার মন, প্রাণ ধ্যান, ঙ্গান সবই তো তোমাতে আবদ্ধ। এমন এক প্রেয়সী থাকতে কী মন অন্য কোথাও যেতে পারে।

কণার মুখে রাগের আভা সরে গিয়ে লজ্জার আভা দেখা দেয়।

কোনোদিন হয়তো তোমাকে সেভাবে ভালোবাসার কথাটা বলা হয়নি তবে আজ বলছি।

“তোমাকে মন থেকে আমি কতটা ভালোবাসি এটা প্রকাশ করার জন্য ভালোবাসি এই শব্দটা অনেক ছোট হয়ে যায়। তোমাকে আমি যে পাগলের মতো ভালোবাসি এটা বুঝানোর জন্য আমার এক জীবন খুব ছোট হয়ে যায়”।

কণা আদিয়াতের বুকে মুখ লুকায়। আদিয়াত পরম আবেশে নিজের প্রেয়সীকে জড়িয়ে ধরে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here