“মেয়েটার সাথে আমার শারীরিক সম্পর্ক ছিল।”
বেশ সহজভাবেই কথাটা বললো মৃন্ময়। এরপর বেশকিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা চললো। নিরবতা কাটিয়ে তুললো মৃন্ময়। বললো,
“চুপ করে আছেন যে?”
প্রিয়া এতক্ষণ অন্যদিকে মুখ করে বসে ছিল। এবার মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি বলবো?”
“আপনার অদ্ভুত লাগছে না?”
“বুঝতে পারছি না।”
“দেখেন, আমি জানি আপনার খারাপ লাগছে। খারাপ লাগাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। কয়েকদিন পরই আপনার আমার বিয়ে। সেখানে আপনি এখন শুনতেছেন হবু বরের অন্য কোনো মেয়েটার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল। আমি চাইলে হয়তো লুকাতে পারতাম। কিন্তু লুকাইনি কারণ আমি চাইনি আপনায় মিথ্যা বলে ঠকাতে।”
প্রিয়া বেশকিছুক্ষণ চুপ করে ভাবতে লাগলো,
“আসলেই তো! কিন্তু আমার খারাপ লাগছেনা কেন? আবার ভালোও লাগছেনা। অন্য কোনো সময় হলে হয়তো দেখা যেতো আমি মৃন্ময়কে ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে দিতাম। কিন্তু এখন আমার কোনো অনুভূতিই হচ্ছেনা। আমার কি বলা উচিত আমি সেটাও বুঝতে পারছিনা।”
মৃন্ময় বললো,
“অনেক ভালোবাসতাম মেয়েটাকে। ওর নাম ছিল রিমি। আমার এক ইয়ার জুনিয়র ছিল। কোনো এক বৃষ্টির সময়ে দেখে ভালো লেগে যায়। এরপর প্রণয়, তারপর ভালোবাসা। এরপর একসময় ফিজিক্যালি জড়িয়ে যাই দুজনে। আমি ওকে কোনো জোর করিনি। দুজনের ইচ্ছেতেই হয়েছিল।”
মৃন্ময়ের কথাগুলো শুনে বেশ অসস্তি হচ্ছিলো প্রিয়ার। তাই প্রসঙ্গটা পাল্টে বললো,
“আমার খুব খারাপ লাগছে। আপনার আর কিছু বলার না থাকলে আমি বাড়িতে যেতাম।”
“খুব বেশি খারাপ লাগছে?”
“ঐ একটু আরকি!”
“চলুন, আমি আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।”
“ধন্যবাদ। আমি একাই যেতে পারবো।”
“বেশ! তবে আমার বলা কথাগুলোর উত্তর আমি এখনই চাচ্ছি না। আপনি আগে সময় নিয়ে ভাবুন তারপর উত্তর দিন। যদি সবকিছু জেনেও মনে হয়, বিয়ে করার জন্য আমি আপনার জন্য পার্ফেক্ট তাহলে বিয়েটা হবে। আর যদি মেনে নিতে না পারেন তাহলে জোর করে বিয়ে করবো না।”
প্রিয়া কিছু বললো না। উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। বেশ অসস্তি লাগছে। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছেনা।
মৃন্ময় বড়লোক বাবার ছেলে। বাড়িতে বাবা-মা, আর মৃন্ময় থাকে। বড় ২ বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। বড় দুই বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রিয়া মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বাড়িতে মা,২ ভাই-ভাবী আর প্রিয়া থাকে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। প্রিয়া সবার ছোট্ট। মৃন্ময়ের বাবার বড় বিজনেস আছে সেটারই দেখাশুনা করে মৃন্ময়। আর প্রিয়া অনার্স ১ম বর্ষে পড়ে+একটা স্কুলে জব করে।
.
বাসায় যেতেই মায়ের সাথে দেখা হয় প্রিয়ার। তিনি প্রিয়ার গালে হাত রেখে চুমু দিয়ে বললো,
“কেমন দেখলি ছেলেটাকে?”
“হুম ভালো।”
“পছন্দ হয়েছে তোর?”
“তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।”
প্রিয়া রুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। হাজার চেষ্টা করেও ঘুম আসছেনা। ঘুমও এখন স্বার্থপর হয়ে গিয়েছে। যে ঘুম আগে প্রিয়ার পিছুই ছাড়তো না সেই ঘুম এখন প্রিয়াকে ধরাই দেয়না। সবই সময়ের বিবর্তন। প্রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এরপর উঠে টেবিল থেকে হুমায়ুন আহমেদের “আজ হিমুর বিয়ে” বইটা নিলো। বেশ কয়েকবার পড়ার পরও ইন্টারেস্ট কমেনা। হিমুর চরিত্রটা এখানে সত্যিই মুগ্ধকর। বই পড়তে পড়তে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে খেয়ালই করেনি। মাগরিবের আজান শেষ হতেই প্রিয়া ওযু করে নামাজ পড়ে নেয়। এরপর আবার বিছানায় গিয়ে পা গুটিয়ে বসে থাকে। মনটা আনচান করছে। কেন করছে এমন বোধগম্য হয়না প্রিয়ার। ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভাঙ্গে । নাম্বারটা সেভ করা নয় কিন্তু পরিচিত। মৃন্ময়ের নাম্বার। কলটা কেটে যায়। দ্বিতীয়বার রিং হতে প্রিয়া রিসিভড করে সালাম দেয়।
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ্। আপনি?”
‘আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। কি করছেন?”
“বসে আছি। আপনি?”
“এইতো ব্যালকোনিতে।”
“ওহহ।”
“হুম।”
এরপর আবারও নিরবতা। মৃন্ময় কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“আপনি কি এরকমই?”
“কিরকম?”
“কেমন যেন চুপচাপ।”
“কিজানি।”
“আপনি জানেন না?”
“না।”
“নিজে কেমন সেটা নিজেই জানেন না?”
“না।”
“অদ্ভুত তো।”
“হয়তো। নিজেকে এতদিন ভুল জানতাম আর ভুল চিনতাম। তাই এখন সঠিক কোনটা জানিনা।”
“ঠিক বুঝলাম না।”
“কিছুনা।”
“উমম ওকে! আচ্ছা কিছু ভাবলেন?”
“কোন বিষয়ে?”
“আজকে বিকালে বলা কথাগুলোর ব্যাপারে।”
“ভাবার কিছু নেই।”
“কেন?”
“সবকিছুরই কি প্রশ্ন হয়?”
“তা নয়। তবুও এত বড় একটা বিষয়ে আপনার ভাবা উচিত।”
“ভাবিনি।”
“তাহলে আমি উত্তরটা কি ধরে নিবো?”
“হ্যাঁ।”
“কি হ্যাঁ?”
“উত্তরটা হ্যাঁ।”
“তাহলে আমার অতীত নিয়ে আপনার কোনো সমস্যা নেই?”
“না। মা বলে, প্রতিটা মানুষের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু অতীত আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা নেহাৎই বোকামি।”
“হুম আপনার মা ঠিকই বলে। ইভেন, আমি মনে করি সন্তানদের মঙ্গলের জন্য প্রতিটা বাবা-মায়ের উপদেশই সঠিক।”
“জ্বী।”
“তো বিয়েটা কি বাবা-মায়ের ইচ্ছেতেই করতেছেন?”
“জ্বী।”
“আমায় আপনার ভালো লেগেছে?”
“আপনাকে আমার পরিবারের পছন্দ হয়েছে।”
“সংসার তো আপনি করবেন। আপনার কোনো মতামত নেই?”
“আমার মনে হয়, আমি নিজে থেকে সবসময়ই ভুল সিদ্ধান্ত নিই।”
“এমন মনে হওয়ার কারণ?”
“আমার অতীত।”
“আপনারও অতীত আছে?”
“প্রতিটা মানুষেরই অতীত থাকে।”
“আপনারটা কি জানতে পারি?”
“পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তুলতে ইচ্ছে করছেনা।”
“ঠিক আছে।”
কথা বলা শেষ করে প্রিয়া মায়ের রুমে গেলো। মা তখন বিছানা ঝাড়ছিল। প্রিয়াকে দেখে বললো,
“কিছু বলবি?”
“আমার কষ্ট হচ্ছে মা।”
মা তাড়াডাড়ি প্রিয়াকে নিজের কাছে এনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। প্রিয়া কান্না করেই বললো,
“এভাবে জড়িয়ে ধরো না মা। আমার আরো কষ্ট হয়।”
“তোকে না কতবার বলেছি অতীত নিয়ে ভাববি না?”
“আমি কি করবো মা? অতীত যে আমার পিছু ছাড়ছে না।”
“অতীত ভুলে যা মা। সবাই অন্যায়ের শাস্তি পায়।”
প্রিয়া কিছু বলছেনা। কেঁদেই যাচ্ছে। প্রিয়াকে বিছানার ওপর বসিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মা চোখ মুছিয়ে দিলো। বললো,
“মৃন্ময় ছেলেটা অনেক ভালো। কত ভালো পরিবারের ছেলে দেখেছিস। অনেক সুখে থাকবি তুই। এমন পরিবার আর ছেলে সচারচর পাওয়া যায় না।”
“হুম।”
“আমি আমার আগের সেই হাসিখুশি প্রিয়াকে ফিরে পেতে চাই। যার হাসিতে এই বাড়ির প্রতিটা লোক হাসে। যার দুষ্টুমিতে এই বাড়ি মেতে থাকে।”
প্রিয়া আবারও চুপ। মা বললো,
“মৃন্ময়ের সাথে কথা হয়েছিল আর?”
“হ্যাঁ। একটু আগে ফোন দিয়েছিল।”
“কি বললো?”
প্রিয়া সব কথাই মাকে বললো। শুধু ফিজিক্যাল রিলেশনের কথা স্কপি করে। মা বললো,
“কোনো মানুষই পার্ফেক্ট হয়না। তাকে মনের মত বানিয়ে নিতে হয়। আর আমি জানি, আমার মিষ্টি মেয়েটা সেটা পারবে।”
প্রিয়া মাকে জড়িয়ে ধরলো। পৃথিবীর অর্ধেক শান্তি তো মায়ের বুকেই।
.
রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। একাই ছাদে হাঁটছে মৃন্ময়। আকাশে আজ চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তবে অসংখ্য তারা মিটমিট করে জ্বলছে। ছাদের রেলিংয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় মৃন্ময়। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে প্রিয়ার কথা। আর আনমনেই বলে,
“মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? হাসেনা, প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেনা। কিন্তু তবুও এই মেয়েটার মধ্যে কি যেন একটা আছে। যেটা আমাকে বারবার ওর প্রতি টানে। মাত্র অল্প কিছুদিনের পরিচয়েও কি কাউকে এত ভালো লাগতে পারে? আচ্ছা প্রিয়াকে কি শুধুই আমার ভালো লাগে? নাকি ভালোবাসাটাও সৃষ্টি হচ্ছে? তাহলে রিমি? রিমিকে কি আমি ভালোবাসিনা? না, না রিমিকে আমি সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। বরং রিমিই আমাকে ঠকিয়েছে।”
মৃন্ময় ছাদে পায়চারি করতে লাগলো। একসময় থমকে গিয়ে ভাবতে লাগলো,
“প্রিয়া তখন কি একটা অতীতের কথা বলেছিল। আচ্ছা ওর আবার কি অতীত আছে? ওরও কি আমার মত ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল? ছিঃ না কি ভাবছি। আচ্ছা যদি থেকে থাকে?”
হাজারটা প্রশ্ন মৃন্ময়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে। আবার পরক্ষণেই মনে হলো সামনাসামনি জিজ্ঞেস করবে। অবাধ্য মনটা তবুও কি যেন চাচ্ছে। মৃন্ময় নিজের গালে এক আঙ্গুল দিয়ে টোকা দিয়ে ভাবতে লাগলো,
“উমম! প্রিয়ার ভয়েসটা শুনতে ইচ্ছে করছে।”
উনিশ-বিশ না ভেবে ফোন দিয়ে দিলো। প্রিয়া তখন ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরে এসে বিছানার ওপর থেকে ফোন নিয়ে দেখে মৃন্ময় ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করে সালাম দেওয়ার আগেই মৃন্ময় তড়িঘড়ি করে বললো,
“স্যরি স্যরি এত রাতে কল করার জন্য। কিন্তু কি করবো বলুন? হাজার চেয়েও নিজের মনটাকে বোঝাতে পারছিলাম না। মনটা বারবার বলতেছিল, প্রিয়াকে ফোন দে তাড়াতাড়ি ফোন দে। এক্ষুণী ফোন দে। তাই আমিও আর মনের কথা না শুনে পারলাম না।”
মৃন্ময়ের কথা শুনে প্রিয়া একটু হাসলো। মৃন্ময় বললো,
“আপনি হেসেছেন?”
“হু।”
“সত্যিই হেসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা আপনি হাসতে পারেন।”
“কি জন্য এত রাতে কল করলেন?”
প্রশ্নটা ইগনোর করায় মৃন্ময় একটু কষ্ট পেলো। নিজেকে সংযত করে বললো,
“ঘুমাচ্ছিলেন?”
“না।”
“তাহলে কি বিরক্ত করলাম?”
“জ্বী না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আমি ভাবলাম, কিছু বলার জন্য হয়তো ফোন দিয়েছেন।”
“কতকিছুই তো বলতে চাই। শুধু অধিকারটা নেই।”
“কিছু বলার জন্য অধিকারও লাগে?”
“হুম লাগে তো। এত রাতে কল করেছি সেটাই তো অধিকারের বাহিরে হয়ে গিয়েছে। সব দোষ এই বেহায়া মনটার। আপনার কণ্ঠ শোনার জন্য আকু্ল হয়ে গিয়েছিল।
তখন প্রিয়া দুম করে একটা প্রশ্ন করে বসলো,
“আমি আপনার কে?
মৃন্ময় ওপাশ থেকে কিছু বলতে যাবে তখনই প্রিয়ার ফোন সুইচড অফ হয়ে যায়। এটা অস্বাভাবিক নয়। প্রিয়ার ফোন খুব একটা প্রয়োজন হয়না এখন তাই চার্জও দেওয়া হয়না বেশ কয়দিন। ফোন চার্জে দিয়ে প্রিয়া শুয়ে পড়ে। ঐদিকে মৃন্ময় ফোনে ট্রাই করেই যাচ্ছে কিন্তু প্রতিবারই অসহ্যকর একটা কথা মহিলা কন্ঠে শুনতে হচ্ছে, “আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।” হুট করেই মৃন্ময়ের প্রশ্নের কথা মনে পড়ে। আর রিপিট করে বলে,
“আমি আপনার কে!!”
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
সকাল সকাল প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে স্কুলে চলে যায়। দুইটা ক্লাস নিয়ে বের হতেই মৃন্ময় ফোন দেয়।
“হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন প্রিয়া?”
“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। আপনি?”
“আমি ভালো নেই।”
“কেন?”
“মনটা চুরি হয়ে গিয়েছে।”
“ওহহ।”
“ওহহ মানে কি?”
“এটার কোনো মানে নেই তো।”
“তাই বলে একবার জিজ্ঞেস করবেন না কে চুরি করলো?”
“জিজ্ঞেস করলে কি মন ফেরত পাবেন?”
“আমি তো মন ফেরত পেতে চাইনা। আমি তো তাকে চাই।”
“আচ্ছা।”
“কি আচ্ছা?”
“আপনি যা বললেন তা আচ্ছা।”
“উফফ! বাবা এমন অনুভূতিহীন কেন আপনি?”
“জানিনা তো।”
“কোথায় আপনি?”
“স্কুলে।”
“দেখা করতে পারবেন বিকালে?”
“চেষ্টা করবো।”
“চেষ্টা নয়। দেখা করতে হবে প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি এখন।”
প্রিয়া কলটা কেটে দেয়। মৃন্ময় ফোন হাতে নিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ওগো প্রেয়সী প্রিয়া তোমায় তো আমার করবোই।”
.
.
বিকালের দিকে প্রিয়া মৃন্ময়ের সাথে দেখা করে। প্রাইভেট কারের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রিয়াকে দেখেই এগিয়ে আসলো। এক পলক তাকিয়ে বললো,
“আপনি কি স্কুল থেকে সোজা এখানে এসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“এজন্যই তো এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
“হুম। গরম লাগছে খুব।”
“গাড়িতে বসো। এসি অন করে দেই।”
“না।”
“কেন?”
“দম বন্ধ হয়ে আসে আমার।”
“মানে কি?”
“কঠিন কিছু বললাম নাকি? আমার প্রকৃতির বাতাসই ভালো লাগে।”
“আপনি এত সাধাসিধা?”
“তাই মনে হলো?”
“দেখে এবং কথা বলে এটাই মনে হচ্ছে।”
“হবে হয়তো।”
“আপনি কি আগে থেকেই এমন?”
“না।”
“তবে?”
“ঐযে আমার অতীত।”
“সেটা কি আমি জানতে পারিনা?”
“পারেন।”
“তাহলে বলেন।”
“ইচ্ছে করছেনা এখন।”
“অদ্ভুত তো।”
“আমার খুব টায়ার্ড লাগছে। আমি বাসায় যাই এবার?”
মৃন্ময় হতাশ চোখে তাকায় প্রিয়ার দিকে। তারপর ভাবলেশহীনভাবে বলে,
“হুম।”
প্রিয়া আর অপেক্ষা করেনা। হাঁটা শুরু করে। মৃন্ময় তাকিয়ে আছে সেদিকে। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এই মেয়ের মন জয় করবো কিভাবে!”
বন্ধুদের আড্ডামহলে সবাই হাসিখুশি থাকলেও মৃন্ময় একদম মনমরা হয়ে বসে আছে। মৃন্ময়ের বন্ধু সাদিক ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কিরে শালা বসে বসে শোক দিবস পালন করছিস নাকি?”
“সেরকমই।”
“বলিস কি রে? এতদিন পর সবাই একসাথে হলাম আর তুই শোক পালন করছিস?”
“তাছাড়া আর কি করবো বল? যার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার মন জয় করতে পারছিনা।”
“কি বলছিস মৃন্ময়? তোকে তোর হবু বউ পাত্তা দিচ্ছে না?”
“না। বিষয়টা সেরকম নয়। মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলেনা।”
“মেয়ে কি খুব সুন্দরী?”
“খুব সুন্দর নাকি জানিনা তবে মায়াবিনী।”
“কই ছবি দেখা তো।”
মৃন্ময় পকেট থেকে ফোন বের করে প্রিয়ার ছবি বের করে দেখায়। সাদিক বেশ ভালো করে দেখে বললো,
“এই মেয়ে চুপচাপ হয় কিভাবে? ছবিটা ভালোমত দেখেছিস? চোখে-মুখে হাসির, দুষ্টুমির ঝিলিক স্পষ্ট।”
“ছবির সাথে বাস্তবে ওর কোনো মিলই খুঁজে পাইনা। হাসেনা একটুও।”
“এমন কেন জিজ্ঞেস করিসনি?”
“করেছি তো।কেমন যেন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে।”
“তোর কি মনে হয়? এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে।”
“বলে তো কিসের নাকি অতীত আছে। কিন্তু কি সেটা তা বলেনা।”
এবার মেয়ে বান্ধবীরা মুখ খুললো। বললো,
“দোস্ত একটা আইডিয়া আছে।”
“কি?”
“মেয়েরা সবসময় গিফ্ট পেতে পছন্দ করে। গিফ্ট বলতে সারপ্রাইজ আরকি!”
“তো?”
“তুইও ওকে সারপ্রাইজ দে।”
“কি সারপ্রাইজ দিবো?”
সুবাহ্ বললো,
“গাধা একটা! কি সারপ্রাইজ দিবি সেটাও আমরা বলে দিবো?”
“মেয়েদের ব্যাপারে আমি আনাড়ি।”
“ইশ! রিমিকে মনে হয় কখনো গিফ্ট দেসনি।”
“দিয়েছি। তবে রিমি যেটা চেয়েছে সেটাই দিয়েছি।”
“বুঝলাম। তুই ওকে শাড়ি, চুড়ি এসব গিফ্ট করতে পারিস।”
“পড়বে বলে মনে হয়না।”
“আরে দিয়ে তো দেখ।”
“ঠিক আছে। চল তাহলে শপিংমলে যাই।”
মৃন্ময় বন্ধুদের নিয়ে শপিংমলে যায়। পছন্দমত ৩টা শাড়ি কিনে। তার সাথে ম্যাচিং চুড়ি। তবে সেগুলো সরাসরি দেয়নি। পার্সেল করে পাঠিয়েছে। একদিন পরই প্রিয়ার বাসায় পার্সেল পৌঁছে যায়। পার্সেল পেয়ে বেশ অবাক হয় প্রিয়া। নামহীন গিফ্ট আবার কি করে হয়! কার গিফ্ট কার কাছে এসেছে। প্যাকেট খুলে প্রিয়া ‘থ’ মেরে বসে থাকে। শাড়ি, চুড়ি এসব কার! সাথে একটা চিরকুট। তাতে লেখা,
“ওগো প্রেয়সী সামান্য গিফ্ট তোমার জন্য।”
শাড়িগুলো নেড়েচেড়ে প্রিয়া রেখে দেয়। ঐদিকে মৃন্ময় অধিক আগ্রহে বসে আছে কখন প্রিয়া ফোন দিবে। মৃন্ময় বসে বসে ভাবছে,
“এতক্ষণে প্রিয়া নিশ্চয়ই বুঝে গেছে গিফ্টগুলো আমি পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনো ফোন করছেনা কেন? মেয়েটা এমন কেন? এত অবুঝ! আমি যে কখন থেকে ফোনের অপেক্ষা করছি সেটা কি বুঝেনা ও।”
এভাবে তিন ঘন্টা পাড় হয়ে যাওয়ার পরও যখন প্রিয়ার ফোন আসেনা তখন বাধ্য হয়ে মৃন্ময়ই ফোন দেয়।
“হ্যালো।”
“কি করছেন প্রিয়া?”
“এইতো বসে আছি। আপনি?”
“আমিও।”
মৃন্ময় একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আজকে কি মন খুব খুশি নাকি হুম?”
“না তো! কেন?”
“না। মনে হলো।”
“ওহহ।”
“আচ্ছা আপনার প্রিয় রং কি?”
“নাই।”
“মানে?”
“মানে সব রংই ভালো লাগে।”
“আপনার কোন জামা ভালো লাগে? মানে শাড়ি, থ্রি পিছ?”
“এসব প্রশ্ন কেন করছেন?”
“করতে পারিনা?”
“কারণ?”
“তেমন কিছুই না।”
“জানেন, আজ না একটা পার্সেল এসেছে।”
এবার মৃন্ময়ের মনে লাড্ডু ফুটলো। মনে মনে একবার লুঙ্গি ডান্সও দিয়ে ফেললো। এরপর খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
“ওহ তাই? পার্সেলে কি ছিল?”
“শাড়ি আর চুড়ি।”
“কে পাঠিয়েছে?”
“কি জানি কোন পাগলে পাঠিয়েছে।”
এবার মৃন্ময়ের হাসিমাখা মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। শেষমেশ কি না পাগল উপাধি নিতে হলো! মৃন্ময় কিছু বললো না। চুপ করে রইলো। প্রিয়া বললো,
“আপনি আছেন?”
“না, আমি গেছি।”
“মানে?”
“মানে মানে আমি ছাদে গেছি।”
“ওহহ।”
“আচ্ছা আমি একটু পর ফোন দেই কেমন?”
“আচ্ছা।”
মৃন্ময় ফোন রেখেই চেঁচিয়ে বললো,
“সুবাহর বাচ্চা!”
সাথে সাথে মৃন্ময় সুবাহকে কল দিলো।
সুবাহ কল রিসিভড করে বললো,
“হ্যালো দোস্ত।”
“রাখ তোর দোস্ত। শাঁকচুন্নি যেন কোথাকার। তোর তিনটা ফুটবল টিম হবে দেখে নিস।”
“আরে! এত রেগে আছিস কেন?”
“রাগবো না তো কি করবো রে? তোকে কোলে নিয়ে ধেই ধেই করে নাচবো?”
“কি হয়েছে বলবি তো?”
“হারামি তোকে আমি কচুরীপানা ভর্তি পুকুরে চুবাবো। ঐরকম বুদ্ধি তোকে কে দিতে বললো রে? জানিস প্রিয়া আমায় কি বলেছে?”
“কি বলেছে?”
“পাগল উপাধি দিয়েছে পাগল।”
সুবাহ্ এবার শব্দ করে হাসতে লাগলো। মৃন্ময় রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
“একেই তো এক আজাইরা বুদ্ধি দিছিস। এখন আবার আমার এই অসময়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসছিস।”
সুবাহ কোনো রকমে হাসি থামিয়ে বললো,
“কি আর করবো বল!”
তোদের আর কিছু বলতে হবেনা।
“রাগ করিসনা। তুই বরং এক কাজ কর। একদিন প্রিয়াকে আমাদের আড্ডায় নিয়ে আয়।”
“কেন? কোন নতুন কেলেঙ্কারি বাঁধাবি শুনি?”
“আরে আগে আনতো।”
পরেরদিন প্রিয়াকে নিয়ে গোল মিটিং বসানো হয়। সবার মধ্যমনি হচ্ছে প্রিয়া। একেকজন একেক কথা বলছে। কেউ গল্প বলছে, কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান গাইছে, কেউ জোক্স শোনাচ্ছে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও আস্তে আস্তে ভালো লাগা কাজ করছিল। কখনো কখনো কারো গল্প শুনে ইন্টারেস্ট বাড়ছিল, কখনো কারো কবিতায় মুগ্ধ হচ্ছিলো, কখনো কারো গানে অনুভূতিরা হাতছানি দিচ্ছিলো আবার কখনো কারো জোক্স শুনে প্রাণ ভরে হাসছিল। আর এই সবকিছুই মনে ভরে দেখছিল মৃন্ময়। মনে মনে হাজারটা ধন্যবাদ দিচ্ছিলো বন্ধুদের। শুধু তাই নয়, বন্ধুদের বড় করে একটা ট্রিটও দিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে প্রায়ই প্রিয়া সবার সাথে আড্ডা দিতো। হাসিখুশিতে মেতে থাকতো। আগের মত স্বাভাবিক হতে লাগলো। আস্তে আস্তে বিয়ের ডেটও এগিয়ে আসলো। না চাইতেও এক ভালোলাগার অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছিলো দুজনের মনেই।
আগামীকাল গায়ে হলুদ। প্রিয়া আজ মৃন্ময়ের দেওয়া একটা শাড়ি পড়েছে।ম্যাচিং করে চুড়ি পড়েছে। আজ মৃন্ময়কে সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু মৃন্ময়ের বাড়িতে গিয়ে প্রিয়া নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে যায়। পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছিলো। বিশ্বাসই হচ্ছিলো না এটা হতে পারে…
চলবে…