তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব ৪+৫

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_৪
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
মা বিছানায় বসে কাঁদছিল। প্রিয়া মায়ের কাছে গিয়ে বললো,
“মা কিছু কথা ছিল।”
প্রিয়াকে দেখে মা তাড়াতাড়ি চোখ মুছে বললো,
“হ্যাঁ বল।”
“মা, আমি আর এখানে থাকতে চাই না। ভাইয়াকে বলো না অন্য কোথাও বাড়ির ব্যবস্থা করতে। চলো না মা, আমরা এখান থেকে একেবারে চলে যাই।”
মা প্রিয়াকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“বলবো মা। আজই তোর ভাইয়াকে বলবো।”

রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে মা দুই ভাইয়াকে বাড়ি ছাড়ার বিষয়ে জানায়। সবাই প্রিয়ার অবস্থা বুঝতে পেরে রাজি হয়ে যায়।
ছাদে বসে বসে গান শুনছিল প্রিয়া। ভাবছিল, জীবন কি অদ্ভুত গতিতে চলে! সুখ ধরা দিয়েও দেয়না ধরা। ছাদে হাঁটতে হাঁটতে রেলিং এর কাছে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ চাঁদ উঠেছে। বড় থালার মত সম্পূর্ণ একটা চাঁদ। প্রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কেমন আছো তুমি আব্বু? তুমি কি আমায় মিস করো না একটুও? জানো আব্বু, আমি সত্যিই অলক্ষী! না হলে কেন বারবার আমার সাথেই এমন হবে বলো তো? আমার অপরাধটা কি? তোমায় খুব মিস করছি আব্বু। একবার তোমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তুমি একটিবার আসবে? ও আব্বু বলো না একটিবার আসবে?”
নিজে নিজে কথা বলতে বলতে একটা সময় ডুকরে কেঁদে উঠে প্রিয়া। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখের পানি মুছে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি? আল্লাহ্ তুমি সব দেখছো তো? অন্যের জন্য কেন নিজে কষ্ট পাচ্ছি আমি? সাথে পরিবারের মানুষগুলোকেও কষ্ট দিচ্ছি। অনেক হয়েছে। আর না। আজ, এখন থেকে নিজের কাছে নিজেই প্রমিস করছি, কারো জন্য আর কষ্ট পাবো না। নিজেকে এভাবে গুটিয়ে রাখবো না। থেমে থাকবো না আমি। সফলতাকে ছিনিয়ে আনবো।”
.
.
এক মাসের মধ্যেই বাড়ি চেঞ্জ করার সব ব্যবস্থা করে ফেলে প্রিয়ার দুই ভাই। আজ ওরা বাড়ি চেঞ্জ করে নতুন বাড়িতে উঠেছে। সম্পূর্ণ নতুন একটি এলাকা। নতুন পরিবেশ, নতুন প্রতিবেশি। মানিয়ে নিতে একটু সমস্যা হলেও কষ্টগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। আগের থেকে অনেকটাই পরিবর্তন করেছে নিজেকে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটা চাকরীর ইন্টার্ভিউও দিয়েছে। শেষে যেই অফিসে ইন্টার্ভিউ দিয়েছে সেই অফিস থেকেই ফোন আসে। ভাগ্য ভালো থাকায় চাকরীটাও হয়ে যায়। প্রিয়ার যে চাকরী করাটা খুব বেশিই দরকার বিষয়টা এমন নয়। নিজেকে ব্যস্ত রাখলে অতীত থেকে অনেকটাই মুক্তি পাওয়া যাবে এটা ভেবেই বাড়ির লোকজন আর বাঁধা দেয়নি। ভার্সিটিতে প্রতিদিন ক্লাসও করা লাগেনা বিধায় কারোরই কোনো সমস্যা নেই।
অফিসে প্রথম জয়েনের দিন প্রিয়া একটা সুতি থ্রি-পিছ পড়ে। অফ-হোয়াইট কালার একটা থ্রি পিছ সাথে ব্লাক কালার হিজাব। ঠোঁটে একদমই হালকা গোলাপি লিপস্টিক দেয়। খাবার খাওয়ার সময় ছোট ভাইয়া বললো,
“কিরে প্রিয়ু তুই লিপস্টিক দিয়ে খাচ্ছিস যে?”
খাবার মুখে নিয়েই প্রিয়া বললো,
“তো কি হয়েছে?”
“পেট খারাপ হলে বুঝবি।”
“লিপস্টিক খেলে পেট খারাপ হয় তুমি কি করে জানলে?”
আমার কথা শুনে ছোট ভাবী বিষম খেলো। ছোট ভাইয়া একটু কেশে বললো,
“জানিনা তো। আন্দাজে বললাম আরকি! জানিসই তো লিপস্টিকে কত কেমিক্যাল থাকে। তাছাড়া লিপস্টিক ঠোঁটে দিয়ে খেয়ে লাভ কি? লিপস্টিক তো উঠেই যাবে।”
“উঠলে উঠুক! আমারটা শেষ হলে ভাবীরটা দিবো।”
খাওয়া শেষে প্রিয়া উঠে দাঁড়ায়। মাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
“মা, আমি আসি কেমন।”
মা প্রিয়ার কপালে চুমু খেয়ে বললো,
“সাবধানে যাবি। মন দিয়ে কাজ করবি।”
ছোট ভাইয়া ডাক দিয়ে বললো,
“এদিকে আয় তো প্রিয়ু।”
“কি হয়েছে?”
“আরে আয় তো।”
প্রিয়া ছোট ভাইয়ার কাছে গিয়ে বললো,
“কি?”
“শার্টের পকেটে কি আছে দেখতো।”
“এটার জন্য তুমি আমায় ডেকে আনলে?”
“দেখছিস তো আমি খাচ্ছি।”
ছোট ভাবী হাসতে হাসতে বললো,
“তোমার ভাইয়ার এই স্বভাব কি আজ নতুন নাকি। অলসের ঢেঁকি একটা।”
প্রিয়া আর কথা না বাড়িয়ে ছোট ভাইয়ার পকেটে হাত দিলো। একটা পাঁচশো টাকার নোট।
টাকাটা ভাইয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“এই ধরো।”
“আমাকে দিচ্ছিস কেন?”
“তো কাকে দিবো?”
“তুই নিবি।”
“আমার লাগবেনা। বড় ভাইয়া অফিসে যাওয়ার আগে পাঁচশো টাকা দিয়ে গেছে।”
“বলিস কিরে! ভাইয়া তোরে টাকা দিলো অথচ আমায় দিলো না। আচ্ছা ওটা আমি পরে বুঝে নিবো। এখন এই টাকাও তুই নিয়ে যা। রাস্তাঘাট বলা তো যায় না কখন কোথায় টাকা লাগে।”
“আমার লাগবেনা ভাইয়া।”
“লাগবেনা মানে কি রে? আর আমি কি তোকে এমনি এমনিই দিচ্ছি নাকি? বেতন পেয়ে এটার ডাবল টাকা মানে সুদসমেত এক হাজার টাকা ফেরত দিবি।”
ছোট ভাইয়ার কথা শুনে প্রিয়া হেসে দিলো। টাকা নিয়ে বললো,
“তোমার সাথে ঝগরা করতে থাকলে আমার অফিস টাইম পাড় হয়ে যাবে। আমি এখন আসি।”
“সাবধানে যাস।”
“আচ্ছা।”
প্রিয়া চলে যাওয়ার পর ছোট ভাবী বললো,
“মা, প্রিয়া কিন্তু আগের থেকে পরিবর্তন হচ্ছে। কি সুন্দর হাসিখুশি থাকে দেখেছেন।”
“হ্যাঁ রে মা। আল্লাহ্ যেন আবারও ওকে আগের মত হাসিখুশি করে দেয়।”

বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দাঁড়াতেই সাথে সাথে একটা বাস আসে। প্রিয়া বাসে উঠে জানালার পাশে একটা সিট দেখে বসে পড়ে। বাসে আরো যাত্রীরা উঠছিলো। হুট করে একটা ছেলে বাসে উঠে ধপাস করে প্রিয়ার পাশের সিটে বসে পড়ে। প্রিয়া একবার তাকিয়ে দেখলো রীতিমত ছেলেটা রাগে কাঁপছে। চোখ দুইটা লাল হয়ে আছে। প্রিয়া আর সেদিকে না তাকিয়ে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালো। বাস অলরেডি ছেড়ে দিয়েছে। পাশে বসা ছেলেটা ফোনে কল আসতেই রাগ ঝাড়া শুরু করে দেয় সে। ঐপাশ থেকে কি বলছে শোনা যাচ্ছেনা। কিন্তু ছেলেটা বলছে,
“এখন আমি গাড়ি দিয়ে কি করবো? এতক্ষণে গাড়ি পাঠানোর সময় হলো তোমাদের? এদিকে যে, আমার মিটিং এর সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে সেটা কি তোমাদের মাথায় নেই। ননসেন্স একেকটা। সব কয়টাকে যদি কঠিন শাস্তি না দেই তো আমার নামও ফাহাদ নয় বলে দিলাম।”
এতটুকু বলেই তিনি ফোন কেটে দিলেন।
এরপর সব চুপচাপ। হেল্পার ভাড়া নিতে আসার সময় প্রিয়াকে উল্লেখ করে বললো,
“আপা ভাড়াটা দেন।”
প্রিয়া ভাড়া মিটিয়ে দিলো। ফাহাদ নামক ছেলেটা হেল্পারের দিকে পাঁচশো টাকার নোট’টা এগিয়ে দিলো। হেল্পার বললো,
“ভাইজান পাঁচশো টাকা তো ভাংতি নাই।”
ফাহাদ রাগে গজগজ করতে করতে বললো,
“ভাংতি নেই কেন? কেন নেই? ভাংতি কেন রাখেন না আপনারা?”
হুটহাট এমন আচরণে হেল্পারসহ বাসের অনেকেই বেশ অবাক হয়। বিষয়টাকে থামাতে প্রিয়া তার ভাড়াটা দিয়ে হেল্পারকে বললো,
“আপনি যান।”
হেল্পার চলে যাওয়ার পর ফাহাদ প্রিয়ার দিকে ঘুরে বললো,
“আপনি কে?”
“স্যরি?”
“কে আপনি?”
“আমি প্রিয়া।”
“আপনার নাম জানতে চাইনি আমি। আমি জানতে চেয়েছি আপনি আমার কে?”
“কিছুইনা।”
“তাহলে আপনি কেন দিবেন আমার ভাড়া?”
“আশ্চর্য লোক তো আপনি! কারো উপকার করলেও দোষ।”
“কে বলেছে আপনাকে আমার উপকার করতে? ১০ টাকার ভাড়া দিয়ে আমায় উদ্ধার করেছেন।”সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।
“পায়ে পা দিয়ে এমন ঝগরা করছেন কেন?”
“কি মিথ্যুক মহিলা। পায়ে পা দিলাম কখন?”
“ঐটা কথার কথা ছিল। আর কালো সানগ্লাসটা চোখ থেকে খুলেন তো। একটা ছোট বাচ্চা মেয়েকে বলে মহিলা। বলি, চোখে কি ছানি পড়েছে?”
“কিহ্? এত্ত বড় কথা? আমার চোখে ছানি? আমি কি আপনার মত কানি?”
প্রিয়া কিছু বলতে যাবে তখনই হেল্পার বললো,
“আপা নামেন। আইসা পড়ছেন।”
প্রিয়া রাগে দাঁত কটমট করতে করতে বাস থেকে নেমে পড়লো। প্রিয়ার সাথে সাথে ফাহাদও নেমে পড়লো। কিছুদূর যেতেই প্রিয়া পেছন ঘুরে দাঁড়ালো। এক হাত কোমড়ে গুঁজে বললো,
“সমস্যা কি? পেছন পেছন আসছেন কেন? ঝগরা করে স্বাদ মিটেনি?”
“ঐ হ্যালো, আমি! আমি আপনার পিছন পিছন আসছি? এই ফাহাদ? আয়মান চৌধুরী ফাহাদ কারো পিছন পিছন যায় না ওকে?”
প্রিয়ার মেজাজ চরমে উঠে গেলো। এদিকে বেশিকিছু বলতে গেলে অফিসে লেট হয়ে যাবে। আর প্রথমদিনই লেট হলে দেখা যাবে কর্পূরের মত চাকরীটাও উধাও হয়ে যাবে। তাই আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো আর মনে মনে বললো,
“কোথা থেকে যে এই পাগলের উদয় হলো আল্লাহ্! এত ঝগরুটে হয় ছেলেরা।”
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_৫
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
অফিসের গেটের কাছে আসতেই একটা পিচ্চি মেয়ে প্রিয়ার ওড়না টেনে ধরলো। প্রিয়া চমকে গেলো। বললো,
“আরে কি করছো? ওড়না ছাড়ো।”
মেয়েটা কিছু বললো না। প্রিয়ার হাত ধরে টানতে লাগলো। প্রিয়া বিরক্ত হয়ে বললো,
“একটার পর একটা ঝামেলা তো দেখি লেগেই আছে।”
টানতে টানতে একটা দোকানের সামনে নিয়ে গেলো এবং খাবার দেখাতে লাগলো। এবার প্রিয়া ভালো করে তাকালো মেয়েটার দিকে। পড়নে একটা পুরাতন ফ্রক। তাও হাতার এক পাশ ছেঁড়া। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। প্রিয়ার মায়া লাগলো। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“কিছু খাবে?”
মেয়েটা কথা না বলে মাথা উপর নিচ করলো। প্রিয়া দোকানদারকে বললো,
“আংকেল এক প্যাকেট পাউরুটি, চারটা কলা আর এক বোতল পানি দিনতো।”
খাবারগুলো পিচ্চিটার হাতে দেওয়ার পর খুশিতে মেয়েটার চোখমুখ উজ্জল হয়ে গেলো। খাবারগুলো নিয়ে দৌঁড়ে চলে গেলো। দোকানদারকে টাকা দিয়ে প্রিয়া অফিসে চলে গেলো।
হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো ১০:১০ বাজে। ১০টার মধ্যে উপস্থিত থাকার কথা সেখানে ১০ মিনিট লেট। না জানি, কপালে কি আছে। চাকরীর মুখ দেখার আগেই বোধ হয় চাকরীটা যাবে।
.
তিন তলায় গিয়ে এদিক সেদিক ঘুরছিলো প্রিয়া। একটা ছেলে এসে বললো,
“কাজ বাদ দিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“একচুয়ালি আমি আজ নতুন জয়েন করেছি।”
“আপনি এখানে কেন তাহলে? নতুনদের নিয়ে তো মিটিং এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আপনি জানেন না?”
“জানি। কিন্তু আসলে আমার দেড়ি হয়ে গিয়েছে।”
“প্রথম দিনই লেট। আসুন আমার সাথে।”
প্রিয়াকে উদ্দেশ্যে করে বললো,
“নক করে ভেতরে যান।”
“আচ্ছা।”
ছেলেটা চলে গেলো। প্রিয়া দরজায় নক করে বললো,
“মে আই কাম ইন?”
একটা মেয়ে মিষ্টি স্বরে বললো,
“ইয়েস কাম ইন।”
সম্ভবত মেয়েটা স্যারের পিএ হবে। প্রিয়া এক পা বাড়াতেই স্যার বললো,
“আউট!”
প্রিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এটা তো সেই বাসের ছেলেটা ফাহাদ। প্রিয়া হা করে তাকিয়ে রইলো। ফাহাদ ধমক দিয়ে বললো,
“কি হলো? কথা কানে যাচ্ছে না? বের হতে বলেছি আমি। এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং চলছে।”
প্রিয়া মুখটা কালো করে বেড়িয়ে এলো। বাহিরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিটিং শেষে সবাই বেড়িয়ে এলো। ফাহাদও। একবার প্রিয়ার দিকে তাকালো তারপর তার পিএ কে বললো,
“উনাকে আমার রুমে পাঠিয়ে দাও।”
“আচ্ছা।”
ফাহাদের কথা মত প্রিয়াকে পাঠিয়ে দিলো তার কেবিনে। প্রিয়া দরজায় নক করে বললো,
“আসতে পারি স্যার?”
“আসুন আসুন। আপনার জন্যই তো অপেক্ষা করছিলাম লেট লতিফ।”
প্রিয়া মুখটা মলিন করে ভেতরে প্রবেশ করলো। কয়েক মিনিট নিরবতা চললো। মনে হয় বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস। হলোও তাই! ফাহাদ ধমক দিয়ে বললো,
“কয়টা বাজে?”
ফাহাদের ধমকে প্রিয়া কেঁপে উঠলো। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
“এ..এ..এগারোটা পাঁচ।”
” এ এ কি? আপনি কি তোতলা?”
“জ্বী না।”
“প্রথমদিনেই অফিসে লেট করে আসলেন। জানেন এর শাস্তি কি দিতে পারি আমি?”
“জ্বী না।”
“জানেন না?”
“না।
“কেন জানেন না?”
“আজব তো! আপনি কি শাস্তি দিবেন সেটা আমি কি করে বলবো?”
“আমার মুখে মুখে তর্ক? আমি আপনার বস হই বস!”
“উদ্ধার করেছেন আমায় বস হয়ে। মুখে তো একটুসখানিও মধু নেই আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে বস হই বস!”
“আউট।গেট আউট।”
“হ্যাঁ যচ্ছি যাচ্ছি। এখানে বসে থাকতে আসিনি আমি।”
প্রিয়া চলে যাওয়ার সময় পেছন থেকে আবার ফাহদ ডাক দিলো,
“দাঁড়ান।”
প্রিয়া ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো,
“জ্বী।”
ফাহাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে প্রিয়ার হাতে ১০ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“এইযে আপনার ১০ টাকা। আয়মান চৌধুরী ফাহাদ কারো কাছে ঋণ থাকেনা।”
প্রিয়া রাগে গজগজ করতে করতে বেড়িয়ে এলো।
“ইশ! কি ঢং এর নাম গো! সেটা আবার ঢং করে বারবার রিপিট করা লাগে। এমন বসই কি কপালে জুটতে হলো আমার? কিভাবে সহ্য করে চাকরী করবো আল্লাহ্!”

৫টার দিকে অফিস ছুটি হয়ে যায়। সবার সাথে সাথে প্রিয়াও বের হয়ে আসে। বাহিরে এসেই ফাহাদের মুখোমুখি হয়। প্রিয়া অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আর ফাহাদ গম্ভীর হয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়।
.
.
বাড়িতে এসেই প্রিয়া ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। মা রুমে এসে বললো,
“কিরে এসেই শুয়ে পড়লি যে?”
“ক্লান্ত লাগছে মা।”
“যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“একটুপর যাই মা?”
“না, এখনই যাবি। উঠ তাড়াতাড়ি।”
প্রিয়া উঠে ফ্রেশ হতে চলে যায়। ততক্ষণে মা কফি বানিয়ে আনে। প্রিয়া তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে। কফির মগটা এগিয়ে দিয়ে মা বললো,
“অফিসের প্রথম দিন কেমন কাটলো?”
অফিসের কথা মনে হতেই প্রিয়ার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু এসব মা বা ভাইয়ারা কেউ জানলে কখনোই এই চাকরীটা করতে দিবে না এটা প্রিয়া ভালো করেই জানে। আর অতীত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রিয়ার ব্যস্ত থাকাটা খুব জরুরী। বস রাগী তো কি হয়েছে? হোক রাগী! তার সাথে ঠিকমত কথা বললেই হয়। সে রেগে যায় এমন কাজ করবে না। ব্যস হয়ে গেলো। চাকরী করতে করতে একটা অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে। তখন ভালো কোনো চাকরী পেলে এটা ছেড়ে দিবে। মনে মনে এসব ছক কষে নিচ্ছিলো প্রিয়া। মা হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
“কিরে? কোথায় হারিয়ে গেলি?”
“এ্যা? হারাইনি তো।”
“জিজ্ঞেস করলাম কেমন কাটলো আজকের দিন?”
প্রিয়া কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,
“ভালো।”
“ভালোমত কাজ করবি।”
“আচ্ছা।”

মাগরিবের নামাজ পড়ে প্রিয়া সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। কারো হাতের ঠান্ডা স্পর্শে প্রিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে দেখে ছোট ভাইয়া ভেজা হাত দিয়ে প্রিয়ার দুই গাল চেপে ধরেছে। প্রিয়া হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা কি হলো?”
“ঘুম ভাঙ্গানো হলো। এখনো ঘুমাচ্ছিস তুই?”
“ঘুমাবো না তো কি করবো?”
“উঠ তাড়াতাড়ি সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
“কেন?”
“কেন আবার কি? খাওয়ার জন্য।”
“আমি খাবো না।”
“তুই খাবি, তোর ভাইও খাবে।”
“তাহলে ভাই’ই খাক। আমি খাবো না।”
“খাবিনা?”
“না, না, না।”
“ওকে।”
ছোট ভাইয়া প্রিয়াকে কোলে করে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলো। প্রিয়া চেঁচামেচি করতে করতে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। ছোট ভাইয়া বললো,
“খবরদার প্রিয়ু। এমন করলে কিন্তু ঠাস করে ফ্লোরে ফেলে দিবো।”
ছোট ভাইয়া প্রিয়াকে চেয়ারে বসিয়ে দিলো। প্রিয়া কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
“আমার ঘুম, তোমাদের কারো সহ্য হয়না আমি জানি তো।”
বড় ভাইয়া হাসতে হাসতে বললো,
“জানিস প্রিয়ু তুই এভাবে কথা বললে তোকে না অনেক কিউট লাগে। এমন করে থাকিস না, তাহলে কিন্তু আমিই তোকে কাঁদাবো।”
প্রিয়া চেঁচিয়ে বললো,
“মা, তোমার এই বাঁদর দুই ছেলেকে কিছু বলবা নাকি আমিই দুইটার ঘাড় মটকাবো বলো?”
ছোট ভাইয়া বললো,
“সে কি রে প্রিয়ু? তুই রাক্ষসী নাকি?”
বড় ভাইয়া বললো,
“ও তো রাক্ষসীই। দেখিস না হাতের নোখ কি বড় বড়।”
“মাআআআআআ।”
এবার বড় ভাবী বললো,
“কি শুরু করলে তোমরা? রাগাচ্ছো কেন ওকে?”
“ইশ! ননদের জন্য কি দরদ।”
“দরদ তো হবেই। চুপচাপ খাও।”
প্রিয়া ভাত নিতে যাবে তখন ছোট ভাইয়া বললো,
“তুই না বললি তুই খাবিনা?”
প্রিয়া দাঁত কটমট করে বললো,
“তো আমি কি এখানে এখন নৃত্য করবো?”
“না বোন। বাতাসে কখন উড়ে যাবি কে জানে।”
“খাবো না। ওকে খাবো না।”
বড় ভাইয়া বললো,
“আমি তোকে খাইয়ে দিচ্ছি।”
ছোটভাইয়া বললো,
“সবসময় ও কেন আদর পাবে? আমায় খাইয়ে দাও না কেন?”
“ছোট ভাইয়া তুমি খুব হিংসুটে।”
“একদম তোর মত। তাই না?”
“কচু।”
দুই ভাই মিলে প্রিয়াকে খাইয়ে দিলো। ছোট ভাবী বিছানা ঠিক করে দিলো,মশারী টানিয়ে দিলো। বড় ভাবী প্রিয়ার চুলে বেণী করে দিলো। রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
“পরিবারের প্রতিটা মানুষই আমাকে কতটা ভালোবাসে। অথচ আমি যাদের ভালোবাসি তাদের কাছেই প্রতারিত হই। আমার পরিবারের মত কেউ আমায় কখনো বুঝবে না। আর ভালোও বাসতে পারবে না। আল্লাহ্, তুমি আমার পরিবারকে এভাবেই হাসিখুশি রেখো। ভালো রেখো।”
প্রিয়া শান্তির একটা ঘুম দিলো।

সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে অফিসে চলে গেলো। আজ পাক্কা ৩০ মিনিট আগেই অফিসে পৌঁছে গেলো। অফিসে গিয়েই খেলো এক ধাক্কা। বিড়বিড় করে বললো,
“বাবারে দেওয়াল নাকি আইফেল টাওয়ার! গেলো রে মাথাটা।”
সামনে তাকিয়ে দেখলো এটা কোনো দেয়াল না আবার কোনো আইফেল টাওয়ারও না। সাক্ষাত বস! ফাহাদ অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া মিনমিন করে বললো,
“প্রিয়ারে আজ তুই শেষ! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যো হয়। এর চেয়ে যদি, আমি তিন তলা থেকে নিচে পড়ে যেতাম তাও ভালো ছিল। নয়তো কলার খোসায় পা পিছলে ফ্লোরে পড়ে কোমড় ভাঙ্গতাম তাও ভালো ছিল। এখন তো জম সামনে দাঁড়িয়ে।”
ফাহাদ রাগী কণ্ঠে বললো,
“চশমায় পাওয়ার আছে?”
“হ্যাঁ।”
“তবুও দেখে চলতে পারেন না? চোখ কি কপালে তুলে রাখেন? আমি তো ব্লাক সানগ্লাস পড়েও সব ঝকঝকা তকতকা দেখি।”
প্রিয়ার ইচ্ছে হলো একবার জিজ্ঞেস করতে, তাহলে আপনি ধাক্কা খেলেন কেন? আপনি দেখে চললেই তো আর ধাক্কা লাগতো না। কিন্তু মুখে এটা বলা যাবেনা। মুখে বললো,
“স্যরি স্যার।”
“স্যরি? স্যরি বললেই সব সমাধান হয়ে গেলো তাই না?”
“তাহলে কি করবো?”
“কিচ্ছু করতে হবে না। চশমাটা দেন।”
কোনো প্রশ্ন ছাড়াই প্রিয়া চশমা খুলে দিলো। ফাহাদ চশমাটা চোখে দিতে দিতে বললো,
“দেখেন আমি কিভাবে পাওয়ারের চশমা পড়ে হাঁটি।”
চশমা পড়ে দুই কদম যেতেই ধপাস করে এক শব্দ হলো। অন্যকিছু নয়! ফাহাদই পড়ে গেছে। প্রিয়া আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। এগিয়ে গিয়ে বললো,
“উঠুন উঠুন। ব্যথা পেয়েছেন?”
“ইশরে! সবই কেমন উঁচুনিচু লাগছিলো আর তাই ধপাস করে পড়ে গেলাম।”
প্রিয়া মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
“আসলে স্যার, আপনার অভ্যাস নেই তো তাই পড়ে গিয়েছেন।”
“আপনি তো মনে মনে এটাই চেয়েছেন।”
“এমন কেন চাইবো আমি?”
“না চাইলে প্রথমে বললেন না কেন?”
“আপনার মুখে মুখে কি আর তর্ক করা যায় স্যার? হাজার হলেও আমার বস আপনি।”
ফাহাদ রাগে দাঁত কটমট করতে লাগলো। মনে মনে বললো,
“আমার কথাই আমায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেখে নিবো আমিও।”..

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here