তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব ১২+১৩

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১২
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
প্রিয়ার মাথা ফাহাদের কোলে রেখে সমানে ডাকছে প্রিয়াকে। কিন্তু প্রিয়ার কোনো হুশ নেই। আলতো করে গালে চাপড় দিচ্ছে আর বলছে,
“এই প্রিয়া কি হলো তোমার? চোখ খোলো। প্রিয়া, প্রিয়া!”
চোখেমুখে পানির ছিটাও দিলো কিন্তু কোনো কাজ হলো না। ভয়ে ফাহাদের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। ফোনটা নিয়ে পৃথাকে কল দেয়,
“হ্যালো”
“হ্যাঁ স্যার বলুন।”
“দ্রুত আমার রুমে আসো।”
বলেই ফাহাদ কল কেটে দিলো। পৃথাও সাথে সাথে চলে আসলো। এই অবস্থা দেখে পৃথা বললো,
“প্রিয়ার কি হয়েছে?”
“জানিনা। হুট করেই সেন্সলেস হয়ে গেলো।”
পৃথা এবার চোখে-মুখে পানি দিলো। বেশকিছুক্ষণ পর প্রিয়ার জ্ঞান ফিরে। প্রিয়া তখনও ফাহাদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ফাহাদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবে সেই শক্তিটুকুও নেই। প্রিয়ার জ্ঞান ফিরতেই ফাহাদ অস্থির হয়ে বললো,
“এই কি হয়েছিল তোমার হঠাৎ করে? জানো কত টেনশন হচ্ছিলো!”
প্রিয়া উত্তর না দিয়ে বললো,
“বাসায় যাবো আমি।”
ফাহাদও আর কিছু বললো না। পৃথার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি তুমি ওকে বাড়িতে দিয়ে আসো।”
“জ্বী স্যার।”
ফাহাদের কথামত পৃথা প্রিয়াকে নিয়ে বাড়িতে গেলো। প্রিয়ার শরীর খুব দূর্বল লাগছিল তাই পৃথা ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলো। দরজা খুলে দেয় প্রিয়ার মা। মা ভয় পেয়ে বললো,
“কি হয়েছে ওর? এভাবে নিয়ে আসছো কেন?”
“আন্টি শান্ত হোন। তেমন কিছু হয়নি। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল।”
পৃথার সাথে মাও প্রিয়াকে ধরে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। মা প্রায় কান্না করে দিবে এমন ভাব। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
“দিনদিন মেয়েটার ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে। একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। আল্লাহ্ জানে আমার মেয়ে কবে একটু সুখের দেখা পাবে।”
“আন্টি প্লিজ কাঁদবেন না। রেস্ট নিলেই সুস্থ হয়ে যাবে।”
“কি করবো বলো মা! মা হয়ে মেয়ের এত কষ্ট আর সহ্য হয়না।”
“আমি বুঝতে পারছি আন্টি।”
কথা বলার ফাঁকে ফাহাদ পৃথাকে কল দিলো।
“হ্যালো পৃথা।”
“জ্বী স্যার বলুন।”
“বাসায় গিয়েছো?”
“হ্যাঁ।”
“প্রিয়া কোথায়?”
“শুয়ে আছে।”
“আচ্ছা ওকে রেস্ট নিতে বলো। আর বলে দিয়ো যে কয়দিন পর থেকে যেন অফিসে আসে।”
“ওকে স্যার।”
“রাখছি।”
মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে পৃথা বিদায় নিলো। আসার আগে ফাহাদের বলা কথাগুলোও বলে আসলো।

সন্ধ্যার দিকে ব্যালকোনিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়া। মা কফি নিয়ে এসে বললো,
“ধর কফি খা।”
“রাখো।”
“মন খারাপ?”
“না।”
“তাহলে?”
“কিছুনা।”
“কি লুকাচ্ছিস?”
“কি লুকাবো?”
“সেটা তো তুই জানিস।”
“কিছুই লুকাচ্ছি না।”
মা প্রিয়ার দুই বাহু ধরে বললো,
“আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলতো।”
“এভাবে ফোর্স করো না। ভালো লাগেনা।”
“কি হয়েছে বল আমায়।”
“কি বলবো বলো তো? যেইসব অতীত থেকে আমি দূরে থাকতে চাই সেগুলোই আমাকে বারবার তাড়া করে।”
“আবার মৃন্ময়ের সাথে দেখা হয়েছে?”
“না।”
“তবে?”
“বস আজ আমায় ভালোবাসার কথা বলেছে।”
“কিহ্!”
“হ্যাঁ। ভালো লাগে না আর। আর কিছু জিজ্ঞেস করিয়ো না। আমি একটু একা থাকবো। যাও তুমি।”
মা আর কিছু বললো না। চলে গেলো। মা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই ফাহাদ ফোন দেয়। প্রিয়ার একদম ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। তবুও ফোনটা রিসিভড করলো। ওপাশ থেকে ফাহাদ বললো,
“এখন কেমন আছো?”
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ্‌।”
“কি হয়েছিল তোমার? হুট করে সেন্সলেস হয়ে গেলে কেন?”
“জানিনা।”
“তোমার কি মন খারাপ?”
“না।”
“আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ। আমি পরে ফোন দিবো কেমন।”
“হুম।”
ফাহাদ ফোনটা রেখে দিলো। এই মেয়েটাকে বুঝা বড্ড কঠিন। আনমনে হাজারও কথা ভাবছিল তখন ফাহাদের মা রুমে আসে।
“কি করছিস?”
“কিছু না মা।”
“কিছু কি ভাবছিস?”
“হুম। তবে তেমন কিছুনা।”
“নিশ্চয় প্রিয়াকে নিয়ে ভাবছিস?”
ফাহাদ হাসলো।
“জানোই তো।”
“ভালোবাসার কথা জানিয়েছিস?”
“আজ তো জানালাম। কিন্তু কোনো রেসপন্স পাইনি।”
“বলার সাথে সাথে কি হ্যাঁ বলে দিবে নাকি? লেগে থাক আঠার মত। ভালো না বেসে যাবে কোথায়?”
ফাহাদ ওর মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমার লক্ষী মা!”
.
পরেরদিন ফাহাদ অফিসে গিয়ে প্রিয়াকে দেখতে পেলো। প্রিয়াকে দেখেই ওর মাথা গরম হয়ে গেলো। মনে মনে বললো,
“এতবার করে বললাম রেস্ট নিতে। তা না করে অফিসে এসে পড়েছে। কি এত কাজ মহারাণীর!”
ফাহাদের রুমে প্রিয়ার ডাক পড়লো। হিমি বললো,
“আসতে না আসতে তোর ডাক পড়ে গেছে। যা তাড়াতাড়ি, নয়তো দেখবি তোকে দেখতে না পাওয়ার পিপাসায় গলা শুকিয়েই মারা যাবে।”
“সবসময়ই শুধু আজেবাজে কথা।”
ফাহাদ প্রিয়ার রুমে গেলো।
“মে আই কাম ইন স্যার?”
“ইয়েস।”
প্রিয়া ভেতরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ফাহাদ হাতে একটা কলম নিয়ে ঘুরাচ্ছে আর প্রিয়াকে পর্যবেক্ষণ করছে। ফাহাদ কিছু বলছেনা দেখে প্রিয়াই বললো,
“আমায় ডেকেছিলেন?”
“কি এত কাজ তোমার অফিসে?”
“মানে?”
“আমি তোমাকে রেস্টে থাকতে বলেছিলাম না? তাহলে অফিসে কেন আসছো?”
“আমার কোনো রেস্টের প্রয়োজন নেই। আমি একদম ঠিক আছি।”
ফাহাদ টেবিলের ওপর হাত দিয়ে বাড়ি দিলো। চেয়ার ছেড়ে প্রিয়ার কাছে এগিয়ে আসতেই প্রিয়া দুই পা পিছিয়ে গেলো।
“স্যার আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে আমি আপনার অফিসের সামান্য একজন ওয়ার্কার। আর আপনি আমার বস। হুটহাট এভাবে কাছে আসাটা মানায় না। আদারওয়াইজ আমি তো আপনার ওয়াইফ নই।”
ফাহাদ ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“বউ হবে বুঝি?”
প্রিয়া সিরিয়াস মুডে বললো,
“কোনো ইচ্ছে নেই আমার। আর একটা কথা, আপনি আমার বস তাই আমাকে ডাকতেই পারেন তবে অবশ্যই কাজের জন্য ডাকবেন। অযথাই অকারণে ডাকবেন না প্লিজ। এতে আমার ওপর ইফেক্ট পড়ে। নানান জন নানান কথা বলে।”
এতটুকু বলেই প্রিয়া চলে যাওয়া ধরলো ফাহাদ প্রিয়ার হাত ধরে বলল,
“তুমি কি আমায় ইগনোর করছো?”
ফাহাদের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়া বললো,
“আপনি কি ইগনোর করার মত কেউ? ইগনোর তাকেই করা যায় যার সাথে এমন কোনো রিলেশন থাকে যাতে তাকে ইগনোর করা যায়। আপনার সাথে আমার এমন কোনো রিলেশন নেই।”
প্রিয়া চলে গেলো। হ্যাঁ ফাহাদকে ইগনোর করা শুরু হয় এখান থেকেই। বেশি কিছু ঘটার আগে এখন থেকেই সবকিছু এমনকি ফাহাদকে এড়িয়ে চলতে হবে। অন্যান্য অফিসে জবের এপ্লাইও করেছে অলরেডি। জব হলেই এখান থেকে, ফাহাদের জীবন থেকে সরে যাবে প্রিয়া। মিছেমিছি ভালোবাসা নামক কোনো বন্ধনো আটকাতে চায় না প্রিয়া।

এভাবে প্রতিনিয়তই প্রিয়া ফাহাদকে এড়িয়ে চলছে। ফাহাদ যতই প্রিয়ার কাছে যেতে চাইছে, প্রিয়া ততই দূরত্ব বজায় রাখছে। ফাহাদও মনে মনে প্রতিজ্ঞা নেয়, “যত পারো ইগনোর করো। আমিও পিছু ছাড়বো না। দেখবো তোমার ইগনোর করার ধৈর্য কত আর আমার ভালোবাসার ধৈর্য কত!”
.
.
অফিস থেকে বাড়ি এতটুকুতেই প্রিয়া নিজেকে আটকে রেখেছে। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছে। প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথেই কথা বলছেনা। অনেক জোড়াজুড়ির পর পৃথার সাথে শপিং-এ যেতে রাজি হয় প্রিয়া। পৃথা শপিং করছে আর প্রিয়া ঘুরে ঘুরে সব দেখছে চুপচাপ। আজ ততটাও ভিড় নেই শপিংমলে। আবার এত কমও নয়। আচমকা কেউ প্রিয়ার হাত ধরে টান দেয়। প্রিয়া পেছন ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে যায়। কি করবে বা কি বলবে বুঝতে পারছেনা। প্রিয়ার সামনে মৃন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়াকে অবাক করে দিয়ে মৃন্ময় প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে। যেটার জন্য প্রিয়া একদমই প্রস্তুত ছিলো না। প্রিয়া এক প্রকার জোর করেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে অনেকেই উৎসুক চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে মৃন্ময়কে কিছু বলা মানেই সিনক্রিয়েট করা। আর একটু চেঁচামেচি হলেই মৃন্ময়ের আস্ত বাড়িতে ফেরা লাগবেনা যেটা প্রিয়া একদমই চাচ্ছিলো না। তাই বেশি কিছু না বলে শুধু বললো,
“আপনি লেকে যান আমি আসছি।”
“না, না একদম না। আবার আমার থেকে লুকিয়ে যাওয়ার জন্য? এটা একদম হবেনা। গেলে আমার সাথেই যেতে হবে।”
প্রিয়া উপায় না দেখে পৃথাকে নিয়ে মৃন্ময়ের গাড়িতে করে লেকে গেলো। প্রিয়া আর মৃন্ময়ের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে পৃথা। প্রিয়া কিছু বলার আগেই মৃন্ময় বললো,
“জানো তোমাকে কত কষ্ট করে খুঁজে পেয়েছি। সেদিন কেন আমার থেকে পালিয়ে গেলে? আমার ওপর রাগ করে? আমি জানি, আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ।”
বলতে বলতেই মৃন্ময় প্রিয়ার পা পেঁচিয়ে ধরে। প্রিয়া মৃন্ময়কে ধরে দাঁড় করায়। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। উহু যেকোনো হাসি নয় এটা। এটা তাচ্ছিল্যর হাসি।
“ভাগ্য মানুষকে কোথায় এনে দাঁড় করায় তাই না? যেদিন আপনি আমাকে ছেড়ে যান সেদিনও ঠিক একইভাবে আমার পা ধরে মাফ চেয়েছিলেন। কিন্তু পার্থক্য এটাই যে, সেদিন মাফ চেয়েছিলেন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য। আর আজ মাফ চাইছেন ফিরে আসার জন্য।”
“আই এম স্যরি প্রিয়া।”
“আমাকে আপনার কি মনে হয় বলেন তো? পুতুল? যেভাবে নাচাবেন সেভাবেই নাচবো?”
“না প্রিয়া। আমি কি করতাম বলো? রিমির কান্নাকাটি আমি তখন সহ্য করতে পারিনি। তাই আবেগে পড়ে ভুলটা করে ফেলেছি।”
“আপনার এই ভুলটা যে আমার জীবনটা তছনছ করার জন্য যথেষ্ট ছিল সেটা কি আপনি জানেন? সে যাই হোক, নিজের ভালোবাসার কাছে গিয়েছেন ভালো কথা। এখন কেন এমন হন্যে হয়ে খুঁজছেন আমায়?”
“আমি আমার ভু্লটা বুঝতে পেরেছি। আমি তোমায় ভালোবাসি।”
“হাহ্! হাসালেন। আপনি কি ভালোবাসা কি সত্যিই জানেন? তখন আপনার মনে হয়েছিল রিমিকে ঠকাতে পারবেন না আর এখন বলছেন আমায় ভালোবাসেন? আপনি যদি তখন একটাবার সময় নিয়ে ভাবতেন তাহলে হয়তো এইদিনটা আমাদের দেখতে হতো না। রিমির সাথে যখন আপনার ব্রেকাপ হয় তখনও একবার উচিত ছিল নিজের একটু সময় নেওয়া এবং রিমিকে সময় দেওয়া। এরপর বিয়ের ব্যাপারে আগানো উচিত ছিল। কিন্তু আপনি সেটা করেননি। এমনকি আমায় দেখার পরও আপনি আমার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করেন। পরমুহূর্তে রিমি ফিরে আসায়,সেটা আবার ভ্যানিশ হয়ে যায়। রিমি যখন ব্যাক করলো, তখন যদি ঠান্ডা মাথায় ভাবতেন। একবার আমায় জানাতেন তাহলেও হতো। কিন্তু আপনি এমন কিছুই করেননি। সবকিছু আপনি এলোমেলো করে দিয়েছেন।”
“আমার মাফ চাওয়ার মুখ নেই। তবুও বলবো একটাবার মাফ করো। ভুল তো মানুষই করে। ভালোবেসে না হয় ভুলটা মাফ করে দাও।”
“সেই ভুলের ক্ষমা হয় যেটা অনিচ্ছাকৃত হয়। ইচ্ছাকৃত ভুলের কোনো মাফ হয়না। সেদিন আপনার অনেক কিছু করার ছিল কিন্তু আপনি কিচ্ছু করেননি। নিজ স্বার্থে আমায় ঠকিয়ে গিয়েছেন।”
“আমি জানি তুমি আমায় এখনো ভালোবাসো।”
“আপনি ভুল জানেন। আমি আপনাকে কখনোই ভালোবাসিনি।”
“তাহলে বিয়ের ব্যাপারে?”
“হ্যাঁ বিয়ের ব্যাপারে এগিয়েছিলাম। যেকোনো সম্পর্ক গড়ার আগে সবচেয়ে বেশি কোন জিনিসটা দরকার জানেন? বিশ্বাস! আমি তো কাউকে বিশ্বাসই করিনা। কিন্তু আপনাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। আপনি আমার চোখে আঙ্গু্ল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আপনি আমার বিশ্বাসের যোগ্য নন। সেখানে ভালোবাসা তো অনেক দূরের কথা।”
“প্রিয়া প্লিজ….”
“কোনো কিছু বলেই কোনো লাভ হবেনা। জানিনা আপনার সাথে আবার রিমির কি হয়েছে। তবুও বলছি যাই হোক মিটিয়ে নিন। জানেন তো,একটা কাঁচের বা মাটির জিনিস ভেঙ্গে গেলে সেটা কখনো জোড়া লাগেনা। আর যদিও জোড়া লাগে তাহলে সেটার গায়ে দাগ থেকে যায়। আপনার আর রিমির ব্রেকাপের পর একটা দূরত্ব এসে গেছে মাঝখানে যে কারণে ভাঙ্গা কাঁচ বা মাটির বস্তুর গায়ের দাগের ন্যায় আপনাদের কারো না কারো অনীহা এসে পড়েছে। আবেগের বশে আর কোনো ভুল না করে ঠান্ডা মাথায় এবার ভাবেন। সময় নিন। আমি মনে করি রিমির সাথেই আপনার জীবন জড়ানো উচিত। আশা করি কারণটাও আপনি জানেন। আর হ্যাঁ, আপনার আর আমার সম্পর্ক কখনোই আর হওয়া সম্ভব নয়। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তাই দয়া করে আমায় আর বিরক্ত করবেন না। ভালো থাকবেন।”
প্রিয়া আর কিছু বললো না। পৃথাকে নিয়ে ওখান থেকে চলে আসে। মৃন্ময়ের চোখে পানি টলমল করছিলো। যেকোনো মুহুর্তেই পানিগুলো উপচে পড়বে। মৃন্ময় এখন উপলব্ধি করতে পারছে, সেদিন অনেক বড় ভুল করে ফেলেছে যার ফলস্বরূপ প্রিয়াকে হারাতে হলো। না পাওয়ার কষ্ট দারুণ কিন্তু পেয়েও হারানোর কষ্ট নিদারুণ। যেটা সহ্য করার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে।

প্রিয়া কাউকে ভালোবাসেনা। কেন জানি মুখ ফসকে কথাটা বের হয়ে গেছে। তবে ভালোই হয়েছে। মৃন্ময় অন্তত নিজের মনকে এটা বলে বোঝাতে পারবে যে, প্রিয়া এখন অন্য কারো। কিছু কিছু ভালোলাগা, ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। যখন মানুষটি জীবনে থাকে তখন তার মূল্য কেউই দিতে পারিনা। কিন্তু যখন মানুষটা দূরে সরে যায়, হারিয়ে যায় তখনই আমরা বুঝতে পারি সে কি আর কতটা ছিল আমাদের জীবনে। তখন বুকের এই শূন্য হাহারগুলো নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হয়।
সেদিনের পরই মৃন্ময় বাংলাদেশ থেকে চলে যায় ব্যাংকক। যে দেশে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়েও নিজের দোষে হারাতে হলো সে দেশে থাকাটা বড্ড কষ্টের। তাছাড়া এখানে থাকলে বেহায়া মনটা বারবার চাইবে প্রিয়ার কাছে যেতে। যতই প্রিয়াকে দেখবে ততই কষ্ট পাবে। যদি কখনো নিজের মনকে আটকাতে পারে তবেই বাংলাদেশে ফিরে আসবে মৃন্ময়।
মৃন্ময় প্লেনে বসে নীলচে আকাশে সাদা সাদা মেঘগুলো দেখছিলো। সাথে এক বুক হাহাকার। প্রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো….

চলবে….
#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৩
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
ফাহাদকে ইগনোর করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় প্রিয়া। কিন্তু তাতে এতটুকুও লাভ হচ্ছে না। ফাহাদও আঠার মত লেগেই আছে। কখনো কখনো কোনো ফাইলের সাথে লাভ লেটার পাঠাচ্ছে তো কখনো কখনো গোলাপ। অফিসের কম বেশি সবাই জানে এখন ফাহাদ প্রিয়াকে ভালোবাসে। এটা নিয়েও নানান জনের নানান মতামত। কারো কারো মতে প্রিয়া খুব বোকা। নয়তো এমন ছেলেকে কি কেউ হাতছাড়া করে? আবার কেউ কেউ এটাই ভেবে পায় না যে, এত বড়লোকের ছেলে সাধারণ ঐ মেয়ের মধ্যে এমন কি খুঁজে পেলো! এসব কথা যে প্রিয়া কিংবা ফাহাদের কানে আসেনা বিষয়টা এমন নয়। সব কথাই ওদের কানে আসে। এইসব রাগ প্রিয়া ফাহাদের ওপর ঝাড়ে। আর ফাহাদ মিষ্টি হেসে প্রতিবারই উত্তর দেয়,
“লোকের কথায় আমার কি এসে যায়? আমি তো তোমায় ভালোবাসি।”
প্রিয়া জানতো, খুব ভালো করেই জানতো ফাহাদকে বোঝানো ওর কাম্য নয়।
দেখতে দেখতে এভাবেই কেটে যায় ছয়টা মাস। এই ছয়টা মাসে প্রিয়ার এত অবহেলা পেয়েও ফাহাদের ভালোবাসা একটুও কমেনি। বরং দিনকে দিন ভালোবাসা চক্রবৃদ্ধি মুনাফা হারে বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে ফাহাদ নিজেও বুঝেনা এমন কি কম আছে যে কারণে প্রিয়া আমায় ভালোবাসেনা। আর কেনোই বা ও কাউকে বিশ্বাস করতে পারেনা!
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে অফিস ছুটি হয়ে গিয়েছে। ফাহাদও চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই কাঁচ ভেদ করে দেখতে পেলো প্রিয়া গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। প্রিয়াকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রিয়া কথা বলতে নারাজ। কিন্তু ঐদিকে ছেলেটাও কিছুতেই সরছে না। এমনকি প্রিয়ার হাত পর্যন্ত ধরে ফেলে। ফাহাদের মাথায় রক্ত উঠে যায়। এত্ত বড় সাহস ফাহাদের অফিসের সামনে দাঁড়িয়েই ফাহাদের ভালোবাসার মানুষটিকে বিরক্ত করা। ফাহাদ দ্রুত বেগে লিফ্টে ওঠে। আজ মনে হয় লিফ্টও স্লো চলছে। ফাহাদ যখন বের হলো প্রিয়া তখন ছেলেটার বাইকে বসেছে। ফাহাদ কিছুই বুঝতে পারলো না। মেজাজ আরো খারাপ হয়ে যায়। গাড়ি নিয়ে ফাহাদও পিছন পিছন ফলো করে ওদের। একটা বাড়ির সামনে বাইক থামতেই ফাহাদও গাড়ি থামায়। ফাহাদ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগিয়ে যায়। ছেলেটার শার্টের কলার ধরে বলে,
“হাউ ডেয়ার ইউ ইডিয়ট।”
ফাহাদের চোখেমুখে রাগে আগুন ঝড়ছে মনে হচ্ছে। ঘটনায় আকস্মিকতায় ছেলেটা চমকে যায় আর সাথে প্রিয়াও। কারণ ছেলেটা আর কেউই নয়। প্রিয়ার ছোট ভাইয়া। প্রিয়া বিশ্বাসই করতে পারছেনা এটা ফাহাদ। ফাহাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রিয়া রাগি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এখানে কেন? আর আপনার সাহস কি করে হয় ভাইয়ার কলার ধরার?”
এবার যেন ফাহাদ আকাশ থেকে পড়ে। কি করবে কিছুই আসছেনা মাথায়। এক পলকে শুধু প্রিয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে। মুখ দিয়ে কোনো কথাও বের হচ্ছেনা। কোনোমতে থতমত খেয়ে বললো,
“ক কে কে? তো..ত..তোমার ভাই?”
“হ্যাঁ আমার ভাই। কিন্তু আপনি এখানে কেন?”
ফাহাদ এবার প্রিয়ার ভাইয়ার কাছে হাত জোর করে বললো,
“প্লিজ ভাইয়া প্লিজ মাফ করে দিবেন। আমি আসলে একদম বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম কোনো ছেলে হয়তো ওকে বিরক্ত করছে। আর তাই মাথা ঠিক ছিলো না।”
ছোট ভাইয়া কিছু বলার আগেই ফাহাদ প্রিয়াকে বললো,
“তুমি তো বলোনি যে তোমার ভাইয়ারা ফিরে এসেছে? তোমার ভুলের জন্য আজ আমি কি একটা ভুল করে ফেললাম।”
“ভাইয়ার সাথে আমি যোগাযোগ করতে চাইনি। তাই ভাইয়া আজ অফিসের সামনে গিয়েছিল। তাছাড়া আমার সব কথা আপনাকে বলবো কেন? কে আপনি?”
এবার ছোট ভাইয়া বললো,
“ছেলেটা কে?”
“আমার অফিসের মালিক প্লাস বস।”
ছোট ভাইয়া মাথা চুলকে বললো,
“বস! তাহলে এত রিয়াক্টের কি হলো?”
“ভাইয়া উনি একটা সাইকো।”
ফাহাদ মুখটা কাচুমুচু করে বললো,
“শুধু শুধু ভাইয়ার সামনে আমার বদনাম করছো কেন?
ভাইয়া আপনি ওর কথা রাখেন, আগে আমায় বলেন ক্ষমা করেছেন?”
“আপনি ওর বস! আপনার দোষ, ক্ষমা দেখি কি করে!”
“আমাকে আপনি তুমি করেই বলেন। আর ওর বস শুধু আমি অফিসে বাহিরে তো….”
ফাহাদ পুরো কথা বলার আগে প্রিয়া বললো,
“বাহিরে উনি একটা সাইকো। ভেতরে চলো মা নাকি অপেক্ষা করছে?”
“আরে উনাকেও নিয়ে চল। বাড়ির সামনে এসে খালি মুখে চলে যাবে নাকি?”
“গরীবের ঘরের খাবার উনার মুখে উঠবে না।”
“সোজা কথায় বললেই পারো যে, আমি খেলে তোমাদের বাড়ির খাবার কমে যাবে। অযথাই আমার দোষ দিচ্ছো কেন?”
“আপনি প্রিয়ার কথা কানে নিয়েন না। আমার সাথে আসেন।”
“আমি না তুমি করে বলতে বললাম ভাইয়া?”
“আচ্ছা সে বলবোনি। এখন আসো।”
“না ভাইয়া। যেদিন প্রিয়া মন থেকে চাইবে সেদিনই ভেতরে যাবো। আজ আসি।”
ফাহাদ আর কিছু না বলে ওখান থেকে চলে আসলো। ফাহাদের এমন রিয়াক্ট, আচরণ সবই সন্দেহজনক লাগলো ছোট ভাইয়ার। কিন্তু এখন প্রিয়াকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করা যাবেনা। এমনিতেই প্রিয়ার রাগ ভাঙ্গাতে জীবন চলে যাবে তার ওপর যদি এসব কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে বোনকে চিরদিনের জন্যই হারাতে হবে।
.
.
প্রিয়াদের বাড়িতে উৎসব উৎসব একটা আমেজ এসে পড়েছে। তার কারণও আছে। বাড়িতে যে নতুন একটা পুচকু আসবে। প্রিয়ার বড় বোন লামিয়া প্রেগন্যান্ট। তাই বড়বোনকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসে। যদিও লামিয়ার স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউ প্রথমে রাজি ছিলো না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে আনতে হয়েছে। কতদিন পর বোন বাড়িতে এসেছে। কিন্তু আসলে কি হবে! দুবোনের ঠুকরাঠুকরি লেগেই থাকে। প্রিয়ার নানু, খালামনি, কাজিনরাও এসেছে। দুই ভাইয়াও মাঝে মাঝে আসে। ভাইদের ওপর প্রিয়ার চাপা রাগ থাকলেও শুধুমাত্র মায়ের কথা ভেবে তা প্রকাশ করেনা। আগের মতই কথা বলে সবার সাথে। এরমধ্যেই ঘটে যায় আরেক অঘটন।সেদিন প্রিয়া অফিসে না গিয়ে বাড়িতে বসে বসে বোনের জন্য হরেক রকম আচার বানাচ্ছে। টেষ্ট করার জন্য ছোট্ট একটা বাটিতে করে একটুখানি আচার দেয় লামিয়াকে। লামিয়া আচার খেতে খেতে বললো,
“তোর বসটা কিন্তু হেব্বি দেখতে!”
প্রিয়া অবাক হয়ে বললো,
“তুই কি করে জানলি?”
“সবাই জানে আর আমি জানবো না?”
“সবাই কি জানে?”
“ন্যাকা! এখন কিছুই বুঝো না?”
“সিরিয়াসলি বুঝতে পারছিনা তুই কি বলছিস।”
“তোর বসের সাথে তোর কি চলে?”
“কেমন ধরণের কোশ্চেন এটা?”
“কেন কমন পড়েনি? নাকি বলবি না?”
“বলার মত হলে তো বলবো।”
“তোর বস ছোট ভাইয়াকে কি বলেছে জানিস?”
“কি?”
“সে তোকে ভালোবাসে।”
“কিহ্! এই ঠোঁট পাতলার পেটে কি কিচ্ছু থাকেনা? ডিরেক্ট ভাইয়াকে বললো?”
“পেটে পেটে রাখতে চাচ্ছিস কেন? আমরা জানলে কি সমস্যা?”
“এমন কিছুই নারে আপু।”
“ছেলে তো ভালোই। রাজি হয়ে যা।”
“আপু অন্তত তুই এটা বলিস না। আমার কোনো কিছুই তো তোর অজানা নয়।”
প্রিয়া চুলা নিভিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। লামিয়া মনে মনে বড় শ্বাস নিয়ে বলে,
“আমার বোনটাকে সুখ মিলিয়ে দাও আল্লাহ্।”
প্রিয়া চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে নিজের রুমে যায়। গিয়ে যা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণী একটা হার্টএটাক হয়ে যাবে প্রিয়ার। এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি প্রিয়া বুঝতেই পারছেনা। হা করে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ পান ছেঁচে দিচ্ছে ওর নানীকে। সাথে রাজ্যের সব গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে আছে। ফাহাদ একবার প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলো। এমন একটা ভাব যেন প্রিয়াকে চিনেই না। ফাহাদের কথা শুনে নানী কখনো কখনো আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া কোমড়ে দুই হাত গুঁজে বললো,
“আপনি আমার বাড়িতে কেন? তাও আবার রুমে?”
ফাহাদ না চেনার ভান করে বললো,
“স্যরি? আমাকে বলছেন?”
“একদম ঢং করবেন না বলে দিলাম।”
“নানী কে এই মেয়ে? বউয়ের মত করে কেন কথা বলছে?”
নানী বললো,
“তুই ওকে চিনিস না? খুব ভালো রে ছেলেটা। ছোট নানুভাইর সাথে এসেছে। দেখেছিস কত আদর-যত্ন করছে আমার? ছেলেটার নানী নেই। নানীর ভালোবাসা কি জানেই না।”
বলেই নানী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো। সাথে ফাহাদও কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
“নানী তুমি প্লিজ মন খারাপ করো না। আমার এক নানী নেই তো কি হয়েছে? এইতো তুমি আছো আমার।”
দুইজনের কথাবার্তা শুনে প্রিয়া ঢের বুঝতে পারছে যে ফাহাদ খুব ভালো করে মালমসলা মাখিয়েছে। কি জিনিস রে বাবা! প্রিয়া নানীর কাছে গিয়ে বললো,
“ছোট ভাইয়া তাকে নিয়ে আসলো আর তুমি একজন অপরিচিত লোককে সোজা আমার রুমে নিয়ে আসলে?”
“এভাবে কেন বলছিস তুই? ছেলেটা কি চোর-ছেচ্চড় নাকি ডাকাত যে তোর ঘরের সব লুট করে নিয়ে যাবে। ওমন হলে ছোট নানুভাই কখনোই বাড়িতে আনতো না বুঝলি।”
“তা নয় নানু! ইনি আমার অফিসের বস।”
“কি? ফাহাদ তোর বস?”
“হ্যাঁ নানু হ্যাঁ।”
“তাহলে তোর তো আরো বেশি খাতির-যত্ন করা উচিত। যা যা তাড়াতাড়ি কিছু বানিয়ে আন।”
নানীর কথা শুনে প্রিয়ার ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। কিন্তু প্রিয়া এটাই বুঝতে পারছেনা যে ছোট ভাইয়াকে এমন কি যাদু করলো বস! প্রিয়া চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
“আমি পারবোনা।”
“তুই তো দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস রে।”
“থাক নানী ওকে কিছু বলো না। ছোট মানুষ তো বুঝেনা।”
প্রিয়ার একদম পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিলো। ছোট মানুষ বলা হচ্ছে এখন।
“তুমি বসো ফাহাদ। আমি ওর মাকে বলে আসি কিছু দেওয়ার জন্য।”
ফাহাদ নানীকে আটকায়নি। তার কারণ এটা নয় যে ফাহাদের ক্ষুধা লেগেছে। নানী গেলেই প্রিয়াকে একটু একা পাবে ভেবেই ফাহাদ চুপচাপ বসে থাকে। নানী চলে যেতেই ফাহাদ খপ করে প্রিয়ার হাত ধরে ফেলে। প্রিয়া দাঁত কটমট করে বললো,
“এটা কেমন অসভ্যতা? আমার বাড়িতে এসে আমার রুমে বসেই হাত ধরছেন?”
“আমি কি তোমার হাত ধরেছি নাকি? আমি তো আমার বউয়ের হাত ধরেছি।”
“ঐ কে আপনার বউ হ্যাঁ?”
“কেন তুমি!”
“স্বপ্নই দেখে যান সারাজীবন।”
“হুম দেখিতো। তোমাকে নিয়ে হাজারও স্বপ্ন দেখি। একদিন ইনশাআল্লাহ স্বপ্ন পূরণও করবো।”
“আপনি আমার বাড়িতে ঢুকলেন কি করে?”
“তোমার ভাইয়াকে হাত করে। এই শুনো তুমি আমায় কি ভাবো? তোমাকে পাওয়ার জন্য শুধু তোমার পিছনে ঘুরঘুর করে যাবো? অত বোকাও নই আমি। আর তাই তো তোমার পরিবারকে আগে হাত করেছি। সবাই রাজি। এখন শুধু বিয়ের আয়োজনটাই বাকি।”
প্রিয়ার মাথা রাগে যেন ফেঁটে পড়ছে। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“এত্ত বড় সাহস ওদের! আমার মতামত ছাড়াই বিয়ে ঠিক করে? কার এত্ত বড় সাহস। কে দিয়েছে এই পারমিশন। তাকে তো আজ আমি দেখেই নিবো।”
ফাহাদ পেছন থেকে শক্ত করে প্রিয়ার হাত আঁকড়ে ধরে। প্রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,
“শান্ত হও! এত অল্পতেই রেগে যাচ্ছো? কেউ রাজি হয়নি তোমার বাড়ির। সবাই বলেছে তুমি রাজি হলেই বাড়ির সকলে রাজি হবে। আদারওয়াইজ তারা তোমাকে কোনো প্রেশার দিবেনা বা ফোর্স করবে না। আমার ধৈর্যও এত কম নয়। তুমি যেদিন আমায় ভালোবাসবে সেদিনই আমরা বিয়ের ব্যাপারে আগাবো। তার আগে নয়। তবে আমি তোমার পিছুও ছাড়ছিনা। যতবার ফিরিয়ে দিবে ততবারই বলবো ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি।”
.
.
আজ পৃথার জীবনে সবচেয়ে খুশির দিন। যাকে ভালোবাসে তার সাথেই আজ বিয়ে হবে পৃথার। প্রিয়া আজ সোনালি পাড়ের লাল জর্জেট একটা শাড়ি পড়েছে। তার সাথে মিলিয়ে হালকা মেকাপ। প্রিয়ার একদম ইচ্ছে ছিলো না এভাবে সাজার। বড় বোনের জোড়াজুড়িতে এভাবে সাজতে বাধ্য হয়েছে। পৃথার বিয়ের কারণে একদিকে প্রিয়া খুশি হলেও আবার মনও খারাপ হয়ে যায়। কারণ আজকের পর থেকেই পৃথা সম্পূর্ণ ব্যস্ত হয়ে পড়বে। অফিসে গিয়েই কারো সাথে আর গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসা হবেনা। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক্যান্টিনে বসে কফির আড্ডা দেওয়া হবেনা। ভাবতেই প্রিয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। পাশ থেকেই ফাহাদ এসে বলে,
“মন খারাপ?”
“না।”
“মিথ্যা বলছো কেন? আমি তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোমার মন খারাপ।”
প্রিয়া মনে মনে বললো,
“এই লোকটা কি মন পড়তে পারে নাকি?”
প্রিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ফাহাদ আবার বললো,
“পৃথার সাথে দেখা করেছো?”
“না।”
“কেন?”
“ওকে দেখলেই আমার কষ্ট লাগবে।”
“তাই বলে দেখবে না নাকি? পৃথা কখন থেকে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। চলো।”
ফাহাদ প্রিয়ার হাত ধরে উপরের রুমে নিয়ে যায়। প্রিয়া কিছুই বললো না। মনটা যে আজ বেশিই বিষণ্ণ। একটা রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো প্রিয়াকে নিয়ে। প্রিয়া ওখান থেকেই দেখলো, পৃথাকে কি অপরূপ সুন্দর লাগছে। শ্যাম বর্ণের এই মেয়েটি প্রচুর মায়াবী। ইচ্ছে করছে গালে চুমু দিয়ে বলতে সারাজীবন সুখে থাক আমার মায়াবী। পরক্ষণেই খেয়াল করলো প্রতিদিনের তুলনায় পৃথা আজ অনেক বেশিই খুশি। চোখেমুখে হাসির ঝলক। ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দটাই হয়তো অনেক। কিজানি! প্রিয়ার জানা নেই এর উত্তর। পৃথা এতক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলছিল তাই প্রিয়াকে খেয়াল করেনি। সামনে প্রিয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই পৃথা দৌঁড়ে এসে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে। এবার আর প্রিয়া নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। কেঁদে দেয়। সাথে পৃথাও কাঁদছে। পরিচয়টা হয়তো অল্প সময়ের কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা অনেক। ফাহাদের নিজেরও অনেক খারাপ লাগছে। তাই পরিস্থিতি সামলাতে বললো,সবার আগে আমার গল্প পড়তে চাইলে “নীল ক্যাফের ভালোবাসা” পেজে পাবেন।
“এই এই কি করছো পৃথা? প্রিয়ার ফাঁদে পা দিয়ো না একদম। ও তোমাকে কাঁদাচ্ছে কেন জানো? যাতে তোমার মেকাপ চোখের পানিতে নষ্ট হয়ে যায় আর তোমাকে দেখতে বিচ্ছিরি লাগে।”
প্রিয়া দুম করে ফাহাদের পিঠে কিল বসিয়ে দেয়।
“আমার পৃথা কি মেকাপ সুন্দরী নাকি? ওকে মেকাপ ছাড়াও অনেক অনেক সুন্দর লাগে।”
সবাই ওদের কাণ্ড দেখে হেসে দেয়। প্রিয়া চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,
“তুই অনেক স্বার্থপররে পৃথা। আমাকে একা করে তুই বিয়ে করে নিচ্ছিস”
পৃথা উত্তর দেওয়ার আগে ফাহাদ বললো,
“আরে এই জন্য কষ্ট পাওয়ার কি আছে? চলো তুমি আর আমিও পৃথার সাথে বিয়ে করে নিই। তুমি তো লাল শাড়ি পড়েই আছো আর আমিও অফ-হোয়াইট কালার পাঞ্জাবি পড়েছি। হয়েই তো গেছে বিয়ের সাজ।”
“আমি মোটেও এই সাজে বিয়ে করবো না! আমার অন্যরকম ইচ্ছে আছে।”
“তাই? শুনি সেটা কি?”
“আপনাকে বলবো কেন? আমি কি আপনাকে বিয়ে করবো নাকি?”
“তো কাকে করবে?”
“আমি বিয়েই করবোনা।”…

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here