তুমি কোন কাননের ফুল, পর্ব:৯+১০

0
678

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#নবম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

নয়নতারার হুট-হাট কল রেখে দেয়ার ব্যাপারটায় আদনান অভ্যস্ত। কোনদিনই মেয়েটা শেষ অব্দি কথা বলে না। শেষ অব্দি কথা বলাটা বোধহয় তার নিয়মে নেই। এর আগেও বহুবার এমন হয়েছে। সেকেন্ড টাইম আর কল দিলেও ধরবে না। ‘ভালো আছি, কেমন আছেন’ অব্দি-ই তার কথা বলার সীমাবদ্ধতা। আদনান বহুবার কথা আগানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু বারংবারই ব্যার্থ হয়েছে। যেন কথা আরেকটু আগালেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে! মাঝে-মধ্যে ভাবে, ‘মেয়েটা এমন কেন? কি হয় একটু কথা বললে?’
আবার ভাবে, মেয়েটা এমন বলেই হয়তো সে অন্যদের চাইতে একটু আলাদা। তার এই ব্যাতিক্রমী স্বভাবগুলোই তাকে সবার চাইতে আলাদা করে দিয়েছে। ভালো লাগার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।
অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বা’হাত দিয়ে গোছানো চুলগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ করে ধরে আদনান। ডান হাতে নয়নতারার ফেলে আসা রবীন্দ্রনাথ এর বই। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে বইটার দিকে চেয়ে থেকে ভাবে,
এই ছোট্ট পৃথীবি’টায় সবার বুঝি একটা অপ্রাপ্তির গল্প থাকে! কিছু সুন্দর স্মৃতিতে ঘেরা অপূর্ণতার মায়াজাল! এই গল্পগুলোতে বেশিরভাগ সময় ‘পাওয়ার আশা করতে করতে, না পেয়েই এক জীবন কেটে যায়!’
কি অদ্ভুত!
আদনানের চোখে ভাসে নয়তারার মুগ্ধতায় জড়ানো সেই প্রথম দিনের কথা…..
ছোট্ট ফুলের মতো সুন্দর একটা মেয়ে। সাদা রঙ এর চুড়িদার পরা, দুই হাত দিয়ে শক্তপোক্ত ভাবে ধরে রাখা একটা পাখি সমেত পাখির খাঁচা।, চুলগুলো কাধ অব্দি ছড়ানো এক কিনারে সিঁথি কাটা, মুখটা গুরুগম্ভীর! ভ্রু জোড়া সামান্য কুঞ্চিত করা, হাসিহীন ফর্সা পাতলা সেই মুখটা উপেক্ষা করার সামর্থ্য আদনানের ছিলো না। আজও আছে কি?

“ভাইজান? কই নামবেন? আরো সামনে যামু নাকি এইহানেই নামবেন?”
রিকশাওয়ালার ডাকে ভ্রম কাটলো ছেলেটার। নরম কন্ঠে বলল,
“এখানেই রাখো।”
রিকশা থেকে নামতেই একটা উত্তেজিত ডাক ভেসে আসলো,
“হ্যালো ভাইয়া!”
আদনান ডাকটার উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করলো, নয়না ডাকছে দু’তলার বারান্দা থেকে। আদনান তাকাতেই নয়না হাত নাড়িয়ে বলল,
“ওয়েট, ভাইয়া। আমি আসছি।”
দুই মিনিটের মাথায় ঝড়ের গতিতে এসে উপস্থিত হলো নয়না। এক হাত পেটে, এক হাত গলায় রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“কেমন আছো ভাইয়া?”
নয়নতারার সাথে সাথে ওর বোন দুইটাকেও বেশ পছন্দ করে আদনান। ক্লাস নাইন-টেনে পড়ুয়া মেয়ে দুটোর চঞ্চলতাই পছন্দের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে তরতর করে। আদনান এক গাল হেসে নিয়ে বলল,
“আরেহ ময়নার মা যে! আমি ভালো আছি, তুমি কেমন আছো ময়নার মা? তোমার ময়না কিরাম আছে? খানা-টানা দেও তো ঠিক মতো? ময়নার বাপ কই?”
নয়না গাল ফুলিয়ে বলল,
“ভাল্লাগে না ভাইয়া। আমাকে ময়নার মা-টয়নার মা বলবা না। কেঁদে দিবো কিন্তু।”
আদনান আওয়াজ করে হাসলো। কুটল দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,
“আরে বাহ! ময়নার সাথে টয়না যোগ হলো কবে? এই সুখবর তো পাই নি! বাই দ্যা ওয়ে, নাইস নেইম কিন্তু!”
এই পর্যায়ে নয়নাও হেসে ফেললো। হঠাৎ হাসি থামিয়ে গম্ভীর হয়ে গেলো। শীতল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি ছাড়া আরো একজন আমাকে এমন করে ডাকতো, জানো ভাইয়া? তোমাকে যেমন পছন্দ করি, তাকেও তেমন পছন্দ করতাম। স্যরি, করতাম না, করি! এখনও খুব পছন্দ করি।”
আদনান চট করে বুঝে ফেললো কার কথা বলছে মেয়েটা। তবুও জিজ্ঞেস করলো,
“কে সে?”
নয়না যেন বাস্তবে ফিরে এলো। স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে বলল,
“কই? কারো কথা বলছি নাহ! আসো, বাসায় আসো।”
আদনান চমৎকার করে হাসলো। এক হাতে বইটা ধরে রেখে অন্য হাত পকেটে ঢুকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
“উমম, আচ্ছা এটা বলো, সে কি আমার থেকে অনেকটুকু বেশি ভালো?”
নয়না এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ালো। যার অর্থ ‘না’।
আদনান ঠোঁটে হাসি রেখে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাতেই নয়নার সহজ-সরল সিকারক্তি,
“তোমার থেকে একটু বেশি ভালোবাসি। রাগ করো না প্লিজ। এই একটু বেশি, অনেকটুকু বেশি না। সত্যিই বলছি।”
আদনান হাসি চেপে রেখে, বেশ ভাব নিয়ে বলল,
“সত্যি-মিথ্যে বুঝি না। আমাকে খুশি করার জন্য একটু মিথ্যেও তো বলতে পারতা, না?”
নয়না মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“আপু বলেছে, ‘মিথ্যে বলে খুশি করানোর চাইতে, সত্যি বলে অখুশি করানো উত্তম।’ রাগ করো না প্লিজ।”
আদনান চোখেমুখে অসন্তোষ ভাব ফুটিয়ে বলল,
“তোমার আপু একটা ফাও কথা বলেছে। উমম, হবে না। রাগ করেছি। ছেলেটাকে একটু বেশি ভালো কেন বাসতে হবে? আমাকে একটু বেশি ভালো বাসা যায় না? রাগ হয়েছি খুব।”
নয়না যেন মহা বিপদে পড়ে গেলো। চোখ পিটপিট করে ঠোঁট উল্টে দাঁড়িয়ে রইলো। সত্যি কথা বলতে গিয়ে মহা যন্ত্রনায় পরে গেলো।
আদনান আড়চোখে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। ছোট মেয়েটাকে বিপদে ফেলে সে খুবই মজা পেয়েছে। সাথে সাথেই উপর থেকে একটা মিষ্টি গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো,
“এই নয়না? বাহিরে দাঁড়িয়ে কি কথা বলছিস? ম্যানার জানিস না? ভেতরে আসতে বল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘হা হা-হি হি’ করলে মানুষ কি বলে, হুম?”
গলার স্বর একটু নিচে নামিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বলে,”হাসির বাজার বসিয়েছে যেন। ডিসগাস্টিং!”
নয়না আর আদনান দুজনই উপরে তাকালো। নয়না আমতা আমতা করে বলল,
“বলেছি তো আপু। তুমি অজথাই আমাকে বকা দিচ্ছো। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে দেখ, বলেছি কি-না। এই ভাইয়া? বলেছি না, বলো?”
আদনানের হাসিটাকে ভেঙানোতে হালকা লজ্জা পেলো ছেলেটা। মুখটা কাঁচুমাচু করে সদ্য গজানো দাড়িগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ বলেছে। রাগ করবেন না নয়নতারা। ঘন ঘন রেগে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই না নয়না?”
নয়না উপর-নিচ মাথা নেড়ে তীব্র সম্মতি জানালো।
দু’হাতে বারান্দার গ্রিল ধরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো নয়নতারা। আদনানের কথাতে বিরক্তি বেড়েছে বৈ কমেনি। প্রয়জনের তুলনায় বেশি কথা বলে ছেলেটা। তার উপর আদনানের এই “ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না” টাইপ স্বভাবটা বড়ই বিরক্তিকর।
নয়নতারা বিরক্তিটা বোধহয় আদনান ধরে চটজলদি ধরে ফেললো। মুখে হাসির রেখা টেনে বলল,
“আপনি এই বইটা রেখে এসেছিলেন। সেটাই দিতে এসেছি।”
নয়নতারা বইটার দিকে দৃষ্টি ফেলে ব্যস্ত গতিতে বলে,
“এই? ঐখানেই দাঁড়ান, আমি আসছি। যাবেন না কিন্তু।”
কথাটুকু বলেই মেয়েটা বারান্দা থেকে উধাও হয়ে গেলো।
নয়না ভিতু ভিতু মুখ করে বলল,
“বাপরে, আপু বোধহয় ভয়ানক রেগে গিয়েছে। আমি যাই বাবা। তুমি থাকো ভাইয়া। টা টা, আল্লাহ হাফেজ, পরে কথা হবে।”
আদনান কিছু বলার আগে নয়নাও উধাও! আদনান আনমনে বলে,’হলো কী মেয়গুলোর! সব এমন ঠুসঠাস উধাও হয়ে যাচ্ছে ক্যান! এটা কি ঘূর্নিঝড় আসার পূর্ব লক্ষণ?’

ভাবনা শেষে সামনে তাকাতেই দেখলো, নয়নতারা দাঁড়িয়ে আছে। ভ্রুগুলো বরাবরের মতোই কুঞ্চিত। আদনান ভ্রু উঁচিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,
“কি সাংঘাতিক লুক! মারবেন নাকি? এমন ‘মহারানী ভিক্টোরিয়া’ টাইপ লুক দিলে ভয় লাগে তো।”

নয়নতারা শত চেষ্টা করেও হাসি আটকাতে পারলো না। ফিক করে হেসে ফেললো। মুখের উপর এক হাত চেপে হাসি থামানোর ব্যার্থ চেষ্টা। আটকানোর চেষ্টায় ব্যার্থ হয়ে অনবরত হেসে যাচ্ছিল। অন্যদিকে যে একজোড়া বিমোহিত দৃষ্টি তার দিকে তাক করে আছে, সেদিকে কোনো হুশই নেই! মেয়েটাকে বোধহয় এই প্রথম হাসতে দেখলো। ইশ! না দেখাটাই উত্তম ছিল। কারো হাসি এমন দম বন্ধ করা অনুভূতি তৈরি করতে পারে, তা একেবারেই ধারনাতীত ছিলো। উফফ, অসহ্য! আদনান দুই ঠোঁট চেপে রেখে ঘন নিঃশ্বাস নিলো। কি আশ্চর্য! গলা-টলা শুকিয়ে যাচ্ছে ক্যান এমন!
নয়নতারা হাসি থামিয়ে পুনরায় গম্ভীর হয়ে হাত বাড়িয়ে বলল,
“কই? দিন আমার বই!”
হুট করে এমন হেসে ফেলায় নয়নতারা নিজেও বিব্রত বোধ করলো। ঠিক কতদিন পর এভাবে হাসলো তাও মেয়েটার অজানা।
আদনান অন্যমনস্ক হয়ে বলল,
“হুম?”
“আজব তো! কি হুম? আকাশ থেকে পড়লেন যেন! বই দিন।”
আদনান নয়নতারার হাতে বই দিয়ে ব্যস্ত গতিতে স্থান ত্যাগ করলো। নয়নতারা এতবার ডাকলো, ‘এই যে, এই? বাসায় না এসে চলে যাচ্ছেন যে? এই যে শুনছেন?’
উঁহু কোনো ডাক-ই যেন ছেলেটার কান অব্দি পৌঁছায়নি!
নয়নতারা দাঁত কিড়মিড় করে ভাবে, “অদ্ভুত! কালা-টালা হয়ে গেলো নাকি লোকটা? সব দেখি ম্যানারলেস! ডাকলেও সাড়া-টারা দেয় না। হনহনিয়ে চলে যায়। অভদ্র!”

#তুমি_কোন_কাননের_ফুল
#দশম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া

আদনান চলে যাওয়ার পর নয়নতারার নজর হাতের বইটার দিকে গেলো। হাত বুলালো বইটাতে। চোখ বুজে বইটা বুকে জড়িয়ে ধরলো।
আরজুর থেকে এক প্রকার জোড় করেই বইটা নিয়েছিলো। বেশিরভাগ কাব্যিক কথা আরজু এই বইটা থেকেই সংগ্রহ করে বলতো। এ কথা ও নিজেই বলেছে নয়নতারাকে। নয়নতারা সেদিন ঠোঁট উল্টে বলেছিলো,
“আচ্ছা? আপনি তো বোধহয় বই পড়েন অনেক। আর আমার জানামতে যারা বই পড়ে তারা এমনিতেই সাহিত্যমনা হয়। কপি করার প্রয়জনই পড়ে না। আপনি এমন অদ্ভুত ক্যান! কাউকে যে কপি করে চিঠি দেয়া যেতে পারে তা আপনাকে দেখে জেনেছি। নাম্বার ওয়ান আজব প্রাণী!”
আরজু খটখট করে হেসে জবাব দিয়েছিলো,
“আমি বই পড়ি ঠিক কিন্তু সাহিত্যিক বই পড়ি না ফুলটুসি। এই একটাই সাহিত্যের বই আমার। তাও তোমাকে পটানোর জন্য কিনেছিলাম! হা হা হা!”
সেদিন সেই অসহ্যকর জ্বালা ধরানো হাসি সইতে না পেরে বইটা সাথে করে নিয়েই স্থান ত্যাগ করেছিলো নয়নতারা। আরজু বাঁধা দিয়ে বলেছিলো,
“আরে আরে! কই যাও ফুলটুসি? আমার বই ছিনতাই করবা নাকি?”
নয়নতারা মুখ বাঁকিয়ে বলেছিলো,
“আপনার কাছে এই বই থাকা মানে বইয়ের অপমান করা। কিছুতে রাখা যাবে না আপনার কাছে এই বই। এটা আজ থেকে আমার, হুহ।”
আরজু হেসে বলেছিলো,
“এত সাহিত্যিক বই পড়েও তো মুখ দিয়ে প্রেম প্রেম কথা বের হয় না! যাও যাও, নিয়ে যাও। দেখ যদি কাজে লাগাতে পারো। এমন আছে হুট করে প্রেম প্রেম পেয়েও যেতে পারে।”
পুরোনো কথা মনে পড়ে অজান্তেই হেসে ফেললো নয়নতারা।
হঠাৎ কি মনে হতে তড়িত গতিতে বইটার পৃষ্ঠা গুলো উল্টাতে লাগলো। যেন মহামূল্যবান কিছু আছে বইটাতে। একেরপর এক পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টেও তার সেই কাঙ্খিত জিনিসটা না পেয়ে মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠলো। অস্থিরতা আকাশচুম্বী হয়ে উঠতেই ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। আর সেই ক্রোধের তীরটা গিয়ে পড়লো আদনানের উপর। রাগে মেয়েটার হাত-পা কাঁপছে রীতিমতো। ফোন খুঁজে আদনানের নাম্বারে কল লাগালো। প্রথম রিং এ কল উঠালো না। আবার কল লাগালো। তিনবারের মাথায় ফোন উঠালো আদনান। নয়নতারার বিক্ষিপ্ত ক্ষোভ,
“এই যে? কি সমস্যা আপনার?”
আদনানের শিতল শিকারক্তি,
“আ’ম স্যরি। একচুয়ালি ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। ফ্রেস হচ্ছিলাম।”
“এই শোনেন? আপনার কাছে বিস্তারিত বয়ান শুনতে চাচ্ছি না। আপনি যা ইচ্ছা করেন, তা দিয়ে আমি কি করবো? আপনি আমার সাথে এক্ষুনি দেখা করুন। এক্ষুনি মানে এক্ষুনি, ফাস্ট।”
আদনানের কপাল কুঁচকে এলো। বিস্ময় চেপে রেখে হালকা হেসে জবাব দেয়,
“একটু আগেই না আসলাম? খুব আর্জেন্ট দরকার কি?”
মাত্রাতিরিক্ত রাগ হলে মেয়েটা কথা বলতে পারে না। এই পর্যায়ে এসেও হলো তাই। যার ফল স্বরূপ কথা না বাড়িয়ে ফোন কেটে দিলো। ও জানে আদনান আসবে। ফোন কেটে পুনরায় বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাতে আরম্ভ করলো।
অপরদিকে আদনানের বুঝে আসলো না, হঠাৎ আবার কী হলো মেয়েটার! চটজলদি একটা টিশার্ট পরে বেড়িয়ে পড়লো বাসা থেকে।
বের হওয়ার সময় পেছন থেকে ডাক এলো,
“কিরে পাগল? আবার কই যাস? একটু আগেই না এলি? পা দু’টোকে একটু নিস্থার দে। ইশশ! চুলগুলো তো ভেজা বেড়াল হয়ে আছে! কি বিচ্ছিরি আর জঘন্য দেখতে লাগছে জানিস?”
আদনান কপাল কুঁচকে পেছনে তাকায়। দেখে, দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে স্নিগ্ধা দাঁড়িয়ে আছে। নিজের নামের মতোই স্নিগ্ধ দেখতে সে। এই অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটার চোখেমুখে খানিক বিদ্রুপের ছোঁয়া।
আদনান এক পলক তাকালো যথেষ্ট বিরক্তির সহিত। কিন্তু মেয়েটার সাথে কোনোরূপ কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
পাশাপাশি বিল্ডিং হওয়ার ফলশ্রুতিতে দু’মিনিটের মাথায় নয়নতারাদের গেইটে এসে উপস্থিত হলো আদনান। এসে দেখলো উদভ্রান্তের মতো কিছু একটা খুঁজছে বইয়ে। আদনান নিজের ভেজা চুলগুলোকে পেছনে ঠেলে সামলে নিলো। নয়নতারার কাছে এসে হাসিহাসি মুখ করে বলে,
“হাই! কোনো সমস্যা নয়নতারা? এতো আর্জেন্ট ডাক!”
নয়নতারা চোখ তুলে তাকায়। চোখেমুখে তার একরাশ বিতৃষ্ণা। ফুঁসে উঠে বলে,
“সমস্যা আমার নাকি আপনার, হুম? আপনি আমার বই ধরেছেন কেন? পারমিশন ব্যাতিত কারো কিছু ধরা যে অভদ্রতা, তা জানেন না? মিনিমাম এই জ্ঞানটুকু নেই? সাধারন এই জ্ঞানটুকু যার নেই, তাকে সব বলে ফেলে মস্তবড় ভুল করে ফেলেছি। আপনাকে ভালো ভেবে খুব ভুল করেছি আমি।”
আদনান ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে গেলো। নয়নতারার হঠাৎ এমন অদ্ভুতুড়ে আচরণের কারন খুঁজে না পেয়ে বলে,
“আপনি রেগে আছেন বোধহয়। আপনার বই তো ইচ্ছে করে ধরিনি নয়নতারা। ফেলে এসেছিলেন তাই ধরেছি। এটা অভদ্রতার ভেতর পরে কিনা জানা নেই। হোয়াটএভার, আ’ম স্যরি। রিয়েলি ভেরি স্যরি।”

নয়নতারা নিজেকে সামলে নেয়। কপালের উপর হাত রেখে চোখ বুজে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“আই এম স্যরি। আমার চিরকুট টা দিন।”
আদনান বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলে,
“চিরকুট! কিসের চিরকুট?”
নয়নতারা আবারও রেগে যায়। চেঁচিয়ে বলে,
“ফাইজলামি করছেন আমার সাথে? আপনি না জানলে কে জানবে? আর কেউ ধরেছে আমার বই? প্লিজ স্টপ ইউর ড্রামা। আই ক্যান্ট টলারেট।”
বলেই মুখে হাত রেখে কেঁদে ফেলে।
আদনান অসস্তিতে পড়ে যায়। নত স্বরে বলে,
“ট্রাস্ট মি, আমি সত্যিই….”
আদনান বুদ্ধিমান। পুরো কথা আর শেষ করার প্র‍য়জন পড়েনি। তার আগেই সে বুঝে ফেলে এই বইটায় নিশ্চই আরজুর দেয়া কোনো চিরকুট ছিলো। সেটা না পেয়েই মেয়েটা অস্থির হয়ে উঠেছে।
ততক্ষণে নিচে নেমে এসেছে নয়নতারার মা। একবার আদনানের দিকে তাকায়। তারপর নয়নতারার দিকে তাকিয়ে বলে,
“কী হয়েছে নয়ন? এমন বেয়াদপের মতো করছিস কেন? ছেলেটাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রাখছিস কেন?”
আদনানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাসায় আসো বাবা।”
নয়নতারা কিড়মিড় করে তাকায় মায়ের দিকে। আদনান লক্ষ্য করে সব। নয়নতারার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“এখন না আন্টি। ওনাকে বাসায় নিয়ে যান। আমি আসছি।”
বলেই চোখের পলকে উধাও হয়ে গেলো আদনান। নয়নতারা ও ছুটে নিজের রুমে চলে আসে। বইটাকে বুকে চেপে কাঁদে। ছোট বেলার অবহেলিত জিনিসগুলো নিয়ে এভাবে কখনো কষ্ট পেতে হবে, তা কি ভেবেছিলো মেয়েটি?
.
সন্ধ্যার পর ছাদে আসে নয়ন। একধারে ডালপালা মেলে ফুটে ওঠা নয়নতারা গাছটার দিকে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে। এই বাড়িতে আসার পরই গাছটা লাগিয়েছিলো। গাছ ভরে যখন ফুল ফোঁটে তখন আরজুর মতো করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘সুন্দর ফুল!’
মনটা বিষন্ন হয়ে উঠে। চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসে। মৃদু বাতাসটাও যেন কানে কানে বলে, ‘মন খারাপ, মন খারাপ!’
“আপনার মনটা কি খুব বেশি খারাপ?” পুরুষালী কন্ঠে নয়নতারা চমকে উঠে। চোখ মুছে পেছন ফিরে তাকায়। কালো টি-শার্ট আর টাউজার পরিহিত পুরুষটাকে এক পলক দেখে পুনরায় ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ায়।
আদনান বুঝতে পারে তার উপর তৈরি হওয়া চাপা ক্ষোভটা একটুও কাটেনি। সেও নয়নতারার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তবে রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। পিঠটা রেলিং এর সাথে লাগানো আর মুখটা নয়নতারার দিকে তাক করা। মুখ তার হাসি হাসি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকে বলে,
“এই মূহুর্তে আরজু থাকলে কি বলতো জানেন?”
আদনানের মুখে আরজুর নাম শুনে হকচকিয়ে তাকায় নয়নতারা। ভ্রু জোড়া সামান্য কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আদনান খুব সুন্দর করে হাসে। মেয়েটা একটু হকচকিয়ে দিতে পেরে তার হাসির রেখা আরো বিস্তৃত হয়।
আরজু হয়তো রবীন্দ্রনাথ এর মতো করেই বলতো,
“প্রিয়ারে বেসেছি ভালো
বেসেছি ফুলের মঞ্জুরিকে;
করেছে সে অন্তরতম
পরশ করেছে যারে।”

এইটুকু বলে থামে আদনান। নয়নতারা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
আরো খানিকটা অবাক করতেই বোধহয় টাওজারের পকেট থেকে চিরকুট টা বের করে নয়নতারার সামনে ধরে।
চিরকুট টা দেখা মাত্রই চিনে ফেলে নয়নতারা। খপ করে ছিনিয়ে নেয় তার অতি প্রিয় জিনিসটা। কর্কশ কন্ঠে বলে,
“আপনি নাকি জানেন না? কই পেয়েছেন তাহলে?”
আদনানের ছন্নছাড়া উত্তর,
“পেয়েছি কোথাও একটা।”
“আপনি পড়েছেন আমার চিরকুট?”
আদনান রহস্যময় হাসে। নয়তারার কাছে ঝুঁকে বলে,
“আমি এতোটাও অভদ্র না, মিস. নয়নতারা। এমনিতে বই ধরে অনেকটা অভদ্রতামী করর ফেলেছি। চিরকুট পড়ে তার মাত্রা বাড়াতে ইচ্ছে করে নি।”
নয়নতারা আর অন্যসব কথায় মন দিলো না। নিজের কাঙ্খিত জিনিস পেয়েই খুশি সে।

প্রিয় মানুষদের খুশি দেখতে পারার চাইতে আনন্দ আর কিছুতে আছে কি? আদনানের উত্তর, ‘না, নেই নেই নেই। হতেই পারে না।’
তৃপ্তি নিয়ে নয়নতারার সুন্দর মুখশ্রীটার দিকে তাকিয়ে থাকে। হুট করেই মেয়েটাকে একটু রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছে থেকেই তাচ্ছিল্য নিয়ে বলে,
“ইশশ! এই সামান্য একটা কাগজের জন্য এভাবে কেঁদেকেটে সারা জগৎ ভাসায় কেউ?”
নয়নতারা সত্যি সত্যি রেগে যায়। কিন্তু ছেলেটাকে কিছু বলে না। মুখ বাঁকিয়ে সে তার চিরকুট নিয়ে নিচে চলে আসে। কিভাবে পেলো, কোথায় পেলো তা জানার প্রয়জনই বোধ করে নি।
নয়নতারার মুখ ভেঙনো দেখে আদনান হো হো করে হেসে ফেলে। পেছন থেকে ডেকে বলে,
“বাহ! আপনি দেখি খুব চমৎকার ভেঙাতে পারেন! আই জাস্ট লাভ ইট মিস. নয়নতারা। হা হা হা।”
.
নয়নতারাদের বাসা থেকে বেড়িয়ে মহল্লার চায়ের টংটায় কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় আদনান। ছুটির দিন তাই অনেকেই আসে চা খেতে খেতে গল্পগুজব করতে। রাত দশটার দিকে বাড়ি ফেরে আদনান। দরজা খোলে স্নিগ্ধা। আদনান জুতা খুলতে খুলতে বলে, “কিরে পাগলনী? মুখটা এমন হনুমানের মতো করে রেখেছিস কেন? কপালটাকে দেখে তো মনে হচ্ছে, কেউ তিন ভাঁজ করে সেলাই করে দিয়েছে।”

স্নিগ্ধা কিছু না বলে ভেতরে চলে যায়। আদনান বুঝতে পারে, এই মেয়ে নিশ্চই কোনো কিছু নিয়ে আবার অভিমান করেছে। দিনে দু’বেলা ঢং করতে না পারলে মেয়েটার পেটের ভাত হজম হয়না বোধহয়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে আপন মনে বলে,”আবেগের ডিব্বা একটা। ড্রামা কুইন!”
সোফায় হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে স্নিগ্ধাকে ডেকে বলে,
“এই ড্রামা কুইন? এক গ্লাস পানি দে জলদি। দেখছিস না হাঁপিয়ে গিয়েছি।”
স্নিগ্ধা কর্ণপাত করলো না মোটেও। পা নাড়াচ্ছে, হাত নাড়াচ্ছে। আপন মনে টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছে।
আদনান কপট রাগ নিয়ে স্নিগ্ধার মাথায় চাটি মারলো। খ্যাঁক করে উঠে বলল,
“এই বেয়াদপ? কানের মাথা খেয়েছিস? কথা কানে যায় না? বড়দের সম্মান দিতে শিখিসনি? কই পানি-টানি এগিয়ে দিবে, তা না সে হেলেদুলে টিভি দেখছে। ফাজিল! দিবো এক থাপ্পড়।”
চাপা রাগটা এবার ফুলেফেপে উঠলো স্নিগ্ধার। কোলের কুশনটা ছুড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে যায়। রাগে কটমট করে চেঁচিয়ে বলে,
“ফুপি? এই ফুপি? তোমার ছেলেকে কিছু বলবা? কি পেয়েছে কি সে, হুম? এসব কোন ধরনের ফাজলামো? যখন যা ইচ্ছে তাই করে! আমাকে কি মানুষ মনে হয়না, নাকি? এখানে থেকে পড়াশোনা করি বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে আমার? এমন হলে, আর একদিনও থাকবো না এই বাসায়। অনেক হয়েছে! আর না। কালই চলে যাবো আমি।”…….(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here