” তূর্ণ ভাইয়া তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? ”
আমার প্রশ্নে কিঞ্চিৎ চমকালেন বুঝি। কিন্তু শব্দমালায় প্রকাশ করলেন না। উত্তর না পেয়ে আমি ঈষৎ বিরক্ত বোধ করলাম। খানিকটা উঁচু গলায় বলে উঠলাম,
” তুমি এমন কেন বলো তো? প্রতিবার পাত্রী দেখতে গিয়ে কোনো না কোনো কাণ্ড ঘটাও। সত্যি করে বলো তো তুমি কি চাও? চিরকুমার ক্লাবের সভাপতি হতে চাও? নাকি কাউকে ভালোবাসো? ”
আমার লম্বা প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই বাজখাঁই কণ্ঠে ধমক দিলেন উনি। যাতে কম্পন অনুভূত হলো আমার তনুমনে। নিমিষেই মিইয়ে গেলাম আমি।
.
আজ পাত্রী দেখতে এসেছি। তূর্ণ ভাইয়ার জন্য। পাত্রীর নাম নয়না। নয়না আপু দেখতে মাশাআল্লাহ! নীলাভ রঙা জামদানী শাড়ি পরিহিতা এই আপুটিকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার ভাবী হিসেবে একদম পারফেক্ট। কিন্তু আফসোস! যার জন্য পাত্রী দেখতে আসা তার ই তো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। মহাশয় এক মনে তার ডান হাতের নখ খুঁটে চলেছে। একটিবারের জন্য নয়না আপুর দিকে তাকায়নি অবধি। এটা কোনো কথা হলো! উপস্থিত সকলের চোখ এড়িয়ে আমি আমার বাম পাশে বসে থাকা তূর্ণ ভাইয়ার হাঁটুতে গুঁতো দিলাম। এই নিয়ে বেশ কয়েকবার গুঁতো মা|রা শেষ। কিন্তু ফলাফল শূন্য। আমার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে তিনি প্রতিবার ই আমায় চোখ রাঙিয়ে দিলেন। আর এই চোখ রাঙানি দেখে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ! কিউট কিউট মুখটা ছোট্ট হুতুম পেঁচার মতো করে বসে রইলাম। ধুৎ! এই তূর্ণ ভাইয়াটা না প্রতিবার ই এমন করে। আমার হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়। ভাল্লাগে না।
নয়না আপুর বাবা হাসিমুখে বললেন,
” মাশাআল্লাহ! ছেলে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে। এবার ছেলেমেয়েরা চাইলে আলাদা করে কথা বলতে পারে। এখনকার জেনারেশনে এটা তো কমন ব্যাপার। তাই না? ”
এতক্ষণে মুখ খুললেন তূর্ণ মহাশয়। নখ থেকে চক্ষু সরিয়ে দাঁত বের করে অতি সুন্দর একটা হাসি উপহার দিয়ে বললেন,
” হাঁ আংকেল। আপনি একদম ঠিক বলেছেন। তবে একটা কথা আছে। আ আসলে আমার না পাত্রী পছন্দ হয়নি। তাই কথাবার্তা… ”
তূর্ণ ভাইয়া তার কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না। এর মধ্যেই বড় খালু বিস্মিত হয়ে বলে উঠলেন,
” পছন্দ হয়নি! কিন্তু কেন? ”
বেশরম এর মতো তূর্ণ ভাইয়া বললেন,
” পাত্রীর দাঁত বাঁকা। হাসলে বাজে লাগে। ”
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম আমরা সকলে! ভাইয়া এসব কি বলছেন! নয়না আপু তো এখন অবধি সেভাবে কথাই বলেনি। উনি হাসতে দেখলেন কখন? আর নখ খুঁটা বাদ দিয়ে তাকালেন ই বা কখন? আজব তো! আর এভাবে কেউ মুখের ওপর বলে নাকি? ছিঃ! কি একটা অবস্থা! খেয়াল করলাম নয়না আপুর সুন্দর মুখশ্রী কেমন মলিন হয়ে গিয়েছে। আংকেল, আন্টিও বোধহয় কষ্ট পেয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক নয় কি? নিঃসন্দেহে এটা পাত্রী পক্ষের জন্য অপমানজনক! তূর্ণ ভাইয়ার ডান পাশে বসে থাকা বড় খালামণি অর্থাৎ তূর্ণ ভাইয়ার মা ক্ষীণ স্বরে তাকে বললো,
” তূর্ণ! এ কেমন বেয়াদবি! এভাবে কেউ বলে নাকি? ”
তূর্ণ ভাইয়াও ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলেন,
” আমার পাত্রী পছন্দ হয়নি। তা বলবো না? ”
” এভাবে বুঝি কেউ বলে? ”
তূর্ণ ভাইয়া বিরক্ত বোধ করে বললেন,
” আমি এভাবেই বলি। ”
উনি এবার দাঁড়িয়ে আংকেল, আন্টির উদ্দেশ্যে বললেন,
” আংকেল, আন্টি! আপনারা দুঃখ পেয়ে থাকলে আ’ম রিয়েলি সরি। কিন্তু সত্যি এটাই যে আমার পাত্রী পছন্দ হয়নি। তাই মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারলাম না। ক্ষমা করবেন। আজ তাহলে আসছি। আসসালামু আলাইকুম। ”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনি আমার বাঁ হাত ধরে দাঁড় করালেন। বললেন,
” পুতুল চল। ”
আমি কিছু বলতে যাবো কিন্তু ব্যর্থ হলাম। ততক্ষণে উনি আমার হাত ধরে বড় বড় কদম ফেলে হাঁটতে লাগলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ফ্লাট থেকে বেরিয়ে গেলাম আমরা দু’জনে।
আমার হাত টেনে সিঁড়ি বেয়ে নামছেন উনি। আমি অনবরত বলে চলেছি,
” তূর্ণ ভাইয়া! এটা কি করছো? আমার হাতটা ছাড়ো। ওনারা কি মনে করলেন বলো তো? এভাবে কেউ টেনে নিয়ে আসে? ”
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে উনি উত্তর দিলেন, ” আমি নিয়ে আসি। ”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ” তোমার সমস্যা কোথায় বলো তো? আজও পাত্রী রিজেক্ট করলে! এ-ই তুমি তো পুরোটা সময় নখের মধ্যে ধ্যান জ্ঞান দিয়ে বসেছিলে। আর নয়না আপু তো একবারের জন্যও হাসেনি। তাহলে তুমি কি করে জানলে নয়না আপুকে হাসলে বাজে দেখায়? তার দাঁত বাঁকা? ”
হাঁটা থামিয়ে পিছু ঘুরে আমার দিকে তাকালেন তূর্ণ ভাইয়া। দু ভ্রুর মধ্যিখানে ভাঁজ ফেলে বললেন,
” নয়নার চামচা হয়ে গেছিস! আর একবার আমার সামনে ওর নাম জপ করেছিস তো এক ধাক্কায় সোজা গ্রাউন্ড ফ্লোর পৌঁছে যাবি। আচ্ছা না? ”
আল্লাহ্! কি ভ’য়ানক হুমকি! এ মানুষ না অন্য কিছু? আমি বাপু আর মুখ খুললাম না। ওনার টানাহেঁচড়ায় নিচে নামতে লাগলাম। হাতে টান লেগে ব্যথা অনুভূত হলো। মৃদু স্বরে বলে উঠলাম,
” তূর্ণ ভাইয়া কি করছো? এভাবে গরুর মতো টানাহেঁচড়া করছো কেন? ছাড়ো আমাকে। আমার লাগছে। ”
কিন্তু মহাশয় শুনলেন ই না। টানতে টানতে নিচে নিয়ে গেলেন। হাঁটতে হাঁটতে পুনরায় এক বুক সাহস সঞ্চয় করে বলে উঠলাম,
” ও তূর্ণ ভাইয়া! নয়না আপুকে রিজেক্ট করলে কেন? এবারের আপুটা তো খুব খুব সুন্দর ছিল। আমি নিজে চুজ করেছি তোমার জন্য। নাইস চয়েস না? ”
চক্ষু কটমট করে তাকালেন আমার দিকে। ওনার আকস্মিক এই চাহনি দেখে ভড়কে গেলাম আমি। উনি হাঁটা থামিয়ে দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
” আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস কেন হাঁ? ভাবি চাই? বাকি ভাইদের চোখে পড়ে না? ওদের বিয়ে করা। হু’জ স্টপিং ইউ? শুধু শুধু আমার পেছনে লেগে আছিস কেন? ”
আমি আমতা আমতা করে বললাম, “স সবার ব বড় তো তু তুমি। ”
” আর একটা বাজে কথা বলবি তো.. আমি মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে তোকে পুতলা বলে ডাকবো আর তোর এই কাকের বাসার মতো চুলগুলো ছিঁড়ে ঝাড়ু বানাবো। আচ্ছা না? ”
চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল আমার! আমার চু-ল! কাঁদো কাঁদো মুখে আমার ডান হাতটা পৌঁছে গেল আমার বারবি ডল এর মতো সুন্দর চুলে। যথাযথ উত্তর না পেয়ে আমি খানিক বাদেই মিনমিনে গলায় জিজ্ঞেস করে বসলাম,
” তূর্ণ ভাইয়া তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? ”
আমার প্রশ্নে কিঞ্চিৎ চমকালেন বুঝি। কিন্তু উত্তর দিলেন না। উত্তর না পেয়ে আমি ঈষৎ বিরক্ত বোধ করলাম। কণ্ঠ সামান্য উঁচু করে বললাম,
” তুমি এমন কেন বলো তো? প্রতিবার পাত্রী দেখতে গিয়ে কোনো না কোনো কাণ্ড ঘটাও। সত্যি করে বলো তো তুমি কি চাও? চিরকুমার ক্লাবের সভাপতি হতে চাও? নাকি কাউকে ভালোবাসো? ”
আমার লম্বা প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই বাজখাঁই কণ্ঠে ধমক দিলেন উনি। যাতে কম্পন অনুভূত হলো আমার তনুমনে। নিমিষেই মিইয়ে গেলাম। উনি নির্দয়ের মতো করে আমায় টেনেহিঁচড়ে বাড়ির বাহিরে থাকা গাড়ির কাছে গেলেন। খুলে দিলেন পেছনের কার ডোর। চোখ দিয়ে ইশারা করতেই আমি ভদ্র মেয়ের মতো সুড়সুড় করে গাড়িতে বসে পড়লাম। উনি কার ডোর বন্ধ করে ড্রাইভিং সিটে বসে ডোর আটকে দিলেন। উইন্ডো দিয়ে খেয়াল করলাম খালামণি হনহন করে হেঁটে আসছে। আর পিছুপিছু আসছেন খালু। মুখটা কাঁচুমাচু করে কিছু বলছেন। খালামনির মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেজায় রেগে রয়েছেন উনি।
খালামনি এসে কার ডোর খুলে আমার বাম পাশে বসে পড়লো। অসহায় আমার বড় খালু গিয়ে বসলেন তূর্ণ ভাইয়ার পাশে। তূর্ণ ভাইয়া বদ একটা হাসি দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। খালু পরাজিত সৈনিকের ন্যায় বসে রয়েছেন। বারকয়েক পেছনে ঘুরে তার বিবি’র অভিব্যক্তি বোঝার বৃথা চেষ্টা অবধি করেছেন। আর খালামনি প্রতিবার ই কটমট চাহনিতে তাকালো। এ দেখে মুখ টিপে হেসে চলেছি আমি! আহা কি দৃশ্য! এ যে নিত্যদিনের চিত্র! হি হি হি!
•
জানালা গলিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে সকালের মিষ্টি রোদ্দুর। পাখির কিচিরমিচির কলরব ভেসে আসছে কর্ণ কুহরে। শরীরে কাঁথাটা ভালোমতো জড়িয়ে আরেকটু আরাম করে ঘুমাতে লাগলো সিনথি আপু। আমি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলাম আপু এখনো ঘুমিয়ে। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা দশ এর কোঠায়। আমি তাড়াতাড়ি তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ লেখিকা তাহিরাহ্ ইরাজ মুছে তোয়ালে রেখে দিলাম চেয়ারে। দ্রুত পায়ে গিয়ে দাঁড়ালাম সিনথি আপুর পাশে। একটু জোরেই ডাকতে লাগলাম,
” সিনথি আপু! ও সিনথি আপু! আর কত ঘুমাবে? দশটা বেজে গেছে তো। মামি রাগ করবে। উঠো না। ”
” উঁ-হু! ”
ঘুমের ঘোরে আপত্তি জানালো সিনথি আপু। আমি আপুর বাহুতে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলাম।
” আপু! এই আপু উঠো না! বিয়ের কনে এত বেলা অবধি ঘুমায় নাকি? উঠো না! এই আপু! ”
কে শোনে কার কথা? আপু তো উঠছেই না। এবার কি করি? মামি তো সেই কখন থেকে ফায়ার হয়ে আছে। যেকোনো মূহুর্তেই বুম! আমি যে কই যাই? উপায়হীন হয়ে রুমে পায়চারি করতে লাগলাম। রুমের এ মাথা থেকে ও মাথা পাঁচবার চক্কর কাটতেই ধুমতানা-না বুদ্ধি পেয়ে গেলাম। ইয়েস্! গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আপুর কাছে গেলাম। আপুর কানের কাছে ঝুঁকে হঠাৎই বলে উঠলাম,
” আরে কবির ভাইয়া আপনি! ”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সিনথি আপু। দেহে ভালোমতো ওড়না জড়িয়ে এলোমেলো চুলগুলো কোনোমতে ঠিকঠাক করে অস্থির হয়ে বললো,
” ক কবির! কো কোথায়? ”
দাঁত কেলিয়ে বললাম,
” তার বাড়িতে। ”
” কিহ্! ”
বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রয়েছে সিনথি আপু! খানিকটা সময় লেগে গেল ব্যাপারটা বুঝে উঠতে। আর তা বোধগম্য হতেই আপু চেঁচিয়ে উঠলো,
” দুয়া’র বাচ্চা! ”
আপুকে তাড়া করতে দেখে আমায় আর পায় কে? আমি তো রীতিমতো পগারপার! হা হা! দু হাতে শুভ্র রঙা চুড়িদারটা আগলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম।
ওহ্ হো! আমার পরিচয়টাই তো এখন অবধি দেয়া হলো না। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ুয়া হাসিখুশি, বারবি ডল এর মতো কিউটিপাই আমি। জাহিরাহ্ দুয়া! বর্তমানে রয়েছি আমার মামার বাসায়। মামাতো বোন সিনথি আপু। তার বিয়ে উপলক্ষে এসেছি। আজ আপুর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। সেই উপলক্ষে সাজসজ্জায় আচ্ছাদিত হয়ে চলেছে পুরো বাড়িটা।
হাফ লিটার এর আইসক্রিম বাটি থেকে তৃপ্তি সহকারে আইসক্রিম খাচ্ছি আর বাড়ির প্রাঙ্গন ঘুরে ঘুরে দেখছি। পুরো প্রাঙ্গন ছেয়ে গেছে হলদে রঙা গাঁদা ফুলে। আহা! কি সুন্দর লাগছে সবটা! এখনো ডেকোরেশন সম্পূর্ণ হয়নি। তাতেই এত্ত সুন্দর লাগছে। আর সন্ধ্যায় যখন অনুষ্ঠান হতে চলেছে, পুরো প্রাঙ্গন সজ্জিত থাকবে তখন না জানি কতটা সুন্দর লাগবে! আ’ম সো এক্সাইটেড! আইসক্রিম খেতে খেতে দেখতে পেলাম বেশকিছু কর্মী গাঁদা ফুলের ঝুড়ি হাতে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। কারোর হাতে নেটের পর্দা। কেউবা চেয়ার ঠিকঠাক করে রাখছে। টেবিলের ওপর টেবিল ক্লথ বিছিয়ে রাখছে। আমি ঘুরে ঘুরে সমস্ত আয়োজন দেখতে লাগলাম। সকালের মিষ্টি রৌদ্রের আলিঙ্গনে হলদে গাঁদা ফুলগুলো যেন চিকচিক করছে। সবটুকু হলদে আভায় ছেয়ে আছে। বেশ মনোমুগ্ধকর লাগছে দেখতে! হাঁটতে হাঁটতে আমার চোখ পড়লো একজনের ওপর। যে নেটের পর্দা লাগানোয় তদারকি করছে। ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছেন। আমি হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম।
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া! ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ”
কাজে ব্যস্ত অবস্থায় উনি সালামের জবাব দিলেন। অতঃপর তাকালেন আমার দিকে। মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিয়ে বললেন,
” কেমন আছো দুয়া? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ”
” এই যে দেখতেই পাচ্ছো। আছি কোনোরকম আলহামদুলিল্লাহ্। বন্ধু আমায় তো কাজ করিয়ে করিয়েই মা|রবে। ”
ওনার কথা শুনে হেসে উঠলাম আমি। আকস্মিক আমার ঠিক ডান পাশে এসে ব্রেক কষলো কেউ একজন। চকিতে চমকে ডানে তাকালাম আমি। তূর্ণ ভাইয়া! উনি বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
” রাজীব! এই তোর ফোরজি কাজের কাজের নমুনা? এভাবে চললে তো দিন গড়িয়ে রাত চলে আসবে। হলুদ হবে কখন? আগামীকাল? ”
রাজীব ভাইয়া বিরক্ত হয়ে বললেন,
” আরে ইয়ার! কাজ করছি তো। আমি বসে আছি নাকি? দেখতে পাচ্ছিস আমার ঘাম? এরা সাক্ষ্য দিচ্ছে আমি কি পরিমান কাজ করেছি। হুহ্। ”
” হাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি। দাঁত কেলাচ্ছিস দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এখন ফালতু কথা বাদ দিয়ে কাজ কর। নইলে সন্ধ্যায় হলুদের মেনু মিস। ”
রাজীব ভাইয়া শুকনো মুখে বললেন,
” শা|লা বা*টপার। কাজ করানোর জন্য হুমকি দিচ্ছে! আব্বে ওই দাওয়াত খেতে এসেছি না কা”মলা খাটতে?”
তূর্ণ ভাইয়ার চাহনি দেখে দমে গেলেন উনি। ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কাজে। আমি তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাণ্ড দেখছি শুধু। তূর্ণ ভাইয়া এবার আমার দিকে তাকালেন। বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন,
” এই যে পুতলা! খেয়েদেয়ে আর কত ফুলবি? একটু তো কাজকর্ম কর। এমনিতেই তো ফুলটুসি। ক’দিন পর দেখা যাবে আকাশে বাতাসে বেলুনের মতো উড়ে বেড়াচ্ছিস। ”
এত্ত বড় কথা! আমি এর যোগ্য জবাব দিতে উদ্যত হলাম তখন আবার বললেন,
” তখন তোকে টেনেহিঁচড়ে জমিনে আনবে কে? আমি? ইম্পসিবল! আমার অত ফাও সময় নষ্ট করার ইচ্ছে ন্যাহি। এখন চোখের সামনে থেকে সর তো। কাজে ডিস্টার্ব হচ্ছে। আর পারলে ভূতের মতো লেপে রাখা আইসক্রিমটুকু মুছে ফেল। বিদঘুটে লাগছে দেখতে। ”
শেষোক্ত কথাটা আড়চোখে তাকিয়ে বললেন উনি। আয় হায়! আবারো আইসক্রিম খেতে গিয়ে মুখ মাখিয়ে ফেলেছি! আমিও না। বাজে অভ্যাস আর গেল না! তাই বলে উনি আমায় এভাবে অপমান করবেন! আমি কিছু বলতে নিলেই হাত দিয়ে ইশারা করে আমায় প্রস্থান করতে বললেন। রাগেদুঃখে সেথা হতে চলে গেলাম আমি। পাঁজি লোক একটা! এর শোধ তো জাহিরাহ্ দুয়া তুলবেই তুলবে। হুহ্! দেখে নেবো।
•
অপরাহ্নে বাড়ির সকলে কম-বেশি ব্যস্ত। সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। শেষ মূহুর্তে সকলেই ব্যস্ত। মা-মামিরা হলুদ বেটে ফেলেছে। আমি সেই বাটা হলুদ সুন্দর মতো বাটিতে রাখছি। গায়ে হলুদ এর অনুষ্ঠান বলে কথা! একটু তো বিশেষত্ব দরকার তাই না? নিজ মনে কাজ করছি তখনই শুনতে পেলাম,
” ওয়ে দুয়া! ”
অতি পরিচিত কন্ঠ শুনে পেছনে ঘুরে তাকালাম আমি। অধর কোণে ফুটে উঠলো হাসির রেখা। আমার শ’য়তা’নের হা’ড্ডি বন্ধুমহল দাঁড়িয়ে। বিন্দু, বিশাল, পুষ্পি চলে এসেছে। ওরা হাসিমুখে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি হলুদ বাটা এর ওপর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমাকে এতটুকু কাজ করতে দেখে পুষ্পি খোঁচা মে|রে বললো,
” বাব্বাহ! এ কি দেখছি আমি? দুয়া রানি কিনা কাজ করছে! ”
বিন্দু হাসতে হাসতে বললো, ” হাঁ করছে তো। দেখছিস না? গোলাপের পাপড়ি ছিটাচ্ছে। ”
আমি চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
” ছিটাচ্ছি! এমনভাবে বলছিস যেন রাস্তায় রাস্তায় গোলাপের পাপড়ি ছিটাচ্ছি। ”
বিশাল দাঁত কেলিয়ে বললো,
” দোস্ত চোখ খারাপ হইছে মনে হয়। আমি তো রাস্তাই দেখতে পাইতাছি। বাই দ্যা রাস্তা বিন্দু চু’ন্নি তুই কি দ্যাখোছ? ”
নিজের আপন জমজ বোনকে চু’ন্নি বলায় বেজায় ক্ষেপে গেল বিন্দু। বিশাল এর পিঠে দুম করে এক কিল মে|রে বললো,
” হতচ্ছড়া শ”য়তান! আমি চুন্নি! তাহলে তুই কি হা? তুই তো আস্ত একটা চুন্না। ”
” চুন্না! এ’গ্লা আবার কি বুইন? ”
নিষ্পাপ মুখ করে শুধালো বিশাল। বিন্দু ওর পিঠে আরেকবার মে|রে বললো,
” চু”ন্নির মেল ভার্সন! তোর মাথা। ”
এবার হাত চালিয়ে দিলো বিশাল। বোনের মাথায় শক্ত হাতের গাট্টা মে|রে বললো,
” তোর মাথা। এত হাত চলে কেন হাঁ? বে দ্দ প মাইয়া। ”
মাথায় হাত বূলাতে বুলাতে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলো বিন্দু।
” বে দ্দ প আমি না তুই। আজকেই আব্বুর কাছে বিচার দেবো। মোছ ছাড়া শ’য়’তা’ন! ”
মোছ ছাড়া শ”য়তান! হা হা হা! হাসতে লাগলাম আমরা বন্ধুরা। আসলে হয়েছে কি! বিশাল এর মাত্র উনিশ বছর চলছে তো। এখনো ঠিকমতো দাঁড়িমোছ গজায়নি। এজন্য বিন্দু সুযোগ পেলেই ভাইকে এই বলে ক্ষেপিয়ে দেয়। আমাকে ক্ষেপাতে এসে এরা নিজেরাই দেখি শুরু করে দিয়েছে। এদেরকে দেখে ভাই-বোন কম শত্রু বেশি মনে হয়। একদম চির শত্রু। শত্রুর কথা ভাবতেই নজর পড়লো তূর্ণ মহাশয়ের দিকে। প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে তাকে দেখেই আমার পৈ’শা’চি’ক সত্ত্বা জাগ্রত হলো। বেচারা ঘেমেনেয়ে একাকার হয়ে গেছে। খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে! আহা রে বেচারা! খুব খাটুনি গেছে বুঝি! আহা গো! আমি আসছি তো। তোমার সমস্ত ক্লান্তি শুষে নিতে। জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ।
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#সূচনা_পর্ব
[