তুমি হৃদয়ে লুকানো প্রেম পর্ব ৫১+৫২+৫৩

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫১

” হেই গাইজ! বড্ড বোরিং লাগছে তাই না? লেটস্ প্লে সামথিং এক্সাইটিং। ”

মিহাদের কথায় সম্মতি পোষণ করে উঠলো তৃষা, পুষ্পি এবং তানু। প্রসন্ন হলো মিহাদ।

হিমাংশু’র দ্যুতিতে মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে রাতের পরিবেশ। রিসোর্টের বাহিরে আজ বারবিকিউ আয়োজন করা হয়েছে। ফায়ারক্যাম্পের উষ্ণতা, হলদে মোহনীয় আভায় মনোরম এ মুহূর্ত! সেথায় উপস্থিত সকল তরুণ সদস্য। একমাত্র ক্ষুদে সদস্য হলো জাহিন। সকলে মিলেমিশে ভোজন পর্ব সেরে নিলো। আপাতত তারা বসে বড় বড় দু’টো ফ্লোর ম্যাটের ওপর। ঠাণ্ডা পবনে শিরশির করে উঠছে গাত্র। অনেকক্ষণ ধরেই বড্ড পানসে অনুভূতি হচ্ছে। কেউ মোবাইল স্ক্রল করছে। কেউ নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় লিপ্ত। কেউবা নীরব। এত সুন্দর রজনীতে এমন গুমোট ভাব পছন্দ হলো না মিহাদের। তাই তো সকলের উদ্দেশ্যে উপরিউক্ত প্রস্তাবটি পেশ করলো। দুয়া বললো,

” ভাইয়া দারুণ প্রস্তাব দিয়েছো। কিন্তু খেলবো টা কি? ”

” এক্সাক্টলি। কোনো নাম সাজেস্ট করো। ” রিশাদ নিজের মতামত জানালো।

দুই তিনজন ভিন্ন ভিন্ন মতামত দিলো। কি খেলা যায় ঠিক নির্বাচন করা মুশকিল হয়ে পড়েছে। কেউ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারছে না। একসময় সকলের মধ্যমণি হিসেবে নিজস্ব মতামত পেশ করলো দুয়া।

” এক কাজ করলে কেমন হয়? চলো ‘ গেস দ্যা মুভি নেম ‘ খেলি। বেশ মজা হবে। ”

তৃষা খুশিমনে বললো, ” ইয়েস! এটা খেলা যেতেই পারে। ফাটাফাটি হবে‌। ”

নিশাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ তৃষায়। সে মৃদু স্বরে বললো,

” কিন্তু এ খেলা কি করে খেলে? আই মিন টু স্যে রুলস্?”

দুয়া স্বল্প হেসে খেলার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দিতে লাগলো।

” এটা একদম সহজ খেলা। এই খেলায় দু’টো টিম থাকবে। প্রতি টিম থেকে একজন প্লেয়ার উঠে আসবে। বিপরীত টিমের একজন প্লেয়ার তার কানে কানে কোনো মুভির নাম বলবে। সে মুভির নাম প্রথম টিমের ওই প্লেয়ার নিজের টিমকে অভিনয় করে দেখাবে। তবে হাঁ। মুখ ফুটে কিচ্ছু বলতে পারবে না। শুধু অভিনয় করে বোঝানোর চেষ্টা করবে। যদি তার টিমমেট নামটা সঠিকভাবে গেস করতে পারে তাহলেই এক পয়েন্ট। ”

সিনথিয়া অবাক হয়ে বললো, ” বাব্বাহ! তাহলে তো খেলাটা টাফ হবে মনে হচ্ছে। কারণ সবাই কঠিন নাম বলে নিজ দলকে জেতাতে চাইবে। ”

দুয়া হেসে বললো, ” এটাই তো খেলা। বেশ জমে উঠবে। কি খেলবে তো তোমরা? ”

মনমতো খেলার প্রস্তাব পেয়ে সকলেই রাজী হলো। তবে এতজন খেলায় অংশগ্রহণ করলে কেমন জগাখিচুড়ি হয়ে যাবে। তাই দুই টিমে সাতজন সাতজন করে মোট চৌদ্দ জন অংশগ্রহণ করলো। খেলা হবে গার্লস ভার্সেস বয়েজ। কেননা ইতঃপূর্বে টিম গঠন করতে গিয়ে একদফা ঝামেলা হয়েছে। কে কোন দলে যাবে কি যাবে না প্রমুখ সমস্যা। শেষমেষ খেলা হবে গার্লস ভার্সেস বয়েজ। গার্লস টিমের সদস্য সাতজন হলো: দুয়া, তৃষা, নিশি, তানজিনা, তানু, পুষ্পি, দিবা। বয়েজ টিমে রয়েছে: তূর্ণ, নিশাদ, রিশাদ, জাবির, বিশাল, রাজীব, মিহাদ। জাবির খেলতে ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু বোনের কথায় হার মানতে বাধ্য হলো। তো ফ্লোর ম্যাট দুই টিমে বিভক্ত হলো। গার্লস ভার্সেস বয়েজ! যারা খেলায় অংশগ্রহণ করেনি দর্শক হিসেবে নিজ টিমকে সমর্থন জানাতে উপস্থিত। যথারীতি খেলা শুরু হলো। প্রথমে মেয়েদের টিম থেকে উঠে দাঁড়ালো পুষ্পি। নিজ দলকে আশ্বস্ত করলো এই বলে যে,

” চিন্তা করিস না। এমন নাম দেবো না… অভিনয় ভুলে খেয়ে ফেলবে। ”

ছেলেদের টিম থেকে অভিনেতা হিসেবে উঠে দাঁড়ালো নিশাদ। পুষ্পি বেশ ভাব নিয়ে এগিয়ে এলো। নিশাদের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো নামটি। নাম শুনেই নিশাদের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। তা লক্ষ্য করে পৈ*শাচিক আনন্দ পেল পুষ্পি। বেশ ভাব নিয়ে নিজের জায়গায় বসে পড়লো। নিশাদ মলিন বদনে টিমের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। বয়েজ টিম রেডি।

রাজীব শুধালো, ” বাংলা না হিন্দী? ”

নিশাদ বৃদ্ধাঙ্গুল নিম্নমুখী করে দেখালো।

” ওকে। হিন্দী। ”

তূর্ণ থাম্বস আপ দেখিয়ে শুভকামনা জানালো। নিশাদ এবার আস্তে ধীরে নিজের মাথার ওপর দু হাতের সহায়তায় মুকুটের আকৃতি তৈরি করলো। তা লক্ষ্য করে ক্ষণিকের মধ্যেই তূর্ণ’র মুখনিঃসৃত হলো,

” কুইন? ”

” ইয়েস! ইয়েস! ” উৎফুল্ল হয়ে উঠলো নিশাদ। বয়েজ টিম অভিভূত। করতালি দিয়ে উঠলো। গার্লস টিম তো স্তব্ধ। ফটাফট পুষ্পির পিঠে কয়েকটা ঘু!ষি পড়লো। তৃষা দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

” গা.ধা! এই তোর কঠিন নাম? ওভার কনফিডেন্সের দোকান! ”

দুয়া কঠিন চোখে তাকিয়ে। পুষ্পি মেকি হেসে নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম হলো। প্রথম শটেই বাজিমাত। বেশ আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলো বয়েজ। অতঃপর খেলা এগিয়ে গেল। রিশাদ নাম বললো কানে কানে। ফ্যাসাদে পড়ে গেল তৃষা। এটা কি করে বোঝাবে সে? বহু চেষ্টা করেও পারলো না। কাউন্টডাউন এক থেকে সাত সেকেন্ড সমাপ্ত হলো। হতাশ হলো গার্লস টিম। দুয়া শুধালো,

” এবার তো নামটা বল। ”

তৃষা মলিন বদনে বললো, ” গল্প হলেও সত্যি। সোহমের মুভিটা। ”

তানজিনা আফসোস করে বললো, ” এটা কঠিন ছিল বটে। ”

এ বলে স্বামীর পানে গরম চাহনিতে তাকালো। কেননা এই কঠিন নামটা তার ই দেয়া। রিশাদ সাহেব অবশ্য এতে পাত্তা দিলো না। এমন ভাব করলো যে সে কিছুই দেখেনি। এরপর দুয়া বিশালকে নাম দিলো। বেচারা সঠিক নাম কোনোভাবেই অভিনয় করে বোঝাতে পারলো না। তার টিম ভুলভাল নাম অনুমান করলো। কেননা নামটাই যে প্যাঁচালো। হিন্দী মুভি বরুণ ধাওয়ান এর ‘ বাদলাপুর ‘. খেলার মোড় এবার ঘুরে গেছে। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। আবারো ব্যর্থ হলো বয়েজ টিম। নিশি’র কথামতো ‘ লাভ আজকাল ‘ বোঝাতে ব্যর্থ হলো জাবির। খেলা একদম শেষের পথে। বয়েজ টিম তখন ৪/৭. আর মেয়েরা ৫/৬. এখন সর্বশেষ নাম। গার্লস টিম থেকে উঠে এলো দুয়া। আর বয়েজ টিম থেকে তূর্ণ। ছেলেরা তো নিশ্চিত হেরে গেছে। এখন কোনোমতে এটা পারলে তাও সান্ত্বনা। খেলা ড্র হবে। নাহলে মানসম্মান সরাসরি বুড়িগঙ্গায়।

আস্তে ধীরে অগ্রসর হতে লাগলো মানব মানবী। মানুষটির দু হাত গলিয়ে রাখা ট্রাউজারের পকেটে। তার প্রতিটি কদমে শিরশির করে উঠলো মেয়েটির কায়া। একান্ত জনের চাহনিতে কুঁকড়ে গেলো অন্তর। লাজে অবনত হলো মুখশ্রী। অধরে আকর্ষণীয় হাসির রেখা ফুটিয়ে সন্নিকটে এলো তূর্ণ। দু’জনে অতি নিকটে দাঁড়িয়ে। দুয়া ডান হাতের মুঠো শক্ত করে চেপে ধরে। নিজেকে সামলানোর প্রয়াস চালিয়ে যায়। আস্তে করে ওর পানে ঝুঁকে গেল তূর্ণ। কর্ণ কুহরে উষ্ণ শ্বাসের স্পর্শ শিহরিত করছে বারংবার। সম্মোহনী স্বরে প্রিয়তমার কর্ণে পৌঁছালো মধুরতম বাক্য,

” আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। ”

ফট করে আঁখি পল্লব মেলে তাকালো দুয়া। আবেশে হৃদ স্পন্দনের গতি ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। কর্ণ পাতায় অধরের ছোঁয়া পেতেই ঘোর কেটে গেল। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে আস্তে ধীরে পেছনে নিজ জায়গায় চলে গেল তূর্ণ। ওর টিমমেট বেশ প্রত্যাশী।

” তূর্ণ নিশ্চয়ই সবচেয়ে কঠিন নাম বলেছে। ” বললো রাজীব।

রিশাদ সম্মতি জানালো, ” হুম। ইনশাআল্লাহ্ আমরা ড্র করবো। অন্তত মানসম্মান তো বেঁচে যাবে। ”

কিন্তু তাদের আশায় সেগুড়ে বালি। সামান্য প্রচেষ্টায় জয়লাভ করলো গার্লস টিম। ৬/৭ পয়েন্ট। অভিনন্দন টিম গার্লস! আনন্দে মুখরিত হলো রিসোর্টের প্রাঙ্গন। বয়েজ টিম করুণ চোখে তাকিয়ে তূর্ণ’র পানে। এ কি করলো তূর্ণ? এতো সহজ নাম? এভাবে স্বেচ্ছায় সারেন্ডার করলো!

দুয়াকে ঘিরে গোল গোল করে ঘুরছে গার্লস টিম। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। তাদের মধ্যমণি দুয়া। মেয়েটি ডান হাতে মুখ চেপে অতি মধুরতম ধ্বনিতে হাসছে। সে হাস্য কলরব সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করে চলেছে তূর্ণ। তার চোখেমুখে পরিতৃপ্তি। খুশির ছাপ। এদিকে নিশাদ এবং রাজীব যে তাকে মে!রে মে রে ধোলাইখাল বানিয়ে ফেলছে সে খেয়াল আছে কি? নেই তো।
.

বিছানায় বসে আনমনা মেয়েটি। চোখেমুখে লজ্জালু আভার আচ্ছাদন। বারবার চক্ষু পাতায় ভেসে উঠছে মানুষটির চাহনি। শ্রবণ ইন্দ্রিয়ে কড়া নাড়ছে সে সম্মোহনী স্বর। তার একটুখানি ছোঁয়ায় এখনো আবেশিত তনুমন। রাতের সে মুহূর্ত এখনো ভুলতে ব্যর্থ মেয়েটি। হঠাৎ বিন্দুর কণ্ঠে ধ্যান ভঙ্গ হলো। বাস্তবে পদার্পিত হলো মেয়েটি। সে তো ভুলেই গিয়েছিল বন্ধুরাও রয়েছে এখানে। বিন্দু দুষ্টুমি করে বলছে,

” আদ্রিয়ান স্যার যতটা গ!ম্ভীর। রষকষহীন। আমাদের তূর্ণ ভাইয়া ঠিক ততটাই মিশুক। রোমান্টিক। ”

পুষ্পি হাসিমুখে সম্মতি জানালো।

” অফকোর্স। সেটা আজ জানলি? আমি তো প্রতিবার দেখা হলেই নোটিশ করি। হায়! দুলাভাই য্যামনে এই ছেড়ির দিকে চায় ম্যায় তো গায়ি। ”

নাটুকে কথাবার্তা শুনে হেসে উঠলো ওরা। দুয়া লজ্জা মিশ্রিত কণ্ঠে থামতে বললো। ওরা তা শুনলে তো? তৃষা বলে উঠলো,

” আজ দেখেছিস? আমি শুধু চেয়েছি তোমায়। উফ্! ভাইয়া নিজের মুখে কানে কানে বলেছে। হাউ রোমান্টিক মুহূর্ত! ”

পুষ্পি আহাজারি করে উঠলো, ” আজ কেউ নেই বলে। জীবন যুদ্ধে পিছিয়ে গেলাম গো… ”

সশব্দে হেসে উঠলো সবাই। দুয়াও সঙ্গ দিলো।

পরেরদিন। ভানু’র উপস্থিতিতে উজ্জ্বল বসুন্ধরা। ব্যস্ত সময় কাটছে রিসোর্টে। রিসোর্টের পার্টি হলরুম পুরোদমে সজ্জিত হচ্ছে। আজ যে তূর্ণয়া’র বাগদান! সকলেই বেশ ব্যস্ত। দম ফেলার ফুরসত নেই। এর মধ্যে দুপুর দিকে ঘটে গেল সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এক ঘটনা। যা লণ্ডভণ্ড করে দিলো সব। ভেঙ্গে গেল কারোর স্বপ্ন! চূর্ণ বিচূর্ণ হলো অনুভূতির চাদর! এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার ফলাফল কোন দিকে মোড় নেবে এবার? অপেক্ষা সঠিক সময়ের।
.

নিশাকরের কিরণ জমিনের বুকে। পার্টি হল এ মনোমুগ্ধকর আয়োজন করা হয়েছে! প্যাস্টেল রঙে আচ্ছাদিত চারিদিক। বাগদান মঞ্চের ওপর কারুকার্য খচিত স্বর্ণালী রঙা বৃহৎ সোফা। সোফার কোমল আবরণ শুভ্র রঙা, সঙ্গে দু’টো শুভ্র আবরণে আবৃত কুশন। ব্যাকড্রপে বিশালাকার কার্টেন। তার সম্মুখে পীচ, ব্লাশ এবং পুদিনার নরম রঙগুলি পুষ্প রূপে নিখুঁত সম্প্রীতিতে একত্রিত হয়েছে যেন। সোফার দু পার্শ্বে ফুলেল বৃহৎ গুচ্ছ। কৃত্রিম আলোয় নজরকাড়া পরিবেশ। যেন এক স্বর্গীয়-মোহনীয় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে! আগত অতিথিরা অল্প অল্প করে সেথায় জমায়েত হচ্ছে। তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন নাজমুল সাহেব, রিশাদ এবং জাবির। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখা মিললো জনাবের।

পড়নে তার লাইট পিংক থ্রি পিস স্যুট। কোটের সবগুলো বোতাম উন্মুক্ত। সেথা হতে দেখা মিলছে একই রঙা ওয়েস্ট কোটের অধিকাংশ। শার্টের স্বল্প অংশ। বাঁ হাতে মানুষটির ডায়ালের দামী রিস্ট ওয়াচ। লালচে চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। পায়ে কৃষ্ণবর্ণ চকচকে শ্যু। অতীব সুদর্শন লাগছে দেখতে! পার্টিতে উপস্থিত কিছু রমণীর হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল ক্রমবর্ধমান হারে। তূর্ণ কোটের দু পার্শ্ব ঠিকঠাক করতে করতে হাজির হলো। বাবার সঙ্গে দেখা হলো পথিমধ্যে। ছেলেকে দেখে নিজাম সাহেব প্রসন্ন হলেন। কাঁধ চাপড়ে গর্বিত কণ্ঠে বলে উঠলেন,

” মাশাআল্লাহ্! এই না হলে আমার ছেলে! কি সুন্দর নিজেকে সাজিয়ে ফেলেছে। মেয়েরা তো চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলছে। ”

বক্র হাসলো তূর্ণ। রসিয়ে রসিয়ে বললো,

” আফটার অল তোমার ছেলে কিনা? তুমি তো এই বয়সেও মেয়েদের হৃদয় কাড়তে ম!রিয়া। তাই তো এত সাজুগুজু। বলবো নাকি আম্মুকে? ”

বেজার হলেন নিজাম সাহেব। তেঁতো স্বরে বললেন,

” বদ ছেলে। বুড়ো বাপের সংসারে কুনজর দিচ্ছিস। যা ভাগ। দেখ বউ কোথায় তোর। আমার মা টাকে কতক্ষন ধরে দেখি না। ”

তূর্ণ এবার দুষ্টুমি বাদ দিয়ে ভদ্র ছেলে হলো। আলতো করে আলিঙ্গন করলো বাবাকে। অপ্রত্যাশিত আচরণে নিজাম সাহেব অবাক হলেও নিজেকে যথাসময়ে সামলে নিলেন। আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলেন পৃষ্ঠে। বাবা ছেলের এমন মধুর মুহূর্ত অবলোকন করে স্বল্প আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো জাবির। স্মরণে এলো মরহুম পিতা। যে আজ আর তাদের মাঝে নেই। ফিরে গিয়েছে স্রষ্টার নিকটে।

চলবে.

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। কেমন লাগলো পর্বটি? তূর্ণয়া’র বাগদানে সকলকে নিমন্ত্রণ রইলো। ]#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫২

” এই তো আমার দুয়া মা চলে এসেছে। ”

নিজাম সাহেবের চোখেমুখে খুশির ছাপ। বাক্যটি কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই থমকে গেল তূর্ণ। বদ্ধ হলো ওষ্ঠাধর। কাজিন এবং বন্ধুমহলকে এড়িয়ে ডান পার্শ্বে তাকালো। তাতেই হলো অঘটন। ধক ধক করে উঠলো বক্ষপিঞ্জর এর অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি। অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ নয়ন জোড়া! অবর্ণনীয় প্রেমাসক্তি ঘিরে ফেললো আষ্টেপৃষ্ঠে। ধীরজ গতিতে এগিয়ে আসছে তার হৃদয়ে লালিত রমণী। বাঁ পাশে সঙ্গিনী তানজিনা, ডান পাশে সিনথিয়া। মধ্যিখানে প্যাস্টেল রঙে রাঙানো তার মাইরা! মাইরা’র পড়নে সুন্দর প্যাস্টেল পিঙ্ক রঙের নেট লেহেঙ্গা। যা সবদিকে সিকুইন এমব্রয়ডারি দিয়ে ডিজাইনকৃত। গোল্ডেন সিকুইন্সের চকচকে আর্ট সিল্ক ফুল স্লিভ চোলি’র উপরিভাগ আড়াল হয়ে পড়েছে মানানসই হিজাবের অন্তরালে। বাঁ কাঁধে অতি সুন্দর ভঙ্গিতে ছেড়ে রাখা পেস্টেল পিঙ্ক নেট দোপাট্টা। যার বর্ডারে দৃশ্যমান স্ক্যালপড লেসের কারুকাজ। মেয়েটির সিঁথির মাঝ বরাবর ক্ষুদ্র টিকলি। বাঁ হাতে এক জোড়া বালা। ডান হাতে আকর্ষণীয় ব্রেসলেট। মুখশ্রীতে কৃত্রিম প্রসাধনীর মানানসই প্রলেপ। আইলাইনারের ছোঁয়ায় জীবন্ত দীঘির রূপ ধারণ করেছে মায়াবী আঁখি যুগল। ওষ্ঠাধরে লাইট পিঙ্ক লিপস্টিকের আচ্ছাদন। অবর্ণনীয় সুন্দর লাগছে! চক্ষু ফেরানো হয়ে গেছে দুষ্কর।

লাজুকতার ন্যায় মিইয়ে মেয়েটি। একান্ত জনকে একটুখানি দেখার জন্য আকুল হৃদয়। তবে সকলের উপস্থিতিতে বেলাজের মতো তা করতে পারলো না। বরং ছটফট করতে লাগলো ভেতরে ভেতরে। দু বোনের সান্নিধ্যে সে পৌঁছে গেল বাগদান মঞ্চে। রিশাদের আলতো দুষ্টু ধাক্কায় চেতনা ফিরলো তূর্ণ’র। মাথা চুলকে লাজুক হেসে উঠলো সে। অধরে খুশির ঝিলিক মেখে এগিয়ে গেল মঞ্চের ধারে। জায়গা করে নিলো তার মাইরা’র ডান পার্শ্বে।
.

পুষ্পি এবং বিন্দু সে-ই কখন থেকে বকবক করে চলেছে। তাদের সঙ্গে থেকেও যেন নেই তৃষা। ম্লান তার বদন। পীড়িত নয়ন জোড়া খুঁজে চলেছে একজনকে। বেশিক্ষণ খুঁজতে হলো না। দেখা মিললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটির। সে-ই দুপুর পেরিয়ে এখন রজনী। অবশেষে দেখা মিললো। মধ্যের সময়টুকু যেন মানুষটি অদৃশ্য হয়ে ছিল। দেখা মিললোই না। আসলেই কি দেখা মিলছিল না? নাকি স্বেচ্ছায় অন্তরালে লুকায়িত ছিল সে? ভাবনা শেষে বাস্তবে পদার্পণ করলো তৃষা। হঠাৎই কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল। এক অনিন্দ্য সুন্দরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপ্ত নিশাদ। নিশাদ বলছে কম শুনছে বেশি। সে রমণীই হাসিমুখে ছলাকলা করে কথা বলছে। আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে এক প্রকার। কেমন গাঁয়ে পড়া স্বভাব। না চাইতেও ঈ!র্ষাকাতর হয়ে গেল তৃষা। হঠাৎই সে রমণী আঁকড়ে ধরলো নিশাদের বাহু। ছলছল করে উঠলো তৃষার নয়ন জোড়া। উঁহু ঈ র্ষার জন্য নয়। বরং নিশাদের অবহেলায়। সে তো মাত্র কয়েক কদম দূরে দাঁড়িয়ে। তবুও মানুষটি তাকে আজ দেখতে পাচ্ছে না, দেখছে না। বরং সম্পূর্ণ রূপে অবজ্ঞা করে চলেছে। এটাই কি স্বাভাবিক নয়? সে তো এমনটাই চেয়েছিল। তাই তো দুপুরে অমন কাণ্ড ঘটালো। এখন তো তার চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ। তবুও কেন যাতনা হচ্ছে? কেন ঝড় উঠছে অন্তঃপুরে? কেন? টলমলে নয়নে তৃষা দেখতে পেল নিশাদ সে-ই অনিন্দ্য সুন্দরী… অর্থাৎ ভার্সিটি লাইফের ক্লাসমেটের পাশাপাশি বর্তমানে নিজাম সাহেবের এক ক্লায়েন্টের বাগদত্তা রমণীটিকে এড়িয়ে চলে গেল। একটিবারের জন্যও তাকালো না তৃষার পানে। তাতেই তৃষার অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো তপ্ত জল।
.

স্বর্ণালী রঙা আকর্ষণীয় সোফায় পাশাপাশি বসে তূর্ণ, দুয়া। সকলের অলক্ষ্যে দুয়া আড়চোখে তাকালো ডান পার্শ্বে বসে থাকা স্বামীর পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো। মেটালো চক্ষু তৃষ্ণা। শান্ত হয়ে এলো তার অশান্ত হৃদয়। সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে লালাভ আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখখানিতে। তা ঠিক লক্ষ্য করলো মানুষটি। দু’জনের নয়নে নয়ন মিলিত হতেই তূর্ণ ওষ্ঠ নাড়িয়ে নিঃশব্দে বললো,

” মাশাআল্লাহ্! ”

লাজুক হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো দুয়া। তখনই শোনা গেল মিহাদের কণ্ঠস্বর। বাগদানের ঘোষণা করা হলো।
.

পুরুষালি হাতের তেলোয় পেলব হাতটি। বিমুগ্ধ নয়ন জোড়া নিবদ্ধ অবনত লাজুক মুখশ্রীতে। আস্তে ধীরে অনামিকায় পড়িয়ে দিলো রিং। নিজস্ব সিলমোহর লেপ্টে দিলো আঙ্গুলিতে। করতালির ধ্বনিতে মুখরিত হলো চারিপাশ। এবার দুয়া’র পালা। তার হাতে রিং তুলে দিলো তানজিনা। বোনকে ইশারা করলো। সাজ্জাদ সাহেব এবং তাহমিদা সজল নয়নে তাকিয়ে। দেখছেন সন্তানের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ, শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। সকলের উচ্ছ্বাসে গুটিয়ে মেয়েটি। আস্তে ধীরে স্বামীর আঙুলে রিং গলিয়ে দিলো। সম্পন্ন হলো বাগদান। স্বামী রূপী প্রেমিক পুরুষটি আলতো ভঙ্গিতে মাইরা’র হাত আঁকড়ে ধরলো। মেয়েটিও নিভৃতে আঁকড়ে ধরলো। নয়নে নয়নে হলো সংযোগ। কর্ণ কুহরে ভেসে আসছে করতালির ধ্বনি। দু’জনে যেন জাগতিক হুঁশ হারিয়ে। এক ভিন্ন প্রেমপূর্ণ বসুধায়।

তৃষা সেথা হতে দৃষ্টি সরিয়ে অশ্রুসজল নয়নে তাকালো নিশাদের পানে। তবে মানুষটি এদিকে তাকিয়ে নেই। বিগত কতগুলো ঘন্টা শুধু অবহেলা করেই চলেছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার অবহেলায় জর্জরিত তার কোমল হৃদয়। থেমে থেমে অশ্রু জমছে অক্ষি জোড়ায়।
.

আঁধারিয়া রজনী। কক্ষ জুড়ে রমণীদের কলতান। হাসিঠাট্টা তে মুখরিত পরিবেশ। বিছানায় মধ্যখানে বসে দুয়া। তাকে ঘিরে বন্ধু এবং কাজিন মহলের ভিড়। খুনসুটি, দুষ্টুমি চলছে সে-ই রাত্রিকালীন ভোজন শেষে। তানু খুশিমনে বললো,

” আহা! অবশেষে দুয়াপু এখন তূর্ণ ভাইয়ার অফিসিয়াল বাগদত্তা। ভাবতেই কেমন রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছে। ”

সিনথিয়া হাসিমুখে বললো, ” দুটিকে মাশাআল্লাহ্ খুউব মানিয়েছে। তাই না? যখন একে অপরকে আংটি পড়াচ্ছিল কি সুন্দর লাগছিল! একদম নজরকাড়া! ”

লাজে অবনত হবু কনের মুখখানি। তানজিনা বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

” আল্লাহ্ তায়ালা দুটিকে খুব ভালো রাখুক। সুখে রাখুক। আমিন! ”

বাকিরা সমস্বরে বলে উঠলো,

” সুম্মা আমিন! ”

দুয়া স্বল্প আবেগী হয়ে পড়লো। আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো বোনের কাঁধে। তানজিনা মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
.

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুয়া। হিমেল হাওয়ায় নৃত্যরত উন্মুক্ত দীঘল কালো কেশ। বলিষ্ঠ এক জোড়া হাতের বলয়ে বন্দিনী সে। ডান কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে একান্ত জন। হিমাংশু’র দ্যুতি ভিজিয়ে চলেছে কপোত-কপোতীকে। আঁধার রজনী। হিমেল হাওয়ার পরশে শীতল গাত্র। সঙ্গে হিমাংশু’র দ্যুতি। এক অভূতপূর্ব মুহূর্ত! সহচর্য দিচ্ছে আবার একান্ত জন। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রাখা মানুষটি প্রিয়তমার হাতটি নিজ হাতের মুঠোয় নিলো। হিমাংশু’র দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করতে থাকা আংটিতে ছুঁয়ে দিলো ওষ্ঠ। মিহি স্বরে শুধালো,

” কেমন লাগছে এই মুহূর্তটি? নাউ উই আর অফিসিয়ালি এনগেজড্। আর মাত্র ক’দিন। এরপর ধর্মীয়ভাবে, সামাজিক ভাবে ইনশাআল্লাহ্ আরো একবার একত্রিত হবো আমরা। ”

দুয়া উদরে রাখা অর্ধাঙ্গের হাতের ওপর হাত রাখলো। সুঠাম বক্ষপটে ছেড়ে দিলো নিজস্ব ভর। মৃদু স্বরে বললো,

” মহান রবের নিকট অসীম শুকরিয়া… আমাদের জুটিবদ্ধ করার জন্য। আজকের এই দিনটি উপভোগ করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। শুকরিয়া আমার মহান স্রষ্টার নিকটে। ”

প্রত্যাশিত জবাবে সন্তুষ্ট হলো তূর্ণ। নীরবে আরো ঘনিষ্ঠ হলো। প্রগাঢ় রূপে আয়ত্ত্ব করে নিলো একান্ত সঙ্গিনীকে। ডান কাঁধে পড়ে থাকা কেশগুচ্ছ ঠেলে বাঁ পাশে পাঠিয়ে দিলো। ছোট ছোট উষ্ণ ছোঁয়া অঙ্কন করতে লাগলো কাঁধের উন্মুক্ত অংশে। শিহরণে আবিষ্ট রমণীর আঁখি পল্লব বুজে গেল। ছোট ছোট ছোঁয়াগুলো স্বল্প সময়ের মধ্যে গভীরতম রূপ ধারণ করতেই দিশেহারা হলো কোমল হৃদয়। তড়িৎ পিছু ঘুরে দাঁড়ালো দুয়া। আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো প্রিয় মানুষটিকে। সে-ও নিজের সনে আগলে নিলো। কর্ণের নিম্ন স্তরে বুলাতে লাগলো অধর। সেথা হতে ধীরগতিতে পৌঁছালো চিবুকে। চিবুকের কোমল ত্বকে ওষ্ঠ চেপে মুহুর্তটি উপভোগ করতে লাগলো। আবেশিত রমণী নখ বিঁধে দিলো স্বামীর ডান কাঁধে। ধীরে ধীরে আলিঙ্গন শিথিল হয়ে এলো। পুরুষালি ডান হাতটি স্থাপিত হলো মাইরা’র কপোলে। কর্ণের নিম্নে গলিয়ে দিল চারটে আঙ্গুল। বৃদ্ধাঙ্গুলি চলমান কপোলের মসৃণ আবরণে। নিভু নিভু নয়নে তাকিয়ে দুয়া। পড়তে পারছে নে!শালো নয়নের অব্যক্ত ভাষা। নিজেও যে আজ উদ্দাম আবেশে সিক্ত। চাইছে প্রিয়জনের একান্ত স্পর্শ। অশান্ত হতে শান্ত করতে চায় প্রেমাসক্ত হৃদয়। কপোলে থাকা বৃদ্ধাঙ্গুলের চালনা খানিক বাদে থেমে গেল। নিঃশব্দে অতি নৈকট্যে পৌঁছালো তূর্ণ। মেয়েটিও আঁখি পল্লব বদ্ধ করে প্রস্তুত। সঁপে দিলো নিজেকে। ঘুচে গেল মধ্যকার সবটুকু ব্যবধান। কোমল ওষ্ঠে আধিপত্য বিস্তার করতে লাগলো মানুষটি। দুয়াও সযতনে লেপ্টে গেল মানুষটির সনে। অতিবাহিত হতে লাগলো একান্ত গভীরতম মুহুর্ত! যার সাক্ষী আকাশে উপস্থিত হিমাংশু! সঙ্গে হিমেল হাওয়া।
.

রাতভর বিনিদ্র কাটিয়েছে তৃষা। হৃদয়ে চলমান অশান্তি, অরা*জকতার দরুণ নিদ্রা উবে গেল। বারবার এপাশ ওপাশ করলো। কখনোবা বিছানা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। পায়চারি করতে লাগলো আঁধার কক্ষ জুড়ে। কখনো আবার জানালার ধারে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলীন করবার প্রয়াস চালালো। এসবের ভিড়ে সে হয়তো ঠিকমতো লক্ষ্যও করেনি কক্ষে তার ভাবি অনুপস্থিত। এত রাতে কোথায় গেল মেয়েটি? এসব ভাববার অবকাশ ছিল না। সে তো ব্যস্ত নিজ চিন্তার জগতে। শেষ রাতের দিকে অবশেষে নিদ্রা হাজির হলো। বিছানায় এলোমেলো রূপে দেহ এলিয়ে দিলো তৃষা। স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালো।

মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ভেসে আসছে সুমধুর আযানের ধ্বনি। সে ধ্বনি পৌঁছালো মেয়েটির কর্ণ গহ্বরে। আস্তে ধীরে নিদ্রা ভঙ্গ হলো। ঘুমকাতুরে আঁখি মেলে তাকালো দুয়া। ঝাপসা দেখছে সব। এখনো বেশ ঘুম পাচ্ছে। আরাম পেয়ে বিছানায় ভালোমতো দেহ এলিয়ে দিলো। তবে শক্ত বিছানার অস্তিত্বে হকচকিয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ উবে গেল ঘুম। নিজের অবস্থান অনুধাবন করতেই লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো মুখশ্রীতে। এ কোথায় তারা? সিঁড়ি ঘরের দেয়াল ঘেঁষে বসে ঘুমন্ত তূর্ণ। তার বক্ষদেশে মিশে দুয়া। পেশিবহুল দু হাতের বেষ্টনীতে বন্দী। তপ্ত শ্বাসেরা আঁকিবুঁকি করে চলেছে ললাটে। মুহুর্তের মধ্যেই গরম হলো মেয়েটির কপোলদ্বয়। আযানের ধ্বনিতে হুঁশ ফিরল। বাঁ হাতে এলোমেলো ওড়না জড়িয়ে নিলো মাথায়। অপেক্ষা করলো আযান সমাপ্ত হবার। আযান শেষে আযানের দোয়া পাঠ করলো মেয়েটি। এবার আস্তে ধীরে ডাকতে লাগলো স্বামীকে। কিন্তু ঘুমন্ত মানুষটি সে ডাক নাকোচ করে দিলো। প্রিয়তমার কাঁধে মুখ লুকিয়ে আরামদায়ক ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। দুয়া বাহুতে হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ বাদে বিরক্ত হয়ে আঁখি মেলে তাকালো তূর্ণ। দুয়া’র কপোলে ওষ্ঠ চেপে অস্ফুট স্বরে শুধালো,

” কি হয়েছে? ”

” নামাজের সময় হয়েছে। ওঠো না। ”

খানিকটা অবাক চাহনিতে তাকালো তূর্ণ।

” নামাজ? কোন ওয়াক্তের? ”

” ফজরের। এবার ওঠো না। ”

তৎক্ষণাৎ সম্বিৎ ফিরল তূর্ণ’র। মাথা তুলে আশপাশে তাকালো। ভোরের পরিবেশ। হিমেল হাওয়ায় লোমকূপ দাঁড়িয়ে। চারিদিকে আঁধার বিদ্যমান। তারা এখনো ছাদে? ফজরের আযান দিয়ে দিয়েছে? ওহ্ নো! তড়িঘড়ি করে বাঁধন মুক্ত করলো তূর্ণ। উঠে দাঁড়ালো দু’জনে। দুয়া’র পরিহিত চুড়িদারের এলোমেলো অবস্থা। যেনতেন রূপে ঘুমানোর ফলাফল। মাথায় ভালোমতো ওড়না জড়িয়ে নিলো দুয়া। ওর পেলব হাতটি মুঠোয় নিয়ে বড় বড় কদম ফেলে ছাদ হতে বেরিয়ে এলো তূর্ণ। ছাদের ছিটকিনি লাগিয়ে দু’জনে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। দুয়া’র কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। তূর্ণ অর্ধাঙ্গীর ললাটে উষ্ণ চুম্বন করলো। তাকে ভেতরে প্রবেশ করার ইশারা করলো। বিনিময়ে মুচকি হেসে কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। তপ্ত শ্বাস ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো তূর্ণ। কিন্তু এ কি? কক্ষে প্রবেশ করে হতবিহ্বল দুয়া!

চলবে.

[ কেমন লাগলো তূর্ণয়া’ময় পর্বটি? ]#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৫৩

তূর্ণ’কে বিদায় জানিয়ে বরাদ্দকৃত কক্ষে প্রবেশ করলো দুয়া। প্রবেশ করেই হতবিহ্বল! ধক করে উঠলো অন্তর আত্মা। কতটা সময় ওভাবেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। আচানক সম্বিৎ ফিরে পেতেই ব্যতিব্যস্ত হয়ে বিছানার ধারে ছুটে গেল মেয়েটি। এলোমেলো ভঙ্গিতে বাঁকা হয়ে শুয়ে তৃষা। তাকে অবলোকন করে অজানা ভীতিতে আড়ষ্ট হলো দুয়া। দু পা ধীরে সুস্থে বিছানায় উঠিয়ে নিলো। বসলো তৃষা’র শিয়রে। নিদ্রায় আচ্ছন্ন মানবীর মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে আদর মাখা স্বরে ডাকতে লাগলো,

” তৃষা। অ্যাই তৃষা। ”

দু ডাকেই নেত্রপল্লব মেলে তাকালো তৃষা। নিদ্রা অগভীর ছিল কিনা। দুয়া আঁতকে উঠলো ননদিনীর অবস্থা দেখে। এলোমেলো ভঙ্গিমায় শুয়ে তৃষা। লালাভ আভা ছড়িয়ে চক্ষু জোড়ার সফেদ অংশে। চোখমুখ শুকিয়ে ম্লান। কেশের হাল করুণ। এক রাতেই ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী লাগছে। এমন দেখাচ্ছে কেন ওকে? কি হয়েছে? উদ্বিগ্ন হয়ে দুয়া তৎক্ষণাৎ শুধালো,

” বোন। কি হয়েছে তোর? এভাবে ঘুমিয়ে ছিলি কেন? শরীর খারাপ করছে? ”

কি জানি কি হলো। তৃষা কিচ্ছুটি বললো না। বরং ভাবির কোলে মুখ গুঁজে দিলো। লুকানোর চেষ্টা করলো ভেতরকার সবটুকু গ্লানি, যাতনা। চুপটি করে শুয়ে রইলো সেভাবে। ওর হাল অবলোকন করে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো দুয়া। কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনের মধ্যে ভালোমন্দ বহু চিন্তা উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে। বড় ভয় করছে। সুস্থ সবল হাসিখুশি মেয়েটির এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো? তার অনুপস্থিতিতে খারাপ কিছু…! না না। ছিঃ! এসব কু চিন্তা কি করে সে প্রশ্রয় দিচ্ছে? আল্লাহ্ সহায় আছেন। নিশ্চয়ই সব ঠিক আছে। তবে কি হয়েছে ওর? কিছু বলছেও না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভীত মনটি আরো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। শেষমেষ নিরুপায় হয়ে নীরবতা ই বেছে নিলো দুয়া। নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে পড়লো কক্ষটি। দুয়া কোমল হাতে বিরহে কাতর মেয়েটির মাথায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। কেটে গেল কিছু মুহূর্ত। নানাবিধ চিন্তায় দুয়া’র অবস্থা বেগতিক। কিছু সময় বাদে সে অনুভব করতে পারলো ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের স্পর্শ। তৃষা ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করলো দুয়া। সমস্ত কু চিন্তা দূরীকরণ করতে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস নিলো। ঘুমন্ত মানবীর মাথার নিচে এক হাত এবং ঘাড়ে আরেক হাত গলিয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে আস্তে ধীরে বালিশে শুয়ে দিলো। অতঃপর ওর অগোছালো কেশ, এলোমেলো পোশাক ঠিক করে মাথায় আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে দিলো। দেহে জড়িয়ে দিলো পাতলা কাঁথা। দেয়ালঘড়িতে চোখ পড়তে আঁতকে উঠলো দুয়া। ওহ্ হো! নামাজের ওয়াক্ত শেষের পথে। তড়িঘড়ি করে মেঝেতে পদযুগল নামিয়ে বিছানা ত্যাগ করলো মেয়েটি। ছুটলো ওয়াশরুমের দিকে।

উন্মুক্ত বাতায়নের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। কানে ঠেকানো ক্ষুদ্র যোগাযোগের মাধ্যম। আদিত্য’র মিঠি কিরণ মেখে যাচ্ছে সুঠাম গাত্রে। হালকা হাওয়ায় মসৃণ লালচে চুলগুলো মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় ছুটছে। ফোনালাপে মগ্ন মানুষটি। ওপাশে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলাপণে ব্যস্ত। দিচ্ছে কোনো নির্দেশনা। অধরে লেপ্টে দুর্বোধ্য হাসির রেখা। ফোনালাপ শেষে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলো তূর্ণ। মোবাইল হাতে পিছু ঘুরে কিঞ্চিৎ চমকালো। বিছানায় বসে মিহাদ। দু পা ঝুলিয়ে ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে।

” হোয়াট হ্যাপেন? এমন খা!টাশের মতো হাসছিস কেন? ”

খা.টাশ! এত পঁচা সম্বোধন শুনে মিহাদ অসন্তুষ্ট হলো না। বরং আরো দাঁত কেলিয়ে হাসলো। হাসি হাসি মুখে শুধালো,

” কি ভাইয়া? গতরাত কোথায় ছিলে? প্রেমনগরে? ”

তূর্ণ হাঁটি হাঁটি পায়ে সমতল আরশির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। এলোমেলো কেশ দু হাতে সেট করতে করতে বললো,

” বউয়ের সাথে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে প্রেমনগর যেতে হবে কেন? বউ সাথে থাকলে অলি থেকে গলি যেকোনো জায়গাতেই প্রেমের পবন বয়ে যায়। কোনো বিশেষ জায়গার দরকার হয় না। বুঝলি? ”

মিহাদ দুঃখী বদনে বললো, ” কি করে বুঝবো? আজ অবধি একান্ত একজন পেয়েছি কি? সিঙ্গেল হয়ে মিঙ্গেলের ফিলিংস মাখা কথা বোঝা কতটা কঠিন, তুমি জানো? ”

তূর্ণ ওর দিকে আফশোসের চাহনিতে তাকিয়ে মুখ দিয়ে চুঁ চুঁ রকমের শব্দ করলো।

” আফশোস! তুই আমার ভাই। আস্ত এক গ*বেট। বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের অভাব পড়েছে নাকি? দুয়া’র ফ্রেন্ড আছে। আমার ফ্রেন্ড আছে। আরো কত গেস্ট আছে। একটাও পটাতে পারলি না? তুই তো সিঙ্গেল নামক জাতির ক*লঙ্ক। ”

মিহাদ অবাক চাহনিতে তাকালো! এত বড় অপবাদ! সহে না গাত্রে। করুণ কণ্ঠে বলে উঠলো,

” কি বলছো এসব ভাইয়া? শেষমেষ তোমার বন্ধু! ওই মনিকা আপু তো ম্যারিড। বাকি আছে শুধু দিবা আপু। আমি নাদান ছেলে হয়ে শেষে কিনা সিনিয়র পটাবো? ”

তূর্ণ হেসে বললো, ” চাইলে ট্রাই করতে পারিস। সিনিয়র আপুর সাথে ডেট করার মজাই আলাদা। ইউ নো না? ”

চোখ টিপে কক্ষ হতে প্রস্থান করলো তূর্ণ। আর নাদান ছেলেটি? তার তো অনবরত হিচকি উঠছে। কোনোমতে উঠে বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখা জগের ওপর
হা;মলে পড়লো।
.

মধ্যাহ্ন ভোজের সময় ডাইনিং এরিয়ায় একত্রিত হলো তরুণ প্রজন্ম। খাওয়ার ফাঁকে চলছে কথোপকথন, খুনসুটি। মিহাদ ওর বিপরীত দিকে বসে থাকা ছোট বোনকে উদ্দেশ্য করে খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,

” এই মু;টকি? আর কত খাবি? বিয়েশাদী হয়ে গেছে। এখনো অন্যের অন্ন ধ্বং*স করবি? একটু তো রয়ে সয়ে খা। ”

সিনথিয়া এমন কটূক্তি গায়ে মাখলো না। প্লেটে হাত চালনা করতে করতে বললো,

” ভাই আমার। অন্যের প্লেটে কালি নজর না দিয়ে নিজের প্লেটে নজর দে। গরুর মাংস কয় পিস নিয়েছিস সে খেয়াল আছে? অন্যকে আবার পেটুক বলে! হুহ্! ”

মিহাদ বোকা বনে গেল। সশব্দে হেসে উঠলো বাকিরা। কবির সকলের অলক্ষ্যে বউয়ের দিকে ঠোঁট চোখা করে চু মু ইশারা করলো। ফাটাফাটি বলেছে তার বউটা। সিনথিয়া স্বামীর পানে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তাতে বক্র হাসলো কবির। দুয়া পানির গ্লাসে এক চুমুক বসিয়ে ফাঁকা মাঠে গোল দিলো,

” ভাইয়া। একটু রয়ে সয়ে। আমরাও আছি কিন্তু। ”

কবির ঠিক বুঝতে পারলো কথাটা তাকে উদ্দেশ্য করেই বলা। যদিওবা বাকিরা বুঝতে পারলো না একমাত্র তূর্ণ ব্যতিত। সে একমনে খেয়ে চলেছে। উপস্থিত অন্য সকলে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে চলেছে। বুঝতে পারছে না দুয়া কাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বললো। কবির দুষ্টু হেসে দুয়া’র প্রত্যুত্তরে বললো,

” সমস্যা নেই বোন। বড়রাই তো ছোটদের গুরু। মাঝেমধ্যে এমন টুকটাক ছোটোখাটো টিপস্ দেয়া দরকার। নাহলে তারা শিখবে কি করে? তাই না? ”

হতবিহ্বল দুয়া! তপ্ত হলো তার কপোলদ্বয়। সিনথিয়া তো লাজে মরি মরি। তূর্ণ তো খুব সুন্দর মতো বোন জামাইয়ের সাথে সম্মত হলো।

” একদম ঠিক বলেছো কবির। টোটালি অ্যাগ্ৰি উইথ ইয়্যু। ”

কবির সমর্থক পেয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসলো। বিজয়ের সে হাসি। সিনথিয়া তো লাজে জড়োসড়ো। ছোট-বড় ভাইবোনদের সামনে এসব কি করছে এরা? এতকিছুর ভিড়ে সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক তৃষা। তার চোখজোড়া স্বল্প সিক্ত। ম্লান মায়াবী মুখখানি। তৃষ্ণা জেগেছে চক্ষে। সকলের ভিড়ে অনুপস্থিত আকাঙ্ক্ষিত মানব। নিশাদ। সে এখানে নেই। কোন দরকারি কাজ আছে নাকি। তাই আগেই খেয়ে নিয়েছে। সকলের সাথে যোগদান করেনি। তবে এ কথাটি যে সত্য নয়, মিথ্যা। তা তৃষা ঠিক অনুধাবন করতে পারলো। তার জন্যই তো নিশাদ এমন করছে। এড়িয়ে এড়িয়ে চলছে। দেখেও নাদেখা করে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। এতে করে তার কোমল হৃদয় যে ভ!ঙ্গুর অবস্থায় ছটফট করে চলেছে! সে খবর কি জানে ভাবলেশহীন মানবটি? সকলের অলক্ষ্যে তর্জনী ছুঁয়ে নেত্রকোণে জমায়িত অশ্রু মুছে নিলো তৃষা। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস চালিয়ে গেল। সে মুহূর্তে কর্ণ কুহরে পৌঁছালো তূর্ণ’র কণ্ঠ,

” তৃষা। তোর প্লেট তো খালি। কিছু নে। ”
.

রিসোর্টের একাংশে সরু পথ। পথের দু ধারে সারি সারি দৈ-ত্যকায় বৃক্ষ সমারোহ। কর্ণ কুহরে ভেসে আসছে পাখপাখালির মৃদু গুঞ্জন। নিরিবিলি নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত এমন পরিবেশে একাকী উপস্থিত মানব। লম্বাকার গাছের সনে হেলান দিয়ে বসে সে। বাঁ পা জমিন ছুঁয়ে তো ডান পা ভাঁজ করে উঁচু ভাবে দাঁড় করা। হাতে তার ক্ষুদ্র এক যন্ত্র। নাম সে যন্ত্রের স্মার্টফোন। তাতে দৃশ্যমান হৃদয়ে লুকানো রমণীর অবয়ব। হাসিখুশি মুখখানি সে যতবার দেখে ততবারই শীতলতম অনুভূতি জেঁকে ধরে অন্তঃস্থলে। রমণীটিকে আরেকটু খানি ভালোবাসার, নিজের সনে আগলে নেয়ার, পবিত্রতম বাঁধনে বেঁধে রাখার ইচ্ছেরা উড়াল দেয় হৃদ দিগন্তে। ছোটখাটো এই মেয়েটিকে সে যে খুব করে ভালোবাসে। দু’টো বছর ধরে লালন করে আসছে হৃদ মাঝারে। কম সময় নয়। দিনপঞ্জির হিসেব মতে লম্বা সময়। সর্বদা সে আড়ালে আবডালে থেকে হৃদয়ে লুকানো রমণীকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছে। প্রয়াস চালিয়েছে সমস্ত দুঃখকষ্ট- ভয় থেকে দূরে রাখার। আল্লাহ্’র রহমতে সফল হয়েছে বটে। এই দু’টো বছরে একটু একটু করে তার অনুভূতি গাঢ় হয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে হৃদয়ের অলিগলি সর্বত্র। বক্ষস্থলে একান্ত রমণী রূপে তাকে মিশিয়ে নেবার ইচ্ছে বারংবার জাগ্রত হয়েছে। তবে সে তাড়াহুড়ো করেনি কখনো। বরং তার লুকানো অনুভূতি লুকায়িত রেখেছে। অপেক্ষা করেছে সঠিক সময়ের। তবে তার অপেক্ষার প্রহর যে যাতনায় সমাপ্ত হবে জানা ছিল না। শেষে এই ছিল তার তাকদীরে? তার হৃদয়ে লুকানো প্রেম এভাবেই অসমাপ্ত, অপূর্ণ রইবে! কভু মিলবে না সে রমণী! তার ছোঁয়ায় আবেশিত হবে না পৌরুষ চিত্ত! হয়ে যাবে দু’জনার দু’টি পথ আলাদা! কেন? কি অন্যায় করেছে সে? প্রেমিক হতে গিয়ে শা*সক হয়ে গিয়েছিল? বেশি ত্রাশ সৃষ্টি করে ফেলেছে! হৃদয়ে লুকানো রমণীর নিকট সে এখন এতটাই অপছন্দনীয়? ঘৃণ্য? ঘৃণা শব্দটি মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই স্নায়ু দুর্বল হয়ে পড়লো। গাছের সঙ্গে লেপ্টে গেল মানুষটির দেহ। অসহনীয় যন্ত্রণা সৃষ্টি হলো বক্ষ মাঝারে। বদ্ধ হলো অক্ষি জোড়া। সে অক্ষিকোল গড়িয়ে পড়লো ক ফোঁটা তপ্ত কণা। পুরুষ মানুষের হৃদয় নাকি পাথরের মতো কঠিন। তাদের কাঁদতে মানা। চিরচেনা সে রীতি ভঙ্গ করে আজ ক্রন্দনে লিপ্ত হলো নিশাদ। তার প্রেমী চিত্ত ভেঙেচুরে আজ অগণিত টুকরো। কভু লাগবে না আর জোড়া!
.

নিশুতি রাত। পুরুষালি হাতের মাঝে বন্দী পেলব হাতটি। সতর্কতা অবলম্বন করে দুজনে বেরিয়ে এলো রিসোর্টের ভবন হতে। মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে মৃদু স্বরে শুধালো,

” এভাবে রাতদুপুরে আমরা চোরের মতো কোথায় যাচ্ছি? বলো না। ”

” আরে ভাই একটু ধৈর্য ধর। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। জানিস না? ”

” আমি ভাই হই? ” ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দুয়া।

তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো, ” কথার কথা বললাম। এটাও বুঝিস না? ”

” তুমি কিন্তু কথা এড়িয়ে যাচ্ছো। সত্যিটা বলবে না? ”

” হ্যাভ প্যাশেন্স। ”

অধৈর্য হয়ে মুখ ফুলালো দুয়া। নীরবে হাঁটতে লাগলো সঙ্গীর সনে।
.

আঁধারিয়া রজনী চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে সে কপোত- কপোতী। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। আঁধারের মাঝে তূর্ণ হাতের ইশারায় দেখিয়ে দিলো চমক। সেথায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে স্তব্ধ হলো দুয়া! অজান্তেই ডান হাতে ঢেকে গেল ওষ্ঠাধর। অবাক নয়নে স্বামীর পানে তাকালো মেয়েটি। তূর্ণ মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। দুয়া পুলকিত, স্তম্ভিত! নীরবে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো প্রেমিক রূপী স্বামীটি। ইশারায় হাতে হাত রাখার আহ্বান জানালো। সম্মোহিতের ন্যায় পুরুষালি হাতের মাঝে নিজের হাতটি স্থাপন করলো দুয়া। তূর্ণ’র বাঁ হাতে বন্দী দুয়া’র কোমল হাতখানি। ডান হাতে মোবাইল তুলে ধরা। ফ্লাশ লাইটের আলোয় পথ ধরে তারা এগিয়ে গেল। সাবধানতা অবলম্বন করে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পেরিয়ে নিচে নেমে গেল। প্রথমে তূর্ণ উঠলো কায়াক এ ( kayak ). সে কায়াকে উঠে সঙ্গিনীর পানে হাত বাড়িয়ে দিলো। সাবধানতা অবলম্বন করে স্বামীর হাত ধরে কায়াকে উঠলো উত্তেজনায় কম্পিত দুয়া। তূর্ণ’র ইশারা মতো সে সাবধানে বসলো।

মাঝারি আকৃতির নীলাভ শুভ্র মিশেলের কায়াক’টি। মধ্যখানে একটি লণ্ঠন রাখা। লণ্ঠন হতে হলদে দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে কায়াকের অন্দরে। মাথার ওপরে কৃষ্ণবর্ণ নভস্থল। গাত্রে ছুঁয়ে যাচ্ছে হিমেল পবন। চারিদিকে আঁধারের মাঝে এক টুকরো হলদে আভা। সঙ্গী হিসেবে রয়েছে একান্ত জন। সে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ! ভালোলাগার আবেশে সিক্ত হলো তনুমন। আচমকা ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। লেকের বুকে আঁধার রাতে চলতে শুরু করেছে কায়াক’টি। কায়াকের নিয়ন্ত্রণ তূর্ণ’র হাতে। চিকন বৈঠা মতো লাঠিটি জলজ বুক চিঁড়ে এগিয়ে চলেছে। দুয়ার অধরে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। যে খুশিতে সয়ংক্রিয়ভাবে সংক্রমিত হলো প্রেমিক পুরুষটি। মনোমুগ্ধকর এ পরিবেশে হঠাৎ মোহনীয় সুর ভেসে উঠলো,

‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘

চমকিত নেত্রে স্বামীর পানে তাকালো দুয়া! তার চোখেমুখে অবাকতার পাশাপাশি উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হলো। তাতেই সন্তুষ্ট হলো হৃদয়। তার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বুঝি এক ফালি হাসিতেই সফলতা অর্জন করলো। স্বামীর চোখের ইশারায় দুয়াও এবার সুরেলা সঙ্গ দিলো। আঁধারের মাঝে মেয়েলী কণ্ঠে ভেসে উঠলো,

‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘

তূর্ণ’র অধর কোণে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। হৃদয় ছুঁয়ে গেল শব্দমালা গুলো। তার হৃদয়ে লালিত রমণীর কণ্ঠ বড্ড সুমধুর! হৃদয়, কর্ণ, মস্তিষ্ক সর্বত্র মা*দকতা ছড়িয়ে দেয়। মাইরা’র চোখের গভীরতায় ভেসে বেড়ানোর মাঝে সে-ও এবার নিজস্ব মনোভাব সুরে সুরে ব্যক্ত করতে লাগলো,

‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘

দুয়া বিমোহিত নয়নে চেয়ে স্বামীর পানে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে একান্ত জনকে। মিটিয়ে চলেছে চক্ষু তৃষ্ণা। হৃদয়ের তৃষ্ণা। এক হাতে বৈঠা আগলে ডান হাতটি বাড়িয়ে দিলো তূর্ণ। ধ্যান ভঙ্গ হলো মেয়েটির। কপোলে ছেয়ে গেল আর’ক্ত আভা। লাজুক রমণী অর্ধাঙ্গের হাতে হাত রাখলো। সুরে সুরে ব্যক্ত করে গেল,

‘ তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন
তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘

অমোঘ আকর্ষণে বশীকরণ হয়ে অর্ধাঙ্গের পানে এগিয়ে গেল দুয়া। বসলো সুঠাম বক্ষপটে পৃষ্ঠ এলিয়ে। তাকে আঁকড়ে ধরলো স্বামী রূপী প্রেমিক পুরুষটি। আবেশে বুজে এলো মেয়েটির আঁখি পল্লব। একান্ত জনকে অনুভব করতে করতে ভীন দুনিয়ায় হারিয়ে গেল। পেলব হাতটি রাখলো উদরে স্থাপিত অর্ধাঙ্গের হাতের ওপর। থেমে থেমে কণ্ঠ নিঃসৃত হতে লাগলো,

‘ ইতিউতি কার্নিশে
আলো-ছায়া যায় মিশে
চলো না কুড়োবো আবার
এলোমেলো চেনা রুট-এ
বসন্ত যায় যায় যায় জুটে
ভালোবেসে জীবন কাবার ‘

লেকের বুকে থেমে গেল কায়াক। বৈঠা সতর্ক ভঙ্গিতে আগলে রেখে অর্ধাঙ্গীকে নিজের সনে মিশিয়ে নিলো তূর্ণ। ললাট কার্নিশে অধর ছুঁয়ে দিলো। জাগতিক হুঁশ ফিরে এলো মেয়েটির। তপ্ত হলো কপোল। তূর্ণ সম্মোহনী স্বরে গাইতে লাগলো,

‘ গুঁড়ো গুঁড়ো করিডোরে
চুপিসারে পাতা উড়ে
আজ বাতাসও মা!তাল
বেপরোয়া হাফ ছুটি
মাখাচ্ছে খুনসুটি, খুনসুটি
ভালোবেসে উথালপাথাল ‘

মাইরা’কে দু হাতে সযতনে আগলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। চোখে চোখে আলাপণ সেরে কপালে ঠেকে গেল কপাল। বদ্ধ হলো দু’জনার আঁখি। পুরুষালি স্বরে ভেসে এলো,

‘ এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে
এত কথা বলি যাকে
চিনি আমি চিনি তাকে ‘

দুয়া মন্থর গতিতে কপাল হতে কপাল সরিয়ে নিলো। আঁখি মেলে তাকালো দু’জনে। স্বামীর নয়নে নয়ন মিলিয়ে দুয়া গেয়ে উঠলো,

‘ চোখে চোখে কথোপকথন
তুই ছুঁলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘

প্রিয়তমার কোমল ওষ্ঠে আলতো পরশ বুলিয়ে তূর্ণ গাইতে লাগলো,

‘ তুই হাসলি যখন
তোরই হলো এ মন ‘

লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো মেয়েটির মায়াবী বদনে। দুজনের একত্রিত সুরের কলতানে মুখরিত হলো চারিপাশ,

‘ দু’চোখে আঁকছে শীত
বাহারি ডাকটিকিট
দু’চোখে আঁকলো শীত
বাহারি ডাকটিকিট
আলসে রোদের চিঠি পাঠালো পিয়ন ‘

সমাপ্ত হলো প্রেমময় গানের শব্দমালা। আবেশে সিক্ত কপোত কপোতী গাঢ় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো। মাঝ লেকের বুকে থমকে কায়াক। তাতে প্রেমাসক্ত এক জোড়া কপোত-কপোতী। মগ্ন নিজেদের মধ্যে। বাতাসেও যেন আজ প্রণয়ের অনুভূতি।

চলবে.

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। কেমন লাগলো আজকের বিশাল বড় পর্বটি? শব্দসংখ্যা ২১০০+. কাহিনীর স্বার্থে আজ পুরো লিরিক্স ব্যবহৃত হলো। আশা করি পাঠকবৃন্দ বিব্রত বোধ না করে মুহুর্তটুকু উপভোগ করবে। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here