বসন্ত বেলায় পর্ব -০২ ও শেষ

#বসন্ত_বেলায়
#মনিয়া_মুজিব

|২|

ভোর পাঁচটায় বাস ঢাকায় এসে পৌঁছায়। রায়া আর আঈদাহ্ একসাথেই নেমে পড়ে। স্টেশনে দিগন্তকে দেখে আঈদাহ্ দৌড়ে যায় তার কাছে। তাকে দৌড়াতে দেখে রায়া সামনে তাকায়। কিছুক্ষণের জন্য স্ত ব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে কেবল সামনের মানুষটির দিকে। দিগন্ত, হ্যাঁ তার দিগন্তই আজ তার সামনে। উঁহু তার নয়, আঈদাহ্’র স্বামী দিগন্ত। খুব জলদিই ভুলটা শুধরে নেয় সে।

আঈদাহ্ দিগন্তকে রায়ার কাছে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়। দিগন্ত স্বাভাবিকভাবেই রায়ার সাথে কথা বলে,
“আসসালামু আলাইকুম। আমি দিগন্ত, আঈদাহ্’র হাসবেন্ড।”
“আমি রায়া।”
“আঈদাহ্ বাসে থাকাকালীন সময়েই ফোনে বলেছে আপনার কথা। থ্যাংকস ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। নয়তো ও একা একা, এতো সাহস নিয়ে আসতে পারতোনা, বোরও হয়ে যেত।”
“থ্যাংকস এর প্রয়োজন নেই। আমি না থাকলেও ও বোর হতো না। আপনি যেভাবে একটু পরপর ওর খোঁজ নিয়েছেন তাতে ওর সময় বেশ আনন্দেই কাটছিল।”
“আসলে ওর সাথে বেশিক্ষণ কথা না বলে আমি থাকতে পারি না। যাই হোক, আসি তাহলে আমরা। সময় করে আমাদের বাসায় আসবেন, আমার আর আঈদাহ্’র ছোট্ট সংসারে। আপনার হাসবেন্ডকেও নিয়ে আসবেন। উনি হয়তো এখনো স্টেশনে এসে পৌঁছান নি। তাই আজ দেখা হলো না। ইন শা আল্লাহ দেখা হবে অন্য কোনো একদিন।”
“উনি এসে পড়বেন কিছুক্ষণের মধ্যেই। আপনারা চলে যান, আমার বাসায়ও আপনাদের দুজনের আমন্ত্রণ রইলো।”
“ঠিক আছে। আঈদাহ্ চলো তবে যাওয়া যাক।”
“হ্যাঁ চলো। আসছি রায়া আপু। ভালো থাকবেন। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।”
“আমারও, দোয়া করি তুমি খুব খুব সুখী হও আঈদাহ্। তুমি সুখী হওয়া ডিজার্ব কর।”
“অসংখ্য ধন্যবাদ আপু।”

দিগন্ত আর আঈদাহ্ চলে গেল। রায়াও অশ্রুসিক্ত লোচনে এগিয়ে চলছে নিজ গন্তব্যের দিকে। সে খুব ভালো করেই জানে ফারাজ তাকে নিয়ে যেতে আসবে না। একাই বাসায় ফিরতে হবে তাকে। অবশ্য বাসায় না ফিরলেও খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই তার। ফারাজ এখন তার পুরোনো প্রেমিকা নিয়ে মহা ব্যস্ত। জীবনের প্রথম প্রেম নাকি ভোলা যায় না। কিন্তু সেই প্রেম যে নিজের বিবাহিতা স্ত্রীকে ভুলিয়ে দিতে পারে ফারাজকে না দেখলে রায়া সেটা কখনোই জানতো না। মেয়েটা ফারাজের ছোটবেলার বান্ধবী কাম প্রেমিকা। তার মায়ের খালাতো বোনের মেয়ে, আফিয়া। আফিয়ার সাথে ফারাজের সম্পর্কের খবর রায়ার কানে আরও অনেকদিন আগেই এসেছিল। তাইতো আফিয়ার নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ নিতে গিয়েছিল ফারাজের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে। আর তাদের সম্পর্কের সত্যতা নিশ্চিত হয়েই আজ ঢাকায় ফিরে এসেছে। যদিও ফারাজকে বলে গিয়েছিল ওর শ্বশুর শাশুড়িকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে। সে কথাও অবশ্য মিথ্যে নয়। বৌমা হওয়ার সুবাদে ছেলেকে কেড়ে নিয়ে যেভাবে তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, ঠিক সেই একই অবস্থানে নিজেকে দেখতে চাইছে না বলেই তো রায়ার শ্বশুরবাড়ির পথে গমন। কিন্তু না চাইলেও অনেক কিছুই আমাদের পাওয়ার খাতায় জমা হয়। তাইতো ফারাজের বাবা-মায়ের প্রতি করা রায়ার অবহেলা ঠিক বুমেরাং এর মতো ওর দিকেই ফিরে এসেছে, তাও আবার ফারাজের ই মাধ্যমে।

বিষন্নতার নীলবিষে আকণ্ঠ ডুবে রায়া আজ জীবনে প্রথমবারের মতো আবিষ্কার করলো সে খুব বাজেভাবে হেরে গেছে। নিজেকে আজ সত্যি সত্যি দিগন্তের অযোগ্য বলে মনে হচ্ছে তার। সে তাকে ভালোবাসতেই পারে নি কখনো। আঈদাহ্ কেমন দিগন্তের সাথে সাথে তার সবকিছুকেই ভালোবেসে ফেললো, তেমনটা তো সে পারে নি। দিগন্ত যে আজ খুব সুখে আছে সেটা সে বুঝতে পারেছে। সেও মনে-প্রাণে চায় দিগন্ত আর আঈদাহ্ সুখে থাকুক। রায়ার আফসোস আজ তার নিজের জন্যই। বারবার মনে হচ্ছে কেন সে সঠিক সময়ে সঠিক মানুষটাকে চিনতে পারলো না। যে মানুষটা তাকে সবসময় এতো অগ্রাধিকার দিত তাকে কিভাবে হেলা করতে পারলো সে, কিভাবে তার ভালোবাসাকে তুচ্ছজ্ঞান করতে পারলো! উত্তর নেই আজ রায়ার কাছে৷ কিছুই আর আগের মতো হবে না। যে দিগন্তকে সে নিজ থেকে ছেড়ে এসেছে তার কাছে ফেরার কোনো পথই খোলা নেই। যে ফারাজের জন্য সে এতোকিছু করেছে, সেও আজ আর তার কাছে নেই। সে মনস্থির করে ফেলেছে, বাসায় ফিরে ফারাজের সামনে দাঁড়িয়ে সব প্রশ্নের উত্তর চাইবে। কিন্তু উত্তর দিলেই বা কি হবে! ফারাজ যদি ওকে ভুলে আফিয়াকে নিয়ে সুখে থাকতে চায়। কিংবা রায়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে যদি ভুল বুঝাবুঝি মিটিয়ে নিতে চায়। তাহলে কি সে ক্ষমা করে দিতে পারবে? ক্ষমার করার প্রশ্নই আসে না, নিজের মনকে কড়াকড়িভাবে উত্তরটা দিল সে। ফারাজ তার মনে যে গভীর ক্ষতটা তৈরি করে দিয়েছে, সেই ক্ষত তো এতো সহজে সারবার নয়। সব ভুলে তাকে একাই সামনে আগাতে হবে। একাই তাকে পাড়ি দিতে হবে অসীম ক ষ্টে র অকুল পাথার। সহসাই রায়ার মনে একটা প্রশ্ন খেলে গেল,
“আচ্ছা, দিগন্ত আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছে তো!”

মুহূর্তেই চেতনাশূন্য দেখালো রায়াকে। চোখ-মুখের আতঙ্কিত ভাব জবাবটা স্পষ্টভাবেই দিয়ে দিল,
“তুমি ক্ষমার যোগ্য নও রায়া। তুমি প্রেমের যোগ্য নও। তুমি ভালোবাসারও যোগ্য নও।”


সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে দিগন্ত আঈদাহ্কে নিয়ে তাদের ফ্ল্যাটে প্রবেশ করল। বসার ঘরেই তার বাবা-মা বসে আছেন। আঈদাহ্ বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করল তাদের সাথে। শাশুড়ি মা মাথায় হাত বুলিয়ে আদরের সাথে বললেন,
“আমরা তো তোর শোকে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলাম রে। এতোদিন কেউ বাপের বাড়ি থাকে বল তো। আমাদের কথা কি মনে পড়ে নি?”
“কি বলছ আম্মু! তোমাদের কি আমি ভুলেছি নাকি। এই দেখো সকাল সকাল কেমন চলে এলাম।”

এবার আঈদাহ্’র শ্বশুর মশাই মুখ খুললেন,
“তুমি যে কি কর না দিগন্তের মা। মেয়েটা সারারাত জার্নি করে সবে বাড়ি এসেছে, এখনই অভিযোগের ফিরিস্তি নিয়ে বসলে! যাও মা, ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নাও। ততক্ষণে তোমার শাশুড়ি মা খাবার রেডি করুক।”
“না আব্বু, আমি এসেই খাবার রেডি করব। আপনারা বসুন, মায়ের উঠতে হবে না এখন।”
“হয়েছে আর পাকামি করতে হবে না। এতদিন আপনি ছিলেন না সব আমাকেই করতে হয়েছে। বুড়ি একটা, যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“আচ্ছা আম্মু, যাচ্ছি।”

আঈদাহ্ কথা শেষে রুমের দিকে পা বাড়ালো। দিগন্ত ব্যাগপত্র নিয়ে আগেই রুমে চলে এসেছে। আঈদাহ্ খেয়াল করে দেখলো রুমে আসার পর থেকেই দিগন্ত পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করছে। তার হাবভাব সুবিধার ঠেকছে না। তাই আঈদাহ্ এগিয়ে গিয়ে দিগন্তের কাঁধে হাত রাখলো।
“তুমি ঠিকাছো?”
“না।”

দিগন্তের সোজাসাপটা উত্তরে আঈদাহ্ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো। পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে বলো আমাকে।”
“তুমি আমাকে ভুল বুঝবে।”
“কেন? কি করেছ তুমি?”

দিগন্ত তাড়াহুড়ো করে আঈদাহ্’র অন্য হাতটি চেপে ধরলো।
“আঈদাহ্, বিশ্বাস কর বাসে যে রায়া থাকবে আমি জানতাম না।”
“বাসে… রায়া আপু থাকাতে কি হয়েছে?”
“তোমাকে বলেছিলাম না ভার্সিটিতে থাকাকালীন আমার একটা অ্যাফেয়ার ছিল? নামটাও বলেছিলাম তোমাকে। তোমার সাথে বাসে যে রায়া ছিল সে ই রায়া ফারদিন, আমার সো কল্ড এক্স।”

একথা বলে দিগন্ত আঈদাহ্’র মুখের দিকে তাকালো। কিন্তু সেখানে স্তব্ধতা ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। এবার কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলতে লাগলো,
“আঈদাহ্, প্লিজ আমাকে ভুল বোঝোনা। রায়ার সাথে আমার সম্পর্ক ভার্সিটির তৃতীয় বর্ষেই শেষ হয়ে গেছে। যেদিন সে আমাকে ছেড়ে ফারাজের হাত ধরেছে ঠিক সেদিন থেকেই আমাদের সম্পর্ক শেষ। আমার মনে তুমি ছাড়া কারো জন্যই কিছু নেই।”

দিগন্ত বরাবরই পড়ুয়া ছেলে। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে যেখানে সবাই আড্ডায় ব্যস্ত থাকতো, সেখানে তাকে বই হাতে ক্যান্টিনে দেখা যেত। তার একমাত্র লক্ষ্যই ছিল ভালো একটা সিজিপিএ নিয়ে সম্মানের সাথে ভার্সিটি থেকে বের হওয়া। তাই পড়াশোনার ক্ষেত্রে সে কোনো আপোষ করেনি। কিন্তু রায়া ছিল একদম তার উল্টো। সারাদিন হৈচৈ আর আড্ডায় মেতে থাকতো সে। আর পরীক্ষার আগে দিগন্তের থেকে নোট নিয়ে দেখে যেত শুধু। যার ফলে তার রেজাল্টও তেমন ভালো হতো না। অন্যদিকে দিগন্ত ছিল ডিপার্টমেন্ট এর টপার। কিন্তু দিগন্তের এই পড়ুয়া মনোভাব আর আড্ডায় নিস্পৃহতা রায়ার একদমই সহ্য হতো না। মাঝে মাঝে এই নিয়ে দিগন্তকে দু’চার কথা শুনিয়েও দিত। এভাবেই দিনের পর দিন তাদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে একটা অদৃশ্য ফাঁকা স্থান তৈরি হয়ে যায়। যে স্থান গলিয়ে অচিরেই ঢুকে পরে ফারাজ নামক মানুষটি। ভার্সিটির প্রথম বর্ষ থেকেই রায়াকে তার পছন্দ ছিল। ছাত্র হিসেবেও সে মন্দ ছিল না। যার ফলে ক্রমশ দিগন্তের অঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে সে। তাইতো দিগন্ত আর রায়ার মনোমালিন্যের সুযোগ নিয়ে রায়াকে জয় করে নিতে একমুহূর্ত দেরিও করে নি ফারাজ আবেদীন।

আঈদাহ্ দিগন্তের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো।
“তুমি ভাবলে কিভাবে এমন একটা সামান্য ব্যপারে আমি ক ষ্ট পাব। তুমি তো আমার চোখে একদম পরিষ্কার। নিজের থেকেও ভালো করে আমি তোমাকে পড়তে পারি। তোমার অতীত আমার অজানা নয়। আর রায়া আপুর সাথে দেখা হওয়াটা ছিল একটা কাকতাল। এই নিয়ে আমি রাগ করব কেন!”
“তুমি জান আঈদাহ্ অতীত নিয়ে আমি কতটা লজ্জিত। সেই অতীত ভুলগুলো যখন আমার সামনে আসে তখন নিজেকে সামলানো বড্ড দায় হয়ে যায়।”
“এসব ভেবে একটুও লাভ নেই। অতীতকে তার জায়গায় থাকতে দাও। অতীতের কিছুই আমরা পরিবর্তন করতে পারব না।”
“ঠিক ই বলেছ তুমি। আমার একটা কথা রাখবে প্লিজ।”
“কি কথা?”
“রায়ার প্রতি আমি কোনো অভিযোগ মনে পুষে রাখিনি। আমি চাই তুমিও এসব কিছু ভুলে যাও। কারো প্রতি বিদ্বেষ রেখো না।”
“তুমি একদম ভেবো না। অন্যদের নিয়ে ভাবার সময় কি আছে আমাদের! আপুর সাথে কালকে আমার যেমন সম্পর্ক ছিল, ভবিষ্যতে কখনো দেখা হলে তেমনই থাকবে।”
“এই তো আমার মিষ্টি বউ এর মতো কথা।”
“ঢং, তবে তোমার কোনো ক্ষমা নেই। আজকে রাতে আমাদের সবাইকে তোমার নিজ হাতে রান্না করা কাচ্চি খাওয়াতে হবে। বলো রাজি?”
“কবুল। আপনার সব হুকুম আমি মাথা পেতে নিলাম মহারাণী।”
“নিতে তো হবেই। নইলে সোজা ঢাকা টু রাজশাহীর বাসে ওঠে পড়ব।”
“একদম না। তুমি না থাকলে আমার বাসাটা একদম খালি খালি লাগে। ভাগ্যিস তুমি আমার জীবনে এসেছিলে।”
“হুঁ, এসে তোমাকে উদ্ধার করেছি।”
“হা হা…
‘এসেছিলে এর বসন্ত বেলায়
যেমন আসে মধুসখা,
তাইতো রোজ আমার ঘরেতে
কুমুদ ফোটে থোকা থোকা।’
কবিতাটা কেমন হয়েছে? তোমাকে নিয়ে বানিয়েছি।”
“ভালো হয় নি।”
“কেন? কেন?”
“আমি তো মধুসখা হতে রাজি নই। আমি বরং কাক হব। সবসময় তোমার কানের কাছে কা কা করে যাব।”
“কাক হলেও আমার আপত্তি নেই। শুধু তুমি হলেই চলবে।”
“সত্যি?”
“একদম।”
“এই দিগন্ত, আঈদাহ্, কোথায় তোরা? সেই কখন টেবিলে খাবার দিয়েছি এখনো আসার নাম নেই দুটোর।”

রান্নাঘর থেকে মায়ের হাঁকডাক শুনে দ্রুত টেবিলে চলে আসল দিগন্ত আর আঈদাহ্। দিনশেষে খাবার টেবিলে এই হাসিখুশি পরিবার ই তো সকলের কাম্য। ভালো থাকুক পৃথিবীর প্রতিটি পরিবার। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল দিগন্ত আর আঈদাহ্’রাও।

~সমাপ্ত~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here