#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৭
” সত্যিটা আর কতটা লুকাবেন ফুফু আম্মা? এবার তো মুখ খুলুন। সে রাতে কি হয়েছিল এ টু জেড বলে ফেলুন। উই আর ইগারলি ওয়েটিং। বলুন বলুন। ”
চরমভাবে ধরাশায়ী সাজেদা ফুফু। উনি বুঝতেই পারছেন না এই মুহূর্তে কি করা উচিত। কি বলা উচিত। করবেন টা কি উনি?
.
সকালের নাস্তা শেষে কিচেন সাফ করছিলেন সাজেদা। জাবির এবং তানু ব্রেকফাস্ট করে নিজ নিজ কাজে বেরিয়ে পড়েছে। দেড় মাস হলো উনি এবং তানু ঢাকায় শিফট হয়েছেন। হবেন নাইবা কেন? ছেলে ওনার কর্মসূত্রে ঢাকায় এসে পড়েছে ক’মাস হলো। আদরের পুত্র একাকী থাকছে। হেল্পিং হ্যান্ডের বানানো অখাদ্য খাচ্ছে। মা হয়ে উনি তা সইতে পারছিলেন না। তাই তো বগুড়ায় সবটা গুছগাছ করে ঢাকায় চলে এলেন। হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য। কিংবা পুত্রের জন্য এখানেই থেকে যাবেন। তবে দুঃখের বিষয় এই যে ওনার ঢাকায় স্থানান্তর হওয়ার খবরটি শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের অজানা। সাজেদা ভাইকে খবর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। মনের কোণে যে অভিমান চাপা পড়ে রয়েছে। শুধুই কি অভিমান নাকি অন্য কিছু? হঠাৎ ওনার ভাবনায় ছেদ পড়লো। কলিংবেল বেজে চলেছে। এখন আবার কে এলো? জাবির অফিসে আর তানু কলেজে। তবে কে? কিচেন সিঙ্কে হাত ধুয়ে নিলেন উনি। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজার কাছে গেলেন। দরজা উন্মুক্ত হতেই অবাক হলেন উনি! তূর্ণ এবং দুয়া! ওরা কোথা থেকে এলো?
” আসসালামু আলাইকুম ফুফু আম্মা। ”
তূর্ণ বড় করে সালাম দিলো। যাতে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন উনি। দুয়া সিক্ত নয়নে ফুফুর পানে তাকিয়ে। সাজেদা তা লক্ষ্য করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। তূর্ণ দুয়া’র হাত ধরে ফুফুর পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বললো,
” ফুফু আম্মা সালামের জবাবটা দিলেন না কিন্তু। সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব। ”
সাজেদা ক্ষীণ স্বরে সালামের জবাব দিলেন। তূর্ণ মুচকি হেসে অর্ধাঙ্গিনীকে নিয়ে সোফায় বসলো। দু’জনে পাশাপাশি। সাজেদা দরজা আটকে ওদের কাছে এলেন। এখনো দাঁড়িয়ে উনি। তূর্ণ ওনাকে সোফায় বসার ইশারা করে বললো,
” বসেন বসেন। লজ্জা পাবেন না। আপনারই তো ঘর বাড়ি হোম। বসেন। কষ্ট করে নাস্তার আয়োজন করতে হবে না। আমরা ব্রেকফাস্ট করে এসেছি। ”
সাজেদা গরম চোখে তাকিয়ে তূর্ণ’র বিপরীত দিকে সোফায় বসলেন। মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলেন,
” তোমরা হঠাৎ? ”
” কেন ফুপি? আমরা কি আসতে পারি না? আসতে বারণ? ”
দুয়া’র প্রশ্নে সাজেদা কি বলবেন খুঁজে পেলেন না। উনি তূর্ণ’র দিকে তাকালেন।
” কি জন্য এসেছো তুমি? নতুন কোনো ড্রামা করতে? ”
তূর্ণ সোফায় আয়েশ করে বসলো। বাম পায়ের ওপর তুলে রাখলো ডান পা।
” কারেকশন ফুফু আম্মা। ড্রামা করতে আসিনি। বরং ড্রামার সমাপ্তি ঘোষণা করতে এসেছি। ”
” মানে কি? যা বলার সোজাসাপ্টা বলো। এরপর চলে যাও। ”
তূর্ণ অভিমানের সুরে বললো,
” প্রথমবারের মতো আদরের ভাতিজি আর তার বর আপনার বাসায় এলো। আপনি তাদের আপ্যায়ন না করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছেন? লোকে কি বলবে বলুন তো? পঁচা বলবে না? ”
তেঁতে উঠলো সাজেদা।
” একদম বাজে কথা বলবে না। কথা না পেঁচিয়ে কিসের জন্য এসেছো বলে ফেলো। আমার ছেলেমেয়ে বাসায় নেই। ”
দুয়া মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে বললো,
” আমরা তোমার কাছেই এসেছি ফুপি। ”
” কেন এসেছিস? জামাই নিয়ে রঙঢঙ করতে? ”
তূর্ণ তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ জানালো।
” আসতাগফিরুল্লাহ্! কি যে বলেন না ফুফু আম্মা। জামাই নিয়ে কেউ রঙঢঙ করে নাকি? জামাই নিয়ে ভালোপাশাপাশি করে। বেবি প্রডিউস করে। আরো কত কি করে। ওসব কি আর বলা যায়? ”
লজ্জা লজ্জা মুখ করে তূর্ণ কথাটা শেষ করলো। সাজেদা তো হতবিহ্বল! দুয়া কটমট করে স্বামীর দিকে তাকালো। অতঃপর ফুপির দিকে তাকিয়ে মোলায়েম স্বরে বলতে লাগলো,
” ফুপি! সে রাতে কি হয়েছিল? আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই। কোনো বাহিরের লোকের কথা শুনতে চাই না। প্লিজ ফুপি তুমি একবার বলো ওসব সত্য নয়। সে রাতে তোমার কোনো ষ*ড়যন্ত্র ছিল না! বলো না ফুপি।”
সাজেদা জিজ্ঞাসু নয়নে তূর্ণ’র দিকে তাকালেন।
” কি? বাহিরের লোক কাকে বললো তাই ভাবছেন তো? মিনু খালাকে বলেছে। মিনু খালাকে চিনতে পেরেছেন? আমাদের বাসার হেল্পিং হ্যান্ড। পাঁচ বছর ধরে কাজ করছিল। কিন্তু এক লহমায় বিশ্বাসঘা*তকতা করে বসলো। তবে শেষমেষ মুখ খুলেছে। ”
সাজেদা কি একটু ভড়কে গেলেন? হয়তো হাঁ। তবে নিজেকে সামলিয়ে কাট-কাট কণ্ঠে বললেন,
” মিনু কি বলেছে না বলেছে তা আমি কি জানি? তোমরা কিসের কথা বলছো? ”
টেবিলের ওপর রাখা ফলের ঝুড়ি থেকে একটি আপেল নিয়ে তাতে কা”মড় বসিয়ে দিলো তূর্ণ। আপেল খেতে খেতে বললো,
” আমাদের বিয়ের আগের রাতের কথা বলছি। কি উদ্দেশ্যে ওমন নিচু খেলা খেললেন আপনি? আমি হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি। তবুও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। ”
আপেল চিবানো শেষে তূর্ণ সাফ সাফ বললো,
” সত্যিটা আর কতটা লুকাবেন ফুফু আম্মা? এবার তো মুখ খুলুন। সে রাতে কি হয়েছিল এ টু জেড বলে ফেলুন। উই আর ইগারলি ওয়েটিং। বলুন বলুন। ”
সাজেদা ঘামতে লাগলেন। বুঝতে পারলেন উনি চরমভাবে ধরাশায়ী। আর কোনো উপায় বুঝি নেই। এবার কি করবেন? বহু খুঁজেও উপায় খুঁজে পেলেন না। ফুফুর নীরবতায় জবাব খুঁজে পেল দুয়া। মেয়েটির কোমল হৃদয় ক্ষ”তবিক্ষত হলো আপনজনের ধোঁ|কায়। ফুপি কেমন করে পারলো ওসব করতে? ভাই-ভাবি কিংবা ভাতিজা ভাতিজির কথা একটিবারের জন্যও ভাবলো না! এতটা পা*ষাণ কি করে হতে পারলো? তার চেনা ফুপি তো এমন পা-ষাণ নি”র্দয় নয়! তবে? সাজেদাকে নীরব দেখে তূর্ণ ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করলো। সোজা হয়ে বসে গমগমে স্বরে বললো,
” এখন চুপ করে আছেন কেন? আমাদের দুজনকে ফাঁ*সানোর সময় তো ঠিক অ্যাক্টিভ ছিলেন। যা নয় তাই বলালেন মিনু খালাকে দিয়ে। তাহলে এখন মুখে কুলুপ এঁটে আছেন কেন? নাকি এসবের মধ্যে আপনার আদরের সুপুত্র জাবিরও জড়িত? তাকে বাঁচানোর জন্য বোবা হয়ে আছেন? মুখ খুলতে কুণ্ঠাবোধ করছেন? ”
ক্ষে পে উঠলেন সাজেদা।
” একদম বাজে কথা বলবে না। আমার জাবিরকে নিয়ে কুটূক্তি করার কোনো অধিকার তোমার নেই। কে তুমি হাঁ? আমার ছেলেকে দোষারোপ করছো? সেদিন তো জাবির ওখানে ছিলই না। তাহলে কিসের ভিত্তিতে ওকে দোষারোপ করছো? ”
” অবশ্যই ভিত্তি আছে। কে বলতে পারে আপনার সুপুত্র ই হয়তো সবটার কাণ্ডারি। আড়ালে আবডালে বসে খেলা চালনা করছে। ”
” তূর্ণ! ”
ক্ষি প্ত সাজেদা ধমকে উঠলেন। দুয়া তো অবাক নয়নে সবটা অবলোকন করে চলেছে। কি থেকে কি হচ্ছে এসব? তূর্ণ?
” নাম ধরে ডাকাডাকি না করে সত্যি বলুন। বলুন আপনি ওসব করাননি? বলুন। মিথ্যা বলবেন না। বলুন ফুফু। ”
” হাঁ। হাঁ। আমি করিয়েছি ওসব। আমি করিয়েছি। ”
উচ্চ স্বরে স্বীকারোক্তি পেশ করলেন সাজেদা। হতবাক নয়নে তাকিয়ে দুয়া! ছলছল করছে আঁখি যুগল। কর্ণ কুহরে থেমে থেমে ভেসে উঠছে সে কঠিন স্বীকারোক্তি! তূর্ণ’র সরল প্রশ্ন,
” কেন করলেন ওসব? কি পেলেন অমন করে? ”
” পাইনি। যা চেয়েছি তা পাইনি। উল্টো তুমি সবটা শেষ করে দিলে। আমরা ভাবনায় জল ঢেলে দিলে। তোমাকে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। কখনোই না। ”
বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন সাজেদা। তড়িৎ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কক্ষজুড়ে পায়চারি করতে করতে বিড়বিড় করতে লাগলেন,
” হয়নি। হয়নি। দুয়া জাবিরের। জাবির বিয়ে করবে। পুতুল বউ আনবে। ”
তূর্ণ এবং দুয়া দুজনেই হতভম্ব চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো সুস্থ সবল ফুফুর ভিন্ন রূপ। কেমন পা*গলামো করছে সে!
_____
বহু রাত্রি পূর্বের কথা। তাসলিমার অনুরোধ রক্ষার্থে সাজ্জাদ সাহেব এবং সাজেদা স্বপরিবারে ‘ ছায়াবিথী ‘ রয়ে গেলেন। হাসিখুশিতে অতিবাহিত হলো ডিনার টাইম। তাসলিমা ডুপ্লেক্স বাসার রুমগুলো সকলের মাঝে বিভক্ত করে দিলেন। তানজিনা’র স্বামী রিশাদ অবশ্য রাতে থাকেনি। বাসায় ফিরে গিয়েছিল। বরাবরের মতো দুয়া একাকী এক রুমে ছিলো।
সকলেই যার যার জন্য নির্ধারিত কক্ষে অবস্থান করছে। রাত তখন এগারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। জাবির তার জন্য নির্ধারিত কক্ষে বিছানায় বসে মোবাইল স্ক্রল করছিল। হঠাৎ জাবিরের মোবাইলে কল এলো। এত রাতে মায়ের নম্বর দেখে সে কিছুটা অবাক হলো বটে। কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে অভ্যাসবশত কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো। করিডোর ধরে বেশ কিছুটা এগিয়েছে হঠাৎ শুনতে পেল ফোনের ওপাশ হতে মায়ের আকুতি মাখা কণ্ঠ,
” জাবির! জাবির রে! দুয়া কেমন যেন করছে! আমার মাথা কাজ করছে না। তুই জলদি আয় বাবা। দুয়া…”
দুয়া ভালো নেই! বিষয়টি মস্তিষ্কে হানা দিতেই জাবির স্তব্ধ হয়ে গেল। ইতিউতি না ভেবে তৎক্ষণাৎ ছুটলো দুয়া’র রুমের দিকে। পথিমধ্যে দেখা হলো তূর্ণ’র সাথে। তূর্ণ নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ জাবিরকে ছুটতে দেখে অবাক হলো!
” এ কি আপনি? এমন ছোটাছুটি করছেন কেন? ”
” দুয়া। দুয়া। ”
হাঁপিয়ে চলেছে জাবির। দুয়া’র নামটি কর্ণ কুহরে পৌঁছাতেই তূর্ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। ব্যতিব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো,
” দুয়া! কি হয়েছে ওর? বলুন। চুপ করে আছেন কেন? বলুন না কি হয়েছে? ”
” দুয়া। দুয়া ভালো নেই। অসুস্থ। ”
” কিহ্! ”
তূর্ণ’র হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বেদজল উপস্থিত ললাটে। কোনোমতে নিজেকে সামলিয়ে তূর্ণ ছুটলো দুয়া’র রুমের কাছাকাছি। জাবিরও পিছু নিয়েছে। কিছুটা পথ এগোতেই জাবিরের মোবাইলে কল এলো। থমকে গেল জাবির। এত রাতে আননোন নম্বর থেকে ফোন! জরুরী হতে পারে বিবেচনা করে থেমে গেল জাবির। বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে কল রিসিভ করলো। অপর প্রান্ত হতে শোনা গেল অপ্রত্যাশিত দুঃসংবাদ! সে তৎক্ষণাৎ পিছু ঘুরে উল্টো পথে ছুটলো। তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল ‘ ছায়াবিথী ‘ হতে।
তূর্ণ দৌড়ে পৌঁছে গেল দরজার ধারে। হালকা করে ভেজিয়ে রাখা দরজায় হাত স্পর্শ করতেই দরজা খুলে গেল। তড়িৎ বেগে ভেতরে প্রবেশ করলো তূর্ণ। কিন্তু হতবিহ্বল হলো দুয়া’র অবস্থা দেখে! কোথায় অসুস্থতা! মেয়েটি তো নীরবে আরাম করে ঘুমিয়ে। মাইরা’র অবস্থা ঠিকঠাক দেখে বড় করে শ্বাস ফেললো তূর্ণ। মনে হলো বক্ষপট হতে কয়েক মণ ওজনের পাথর সরে গেছে। তূর্ণ যখন স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করতে ব্যস্ত ঠিক তখনই বাহির হতে দরজা আটকে দিলো একজন। সে আর কেউ নয় বরং এই বাড়ির বিশ্বস্ত হেল্পিং হ্যান্ড মিনু খালা। দুঃসময়ে মাত্র আট হাজার টাকার লো ভে সততা বিক্রি করে দিলো সে।
ঘুমন্ত মাইরা’কে দেখে বিমোহিত হলো তূর্ণ। সম্মোহিতের ন্যায় ছোট ছোট কদম ফেলে এগিয়ে গেল। গিয়ে বসলো মেয়েটির শিয়রে। পাশে বসতেই পুলকিত হলো হৃদয়। মুগ্ধ চাহনিতে তূর্ণ কতটা সময় তাকিয়ে রইলো হিসেব নেই। একটু একটু করে অতিবাহিত হতে লাগলো সময়। বিমুগ্ধ তূর্ণ একটুখানি ঝুঁকে গেল। ঘুমন্ত মাইরা’কে ছুঁয়ে দেয়ার প্রবল বাসনা জাগলো মন কুঠিরে। সে ইচ্ছে পূরণ করতেই হাতটি বাড়িয়ে দিলো। আলতো করে ছুঁয়ে দিলো দীঘল কালো কেশ। কেশে হাত রাখতেই মানসপটে স্নিগ্ধ হাওয়া ছুঁয়ে গেল। আবেশে মুদিত হয়ে এলো নেত্রপল্লব। ঠিক সে মুহূর্তে দরজা উন্মুক্ত হলো। তড়িঘড়ি করে ভেতরে প্রবেশ করলো পরিবারের সদস্যরা। সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
.
এরপরের সময়টা খুবই বাজেভাবে কাটলো। মিনু খালা একের পর এক নোং রা কথা বলে চলেছে। সাথে সঙ্গ দিচ্ছে হতাশ-ক্ষি*প্ত সাজেদা। সে ভেবেছিল কি আর হচ্ছেটা কি? সে তো এখানে তূর্ণ নয় বরং জাবিরকে আশা করেছিল। পরিকল্পনা ছিল যেমন তেমন ভাবে জাবির এবং দুয়া’কে একত্রে সকলের সামনে ফাঁ স করা। এরপর নোং রা পরিকল্পনা মাফিক বলেকয়ে ওদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করা। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল? জাবিরের বদলে তূর্ণ কেন? কোথায় জাবির? সাজেদা আশপাশে তাকিয়ে ছেলেকে পেলেন না। তাই মনের আ”ক্রোশ মেটাতে ওদের দুজনকে নিয়ে একের পর এক নোং রা কথা বলতে লাগলেন।
হতবিহ্বল মানব মানবী অর্থাৎ তূর্ণ এবং দুয়া অসহায় বোধ করতে লাগলো এতগুলো অহেতুক নোং রা বাক্যের বিপরীতে। তবে ভাগ্য সহায় ছিল। তাই তো পরিবারের সদস্যরা ওদের ভুল বুঝলো না। বরং সঙ্গ দিলো। তাতে আরো ক্ষি প্ত হলেন সাজেদা। যা নয় তাই বলতে লাগলেন। তূর্ণ’র পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে অবধি প্রশ্ন তুললেন। ধৈর্যের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করা আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ তখন বজ্র্য কণ্ঠে ধমকে উঠলো।
” স্টপ ইট। আর একটাও নোং রা কথা নয়। ”
ধমকে কাজ হলো। সাজেদা আপাতত থামলেন। তূর্ণ ছোট ছোট কদম ফেলে তাহমিদা’র কাছে গেল। খালামণির হাত দু’টো আঁকড়ে ধরে কোমল স্বরে শুধালো,
” খালামণি তুমিও কি ফুফুর মতো আমাদের ভুল ভাবছো? তোমার সত্যিই মনে হয় আমরা পাপী? এমন অন্যায় করেছি? ”
তাহমিদা ছলছল নয়নে প্রিয় ভাগ্নের দিকে তাকালেন। মাথা নাড়িয়ে আপত্তি জানালেন। তূর্ণ বেদনামিশ্রিত হাসলো। এক পলক তাকালো দুয়া’র পানে। মেয়েটা বিছানায় বসে কেমন কাঁদছে! সে কি করুণ চাহনি! তানজিনা এবং তাসলিমা ওকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
” আমরা নির্দোষ। তবুও এতগুলো বি শ্রী কথা শুনতে হলো। খালামণি, খালু! তোমাদের মেয়ে কোনো ক*ল গার্লের মতো নোং’রা নয়। সে খালাতো ভাইয়ের সাথে রা*শলীলা করছিল না। তোমাদের মেয়ে সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পের ন্যায় ক*লঙ্কমুক্ত। তবুও এতগুলো কথা ওকে শুনতে হলো। আমাদের চরিত্রে দাগ কাটা হলো। আমি তো পুরুষ মানুষ। আজকের এই বাজে ঘটনা হয়তো আমার ওপর প্রভাব ফেলবে না। তবে দুয়া? ও তো একটা মেয়ে। আমাদের সমাজে মেয়েরা বরাবরই অবহেলিত, নিপীড়িত। দেখবে আজকের জন্য ওকে বড্ড ভোগান্তি পোহাতে হবে। মানসিক চাপে পড়তে হবে। আমি আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ তা কখনোই টলারেট করবো না। ”
তূর্ণ তপ্ত শ্বাস ফেলে সাজ্জাদ সাহেবের দিকে তাকালো। উনি এই মূহুর্তে থমথমে বদনে দাঁড়িয়ে। অবনত তার দৃষ্টি। তূর্ণ নিজেকে ধাতস্থ করে জীবনের অন্যতম বড় সিদ্ধান্ত পেশ করলো,
” আজ এই মুহূর্তে আমি আদ্রিয়ান আয়মান তূর্ণ তোমাদের সকলকে জানিয়ে রাখছি যে… ইনশাআল্লাহ্ কাল সকাল সকাল আমি তোমাদের আদরের কন্যা জাহিরাহ্ দুয়া’কে আল্লাহ্’র কালাম সাক্ষী রেখে বিয়ে করবো। ইটস্ মাই ফাইনাল ডিসিশন। ”
পুরুষালি ভারিক্কি স্বরের সে এক দৃঢ় অপরিবর্তনীয় সিদ্ধান্ত। হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে রইলো পরিবারের সদস্যরা। ক্রন্দনরত দুয়া নিজ কানকে বিশ্বাস করতে ব্যর্থ। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
চলবে.#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৮
সেদিন ছিল জাবিরের জন্মদিন। আদরের পুত্রের জন্মদিন উপলক্ষে অনাকাঙ্ক্ষিত সেই কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন সাজেদা। ওনার উদ্দেশ্য ছিল যে করেই হোক জাবির এবং দুয়া’কে এক রুমে বন্দি করে সকলের সামনে উপস্থাপন করা। হোক না তাতে দু’জনের সাময়িক ক*লঙ্ক লেপন। তাতে কি হয়েছে! ওদের বিয়েটা তো কোনোমতে সম্পাদিত হবে। সে-ই অনেক। তবে ওনার কুটিল পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো করুণ ভাবে। জাবিরের পরিবর্তে দুয়া’র কক্ষে পৌঁছালো তূর্ণ। বিয়েটা হলোও তার সঙ্গে। সাজেদা বুঝতে অপারগ এসবের ভিড়ে ওনার ছেলে গেল কোথায়? একদিকে যখন তূর্ণ দুয়া’র চরিত্রে কালিমা লেপন করা হচ্ছে। ঠিক তখনই অন্যদিকে ভার্সিটি জীবনের বন্ধুদের সঙ্গে জন্মদিন উদযাপনে ব্যস্ত জাবির। বন্ধুরা তার সাথে প্রাঙ্ক করেছে। বারোটা বেজে ওঠার কিয়ৎক্ষণ পূর্বে ফেক কল করে জানালো তার কোম্পানির গোডাউনে আগুন লেগেছে। অবস্থা করুণ। সে যেন তৎক্ষণাৎ রওনা হয়। ইতিউতি না ভেবে জাবির সে মুহূর্তে ছুটলো। দুয়া’কে রেখে গেল তূর্ণ’র ভরসায়। তবে নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে হতাশ এবং অবাক হলো জাবির। অনার্স ও মাস্টার্স সে ঢাকায় সমাপ্ত করেছে। ভার্সিটি লেভেলের সে-ই পুরনো বন্ধুরা ওকে হঠাৎ ফেক কল করে ডেকে পাঠালো। সেই সঙ্গে দিলো চমকপ্রদ সারপ্রাইজ! বন্ধুদের অপ্রত্যাশিত চমকে পুলকিত হলো জাবির। রাত্রি কাটলো বন্ধুদের সনে। পরদিন সকাল সকাল সে
‘ ছায়াবিথী ‘ পৌঁছে গেল। ততক্ষণে অঘটন ঘটে গেছে। বাড়িতে হাজির কাজী সাহেব। খানিকের মধ্যেই বিবাহ কার্যক্রম আরম্ভ হবে। অসহায় জাবিরের সে মুহূর্তে কিচ্ছুটি করার ছিল না। চোখের সামনে দেখে গেল তার লুকায়িত অনুভূতির করুণ মৃ ত্যু!
ছেলের মনোভাব অনুধাবন করে সাজেদা ভেঙে পড়লেন। জন্মদিনে সবচেয়ে সেরা উপহার দিতে চেয়েছিলেন উনি। সেখানে কিনা ছেলের জন্মদিন ম্লান হয়ে গেল! হতাশায় ভঙ্গুর হয়ে পড়লেন সাজেদা। আর হেল্পিং হ্যান্ড মিনু খালা! সামান্য কিছু অর্থের লো|ভে সে তার সততা বিক্রি করেছে। করেছে বে*ইমানি। তাকে কোনোরূপ জবাবদিহিতা করার পূর্বেই সে পলায়ন করলো ‘ ছায়াবিথী ‘ হতে। বিনিময়ে সাজেদা হতে পেল আরো আট হাজার।
বিয়ের পর ক্রমশ সবটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। তবে পুরনো স্মৃতি ভুললো না তূর্ণ। কফিশপে দেখা করলো জাবিরের সঙ্গে। কেননা তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল জাবিরের সেদিনের প্রস্থান স্বাভাবিক ছিল না। কিছু তো অস্বাভাবিক ছিল। তাই তো কফিশপে সাক্ষাত দু’জনার। তবে আশানুরূপ ফল এলো না। সত্যিটা জানালো জাবির। হতাশ না হয়ে তূর্ণ পুনরায় কাজে লেগে পড়লো। কোনোরূপ প্রমাণ ব্যাতিত সাজেদা কিংবা জাবিরের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা অনুচিত হবে। আফটার অল দে আর ফ্যামিলি। তার মাইরা’র ঘনিষ্ঠ স্বজন। তাই তূর্ণ লোক লাগিয়ে দিলো। উদ্দেশ্য মিনু খালাকে খুঁজে বের করা। মিনু খালা স্বেচ্ছায় পলায়ন করে নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছে। সন্দেহের তীর পুরোপুরি তার দিকে। কয়েক মাস ধরে খোঁজাখুঁজি চললো। অবশেষে তিনদিন পূর্বে খোঁজ মিললো মিনু খালার। সে পলায়ন করে তার চাচাতো বোনের শ্বশুরবাড়ি ঘাপটি মে রে ছিল। সেখানে গিয়ে হানা দিলো তূর্ণ। সঙ্গিনী দুয়া। দু’জনে মিলে জবাবদিহি করলো। মুখ খুলতে বাধ্য হলো মিনু খালা। কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত সত্যিটা প্রকাশ করলো। হতবিহ্বল দুয়া তখন অসহায়ের ন্যায় আঁকড়ে ধরলো অর্ধাঙ্গের হাতটি। নোনাজলে ভরপুর আঁখি যুগল। এমন করেও আপনজনের দ্বারা বিশ্বাসঘা*তকতা হয়?
_____
অপ্রাপ্তি! অপ্রাপ্তি! অপ্রাপ্তি। সাজেদার জীবনটা এমন ছিল না। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে। বাবার আদরের দুলালী। ভাইয়ের প্রাণ। শৈশবে মাতৃহারা সাজেদা কখনো অপ্রাপ্তি কি তা জানতো না। বাবা, বড় ভাই সর্বদা তাকে আগলে আগলে রেখেছে। চাওয়ার পূর্বেই পেয়ে যেতো সবটা। সর্বপ্রথম অপ্রাপ্তি নামক শব্দের সঙ্গে সে পরিচিত হলো ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন। কিশোরী বয়স তখন। আবেগে ভরপুর তনুমন। প্রণয়ে জড়িয়ে পড়লো ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাইয়ের সঙ্গে। তার কলেজ এবং মাসুদ আহমেদ এর ভার্সিটির দূরত্ব ছিল একদম ক্ষীণ। সিনেমার মতো নাটকীয় ভঙ্গিতে হয়েছিল তাদের প্রথম সাক্ষাৎ। অতঃপর ধীরে ধীরে আলাপণ এবং সর্বশেষ প্রণয়। বড়লোক বাবার কনিষ্ঠ পুত্র ছিল মাসুদ। বাবা মায়ের বাধ্য সন্তান। প্রেমের নামে টাইম পাস করার জন্য বেছে নিলো সহজ-সরল কিশোরী সাজেদাকে। আবেগে মোড়ানো কিশোরী সাজেদা বাস্তবতা যাচাই বিনা মনপ্রাণ দিয়ে বসলো মাসুদের তরে। বাবা ভাইয়ের আড়ালে চালিয়ে গেল প্রেম। তাদের এই প্রেমের স্থায়িত্ব ছিল একবছর। এক বছরে সাজেদা মাসুদ বলতে
পা গ ল প্রায়। হঠাৎ এলো ঝড়ো দিন। এলোমেলো হয়ে গেল সব। বাবা সবটা জেনে গেল। আদরের কন্যার অধঃপতন মানতে পারলেন না উনি। প্রথমবারের মতো মেয়ের গালে আঘাতের চিহ্ন লেপে দিলেন। সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সাজেদা। সাজ্জাদ সাহেব নিজেও অবাক! বাবা এ কি করলো?
বাবা বারবার সতর্ক বার্তা দিতে লাগলো। মাসুদ বড়লোক বাবার বিগড়ে যাওয়া সন্তান। প্রেমের নামে টাইম পাস করে। মেয়েদের খেলনা মনে করে। কিন্তু প্রেমে পা গ ল সাজেদা তা মানতে নারাজ। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে সে মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে লাগলো। নিরুপায় হয়ে বাবা সাজেদার বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সাজ্জাদ সাহেবের মতামত অবজ্ঞা করে বাবা পাত্র নির্বাচন করলো। পাত্রের নাম রাকিবুল। সে-ও মধ্যবিত্ত। তবে সাজেদাদের চেয়ে কিছুটা উন্নত। পেশায় চাকুরিজীবী। সাজেদা সবটা জানতে পেরে তীব্র প্রতিবাদ জানালো। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। করলে একমাত্র মাসুদকেই করবে। কিন্তু বাবা তা হতে দিলো না। জোরপূর্বক বিবাহের আয়োজন করলো। সমস্ত যোগাযোগ তখন বন্ধ। নিরুপায় হয়ে বিয়ের পূর্ব রাতে সাজেদা আত্মহ*ননের পথ অবধি বেছে নিয়েছিল। তবে ব্যর্থ হলো বড় ভাইয়ের জন্য। সাজ্জাদ সাহেব বোনকে অনেক করে বোঝালেন। সাজেদা নিস্তব্ধ হয়ে সবটা শ্রবণ করলো। কিছু বুঝতে পারলো কি? বোধহয় না।
ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে রাকিবুলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো সাজেদা। বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীর ভালোবাসা নামক দেহে সিলমোহর মা রা সয়ে গেল। সেদিন প্রথমবারের মতো অপ্রাপ্তি কেমন তার স্বাদ অনুধাবন করতে পারলো সাজেদা। রাগে ক্ষো’ভে পিতার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলো। শুধুমাত্র মাঝেমধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হতো। সাজ্জাদ সাহেব তখন অবিবাহিত। নতুন নতুন চাকরিতে যোগদান করেছে। এর পরের সময়টা বুঝি খুবই ধীরে ধীরে কাটলো। সাজেদা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল মাসুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু লাভ হচ্ছিল না। মাসুদ তখন মাস্টার্স কমপ্লিট করে অন্যত্র। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত দিন এলো। হঠাৎ একদিন শপিংমলে দেখা হলো দু’জনের। আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে উঠলো সাজেদা। দু’জনে বসলো এক রেস্টুরেন্টে। কথা হলো অনেকটা সময় ধরে। এতদিনের লালিত স্বপ্ন চোখের সামনে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। মাসুদ তাকে প্রত্যাখান করলো। চার মাসের গর্ভবতী নারীকে কেইবা আপন করবে? মাসুদের মতো চরিত্রহীন তো নয়ই। মাসুদ তখন বিবাহিত। বাবার বিজনেস পার্টনারের মেয়েকে বিয়ে করে দেশ-বিদেশে সফর করে বেড়াচ্ছে। সে সাজেদার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো ‘ ইউ আর ইমপারফেক্ট ফর মি ‘.
গর্ভবতী সাজেদা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরলো। স্বামী রাকিবুল তা লক্ষ্য করে দিশেহারা হয়ে পড়লো। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে। সাজেদা কিছু বলতে পারলো না। সেদিন প্রথমবারের মতো স্বেচ্ছায় স্বামীকে আলিঙ্গন করলো। তার বুকে মাথা রেখে দুঃখ নিঃসরণ করতে লাগলো। রাকিবুল সযত্নে স্ত্রীকে আগলে নিলো। এরপর শুরু হলো এক নতুন সূচনা। সাজেদা অনুধাবন করতে লাগলো স্বামী সুখ, সংসারের মহত্ত্ব। মাসুদ নামক প্র*তারককে ভুলে যাওয়ার প্রয়াস চালিয়ে গেল প্রতিটি ক্ষণ। মহান স্রষ্টার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো। স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী হওয়ার দোয়া করলো। অতঃপর এলো মাহেন্দ্রক্ষণ। পৃথিবীর আলো দেখলো জাবির। মাতৃত্বের স্বাদ পেল সাজেদা। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে সেদিন খুব কেঁদেছিলো। বাবা তখন কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে সন্তানের সুখ উপলব্ধি করলো। খুশিমনে চলে গেল সেথা হতে। মেয়ে যে তার সঙ্গে আজো কথা বলে না।
জাবিরের বয়স তখন মাত্র তিন মাস। ইদানিং মনটা কেমন কেমন করে সাজেদার। বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে। তার বুকে মাথা রেখে কত কথা বলতে ইচ্ছে হয়। তবে তা আর করা হয় না। নিজেকে পা পী মনে হয়। অনুশোচনায় লজ্জায় বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস হয় না। তাই তো এতটা দূরত্ব। তবে সে-ই দূরত্ব আর ঘুচলো না। বরং আজীবনের জন্য স্থায়ী হলো। এক সন্ধ্যায় ফোন করলো বড় ভাই। ফোনের ওপাশ হতে দিলো জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ। আরেক অপ্রাপ্তির স্বাদ। বাবা আর নেই। পিতৃশোকে দিশেহারা সাজেদা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে। ‘বাবা ও বাবা’ চিৎকারে মুখরিত চারিপাশ। মায়ের কান্নায় শিশু জাবিরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগলো। ছুটে এলো শাশুড়ি মা। পুত্রবধূর অবস্থা দেখে তৎক্ষণাৎ রাকিবুলকে ফোন করলেন। তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো রাকিবুল। এরপর শুরু হলো যন্ত্রণাদায়ক প্রহর। দিন নেই রাত নেই বাবার কবরের কাছে পড়ে থাকতো সাজেদা। অনুশোচনা চিৎকার করে কাঁদতে। কবর খামচে বেড়াতো। মাটিতে মেখে যেতো শরীর, পোশাক। শিশু জাবির বঞ্চিত হতে লাগলো মাতৃস্নেহ হতে। পা’গ’লপ্রায় দশা সাজেদার। সাজ্জাদ সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। উনি এবং নববধূ তাহমিদা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সাজেদাকে আগলে আগলে রাখলেন। বছর লেগে গেল। সাজেদা আস্তে আস্তে একটু স্বাভাবিক হলো। বাবা বিহীন চলতে লাগলো দিন। ধীরে ধীরে পুনরায় সুখে আচ্ছাদিত হলো জীবন। জন্মগ্রহণ করলো কনিষ্ঠ সন্তান তানমি। ভালোবেসে সবাই ডাকতো তানু।
সাজেদার বিবাহিত জীবন তখন এগারো বছর চলছে। আকস্মিক এক দুর্ঘটনায় চূর্ণ বিচূর্ণ হলো সাজেদার সাজানো জীবন। ইন্তেকাল করলেন রাকিবুল। এরপর থেকে শুরু হলো অপ্রাপ্তিময় জীবন। এক জীবনে কাছের মানুষদের হারাতে হারাতে সাজেদা তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অসুস্থ। মস্তিষ্কের ওপর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। সময়মতো সুচিকিৎসার অভাবে সাজেদা আজ মানসিক রোগী। বাবার আদরের দুলালী, ভাইয়ের প্রাণ সাজেদা আজ মানসিকভাবে অসুস্থ। গোটা দুনিয়ার সামনে হয়তো সে সুস্থ স্বাভাবিক। কিন্তু তার অন্তর, মস্তিষ্ক জানে কতটা অসুস্থ অস্বাভাবিক সে! আপন বড় ভাই, নিজের সন্তানরা অবধি অবগত নয় সাজেদার অবস্থা সম্পর্কে। সব হারাতে হারাতে সাজেদা আজ মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারা। নিজের অস্তিত্ব হারা। সর্বহারা সে অসহায় এক নারী!
আজ আর সে হারতে জানে না। যেকোনো মূল্যে নিজের ইচ্ছে পূরণ করতে উদগ্রীব। হোক না তা অসৎ উপায়ে। তবুও প্রাপ্তি চাই তার। আর নয় অপ্রাপ্তি। এখন থেকে শুধু প্রাপ্তি আর প্রাপ্তি।
•
রাজধানীর নামকরা এক হসপিটাল। খ্যাতিমান-অভিজ্ঞ ডক্টর নিশ্চিত করলেন সাজেদার মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত। স্বাভাবিক নয়। স্তব্ধ হলো পরিবারের সদস্যরা! সাজ্জাদ সাহেব আরেকটু হলেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তৎক্ষণাৎ ওনাকে আঁকড়ে ধরলেন তাহমিদা। সকলের চোখেমুখেই অবাকের রেশ! নোনাজলে ভরপুর আঁখি। তানু ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। জাবির দিশেহারা বোধ করছে। গণ্ডস্থল শুকিয়ে কাঠ। এক সমুদ্র পানি পান করলে মিটবে কি তৃষ্ণা? তার যে চিৎকার করে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ছেলেদের তো কাঁদতে মানা। এটা যে তাদের বৈশিষ্ট্য বিরুদ্ধ। তবে কি করে সে মেটাবে অন্তরের জ্বালা? কি করে প্রকাশ করবে সমস্ত যন্ত্রণা? কি করে…?
•
অতিবাহিত হলো বেশ কিছুদিন। সাজেদা এখন ভাইয়ের বাসায় থাকে। তার সুচিকিৎসা চলছে। জাবির এবং তানুও মামার আদেশ রক্ষার্থে মামার বাসায় থাকে। তাদের সকলের এখন একটাই প্রার্থনা। সাজেদার আরোগ্য লাভ!
•
তমস্র রজনী। প্রেমিক পুরুষটির হৃদয়ে ঝড় উঠেছে মাইরা’র ক্রন্দনে। কি করে সে দূরীকরণ করবে এই ঝড়?
#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৯
তমস্র রজনী। তূর্ণ’র বক্ষপটে লেপ্টে মেয়েটি। কেশের অন্তরালে লুকায়িত মুখশ্রী। কোমল দু’টো হাত আঁকড়ে ধরে পৃষ্ঠদেশ। নীরবে ক্রন্দনে লিপ্ত মেয়েটি। সে ধ্বনিতে দিশেহারা পৌরুষ চিত্ত। তা’ণ্ডব বয়ে যাচ্ছে অন্তঃস্থলে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মাইরা’কে। প্রশস্ত বক্ষপটে মিশিয়ে নিলো প্রগাঢ় রূপে। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত কায়া আগলে নিলো সযত্নে। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। তূর্ণ পৃষ্ঠদেশ হতে হাত দু’টো সরিয়ে নিলো। দু হাতের আঁজলায় ভরে নিলো ক্রন্দনে র’ক্তিম মুখখানি। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। লালাভ চোখে তাকাতেই ধক করে উঠলো তূর্ণ’র অন্তঃস্থল। আলতো করে কপোলে লেপ্টে থাকা বিন্দু বিন্দু অশ্রু মুছে দিলো। ললাটের মধ্যিখানে ছুঁয়ে দিলো অধর। দুয়া আঁখি পল্লব বন্ধ করে সে পবিত্র ছোঁয়াটুকু অনুভব করলো। তূর্ণ একে একে অধরের ছোঁয়া অঙ্কন করে দিলো নেত্রপাতায়। অতঃপর কপালে ঠেকালো কপাল। মিহি স্বরে মানুষটি বললো,
” হুঁশ আর কাঁদে না। ফুপি ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্।
দুয়া ভেজা কণ্ঠে বলতে লাগলো,
” দু’দিন পর দাদার মৃ*ত্যুবার্ষিকী। ফুপি বড্ড পা”গলামি করছে। দিনদিন তার অবস্থা করুণ হয়ে যাচ্ছে। ফুপি ঠিক হয়ে যাবে তো? বলো না। ”
” আল্লাহ্ আছেন দুয়া। উনি নিশ্চয়ই সব ঠিক করে দেবেন। ওনার ওপর একটু ভরসা রাখো। ফুপির ট্রিটমেন্ট চলছে। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। সুস্থ হয়ে যাবেন উনি। ”
কিঞ্চিৎ আশ্বস্ত হলো মেয়েটি। কপাল হতে কপাল সরিয়ে নিলো। আলতো করে মাথা এলিয়ে দিলো একান্ত মানুষটির বক্ষপটে। বাঁ হাতে আঁকড়ে ধরলো বুকের দিকের টিশার্ট। ডান হাতটি পৃষ্ঠ আঁকড়ে ধরে। তূর্ণ ওর পিঠে বাম হাতটি স্থাপন করলো। ডান হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো কেশের ভাঁজে ভাঁজে। আবেশে সিক্ত হয়ে মেয়েটি আরেকটু মিশে গেল। আদুরে পাখির ন্যায় লেপ্টে রইলো। কেশের ভাঁজে ঠোঁটের উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিলো মানুষটি। অতিবাহিত হতে লাগলো প্রহর।
•
দিবা পেরিয়ে রাতের আগমন। অতঃপর নতুন এক দিনের সূচনা। স্রষ্টার নিয়মানুসারে অতিবাহিত হতে লাগলো দিনের পর দিন। জীবন হতে হারিয়ে গেল অনেকগুলো দিন।
দিবাবসুর দীপ্তিতে আলোকিত ধরনী। ব্যস্ত রমণী কাবার্ড হতে শার্ট বাছাই করে একটি নীলাভ রঙা শার্ট নির্বাচন করলো। শার্টটি বিছানায় রেখে কাবার্ড হতে একটি প্যান্ট হাতে নিলো। সেটিও বিছানায় শার্টের পাশে রেখে দিলো। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের ওপর রিস্ট ওয়াচ, ওয়ালেট, চিকন ফ্রেমের চশমা গুছিয়ে এক জায়গায় রেখে দিলো। ঠিক তখনই খট করে শব্দ হলো। ওয়াশরুমের দ্বার উন্মুক্ত করে বেরিয়ে এলো তূর্ণ। দুয়া পিছু ঘুরে তাকানোর পূর্বেই ওর ওপর ছিটকে পড়লো তোয়ালে। যথাসময়ে মেয়েটি তোয়ালে ক্যাচ ধরতে সক্ষম হলো। রাগী রাগী দৃষ্টিতে পিছু ঘুরে তাকালো। উদোম দেহে দাঁড়িয়ে তূর্ণ। প্রশস্ত বক্ষপটে বিন্দু বিন্দু জলের অস্তিত্ব। সিক্ত চুল গড়িয়ে পড়ছে পানি। ভিজিয়ে দিচ্ছে গলদেশ, বক্ষস্থল। শুকনো ঢোক গিললো মেয়েটি। অনুভব করতে পারলো হাতের মৃদু কম্পন। দৃষ্টি সংযত করে মেয়েটি মিহি স্বরে বললো,
” তোমার স্বভাব কি কখনো বদলাবে না? এসব কি? ”
” বউয়ের সেবাযত্ন নেয়ার নিনজা টেকনিক। ”
বিছানায় বসে তূর্ণ আদেশের স্বরে বললো,
” হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি চুল মুছে দে। রেডি হতে হবে। ”
দুয়া তোয়ালে হাতে সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। ভেজা চুলে তোয়ালে চালনা করতে করতে বললো,
” চুলগুলো নিজের হাতে মুছলেই তো পারো। সময় বেঁচে যায়। ”
” বউ থাকতে আমি কেন অযথা শ্রম করবো? বউ কি শোকেসে সাজিয়ে রাখার জন্য এনেছি? ”
” উফ্। খালি ত্যা ড়া কথা। ”
তূর্ণ মৃদু হেসে পেশিবহুল দু হাতে আলিঙ্গন করলো মেয়েটির কটিদেশ। শিউরে উঠলো গাত্র। থমকে গেল তোয়ালে চালনাকৃত হাতটি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
” ক্ কি করছো? ছাড়ো। ”
ছাড়লো না মানুষটি। বরং গাঢ় করলো আলিঙ্গন। নিভৃতে মুখ গুঁজে দিলো উদরে। উদরের কোমল আবরণে সদ্য স্নাত মানুষটির চুলের স্পর্শ। শিহরণে আবিষ্ট মেয়েটি আঁকড়ে ধরলো অর্ধাঙ্গের ডান কাঁধ। উদরে মুখ গুঁজে থাকা অবস্থায় তূর্ণ জবাব দিলো,
” বউকে সোহাগ করছি। বউ আমার স্বামী সোহাগের অভাবে শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে যাচ্ছে। রাতদুপুরে স্বপ্নে এসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদে। পত্নীভক্ত পুরুষ আমি। এসব সইবো কি করে? হুঁ? ”
প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সময় অধর এবং নাকের স্পর্শ অনবরত ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল উদর। আবেশে মুদিত হয়ে এলো নেত্রপল্লব। ডান হাতে আস্তে আস্তে করে ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে লাগলো। কতটা সময় অতিবাহিত হলো জানা নেই। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল তূর্ণ’র। দেরি হয়ে যাচ্ছে। পুতুল বউটার সান্নিধ্যে এলে সময়জ্ঞান বড্ড লোপ পায়। উদরে অধরের আলতো ছোঁয়া এঁকে দিয়ে সরে গেল তূর্ণ। ছাড়া পেতেই তৎক্ষণাৎ কয়েক কদম পিছু হটে গেল মেয়েটা। ঘন শ্বাস পড়ছে বারংবার। তূর্ণ তা লক্ষ্য করে বক্র হাসলো। বিছানা হতে শার্ট হাতে নিয়ে তা পড়তে পড়তে বললো,
” সামান্য ছোঁয়াতেই এই হাল? আমি তো চোখের সামনে সাড়ে স র্ব না শ দেখতে পাচ্ছি ব উ। ”
টেনে টেনে কথাটি সমাপ্ত করলো তূর্ণ। লাজে রাঙা দুয়া’র মুখখানি আরো র’ক্তিম হয়ে উঠলো। ম`রমে
ম রে যাওয়ার মতো দশা তার! ইশ্! বেলাজ পুরুষটির কথা ও কাজ কোনোটিতেই লাজের অস্তিত্ব নেই। বেশরম পুরুষ। ধ্যাত! লাজুক মেয়েটি দুরন্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করলো। নিম্ন অধর কা’মড়ে হাসলো তূর্ণ। তার আদুরে পুতুলটি এত লাজুক! জানাই ছিল না। সামান্য ছোঁয়াতেই গলে যায় মোমের ন্যায়।
•
কফিশপে বসে রয়েছে তৃষা। বিপরীত দিকে বসে ছেলে বন্ধু। দু’জনে নোটস নিয়ে আলাপচারিতায় লিপ্ত। মেয়েটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার জানান দিচ্ছে কেউ রয়েছে এখানে। ওকে অবিরাম দেখছে। মেয়েটা মাথা তুলে তাকালো। চোখ ঘুরিয়ে দেখলো আশেপাশে। সব স্বাভাবিক। সন্দেহজনক তেমন কিছুই নেই। শুধুমাত্র ওর থেকে দু টেবিল সামনে একজন বসে রয়েছে। মেনু কার্ডের আড়ালে লুকায়িত চেহারা। তবে সে অতটাও সন্দেহজনক নয়। তাই দৃষ্টি সরিয়ে নিলো তৃষা। মনোনিবেশ করলো আলাপচারিতায়। বন্ধুর সঙ্গে নোট নিয়ে আলাপ করাকালীন ওর চুলগুলো বারবার দুষ্টুমি করছিল। চোখেমুখে পড়ে ওকে আড়াল করে দিচ্ছিল। তৃষা কয়েকবার চুল কানের পেছনে গুঁজে দিলো। তবুও দুষ্টুমি করে চলেছে চুলগুলো। একসময় ছেলে বন্ধুটি ওকে কিছু একটা বললো। তা শুনে হেসে উঠলো তৃষা। হাসিমুখে কানের পেছনে চুল গুঁজে নিলো। তা লক্ষ্য করে চোখমুখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেল মেনু কার্ডের আড়ালে লুকায়িত নিশাদের। বন্ধুর সঙ্গে এত কিসের হাহা হিহি? হুঁ? এখানে পড়তে এসেছে না দাঁত কেলাতে? কই তার সঙ্গে তো কখনো একটু মিষ্টি করে কথা বলে না? তবে এই পরপুরুষ ছেলে বন্ধুর সঙ্গে এত কিসের সখ্যতা? তাদের আলাপণ দেখে যে কেউ প্রেমিক প্রেমিকা ভাবলেও ভুল ভাববে না। এতটাই স্বচ্ছতা, কোমলতা তাদের মধ্যে!
নিশাদ মেনু কার্ড মুখের সামনে হতে সরিয়ে ফেললো। ডান হাতটি মুষ্ঠিমেয় করে দেখতে লাগলো দু’জনের পি’রিতি আলাপ। আর তার মনের মধ্যে দামামা বাজতে থাকলো। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে মেয়েটার গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিতে। তার সঙ্গে সমস্ত পরপুরুষের আলাপণে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে। কেন সে নিশাদ বিহীন অন্য কারোর সঙ্গে মিষ্টি স্বরে কথা বলবে? কেন ঘন্টা ব্যয় করবে অন্য কারোর সঙ্গে? কেন? এত কেন’র উত্তর জানা আছে কি নিশাদের? বোধহয় না। তাই তো রাগে গজগজ করছে অন্তঃস্থল। কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে হৃদ দিগন্ত।
•
কিচেনে ব্যস্ত শাশুড়ি-বৌমা যুগল। তাসলিমা নির্দেশনা দিচ্ছেন। সে-ই মোতাবেক কার্য সম্পাদন করছে মেয়েটি। কোনো ভুলত্রুটি হলে শুধরে দিচ্ছেন তাসলিমা। কিচেনের দ্বারে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলেন তাহমিদা। হঠাৎ কাউকে না বলে হাজির হয়ে উনি কোনো ভুল করেননি বটে। বরং মুগ্ধ হলেন শাশুড়ি বৌমার সখ্যতা দেখে। দুয়া তার মামণির নির্দেশনা অনুযায়ী রান্না করছিলো। হঠাৎ তাসলিমা বোনকে দেখতে পেলেন।
” আরে তাহমিদা তুই? ”
মুচকি হেসে তাহমিদা সালাম দিলেন।
” আসসালামু আলাইকুম আপা। কেমন আছো? ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস বল? ”
সালামের জবাব শুনে পিছু ঘুরে তাকালো দুয়া। মা’কে দেখে বেশ উৎফুল্ল হলো। ছুটে গিয়ে এঁটো হাত সামলিয়ে আলিঙ্গন করলো মা’কে।
” আম্মু তুমি এসেছো? ”
তাহমিদা মুচকি হেসে মেয়েকে আগলে নিলেন। চুমু এঁকে দিলেন ললাটে।
” আমার মা কি করছে? রান্না করছে? ”
দুয়া খুশিমনে জবাব দিলো,
” হাঁ আম্মু। পাবদা মাছ রান্না করছি। মামণি শিখিয়ে দিচ্ছে। খুব ভালো সুগন্ধ বেরিয়েছে তাই না? ”
বলেই মায়ের হাত পেঁচিয়ে চুলার কাছে নিয়ে গেল। দেখাতে লাগলো চুলায় থাকা পাবদা মাছের রান্না।
” মাশাআল্লাহ্! বেশ সুন্দর লাগছে দেখতে। খেতেও নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। ”
তাসলিমা বললেন,
” সে আর বলতে? আমার মেয়ে কিন্তু কুইক লার্নার। সহজেই সব শিখে যায়। ও এখন কতকিছু রাঁধতে শিখে গেছে! ”
তাহমিদা মেয়ের এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন।
” তাই? ”
দুয়া খুশি খুশি মাথা নাড়ালো। তাহমিদা বললেন,
” তাহলে তো আজ লাঞ্চ এখানেই করতে হয়। কি বলো আপা? ”
তাসলিমা দুষ্টুমি করে বললেন,
” সে করতেই পারিস। তবে মাছ কিন্তু অর্ধেক পাবি। অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি কিনা! ”
তাহমিদা হেসে উঠলেন। দুয়া মা’কে আলিঙ্গন করে বললো,
” মোটেও না। আমি প্রথমবারের মতো পাবদা মাছ রান্না করেছি। আম্মু বড় পিস খাবে। আব্বু, ভাইয়্যু ওদের জন্যও নিয়ে যাবে। ”
তাসলিমা মাছ নেড়ে বললেন,
” তাহলে আমরা কি খাবো? মাছ তো ভাগবাটোয়ারা করতে করতেই শেষ। এ তো ভারী অন্যায়। গুরুকে শেষমেষ বঞ্চিত করা হচ্ছে? ”
দুয়া মুচকি হেসে শাশুড়ি মা’কে ফ্লাইং কিস ছুঁড়ে দিলো। মুশফিকুর রহিমের বিজ্ঞাপনের মতো কণ্ঠ অনুকরণ করে নাটুকে ভঙ্গিতে বললো,
” কেউ খাবে কেউ খাবে না। তা হবে না। তা হবে না। সব্বাই খাবে। হুম। ”
দুই বোন একসাথে হেসে উঠলো। সঙ্গী হলো দুয়া নিজেও।
•
রাত্রি বেলা। তাসলিমা বিছানায় বসে। তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে রয়েছে দুয়া। ওর চুলে হাত বুলিয়ে চলেছেন তাসলিমা। শাশুড়ি মায়ের আদর উপভোগ করতে করতে মেয়েটির আঁখি পল্লব মুদিত হলো। আস্তে করে ডেকে উঠলো,
” মামণি? ”
” হুঁ বল। ”
চোখ মেলে তাকালো দুয়া। বললো,
” তোমাকে একটা প্রশ্ন করার ছিল। করবো? ”
” বাব্বাহ! তুই আবার প্রশ্ন করতে কবে থেকে অনুমতি নিচ্ছিস? ”
” উফ্ মামণি। প্রশ্ন করবো কিনা বলো। ”
তাসলিমা মুচকি হেসে বললেন,
” আচ্ছা কর। আমি শুনছি। ”
দুয়া মায়ের মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিহি স্বরে শুধালো,
” তুমি কি আমাকে অনেক আগে থেকেই পুত্রবধূ করতে চেয়েছিলে? আব্বুর কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলে? ”
চমকালেন তাসলিমা! এসময়ে এমন প্রশ্ন উনি আশা করেননি। হঠাৎ মেয়েটা এমন প্রশ্ন করছে কেন?
” হঠাৎ এই প্রশ্ন? ”
” তোমার সাথে আম্মুর কথাবার্তা কিছুটা আমি শুনতে পেয়েছি। পুরোটা নয়। তাই জিজ্ঞেস করলাম। বলো না মামণি এটা কি সত্যি? তুমি আমাকে আগে থেকেই পুত্রবধূ করতে চেয়েছিলে? অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আমাদের বিয়েটা না হলে পারিবারিক ভাবেই একসময় বিয়ে হতো? ”
তাসলিমা কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। অতঃপর মৌনতা ভেঙে বললেন,
” হাঁ। এটা সত্যি যে তোকে আমি অনেক আগে থেকেই পুত্রবধূ হিসেবে ভেবে রেখেছিলাম। তাই সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আর উনি? রাজি হয়েছিলেন। ”
বেশ অবাক হলো দুয়া! ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল শাশুড়ি মায়ের দিকে। আনমনে প্রশ্ন করে বসলো,
” হঠাৎ আমাকে পুত্রবধূ হিসেবে চাইলে কেন? ”
চলবে.
[