দীর্ঘ পাঁচ বছর পূর্বে স্বামীর হঠাৎ ছেড়ে চলে যাওয়ায় সমাজের মানুষের কাছে আমার পরিচয় হয়েছে একজন পরকীয়া করা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে, আজ নিজের ছেলের স্কুলের প্রিন্সিপাল এর কাছ থেকে এমন একটা কুপ্রস্তাব(পরকীয়া)পেতেই আরু আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না,তাড়াতাড়ি চেয়ার থেকে উঠে সপাটে তার গালে একটা ঠাস করে চড় মেরে বলল,,,,
‘ আপনার বাড়িতে মা বোন নেই? তাদের সাথে কি আপনি এভাবেই ব্যবহার করেন? তাদের কেউ কি আপনি বিছানায় টেনে আনার জন্য প্রস্তাব দেন ?কথাটা বলে আর একগালে ঠাস করে চড় মারলো আরু ৷
প্রিন্সিপাল যেনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন আরূর এমন রুপ দেখে ৷
প্রিন্সিপালের শার্টের কলার ধরে এবার টেনে-হিঁচড়ে টানতে টানতে উনার রুম থেকে বের করে এনে মাঠের মাঝখানে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতেই আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেল ৷
একজন শিক্ষিকা এসে যখন বললেন
‘ আপনার সাহস তো কম না আপনি প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে এরকম ব্যবহার করছেন, আপনি কি জানেন এর জন্য আপনাকে আমরা পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিতে পারি ৷’
আরো গলা উঁচিয়ে গর্জন করে বলল
‘ একদম চুপ ৷ উনি শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাই রাখেন না, একজন শিক্ষক যখন একজন গার্জিয়ানের সাথে সঠিকভাবে ব্যবহার করতেই জানে না তখন তিনি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের কি করে নিরাপত্তা দেবেন!কি করে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের বাবা-মা তাদের সন্তানকে স্কুলে দিয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে নিজেদের কাজে মন দেবেন? আর আপনি বলছেন আমি ওনার সাথে এমন ব্যবহার করলাম কি করে ! বেশ করেছি এমন ব্যবহার করেছি ৷ একজন প্রিন্সিপাল হয়ে যখন একটা সিঙ্গেল মাদারকে তার বিছানায় টেনে আনার জন্য কুপ্রস্তাব দেয় আর তার পরিবর্তে যখন তাকে টাকা অফার করে তখন আপনার কি মনে হয় না আমি যা করেছি ঠিক করেছি নাকি আপনি হলে ওনার বিছানায় চলে যেতেন কোনটা!’
আরুর কথা শুনে সকলেই মাথা নিচু করে আছে এমনকি মাটিতে পড়ে থাকা প্রিন্সিপাল স্যার উনিও, ওনার কুকীর্তি সকলের সামনে ফাঁস করে দিলো আরু, এই অবধি অনেককেই উনি এমন প্রসতাব দিয়েছেন , তবে কেউ রাজি না হলেও ওনার ভয়ে কখনো তা সকলের সামনে জানাতে পারেনি ৷
আরূ ছেলের হাত ধরে বলল
‘ দরকার নেই আমার ছেলের আপনাদের মত এমন স্কুলে পড়ানোর,যেখানে স্বয়ং প্রিন্সিপাল স্যার নিজেই একজন নোংরা মনের মানুষ ৷ আজ আপনারা নিজেরাও জানলেন আর অপরকেও সতর্ক করে দেবেন আর নিজেরা সতর্ক থাকবেন যাতে ভবিষ্যতে আপনাদের কেও এমন হেনস্থা না হতে হয় ৷’
কথাগুলো বলে ছেলের হাত ধরে হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেল আরু ৷
আরিশ চলে যাওয়ার পর পাঁচ বছরে অনেক কিছু সহ্য করেছে ,অনেক কঠিন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে || মানুষটা কেন হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেল তার কারণটা ও নিজেই জানে না আর অপর কেউ বুঝাতে পারেনা ৷
রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর ছেলের হাত ধরে কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পরই যেন জীবনের প্রতি হাঁপিয়ে পড়ল, শরীরে বইছে না ,কিছুক্ষণ আগে শরীরের মধ্যে যে উত্তেজনা ছিল তাও যেন শূন্য , এক্ষুনি যেন রাস্তায় নেতিয়ে পড়বে ৷ আরুর এমন অবস্থা দেখে আরশিয়ান আরুর দিকে তাকিয়ে বলল
‘মাম্মাম তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?’
আরু ছেলের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টি নিয়ে বলল
‘ না সোনা আমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না, তোমার মাম্মাম তো সুপারওম্যান তাইনা ! তার কি কখনো কষ্ট হতে পারে বলো !’
আরুর কথা শুনে আরশিয়ান বলে উঠলো
‘ হ্যাঁ আমার মাম্মাম সুপারওম্যান কিন্তু আজকে তোমাতে দেখে আমাল না কেমন এত্তা নাগছে !'(আধোআধো কন্ঠে)
আরু এবার হাঁটু ঝুঁকে বসে আরশিয়ানের গালে হাত রেখে বলল
‘তোমার মাম্মামের কখনো কোনো কষ্ট হয় না , আর যেদিন তোমার পাপা ফিরে আসবে সেদিন দেখবে আমাদের আর কোন কষ্ট থাকবে না, কেউ তোমার মাম্মামের দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারবে না যে আমি একজন কুলটা নারী, আর আরশিয়ান অবৈধ ছেলে ৷’
মায়ের এমন কথা শুনে আরশিয়ান আরুকে জড়িয়ে ধরলো ৷চার বছর বয়সী ছেলেটা সব কিছু না বুঝলেও নিজের মায়ের কষ্টটা বুঝতে পারে ৷
পাঁচ বছর হলো আরূ আলাদা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, সকল আপনজনকে ছেড়ে আলাদা সিঙ্গেল মাদার হিসেবে ,এখনো বুকের ভিতর পুরনো কষ্টগুলো হানা দেয়য৷ পাঁচ বছর পূর্বে আরশের ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণটা আরু জানতে চাই, আর আরিশ ওকে বলে যেতে পারত তাহলে হয়তো আজ কষ্ট টা এতো বেশি হতো না ৷ আরিশের পরিবারের সকলে চেয়েছিল আরূকে নিজেদের সাথেই রাখতে কিন্তু আরু থাকতে চাই না ৷ দশ তলার উচ্চতার ফ্ল্যাটটার 4 তলায় থাকে আরু, মাঝে মাঝে প্রতিবেশীরা জিজ্ঞাসা করে যে ওর স্বামী কোথায় থাকে তখন আরু মুচকি হেসে একটাই জবাব দেই,
‘ আমিও জানিনা আমার স্বামী কোথায় তাই আপনার আর কখনো জানতে চাইবেন না যে তিনি কোথায় , অন্যথায় আমি আপনাদেরকে উত্তর দিতে পারব না আপনারা কষ্ট পাবেন ৷’
লিফটে ঢোকার আগেই ওর মনে পড়ল এই মাসের টাকাটা বাকি , যদিওবা প্রত্যেক মাসের টাকা প্রত্যেক মাসে দিতে পছন্দ করেন আরু তবে এই মাসে অগ্রিম টাকা দেবে,কারন কালকে ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দেবে তারপর এমন কোথাও চলে যাবে যেখানে সমস্ত দুঃখের আচ ও আর থাকবেনা ৷ নিজের ছেলেটাকে নিয়ে বাকিটুকু জীবন সুখের সাথেই কাটাতে চায় আরু ৷ পাঁচ বছর হলো জীবনে শান্তি নামক জিনিসটার বড়ই অভাব ৷
রিসিপশনিস্ট এর কাছে টাকাটা দিয়ে চলে যেতে নিলেই রিসেপসনিস্টের ছেলেটা আরুকে বলে উঠলো ‘ এই মাসের টাকাটা অগ্রিম যে !’
আরু খানিকটা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল
‘ফ্ল্যাট ছেড়ে দেবো সেই কারণেই!’
কথাটা শুনে ছেলেটার অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করছে, মুখে বলতে না পারলে আরুকে সে মনে মনে খুব পছন্দ করে , তবে আরু বারবার বলেছে যে এ সমস্ত ভালোবাসায় সে বিশ্বাসী নয় তাই কখনো মুখ ফুটে বলতে সাহস পায়নি বললে হয়তো আরুর সাথে ওর সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যেত সেই কারণেই ৷
ছেলেটার উত্তরের অপেক্ষা না করে আরু লিফটে উঠে গেল ছেলেকে নিয়ে ৷
2.
বিকেল ধোঁয়া ওঠা কফিতে মাঝে মাঝে চুমু দিচ্ছে আরু, আর বাকি গোছগাছের সমস্ত কাজ করছে, আরিয়ানের জামা কাপড় গোছানো কমপ্লিট শুধু নিজের জামাকাপড় গুলো এখনো গোছাতে ব্যস্ত ৷
ছোট আরশিয়ান বিছানার উপর পা গুটিয়ে বসে চুপচাপ মায়ের কার্যকলাপ গভীরভাবে লক্ষ্য করছে , আর মাঝে মাঝে মুচকি মুচকি হাসছে দেখে আরু বলে উঠলো
‘ আমার চকলেট বয়টা এভাবে হাসছে কেন তার কারনটা আমি কি জানতে পারি?’
আর্শিয়ান এবার মুখ চেপে খিলখিল করে হেসে বলল ‘তুমি যখন স্যারকে মারছিলে তখন তোমাকে স্পাইডারওম্যানের মতো লাগছিলো, কিভাবে ঢিসুম-ঢিসুম করে তুমি মারলে ৷’
কথাটা বলে আরশিয়ান আবার মুখ চেপে হাসলো ৷
ছেলের কথা শুনে আরু মুচকি হেসে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো, বাচ্চা ছেলে আরশিয়ান, সব সময় এটা ওটা বলতে থাকে যা শুনে আরুর মাঝে মাঝে খুব হাসি পায় ৷
3.
সন্ধ্যা সাতটা,,,,
আশিয়ান টিভি দেখছে আর আরূ গোছগাছ শেষ করে সবে একটু সোফাতে বসে বড় বড় গভীর ভাবে শ্বাস নিচ্ছে ৷ আজ আরশিয়ানের পড়া থেকে ছুটি কারণ আরশিয়ান আজকে বড্ড জেদ করছি যে ওরা এখান থেকে চলে যাবে তাই আজকে পড়াশোনা করবে না , ছেলের এইটুকু আবদার তো আরু রাখতেই পারে ৷
আরশিয়ানের কাছে টিভির রিমোটটা চাইতে গেলেই হঠাৎ ফোনে ফোন আসলো, ফোনে অনিকা ফুপি নামটা ভেসে আসতেই আরু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা নিয়ে ব্যালকনিতে চলে গেল ৷
‘হ্যাঁ ফুপি কেমন আছো তুমি?’
‘আমি কেমন আছি সেটা তুই জিজ্ঞাসা করছিস রে! তোকে ছাড়া আমরা কখনো ভালো থাকতে পারি ?কতবার বলেছি আরশিয়ান কে নিয়ে এখানে চলে আয়, কেন আসিস না মা? আর্শিয়ান কি আমাদের কেউ নয়, তুই আমাদের নিজের মেয়ে, নিজের বাড়িতে থাকবি তার জন্য তোর আলাদা কোনো পরিচয় এর প্রয়োজন নেই ৷ তুই আরশিয়ানকে নিয়ে এখানে চলে আয় না , আর কতদিন আর এভাবে একা একা থাকবি আর সমাজের লোকের উল্টোপাল্টা কথা শুনবি বল !’
‘ সমাজের মানুষের কাজই এগুলো , সমালোচনা করা , তার জন্য কি আমি কি থেমে থাকবো ? কখনোই না , আর তুমি এই রিকুয়েস্ট আমাকে আর কখনো কোরোনা, আমি হয়তো রাখতে পারবোনা ৷’
বলে আরো কিছু টুকটাক কথা বলে আরু ফোন রেখে দিল তবুও বলেনি যে ওরা বাড়ি পরিবর্তন করছে , করলে হয়তো এই রাতে আরুর কাছে এসে হামলা করবে আর ওকে নিয়ে চলে যাবে নিজেদের কাছে ওরা আর সেটা আরু ভালোই জানে ৷
বেলকনি থেকে চলে আসতে গেলেই চোখে পরলো আর নিচের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে একটা সাদা শার্ট পরা লোক গিটার হাতে নিয়ে বসে আছে সেদিকে, গিটারের তার গুলো কে স্পর্শ করে আছে তবে তা থেকে এখনো কোনো শব্দ বেরিয়ে আসেনি ৷ পিছন থেকে দেখতে অনেকটা নিজের প্রিয় মানুষটার মতোই লাগছে,আরুর কাছে, লোকটাকে দেখে বুকের ভেতর ধক করে উঠল আরুর, অদ্ভুত এক অনুভূতি হতে লাগলো , যদিও জানে যে অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যে ,আজকাল বড্ড বেশি মিস করি আরিশকে কল্পনা করে ৷
লোকটা কে উপেক্ষা করে আরু রুমে চলে এলো , আরশিয়ান কার্টুন দেখছে আর খিলখিল করে হাসছে তা দেখে আরশিয়ানের দিকে নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে রইল আরু ৷
4.
কালকে সকাল সকাল বের হতে হবে বলে আজ একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে আরু, ব্যালকনির দিকের ঘরের দরজাটা খোলা তা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঘরে এসে পড়ছে ,পর্দা গুলো হাওয়ায় উড়ে উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে ৷
হঠাৎ অন্ধকারে দুটি হাত আরুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যা হয়তো আরু বুঝতে পারছেনা ৷ আরুর ঘুমের ঘরে
মানুষটা তার বাম হাতটা আরুর গালে আলতো করে স্পর্শ করলো, মুখের উপর আছড়ে পড়া চুলগুলো হাত দিয়ে আলতো করে সরিয়ে দিয়ে কানের পাশে গুঁজে দিয়ে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে রইলো ৷ পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় আরুর মুখটা কতোটা মায়াময়ী লাগছে সেটা হয়তো মানুষটা খুব ভালোভাবেই জানে ৷
আরুর কাছে গিয়ে আরুর থুতনীতে থাকা কালো গভীর তিলটাই নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতেই আরু খানিকটা কেপে উঠলো, তবু জেগে গেল না ৷ তারপর মানুষটা আরুর থেকে সরে এসে আরুর কানে ফিসফিস করে বলল
‘ ভালোবাসার আরুপাখি, অনেক বেশি ভালোবাসি, আমি ফিরে এসেছি আমাকে ফিরিয়ে নেবে তাই, তবে তুমি না নিলেও যে আমি তোমাকে ফিরিয়ে নেব সে তুমি চাও আর না চাও ,বিকজ আই এম ইউর মিস্টার অভদ্র ৷’
কথাটা আরুর কান অবধি যেতেই আরু জেগে উঠলো, তাড়াতাড়ি করে আশেপাশে তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা ,তবে কারোর উপস্থিতি অনুভব করলো না , পাশে আরশিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখল ছেলেটা ঘুমাচ্ছে ,আরু ভেবে নিল এটা যা হয়েছে একটা দুঃস্বপ্ন ৷ বলে আরশিয়ানের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে আরশিয়ানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো, কালকে সকাল সকাল বেরিয়ে যাবে ও,ছেড়েদেবে এই শহর যেখানে ওর ভালোবাসার মানুষটা নেই ,আছে কেবল তাকে হারানোর বেদনা ৷
Suraiya Aayat
#চলবে,,,,,
#তুমি_নামক_প্রাপ্তি
#part:1
#Suraiya_Aayat
এই গল্পে রেসপন্স না এলে আমি লেখালেখি ছেড়ে দেবো ,আর ভালো লাগছে না ৷
Golper shurutai etto shundor je porei monta valo hoye gelo.apu golpota bondho korben na pls