তুমি_নামক_ব্যাধি সিজন ২ পর্ব ১

#তুমি_নামক_ব্যাধি (২)
#মুন্নী_আরা_সাফিয়া
#পর্ব_০১

১.
ইতালির ভেনিস শহরের বিমানবন্দরে নেমে ভীত-সন্ত্রস্থ চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই দূর থেকে আমার বড় খালামণির ছেলে তিহাম ভাই এসে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো।আমার একদম পিলে চমকে উঠলো।বড় বড় চোখ করে হা হয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম কি হচ্ছে!

উসখুস করে একটু সরে আসতে নিতেই তিহাম ভাই আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।হঠাৎ করেই যেন এত মানুষের মধ্যে থেকেও চারিদিক নিস্তব্ধ হতে শুরু করে।মনে হয় আমরা এই মুহুর্তে কোনো দ্বীপের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি।সমুদ্রের নীল জলরাশির মাঝে সবুজে সবুজ এক খন্ড ছেঁড়া দ্বীপ!আমার আশপাশে তিহাম ভাই আর প্রকৃতি ছাড়া যেন কিছুই নেই!

আমি চোখ বন্ধ করলাম।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিহাম ভাইয়ের হার্টবিটের মৃদু ঝংকারের শব্দ কানে এলো।উনার চেয়ে আমার হাইট অনেক কম হওয়ায় ওনার হার্টের গতিবিধির ছন্দ কানে বাজছে।।উনার বুকের ঠিক দু ইঞ্চি গভীরে যেন স্বর্ণের অলংকারের মতো টুংটাং আওয়াজ বেড়ে চলেছে।উনার হার্টবিট এত বেড়ে গেছে কেন?কার্ডিয়াকের পেশেন্ট নাকি?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের হার্টবিটও যেন ঢোল বাজানো শুরু করলো।আমি তো এতদিন জেনে এসেছি যে আমার দেহের মধ্যে হয়তো হার্টই নেই,কিসের রক্তপাম্প?কিন্তু এই প্রথম তার খোঁজ পেলাম।সঙ্গে তার তুমুল বেগে ছুটে চলার শব্দ।এই প্রথম কোনো একটা ছেলে আমার এত কাছাকাছি আসতেই আমার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তন হলো।সেই কিছু একটা যে কি তা বুঝে উঠার আগেই এক ঝটকায় সরে আসলাম।

—‘দিয়ানা, কেমন আসিস রে?’

তিহাম ভাইয়ের বিষণ্ন সুন্দর কন্ঠ কানে আসলো।প্রথম যখন ওনার সাথে ফোনে কথা বলি তখন হঠাৎ করে মনে হয় মানুষটার কন্ঠ এত সুন্দর কেন?কেমন বিষণ্ন বিষণ্ন ভাব!যত শুনি তত শুনতে মন চায়!নিজের অজান্তে মনে হয় মন খারাপের কোনো সন্ধ্যায় এমন কন্ঠের দু চার কথা না শুনলে যেন মন কিছুতেই ভালো হবে না।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো তিহাম ভাইয়ের কন্ঠ ফোনেই সুন্দর শোনা যায়।কিন্তু না!জ্ঞান হওয়ার পর জীবনে প্রথম বাস্তবে ওনার কন্ঠ শুনে মনে হলো সত্যি সত্যি উনার কন্ঠে জাদু আছে।

—‘কি রে কথা বলছিস না কেন?আসার পথে কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

আমি এখনো তিহাম ভাইয়ের দিকে সরাসরি তাকাইনি।মাথা নিচু রেখেই বললাম,

—‘সমস্যা হয়নি!’

—‘প্লেন টেক অফের সময় ভয় পেয়ে কান্না কাটি করিসনি তো?’

—‘আমি সহজে কাঁদি না।’

—‘আমার কাছে ভাব নিতে আসবি না একদম।এক থাপ্পড়ে গাল ফাটিয়ে দিবো।ছোটবেলা তোকে কোলে নিলে ভেউ ভেউ করে ক্রন্দন শুরু করতি!আমার কোল থেকে অন্য কেউ নিলেই একদম চুপ!তুই পিচ্চি কাল থেকেই বেদ্দপ!ভারী বেয়াড়া স্বভাবের।তোকে বেয়াড়া থেকে মানুষ বানানোর জন্যই কলেজের পাঠ শেষ হতে না হতেই খালুকে বলে এখানে নিয়ে আসলাম।এবার বুঝবি এই তাজবীর আজমাইন তিহাম কি জিনিস!ছোটবেলা অনেক জ্বালিয়েছিস।এবার তো সেই আমার খাঁচাতেই ধরা দিলি।পিচ্চি কালে গুণে গুণে একুশ বার আমার জামাকাপড় ভিজিয়ে দিয়েছিস।আমি কোলে নিলেই তোর জামা ভেজানো শুরু হতো!মনে আছে?হুঁ?’

আমি লজ্জায় মিইয়ে গেলাম।এসব কি ধরনের কথাবার্তা?ছোটবেলার ওসব কথা কেউ এখনো বলে?ছি!তিহাম ভাইয়ের লাজ-লজ্জা কিছু নেই?নাকি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার দরুন?

আমি দীর্ঘক্ষণ নিচের দিকে তাকিয়ে আঙুল কচলানো শুরু করলাম।

তিহাম ভাই নিরবতা ভেঙে নরম কন্ঠে বলল,

—‘সত্যি করে বলতো, কেমন আছিস দিয়ামণি?’

তিহাম ভাই এই প্রথম আমায় দিয়ামণি বলল।এর আগে ফোনে দিয়ানা বলে ডেকেছে।উনার মুখের দিয়ামণি ডাক শুনে অতি আগ্রহ নিয়ে উনার দিকে মুখ তুলে তাকালাম।

সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর এক ধরনের ব্যথা শুরু হলো।এ ব্যথা শুধু মাত্র তখনই শুরু হয় যখন তীব্র সৌন্দর্যের মুখোমুখি হওয়া যায়।তিহাম ভাই দেখতে এত সুন্দর?ছবির থেকেও সুন্দর?

আমি হা করে তার মুখপানে তাকিয়ে আছি।হার্টবিট যেন আরো বেড়ে গেছে।কয়েক সেকেন্ড পর বিড়বিড় করে বললাম,

—‘বুঝতে পারছি না কেমন আছি!’

—‘মানে?’

আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম।আশপাশে চোখ বুলিয়ে বললাম,

—‘ন-না মানে সবাইকে ছেড়ে ছুঁড়ে বিদেশ আসলাম।এখনো বুঝতে পারছি না কেমন লাগছে।’

—‘সবাইকে ছেড়ে ছুঁড়ে মানে?তোর কি বয়ফ্রেন্ড ছিল?’

—‘আসতাগফিরুল্লাহ।’

—‘বাঁচা গেল!বাদ দে!চল তো,গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি।’

বলে তিহাম ভাই আমার ডানপাশে থাকা ট্রলিটা টেনে সামনে এগিয়ে গেল।আমি চারপাশ দেখতে দেখতে তার পিছু নিলাম।

ট্রানজিট এরিয়া থেকে একটু হেঁটে বহির্গমন গেটের ডানপাশে এসে দেখি সাদা রঙের গাড়িতে তিহাম ভাই ট্রলি উঠাল।গাড়িটা দেখে আমার পছন্দ হলো না।সাদা রঙের গাড়িই আমার পছন্দ না।কেমন অ্যাম্বুলেন্স অ্যাম্বুলেন্স ফিলিংস!

তিহাম ভাই গাড়ির সামনের গেট খুলে দিয়ে নিজে গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলো।আমি একটু ইতস্তত করে বললাম,

—‘বলছিলাম কি তিহাম ভাই, আমি পেছনের সিটে বসি।মানে অনেক ক্লান্ত তো!একটু গা ছড়িয়ে বসতে চাচ্ছি।’

—‘হোয়াট ইজ গা ছড়িয়ে বসা?জামা কাপড় খুলে বসবি?’

—‘ছি!কি বলছেন এসব?আপনার সত্যি সত্যি বিদেশের হাওয়া লেগেছে।আমি একটু বেশি জায়গা নিয়ে বসবো।’

—‘বেশি জায়গা নিয়ে বসতে বারণ করেছে কে?বস!সামনে তো পুরো সিটই ফাঁকা।তাতেও জায়গা না হলে আমার কোলের উপর বোস।না হয় কোলের উপর ঠ্যাং তুলে দে।’

আমি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তিহাম ভাইয়ের দিকে তাকালাম।উনি কেমন নির্বিকার ভঙ্গিতে কথা বলছেন।সারা মুখে মজা করার লেশমাত্র চিহ্নটুকুও নেই।যেন এই মুহূর্তে আমি যদি ওনার কোলে গিয়ে বসি তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হবে না।

আমি তর্ক না করে ওনার পাশে বসে পড়লাম।আমার যখন চার-পাঁচ বছর বয়স তখন বড় খালুর ইতালির ইউনিভার্সিটিতে চাকরির অফার পায়।তখন তিনি পরিবার নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান।তিহাম ভাই তখন কতটুকু হবে আর!ইতালিতে নাকি ক্লাস এইট গ্রেডে নতুন করে ভর্তি হয়।কিন্তু কথা হচ্ছে, এত ছোট বয়সে বিদেশে থেকেও কি সুন্দর ফ্লুয়েন্টলি বাংলা বলে যাচ্ছে।সাথে বাঙালিদের মতো অদ্ভুত নিজস্ব বাংলা শব্দও ব্যবহার করছে।এ কি বিদেশে বসে বসে বাংলা ডিকশনারি আর সাহিত্য পড়ে কাটিয়েছে?

তিহাম ভাই বললেন,

—‘সিটবেল্ট লাগিয়ে শক্ত হয়ে বস।আর বমি টমি করবি না তো?আগে থেকেই বল।গাড়ি নষ্ট করলে খবর আছে কিন্তু!’

—‘বমি করবো না।’

—‘মনে থাকে যেন।বমি করলে রাস্তায় ফেলে চলে যাব।’

—‘মনে থাকবে।’

আমি সিটবেল্ট লাগাতেই তিহাম ভাই গাড়ি স্টার্ট দিলেন।কয়েক মিনিট ইতালির ব্যস্ত সড়ক থেকে চোখ সরিয়ে তিহাম ভাইয়ের দিকে তাকালাম।উনার ড্রেস নজরে এলো মাত্র।এত সুন্দর মুখোশ্রীর কারো পোশাক নিশ্চয়ই গৌণ বলেই চোখে পড়ে না।

উনার গায়ে সম্পূর্ণ কালো পোশাক।কালো জিন্স,কালো শার্ট আর কালো লেদারের জ্যাকেট।সম্পূর্ণ কালো পোশাকটা তার সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে যেন!উনার হাতের ধবধবে ফর্সা আঙুল গুলো দেখে নিজের হাতের খোলা অংশটুকুতে চোখ পড়তেই মন খারাপ হয়ে গেল।

মন খারাপ ভাব গোপন না করে বললাম,

—‘আপনি এত ফর্সা কেন?’

তিহাম ভাই এক নজর আমার দিকে তাকিয়ে ফের সামনে তাকালেন।বললেন,

—‘ইতালিতে সূর্যের মুখ দেখা যায় না বললেই চলে।বারো মাসের মধ্যে প্রায় আট মাসই শীতকাল।সারাক্ষণ শীতের পোশাক পড়ে ঢেকে ঢুকে থাকতে হয়।কয়েক মাস গেলে তুইও কাগজের মতো সাদা হয়ে যাবি।’

আমি দুঃখী মন নিয়ে বললাম,

—‘আমার গায়ের রঙ পঁচা আলুর মতো।’

তিহাম ভাই মুখ ফসকে ফিক করে হেসে ফেললেন।কয়েক সেকেন্ড পরেই গম্ভীর হয়ে বললেন,

—‘বক বক করিস না।চুপচাপ ঘুমা।বাসায় গিয়ে তোর খালুজান-খালামণির লক্ষ কোটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।’

আমি অন্য দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করলাম।

২.

কতক্ষণ কেটে গেছে জানা নেই!গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে বার বার বেরিয়ে আসতে নিতেই ধপ করে চোখ খুললাম।দেখি তিহাম ভাই ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন।আমি মুখে হাত দিয়ে উম উম করতেই উনি এক পলক তাকিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,

—‘দাঁড়া,দাঁড়া!গাড়ি থামাচ্ছি।’

দ্রুুত ব্রেক কষে গাড়ি থামাতেই নেমে যেতে নিলাম।তিহাম হাত থামিয়ে ড্রয়ার থেকে ব্যাগ বের করে বলল,

—‘স্টুপিড!এটা বাংলাদেশ পেয়েছিস নাকি?এখানে রাস্তায় বমি করলে জরিমানা করবে।কয়েক দিনের জন্য জেলও হতে পারে।যেখানে সেখানে গাড়ি পর্যন্ত থামানো যায় না।’

আমি দুহাতে ব্যাগ ধরে দ্রুত মুখ ঢুকিয়ে কয়েক বার ওয়াক থু করলাম।কিন্তু কিছু বের হলো না।সামনের চুলগুলো এলোমেলো ভাবে মুখের চারপাশে আসতেই তিহাম ভাই দুহাতে সব একগোছা করে পেছনে একমুঠে ধরে রাখল।

চিন্তিত গলায় বললো,

—‘বের হচ্ছে না?পেটে চাপ দিতে হবে?আচ্ছা,থাক!তুই পানি খা!’

পানির বোতল এগিয়ে দিতে মুখ উঁচিয়ে পানি খেলাম।চুলে হালকা টান পড়তেই হাঁসফাঁস করে বললাম,

—‘তিহাম ভাই,চুল ছাড়ুন।ব্যথা পাচ্ছি।’

—‘এত আস্তে ধরেছি তারপরও ব্যথা পাচ্ছিস?তোর সহ্য ক্ষমতা বেলে দোঁঁআশ মাটির চেয়েও কম দেখছি।ভবিষ্যতে বর পেটালে কি করবি?’

—‘আজব প্রশ্ন।বর পেটাবে কেন?পেটালে তাকে আস্তো রাখবো নাকি?’

তিহাম ভাই বেশ কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,

—‘কি করবি তুই?কিভাবে তাকে আস্তো থেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করবি?’

—‘জানি না!তখন কারটা তখন দেখা যাবে।আপাতত চুল ছাড়ুন।’

—‘তোকে যে ছোটবেলায় আমি ডজন খানেক চুমু খেয়েছি সেটা মনে আছে?তোর সেই স্পর্শ টুকু আমার সাথে এখনো লেগে আছে।মনে হয় এই সেদিনের কথা!’

আমি বিস্ফারিত নয়নে তিহাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হড়হড় করে উনার গা ভর্তি বমি করে দিলাম।উনি……….. ‘

(চলবে)

আসসালামু আলাইকুম।এই গল্পের প্রথম সিজনের সাথে দ্বিতীয় সিজনের তেমন উল্লেখ যোগ্য মিল নেই।শুধু প্রথম সিজনের ক্যারেক্টার গুলো কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে থাকবে।দিয়ানা-তিহামের নতুন জার্নিতে সবাই পাশে থাকবেন তো??🖤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here