#তোমাকে_চাইবো_বলে
#পর্ব_৯
প্রায় মাঝরাত।মুনার দুচোখের পাতা এক হচ্ছেনা।জেদের বশে ফোনটাও ভেঙে ফেললো। বারবার মনে হচ্ছে নাদিব যদি একবার কল করতো।মাকে জিজ্ঞেস করতেও সংকোচ হচ্ছে।
মুনা বারান্দায় গিয়ে বসলো। চারদিকে যেনো নাদিবের হাসিটা ভাসছে।কত শত খুনসুটি ভরা মুহূর্ত কেটেছে এখানে একসাথে।মুনার কান্না পাচ্ছে,চিৎকার করে নাদিব কে ডাকতে ইচ্ছে করছে।অন্ধকার রুম টাতে নাদিব নেই,নাদিবের হাসি ঠাট্টা নেই,গম্ভীরতা নেই,যেটুক আছে শুধু হাহাকার। সেটাই যেনো মুনাকে গিলে খেতে চাইছে বড্ড।মুনা ভাবতেই পারেনি এতটা নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসবে নাদিব ছাড়া।লোকটা পৌছেছে তো? কবে ফিরবে?আমাকে মিস করছে কি?
…
সকালে উঠেই মুনা চা বসালো। মা জেগে গেছেন আরো আগেই।চা বানিয়েই অভ্যেস মতন রুমে নিয়ে গেলো সে।নিরাসক্ত হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। প্রতিদিন ঘুম ভাঙার পর পাশ ফিরেই যে মুখটা দেখার অভ্যেস হয়ে গেছিলো,সে মুখটা এখানে কোথাও নেই।চা নিয়ে মায়ের রুমে গিয়ে বসলো। মুখের কাছে এনে নাড়াচাড়া করলেও জিজ্ঞেস করতেই পারছেনা নাদিব কল করেছে কিনা।রেবা বেগম চা নিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন।
” নাদিব কল দিয়েছে তোকে?ও তো পৌঁছে গেছে রাতেই।আমাকে মাঝরাতে কল দিলো।বললো তোর ফোন অফ।
“হ্যাঁ মা।দিয়েছে তো।আমি ঘুমিয়ে গেছি তাই টের ই পাইনি যে চার্জ ছিলোনা।
কোনো ভাবে কথা কাটালো মুনা।নিজেকে এখন আস্ত গাধী মনে হচ্ছে।কি দরকার ছিলো ফোনটা ভাঙার।এখন ফোন কিনতে গেলে মা কে কারণ দেখাতে গেলেই ধরা পড়ে যাবে।
তাকে যে কল দিয়েছে এটা শুনে কিছুটা শান্তি পাচ্ছে মুনা।অফ পেয়েছে এতেও লাভ হয়েছে,লোকটা বুঝুক আমি রেগে আছি খুব।
কিছুদিন আর কথা বলবেনা নতুন ফোন নেয়া অব্দি।
সারাদিন বউ শ্বাশুড়ি মিলে এটা ওটা করে কাটিয়ে দেয়।রাত হলেই রাজ্যের দুশ্চিন্তা এসে ভর করে মুনার মনে।হাজারো অদ্ভুত প্রশ্ন জাগে নাদিবকে ঘিরে। হাসফাস করে কেটে যায় সারারাত। ঘুম আসেনা কিছুতেই।খেতে ইচ্ছে করেনা,ঘুমাতে পারেনা।সামনে এক্সাম,মুনার পড়াশুনাও হচ্ছেনা কিছু।সারাক্ষণ দরজা বন্ধ করে থাকে,শ্বাশুড়ি ভাবেন হয়তো পড়ছে তাই বিরক্ত করেন না আর। শুধু মুনাই জানে কিভাবে তার দিন গুলো কেটে যাচ্ছে গুণে গুণে।এভাবেই কেটে গেলো কয়েকদিন।
নাদিবের কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে আসার পর থেকেই।এত বেশি ব্যস্ত যে যখন ফ্রি হয় তখন প্রতিদিন বাড়িতে কল দেয়ার ইচ্ছে থাকলেও দেয়া হয়না।কারণ সে জানে মা তখন ঘুমাচ্ছে।আর যাকে কল করার জন্য প্রতি মুহুর্তে চঞ্চল হয়ে উঠছে মন,সে তো কথাই বলতে চায়না।ফোন ই অফ করে রেখেছে।এ ব্যাপারে মাকেও কিছু বলতে পারছেনা।মা হয়তো জানেনা, জানলে নিজেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো। কার থেকে খোজ নিবে মুনার সেটাই বুঝছেনা।যতক্ষণ ফ্রি থাকে ততক্ষণেই মুনার জন্য ব্যাকুলতা বাড়ে,ব্যস্ত থাকছে সেই ভালো হলো। কাজটা যত আর্লি কম্পলিট হয় ততই ভালো। এখানে বেশিদিন থাকা যে দূর্সাধ্য তা কদিনেই টের পাচ্ছে নাদিব।
পনেরো দিন পর!
মুনা বিছানা ছেড়ে পড়তে বসলো। মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা সরিয়ে এবার এক্সামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।শরীর টাও দুর্বল লাগছে ইদানীং, মাথা ধরে থাকে শুধু।তখনি রেবা বেগম মুনার ঘরে এসে বসলেন।
“মুনা!তোর ফোন কি নষ্ট হয়ে আছে?
” কেনো মা।আছে তো ফোন।
“দেখ কি করেছিস না করেছিস আমি জানিনা।বাবু কাল ফোন করেছিলো,কথার ধরণে বুঝলাম তোর সাথে কথা বলতে পারছেনা।আমিও কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
” আসলে মা,হাত থেকে পড়ে…
“আমাকে বলিস নি কেন? আর তোর কাছেই তো নাদিব খরচের টাকা দিয়ে গেছে। নিজেও একটা নিয়ে নিতে পারতি।
” না মা।দরকার হচ্ছিলো না তো তেমন।তাছাড়া বের ও হইনি আর।এক্সাম ও সামনে।তাই
“অজুহাত?নাকি নিতে চাস না? সমস্যা টা কি তোদের?চেহারা দেখেছিস নিজের? শুকিয়ে কেমন হয়েছিস।ঠিকমতো খাওয়াটাও খাস না।
এমন কষ্টই পাবি তো যেতে দিলি কেনো?কেনো আটকালি না?
মুনা মাথা নিচু করে আছে,দু চোখে জল টলমল করছে।এই মানুষ টার কাছে কিছুই গোপন রাখা যায়না।
” মুনা,কেনো অভিমান করে আছিস? নিজের জিনিস নিজেকেই আগলে রাখতে হয় জোর করে।না রাখলে কেমন ফাঁকি হয়ে যায় তা তো আমাকে দিয়েই দেখলি বল?
“আমি আর কি করতাম মা? ও আমার একটা কথাও শুনতে চাইলো না।আমি মানছি আমি আদিব কে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারিনি।কিন্তু এও সত্যি আমি তাকেও ভালোবেসে ফেলেছি।আমি ভাবতেও পারিনি সে এভাবে ভুল বুঝে চলে যাবে।আবার বলেছে ফিরবেও না।
তাই আমিও বলেছি না ফেরা অব্দি কথা বলবোনা।
সমস্ত বাধ ভেঙে কান্না শুরু করলো মুনা।কান্নার জন্য কথাই বলতে পারছেনা।
রেবা বেগম অবাক হয়ে গেলেন,এত ভালোবেসে ফেললো তারা একে অন্যকে?
“কথা বলবি বাবুর সাথে?কল দিই আমি?
” না,বলবো না আমি।সে সত্যিই ফিরবেনা আর মা।সব নিয়ে গেছে তার।
“দূর পাগলী।ও তো নিতেই পারে।আমি আছি কিজন্য? শুধু ওর কাজ টা শেষ হতে দে।কিভাবে টেনে নিয়ে আসি দেখিস।তুই মন দিয়ে পড় শুধু,কিচ্ছু ভাবিস না আর।
” ও যদি না ফিরে মা?তবে
“তবে তুই আছিস কেনো? বউ হোস তুই।ও যে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে তা আমি কথা শুনেই বুঝেছি।তুই মন থেকে একবার ডাকলেই ও চলে আসবে।আমি চিনি ওকে।
” তুমি কিন্তু ওকে এসব কিচ্ছুটি বলবেনা।আমি কাঁদছি শুনলে সে আরো মজা পাবে।
“হাহা,বেশ বলবোনা। তোদের দুজনের মান অভিমান দেখেই আমার বাকি জীবন কাটাতে হবে দেখছি।তুই পড় আমি কিছু আনি,খেয়ে নিবি।
দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এলেন তিনি।
” আচ্ছা শুন,কাল কি ওই লোকটার সাথে আমার দেখা করিয়ে দিতে পারবি একবার?
“তুমি কথা বলবে মা?আমি কল দিলেই উনি এখানে চলে আসবে।
” না এখানে না।বাইরে কোথাও।
“আচ্ছা,আমি ব্যবস্থা করছি সব।
মুনা খুশিই হলো। এই উছিলায় যদি সব মান অভিমান ভেঙে যায়,যদি আদিবের ইচ্ছামতই তার বাবা মা এক হয়ে যান।কি সুন্দর ই না হবে।সমস্যা শুধু নাদিব কে নিয়ে।সে যাহোক পরে হবে।নাদিব কে বুঝিয়ে নিবে পরে।শত হোক বাবাই তো।
…
নাদিবের আর কিছুতেই ভালো লাগছেনা।এসেছে দিন পঁচিশ মাত্র।এখনি এই অবস্থা। বাকি অর্ধেক কাজ যদি একটু এগিয়ে দেয়া যায়,তাহলে অন্য কাউকে ভার দিয়ে চলে যেতে পারতো।মুনা যতই যা করুক,অন্তত আশেপাশে থাকলেও সব কিছুই ভালো লাগে।একটা কেয়ারিং ভাব শুরু থেকেই পেয়েছে মুনার থেকে।হয়তো কেয়ার থেকে বেশিই সেটা,ভালো বাসা কিনা কে জানে।সেদিন মুনার কথা মন দিয়ে শোনা উচিত ছিলো। আচ্ছা কেউ কি এত অল্প সময়ে কাউকে সত্যিই ভালো বাসতে পারে?যেখানে তার আগেও একটা আঘাত পাওয়া? হয়তো পারে।আমিও তো পেরেছি,একেবারে কল্পনার মত করে। তাছাড়া সত্যিই তো,মুনা তো ঠিক ই বলেছে,কাউকে ভুলিয়ে দেয়া কি এত্ত সহজ? আরেকটা ভালোবাসা এসেই তো পুরোনো ক্ষতগুলোকে ধীরে ধীরে সারিয়ে তুলে।এটাই নিয়ম। তবু একটা দাগ তো থেকেই যায়।তীব্র ভালোবাসার কাছে সেই অতীত দাগ টা কিছুই না।
এটা ভেবেই অস্থির লাগছে মেয়েটা এত জিদ্দি যে ফোনটাই ওপেন করছেনা।আচ্ছা ও যদি একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়,যদি আর না ডাকে।তবে কি হবে? ধুর বাবা,কিসব ভাবছি আমি।ডাকবে না কেন,আলবৎ ডাকবে,ভালোবাসে তো নাকি।নিজ থেকে এত তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে তো নিজের বলা কথার ই ইজ্জত থাকবেনা। কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ ম্যান,কন্ট্রোল।
নিজেকে বুঝ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো নাদিব।
..
মুনা ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে ফ্রেন্ডস কে সাথে নিয়ে নতুন ফোন কিনতে গেলো। ফোন নিয়েই সীমকার্ড এক্টিভ করেই নাদিবের বাবাকে কল দিলো।এরপরেই শ্বাশুড়িকে কল দিয়ে নিশ্চিন্ত হলো।
বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে খেয়েদেয়ে শুয়েছে মুনা।ফোন হাতে নাড়াচাড়া করছে আর ভাবছে একবার নাদিব কে কল দিবে কিনা।কিন্তু নাম্বার তো নেই,মায়ের থেকে চাইবে? না থাক।দেখাই যাক লোকটা নিজে কল করে কিনা।ভাবতেই মনটা বিষাদে চেয়ে গেলো।
বেলা পড়তেই মুনা তাড়া দিলো রেবা বেগম কে রেডি হতে।নিজ হাতে শাড়ি চুজ করে দিয়ে জোর করে পরিয়ে দিলো।বেস্ট অব লাক বলে শ্বাশুড়িকে কফিশপের ঠিকানা দিতেই রেবা বেগম মুনার হাত চেপে ধরলেন।
“তুই ও যাচ্ছিস আমার সাথে।
” মা!
“হ্যাঁ। কথা না বাড়িয়ে চল।
অগত্যা মুনা যেতে বাধ্য হলো। নাহয় মা যাবেই না।
রেবা বেগম শুধুমাত্র সাহসের অভাবেই মুনাকে সাথে নিলেন।বুকের ভেতর ধুকপুক, মাথার উপর সারা অতীত বর্তমান ঘুরছে।কথা বলতে পারবে কিনা সেটাই ভাবছে।বলাটা খুব ই জরুরী আজ।ক্ষমা যে শুধু একাই লোকটার প্রাপ্য তা নয়।রেবা বেগম নিজেও ভীষণ স্বার্থপরের মতন সবটা বিচার করে সরে গেছিলেন।চাইলেই আজ সব অন্যরকম হতেই পারতো।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কফিশপে পা রাখলেন তিনি।মুনা থমকে দাঁড়ালো। সে আর যাবেনা।এদের কিছু স্পেচ দরকার আজ।মুনা বললো, আমি সামনের একটা টেবিলে বসছি।তুমি নির্বিঘ্নে কথা বলে আসো। প্লিজ মা।
রেবা বেগম বর্ষ পুরোনো শত রকমের অভিমান,অজুহাত, রাগ, জেদ, অপরাধবোধ এর গ্লানি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।চিনতে একটু কষ্ট হয়নি ভদ্রলোককে।দাড়ি গোফে পাক ধরেছে অবশ্য,বয়স এখনো আগেরি মতই যেনো। প্রিয় মানুষ গুলো বোধ করি কখনোই বুড়িয়এ যায়না। কে বলবে এই মানুষ টাকেই কিশোরী বয়সে সবটা ছেড়েছুড়ে ভালোবেসেছিলো। সময় কত সংজ্ঞাই পালটে দেয়।
খানিক দূর থেকেই রেবা বেগম কে দেখে ভদ্রলোক উঠে দাড়ালো। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে রেবা তার সামনে। এই মানুষ টাকেই তো তিনি কষ্ট দিয়েছিলেন একদিন। আজ কি সেই অপরাধের ক্ষমা নিয়েই এসেছে রেবা?
রেবা বেগম এবার আর চোখাচোখি তাকালেন না।ভদ্রলোক কিছু অর্ডার দিতেই রেবা মানা করলেন।তাড়া আছে তার বললেন।
দুজনেই চুপ। শুরুর কথা গুলো কি বলা উচিত কেউই খুঁজে পাচ্ছেনা।বেশ নিরবতার পর রেবাই প্রশ্ন করলো।
“কিজন্য এসেছেন এত বছর পর?
“কেমন আছো রেবু?
রেবা বেগমের হার্টবিট মিস করলো যেনো।
কত কত বছর পর, যে নামটা স্বযত্নে ভুলিয়ে দিয়েছিলেন সেটাই কেন আজ আবার শুনতে হচ্ছে।
“কি চান আপনি এখন?
” কি বা চাওয়ার আছে আমার আর?
“আমার ছেলেদের পিছু করছেন কেনো? কি উদ্দেশ্য আপনার?নিজের পিতৃত্ব জাহির করতে চাচ্ছেন?
” আমি বোধহয় সেই হতভাগ্য পিতা যে সাহস করে ছেলেদের সামনেই আসতে পারেনি।সেখানে নিজের পরিচয় জাহির করা কি দূর্লভ নয়?
“তাহলে?এতবছর পর কেনো পুরোনো স্মৃতির ধুলো ঝাড়তে এসেছেন? লাভ নেই।ধুলো জমে জমে এতটাই গভীরে চলে গেছে সেসব যে,ইচ্ছে করলেও আমি আর খুঁজে পাইনা নিজের জন্য কিছুই।
” জানি।তুমি বরাবর কঠিন ই রয়ে গেলে রেবু।আমি ধুলো ঝাড়তে আসিনি।আদিবের সাথে আমার দেখা হয়েছিলো জানো।আল্লাহ ই মিলিয়েছে হয়তো আমাদের।এক ছেলের কাছে আমি ক্ষমা চেয়েছিলাম।তাকে হারিয়েছি।আরেক ছেলের সামনে যাওয়ার সাহস আর হলোনা। কিছুই তো বাকি নেই,ক্ষমা ছাড়া।
“ক্ষমা করে দিয়েছি কবেই। যে ভুলে আপনি দোষী তার অধিক ভুল আমিও করেছি।ছেলেদের পিতার থেকে বঞ্চিত করেছি। তাদের মানুষ করার স্বার্থেই আমি কঠোর হয়ে থেকেছি।খুব সহজ ছিলোনা একটা সিঙেল মাদার এর স্ট্রাগল। ছেলেরা মানুষ হয়েই গেল,আমিও বয়সের আরেক গন্ডি পার করলাম স্মৃতি আঁকড়ে আর স্বার্থপরতার গ্লানি নিয়ে। ক্ষমা টা আমার প্রাপ্য আজ।আপনার নয়।আপনি হয়তো আপনার জায়গায় ঠিক ছিলেন,আমিই ছিলাম স্বার্থপর। তার জন্য শাস্তিও কম পাইনি,আমার এক ছেলে আজ আমার কাছে নেই।হয়তো আমার জেদের ফল এটা।
” তোমার পীড়া আমি বুঝি।ছেলে হারানোর শোক আমার ও ছিলো বলাটাই এখন অবান্তর। যাক সে কথা,আমি চাই তুমি আরেক ছেলে নিয়ে সুখে থাকো।তোমার জীবনে আমি আর নতুন করে কোনো পয়েন্ট দাঁড় করাতে আসিনি বিশ্বাস করো।
“ব্যাস তাহলে তো মিটেই গেলো সমস্ত হিসেব।আপনি মুক্ত হলেন আজ। যদিও আমি আগেই কোনো দায়বদ্ধতা রাখিনি আপনার থেকে।
” মিটিয়ে দিলেই কি সব মেটে রেবু? শুধুমাত্র তোমার মুখটা দেখবো বলে কতবার ফিরতে চেয়েছি।কিন্তু তোমার কঠোরতার কথা ভাবলে আমি মুষড়ে যেতাম।বয়স হয়েছে,কখন সব মায়া ত্যাগ করি বলা তো যায়না।শান্তি পাচ্ছিলাম না দেখা না করে।
“বয়স নিশ্চয় থেমে নেই আমারো।ক্ষমা করবেন আপনার ছেলেদের সরিয়ে রাখার জন্য আপনার থেকে।
” নাদিব কি জানে আমার ব্যাপারে?
“না।ও দেশে নেই।আমি চাইনা এই বয়সে ও এমন সত্যিটা জানুক। খুব সহজে নিতে পারবেনা আমার ছেলেটা।হয়তো আমাকেই উল্টো ঘৃণা করতে পারে।আমি এটুক ভিক্ষা চাইছি আপনার থেকে।
” বেশ জানবেনা।আমি চলে যাচ্ছি এ সপ্তাহেই।চিন্তা করোনা।
“চলে যাবেন?
“হু
” আর কবে ফিরবেন?
“হয়তো কখনোই নয়।হয়তো বা আবার তোমাকে দেখার তীব্র ইচ্ছাটা দমনে ব্যর্থ হলে।
” হাসালেন।অতীত ভুলে থাকাই শান্তির।পুরোনো ক্ষতে পঁচন ধরলে সারেনা সেটা।আসি তবে।
রেবা বেগম উঠে দাড়ালেন।
“তুমিও কি ভুলতে পেরেছো রেবু?
” পেরেছি বটে।
“মনে পড়েনি একবার ও?
” না।হয়তো একদিন খুব যত্নে ভুলিয়ে দিয়েছিলাম বলেই।
“বড্ড বেশিই কঠিন তুমি, বড্ড বেশি।
” বড্ড স্বার্থপর ও বটে।
আরেকবার ও পিছু না তাকিয়ে হাটা ধরলেন রেবা।পেছনে একটা মায়ার দুনিয়া।লোকটা অশ্রস্নাত চোখে তাকিয়ে।কি অদ্ভুত দুনিয়ার নিয়ম।কেউ কাউকে আটকানোর অধিকার একসময় যুক্তিহীন হয়ে পড়ে।রেবা বেগম মেরুদণ্ড সোজা করেই আগাচ্ছেন।পিছু তাকানোর ভয় ভীষণ। মায়া হচ্ছে সীম গাছের মতন,আশকারা পেলেই ডালপালা গজিয়ে আকাশ ছুঁতে চায়।একসময় সমস্ত নির্ভরতা ছাড়িয়ে যায়,তারপর নুইয়ে পড়ে। তখন শুধু পদদলিতই হতে হয়।যত শীঘ্রই এর আগা কেটে দেয়া যায় ততই মঙল।
মুনা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।আজ একটা মিরাকল ঘটুক এটাই তার প্রার্থনা। তখনি রেবা বেগম এসে সামনে দাড়ালেন।
“কথা শেষ তোমাদের?উৎসুক চোখ মুখ নিয়ে মুনা বারবার পেছনে দেখছে।
” চল মুনা।কেউ নেই পেছনে।
“মা!আমি কথা বলতে চাই ওনার সাথে।কি কথা হলো তোমাদের? এখনো কি অভিমান করেই থাকবে তোমরা?
” সে বয়স আমাদের কারোর ই নেই মুন্স।যা করছি ভেবে চিন্তেই এবার।এর জন্য অন্তত কোনো আফসোস থাকবেনা।চল।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুনা গাড়িতে উঠলো। মুড অফ করে বসে রইলো।
“তোর কি মনে হয়, পাশাপাশি থাকলেই ভালোবাসা টিকে থাকে শুধু?
” জানিনা
“এইযে নাদিব তোর থেকে দূরে আছে তুই কি ওকে ভালোবাসা ছেড়ে দিয়েছিস? বরং সেটার ঘনত্ব আরো বাড়ছে।
” তুমি কেনো ওই মানুষ টাকে যেতে দিচ্ছো মা? আমি লোকটার অসহায়ত্ব দেখেছি সেদিন।কাছের মানুষ দের থেকে দূর থাকার যন্ত্রণা তাকে শেষ করে দিচ্ছে। মুনা কেঁদে দিলো বাচ্চাদের মত।
মুনা চোখ মুছে দিয়ে হাসলেন রেবা।
“যে মানুষ টা কে নেই বলে ভাবতে ভাবতে এতগুলা বছর পাড়ি দিয়েছি,যে মানুষ টাকে নেই বলে ভেবেছি বলেই বিন্দুমাত্র ঘৃণা করতে পারিনি তার কর্মের জন্য,বরং গোপনে ভালোবেসে যাওয়ার অভ্যেস গড়ে তুলেছিলাম,সেই মানুষ টা যদি আজ সামনে এসে দাঁড়িয়ে গ্রহনযোগ্যতা পেতে চায় তবে সেটা দুঃসাহসিকতা। যে ঘৃণা টা আজ নেই সেটা কাল উপস্থিতিতে যে নতুন করে জন্মাবে না তার ভরসা কি? তারচেয়ে বরং আমার মতই ভেবে কাটিয়ে দিলাম বাকি জীবন টা।সেও দিব্যি কাটিয়ে দিবে এবার। আমাদের সময় টা ফেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু নিজেকে ভুলিয়ে চলা।
মুনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
তারচেয়ে বেশি অবাক হচ্ছে এমন স্বাভাবিক থাকতে দেখে।কিভাবে পারে মা।
…
বাসায় এসে যে যার মত রইলো। রেবা বেগম বারান্দায় বসে রইলেন। রাত গভীর হচ্ছে,চাঁদটা ক্রমশ ডুবে ডুবে যাচ্ছে।ডুকরে কেঁদে উঠলেন রেবা।
পেছনে সাক্ষী হয়ে রইলো মুনা।অন্ধকারে মুনা মেলাতেই পারছেনা মানুষ ভালোবাসার কাছে কতটা অসহায়।সময় আর নিয়মের কাছে কতটা বন্ধী। বুকের ভেতর খামচে ধরলো। মুনা অন্ধকারেই শ্বাশুড়ির ফোন হাতে নিয়ে চলে গেলো। নিজের ফোনে নাদিবের নাম্বার টা সেভ করে ফোন রেখে গেলো।সারা ঘরে যেনো কেউ নিঃসঙ্গতা ছড়িয়ে দিয়েছে আজ।মুনা দরজা বন্ধ করে খাটে শুয়ে পড়লো। মাথায় শুধু আজকে বিকেলের এক হৃদয়বিদারক বিচ্ছেদ ঘুরছে।প্রচন্ড কান্না আসছে মুনার।মানুষ ছোট্ট একটা বুকে এত কষ্ট কিভাবে লুকিয়ে এতগুলা বছর নিরবে কাটিয়ে দেয়? মুনা উঠে বসে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো। গা কাপিয়ে জ্বর পাচ্ছে যেনো। খুব ইচ্ছে করছে আজ নাদিব কে জড়িয়ে ধরে নিজের ব্যাকুলতা শানত করতে।চোখ মুছে মুনা নাদিবের নাম্বারে ডায়াল করলো, এক বার, দু বার, বারবার ই কল যাওয়ার আগেই কেটে দিচ্ছে মুনা।এবার দিয়েই ফেললো, একটা রিং হতেই রিসিভ হলো। মুনা লাউড দিয়ে পাশে ফেলে রাখলো ফোন।ওপাশ থেকে ক্রমাগত একটাই শব্দ আসছে।
মুনা,মুনা,..
মুনা আর থাকতে পারলোনা। কল কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুজে কাদতে লাগলো।
সাথে সাথেই আবার কল নাদিবের।কয়েকবার রিং হতেই মুনা রিসিভ করে কানে ধরলো।
নিজেকে শান্ত করার জোর চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হলো সে।
“মুনা,কেমন আছো তুমি?
”
“এতদিন পর ফোন ওপেন করলে? এমন কেন তুমি? কতবার কল দিয়েছি তোমাকে এই একমাসে।একটুও ইচ্ছে হয়নি তাইনা কথা বলতে?
”
“কি হলো মুনা,কথা বলবেনা আমার সাথে? তুমি জিজ্ঞেস করবেনা কখন ফিরবো? তুমি যদি না বলো আমি সত্যিই কিন্তু ফিরছিনা সহজে।
মুনা এবার আর পারলোনা।স্বশব্দে কেঁদে উঠলো। এত জোরে যে মনে হচ্ছে কেউ তাকে মেরেছে।মুনার গোঙানির শব্দে নাদিব তাজ্জব হয়ে গেলো। কি হলো মেয়েটা হঠাত এভাবে কেন কাঁদছে? মুনার কান্নার শব্দে নাদিবের শরীরের লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে।ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে এসে কান্না থামাতে।
” প্লিজ মুনা,কি হইছে তো বলো প্লিজ।প্লিজ মুনা।কেনো এভাবে কাদছো তুমি। বিশ্বাস করো মুনা আমি তোমাকে প্রতিদিন ই কল করেছি,তোমার ফোন অফ এসেছে।আমার কি দোষ বলো তো।
মুনার কান্নার গতি বেড়েই চলেছে।নাদিবের আর কিছুই ভালো লাগছেনা।বুকের ভেতর কেমন করছে।তার নিজের ও কান্না পাচ্ছে ভীষণ ।
” প্লিজ মুনা, কেদোনা প্লিজ।আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না তো।এই যে কান ধরে স্যরি বলছি মুনা,প্লিজ একটু কথা বলোনা প্লিজ।নাদিবের কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে সে কাঁদছে।মুনার কান্না এবার আরো বেড়ে গেলো।কিছুতেই নিজেকে আর বাধা দিতে পারছেনা।মুনা বুঝতেই পারছেনা এমন কেন করছে সে।ওপাশের মানুষ টার নিরব কান্না তার বুকে এসে আঘাত করছে শুধু।মুনা ফোন অফ করে দিলো আবার।শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো শুধু।
নাদিব জরুরী কাজে ছিলো। ওখান থেকে এসে মুনার কল ধরেছিলো।এতটা খুশি হয়েছিলো বলার বাইরে।কিন্তু এভাবে মুনার কান্না ওকে একেবারেই মন ভার করে দিলো। আর এক মুহুর্ত ও তার ইচ্ছে করছেনা এখানে থাকতে। টেনশনে মায়ের ফোনেও কয়েকবার কল দিল সে।কিন্তু কেউ কল উঠায় নি।আরো টেনশন হচ্ছে এবার।নাদিব তার বাসায় এসে বারবার শুধু মুনার ফোনে ট্রাই করছে,কিছুতেই আর পাচ্ছেনা।তাকে যে করেই হোক খুব তাড়াতাড়ি ফিরতে হবেই।যেভাবেই হোক।!
..
দেখতে দেখতে মুনার এক্সাম শুরু হয়ে গেলো। সেদিনের পর থেকে মুনা কেমন যেনো চুপসে গেছে।কাউকে কিছু বলে বুঝাতেও পারছেনা।নিজের দিকেও খেয়াল নেই।সেদিন রাতে এমন কেনো করলো মুনা নিজেই ভেবে পায়না।তারপর থেকে বারবার ফোন দিতে চেয়েও দিতে পারেনি নাদিব কে।সংকোচ লাগছে খালি।নাদিব এই কদিনে সম্ভবত হাজারবার কল দিয়েছে।প্রতিবার ই মুনা ফোন হাতে নিয়ে বসে বসে কেদেছে।কিন্তু একবার ও সাহস করে ফোন ধরে বলতে পারেনি,”আপনি চলে আসুন প্লিজ,আমার খুব কষ্ট হয় আপনাকে ছাড়া।”
মাঝে সপ্তাহখানেক হয়ে গেলো। রেবা বেগম এখন বেশিরভাগ সময় ই নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য তটস্থ থাকেন।মুনা পড়াশুনার চাপে তার সাথে তেমন আড্ডা দিতে ও পারছেনা। কিন্তু ঠিক ই বুঝলো নিজেকে ব্যস্ত রাখার কারণটুকু। মুনাও কিছু বলেনা,থাকুক না মানুষ টা নিজের মতই,যেভাবে খুশি থাকেন।পরিস্থিতির সাথে লড়তে লড়তে মানুষ একসময় পরিস্থিতির যোগ্য হয়ে উঠে,মানিয়ে নিতে পারে।কিন্তু একবার সেই মানিয়ে নেয়া অভ্যসের ভীত টা নড়ে গেলে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। সেই অসহায়ত্ব আর সহজে ঘুচে না।
নাদিব এর মনটা অশান্ত হয়ে আছে। মুনার সাথে বারবার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারছেনা আর।মেয়েটা পুড়িয়ে মারছে তাকে।কিচ্ছুই ক্লিয়ারলি বলবেনা,একটা কনফিউশান ক্রিয়েট করে উদাও হয়ে যাবে।এদিকে আমার অবস্থা কে দেখে? কাজের এত্ত প্রেশার,তারউপর কদিন ধরে মায়ের সাথে কথা বলেও শান্তি পাচ্ছিনা।মাকে কেমন গম্ভীর শুনায় আজকাল।অসুস্থ কিনা কি জানি।হলেও তো আমাকে শুনাবেনা। সব মিলিয়ে এক মিশ্র বিষন্নতা নিয়ে কাটছে নাদিবের। এ থেকে যেনো আর মুক্তিই নেই।
চলবে…