তোমাকে শুধু তোমাকে চাই পর্ব -০৪

তোমাকে শুধু তোমাকে চাই

চতুর্থ পর্ব

– তোর কি হয়েছে ভাইয়া ? শরীর খারাপ ?
মুনির জবাব দিল না I আগের মতোই খাটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল I নাজমা আরেকটু এগিয়ে এসে , ভাইয়ের কপালে হাত রেখে , নরম গলায় বলল
– কি হয়েছে ভাইয়া ?
মুনির চোখ খুলে তাকালো I চোখ রক্তবর্ণ হয়ে আছে I কোনমতে বলল
– আমি কাল একটু ঢাকার বাইরে যাব I তুমি মাকে বলে দিস
– সে না হয় বলে দেব I কিন্তু হয়েছেটা কি ?
মুনির এবারেও জবাব দিল না I শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল I
– সমস্যাটা কি অনিমা আপুকে নিয়ে ?
মুনির চমকে উঠল I তার পর বলল
– তুই কি করে বুঝলি ?
নাজমা খাটে বসতে বসতে বলল
– না বুঝার কি আছে ? এখন কি হয়েছে আমাকে বল
নাজমার বয়স 17 বছর I এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে I প্রাথমিকভাবে ওর সঙ্গে কথা বললে যে কারো মনে হবে, মেয়েটা অত্যন্ত শিশুসুলভ I কিন্তু যারা ওকে কাছ থেকে জানে , শুধুমাত্র তারাই বুঝতে পারে যে ও অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে I এবং এ বয়সি অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় ওর মানসিক পরিপক্কতা ও অনেক বেশি I সব শুনে নাজমা বললো
– সবই বুঝলাম Iশুধু একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না I
– কি ?
– শাড়িটা ভুল করে অনিমা আপুর কাছে কেন গেল I আমরা তো সবাই জানি তুই ওকেই ভালবাসিস I
– আমরা মানে ?
– মানে আমি মা
– কি বলিস এসব ?
– যাক , বাদ দে I কাল গিয়ে ওকে নিয়ে আয় I আর এখন চল খেতে যাবি I
– নাজমা শোন Iমাকে এখন কিছু বলার দরকার নেই I
– আচ্ছা

খেতে বসে মুনিরের মন আরও খারাপ হয়ে গেলো I মা আজ কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না করেছে I এটা অনিমার অসম্ভব প্রিয় একটা খাবার I কয়েকবার ওরা বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে গিয়ে একসঙ্গে খেয়েছে ও I কোন দোকানেরটাই মুনিরের ভালো লাগেনি I শেষবার বিরক্ত হয়ে বলেছিল
– এসব জঘন্য বিরিয়ানি মানুষ কেন পয়সা দিয়ে কিনে খায় আমি বুঝিনা I এর চেয়ে আমার মায়ের হাতের বিরিয়ানী অনেক মজারI
– তাই ?
– হ্যাঁ I নেক্সট টাইম আর এসব জায়গায় আসবো না I মাকে বলবো রান্না করতে I তোমাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে খাওয়াবো I

সেই কথা মতোই গত বছর এক শুক্রবারে মুনির অনিমাকে নিতে ওর হলে গিয়েছিল I অনিমা নিচে নেমে এলো হাতে একটা কাচের বোতল নিয়ে I পরনে সাধারণ পোশাক I মুনির অবাক হয়ে বলল
– তোমার হাতে এটা কি ?
– তেমন কিছু না I প্রথমবার তোমাদের বাসায় যাচ্ছি তাই নিলাম
– কে জিনিস ?
– আচার I আমার মায়ের বানানো
– বল কি ? এর এক ফোটাও আমরা কেউ পাবো না I দেখার সঙ্গে সঙ্গে নাজমা পুরোটা খেয়ে ফেলবে I
অনিমা হেসে ফেললো I
-তাহলে তো তোমাদের জন্য কিছুই নেওয়া হলো না
– সমস্যা নেই I এমনিতেও আমি আচার খাই না I
– ও I অনিমা মন খারাপ করা গলায় বলল
মুনিরের বাসা রায়েরবাজার Iহল থেকে খুব বেশি দূরে নয় I ওরা দুজন একটা রিক্সা নিয়ে নিল I শুক্রবার সকাল বলে এদিকটায় তেমন ভিড় নেই I অনিমার মন খারাপ ভাব দেখে মুনির বলল
– আমার জন্য কিছু নিতে পারছ না বলে মন খারাপ করোনা I সময় মত আমি ঠিক তোমার কাছ থেকে আদায় করে নেব I তোমাকে আমার খুব জরুরী একটা কাজ করে দিতে হবে I
– কি সেটা ?
– এখন বলবো না
– না ,এখনই বলতে হবে
– তুমি এত জেদ করো কেন সবকিছু নিয়ে ?
– আমি এমনই I বল এখন
মুনির কিছু বলার সুযোগ পেল না তার আগেই একটা রিক্সা পেছন থেকে ধাক্কা দিল I আরেকটু হলে অনিমা পড়ে যেত Iমুনির ওর একটা হাত ধরে ফেলল I তারপর বলল
– একটু ঠিক হয়ে বস I এখনইতো পড়ে যেতে
মুনির হাত সরিয়ে নিয়েছে I অনিমা রিক্সার হুড ধরে বসলো I কেন জানিনা ওর খুব ইচ্ছা হচ্ছে পুরোটা পথই মুনিরের হাত ধরে যেতে I খুব ইচ্ছা করছে I খুব ইচ্ছা করছে I
-কি খুব ইচ্ছা করছে ? মুনির ভয় পাওয়া গলায় বলল
– ও I জোরে বলে ফেলেছি নাকি ?
– কেন মনে মনে বলছিলে ?
– হ্যাঁ I মাঝে মাঝে আমি মনে মনে কথা বলতে বলতে কখন যে জোরে বলে ফেলি বুঝতে পারিনা I
– তোমার মাথায় ভালো সমস্যা আছে I
– থাকলে আছে
মুনির হাসতে হাসতে বলল
– কিন্তু তোমাকে সমস্যাসহই ভালো লাগে I বললে না তো কি খুব ইচ্ছা করছে
– কিছু না
– আচ্ছা বলতে হবে না I যেটা ইচ্ছা করছিল সেটা করে ফেলো
– সেটা করলে এখন তুমি রিক্সা থেকে নেমে যাবে
– এমন কি ইচ্ছা করছে ? মুনির অবাক হয়ে বলল
– আমার এখন চিৎকার করে গান গাইতে ইচ্ছে করছে
– কি সর্বনাশ I তুমি এখন গান শুরু করলে তো রাস্তায় লোক জমে যাবে I আর আমাকে সবাই রিকশা থেকে টেনে নামিয়ে দেবে I
অনিমা হাসতে হাসতে বলল
– আমি এতটাও ভালো গান গাইনা
– তুমি নিজেও জানোনা তুমি কতটা ভালো গান গাও I

-কি হলো খাচ্ছিস না কেন ?

মুনিরের চিন্তার সুতো কেটে গেল I ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাবার মুখে তুলল I চমৎকার সুঘ্রান কিন্তু খেতে বিস্বাদ লাগছে I মুনির খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেল I খেতে পারলো না I রেহানা বেগম জোর করতে চাইছিলেন কিন্তু নাজমার জন্য পারলেন না I মুনির মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল I আচ্ছা , অনিমাও কি খেতে পারছে না I কোথায় ও এখন ?

সেদিন বাসায় এসে অনিমা খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিল I রেহানা বেগম নিজ হাতে তুলে দিয়েছিলেন I মেয়েটা একা একা থাকে I বাবা মায়ের থেকে এত দূরে I কিনা কি খেয়ে থাকে I
– তোমার বাড়িতে কে কে আছে অনিমা ? উনি জানতে চাইলেন
– আমি বাবা আর মা
– তোমার আর কোনো ভাইবোন নেই ?
– না আন্টি
– কখনো মন খারাপ লাগলে আমাদের এখানে চলে এসো I কেমন ?

রেহানা বেগম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওর কাছ থেকে সব খবর নিলেন I বাড়িতে কে কে আছে I ওর কি খেতে পছন্দ I কি ভালো লাগে কি না I মেয়েটাকে তার অসম্ভব ভালো লাগলো I ছেলের পছন্দ দেখে উনি খুবই নিশ্চিন্ত হলেন I বিকেলে অনিমার জন্য ফুচকা চটপটি তৈরি করলেন I মেয়েটার সঙ্গে একটু শান্তি মত গল্প করতে পারলেননা নাজমার যন্ত্রণায় I নাজমা জোর করে ওকে ধরে নিয়ে গেল নিজের রুমে I তারপর দুই হাতে মেহেদি পরিয়ে দিল I মুনির নামাজ পড়ে এসে বোনের কান্ড দেখে ধমকাধমকি শুরু করে দিল I অনিমা হাসতে হাসতে বলল
– তুমি এতো রাগ করছ কেন ?
– একটু পরেই বুঝতে পারবে কেন রাগ করছি I তাকিয়ে দেখো তোমার হাতে কি এঁকেছে I
– অনিমা সত্যি সত্যি হেসে ফেললো I
এক হাতে একটা গন্ডারের ছবি I অন্য হাতে একটা হার্ট I নাজমা অপরাধীর মত মুখ করে বলল
– আমি তো মাত্র শিখছি I প্র্যাকটিস করার কোন চান্সই পাই না I ভাইয়াকে কত বলি হাত দুটো একটু দে I রাজিই হয় না I

নাজমা শুধু ভাইয়ের না, মায়ের কাছেও বকা শুনল I কারণ টেবিলে ফুচকা দেয়া হয়েছে I অনিমা বলল
– আন্টি আমি আর একটু পরে খাই I এটা এখনই শুকিয়ে যাবে

অনিমা ফুচকার প্লেট সামনে নিয়ে টেবিলে বসে আছে I পাশেই মুনির ওর প্লেট থেকে একটার পর একটা ফুচকা তুলে মুখে দিচ্ছে আর আয়েশে চোখ বন্ধ করে বলছে
– আহ কি যে মজা হয়েছে
– তুমি খুব খারাপ একটা মানুষ
– আমি খারাপ তাই না ? গন্ডারের ছবি বানাবে তুমি আর মানুষ খারাপ আমি ? হয়েছে I হা কর I আমি খাইয়ে দিচ্ছি I

অনিমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে I ওর বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যি সত্যি মুনির ওকে খাইয়ে দিচ্ছে I ও ঠিকমতো খেতেই পারছে না I ঠোঁটের কোণ বেয়ে তেতুলের জল গড়িয়ে পড়ছে Iমুনির বিরক্ত হয়ে একটা টিস্যু নিয়ে মুছে দিতে দিতে বলল

– একটা খাবার ঠিকমতো খেতে পারো না I কি করব তোমাকে নিয়ে ? কি হল এখন আবার কাঁদছো কেন ?
– কিছুনা I ঝাল I
অনিমা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছলো I আজকের দিনটি ও কোনদিনও ভুলবে না I

চলবে ……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here