তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব -০৪+৫

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৪.
~
দুপুরের কড়া রোদের শেষে সূর্যের তাপ এখন কিছুটা কমেছে। তবে ভ্যাপসা গরমটা রয়ে গেছে এখনও। রাস্তার ধারের গাছগুলোও যেন এই গরমে অতিষ্ঠ। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত পথিক গুলো রাস্তার কিনার বেয়ে হেটে চলছে যার যার গন্তব্যে।

রাদিতকে নিয়ে মিথির রুমে গিয়ে বসলেন আতাউর সাহেব। রাদিতের সাথে কথা বলে তার মনে প্রগাঢ় এক বিশ্বাস জন্মেছে। রাদিত পারবে তার মেয়েকে বোঝাতে। পড়ার টেবিলের এক পাশের চেয়ারে মিথি বসা আর অন্যপাশেরটায় রাদিত। মিথির কাছে বড্ড পরিচিত এক মানুষ তিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তাকে দেখে আসছে। ক্লাসের সবার প্রিয় স্যার উনি। একজন প্রাণবন্ত মানুষ। ক্লাসকে মাতিয়ে রাখেন সবসময়। কোন এক অজানা কারণে মিথির উনাকে পছন্দ নয়। হতে পারে সেই কারণটা, রাদিত তার আম্মুর বান্ধবীর ছেলে হওয়ায়। আর আমিরা বেগমেরও রাদিত বলতেই একবারে অজ্ঞান অবস্থা। ছেলে তো নয় যেন খাটি সোনা।

মিথির বাবা বললেন,

‘তাহলে বাবা, তুমি আজ থেকেই পড়ানো শুরু করো। তোমার ছাত্রীকে তো তুমি চেনোই, একটু ফাঁকিবাজ আরকি। আমাদের কোনো কথা তো শোনে না। পড়াশোনা বাদে বাকি সবকিছুতেই ফার্স্ট ক্লাস, শুধু এই একটা জিনিসই হয় না। এখন তুমি একটু ট্রাই করে দেখো বাবা। মেয়েটার যদি কোনো উন্নতি করতে পারো।’

রাদিত সাবলীল কন্ঠে জবাব দিল,

‘জ্বি আংকেল, আমি চেষ্টা করবো। আপনি চিন্তা করবেন না।’

এক বুক নিশ্চয়তা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলেন আতাউর সাহেব।

রাদিত তখন বললো,

‘তোমার কোন সাবজেক্টে বেশি সমস্যা মিথি?’

মিথি কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিল,

‘সব সাবজেক্টেই।’

মিথির কথা শোনে রাদিত কপাল ভাজ করে বললো,

‘এত দিন কি কিছু পড়োনি? শুনেছি আমার আগেও নাকি আরেকজন টিচার ছিল তোমার? উনার কাছে কি পড়েছো?’

মিথি তাকাল রাদিতের দিকে। চোখ মুখ কেমন বিষন্ন তার। কেউ যেন মিথিকে ধরে বেঁধে এখানে বসিয়ে রেখেছে। পারছে না এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে। এত অসহ্য কেন সবকিছু? তার সামনে বসে থাকা মানুষটাই বা এত অসহ্য কেন? এই মানুষটা কি বোঝে না যে তার তাকে একটুও পছন্দ হচ্ছে না? তার বলা প্রতিটা কথায় সে বিরক্ত হচ্ছে, ভীষণ বিরক্ত।

মিথি হালকা কেশে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বললো,

‘স্যার, আগের স্যার যা পড়িয়েছে ঐগুলো সব ভুলে গেছি। আমাকে আবার নতুন করে সব পড়ান।’

রাদিত কিছুটা অবাক হয়ে বললো,

‘একটা মানুষ এত ভুলে কি করে বলতো? নিশ্চয়ই তখন ফাঁকি দিয়েছিলে তাই এখন সব খেয়ে বসে আছো? যাকগে সেসব, আমি এখন আবার প্রথম থেকেই সবকিছু শুরু করবো। আমার কাছে নো ফাঁকি। সারাদিন শুধু পড়াশোনা আর পড়াশোনা এছাড়া আর অন্য কিছু না, বুঝেছো?’

তড়িৎ গতিতে মিথির অসহ্যের মাত্রাটা বেড়ে গেল। এই লোকটা তাকে যে পাগল বানিয়ে ছাড়বে সেটা সে এখনই উপলব্ধি করতে পারছে। নিজেরই এখন নিজের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। কি দরকার ছিল, নৈরিথকে রাগিয়ে দেওয়ার?

মিথির কোনো রেসপন্স না পেয়ে রাদিত বললো,

‘কি হলো? কথা বলছো না যে?’

মিথি জোরপূর্বক হেসে বললো,

‘জ্বি স্যার, মনে থাকবে।’

প্রসন্ন হেসে রাদিত বললো,

‘ঠিক আছে। এবার তোমার গণিত বইটা বের করো। গণিত দিয়েই শুরু করি।’
.
.
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল মিথি। মন ভালো নেই। চায়ের কাপে চুমুক দিতেই তার চোখ যায় তাদের বরাবর বিল্ডিং এর পাঁচতলার ফ্লোরের বারান্দাটার দিকে। একটা দোলনায় বসে কেউ একজন টুংটাং গিটারের সুর তুলছে। মিথি চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে সেই মানুষটার মুখটা দেখার চেষ্টা করলো। কিছুটা সময় নিলেও মিথি চেনে ফেলল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে মিথির বুকটা কেঁপে উঠল। সে চিৎকার দিয়ে ডেকে উঠল,

‘সিফাত!’

সেই মানুষটার কানে মিথির সুর পৌঁছাল না। মিথি এবার আরও কিছুটা জোরে ডেকে উঠল,

‘সিফাত! এই সিফাত!’

শুনলো না সিফাত। গিটারটা বারান্দার দোলনাটায় রেখে সিফাত ভেতরে চলে গেল। মিথির মনে ধাক্কা খেল। মনে হলো সিফাত যেন তাকে ইচ্ছে করে ইগনোর করছে। মিথি চায়ের কাপ রেখে ছুটে গেল তার মায়ের কাছে। বিচলিত হয়ে বললো,

‘আম্মু, জানো আমাদের পাশের বিল্ডিং এর পাঁচ তলার বারান্দায় আজ আমি সিফাতকে দেখেছি।’

আমিরা বেগম ব্রু কুঁচকি অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললেন,

‘কি? সিফাতকে তুই কই থেকে দেখবি? ও দেশে আছে নাকি? ও না কানাডা?’

মিথি অস্থির হয়ে উঠল। হাত কচলাতে কচলাতে বললো,

‘না আম্মু। তুমি বুঝতে চাইছো না কেন? আমি দেখেছি সিফাতকে। ওর সেই গিটারটাও আছে। প্লীজ আম্মু, তুমি চল না আমার সাথে। ঐ বিল্ডিং এ গিয়ে একবার দেখে আসি ও সিফাত কিনা? আমার মন বলছে আম্মু, ঐ সিফাত। প্লীজ চলো আম্মু।’

মেয়ের অস্থিরতা দেখে আমিরা বেগম আর বসে থাকতে পারলেন না। তিনি মিথিকে নিয়ে ঐ বিল্ডিং এ গেলেন। কিন্তু সেই বিল্ডিং এর মিথির দেখা ফ্ল্যাটে সিফাত নামের কেউ থাকে না। মিথির অস্থির মনটা হঠাৎ এক অজানা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। বিষন্ন মনে মাকে নিয়ে আবার বাসায় ফিরে এলো।
আজ দিনটাই ভীষণ খারাপ। সকাল থেকে শুধু খারাপই হচ্ছে। মিথি নিজের রুমে গিয়ে চোখ বুজে শুয়ে পড়ল। দৃশ্যপটে ভেসে উঠল সেই সোনালি দিনগুলো।
মিথি তখন এইট পাশ করে নাইনে গিয়ে ভর্তি হয় নতুন এক স্কুলে। সেই স্কুলেই তার পরিচয় হয় সিফাতের সাথে। ভীষণ রকম শান্ত একটা ছেলে সে। একদিকে মিথি ছিল উড়নচন্ডালি অন্যদিকে সে ছিল শ্রান্ত নদী। মিথির জীবনের প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড, ‘সিফাত’। যাকে আজ জীবন থেকে হারিয়ে সে আফসোস করছে। প্রচন্ড আফসোস। হয়তো বাকিটা জীবনও তাকে এইভাবেই আফসোস করে বাকিটা পাড় করতে হবে।

মিথির চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল উষ্ণ জল। মিথি জোরে শ্বাস টেনে সেই জলটা মুছে নিল।

______________________

‘ভাই, আসবো?’

‘হুম, আয়।’

‘ভাই, একটা কথা বলার ছিল তোর সাথে!’

নৈরিথ ফাইলগুলো বন্ধ করে নেহাকে বললো,

‘কি বলবি বল?’

নেহা কাঁচুমাঁচু করতে করতে বললো,

‘ভাই, মিথিকে কি সত্যিই আর পড়াবি না?’

নেহা ভাবল নৈরিথ বোধ হয় আবারও রেগে যাবে। কিন্তু নৈরিথ এবার রাগেনি। সে প্রসন্ন হেসে বললো,

‘না। শুধু মিথি না, আমি আমার বাকি টিউশনিগুলোও বন্ধ করে দিব।’

নেহা খানিক অবাক হয়ে বললো,

‘কেন? তুমি কি জব পেয়ে গিয়েছো?’

নৈরিথ হেসে জবাব দিল,

‘হুম। একটা মাল্টিকম্পানিতে জব পেয়েছি। এসিসটেন্ট ম্যানেজার। কাল উনারা ডেকেছে। আল্লাহ চাইলে এবারের জবটা হয়ে যাবে।’

নেহা খুশি হলো। অনেক কষ্ট করেছে নৈরিথ একটা চাকরির জন্য। এত এত পরিশ্রমের পরে অবশেষে সে পেরেছে। নেহা ভীষণ খুশি খুশি গলায় বললো,

‘দাঁড়াও মাকে গিয়ে বলে আসি।’

নৈরিথ তাচ্ছিল্যের সুরে দিয়ে বললো,

‘মা কি আর এই খবর শুনলে খুশি হবে নেহা? উনার তো বরং কষ্ট লাগবে। আমি উনার স্বামীর ব্যবসায় না গিয়ে নিজে জব করছি এই খবরটা তো নিঃসন্দেহে উনার জন্য খুব খারাপ একটা খবর।’

নেহা কোনো জবাব দিতে পারল না। মুখের হাসির রেশটা কেটে গেল। মৃদু সুরে বললো,

‘আচ্ছা, আমি আমার রুমে গেলাম।’

‘ঠিক আছে যা। আর শোন, মিথিকেও খবরটা দিয়ে দিস।’

নেহা মাথা হেলিয়ে বললো,

‘ঠিক আছে।’
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
৫.
~
বিকেলে ঘুমিয়েছিল মিথি। এখন রাত আটটা বাজে, তার ঘুম এখনও ভাঙেনি। আমিরা বেগমের মনের অবস্থাও আজ ভালো নেই। মিথি যে এখনও সিফাতকে অনেক বেশি মিস করে সেটা তার আর বুঝতে বাকি রইল না। বন্ধু হারিয়ে গেলেও বন্ধুত্ব কখনও হারিয়ে যায় না। সেই বন্ধুত্বের জোরেই একবার হলেও ফিরে আসুক সিফাত। মনে প্রাণে সেটাই চান আমিরা বেগম। কি জানি তার এই চাওয়া আদৌ কখনও পূরণ হবে কিনা?

মিথি চোখ খুলে দেখল মাহি তার মাথার উপর বসা। ছেলেটা কেমন ড্যাব ড্যাব করে ওর দিকে চেয়ে আছে। মিথি বড় একটা হাই তুলে উঠে বসলো। বললো,

‘কিরে এমন করে তাকিয়ে কি দেখছিস?’

মাহি সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

‘বুবু, তুমি বেঁচে আছো? যেভাবে মরার মতো পড়েছিলে, আমি তো ভেবেছিলাম তুমি বোধ হয় ইনলিল্লাহ করেছো। কি খুশিটাই না হয়েছিলাম!’

মিথি রাগি চোখে মাহির দিকে তাকাল, বললো,

‘খুব খুশি না? আমি মরলে খুব খুশি হবি? ঠিক আছে, আমিও দেখবো তখন কে তোকে এত্তগুলো চকলেট কিনে দেয়। কে তোকে আম্মুর মার খাওয়া থেকে বাঁচায়। আর…আর পাড়ার তোর ঐ বন্ধুগুলো আছে না ওদের সাথে ঝগড়া লাগলে কে তোর সাপোর্ট করে সেটা আমিও দেখে নিব,হু।’

মিথি গাল ফুলিয়ে বসল। মাহি বাচ্চাদের মতো মুখ করে বললো,

‘বুবু, তুমি সত্যি সত্যি রাগ করেছো? আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম তোমার সাথে। রাগ করো না বুবু। আমি তো তোমায় এত্তগুলা ভালোবাসি।’

কথাটা বলে মাহি মিথিকে জড়িয়ে ধরে। ফিক করে হেসে দেয় মিথি। ভাইকে বুকে জড়িয়ে কপালে চুমু খায়। মাহি তখন কাঁদো কাঁদো মুখে বলে,

‘বুবু, আমার স্কুল থেকে অনেকগুলো ম্যাথ দিয়েছে। আমি না ঐগুলো পারছি না, আমাকে একটু ঐগুলো করিয়ে দিবে?’

মিথি হেসে জবাব দিল। বললো,

‘ঠিক আছে, তুই খাতা বই নিয়ে আয় আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
.

হাইয়ার ম্যাথের জটিল অংকগুলো মিথির মাথায় কোনোমতেই ঢোকে না। বেচারি হাঁপিয়ে উঠেছে অংক করতে করতে তাও যদি কিছু শেষ হতো। যতই করছে ততই যেন কঠিন থেকে আরো কঠিনতর হচ্ছে। কোন দুঃখে যে সে ইন্টারে এসে আবারও সাইন্স নিয়েছিল তা এক আল্লাহই জানে। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা বোধ হয় এটাকেই বলে।

মিথি একটা অংক করতে গিয়ে আটকে গেল। অন্যদিন হলে এতক্ষণে সে নৈরিথকে কল দিয়ে বসতো। অংক বোঝার উছিলায় একটু কথাও বলা হয়ে যেত। আজ আর কল দিল না সে। নিজে নিজে যখন চেষ্টা করে পারল না তখন গাইড খুলে বসলো। নিজের মনকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু কতক্ষণ? কতক্ষণ পারবে নিজেকে সংযত রাখবে? যদি হেরে যায়, মনের সাথে যুদ্ধ করে যদি সে আর না পারে তাহলেই তো মন আবার নৈরিথের জন্য উতলা হয়ে উঠবে। যেটা সে আর চায় না। কষ্ট হলেও পারতে হবে তাকে। নৈরিথ তাকে ভালোবাসে না আর কখনও বাসবেও না, এই অপ্রিয় বাস্তবটাকেই তার মেনে নিতে হবে।

কিছুক্ষণ থম মেরে বসে মিথি আবারও তার অংকে মনোযোগ দিল। দুইটা অংক করতেই তার ফোনটা বেজে উঠল। নেহা কল করছে। মিথি কলটা রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে নেহা বলে উঠল,

‘দোস্ত, একটা গুড নিউজ আছে।’

উদ্বেগহীন কন্ঠে মিথি বললো,

‘কি?’

নেহা উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো,

‘নৈরিথ ভাই চাকরি পেয়ে গেছে, মিথি।’

হঠাৎ করে মিথিও খুশি হয়ে গেল। নিমিষেই যেন তরতাজা হয়ে উঠল তার প্রাণ। খুশিতে ঝুমঝুম করে উঠল সে। বললো,

‘সত্যি? নৈরিথ চাকরি পেয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ সত্যি। একটা মাল্টিকম্পানিতে জব পেয়েছে এসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।’

নেহা তখন কিছুটা গম্ভীর সুরে বললো,

‘ভাই চাকরি পেয়ে গেছে মিথি। এখন কিন্তু ভাই আর তার কোনো টিউশনিই করাবে না।’

মিথি আলতো হাসল। ক্ষীণ সুরে বললো,

‘জানি তো। এতদিন চাকরি পাচ্ছিলেন না বলেই তো উনি টিউশনি করিয়েছিলেন। এখন চাকরি পেয়ে গেছেন। এখন আর টিউশনি করিয়ে কি হবে। আর আমিও নতুন টিচার পেয়ে গেছি। রাদিত স্যারের কাছেই পড়ছি। উনি বেশ ভালোই পড়ান।’

হুট করে মিথির কথার পিঠে বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না নেহা। এত এত ভাবার পরও কিছু পাচ্ছে না। পৃথিবীর সব কথা কি আজ করে ফুরিয়ে গেল নাকি? কোনো কথা কেন খুঁজে পাচ্ছে না সে? দুজনেই চুপ। এই নিরবতা যেন অনেক কিছুই বলছে কেবল শুনতে পাচ্ছে না তারা। কিছু ভাবতে ভাবতে নেহা বলে উঠল,

‘দোস্ত!’

ওপাশ থেকে মৃদু সুর ভেসে এলো,

‘হুম বল।’

‘আজ কলেজ ছুটির পর কি তুই সত্যি সত্যিই কেঁদেছিলি?’

মিথি হেয়ালির সুরে বললো,

‘তোর কি মনে হয়?’

অস্থির কন্ঠে নেহা বললো,

‘বল না প্লীজ!’

মিথি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

‘হয়তো এক্টিং ছিল।’

নেহা বললো,

‘মিথ্যে বলছিস কেন?’

মিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

‘সত্যি বললে যে তুই বিশ্বাস করবি না, তাই।’

নেহা খানিক চুপ থেকে বললো,

‘মার সাথে কি আমি তোর ব্যাপারে কথা বলবো?’

মিথি হেসে বললো,

‘তোর ভাই আদৌ তোর মার কথা শোনে নেহা? কি দরকার এসবের মাঝে আন্টিকে আনার? তার চেয়ে সবকিছু যেভাবে আছে ওভাবেই থাকতে দে। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস।’

আর বেশিক্ষণ কথা হলো না তাদের। কলটা কেটে দিয়ে মিথি আবার তার পড়াশোনায় মনোযোগ দিল।
.
.
ঘড়ির ঘন্টার কাটাটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। প্লেটটা নিয়ে খাবার টেবিলে বসেছে নৈরিথ। গরম গরম ভাতের সাথে একটা ডিম ভেজে এনেছে সে। নৈরিথ দু লোকমা ভাত মুখে তুলতেই তার মা এসে বসলো তার পাশের চেয়ারটায়। ভদ্র মহিলার মুখপানে একবার চাওয়ারও কোনোরূপ প্রয়োজন বোধ করলো না নৈরিথ। খাবার খাওয়াই যেন এখন তার সব থেকে বড়ো কাজ। নৈরিথের মা মাংসের বাটি থেকে দুই টুকরো মাংস নৈরিথের প্লেটে দিতেই সে মানুষটার দিকে তাকাল। চোয়াল শক্ত করে ফেলল সে। বললো,

‘আমি নিজের খাবার নিজে নিয়েই খেতে পারি। কাউকে কষ্ট করে বেড়ে খাওয়াতে হবে না।’

কথাটা বলেই নৈরিথ উঠে যেতে লাগল। পেছন থেকে এক বুক আকুতি নিয়ে লাভলী হাসনাত তাকে ডেকে উঠলেন। মায়ের এই আকুতি ভরা কন্ঠে থেমে গেল নৈরিথের পদযুগল। ঈগল চোখে মায়ের দিকে ফিরে তাকাল সে। লাভলী হাসনাত এগিয়ে গেলেন নৈরিথের দিকে। মোলায়েম কন্ঠে বললেন,

‘বাবা, তুই নাকি চাকরি পেয়েছিস? শুনে আমি খুব খুশি হয়েছি। তোর এত এত পরিশ্রম কাজে দিয়েছে। আমি খুব খুশি বাবা, খুব খুশি।’

নৈরিথ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

‘আপনি খুশি হয়েছেন দেখে আমারও ভালো লাগছে। তবে আপনার এই খুশিটা আদৌ মন থেকে আসছে কিনা সেটা নিয়ে অবশ্য আমার একটু সন্দেহ আছে।’

মুখের সেই অল্প বিস্তর হাসিটাও বিলিন হয়ে গেল লাভলী হাসনাতের। নৈরিথ তপ্ত শ্বাস ফেলে খাবারের প্লেটটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বরাবরের মতো আজও চোখের কোণ ভিজে উঠল লাভলী হাসনাতের। মনে মনে ভাবতে লাগল, তার ছেলে কি আর কখনও তাকে আগের মতো ভালোবাসবে না? আর কখনও কি একবার তার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না? এই রাগ, ক্ষোভ, অভিমান কবে মিটবে তার? কবে?

_________

মিথি খাবার শেষ করে তার বাবার রুমে গেল। বাবা কি যেন জরুরি কথা বলবে তার সাথে। আতাউর সাহেব তখন মাহির ঔষধগুলো বের করছিলেন। মিথিকে দেখে বললেন,

‘তোমার বাদর ভাইটা কোথায়, মিথি? ঔষধ দেখলেই সে পালায়।’

মিথি হেসে বললো,

‘দুই মিনিট দাঁড়াও বাবা। আমি ওকে এক্ষুণি ধরে আনছি।’

জোরে করে মাহিকে ধরে আনল মিথি। ঔষধ খাওয়া যেন পৃথিবীর সবথেকে কষ্টদায়ক কাজ তার জন্য। ঔষধটা মুখে পুরার পর মুখের এমন সব ভঙ্গিমা করে সে যা দেখে মিথি হাসতে হাসতে কুপোকাত হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম ঘটল না। মিথি হাসতে হাসতে বললো,

‘বাবা, তোমার ছেলের ফেইসটা দেখো। যেন ঔষধ না ওকে কেউ বিষ খাওয়াচ্ছে।’

মাহি তেতে উঠে বলে,

‘এএ তুমি খেলে বুঝতে। এটা বিষের চেয়ে কম কিছু না।’

মিথি ভেংচি কেটে কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আতাউর সাহেব বললেন,

‘মিথি, তুমি বাবাকে একটা সত্যি কথা বলবে?’

কথার এহেন ভঙ্গিমায় অবাক না হয়ে পারলো না মিথি। বললো,

‘কি কথা বাবা?’

আতাউর সাহেব কিছুটা সময় নিয়ে বললেন,

চলবে..
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here