তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব -১০+১১

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১০.
~
রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে নৈরিথ। আকাশের গায়ে ছোট ছোট তারাগুলো তার ভীষণ প্রিয়। নৈরিথ তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অতীতের খারাপ কিছু সময়ের কথা মনে পড়ে তার। নৈরিথ ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারেনা। সারাদিন কিছু মনে না পড়লেও রাত হলেই যেন এই অতীতের যন্ত্রণাগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করা শুরু করে।
সেই ছোট্টবেলা থেকে মা বাবার ঝগড়া অশান্তি দেখে বড় হয়েছে সে। একটা মানসিক অশান্তি তার সবসময় ছিল। তারপর তার মা বাবার বিচ্ছেদও সে মেনে নিতে পারেনি। বাবার জেলে যাওয়া নৈরিথের জন্য সবচেয়ে কষ্টদায়ক ব্যাপার ছিল। সেদিন খুব কেঁদেছিল সে। মা বাবা দুজনকেই ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু আজ..আজ তার মন বিষিয়ে উঠেছে। ভালোবাসার ছিটেফোটাও যেন নেই এই মনে। যেখানে প্রত্যেকটা বাচ্চার শৈশব কাটে তার মা বাবার ভালোবাসা আর আদরে সেখানে তার শৈশব কেটেছে শুধু চোখের জল ফেলে। নৈরিথ কিছু ভুলতে পারে না। পুরোনো স্মৃতিগুলো তাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠে সে। আর কত..কবে ঘটবে তার এই কষ্টের অবসান?

নৈরিথের নিষ্প্রাণ চোখে চেয়ে থাকে। যেন কোনো অনুভূতিই তার কাজ করছে না। নিরব, নিস্তব্ধ পরিবেশের মাঝে ঢিপঢিপ করে কেবল তার বক্ষ পিঞ্জরের কম্পনের ধ্বনিই শোনা যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর রুমে গিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বিছানার এক কোণে বসল। মোবাইলের গ্যালারি ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল একটা ছবির দিকে। সেদিন নেহার জন্মদিন ছিল। মিথিও এসেছিল একটা নীল সাদা রঙ মিশ্রণের শাড়ি পরে। সেদিনই প্রথম মিথির সাথে পরিচয় হয়েছিল নৈরিথের। প্রথম দেখাতেই নৈরিথ বুঝেছিল এই মেয়ে কি পরিমাণ চঞ্চল। প্রথম দেখায় কেউ কাউকে এত এত প্রশ্ন করতে পারে, সেটা নৈরিথের জানা ছিল না। সেদিন মিথির কারি কারি প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে নৈরিথ হাঁপিয়ে উঠেছিল। এই ছবিটা তোলা হয়েছিল একদম শেষ মুহূর্তে। যদিও মিথি এক প্রকার জোরেই নিজেকে এই ফ্রেমে আটকিয়েছে। ছবিটা আজ অনেকদিন পর দেখল নৈরিথ। মুচকি হাসল সে। অনেকক্ষণ মিথির মুখটার দিকে চেয়ে রইল। মেয়েটার হাসি ভীষণ মিষ্টি। কিছু থেকে কিছু হলেই হাসতে হাসতে মরে যায়। এত হাসি কোথা থেকে আসে ওর? মাঝে মধ্যে এই কথা ভেবেই উত্তর পায় না নৈরিথ। শুনেছে প্রচন্ড কষ্টে থাকা মানুষগুলো নাকি খুব হাসে। তাহলে কি মিথির মনেও কোনো কষ্ট আছে? যেই কষ্টকে আড়াল করার জন্য সবসময় তার মুখে এই হাসি লেগেই থাকে। নৈরিথ বুঝে উঠতে পারল না। হঠাৎ কি ভেবেই সে মিথিকে কল দিয়ে বসে। দুইটা রিং হওয়ার পরই তার স্নায়ু কোষগুলো জেগে উঠে। মস্তিষ্ক তাকে ধমকে উঠে বলে, ‘কি করলি তুই? মাথা খারাপ? এত রাতে কেউ কাউকে কল দেয়? মেয়েটা তোকে নিয়ে কি ভাববে বল তো? স্টুপিড একটা!’

নৈরিথ কলটা কেটে দিয়ে সটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কল দিয়ে কি আসলেই সে ভুল করে ফেলেছে? উচিত হয়নি কল দেয়া তাই না? উফফ, নিজের ইমোশনটা এখনও কন্ট্রোল করতে শিখল না সে।

ফোনটা বেজে উঠে নৈরিথের। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে সে। মোবাইলের দিকে বিরক্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ঠিক করে নেয় কলটা রিসিভ করেই মেয়েটা কিছু ধমক দিবে। এত রাত হয়েছে এখনও ঘুমায় নি কেন? জেগে জেগে কি করে সে?

যেই ভাবা সেই কাজ। কল রিসিভ করেই ধমক দিয়ে উঠে সে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় মিথি। নৈরিথ কি তাকে এত রাতে ধমকানোর জন্য কল দিয়েছে? যদি এমনটা হয় তবে মিথিও আজকে ছাড়বে না। মুখ তারও আছে। ধমক সেও দিতে পারে। মিথি সশব্দে বলে উঠে,

‘সমস্যা কি স্যার? একে তো এত রাতে কল দিয়েছেন, তার উপর এখন আবার আমাকে ধমকাচ্ছেন? কি হয়েছে আপনার?’

থ মেরে গেল নৈরিথ। লজ্জায় মরে যাওয়া বলে একটা কথা আছে না। এখন তার তাই করতে ইচ্ছে করছে। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে। নৈরিথ আমতা আমতা করে বললো,

‘ভ-ভুলে কল গিয়েছে।’

মিথি বিরক্ত হলো। চরম মাত্রায় বিরক্ত। সে বললো,

‘ভুলে যখন কল এসেছে, তাহলে কল দিয়ে আমার উপর কেন চিল্লাচ্ছেন? আপনি কল দিয়েছিলেন বলেই তো আমি কল ব্যাক করেছি।’

নিজের উপর নিজেরই উপরই ভীষণ রাগ হচ্ছে নৈরিথের। কি দরকার ছিল..কি দরকার ছিল, এই মেয়েটাকে কল দেওয়ার? এখন যে এই মেয়ে তোকে এক কথা শোনাতে শোনাতে তোর ইজ্জতের ফালুদা বানাবে সেটা ভাল লাগবে? শুধু তো এই মেয়ে না, সকাল হতে না হতেই এই কথা তোর বোনের কান অবধি পৌঁছে যাবে। তারপর যে সে তোকে জ্বালিয়ে খাবে, তখন..তখন কি করবে তুই? এই জন্যই কবি বলে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ নৈরিথের ভাবনার সুতো কাটল মিথির প্রশ্নে,

‘আচ্ছা স্যার, সত্যি করে একটা কথা বলুন তো; আপনি কি আমাকে মিস টিস করছিলেন নাকি?’

নৈরিথের এবার শক্ত গলায় জবাব দেয়,

‘আজে বাজে কথা বলো না তো? আমি কেন শুধু শুধু তোমাকে মিস করতে যাবো। ভুলে তো কল যেতেই পারে, তাই না? আর যদি এতই তোমার সাথে কথা বলার ইচ্ছে থাকতো, তবে কি আমি তোমায় মিসড কল দিতাম? ডিরেক্ট কলই দিতাম। তাই এসব আকাশ কুসুম চিন্তা করা বন্ধ করে ঘুমাও। রাখছি।’

‘এক মিনিট, এক মিনিট।’

নৈরিথ বিরক্তির সুরে বলে,

‘কি?’

‘আপনার সাথে কি আজ রাদিত স্যারের কথা হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ, হয়েছিল তো। কেন?’

মিথি কৌতূহল সহিত প্রশ্ন করলো,

‘রাদিত স্যার আপনাকে কিভাবে চিনে?’

‘চিনবে না কেন? নেহার ভাই হিসেবে উনার সাথে আমার প্রায়ই কথা হতো। নেহাকে নিয়ে যেদিন প্রথম কলেজে গিয়েছিলাম, সেদিন উনার সাথেই প্রথম পরিচয় হয়েছিল।’

মিথি বললো,

‘ওহহ, আপনারা আগেই পরিচিত। তবে রাদিত স্যারের কথা শুনে মনে হয়েছে যেন আজই প্রথম আপনার সাথে উনার কথা হয়েছে।’

‘আচ্ছা, বাদ দাও সেসব। এখন আসল কথা বলো, পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে তোমার? ফাঁকিবাজি কিছু কমেছে, নাকি আগের থেকে বেড়েছে, কোনটা?’

মিথি মুখ কালো করে বলে,

‘এই বেটা যে চিল্লানো চিল্লায়, ফাঁকিবাজি করতে পারি না।’

নৈরিথ হেসে বললো,

‘বেশ হয়েছে। এবার যদি কিছু ফাঁকিবাজি কমে।’

মিথি ভেংচি কেটে বললো,

‘হুম, শুধু উনি কলেজের স্যার বলে কিছু বলতে পারিনা। আপনি হলে তো জীবনেও আমি আপনার কথা শুনতাম না।’

‘সেটা আমিও জানি। যাকগে সেসব, ভালোভাবে পড়। এইচ এস সি তে পাশ করতে হবে। না হলে কিন্তু মা বাবার মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে। তাই মা বাবার কথা চিন্তা করে হলেও পড়াশোনায় মন দাও, কেমন।’

মিথি সরস গলায় বললো,

‘ঠিক আছে।’

নৈরিথ মৃদু সুরে বললো,

‘আচ্ছা, রাখছি তাহলে।’

মিথি বাঁধা দিয়ে বললো,

‘দাঁড়ান, দাঁড়ান।’

‘আবার কি?’

মিথি স্মিত হেসে বললো,

‘আপনার অফিস কেমন যাচ্ছে।’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।’

‘আচ্ছা আপনার অফিসটা কোথায় বলুন তো?’

নৈরিথ ব্রু কুঁচকে বললো,

‘কেন? অফিসের ঠিকানা জেনে কি করবে?’

মিথি হেসে বললো,

‘একদিন হুট করেই গিয়ে আপনাকে সারপ্রাইজ দিব।’

‘তাহলে ঘুণাক্ষরে তোমাকে অফিসের ঠিকানা দেওয়া যাবে না। তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে সত্যি সত্যিই কোনোদিন আমার অফিসে চলে আসবে।’

মিথি তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,

‘হু, যান লাগবে না বলা। যেন উনি না বললে আমি জানতে পারবো না। আমি দুই মিনিটে আপনার অফিসের ঠিকানা বের করে ফেলতে পারবো। সেই ক্ষমতা আমার আছে, বুঝেছেন?’

নৈরিথ বাঁকা হেসে বললো,

‘ওকে বের করতে পারলে করো। আমার কোনো আপত্তি নেই। রাখছি, গুড নাইট।’

কলটা কেটে দিয়ে মিথি বিছানায় শুলো। আহ, আজকের নাইটটা সত্যিই ভীষণ গুড। একেবারে ভেরি ভেরি গুড। পাশের কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে মিথি।

এতক্ষণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবকিছু কেউ একজন পর্যবেক্ষণ করেছেন। মনের সন্দেহটা যেন তার তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। না আর না..আর সময় নষ্ট করা যাবে না। কালই কথা বলতে হবে। খুব তাড়াতাড়িই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলতে হবে। নয়তো পরে বসে বসে তাকে আফসোস করতে হবে..#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১১.
~
বাইরে কাঠফাটা রোদ্দুর। দিবাকরের তেজ যেন কেবল ক্ষণে ক্ষণে বেড়েই চলছে। শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে যেন ধাপিয়ে চলছে উত্তাপ। উফ, এত গরম কেন? গ্রীষ্মের শেষে কবে বর্ষা আসবে? কবে পাবে প্রকৃতি এক ফোটা শীতলতা? চৈত্রের তান্ডবে তো হাঁপিয়ে উঠেছে সবকিছু। মাথার উপর ফ্যানটাও কোনো কাজের না। এটা ভো ভো করে ঘোরার সত্বেও মিথি ঘেমে চলছে। তার শরীরের সমস্ত পানি কি আজ প্রতিযোগীতায় নেমেছে নাকি যে কে কার আগে বের হতে পারে? উদ্ভুত, আজ কি আশেপাশের কোথাও লাভা বিস্ফোরণ হয়েছে নাকি? এত গরম কেন? মিথি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। তার পাশে বসে থাকা তার ভাইয়ের মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। ছেলেটা সেই কখন থেকে ঘাপটি মেরে এখানে বসে আছে। মিথি কপাল কুঁচকালো। মাহির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কন্ঠে বললো,

‘তোর কি গরম লাগছে না?’

মাহি স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

‘না তো। মাথার উপর তো ফ্যান ঘুরছেই তাহলে গরম কিসের?’

মাহির উত্তর শুনে মিথির রাগ হলো। যেন গরম না লাগাটা পৃথিবীর সবথেকে বড় অপরাধ। কেন গরম লাগবে না? অবশ্যই লাগতে হবে। যেহেতু তার গরম লাগছে, এখন তার সাথে পুরো পৃথিবীর মানুষের গরম লাগতে হবে। না লাগলেও জোর করে হলেও লাগাতে হবে। মিথি ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। মাহি পড়ার বইটা বন্ধ করে বললো,

‘বুবু, কি হয়েছে তোমার? মা তোমাকে কি বলেছে? যেটা শোনার পর থেকেই তুমি কেমন যেন করছো?’

মিথির এতক্ষণে মনে পড়েছে। আসলে তার গরম লাগছে না, তার রাগ হচ্ছে। ভীষণ রাগ। একদম হার কাঁপাকাঁপি রাগ। যেই রাগে সে রীতিমত অস্থির। তার মা তাকে এই কথাগুলো কিভাবে বলতে পারলো। আর রাদিত, তাকে তো সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না। মিথি রাগে হাত কঁচলাতে থাকে। রুমের মধ্যে অস্থির হয়ে পায়চারি করতে থাকে। মাহি বোকা বোকা চোখে বোনের কার্যকলাপ গুলো দেখতে থাকে। তার ছোট্ট মাথাটাও এখন টেনশনে ভরে গিয়েছে। সে মিথিকে আবারও বললো,

‘বুবু, বলোনা কি হয়েছে তোমার?’

মিথি জোরে একটা নিশ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর মাহির পাশে বিছানায় বসলো। দুঃখি দুঃখি গলায় বললো,

‘মা আমাকে রাদিত স্যারের সাথে বিয়ে দিতে চায় মাহি।’

‘কিহহহ!’

ভাইয়ের হঠাৎ এমন চিৎকার শুনে মিথি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। সে বুকে থু থু দিয়ে বলে,

‘এত জোরে চিৎকার দিয়েছিস কেন? স্টার জলসার শ্বাশুরি মারাও তোর থেকে আস্তে চিৎকার দেয়।’

মাহি অস্থির হয়ে বোনের দুহাত ঝাঁকিয়ে বললো,

‘মানে কি বলছো বুবু? তোমার বিয়ের কথা বলছো আর আমি চিৎকার দিব না? মা তোমাকে বিয়ে কেন দিতে চাইছে? তুমি আবার কি দুষ্টামি করেছো বলতো?’

ছেলেটা চোখে পানি চলে এলো। বোনের বিয়ে হলেই সে তাকে ছেড়ে চলে যাবে, এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। ভাবলেই কেঁদে ফেলে সে।

মিথি মাহিকে জড়িয়ে ধরলো। মাহি বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে এবার কেঁদেই ফেলল। মিথি হতভম্ব! ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তুই কাঁদছিস কেন ভাই?’

মাহি নাক টানতে টানতে বললো,

‘তোমার বিয়ে হলে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। আমি তখন কিভাবে থাকবো? তোমাকে খুব মিস করবো তো। আমার তো এখনই এত কান্না পাচ্ছে। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না বুবু। তুমি বিয়ে করো না, প্লীজ।’

মিথিও ইমোশনাল হয়ে পড়ে। চোখের কোণে পানি জমে তার। তার ভাইটা যে তাকে এত ভালোবাসে সেটা তার জানা ছিল না। মিথি মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

‘এই বোকা! কাঁদছিস কেন? আমার বিয়ে হতে এখনও অনেক দেরি। তুই বড়ো হওয়ার পর আমি বিয়ে করবো। যেন আমার বিয়ের সব কাজ আমি তোকে দিয়ে করাতে পারি।’

মাহি মাথা তুলে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো,

‘তাহলে মা কেন তোমার বিয়ের কথা বলছে? মা কি এখনই তোমার বিয়ে দিয়ে দিবে?’

মিথি হেসে বললো,

‘আরে না। ওটা তো মা আমার সাথে রাগ করে বলেছে। এখন কান্না বন্ধ কর। আর পড় সামনে না তোর পরীক্ষা, প্রাইমারি লেবেল শেষ করে হাইস্কুলে উঠবি। ভালো একটা রেজাল্ট করে তো উঠতে হবে নাকি?’

মাহি হাসলো। বললো,

‘আচ্ছা, পড়ছি।’

মিথি মুচকি হেসে মাহির কপালে চুমু খেল। বাচ্চাটার ভালোবাসায় আপ্লুত সে। সেও ভীষণ ভালোবাসে তার এই জান বাচ্চাটাকে। প্রতিটা মোনাজাতে তার সুস্থতা কামনা করে। তার ভাইটা আবার আগের মতো সুস্থ হয়ে উঠুক, আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠুক এটাই তার একমাত্র চাওয়া।
.
.
‘মা, আমি রাদিত স্যারকে বিয়ে করতে পারবো না।’

‘কেন পারবি না? কি সমস্যা তোর?’

মিথি অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাল। আমিরা বেগম রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন। তিনি সশব্দে বলে উঠলেন,

‘কি রে বল, কি সমস্যা? কেন তুই রাদিতকে বিয়ে করবি না?’

মিথি রাগ দেখিয়ে বললো,

‘উনি আমার স্যার, তাই।’

আমিরা বেগম শক্ত গলায় বললেন,

‘স্যার হয়েছে তো কি হয়েছে? স্যারকে বিয়ে করা যাবে না এটা কোন আইনে লেখা আছে?’

মিথি অসহায় হয়ে পড়ল। গুছিয়ে বলার মতো কিছু কথাও খুঁজে পাচ্ছে না। বাবা বাসায় থাকলে তাকে সাপোর্ট করতে পারতো। কিন্তু বাবাও এখন অফিসে। মিথি কথা ঘুরানোর জন্য বললো,

‘মা, তোমার জন্য আমার প্রথম ক্লাসটা মিস গিয়েছে। এখন আমি কলেজে যাবো। সামনে পরীক্ষা এখন কলেজের ক্লাসগুলো খুব ইম্পোরটেন্ট।’

‘কোত্থাও যাবে না তুমি।’

মায়ের হঠাৎ চিৎকারে খানিক কেঁপে উঠে মিথি। মাথা নুইয়ে ফেলে ভয়ে। আমিরা বেগম প্রচন্ড রেগে গেছেন। তিনি চেঁচিয়ে উঠে বললেন,

‘নৈরিথের সাথে কি সম্পর্ক তোমার?’

মিথি চমকে উঠে মার দিকে তাকায়। মায়ের চোখমুখ ভয়ানক লাল হয়ে আছে। ভয়ে বুকের কম্পন বেড়ে গিয়েছে তার। মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। তাও কষ্ট করে বললো,

‘কক-কোনো সম্পর্ক ন-নেই মা।’

আমিরা বেগম তেড়ে আসলেন মেয়ের দিকে। মিথি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এই বুঝি তার গালে এক দানবীয় চড় পড়ল বলে। কিন্তু আমিরা বেগম নিজেকে কন্ট্রোল করলেন। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে তিনি সোফার এক কোণে গিয়ে বসলেন। মিথি ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকাল। তিনি যেন হাঁপাচ্ছেন। মিথি বিচলিত হয়ে মায়ের পায়ের সামনে বসে পড়ল। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,

‘তুমি এত অস্থির হইও না মা। তোমার হাই প্রেশার। ডক্টর বারণ করেছে তো।’

‘কি হয়েছে তাতে? তোমার কিছু আসে যায়? আমি বাঁচি কি মরি, তাতে তোমার কিচ্ছু আসে যায় না। তুমি এমনটা কি করে করলে মিথি? তোমাকে আমি বিশ্বাস করেছিলাম। আর তুমি আমার বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিলে? আর এখন আমাকে শান্ত হতে বলছো? হাই প্রেশার আমার, হোক হাই প্রেশার। হাই প্রেশারে স্ট্রোক করে মরে গেলেই ভালো। তাতেই তুমি শান্তি।’

মিথি কেঁদে ফেলল। জোরে জোরে কাঁদতে লাগল সে। বললো,

‘মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমি এসব কি বলছো? তুমি মরে গেলে আমার কি হবে? বাবা আর মাহির কি হবে? তুমি আমাদের প্রাণ মা। প্লীজ আর এসব কথা বলো না।’

আমিরা বেগম খুব কষ্টে অক্ষিকোটরের নোনতা জলকে আটকালেন গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া থেকে। তিনি অনেকক্ষণ থম মেরে বসে রইলেন। মিথিও ঠাই বসে রইল তার পায়ের সামনে। চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে তার।

বেশ কিছু সময়ের পর আমিরা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন,

‘মাকে ভালোবাসো তো তাই না?’

মিথি কাঁদো কাঁদো মুখে মাথা নাড়াল। আমিরা বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে তখন বললেন,

‘তবে মায়ের কথাও শুনতে হবে তোমাকে। রাদিতকেই বিয়ে করতে হবে তোমার।’

মিথি নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইল মায়ের দিকে। মায়ের মুখের কাঠিন্য ভাবই বলে দিচ্ছে তিনি তার সিদ্ধান্তে কতটা অটুট। অনেকক্ষণ মিথি ওভাবেই বসে রইল। এক পর্যায়ে আমিরা বেগমই উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরে। কষ্ট উনিও পাচ্ছেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে, মেয়েদের সুখের জন্য মায়েদের একটু কঠোর হতেই হয়। তাই মেয়ের সুখের তাগিদে তিনিও কঠোর হবেন। তাতে যদি মেয়ে তাকে ভুল বুঝে তবে বুঝুক। তাতে তার কোনো আপত্তি নেই।

চলবে..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here