#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৩.
~
পরদিন কলেজে গিয়েই দেখল নেহা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মিথি আস্তে করে গিয়ে তার পাশে বসলো। মিথির উপস্থিতি টের পেয়ে নেহা নাক ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। নেহার অভিমানের কারণ মিথি জানে। সে পেছন থেকে নেহাকে জড়িয়ে ধরলো। নেহা এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘ছুঁবি না একদম।’
মিথি নেহার কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
‘সরি বেবি।’
নেহা রাগি চোখে মিথির দিকে তাকাল। তারপর বললো,
‘তোর সরি তোর কাছেই রাখ। আমাকে বলতে আসবি না। তোর সাথে আমার কোনো কথা নেই।’
মিথি অসহায় কন্ঠে বললো,
‘দোস্ত, আগে কি হয়েছে সেটা শুনবি তো?’
নেহা চেতে বললো,
‘হ্যাঁ বল। আজকে আবার কি বাহানা দিবি? সবসময়ই তো এমন করিস। কলেজে না আসলেই তোর এটা ওটা বাহানা দেওয়া শুরু হয়ে যায়। ওসব আমার জানা আছে বুঝেছিস?’
মিথি ঠোঁট উল্টে বললো,
‘সত্যি বলছি দোস্ত। মিথ্যে না সত্যি সত্যিই একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে।’
নেহা কিছুক্ষণ রাগি রাগি চোখে মিথির দিকে চেয়ে থেকে বললো,
‘কি? কি ঘটেছে? বিয়ে হয়ে গেছে তোর? নাকি এখন একটা বাচ্চা নিয়ে এসে বলবি, “দোস্ত দেখ কাল আমার এই বাচ্চাটা পয়দা হয়েছে, তাই আমি কলেজে আসতে পারিনি।” কোনটা হু?’
মিথি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললো,
‘বাচ্চা না হলেও বিয়েটা হয়ে যাচ্ছিল।’
নেহা ব্রু কুঁচকে বললো,
‘মানে?’
মিথি এবার নেহার দিকে তাকাল। বিধ্বস্ত কন্ঠে কালকের সকল ঘটনা খুলে বললো তাকে। নেহা রীতিমতো অবাক। সে বললো,
‘রাদিত স্যারের সঙ্গে আন্টি তোকে বিয়ে দিতে চায় কেন? আমার ভাইয়ের মধ্যে কি সমস্যা?’
মিথি মন খারাপ করে বললো,
‘কি জানি, আমিও বুঝি না? রাদিত স্যার উনার বান্ধবীর ছেলে বলে উনার প্রতি মার একটু বেশিই টান। আর এই সবকিছু দুই বান্ধবী আগে থেকেই প্ল্যানিং করে রেখেছিল। রাদিত স্যারও জানতো। খালি জানতাম না কিছু আমিই।’
নেহা খানিক চুপ থেকে বললো,
‘রাদিত স্যার যে ভালো এত সহজে তোর সব কথা মেনে নিয়েছে? আমি তো ভেবেছিলাম উনি হয়তো ত্যাড়ামি করবে।’
‘উনি ভালো মানুষ। উনি বুঝেছেন জোর করে সবকিছু হয় না। আর সেটা যদি ভালোবাসা হয় সেটা তো আরো আগে না। আর বিয়েতো সারাজীবনের ব্যাপার। একটু ভুল করলে সারাটা জীবন শেষ। তাই হয়তো রিস্ক নেন নি।’
নেহা বললো,
‘হুম আমারও তাই মনে হয়। এখন আন্টিকে বোঝাতে পেরেছিস তো? নাকি এখনও উনি উনার কথায়’ই বসে আছে?’
মিথি মন খারাপ করে বললো,
‘মা আমার সাথে কথা বলছে না। তবে বাবা সাফ জানিয়ে দিয়েছে আমাকে নাকি নৈরিথের সাথেই বিয়ে দিবে। মা বাবার মুখের উপর কিছু বলেন নি। এখন বুঝতে পারছি না, আদৌ মা বাবার কথাটা মেনে নিয়েছে কি নেয়নি?’
নেহা মিথির কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে বললো,
‘টেনশন নিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে। দেখিস আন্টি ঠিক মেনে নিবে। আর এখন তো ভাইও জব করছে আগের মতো তো আর টিউশনি করায় না। আন্টিকে বুঝিয়ে বলিস। আমার মন বলছে আন্টি মেনে নিবে।’
মিথি স্মিত হেসে বললো,
‘তাই যেন হয় দোস্ত।’
________________________
সময় স্রোতের ন্যায় বয়ে গেল। দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল অনেকটা সময়। মিথির আজ এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েই মিথি নেহাকে বললো,
‘চল আজকে ফুচকা খাবো। কতদিন ফুচকা খাই না।’
নেহা খুশিতে ঝলমল করে উঠল। বললো,
‘হ্যাঁ চল।’
দুজনেই লাফাতে লাফাতে গেল ফুচকার স্টলে। মামাকে বললো ঝাল দিয়ে দু প্লেট ফুচকা দিতে। তারপর দুজন গল্প করতে লাগল। এবার কি করা যায়? পরীক্ষা তো শেষ। মিথি নেহাকে জিগ্যেস করলো,
‘কই কই ঘুরতে যাবি?’
নেহা দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘কোচিং এ। যাবি?’
ব্রু কুঁচকালো মিথি। বললো,
‘কোচিং এ মানে?’
‘মানে আর কি? আমার একমাত্র ভাইজান আমাকে অলরেডি ভার্সিটির কোচিং এ ভর্তি করে দিয়েছে, পাঁচদিন পর থেকে ক্লাস শুরু। তো এমতাবস্থায় কোচিং এ ঘুরতে যাওয়া ছাড়া আমার আর ঘুরতে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’
মিথি দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘তোর কষ্ট দেখে আমার ভালো লাগছে। আমি তো এক মাস খালি ঘুরবো আর ঘুরবো। নো পড়াশোনা। এতদিন অনেক পড়েছি। আগে এক মাস রেস্ট নিব। তারপর আবার পড়া নিয়ে ভাববো।’
নেহা ভেংচি কেটে বললো,
‘হু, যাও যাও ঘুরো। আমিই খালি বাঁশ খাবো। আমার হনুমান ভাইটার কারণে।’
মিথি বললো,
‘যাহ, এইভাবে বলিস না তো। উনি হনুমান না, উনি তো আমার সুইট, কিউট, হ্যান্ডসাম, ডেসিং একটা জামাই..ওহহ সরি হতে হতে না হতে পারা জামাই।’
নেহা হেসে বললো,
‘চিন্তা নেই। তোমার হতে হতে না হতে পারাটা জামাইটা কিছুদিন পরই তোমার পারমানেন্ট জামাই হয়ে যাবে।’
মিথি লজ্জা পাওয়ার ভান করে বললো,
‘যাহ দুষ্টু!’
নেহা নাক ফুলিয়ে বললো,
‘ঢং দেখলে বাঁচি না।’
ফুচকা খাওয়া শেষ করেই মিথি আর নেহা রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। নেহা অপেক্ষা করছে নৈরিথের জন্য। নৈরিথ তাকে আজ নিতে আসবে। মিথিও তার পাশে দাঁড়িয়ে। নৈরিথের সাথে দেখা করবে বলে। কিছুক্ষণ পর একটা কালো রঙের গাড়ি এসে রাস্তার অপর পাশে থামল। নেহা হাত নাড়িয়ে বললো,
‘ভাই, এইদিকে আমরা।’
মিথি গাড়িটা ভালো ভাবে খেয়াল করার আগেই তার ফোনটা বেজে উঠল। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখল, বাবা কল করছে। মিথি কলটা রিসিভ করলো। সামনের দিকে দৃষ্টি পড়ল তার। ফর্মাল ড্রেস আপে নৈরিথকে চমৎকার লাগছে। নৈরিথের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশ ফুটে আছে। সে এক পলক মিথির দিকে তাকাতেই মিথির চোখ মুখ কুঁচকে গেল। অস্থির হয়ে পড়ল সে, কাঁপা কাঁপা কন্ঠে ফোনের ওপাশের মানুষটাকে বললো,
‘এসব কি বলছো বাবা? কখন হলো এসব? এখন কোন হসপিটালে তুমি? আর মাহি..মাহি কেমন আছে?’
ওপাশের বাবার কন্ঠস্বর শুনে মিথি আর দাঁড়াতে পারলো না। নেহা বিচলিত হয়ে তাকে “কি হয়েছে” জিগ্যেস করতেই মিথি অস্থির হয়ে বললো,
‘মাহি হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে যেতে হবে।’
মিথি অস্থির হয়ে এদিক ওদিক রিক্সা খুঁজতে লাগল। নৈরিথ রাস্তা পার হয়ে এসেই নেহাকে মিথির এমন অস্থির হওয়ার কারণ জিগ্যেস করলো। নেহা বললো নৈরিথকে সবটা। মিথি ততক্ষণে রিক্সা না পেয়ে উল্টো পথে হাটা ধরতেই নৈরিথ তার হাত ধরে ফেলল। জিগ্যেস করলো,
‘কোথায় যাচ্ছো?’
মিথি ভয় আর অস্থিরতায় কথা বলতে পারছে না। তাও কষ্ট করে বললো,
‘এখানে রিক্সা পাবো না। সামনে থেকে রিক্সা নিতে হবে।’
নৈরিথ বললো,
‘রিক্সা নিতে হবে না। আমার গাড়িতে চলো।’
মিথি ঢোক গিলে বললো,
‘তাহলে আমাকে এক্ষুণি হসপিটালে নিয়ে চলুন। মাহির শরীর ভালো না। আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। তাড়াতাড়ি চলুন।’
মিথি নৈরিথের হাত ছাড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে রাস্তা পার হতে গিয়েছিল। সে খেয়াল করেনি। অপর পাশ থেকে একটা গাড়ি ছুটে এসে তার গায়ে লাগবে ঠিক সেই মুহূর্তেই নৈরিথ তাকে হেঁচকা টান দিয়ে পিছিয়ে নেয়। ধমক দিয়ে উঠে সে,
‘পাগল হয়েছো নাকি? এক্ষুণি তো একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেত। এত পেনিক হচ্ছো কেন? বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখা লাগে। এত অস্থির হয়ে পড়লে বিপদ কমবে না বরং বাড়বে। চলো’
নৈরিথ মিথির হাত ধরে তাকে নিয়ে রাস্তার অপর পাশে গেল। নেহাও তাদের পেছন পেছন গেল। মিথির মাথা যেন কাজ করছে না। বারবার তার কানে বাবার কান্নার শব্দগুলো ভাসছে। মাহি খুব বেশি অসুস্থ। তার আর সহ্য হচ্ছে না। পারছে না শুধু উড়ে চলে যেতে। না জানি তার ভাই এখন কোন অবস্থাতে আছে? বার বার ভাইয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে তার। মিথি চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে বসে। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে তার ভাইয়ের জন্য দোয়া করতে থাকে।
#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৪.
~
হসপিটালের দুতলায় মাহিকে এডমিট করা হয়েছে। মিথি সেখানে ছুটে গিয়েই দেখল তার মা এক কোণে থম মেরে বসে আছে। আর অন্য পাশে তার বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। মিথির বুকে মোচড় দিয়ে উঠল। সে দৌঁড়ে তার বাবার কাছে গেল। বিচলিত হয়ে বাবাকে জিগ্যেস করলো,
‘বাবা, বাবা মাহি এখন কেমন আছে? ও সুস্থ তো? ডক্টর কি বলেছে? হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়ল কেন? বাবা কি হয়েছে, বলো না?’
আতাউর সাহেব ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছেন। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,
‘মাহির অবস্থা ভালো নয়। ডক্টর বলেছে ওকে ইমিডিয়েট কিডনী ডোনেট করতে হবে। ওর দুটো কিডনীই নাকি ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।’
মিথি এবার কেঁদে ফেলল। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। আজকে সকালেও তো তার ভাই একদম সুস্থ ছিল। হঠাৎ কি হলো তার? মিথি অস্থির হয়ে মাথা চাপড়ে নিচে বসে পড়ল। নেহা এসে মিথিকে ধরে সিটে বসাল। সবাই হতভম্ব। এই মুহুর্তে কারো মস্তিষ্কই যেন কাজ করছে না। নৈরিথ এগিয়ে গিয়ে মিথির বাবার কাছে বসলো। বিনয়ের সুরে বললো,
‘আংকেল, এতদিন না মাহির ডায়লাসিস চলছিল? ও তো সুস্থই ছিল। তাহলে হঠাৎ করেই ওর দুটো কিডনীই কি করে ড্যামেজ হলো?’
আতাউর সাহেব কেঁদে উঠে বললেন,
‘আমিও বুঝতে পারছি না বাবা। কি করে কি হয়ে গেল। ছেলেটার এতদিন একটা কিডনী ড্যামেজ ছিল বলে ডক্টর বলেছিল ডায়লাইসিস করালেই হবে। কিন্তু আজ একটু আগে ও হঠাৎ করেই কোমর ব্যাথায় কাঁদতে থাকে। তাই ডক্টরের কাছে নিয়ে আসি টেস্ট করে দেখার জন্য সব ঠিক আছে কিনা? কিন্তু ডক্টর সবকিছু টেস্ট করেই বললো, ওর নাকি দুটো কিডনীই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। এখন ইমিডিয়েটলি কিডনী ট্রান্সফার না করলে ওকে বাঁচানো যাবে না।’
মিথি এবার জোরে কেঁদে উঠল। নৈরিথ অসহায় চোখে মিথির দিকে তাকাল। নৈরিথ টের পায় ভাই বোনের এই গভীর ভালোবাসাটাকে। নৈরিথ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘মিথি, অস্থির হইও না। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আসছি।’
নৈরিথ উঠে ডক্টরের কেবিনে গেল। তারপর ডক্টরের কাছে মাহির শারিরীক অবস্থার কথা জানতে চাইল।
‘পেশেন্টের শারিরীক অবস্থা ভালো নয়। আপনারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একজন কিডনী ডোনারের ব্যবস্থা করুন।’
‘ডক্টর, আপনাদের হসপিটাল থেকে কি ব্যবস্থা করা যায় না?’
‘দেখুন, আমরা চেষ্টা করেছি। কিন্তু একটা কিডনী ডোনেট তো আর এত সহজ কথা নয়। অনেক কিছু আমাদের দেখতে হয়। পেশেন্টের ব্লাড গ্রুপ, টিস্যুর স্ট্রাকচার ম্যাচ করতে হয়। কিন্তু আমাদের এখান থেকে এসব ম্যাচ করছে না। এখন আপনারা বাইরে থেকে ট্রাই করুন। কিংবা খোঁজ নিয়ে দেখুন, আপনাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কাউকে পান কিনা? তাহলে দেখা যাবে কি খুব সহজেই ব্লাড আর টিস্যুটা ম্যাচ করছে।’
নৈরিথ চিন্তায় পড়ে গেল। কি করে এত অল্প সময়ের মধ্যে কিডনী ডোনার পাবে সে? ডক্টরের কেবিন থেকে বেরিয়ে মিথির বাবাকে সে সব কিছু খুলে বললো। সবকিছু শুনে মিথির বাবা বললো,
‘তাহলে আমি আমার ছেলেকে আমার কিডনী দিব।’
নৈরিথ বললো,
‘কিন্তু আংকেল আপনার তো ডায়াবেটিস আছে? আপনি কি করে কিডনী ডোনেট করবেন?’
আতাউর সাহেব অসহায় হয়ে পড়লেন। কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। ওদিকে তার ছেলেটার প্রাণ যায় যায়। আর তিনি বাবা হয়ে কিচ্ছু করতে পারছেন না। নিজেকে এখন বড্ড অসহায় লাগছে তার। কোনো দিকে কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। মিথির মা এতক্ষণ নিস্তেজ হয়ে এক কোণে পড়ে ছিলেন। তিনি এখন মিনমিনিয়ে বললেন,
‘আমার রক্তের সাথেও আমার ছেলের রক্ত মিলে না। মিললে তো আমি পারতাম আমার ছেলেটাকে বাঁচাতে। এখন..মিথির বাবা এখন কি আমার ছেলে আর বাঁচবে না? আমার ছেলে আর আমাকে মা বলে ডাকবে না? আর আমার কাছে পায়েস খাওয়ার আবদার করবে না? ও মিথির বাবা, আমার ছেলেটা যে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে, তুমি ওকে ফিরিয়ে আনো। ঐ যে আমার ছেলে চলে যাচ্ছে। যাও না, বসে আছো কেন? চলে যাচ্ছে তো ও। ওকে আটকাও মিথির বাবা, ওকে আটকাও।’
অবচেতন মনে অনেক কিছুই বলছেন আমিরা বেগম। মিথি বরাবরই কেঁদেই চলছে। নেহা তাকে সান্তনা দিতে ব্যস্ত। নৈরিথ তার কিছু বন্ধুকে কল দিয়েছে কিন্তু তাও কোনো ব্যবস্থা করতে পারলো না।
ডক্টর তখন কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন। ঠান্ডা গলায় বললেন,
‘আপনারা কি এখনও কোনো কিডনী ডোনার পাননি?’
হঠাৎ মিথির কি হলো। সে কিছু একটা ভেবে হুট করেই উঠে দাঁড়াল। থমথমে কন্ঠে বললো,
‘আমি দিব কিডনী।’
অনেক জোড়া বিক্ষিপ্ত দৃষ্টি তার উপর গিয়ে পড়ল। মিথির বাবা বললেন,
‘না মা, আমরা কিডনীর ব্যবস্থা করে ফেলবো। তোকে কিডনী দিতে হবে না। আমার এক সন্তানের জন্য আরেক সন্তানের জীবন রিস্কে ফেলতে পারি না।’
মিথি নিজেকে শক্ত করলো। বাবার কাছে গিয়ে বসে বললো,
‘কিসের রিস্ক বাবা? মানুষের একটা কিডনী হলেই চলে। এক কিডনী নিয়েই অনায়াসেই জীবন পার করা যায়। আর আমার কাছে আমার জীবনের চেয়ে আমার ভাইয়ের জীবন বড়। আমাকে আমার ভাইকে বাঁচাতে হবে বাবা। ও না থাকলে আমিও বাঁচতে পারবো না। প্লীজ বাবা, আমাকে আটকিও না।’
আতাউর সাহেব কেঁদে উঠলেন। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমিরা বেগম নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। হয়তো অনেক কথা বলতে চাইছিলেন। তবে সেগুলো সব গলায় আটকে যাচ্ছিল তার।
মিথিকে ডক্টর নিয়ে গেল টেস্ট করাতে। সব টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ আসলে তবেই সে কিডনী ডোনেট করতে পারবে। নেহা, নৈরিথ দুজনেই নিশ্চুপ। নেহা থেকে থেকে নাক টানছে। কাঁদছে সে। বান্ধবীর জন্য মায়া হচ্ছে তার। নৈরিথ এক কোণে চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল মিথিকে আটকাবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, সেই অধিকার তার নেই।
কিছুক্ষণের মাঝেই টেস্টের রিপোর্ট বেরিয়ে এল। এবং সমস্ত রিপোর্ট পজিটিভ। মিথি প্রচন্ড খুশি হলেও বাকি মানুষগুলো পড়ে গেছে দুটানায়। তারা না পারছে খুশি হতে না পারছে কষ্ট পেতে।
মিথিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়ার জন্য রেডি করা হলো। সামান্য ইনজেকশনে যে মেয়েটা ভয়ে আঁতকে উঠে, সেই মেয়েটাই ভাইয়ের জন্য আজ কি অনায়াসেই না এত বড় একটা অপারেশন করে ফেলছে। নিজের শরীরের একটা অঙ্গ দিয়ে ফেলছে। যাওয়ার আগে মিথি মা বাবাকে সালাম করলো। উনারা কেঁদে চলছেন। মিথিরও খুব কান্না পাচ্ছিল কিন্তু সে কাঁদল না। খুব কষ্টে নিজেকে সামলেছে। নেহাও তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদল। যাওয়ার আগে নৈরিথ তার কাছে এসেছিল। তার গালে হাত রেখে বলেছিল,
‘ইউ আর অ্যা ব্রেভ গার্ল মিথি। যাও, ভাইকে নিয়ে এসো। আমরা অপেক্ষা করছি।’
মিথি তখন জবাবে কিছু বলেনি। ফিচেল হেসে নার্সের সাথে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে ঢুকেছিল। সেখানে তার পাশের স্ট্রেচারেই মাহিকে রাখা হয়েছিল। মাহিকে দেখা মাত্রই মিথির গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার স্যালাইন চলছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো।
মিথিকে একটা বেডে শুইয়ে ডক্টর তাকে কিছু প্রশ্ন করলো। মিথিকে স্বাভাবিক করার জন্যই এই প্রশ্ন। তারপর তাকে একটা ইনজেকশন পুষ করা হয়। আর তারপর ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সেই মুহুর্তেও নিজের জন্য বিন্দুমাত্র ভয় হচ্ছিল না তার। মনে ছিল তার শুধু একটাই কথা, তার ভাইটা সুস্থ হয়ে উঠুক।
চলবে..
চলবে..