তোমাতেই পরিপূর্ণ পর্ব -১৫+১৬

#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৫.
~
দু ঘন্টা পর দুজনকে কেবিনে দেওয়া হলো। এখনও কারোর জ্ঞান ফেরেনি। বাইরের মানুষগুলো অস্থির হয়ে কেবিনের দরজার সামনে ঘোরাফেরা করছে। জ্ঞান ফিরলে তবেই ভেতরে যেতে পারবে তারা। কিছুক্ষণ পরেই মাহির জ্ঞান ফিরল। সে পিটপিট করে চোখ খুলে তাকাল। প্রথমেই কিছু বুঝে উঠতে পারল না। আস্তে করে মাথাটা ঘুরিয়ে যখন সে তার পাশের বেডে তার বোনকে চোখ বুজা অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখল তখন যেন সে অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল। বাচ্চাদের মতো বুবু বুবু বলে ডাকতে লাগল। গলার স্বর ভীষণ ক্ষীণ তার। ডক্টর তার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে বললো,

‘তোমার বুবু একদম সুস্থ আছে বাবু। এত অস্থির হইও না।’

মাহি কিছু না বলে কাঁদো কাঁদো চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে রইল। ডক্টর বাইরে গিয়ে মাহির জ্ঞান ফেরার খবরটা সকলকে দিলেন। সাথে সাথেই তখন নৈরিথ বললো,

‘মিথির জ্ঞান ফেরেনি?’

‘না। তবে চিন্তা করবেন না, খুব শীঘ্রই উনারও জ্ঞান ফিরবে।
আর এখন আপনারা মাহির সঙ্গে দেখা করতে পারেন।’

মাহির মা বাবা দ্রুত কেবিনের ভেতর প্রবেশ করলো। আমিনা বেগম মাহিকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আতাউর সাহেবও চোখের পানি আটকাতে পারলেন না। তিনি মাহিকে খানিক আদর করে মিথির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। মিথির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘মা রে উঠ। দেখ, তোর ভাই সুস্থ হয়ে গিয়েছে। তোকে ডাকছে মা। চোখ খুলে তাকা। এই ভাবে চোখ বুজে শুয়ে থাকলে ভাইকে কিভাবে দেখবি? উঠ না মা আমার।’

মাহি ভেজা চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমিরা বেগম মাহিকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। মনের ভেতর অস্থিরতা এখনও তার কমেনি। তার মেয়ে যে চোখ খুলছে না। এক সন্তানের মায়ায় আরেক সন্তানকে বলি দিতে পারবেন না তিনি। দুই সন্তানই যে তার প্রাণ।

কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে নেহা আর নৈরিথ। নেহার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। ফর্সা গালগুলোও রক্তিম। মিথিকে এমন ভাবে দেখে কষ্ট হচ্ছে তার। কান্না পাচ্ছে খুব। নেহা এগিয়ে যায় মিথির কাছে। তার পাশে গিয়ে বসে। মিথির স্যালাইন চলছে। নেহা আস্তে করে তার হাতের উপর হাত রাখে। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,

‘দোস্ত, আমার আর তোকে এইভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। এবার উঠে পর। প্লীজ দোস্ত, তাকা একবার। আমার কষ্ট হচ্ছে তো।’

নেহার গাল বেয়ে মায়া অশ্রুগুলো গড়িয়ে পড়ল। নৈরিথ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। তার নিরব স্তব্ধ দৃষ্টি মিথির উপর। কঠিন এই মানব মনের ভেতরটা খাঁ খাঁ করছে। এক ভয়ানক কষ্ট যেন তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। নৈরিথ তার মনকে প্রশ্ন করলো, কিসের ভিত্তিতে সে এত কষ্ট পাচ্ছে? মিথির প্রতি তারা মায়া আছে ঠিকই; কিন্তু তাই বলে কি শুধু এই মায়ার টানেই সে এত কষ্ট পাচ্ছে? নাকি তার এই টান আরো গভীর? নৈরিথ কোনো উত্তর পেলো না। তার মন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হলো। তবে এইটুকু আন্দাজ করতে পারলো, মিথি নামের মেয়েটার কিছু হলে সে ঠিক মেনে নিতে পারবে না। তার আজ হঠাৎই মনে হচ্ছে, মেয়েটা যেন তার আত্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সে চোখে বুজে মেয়েটার অনুপস্থিতি কল্পনা করলেই কেঁপে উঠে। ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠে তার। তার মন তাকে এইটুকু বলেছে যে, তার বেঁচে থাকার জন্য এই মেয়েটাকে প্রয়োজন। হ্যাঁ, প্রয়োজন। ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।

নৈরিথ ছোট্ট একটা ঢোক গিলে। মনে মনে ঠিক করে, মিথি সুস্থ হয়ে উঠলেই সে এই কথাগুলো মিথিকে বলবে।
.
.
দুপুরে অপারেশন হলেও মিথির জ্ঞান ফিরল বিকেলে। তার মধ্যে মাহিকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। ছেলেটার পেটের সেলাইয়ের মধ্যে ব্যথা হচ্ছিল, তাই। মিথি চোখ খুলে দেখল, তার পরিচিত প্রিয় মুখগুলো কেমন চুপসে গেছে। কিছু সময়ের ব্যবধানেই চোখ মুখ শুকিয়ে গেছে তাদের। মিথির ঠোঁটগুলো প্রচন্ড শুকিয়ে আছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট যুগল ভিজিয়ে ক্ষীণ সুরে বললো,

‘ভাই কেমন আছে বাবা?’

আতাউর সাহেব এবার দম ফেললেন। মিথির মুখে বাবা ডাক শুনে মনের শান্তি ফিরে পেয়েছেন তিনি। মিথির কপালে চুমু খেয়ে তিনি বললেন,

‘মাহি একদম সুস্থ মা। ওর জ্ঞান তো অনেক আগেই ফিরেছে। এখন আবার ঘুমাচ্ছে। জ্ঞান ফিরেই তোকে এইভাবে দেখে ভয় পেয়ে গেছিল। পরে ডক্টর ওকে বুঝিয়ে বলাতে বুঝেছে।’

মিথি ঢোক গিলে ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলল। তারপর তার মা বাবার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে মৃদু সুরে বললো,

‘আমার একটা কথা রাখবে তোমরা?’

আমিরা বেগম বললেন,

‘হ্যাঁ মা, বল কি কথা?’

মিথি আবারও নিশ্বাস ফেলল। বললো,

‘মাহিকে তোমরা কোনোদিন, কোনো কারণে এটা বলবে না যে আমি ওকে কিডনী দিয়েছি বলেই ও বেঁচে আছে। ওর যেন কোনোদিন এটা মনে না হয় যে ও আমার একটা কিডনীর জন্যই বেঁচে আছে। ও বেঁচে আছে শুধু আল্লাহর দয়ায়। ওর বেঁচে থাকার পেছনে আমার কোনো হাত নেই। তাই অনুরোধ করছি তোমাদের কাছে, ওকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না। আর ও যদি আমার অসুস্থতার কারণ জিগ্যেস করে, তাহলে বলবে যে ওর শরীর খারাপের কথা শুনে আমিও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। এর বেশি আর কিছু বলো না। প্রমিস করো, বলবে না?’

মিথির মা বাবা স্তম্ভিত। তাদের এইটুকু মেয়েটা তার ভাইকে নিয়ে এত ভাবে? আমিরা বেগম কেঁদে ফেললেন। তার মনে হচ্ছে যেন তার কোনো পুণ্যের গুণেই খোদা তাকে এই কন্যা সন্তানের জননী করেছে। তিনি মেয়ের চোখে মুখে আদর দিয়ে ভরিয়ে দিলেন। মিথি হেসে ফেলল। বললো,

‘কি ব্যাপার মা? আজ এত আদর করছো? আমাকে আদর টাদর দিয়ে কিছু করিয়ে ফেলার জন্য কোনো ফন্দি টন্দি আঁটছো নাকি?’

আমিরা বেগম নাক ফুলিয়ে বললেন,

‘মার খাবি কিন্তু ফাজিল। এই অবস্থাতেও তোর দুষ্টুমি গেল না।’

মিথি দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে বলে,

‘আমি অলওয়েজই এমন।’

সঙ্গে সঙ্গে তার পেটে টান লাগতেই সে ‘উহহ’ শব্দ করে উঠে। মিথির মা বাবা অস্থির হয়ে বললেন,

‘হয়েছে হয়েছে আমরা বুঝেছি। আর এত হাত পা নড়াতে হবে না।’

মিথি সোজা হলো। তার মাথার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে এতক্ষণ সে খেয়াল করেনি। নেহার দিকে মাত্রই তাকাল। ব্রু কুঁচকে ফেলল মিথি। বললো,

‘কিরে মেয়ে, পুরো মুখে কি ব্লাশন মেখে এসেছিস নাকি? চোখ মুখ এত লাল হয়ে আছে কেন?’

মিথির মা জবাবে বললো,

‘তোর জন্য কেঁদে কেটে এই অবস্থা করেছে।’

মিথি অবাক হওয়ার ভান করে বললো,

‘তুই আমার জন্য কেঁদেছিস? সিরিয়াসলি?’

নেহা কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে বললো,

‘না কাঁদিনি। কেন কাঁদবো? আমার চোখের পানি কি এতই সস্তা নাকি যে তোর মতো একটা গরুর জন্য আমি কেঁদে কেটে চোখের পানি নষ্ট করবো? ইম্পসিবল।’

মিথি মুচকি হেসে বললো,

‘আর আজ যদি আমি মরে যেতাম?’

নেহার চোখগুলো আবারও ভিজে উঠল। মিথির জ্ঞান ফিরছিল না বলে সেই কি ভয়ই না পেয়েছিল সে। কিছুক্ষণের জন্য তারও মনে হয়েছিল, মিথি বোধহয়…! ভাবলে এখনও নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার।

নেহা নাক টেনে বললো,

‘তাহলে চল্লিশা খেতাম।’

মিথি মুচকি হেসে বলে,

‘আই লাভ ইউ নেহু।’

নেহা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,

‘আই হেইট ইউ।’

মিথি তার প্রতিউত্তরে প্রাণখোলে হাসে।

নৈরিথ কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে মিথির সেই হাসি দেখে। হৃদ কম্পন অল্প বিস্তর বেড়ে যায় তার। নিশ্বাস ভারি হয়ে আসে। সে তাকিয়ে থাকে এক ধ্যানে। মন বলে উঠে, এই মেয়েটাকে বাঁচতে হবে, হাসতে হবে আর…আর তাকে প্রাণ ভরে ভালোও বাসতে হবে।#তোমাতেই_পরিপূর্ণ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১৬.
~
সন্ধ্যায় মাহির ঘুম ভাঙল। সে ঘুম থেকে উঠেই মিথিকে দেখে খুশিতে ডেকে উঠল,

‘বুবু!’

মিথি ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে হাসল। সে আস্তে করে উঠতে নিলেই আমিরা বেগম তাকে উঠতে সাহায্য করলো। মিথির বসতে কষ্ট হচ্ছিল। তাও সে উঠে বসল, আস্তে আস্তে হেঁটে তার ভাইয়ের কাছে গেল। মিথিকে দেখে মাহি ঠিক ধরতে পারল তার বোনের কিছু একটা হয়েছে। সে অস্থির কন্ঠে জিগ্যেস করলো,

‘তোমার কি হয়েছে বুবু?’

মিথি আলতো হেসে মাহির পাশে বসলো। মাহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

‘আর বলিস না। তোর অসুস্থতার কথা শুনে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। কত ভয় পেয়েছিলাম তখন জানিস?’

মাহি ঠোঁট উল্টে বললো,

‘এত ভয় পাওয়ার কি আছে? দেখো আমি একদম সুস্থ। কিচ্ছু হয়নি আমার। তোমরা শুধু শুধু এত ভয় পাও।’

মিথি মৃদু হেসে বললো,

‘হ্যাঁ তো, আমরা যে ভীষণ ভীতু। আর আমার ভাইটা তো প্রচন্ড সাহসী। তাকে কেউ কাবু করতে পারবে না। এই সামন্য অসুখ তো জীবনেও না।’

মাহি হাসল। বড্ড প্রশান্তি আছে এই হাসির মাঝে। মিথি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। এতক্ষণে সত্যিকার অর্থে সে তার জীবন ফিরে পেয়েছে যেন।
.
.
রাত দশটা বাজে। এখনও কেবিনের বাইরে বসে আছে নৈরিথ। নেহা তাকে অনেকবার ভেতরে গিয়ে মিথির সাথে দেখা করতে বলেছে। কিন্তু সে কোনোভাবেই যাচ্ছে না। এর মাঝে রাদিত এসেও দেখা করে গিয়েছে। আরো অনেকেই এসেছে ওদের সাথে দেখা করতে। ঐ যে একটা কথা আছে না, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। কথাটা অনেকাংশেই সত্যি। সেটা আজ প্রমাণ পেয়েছে নৈরিথ। মিথিদের পাড়ার কিছু প্রতিবেশী এসেছিল ওদের দেখতে। দেখে যাওয়ার সময় তারা গুনগুন করে বলা বলি করছিল,

‘আহারে আমার তো মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছে। কি মিষ্টি মেয়েটা এই অল্প বয়সেই একটা কিডনী হারাল। ছেলেটা তো আগে থেকেই অসুস্থ ছিল এখন আবার মেয়েটাও হয়েছে।’

অন্য একজন বললো,

‘আমি তো ভাবছি বিয়ের কথা। এই মেয়েকে এখন আর কে বিয়ে করবে বলতো? কেউ জেনে শুনে কি অসুস্থ মেয়েকে বিয়ে করবে? আমার তো মনে হয় না।’

নৈরিথ বাইরে ছিল বিধেয় সব কথায় শুনেছে। রাগে তখন মাথার রগ ফুলে উঠেছিল তার। তবে কিছু বলেনি। খুব কষ্টে কথাগুলো তখন হজম করেছিল। এখন আবারও সেই কথাগুলো মনে পড়তে রাগ হয় তার। সমাজটা উন্নত হচ্ছে না বরং দিনকে দিন অবনত হচ্ছে। এই সমাজের মানুষগুলোর মন ভীষণ কুৎসিত। তারা সাদাকেও কালো দেখে। তাদের থেকে এর থেকে বেশি আর কি আশা করা যায়? দীর্ঘশ্বাস ফেলে নৈরিথ। চোখ বুজে পেছনে হেলান দিয়ে বসে। তখনই আবার নেহা আসে। তার পাশে বসে মৃদু সুরে বলে,

‘ভাইয়া, কি হয়েছে তোর?’

নৈরিথ চোখ মেলে নেহার দিকে তাকিয়ে ফিচেল গলায় বলে,

‘মিথি স্যুপটা খেয়েছে?’

‘হুম খেয়েছে। ঔষধ খেয়ে এখন রেস্ট নিচ্ছে। কিন্তু তোর কি হয়েছে বলতো?’

নৈরিথ আবারও চোখ বুজে হেলান দিয়ে বসলো। বললো,

‘কিছু হয়নি। বাড়ি যাবি না?’

‘না আমি আজকে এখানে থাকব। তুই চলে যা।’

‘না আমিও যাবো না। তুই মাকে কল দিয়ে বলেছিস সবকিছু?’

‘হ্যাঁ বলেছি।’

নৈরিথ আবার কিছু বলার আগেই সেখানে মিথির মা বাবা এল। তাদের কন্ঠ শুনেই নৈরিথ সোজা হয়ে বসলো। মিথির বাবা তার পাশে বসে বললো,

‘বাবা, আমাদের জন্য তোমরা এইভাবে কষ্ট করছো। এবার বাড়ি যাও বাবা। গিয়ে খেয়ে দেয়ে একটু রেস্ট নাও। আমরা এইদিকে আছি। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই বলবো তোমাদের।’

নৈরিথ প্রসন্ন হেসে জবাব দিল,

‘না আংকেল, আপনাদের একা রেখে আমি যেতে পারবো না। দুই দুটো ছেলে মেয়ে অসুস্থ। কখন কিসের প্রয়োজন হয় বলা তো যায় না। তার উপর আপনি আর আন্টিও এসবের জন্য দূর্বল হয়ে পড়েছেন। এই সময় আপনাদের সাথে যদি একজন কেউ না থাকে পরে সমস্যা হতে পারে। আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন আমি আর নেহা একদম ঠিক আছি। আপনারা কেবিনে ওদের সাথেই থাকুন। আমাদের নিয়ে চিন্তা করবেন না।’

আমিরা বেগম তখন বললেন,

‘তোমরা তো কিছু খাওনি, তাই না।’

নৈরিথ হালকা হাসার চেষ্টা করে বললো,

‘সমস্যা নেই আন্টি। ক্যান্টিন থেকে খেয়ে নিব।’

‘না ক্যান্টিন থেকে খেতে হবে না। আমি বাসা থেকে রান্না করে এনেছিলাম। আমাদেরও খাওয়া হয়নি। চল একসাথে খাবো।’

নৈরিথ খুশি হয় ভীষণ। যেন আমিরা বেগমের এই উক্তিতে সে তার মায়ের ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে যায়। তারপর সবাই ফ্রেশ হয়ে এসে একসঙ্গে খেতে বসে।
.
.
রাত দুটো,

সবাই ঘুমোলেও একজনের চোখে খুব নেই। তার ক্লান্ত চোখের দৃষ্টি এক মানবীকে দেখতে ব্যস্ত। কই আগে তো এমন অনুভূতি তার হতো না। তবে আজ কেন? আজ কেন এই চোখের তৃষ্ণা মিটছে না? কেন মন তার ভরছে না? এত কেন মায়া ঐ মুখশ্রীটাতে? এই মায়ায় তো আগে কখনও পড়েনি সে, তবে আজ কেন? নিজের প্রশ্নের কোনো উত্তর নৈরিথ খুঁজে পেল না। কেবিনের বাইরের স্বচ্ছ কাঁচ ভেদ করে তার দৃষ্টি ঐ প্রিয় মানুষটার উপর। যার ক্লান্ত মুখটাতে খুঁজে পেয়েছে সে একরাশ প্রশান্তি। খুঁজে পেয়েছে ভালোবাসা। নৈরিথ চোখ বুজে মিথিকে অনুভব করে। মনে পড়ে মিথির প্রথম আই লাভ ইউ বলার মুহুর্তটা।
তাদের প্রথম পরিচয় হওয়ার পর মিথিই নৈরিথকে প্রথম ম্যাসেন্জারে ম্যাসেজ দেয়। প্রথম প্রথম সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও একদিন মিথি হুট করেই বলে বসে আই লাভ ইউ। নৈরিথ ম্যাসেজ দেখে সঙ্গে সঙ্গেই মিথিকে কল দিয়েছিল। ইচ্ছে মতো বকেও ছিল খুব। কিন্তু মিথির পাগলামো কমলো না বরং সেদিন থেকে আরও বেড়ে গেল। কারণে অকারণে সে নৈরিথকে কল দিয়ে জ্বালাত। কত যে সে নৈরিথের বকা শুনেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবুও জ্বালানো বন্ধ করেনি।

কথাগুলো ভাবতেই নৈরিথ হেসে উঠে। মিথির দুষ্টুমিগুলো মনে পড়লে বড্ড হাসি পায় তার। তবে মনের মাঝে এক দারুণ প্রশান্তিও পায় সে এটা ভেবে যে, এই মেয়েটা সত্যিই তাকে ভীষণ ভালোবাসে। যেই ভালোবাসায় কোনো স্বার্থ নেই, আছে শুধু একরাশ ভয়ানক তৃপ্তি। আর এই তৃপ্তিটাই সে এই ভালোবাসাকে ঘিরে মেয়েটার শতশত পাগলামী গুলোতেই খুঁজে পায়।

নৈরিথ মুচকি হেসে আগের জায়গায় গিয়ে বসে। নেহা ততক্ষণে ঘুমে বেহুঁশ। সিটে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে সে। মাথাটা বার বার পড়ে যাচ্ছে। নৈরিথ তার পাশে গিয়ে বসে নেহাকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। পৃথিবীতে নিজের পরে এই বোনটাকেই সে সবথেকে বেশি ভালোবাসে।
____________________

সবেই সূর্য উঠেছে হয়তো। বাইরে ঝাপসা ঝাপসা আলো। মিট মিট করে চোখ মেলে তাকায় মিথি। চেয়ে দেখে তার পাশেই তার মা ঘুমাচ্ছে। বাবা ঘুমাচ্ছে রুমের কোণে একটা সোফাতে। মাহি অন্য একটা বেডে আরামসে ঘুমিয়ে আছে। সে ওয়াশরুমে যাবে। কিন্তু একা যেতে পারবে না আবার মাকে ডাকতেও ইচ্ছে করছে না তার। গভীর ঘুমটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে। সে আস্তে আস্তে করে উঠে বসে। পেটের সেলাইটাতে চিন চিন ব্যাথা করে উঠে তার। খুব কষ্টে উঠে দাঁড়ায়। এক পা এক পা করে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই তাকে কেউ পেছন থেকে ধরে ফেলে। হঠাৎ চমকে উঠে সে। পাশে তাকিয়ে দেখে নৈরিথ। ঘুম ঘুম চোখ মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ক্লান্ত মাখা মিষ্টি এক চেহারা। নৈরিথ কপাল কুঁচকে বললো,

‘কোথায় যাচ্ছো?’

মিথি আমতা আমতা করে বললো,

‘ওয়াশরুমে।’

নৈরিথ তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,

‘একা একা উঠলে কেন? আন্টিকে ডাকতে পারনি?’

‘মায়ের ঘুমটা ভাঙতে ইচ্ছে করছিল না। আর আমি একা একা পারবো যেতে।’

‘হ্যাঁ, সবকিছুই তো পারো তুমি। যাকগে আমি এখানে আছি তুমি যাও ভেতরে। আর শুনো ভেতর থেকে দরজা আটকানোর দরকার নেই।’

মিথি বড়ো বড়ো চোখ করে বললো,

‘কি?’

‘যা শুনেছো তাই। শরীর দুর্বল তোমার। বাথরুমে পড়ে টড়ে থাকলে দরজা ভেঙে ঢুকতে ঢুকতেই যা হওয়ার তা হয়ে যাবে। তাই বলছি, দরজা চাপিয়ে রাখো, আটকাতে হবে না।’

মিথির ভীষণ লজ্জা লাগলেও সে নৈরিথের কথাই শুনে। ওয়াশরুম থেকে বের হতেই নৈরিথ তাকে ধরে নিয়ে তার বেডে বসায়। তারপর বলে,

‘ঘুমাও তাহলে। আমি বাইরে আছি।’

নৈরিথ চলে যেতে নিলেই মিথি তার হাতটা চেপে ধরে। নৈরিথ তার দিকে ঘুরে তাকায়। তারপর কিছুটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আস্তে করে বলে,

‘গেট অয়েল সুন ডেয়ার। অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে।’

কথাটা বলেই সে মিথির হাত ছাড়িয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। মিথি খুশি হয়ে যায়। প্রচন্ড খুশিতে দুহাত মেলতেই তার আবারও ব্যথা লাগে। তবে এখন আর খুশির চোটে সেই ব্যাথা টেরই পায় না সে। নৈরিথ তাকে অনেক কিছু বলতে চায়। আর এই অনেক কিছু মানেই ভালোবাসার কথা। লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ লুকায় সে। তারপর আস্তে করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আর মনে মনে ভাবতে থাকে সেইদিনটার কথা যেদিন নৈরিথ সত্যি সত্যিই তাকে ভালোবাসার কথা বলবে..

চলবে..

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here