#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১৬/
একটা মেসেজ জিসান ভাইকে সেন্ড করতে চেয়েছিলাম। করলাম ইফাজকে। মেসেজটা মেসেঞ্জারে পাঠাইনি। তাই আনসেন্ড করা যাচ্ছে না। বিরক্তি আর অস্বস্তিতে চোখ খিচে বসে থাকি। মেসেজটা দেখলে ইফাজ কি ভাববে!? কিছুক্ষণ পর মনে হলো ভাবুক! ভেবে উল্টে থাকুক। তাতে আমার বাপ-দাদা চৌদ্দপুরুষের কিছু যায় আসছে না। বরং একটা সরি মেসেজ পাঠানো যায়। নিরুপায় তাই করলাম। চোখ বুলিয়ে পুরো মেসেজগুলো পড়লাম। তীব্র অস্বস্তি আকড়ে ধরল। ইফাজের সাথে ছোটখাটো কথোপকথন যা হয়েছে সব ফোন থেকে মুছে ফেললাম। হায়! এটা যদি ইফাজের ফোন থেকে মুছতে পারতাম! মেসেজটা ছিল এরকম, “জিসাইন্নার জিসাইন্না! তোর সাথে আমার সীমিত সময়ের ব্রেকাপ!”
সব অস্বস্তি ঝেরে ফেলি। যার মেসেজ তাকে পাঠিয়ে দেই। ফোনটাও অফ করে দেই। এখন বাজছে নয়টা। জানলার থাই গ্লাস আর বারান্দার দরজা শক্ত করে লাগাই। ঠিকমতো লেগেছে কিনা পরিক্ষা করি। নিশ্চিত হয়ে বিছানায় গা এলাই। পৃথিবী ভেসে গেলে ভেসে যাক। এত অস্বস্তি, বিরক্তি, রাগ, জেদে অসহ্য হয়ে গেছি! তীব্র মাথা ব্যাথায় একসময় চোখে ঘুম নামল।
ঘুম ভাঙে ভোর সকালে। চোখ কচলে বসি। বালিশের কাছে ফোন হাতড়াই। অন করি। বিরামহীন নোটিফিকেশন আর মেসেজ আসতে থাকে।
১১:৩০
“ঝুম বারান্দার দরজা খোল”
“আমি জানি ঘুমাসনি”
“ঝুম খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু”
১১:৫০
“আচ্ছা যা খুলতে হবে না দরজা তোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকব সারারাত”
“এই তোর দয়ামায়া নেই?”
১১:৫৯
“আরে আমি কি করেছি? রাগের মাথায় ঐসব বলা অস্বাভাবিক?”
“আচ্ছা যা সরি। তোর শ্রদ্ধেয় পরিবারকে আর আজাইরা বলব না। দিনরাত ওদের নাম জপে মুখের ফেনা তুলে ফেলব!”
১২:০২
“শালি, মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে!”
“দরজা একবার খুলতে পারি তোকে..!”
“তোর ব্রেকাপ ছুটাচ্ছি দাঁড়া।”
১২:২০
“এত আওয়াজেও ঘুম ভাঙে না? কি ঘুম ঘুমিয়েছিস!”
১২:৩০
“তুই একবার দরজা খুল তো! এখুনি বিয়ে করব।”
“পরিবারকে জানাইনি এটাই সমস্যা? মাঝরাতে বিয়ে করে ঐ পরিবারের সামনেই আগে যাব!”
১২:৫৫
“ধ্যাত! তুই আজাইরা। তোর পরিবার আজাইরা। তোর ফোনও আজাইরা। এত কল করি বারবার নট রিচেবল!”
“তোদের বারান্দাও আজাইরা। এত মশা!”
০২:২০
“খুললি না শেষ পর্যন্ত! তোকে আমি কালকে পাই খুন করব! শালির বোন!”
“খুন হয়েও শান্তি পাবি না। তোকে নিজের রুমে ফরমালিন জারে রাখব! বাই এনি চান্স হঠাৎ হৃৎপিন্ড সচল হলে ফরমালিনে শ্বাস নিবি! গিলবি!”
“বেয়াদব মেয়ে!”
পাশাপাশি মিসড কলের মেসেজ। ছোট্ট এক শ্বাস ফেললাম। লাস্ট মেসেজ এসেছে আধঘন্টা আগে, “ঝুম আমি সিরিয়াস দিনের বেলা তোকে সামনে পাই। তুলে নিয়ে বিয়ে করব! গাঁইগুঁই করবি চড় খাবি! ঘুম হারাম করে দিয়েছিস!”
বারান্দায় এসে বসলাম। আলো ফুটছে সবে। ভোর শীতল হাওয়ারা ছুয়ে ছুয়ে যাচ্ছে। সদ্য ফোটা সকালের স্নিগ্ধতায় আমার রাগ, জেদ উবে গেল। আবিষ্ট হলো মুগ্ধতায়। মেসেজগুলো পড়ে এখন বরং হাসি পাচ্ছে। বারন্দায় আনা চেয়ারে পা উঠিয়ে বসলাম। ফোন লক খুলে গ্যালারিতে যাই। গ্যালারিতে আমার ছবি কম, জিসান ভাইয়ের ছবিতে ভরপুর। উনার জন্য আলাদা দুটো এলবাম আছে। সেখানে কোনটা উনার সজ্ঞানে, কোনটা লুকিয়ে তোলা ছবি। বেশির ভাগ আমাদের কাপল ছবি। উনার গ্যালারিতে যাই। উনি যেদিন পাঞ্জাবি পরেন আমি জোর করে উনার গোল চশমাটা উনাকে পরাই। চশমাটায় উনাকে দারূণ মানায়। সমস্যা সেটা তিনি জানেন না। পরতেও চান না। স্নিগ্ধ সকাল আর প্রিয়ের হাস্যোজ্জ্বল স্নিগ্ধ চেহেরা ঠোঁটে আপনাই হাসি ফোটাল। ছবিগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি আর অধিকারবোধ স্বগর্জনে গর্জায়, “এই পাগলাটে ছেলেটা আমার একান্তই আমার!” এসময় ফোন রিং বেজে উঠল। ত্যক্ত মুখে তাকাই। জিসান ভাইয়ের কল। বিরক্তি মুছে ঠোঁট হাসি ফুটে। কণ্ঠে তবু গাম্ভীর্য এনে বলি, “হ্যালো।”
ওপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। ক্লান্ত কণ্ঠে বললেন, “কাল রাতে জেগে ছিলি?”
“না ঘুমিয়ে গেছিলাম।”
“সত্যি?”
“মিথ্যের কি হলো?”
“কখন উঠলি? ফ্রেশ হয়েছিস?”
“অনেকক্ষণ হলো উঠেছি। উঠেছি যখন অবশ্যই ফ্রেশ হয়েছি!”
বিরক্তি নিয়ে, “এমন রূক্ষ কণ্ঠে কথা বলছিস কেন?”
“কই না তো। আমার স্বাভাবিক কণ্ঠই আজকাল আপনার রূক্ষ মনে হয়।”
“বাই এনি চান্স, সকাল সকাল তুই ঝগড়া করতে চাইছিস?”
“আশ্চর্য আমাকে ঝগরুটে মনে হয় আপনার?”
“ঝুম শুধু শুধু ঝামেলা বাজাচ্ছিস। এখনও ছোট কারনের রেশ ধরে আছিস। ছাড় না ওসব!”
“ছাড়ব কেন? আপনি সরি বলেও একই সময়ে আমায় বকেছেন!”
ওপাশ থেকে ধমক আসে, “কি চাইছিস তুই?”
আত্মা কেঁপে উঠল। চেয়ার থেকে একটু হলে পরে যেতাম। ধাতস্থ হই। বলি, “শাস্তি দিতে চাই। এমন শাস্তি যা আপনি সারাজীবন বইবেন। কাহিল হবেন। তবু ফেলতে পারবেন না।”
“ত্যক্ত হয়ে গেছি তোর বেহুদা পাগলামিতে। বন্ধ কর এসব!”
চোখে পানি এল, বললাম, “ঠিকাছে আর ফোন দিবেন না আমাকে।”
“আমার ঠেকা না। সামান্য একটা বিষয়ে এত কাহিনী! যত্তসব!”
তিনি কল কেটে দেন। আমি গাল ফুলিয়ে বসে থাকি। সময় গড়ায়। তিনি কল করেন না। আশ্চর্য আমি রেগে আছি! তিনি মান ভাঙাবেন না? কল এল না। না কোন মেসেজ। আমি ধীরে ধীরে অস্থির হতে লাগলাম। ভয় জমাট বাধল। তিনি আমাকে ভুলে যাননি তো? একদিনে ভালবাসা কমে গেল? উদভ্রান্ত পাগল পাগল আমি রুমে পায়চারি করি। কখনো রুম থেকে বেরিয়ে আবার রুমে এসে ঢুকি।
সন্ধ্যে নাগাদ আমার অবস্থা হলো ভুতগ্রস্ত। এলোমেলো চুল। এলোমেলো চোখ-মুখের অবস্থা। দীর্ঘ সময়ের কান্নায় চোখের কোল ফুলে। মাথা ব্যাথা করছে। হারানোর ভয় আমাকে চিন্তায় গুমরে মারছে। তিনি বিহীন জীবন ভাবনায় কখনো উঁকি দিচ্ছে। আর আমি গুটিয়ে যাচ্ছি। তিনি বিহীন জীবন লিড করা অসম্ভব! মামীর গলা পেলাম এসময়। রুমের লাইট জ্বলে উঠে।
“একি অবস্থা! জানলা লাগানো হয়নি! আলো না জ্বালাসনি! এমন ভুতের মতো বসে আছিস যে? ঠিক আছিস?”
উত্তর দেই না। মাথা নিচু করে হাতখোপা করতে থাকি। মামী জানলা, দরজা লাগান। উঠে দাঁড়িয়েছি তখন, বললেন, “কি হয়েছে তোর?” কাছে এসে থুতনি উঁচিয়ে, “দেখি। মুখ চোখ এমন লাগছে কেন? অসুস্থ?”
ভারী কণ্ঠে বলি, “মাথাব্যাথা। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে আসি। সরো।”
মামী সপ্রশ্ন চোখে ছাড়েন। ওয়াশরুমে এসে চোখে-মুখে পানি ছিটাই। মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে। ভারী লাগে। বেরিয়ে আসি। মামী তখনো দাঁড়িয়ে, বলেন, “বেশি খারাপ লাগলে সুয়ে থাক। রেনু খাবার দিয়ে যাবে।”
অসম্মতিতে বলি, “এত অসুস্থ না। সবার সাথেই খাব।”
মামী অসন্তুষ্ট হন। দৃষ্টিতে সে ছাপ পরে। বলেন, “বড় হয়ে গেছিস। এখন সমস্যা যাই হোক সব তোদের পার্সোনাল মেটার!”
শেষ বাক্যে হালকা শ্লেষ মিশে ছিল। আমি বিস্মিত হই। মামীর দিকে তাকাই। মামী রুম থেকে চলে যান। ছোট্ট এক শ্বাস ফেললাম। তাতে আক্ষেপ নাকি বিরক্তি কি ছিল সেটা নিজেরই অজানা। ধীর পায়ে ডাইনিং রুমে আসি। তিয়াস ভাইয়ার সাথে চোখাচোখি হয়। ভ্রু কুচকায়, “কি রে, কি হয়েছে?”
থমথমে মুখে বলি, “কিছু না।”
ভাইয়া আর প্রশ্ন করে না। আপুকে ইশারা করে। আপু উত্তর দিতে পারে না। মামা, সাদ ভাইয়া, নানা এসে টেবিল দখল করেন। নানা সামনা সামনি বসেন। কিছুক্ষণ উৎসুক চোখে তাকান। বলেন, “কি হয়েছে নানু?”
সবার দৃষ্টি আমার ওপর পরল। এবার আমি কেঁদে দিলাম। উনারা বিস্মিত হন। মামী, রেনু খালা খাবার বেরে দিচ্ছিলেন। হাত থেমে যায়। ভাইয়া, নানার মিলিত কণ্ঠ আসে, “কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
অস্পষ্ট কণ্ঠে বলি, “আমি বিয়ে করব নানা।”
মামী বিস্মিত কন্ঠ, “কি বললি?”
আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে, “আমি বিয়ে করব।”
মামা বিস্ময়ে বলেন, “তোকে গতকাল তোর মামী বারবার জিজ্ঞেস করেছে ঠিক কিনা। তুই তবু অসম্মতি দিয়েছিস। এখন…”
বিরক্তিতে ভারী কণ্ঠে বলি, “আমি বলেছি ওকে বিয়ে করব?”
নানা হাসেন, বলেন, “কাকে করবে তাহলে? এ অসময়ে পাত্র কোথায় খুজব?”
কান্না মুছি। ভয়ে ভয়ে বলি, “তোমাদের শাফিকে বিয়ে করব।”
মামা চমকান। কিন্তু নানার ঠোঁটে হাসি। মশকরা করে বলেন, “শাফি রাজি হবে? নাকি জোর করতে হবে?”
মামী বলেন, “বাবা আপনি হাসছেন?”
“দেখ মা, আমার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। হাসি পাবে না? আমি আশ্চর্য হচ্ছিলাম। বিয়ে করতে যে আমার মেয়েকে ভোর রাতে তুলে নিয়ে গেছিল। তার মেয়ে কিভাবে বিয়ে বিমুখী! এটাই হওয়ার নয় কি?”
উপস্থিত সবাই বিস্ময়ে তাকাচ্ছে। আমি আরও জোরে কাঁদতে থাকি। মামী ধমকান, “এই কান্না বন্ধ কর।”
ছোটদের মতো অস্থির হয়ে উঠি। পা দাবড়াই, “আমি বিয়ে করব! আর কিছু জানি না, আমি বিয়ে করব! মানে বিয়ে করব!”
সাদ ভাইয়ার ত্যক্ত কণ্ঠে আসে, “এই তোর বয়স হয়েছে? লজ্জা লাগছে না?”
ভাইয়ার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাই। ভাইয়া মুখ ভেঙায়। বলে, “বয়স হলে বিয়ে এমনিতেই দিব। চুপচাপ ভাত খা!”
আমি হাত গুটিয়ে নেই। গাল থেকে অনবরত পানি গড়ায়। ভাইয়া এবার কথা পালটায়, “আচ্ছা বাপ করিস। এখন ভাত খা!”
“না আমি আজকেই বিয়ে করব!”
“আশ্চর্য মেয়ে তো! শাফির পরিবারের সাথে কথা বলতে হবে না?”
“তো বলো। আমি বিয়ে করব! বিয়ে করব! বিয়ে করব! আর ঐ জিসান বেটাকেই করব!”
মামী মাথায় মারলেন, “চুপচাপ খেয়ে ওঠ। এটা বাচ্চার বায়না না।”
মাথায় হাত বোলাই। তবু জেদ ধরে থাকি। মামীর মুখ রক্তাভ হয়। কখনো ঠোঁট টিপে অন্যদিকে ফিরেন। তিয়াস ভাইয়া আর আপু ওদিকে মুখ লুকিয়ে হাসছে। এসবে নজর দেয়ার সময় নেই! আমি বিয়ে করব মানে করবই। মামী একসময় ত্যক্ত কন্ঠে মামাকে বলেন, “তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ওপর তলায় যাও তো। সাদ কাজি ডেকে আনুক। তোমার ভাগ্নী যা চাইছে তাই হোক! এত জিদ্দি এ মেয়ে!”
সাদ ভাইয়ার হাত থেমে যায়, “মানে? সত্যিই তোমরা ওকে বিয়ে দিবে? ওর বয়স হয়েছে? এখনো কত পিচ্চি! সবার ছোট হয়ে সবার আগে বিয়ে করে ফেলবে! বিয়ে কি হাতের মোয়া? জেদ ধরল আর হয়ে গেল! যত্তসব। ঢং না করে ভাত খা! এসব বাইপাস কাজকর্ম চলবে না!”
আমি গাল ফুলিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকাই। ভাইয়া কঠিনচোখে খেতে ইশারা করে। চোখ সরাই। হাত গুটিয়ে রাখি। আমাকে আজকে মারধর করলেও আমি বিয়ে করব! করব মানে করেই ছাড়ব! মিশেল আপুর কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠ আসে, “ওর কি দোষ ভাইয়া? তুমিই দেরিতে বিয়ে করে জ্যাম লাগিয়েছ। এখন অন্য পথ নাই। মেয়ের বয়স কম কি! আঠারো হয়েছে। ডিসেম্বরে উনিশ হবে!”
মামা, নানা খেয়ে যাচ্ছেন। ঠোঁটের কোণায় হাসি। মামী আরেকবার মাথায় মারলেন। আমি চোখ মুছে হাত গুটিয়ে নেই। তিয়াস ভাইয়া বলল, “মিশেল চল আমরাও গণ বিবাহ করি। ঝুম নতুন বাইপাস প্রজেক্টের উদ্যোক্তা হয়েছে আমাদের বড় ভাই-বোন হিসেবে উচিত ওকে সাপোর্ট করা। কি বলিস?”
কিছুক্ষণ নীরবতা। আপু একসময় রুম কাঁপিয়ে জোরে জোরে হাসতে থাকে। শুরু হয় সম্মিলিত হাসি। আমি অসহায় মুখে ওদের দিকে তাকাই। মামী পর্যন্ত ঠোঁট টিপে হাসছে। ওরা হাসি সামলে খেতে বলে। আমি গাট হয়ে বসে থাকি। ওরা এখনো মজা করছে! সিরিয়াসলি? খাব না আজকে আমি। ওরা খাওয়া শেষ করল। আমি তবু বসে রইলাম। নানা নিজের খাওয়া শেষে উঠে আসেন। মাথায় হাত বোলান, “খাও নানু। আমি কালকে কথা বলতে যাব!”
গাল ফোলাই। অসহায় চোখে নানুর দিকে তাকাই, “আমি আজকেই বিয়ে করব।”
কান্না থেমে গেছিল। আবার গড়িয়ে পরতে থাকল। নানা সস্নেহে চোখের পানি মুছে দেন। স্নেহকোমল কণ্ঠে বলেন, “আরে আমার নানাভাই কাঁদছে কেন? তুমি না খেলে আমার খাবার হজম হবে? বুড়ো নানা কষ্ট পাবে না?”
নাক টেনে বলি, “নানা আমি এখনো ছোট নাই।”
“ও তাই তো। আমার নানা বড় হয়ে গেছে। আমি এক্ষুনি তোমার মামাকে নিয়ে তিনতলায় যাচ্ছি। তুমি খাও।”
“সত্যি তো?”
মামা হাসেন, “হ্যা রে বাপ। তুই খা এখন।”
“আমি বিশ্বাস করি না। তোমরা আগে বেরোও পরে বুঝব সত্যি।”
সাদ আর তিয়াস ভাইয়াকে সত্যিই কাজি খুজতে পাঠানো হলো। নানারা গেলেন শাফি ভাইয়ের বাসায়। ভয়ে তীব্র গতিতে বুক ধুকপুক করছে। ভাবলাম নিসাকে ফোন করি। টেনশন মুক্ত হব। সব শুনে নিসার গগনবিদারী চিৎকার। চেঁচিয়ে কিসব বলল। বুঝলাম না। শুধু এটুকু কানে এল, “মা’কে নিয়ে আসছি। আমাকে ছাড়া বিয়ে করবি না খবরদার!” ভেবলা বনে গেলাম।
তখন থেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। আপু, মামী একের পর এক শাড়ি আনছে। গায়ের ওপর রাখছে। একটা হয়ত আপুর পছন্দ হলো। মামীর হয় না। মামীর হলে আপুর হয় না। একটায় রেনু খালার আপত্তি। মাঝখানে ওদের পছন্দের যাতাকলে আমি ছিবড়ে হই। শাড়ি শেষ পর্যন্ত পছন্দ হলো। এবার সাজা। ওদের সাথে নতুন উদ্যোক্তা যুক্ত হয়েছে। নিসা আর আন্টি। মামী শাড়ি পড়ায়। জ্ঞান দেয়। নিসা আর আপু সাজার কারবারে ব্যস্ত। জোরালো আলোচনা চলছে। ত্যক্ত হয়ে বললাম ব্রাইডাল সাজতে হবে না। সাদামাটা বিয়ে। সাজও সাদামাটাই হোক। নিসা কঠিন চোখে তাকায়, “তুই কিছু বুঝিস?”
তীর্যক চোখে নিসার দিকে তাকালাম, “ভাব নিচ্ছিস যেন একশটা বিয়ে করে ফেলেছিস! এক্সপেরিয়েন্স অনেক।”
নিসা ভেবাচেকা খেয়ে যায়। মুহূর্তে রূপ পালটায়। বিজ্ঞের ভাব নেয়, বলে, “দেখেছি। এসবে দেখলেই চলে!”
তখন বাজছে দশটা। খোদা মালুম আমার দুই ভাই কোথা থেকে কাজি জোগাড় করেছে! সাজানো শেষ। নিসা সামনে চোখ বড় বড় করে বসে। দুহাত গালে রাখা। মুহূর্ত পর পর বলছে, “আই কান্ট বিলিভ! তোর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে!”
রুমে আর কেউ নেই। বিয়ে ব্যাপারটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম দেখছি ততটাই জটিল। এখন আমার ভয় করছে। পেটের ভেতর গুড়্গুড় করছে। মনে হচ্ছে টাইম মেশিনে কিছু সময় পিছিয়ে যাই। পাগলামি জেদটা না ধরি।
বসার ঘরে যখন আনা হলো। জিসান ভাইয়ের দিকে একবার আড়চোখে তাকালাম। তিনি শক্ত হয়ে বসে আছেন। অনুভূতিশূন্য পুতুল যেন। চোখ পিটপিট করে তাকালেন। চোখে মুখের অভিব্যক্তিতে অবিশ্বাস। আশপাশের কণ্ঠ শুনে চমকে আশপাশে তাকাই। এত রাতেও নেহা আপুরা এসে হাজির। জিসান ভাইয়ের কিছু বন্ধু এসেছে। ইফাজও। অবাক হলাম। ও ক্লিষ্ট হাসল। দৃষ্টি ঘুরে আবার জিসান ভাইয়ের ওপর পরে। উনার চোখে তখনও অবিশ্বাস। তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে। কাজি বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।
বিয়ে শেষে চারপাশে হৈ হুল্লোড় পরল। নেহা আপু যখন সামনে এল লজ্জায় গুটিয়ে গেলাম। আপু খিলখিলিয়ে হাসে। আমার দু গাল টেনে দেয়, বলে, “কি পিচ্চি শেষমেশ বাইপাস ধরলা! আমার আগেই বিয়ে করে ফেললা! আচ্ছা তুমি আমার বিয়েতে কনেপক্ষ হবা না বর?” বিয়েটা উত্তেজনায়, ভয়ে সম্পূর্ণ মাথার ওপর দিয়ে গেছে। এতো অল্প সময়ে আমাদের বিয়ে হয়ে গেল? চিন্তায় আপুর মশকরা ধরতে পারি না। নিরুত্তর তাকিয়ে থাকি। তিনি সবার দৃষ্টির অগোচরে একসময় হাত চেপে ধরেন। বিস্মিত হয়ে তাকাই।
“তুই সত্যিই আজকে আমার হলি?”
~চলবে
#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল
/পর্ব ১৭/
শক্তচোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি, সামনে হাত বাড়াই, “না মিথ্যে মিথ্যে আপনার হলাম। দেন আমার আমিকে ফেরত দেন!”
তিনি এবার মোহময় হাসেন। বাড়ানো হাতে নিজের হাত রেখে তা উল্টো করেন। গালে ঘষেন। দাঁড়ির খোচা লাগল। হেসে উঠি। তিনি সেই হাতটায় গাঢ় ঠোঁট ছোয়ান।
“ওয়াও, দারূণ!”
চমকে তাকালাম। নিসা সামনে দাঁড়িয়ে। মুখের সামনে ক্যামেরা ধরা। ক্যামেরা নামাল। ফিচেল হেসে বলল, “কেন্ডিডটা দারূণ আসছে।”
জিসানের মুঠো থেকে তড়িতে হাত ছাড়াই। তিনি বললেন, “দেখি। কি তুললে?”
নিসা সাগ্রহে ক্যামেরা এগিয়ে দিল। প্রথম ছবিটায় আমি হাত বাড়িয়ে। ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি ঠোঁট টিপে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে। দ্বিতীয়টায় তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বাড়ানো হাতটা গালে ছুয়িয়ে। আমি হাসছি। তৃতীয়টা আমার হাতটায় তিনি হালকা কুজো হয়ে ঠোঁট ছোয়াচ্ছেন। আমি ঠোঁট টিপে হাসি সামলানোর বৃথা চেষ্টা করায় গাল দুটো হালকা ফুলেছে। তিনি প্রসন্ন মুখে একবার আমাকে দেখলেন। তৃপ্ত হাসিতে বললেন, “ছবি তো দারূণ তুলো তুমি!”
নিসা গর্বিত হাসে। কিছু বলতে চায়। তার আগেই নিশান ভাইয়া কোথা থেকে দলছুট হলেন। জিসানের পাশে সোফার হাতলে বসলেন। বললেন, “বেয়ান চশমা, আপনাকে না বললাম আমার কিছু ছবি তুলেন! আপনি অমন পালিয়ে এলেন যে?”
নিসার হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি মুহূর্তে পাল্টায়। চোখে খেলে ক্ষুব্ধ দৃষ্টি। মেয়েটা চঞ্চল হাতে নাকের ডগায় চশমাটা ঠিক করল। নিশান ভাইয়া নিরস। জিসানের কাধে হাত রাখেন। থুতনি নাড়ান। করুণাভরে বলেন, “তোদের একটু স্পেসও দিল না এইসব থিক হেডেড মেয়েরা। ইস, মুখ কি শুকিয়ে গেছে তোর!”
জিসান হেসে নিশান ভাইয়ার হাতটা ঝারা মেরে সরান। নিসা ফুসে উঠে, “আপনার আর কাজ নেই? যেখানেই যাচ্ছি পেছন পেছন ঘুরছেন!”
আমি আর জিসান নির্বাক দৃষ্টা। ও, জিসানকে নির্বাক দৃষ্টা বলা যায় না। বলা যায় সক্রিয় দ্রষ্টা। তিনি আমার হাতটা নাড়ছেন আপন খেয়ালে। কখনো আঙুলের ভাজে আঙুল ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। কখনো ওদের দিকে তাকাচ্ছেন। তাকানোর ভঙ্গিতে উদাস অবহেলা। নিশান ভাইয়া বিস্মিত হয়, “আপনি নিজেকে এত গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন? ইন্দ্রিয়ের লজ্জা অনুভূতি সহিসালামত আছে তো?”
“একদম অপমান করবেন না আমায়! গায়ে পরে যে অপমান করতে আসেন আপনারই ভদ্রতা জ্ঞান নেই!”
ভাইয়া বাকা হাসেন, “অপমানিত হতে যদিও আপনার যোগ্যতা নেই! তবে অপমান বোধ হতে নিউরনের তারতুর একটু আছে দেখি।”
নিসা নাক, মুখ ফোলায়। দুর্দম্য আক্রোশ নিয়ে বলে, “আপনি চরম অসভ্য একজন! লম্পট! বখাটে! একদম যাচ্ছেতাই!”
নিসা দ্রুতপদে সামনে থেকে চলে গেল। নিশান ভাইয়া হাসতে হাসতে উঠে পরেন।
আমাদের বিয়ের মতো আমার আধা শ্বশুরবাড়িতে পদার্পণও হলো কিছু অদ্ভুতভাবে। বরযাত্রীর সাথে কখনো কনের পুরো পরিবার শ্বশুরবাড়ি আসে না। কিন্তু আমার পরিবার এল। ঘরদোর তালা দিয়ে এল। যাকে বলে মাঞ্জা মেরে আসা। সিড়িতে জন কোলাহল আর ভিড়ে ছোটখাটো বিক্ষোভ মিছিল পরে গেল। এ নিয়েও হাসাহাসি। আসার সময় নিশান ভাইয়া তার বাঁশ গলায় সবার মাঝে জোর স্বরে বলে উঠলেন, “ইতিহাসে এটাই হয়ত অদ্ভুত বরযাত্রী। সিড়ি বেয়ে নিচে নামল। বিয়ে করল। বউ নিয়ে আবার সিড়ি বেয়ে ওপরে এল। কোন যানবাহন ভাড়া করতে হল না। সুষ্ঠু এবং পরিকল্পিতভাবে আমরা বিশাল জনতাকে হ্যান্ডেল করলাম!” একটু থেমে, “বরের নাম অবশ্যই গিনিসবুকে উঠে যাওয়া উচিত। সে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে সুদূর শ্বশুরবাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে বউকে কোলে বহন করে।”
চারধারে হাসির গুঞ্জন পরে। নিকিতার সাথে নিসার ভাব জমেছে খুব। আমাদের আগে আগে তারা সিড়ি বেয়ে উঠছিল। নিশান ভাইয়ের দিকে কথাপ্রেক্ষিতে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, অসন্তুষ্ট মৃদু কণ্ঠে বলে, “এই ছেলে পাগল!”
সোফায় তখন থেকে বসে আছি। আমাকে ঘেরাও করে জিসানের কাজিন। এদের মধ্যে পরিচিত মুখ শুধু নেহা আপু, নিকিতা আর নিসা। বাকিদের কাউকে চিনি না। প্রয়োজনও হচ্ছে না। যে যে সময়ে গল্প বলছে সে সময় উৎসুক চোখ তাতে আবদ্ধ করছি। আশপাশে ওরা হাসলে আমিও ঠোঁট জোর হাসি ফুটাচ্ছি। একসময় অসহ্য হয়ে উঠলাম। বাইরে তা প্রকাশও করা যাচ্ছে না। সেটা আরও তীব্র অসহ্যকর মুহূর্ত! নিকিতা একসময় সরে এল। বলল, “তোমার কি খারাপ লাগছে?”
অসহায় মুখে তার দিকে তাকাই। মেয়েটি বুদ্ধিমান। বুঝে নিল। রুমে আসলে হাফ ছাড়লাম। মেয়েটা মৃদু হাসে। জটলা নিয়ে চলে যায়। শুরু হলো অপেক্ষা। অপেক্ষায় কোন সময় ঝিমোতে শুরু করলাম নিজেই টের পেলাম না। জিসানের তীব্র কণ্ঠে তন্দ্রা ছুটে। তিনি সামনে বসে ধমকান, “এখনো সং সেজে আছিস কেন? ঘুম পাচ্ছে চেঞ্জ করে ঘুমিয়ে যেতি!”
সদ্য তন্দ্রা কাটায় বিরক্তিও ঠিকঠাক প্রকাশ করতে পারলাম না। তিনি বললেন, “যা চেঞ্জ করে আয়।”
আদেশ পালন করি। ট্রলি খুলে ধাধায় পরে যাই। বললেন, “ওখানে আবার ঘষটে বসেছিস কেন?”
অসহায়মুখে উনার দিকে ফিরি, “কি পরব? শাড়ি না কামিজ? নাকি টিশার্ট আর ট্রাউজার?”
উনার মুখে চরম বিরক্তি ফুটল। বললেন, “যেটায় তুই কমফোর্ট বেশি সেটাই পরবি। এগুলো জিজ্ঞেস করতে হয়!”
“না মানে বিয়ে হয়েছে আপনার আপত্তি থাকতে পারে তাই..”
“হয়েছে। একদিনেই সংসারী হতে হবে না।”
পারমিট পেয়ে টিশার্ট আর ট্রাউজারই নিলাম। ফ্রেশ হয়ে বেরই। তিনি চেঞ্জ করে ফেলেছেন। সটান কপালে হাত রেখে চোখ বুজে। হয়ত ঘুমিয়ে গেছেন। কাছে এসে উনার মুখের ওপর ঝুকি। মুখমন্ডল গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করি। একহাতে ভর রেখে দেখছিলাম। তিনি হঠাৎ দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। আচমকা চোখ মেললেন, “আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হচ্ছে?”
“লুকিয়ে কোথায়? প্রকাশ্যেই দেখছিলাম।”
তিনি অপলক তাকিয়ে রইলেন। তৃপ্ত হাসিতে মুখটা ঝলমলে। সুখী কণ্ঠ আসে, “তুই এখন থেকে সর্বক্ষণ আমার সাথে থাকবি তাই না? যখন দেখতে মন চাইবে তখুনি দেখব। কোন লুকোছাপার দরকার নেই। সবসময় জড়িয়ে থাকলেও কেউ দেখে ফেলবে সে কেলেংকারীর ভয় নেই।”
“বললেই হলো। আপনি কি সবার মাঝখানে আমাকে জড়িয়ে থাকবেন!?”
“মন চাইলে থাকব! আটকাবে কে? আমার বিয়ে করা বউকে আমি যেভাবে ইচ্ছে যখন ইচ্ছে জড়িয়ে থাকব। তাতে কার কি? কারোর কিছু থাকলেও জিসান থোরাই পরোয়া করে! এই শুন, রাতে এভাবেই তোকে ঝাপ্টে ঘুমাব। শীত, গ্রীষ্ণ যাই হোক! বর্ষায় একই চাদরে থেকে দুজনে বৃষ্টি বিলাসী হব। হুটহাট ব্যস্ত জীবনকে ছুটি দিব। কোলাহল ছেড়ে নির্জনতায় হারাব। কখনো তুচ্ছ কিন্তু সুখমিশ্রিত গল্পগুলোয় মেতে সারা রাত জাগব। আনলিমিটেড ঝগড়া, খুনসুটি, রোমান্স চলবে! আহা, জীবন কত সুন্দর!”
উনার চোখে মুখে স্বপ্নিল হাসি। পূর্ণাঙ্গ একজন সুখী মানুষের অভিব্যক্তি। একসময় তিনি ঘুমিয়ে যান। আমার ঘুম আসে না। তীব্র আনন্দের অনুভূতিতে জেগে থাকি। উনার বুকে পরে একদৃষ্টি মুখপানে চেয়ে থাকি। স্নিগ্ধ মুখমন্ডল প্ররোচিত করে আলতো হাত বুলিয়ে দিতে। নরম খচিত ওই দাড়ি কি এক অদম্য মোহনীয় আবেশে টানে। উনার হাতের বন্ধন ছেড়ে উঠতে যাই। তিনি হালকা নড়লেন যেন। হাতের বন্ধন আরও শক্ত করে পরে রইলেন। আশ্চর্য ঘুমের মধ্যেও কারোর সচেতন ইন্দ্রিয় জেগে থাকে!?
চোখ খুলেই জিসানের মুখটা সরাসরি দেখলাম। চোখ আবার বুজে নেই। তিনি গালে আলতো চাপড়ান, “এই উঠ। পরে পরে আর কত ঘুমাবি?”
“সরুন। আপনি সব সময়ই বিরক্ত করেন!”
কিছু মুহূর্ত চুপ থেকে, “আরে উঠ আমার বউ! কাল রাতে কিছু করলামই না তাই এত ঘুমোচ্ছিস! না জানি করলে কত ঘুমাতি!”
ঘুম ছুটে গেল। বিরক্তি নিয়ে উঠে বসলাম। বললাম, “সকাল সকালেও আপনার মুখের লাগাম থাকে না!”
তিনি ঠোঁট টিপে তাকিয়ে থাকেন। গালের দুপাশের গর্তটা ফুটে উঠে। বলেন, “লাগামহীন নাহলে পরে ভড়কে যাবি! কেঁদেকেটে বড়দের বলে দিবি! মানসম্মান কিছু থাকবে?”
বালিশ ছুড়ে মারলাম। তিনি সেটা ধরলেন, বললেন, “শাড়ি নিয়ে যা। মানুষজন আসবে তোকে দেখতে।”
ভ্রু কুচকাই, বলি, “কে আসবে দেখতে? আমাকে এখানকার মানুষজন ছোট থেকেই দেখে আসছে।”
ছোট্ট এক শ্বাস ফেললেন, “আমার আত্মীয়। পুরো পরিবার আসবে!”
চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ভিতু কণ্ঠে বলি, “ইফাজের পরিবারও?”
“ভয় পাচ্ছিস?”
“ঐ একটু।”
“শুধু শুধু ভয় খাস না তো। ইফাজের মা বোকাসোকা হলেও মানুষটা মাটির। চমৎকার একজন!”
“কিন্তু ওরা কি বলবে? ওদেরই এক ছেলেকে রিজেক্ট করে আরেক ছেলেকে বিয়ে করতে পাগল হয়ে গেছিলাম!”
তিনি গাল দুহাতে তুলে কপালে ঠোঁট ছোয়ান। ভরসাপূর্ণ হাসেন। মুগ্ধতায় ভরসা পেলাম। বললেন, “না ভাববেন না। আমার পরিবার এত চিপ মেন্টালিটির নয়।”
রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেই। নিকিতা, নেহা আপু সবাই কাজে লেগে গেছে। এত রাধুনি দেখে কিছুটা বিস্মিত, কিছুটা লজ্জিত বোধ করি। জড়তা নিয়ে আন্টির কাছে যাই। তিনি রুটি বেলছিলেন। মুখ তুলে চাইলেন। বললেন, “উঠে গেছ?”
সম্মতিতে মাথা নাড়ি, বলি, “এত রাধুনি যে?”
“অনেক মানুষ এসেছে। কাল কেউ তো যায়নি। ওদেরই নাস্তা বানানো হচ্ছে।”
জোরাজোরি করে আমিও অংশ নিলাম। আন্টি ড্রয়িং রুমের কোণে পাঠালেন আমাকে। সেখানে রুটি বেলার জন্য ছোটখাটো টেবিল আছে। বেলতে সুবিধে হবে। সঙ্গী হলো নিসা। মেয়েটি কাল সারারাত নিকিতাদের সাথে জেগেছে। তবু চোখে মুখে ক্লান্তি নেই। যেন এডভেঞ্চারে মত্ত! রুটি বেলছি তখন। নিসা কাল রাতের একেকজনের গল্প করছে। কপালের কিছু ছোট চুল এসে বিরক্ত করছে। হাত দিয়ে সরাচ্ছি। মনে হচ্ছে কপালে, গালে আটা লেপ্টে গেছে। কিন্তু নিসা কিছু বলছে না। আশ্বাস মিলল। হয়ত লাগেনি। হঠাৎ মনে হলো কোমড়ে শীতল স্পর্শ পেলাম। তড়িতে পাশ ফিরি। জিসান আমার কোমরে গোজা আঁচল ছেড়ে দিয়েছেন। চোখ রাঙিয়ে বললাম, “কি করছেন কি?”
তিনি কাছঘেষে দাঁড়ান। ধীর মৃদুকণ্ঠে বলেন, “তোর লোশনের বোতলে মোড়ক রাখা যায় না? আরেকবার মোড়ক সরলে রাত্রে বোতলের হাওয়া বের করব!”
বিস্মিত, স্তব্ধ চোখজোড়াকে পাত্তা না দিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি নিজের দিকে তাকালাম। লোশনের বোতল তো সাথে রাখিনি! খিলখিলানো শব্দে নিসা হাসতে শুরু করেছে। হাসতে হাসতে বেতাল হয়ে একসময় চেয়ার থেকে পরে গেল। কিছুক্ষণ বন্ধ রইল হাসি। থমকানো ভাব কাটিয়ে মেয়েটা নিচে থেকেই সশব্দে হাসতে থাকে। বাড়িতে থাকা অতিথিরা, জিসান ভাইয়ের বন্ধুরা আরও অনেকে কৌতুহলে দেখছেন। মেয়েটি মাটিতে পরেও পাগলের মতো হাসছে। বিরক্ত লাগল, ধমকালাম, “এই উঠ ওরা দেখছে।”
নিসার হাসি থামে না। বরং হাসিতে চোখ পানি আসে। ওকে টেনে উঠালাম। মেয়েটা চেয়ারে বসে মুখ ঢেকে হাসতে লাগল।
কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বাচ্চা-কাচ্চা ইয়াং স্টাররা তখন আড্ডায় বসেছি। বসার ধরন বৃত্তের মতো। নিকিতা, নিসার মাঝখানে আমি। জিসান আমার সরাসরি। আড্ডায় জিসানের কাজিন বেশি। হৈ হল্লোড়ে একসময় কথা উঠল। ওরা আজকেই নেহা আপুদের বাসায় চলে যাবে। এখন জিসান আর আমাকে নিয়ে প্রশ্ন। আমরা কি করব। বললাম, “আমি আজকে যেতে পারব না। আপন ভাইয়ের বিয়েতে না থাকলে হয়?”
নেহা আপু জিসানের দিকে তাকায়। বিস্ময়ে বলে, “শাফি তাহলে তোমাকে রেখে যাবে?”
আমি সম্মতিতে মাথা নাড়ি। কিন্তু জিসান ভ্রু কুচকান, বলেন, “আমি কেন যেতে যাব?”
নেহা আপু ফুসে উঠে। গাল ফোলায়, “বিয়ে করতেই একদিনে স্ত্রৈণ হয়ে গেলি! এখন আপনও পর! বরপক্ষ হবি তাই না?”
জিসান সোফায় হেলে নিমগ্নচিত্তে ফোন চালাচ্ছিলেন। ফোন থেকে নিতান্ত অবহেলায় মুখ তুলে চায়লেন। ধীর কিন্তু স্পষ্ট আক্ষেপে বললেন, “আমি বলেছি আমি বরপক্ষ? যা তোর বিয়েতে যাবই না আমি।”
নিকিতা উৎসুক চোখে তাকায়। বলে, “তাহলে তুই কোন পক্ষ?”
জিসানের ভাবলেশহীন উত্তর, “থার্ড পক্ষ!”
উনার কাজিনদের সম্মিলিত গুঞ্জন উঠল, “থার্ড পক্ষ? এই থার্ড পক্ষটা আবার কি?”
“যে পক্ষ রেফারি করে। দুপক্ষের সমতায় বিশ্বাসী! না কনে পক্ষ। না বর।”
~চলবে❤️