তোমাতে,পর্ব:১২+১৩

#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল

/পর্ব ১২/

“হ্যালো।”

“কি হয়েছে? এমন ঝাঝ নিয়ে কথা বলছিস কেন?”

গাল ফোলাই, “কিছু হয়নি!”

“ঢং করবি না! কি হয়েছে সেটা বল?”

এবার আমার কান্না পেল। ইদানিং আমার কারনে অকারনে কান্না পায়। খুশিতে কান্না পায়, দুঃখে কান্না পায়, রাগেও কান্না পায়! ফোঁপাতে শুরু করি। তিনি বিব্রত, অস্থির হয়ে উঠেন, “এই কি হয়েছে তোর? কেউ বকেছে? তিয়াস কিছু বলেছে?”

কেঁদে কেঁদে নিশব্দে মাথা দুদিকে নাড়ি। কেউ কিছু বলেনি। তিনি ধমকে উঠেন, “এই ঝুম! জবাব দিচ্ছিস না কেন?”

কান্নার শব্দ বেশি হতে থাকে। অস্পষ্ট কণ্ঠে বলি, “জবাব দিয়েছি তো বকছেন কেন?”

“মুশকিল! আচ্ছা আমি আসছি বাসায়।”

“আপনি না হসপিটালে?”

“সময় নিয়ে আসব।”

“দ্রুত আসুন তাহলে।”

কল কেটে যায়। আমি চোখ মুছে উঠে দাঁড়াই। ইচ্ছে চোখে-মুখে পানি ছিটাব। দরজার দিকে চোখ পরতে বিস্মিত হয়ে গেলাম। মামী দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবাচেকা খাই। চমকে যাই। উনি কি শুনেছেন আমার কথাগুলো? মামী বিস্মিত হয়ে এগিয়ে আসেন, “কাঁদছিস কেন? আর কার সাথে কথা হলো?”

আমি ভেবাচেকা খেয়ে মাথা নিচু করে থাকি। মামী কাছে এসে দাঁড়ান। থুতনি ধরে মুখটা তুলেন। কোমল কণ্ঠে বলেন, “কি হয়েছে মা? আমাকে বল।”

মাতৃমূর্তি এই অর্ধবয়স্ক মানুষটিকে মিথ্যে বলতে বাধল। আমার জীবনে মাতৃস্নেহ পাবার আফসোস, আকুলতা বিন্দুমাত্র নেই হয়ত এই মানুষগুলোর জন্য। যাদেরকে আকড়ে থাকায় কোন কালো ঝরই আঘাত হানেনি। বরং বাধ্য হয়েছে দূর থেকে পাশ কাটাতে। মামী পরম স্নেহে হাত বুলিয়ে দেন। বলেন, “বলবি না?”

মস্তিষ্কের জট হাতড়ে এক যুক্তি মুহূর্তে দাঁড় করালাম, “আমার বান্ধবীরা কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছে ট্যুরে। সবাই একজোট মাঝখানে আমিই যেতে পারব না।”

বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করল। আদো যুক্তিটা বিশ্বাসযোগ্য হল? মামী আলতো হাসেন, “এর জন্য কাঁদতে আছে? তাছাড়া কাকে বলেছিলি ব্যাপারটা? কে মানা করল?”

মামীর দিকে সরাসরি তাকাই। অভিমানী কণ্ঠে বলি, “আমার পুরো জীবনটাই রেস্ট্রিকশন। কলেজ, স্কুল, কোচিংয়ে সবসময় কেউ না কেউ নিয়ে গিয়েছে। যেন একা না যাই। প্রত্যেকবার স্কুল, কলেজ থেকে পিকনিকে যেত আমার সেখানে যাওয়ার পার্মিশন থাকত না। বান্ধবীদের বাসায় যেতে হলেও ভাইয়া নয় আপু যাচ্ছে…”

“এসব তোর নিরাপত্তার জন্য করে। তোর ভাই/আপু কি খারাপ চাইবে?”

“অন্যদের এমন নিয়ম না। আমারই কেন?”

“সবারই থাকা প্রয়োজন। কার কখন কি হয় বলা মুশকিল। এর জন্য কাঁদছিলি?”

মাথা নিচু করে সম্মতি দেই। মামী বলেন, “একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। নইলে ভাইয়ের বিয়ে মিস করতি।”

অবাক চোখে তাকালাম, “মানে?”

“আজকে তোর ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাব। নেহা না কি নাম! তোর ভাই যে পছন্দ করে রেখেছে? ওর জন্য পাত্রপক্ষ আসছে যাচ্ছে বারবার। তোর ভাইয়া পাগল হয়ে গেছে!”

“আজকেই যাব? তোমরা একটা দিন রেস্ট নিবে না?”

“আর রেস্ট! তোর ভাই কি ছাড়ে?”

খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। মামীকে জড়িয়ে বললাম, “ভাইয়ার বিয়ে কি এই সপ্তাহেই?”

“কি জানি! ওরা সম্মতি দিলে হয়ে যেতে পারে।”

একগাল হাসি, “আমিও যাব মেয়ে দেখতে?”

মামী গাল টেনে দেন, “অবশ্যই। বরের একমাত্র বোন!”

“লেহেঙ্গা পরব তাহলে।”

“আজকে?”

“হ্যা। কেন পরা যাবে না?”

মামী কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কি যেন ভাবলেন। আপনমনে হেসে মাথা নাড়েন। আমি বাথরুমে এসে গেলাম। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নায় তাকালাম। চোখের কোল একটুতেই ফুলে উঠেছে। কেমন যেন লাগছে চেহেরাটা! পাত্তা না দিয়ে বাইরে বেরই। মামী চলে গেছেন। টেবিলে জুসের গ্লাস ঢাকা। মৃদু হেসে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াই। কোমড়ে হঠাৎ শীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। চমকে পেছনে তাকাই। জিসান ভাই ক্লান্ত হাসেন। আমাকে বুকের কাছে দাঁড় করিয়ে বলেন, “কাঁদছিলি কেন?”

“দরজা খোলা। কেউ এসে পরবে।”

“আসুক। পেয়ার কিয়া তো ডারনা কিয়া?”

বিস্ময়ে তাকাই। চোখ টিপ মারলেন। উনার মাথার তার তুর হয়ত দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! স্থান, কাল বোঝা বাদ দিচ্ছেন। সরে দাঁড়াই। দরজাটা লাগিয়ে এসে বলি, “আপনার বুদ্ধিসুদ্ধি দিন দিন কমে যাচ্ছে!”

“এটা আমার জানা কথা। অজানাটা বল!”

তিনি চেয়ারে বসে যান। ক্লান্ত দৃষ্টি টেবিলের জুসের গ্লাসটার ওপর পরল। জিজ্ঞেসা না করে তা গোগ্রাসে শেষ করলেন। ঠোঁট মুছে নিয়ে বললেন, “কি রে বল!”

উনার কাছাকাছি টেবিলে ভর রেখে দাঁড়াই। লকেটটা দেখিয়ে বলি, “এটা কি লিখিয়েছেন আপনি?”

তিনি কিছুক্ষণ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকেন আমার দিকে। লকেটের দিকে আর তাকান না। অসন্তোষ নিয়ে বলেন, “কেন তুই কথাটা জানিস না? এর জন্য ওভাবে কাঁদতে হয়?”

বিরক্ত হলাম, “লেখাটা একবার পড়ে দেখুন!”

তিনি ভীষণ বিরক্ত। ফর্সা চেহেরায় বিরক্তিটাও খাপে খাপ মিলে যায়। ক্লান্তিমাখা ঐ ঘামের বিন্দু ফোটারাও যেন সে সৌন্দর্যে ঝলসে যায়। মাঝে মাঝে আমার হিংসে হয়। চরম হিংসে হয়। তিনি কেন এত সুন্দর? উনার চেহেরা থাকবে সাদামাটা একহারা। হয়ত তাতে একটু বিশেষত্ব লুকিয়ে থাকবে। যা একান্ত আমার সামনে প্রকাশ পাবে। অন্য কারোর জন্য তার প্রকাশ দ্বার বন্ধ। তিনি আলতো হাতে ঝাকরা চুলগুলো একবার পেছনে পাঠান। হাত বারিয়ে লকেটটা নেন। বিস্মিত দৃষ্টি ফুটে উঠে। সাথে আক্রোশ! কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে গোল চশমাটা বের করলেন। পরলেন। মুখটা আরও ক্রুব্ধ হলো।

“এটা কে লিখিয়েছে?”

“আপনি দিয়েছেন। তাহলে আপনারই লেখানো!”

“না আমি এটা লিখতে বলিনি। কারেকশনটাই বলেছিলাম। তোমাকে’র জায়গায় ওরা তোমাতে লিখে দিয়েছে!”

কাহিনীটা বুঝে আমি অসহায় মুখে টেবিলের ওপর বসে যায়। উনার মুখটা এখন ছোট হয়ে এসেছে। মন খারাপ কণ্ঠে বলেন, “গিফট তোর পছন্দ হয়নি তাই না?”

“এই না। কে বলল কথাটা?”

“কাঁদছিলি যে!? এরজন্যই হয়ত। মন খারাপ করিস না। এ মাসের বেতনে ত্রুটিহীনটা কিনে দিব।”

উনার মন খারাপ চেহেরাটা দেখে মায়া হলো। নরম চুলের ভাজে আঙুল চালিয়ে বললাম, “মন খারাপ আমার সেজন্য হয়নি। আপনি বাংলায় কিভাবে ভুল করলেন সেটাতে হয়েছিল। লকেটের ছবির জায়গায় কেন দুটোই আমার ছবি সেটাতে হয়েছিল। ঐগুলো বাদে আপনার প্রথম গিফট দারূণ।”

মন খারাপের মেঘ তবু সরে না। বরং ক্লান্ত চেহেরায় আরও ক্লান্তি নামে। বলেন, “স্বান্তনা দিস না। পছন্দ না হলে খুলে রাখ। এ মাসের টাকায় কিনে দিব।”

“আপনি বেশি বুঝেন সবসময়।”

“তাহলে ওমন অরে কাঁদছিলি কেন?”

মাথা নিচু করলাম, “ভেবেছি আপনি ইচ্ছে করে লিখিয়েছেন।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলেন, “রেখে দিস কোথাও। ফেলবি না আবার। আমার প্রথম বেতনে কেনা। ত্রুটিহীনটা নাহয় মাসশেষে কিনে দিব।”

উনার দুহাত টেনে ধরি, “লাগবে না। ত্রুটিটাই অসাধারণ।”

তিনি রেগে তাকান। আমার ভয় লাগে না। বরং ভাল লাগায় বুদ হই আরও। মানুষটার কাছে আমি ঠিক কতটা স্পেশাল ভাবতেই সুখব্যাথা পাক খেল। কানে ছাড়া ছাড়াভাবে বারি খেতে লাগল, “প্রথম বেতনে কেনা” শব্দগুলো। বললাম, “সব সময় ত্রুটিহীনতা চাইতে নাই। আমারও চাই না।আমার ত্রুটিপূর্ণ প্রেমিকের দেয়া ত্রুটিপূর্ণ ছোট ছোট যে ভালবাসাগুলো পাই ওরাই আমার প্রিয় আবেশ। হঠাৎ ভুলে প্রিয় শাস্তির জন্য করা প্রিয় বোকামি।”

উনার দৃষ্টি নম্র হলো। হাত টেনে বুকে জড়িয়ে নিলেন। কপালে গাঢ় ঠোঁট ছুয়িয়ে বললেন, “প্রেমিকা আমার কাব্যিক বটে!”

দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি, “প্রেমিকাও প্রচন্ড ভালবাসি তোমাতে!”

তিনি কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। একটু পর নিশব্দে আমাকেসহ দুলে দুলে হাসতে লাগলেন। উনার বুকের ধুকধুকানি আমার কানে ছন্দ মেলে দেয়। সে ছন্দে তাল মেলায় আমার অবুঝ মন।

গাড়ি থেকে নেমে লেহেংগা দুহাতে তুলে হাঁটতে থাকি। সবাই গেটের কাছে। আমি আর তিয়াস ভাইয়া পেছনে পরে আছি। লেহেংগা দুহাতে হাঁটছি তাই গতি কম।

“এমন স্কার্ট পরে আসতে গেলি কেন? কনে বাড়ির লোকেরা বলবে মেয়ে দেখতে এসে রেডিমেড আরেক কনে গছাতে নিয়ে এসেছি।”

“ভাইয়া!”

পাথুরে পথ ধরে ভাইয়া ফোন ঘাটতে থাকে। আমার চোখ রাঙানিতে আর ফিরে চায় না। আপুও বেশ বিরক্ত আমার প্রতি। আমার কি দোষ? ইচ্ছে হয়েছে পূরণ করব না? আশ্চর্য!

নেহা আপুরদের বাসার কাছাকাছি আসতে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে দেখলাম। নেহা আপুর চাচা হয়ত। এলাকাটা মফস্বলি। আশপাশে গ্রাম গ্রাম ছোয়া। বুনো ফুলের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লেগেছিল তখন। এত সবুজ দেখলে চোখ, হৃদয় আপনাই জুড়ায়।

~চলবে❤️

#তোমাতে
লেখনীতে~আগ্নেস মার্টেল

/পর্ব ১৩/

নেহা আপুদের বাড়ি দোতলা। তার চারদিক ঘেরাও করে পাঁচিল তুলে দেয়া। ভেতরে বাগান। রঙ বেরঙের ফুলগুলো থোকায় থোকায় এখানে সেখানে ফুটে আছে। ঢোকার রাস্তা ইটের। কোমল বাতাসে উপরের দিকে তাকাই। মনে হলো কেউ দ্রুত সরে পরল। অদ্ভুত! আমাদেরকে বসার রুমটায় বেশ আপ্যায়ন করে বসালো। ঢোকার সময় আমাকে তীব্র লজ্জায় পরতে হয়েছে। গোল গাল চেহেরার এক আন্টি আমাকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সবাই যখন ভেতরে ঢুকছি তিনি আমার দিকে সরে আসেন। থুতনি ধরে বলেন, “তুমি রাধিকার বিয়েতে গেছিলে না?”

কিছু না বুঝে মাথা নাড়লাম। তিনি মিষ্টি হাসলেন। আরও দৃঢ় চোখে পর্যবেক্ষণ শুরু করলেন। আমার পরিবার তখন কিছুদূরে দাঁড়িয়ে। তিনি বললেন, “সেদিন তোমাকে ইফাজের পেছনে ঘুরঘুর করতে দেখেছিলাম।”

বজ্রাহত হই। চোখ পিটপিট করতে থাকি। লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে প্রমাদ গুনি। ছিঃ আমার পরিবার কি ভাববে! এই আন্টিরই বা আক্কেল কি! এত মানুষের মাঝে কেউ এ কথা বলে? উদ্ধার করল জাদরেল আপুটা। এগিয়ে এসে কাধে হাত রাখল। বলল, “বয়স কম। আবেগ বেশি। ভাললাগা আকসার হয়েই যায়!”

আন্টি তবু নিভলেন না। তৃপ্তচোখে চেয়ে রইলেন। বিভ্রান্ত হলাম। সাথে ক্ষুব্ধ। এই ইফাজও জিসান ভাইয়ের কাজিন!? নানু, মামাও ছিলেন। লজ্জায় আর তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিলো আমাকেই দেখতে এসেছে। আমার একপাশে মিশেল আপু আরেক পাশে তিয়াস ভাইয়া বসেছে। ভাইয়া ফোন পকেটে রেখে খোচা মারল। রেগে তাকালাম। সে হাসে, “এমন লজ্জা পাচ্ছিস কেন? ফ্রি হ। আবেগে ভাসা কমন ব্যাপার। বাবা, দাদা কেউ তোকে পরখ করছে না। কেউ বসেও নেই!”

কথায় একটু ভরসা পেলাম। আড়চোখে নানা, মামা’র দিকে তাকালাম। না কেউ আমার ব্যাপারে কৌতুহলী নয়। নিজেরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। স্বস্থির এক শ্বাস ফেলি। কিন্তু জমাট বাধা অস্বস্থিরা ঠায় বসে থাকে। একসময় নেহা আপু আসে। ট্রে হাতে পেছনে প্রায় একই চেহেরার আরেক মেয়ে। উচ্চতায় নেহা আপুর তুলনায় কিছু খাটো। রংটা আপুর থেকে একটু বেশি ফর্সা। তাদের পরে শিফা। ভেতরের রুমগুলোতে উঁকিঝুকি দিলাম। মনে হচ্ছে নেহা আপুর সব আত্মীয়রা এ বাড়িতে একজোট হয়েছেন। আপুর কাজিনদের কাউকে অবশ্য এখান থেকে চোখে পরছে না। তিয়াস ভাইয়ার ফিসফিসানো কণ্ঠ এল, “ঐ আকাশি স্কার্ট পরা পিচ্চিটা তোদের ভাড়াটে না? সকালে ছাদে দেখেছিলাম। ভুতের মতো বর্ডারে পা তুলে বসে গুনগুনাচ্ছিল।”

চোখ মেলে সামনে তাকাই। আশপাশে দৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে কিছুদূরে গিয়ে থামে। আমার দৃষ্টি সুচালো হয়। বলি, “হ্যা কেন?”

ভাইয়া ফিচেল হাসে। উত্তর দেয় না। সন্দিহান কণ্ঠে বলি, “জিসান ভাই যে আমাদের বিল্ডিংয়ে থাকেন এটা জানিস?”

“জানব না কেন? এটাও জানি তোর রুমে প্রায় প্রতিদিন আসে।”

আমি ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। ভাইয়া যেন মজা পেল। বলল, “কি রে তুই! আমার দুই ফ্রেন্ডের পেছনেই লেগেছিস! মনে হচ্ছে দুইটার মাথাই খেয়েছিস! কি দেখল তোর মধ্যে? শুটকি মার্কা চেহেরা, হাসলে শুধু দাঁত দেখা যায়, গায়ের রঙ জন্ডিসের রোগীর মতো এরকম কাউকে কারোর পছন্দ হয়!?”

রেগে গেলাম। ভাইয়ার বাহুতে কয়েক ঘা মারতে লাগলাম। ভাইয়া হেসে সেগুলো প্রতিহত করছিল।আপু পাশ থেকে চিমটি কাটে। হাত থেমে যায়। আপুর দিকে তাকালাই। আপু চোখ রাঙায়। গাল ফুলিয়ে হাত গুটিয়ে নিলাম। আপু কঠিনস্বরে ফিসফিসাল, “যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যাস! অবস্থা বুঝিস না?”

নিরুত্তর বসে থাকি। একসময় অসহ্য লাগতে থাকে। চুপ করে এতক্ষণ সং হয়ে বসে থাকা যায়? পা ইতিমধ্যে ঝিনঝিন করছে! উনারা বিয়ের কথাতেও এখনো যাননি। না বর কনেকে আলাদা কথা বলতে পাঠিয়েছেন! শিফারা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। শিফার দৃষ্টি একসময় আমার ওপর পরল। হাসল। হাত নেড়ে কাছে ডাকলাম। ভাইয়া আবার ফিসফিসায়, “মেয়েটার নাম কি রে?”

আড়চোখে তাকালাম, “শিফা!”

ভাইয়ার চোখ বিস্ফারিত হল। গুঙিয়ে বলল, “ও শাফির ছোটবোন?”

সম্মতিতে মাথা নাড়ি, “কেন চিনিস না?”

ভাইয়া অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। শিফা কাছে এসে দাঁড়াল। রিনরিনে কণ্ঠে বলল, “কি হয়েছে আপু?”

একবার বড়দের দিকে তাকালাম। বললাম, “আমাকে একটু ওয়াশরুম দেখিয়ে দিবা?”

মেয়েটা সম্মতিতে মাথা নাড়ল। তিয়াস ভাইয়ার সাথে একবার চোখাচোখি হল। সৌজন্যমূলক হাসল। মনে হলো ভাইয়া বজ্রাহত হয়ে গেছে। আমি মনে মনে হাসলাম। ড্রয়িং রুমটা পেরিয়ে বললাম, “ঐখানে বড়দের ভিড়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছি।”

“স্বাভাবিক। আমার বড় চাচা কথা শুরু করলে দুনিয়াদারী খেয়ালে রাখেন না।”

আশপাশ দেখতে দেখতে বলি, “পুরো পরিবার এসেছ তোমরা?”

“হ্যা।”

“জিসান ভাইও?”

শিফা ঠোঁট টিপে মাথা নাড়ল। ওর হাতে ব্যাগ ধরিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। বেরনোর সময় নিজেকে খুটিয়ে আয়নায় দেখি। লেহেঙ্গাই যা পরেছি। সেজে আসা হয়নি। কপালে লেহেঙ্গার রঙ মিলিয়ে টিপ! এটুকুই। এতে আন্টিটার ওমন গলিত দৃষ্টি পরবে আদো? ভাবনা ঝেরে ফেলি। আমার কি! বেরিয়ে চমকে উঠি। জিসান ভাই কিছুদূরে ওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ফোন টিপছেন। হাতে আমার ব্যাগ। দরজা খোলার শব্দে মুখ তুলে তাকালেন। বিস্ময়ে আশপাশে তাকাই। শিফা নেই। উনার স্থির দৃষ্টিতে হালকা ঢোক গিললাম।

“এটা কি পরেছিস? এদিক ওদিক হলেই ওড়নার নিচে কোমড় উঁকি দিচ্ছে!”

বিস্ময়ে কোমড়ের দিকে তাকাই। ঠিকই তো আছে। ব্যাগটা নিতে গেলাম। তিনি ব্যাগধরা হাতটা ওপরে তুলে দেন। তিনি উচ্চতায় আমার থেকে প্রায় এক ফুট বড়। হাতটা সামান্য একটু উঁচু করলেই জিনিসটা নিতে আমাকে লাফাতে হয়। আর এখন তো হাত সটান ওপরে তোলা! গাল ফুলিয়ে উনার দিকে তাকাই। তিনি একহাতে কোমড়ে চেপে আমাকে দেয়ালের দিকে হেলান দিয়ে নিজে সামনে এসে দাঁড়ান। চমকে যাই। ওয়াশরুমটা আলাদা। হয়ত কমন! যেখানে দাঁড়িয়ে আছি জায়গাটা খোলামেলা। ভয় লাগল। উনার হাতটা সরাতে গেলাম তিনি আরও শক্ত করে চেপে ধরেন। আফসোস হলো এত কেন হেংলা হলাম! আরেকটু মাংস থাকলে হয়ত শক্তিতে উনাকে টেক্কা দিতে পারতাম।

“তোকে শাড়ি পরতে বলেছিলাম!”

চঞ্চল দৃষ্টিজোড়া এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে। অচেনা পরিবেশে কেউ একবার এভাবে দেখে ফেললে? হাত দিয়ে মৃদু ধাক্কা দিলাম উনাকে। উনি টললেন না। বরং আরও ঝুকে আমার সামনের চুলগুলো এক আঙুলে প্যাচিয়ে খেলতে লাগলেন। ত্যক্ত কণ্ঠে বললাম, “সরুন। কেউ এসে পরলে খারাপ হবে!”

উনি কুটিল হাসেন। আমার সেদিনের ডায়লগটা রিপিট করেন, “আসুক। এসে ভাবুক কেলেংকারী হয়ে গেছে। ভেবে গ্রামের মানুষদের মতো বিয়ে দিয়ে দিক।”

চোখ পাকিয়ে তাকাই। তিনি ঠোঁট টিপে হাসেন। দৃষ্টিজোড়া আমার ঠোঁটে নিবদ্ধ। কেঁপে উঠে ধাক্কা দেই, “এটা আমাদের বিল্ডিংয়ের রুম বা ছাদ না! সরুন।”

“রোমান্সের স্পেশিফিক জায়গার দরকার হয় না।”

“পাগল!? এটা খোলামেলা জায়গা!”

ফিচেল হাসেন, “খোলামেলা না হলে কি অংশগ্রহণ করতি?”

“আপনার মুখের লাগাম দিন দিন বাজেভাবে খুলে দিচ্ছেন।”

“বাজের কি দেখলি প্রিয়া
এখনো ডাকিস জিসান ভাইয়া!”

আমি খিলখিলিয়ে হাসি। তিনি গালে টোকা দেন, “এটা কি পরে এসেছিস?”

“সরুন। উত্তর দিচ্ছি।”

“আমার মন আগেই নষ্ট করেছিস। তুই সামনে থাকলে এখন শুধু উদ্ভট ইচ্ছে জাগে। এক মিনিটও শান্ত থাকতে দেয় না। মন মস্তিষ্ক অকেজো করে যে বিন্দু পরিমাণ চিন্তাশক্তি রাখলি তাও কেড়ে নিতে চাস?”

কণ্ঠে মাদকতা আর চোখে অদ্ভুত সম্মোহন। উনার কণ্ঠ ক্রমশ ধীর হচ্ছিল। ফিসফিসিয়ে মুখ নিচু করছিলেন। আমি ভয়ে চোখ বড় বড় করে তাকাই। তিনি লাপাত্তা। ঠোঁট যখন ছুইছুই অবস্থা এমন সময়ে শিফার বিস্মিত কণ্ঠ আসল, “ভাইয়া!”

দুজন ছিটকে সরে যাই। থতমত খেয়ে সামনে তাকাই। শিফা আর নেহা আপুর ছোট বোনটা দাঁড়িয়ে। মেয়েটি ঠোঁট টিপে হাসছে। আর শিফা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় মাথা নুয়িয়ে দ্রুত জায়গা ত্যাগ করলাম। পেছন থেকে শিফার বিস্মিত কণ্ঠ আসতে থাকল, “কি করছিলি ভাইয়া?”

জিসান ভাইয়ের ত্যক্ত কণ্ঠ, “কিছু আর করতে দিলি? বড় হয়েছিস বুদ্ধিসুদ্ধি মাথায় ধর কিছু।”

লজ্জায় মন চায়ল মাটি ফুড়ে ক্ষণস্থায়ী অক্সিজেনযুক্ত কবরে ঢুকে যাই। মুড সুয়িংয়ে যখন সেখানে থাকার ইচ্ছে চলে যাবে আবার এই মাটির ওপর চলে আসব। কিন্তু হায়, আমার কাল্পনিক ইচ্ছে আর পূরণ হয় না!

~চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here