তোমার নিরব অভিমানীনি পর্ব -২৩

#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(২৩)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)

বেলকনির গ্রিল গলিয়ে সূর্যের একফালি রোদ এসেছে। সেই রোদ্দুরের উষ্ণতায় নজরাত তার মাথার ঘন কোঁকড়ানো চুল গুলো শুকিয়ে নিতে সূর্য কে পিছনে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। চুল ভিজে থাকা অবস্থায় একটুও ভালো লাগে না নজরাত এর। যতক্ষন পর্যন্ত চুল গুলো শুকিয়ে হাতখোপা করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কেমন একটা বোঝা মনে হয়।

ছোট বেলা থেকেই চুল বেঁধে ঘোমটার আড়ালে রাখতে পছন্দ করে সে। অন্যান্য মেয়েদের মত খোলা চুলে ঘুরে বেড়ায় না।

শীতের মৌসুম শেষ যার ফলে কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাড়াতেই প্রচুর গরম অনুভব হতে নজরাত রুমে চলে আসে। রাদ সদ্য‌ই শাওয়ার নিয়ে বের হল। নজরাত তাকে দেখতে পেয়ে দুষ্টুমি মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দুষ্টু হেসে কাছে গিয়ে জরিয়ে ধরে বলল,
–” আহ্ ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল!

নজরাত এর আকস্মিক ঘটনায় রাদ বোকার মত দুই হাত উপরে তুলে রাখে। যেন সে একজন আসামি। তখন নজরাত এর ভীষণ হাসি পায়। রাদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে,
–” কি ব্যাপার বলো তো? আজকে নিজ থেকে আমায় জড়িয়ে ধরেছো! সূর্যোদয় কোন দিকে হল?
–” আপনি ও বলেন আজকে আমাকে হঠাৎ “তুমি” সম্বোধনের কারণ কি?
–” সত্যিটা বলব?
–” হুম বলেন?

রাদ হাত নামিয়ে নজরাত এর কাধে রাখতে বলল,
–” তোমার শরীর এত গরম কেন? তুমি না একটু আগেই শাওয়ার নিলে? জ্বর আসেনি তো?
নজরাত রাদ কে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো। চুল গুলো একটু ঝেড়ে বলল,
–” রোদে দাঁড়ানোর কারণে এরকম হয়েছে। আর তাই তো আপনাকে জরিয়ে নিলাম। যেন আপনার শরীরের শীতলতায় শীতল হতে পারি।
–” তোমার পেটে এতো দুষ্টুমি?
–” হা হা হা। এবার বলেন তো তুমি সম্বোধনের কারণ কি?

রাদ কাবার্ড খুলে একটা মরিচ গুঁড়া রঙের টি-শার্ট পড়তে পড়তে বলল,
–” লেখিকা ইসরাত বিনতে ইসহাক এর পাঠক/পাঠিকারা কানাঘুষো করছিল! আমি এখনো কেন তোমাকে আপনি সম্বোধন করি? এটা তাদের পছন্দ নয়। তাই ওদের কথা ভেবেই তোমাকে তুমি সম্বোধন করা।

নজরাত থুতনিতে হাত রেখে গভীর ভাবনার ভঙ্গিতে বলল,
–” আচ্ছা এই ব্যাপার? তাহলে আপনি নিজ থেকে বা মন থেকে ভালোবেসে বলেন নাই? তাই তো?

রাদ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নজরাত এর চুল গুলো কাঁধের পিছনে ফেলে, নরম তুলতুলে গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বলল,
–” সে তো একটা বাহানা মাত্র। প্রত্যেকটা পুরুষ মানুষ চায় তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে তুমি বলে সম্বোধন করতে। কারণ “তুমি” বলাটা খুব কাছের মনে হয়। যেখানে কোন দূরত্ব থাকে না। “আপনি” সম্বোধন তো যে কেউ যে কাউকে বলতে পারে। কিন্তু “তুমি” করে বলতে কজন পারে?
–” আপনি ঠিক বলেছেন। এমনি করে কখনো ভেবে দেখিনি আমি। সবসময় একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেত। ছেলেরা তুমি সম্বোধন কে এতো পছন্দ করে কেন? আজকে বুঝলাম এটাই সেই কারণ তাই না?
–” ইয়েস ম্যাডাম।

আচ্ছা এই ঘটনা ঘটে গেছে! অথচ আমি জানতেই পারলাম না?

রাহার এহেন কথায় নজরাত আর রাদ দুজনে দুই দিকে ছিটকে দাঁড়ায়। রাহা জানে তাদের সম্পর্কটা এখনো জোড়া লাগেনি তবে লাগার পথে তাই জানতো। তাই রুমে ঢুকার আগে নক করার প্রয়োজন মনে করেনি।
অথচ তাদের সম্পর্ক আল্লাহর রহমতে জোড়া লেগে গেছে। যা দেখে উপরিউক্ত কথাটা বলে রাহা।

বোনের অসময়ে আগমনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রাদ। লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা চুলকে বলল,
–” আমি মসজিদে গেলাম।

তারপর তাড়াহুড়ো করে যেতে নিলে নজরাত বলল,
–” এই টুপিটা তো নিয়ে যান?
তারপর কোন রকম টুপি নিয়ে পালালো রাদ।
রাহা কোমরে হাত রেখে বলল,
–” কি ব্যাপার? এখনো তো আযান ই হলো না! ভাইয়া এভাবে তাড়াহুড়ো করে চলল কেন?

নজরাত চুপ করে থাকলে রাহা দুষ্টু হেসে বলল,
–” তা ভাবীমণি তোমরা কি দুজনে মিলে কি করছিলে বলো তো? এভাবে ভর দুপুরে দরজা খুলে…
নজরাত লজ্জা পেয়ে বলল,
–” ননদিনী ভাবীমণি তুমি চুপ করবে? কি সব লাগামহীন কথাবার্তা বলে চলেছ?
রাহা নজরাত এর দুই কাঁধে দুই হাত ভর করে রেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–” তাহলে বলো? তোমাদের মধ্যে সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে কিনা? আমি শুনে প্রাণ জুড়াই।
–” তোমাকে বলেছিলাম না সারপ্রাইজ আছে? এটাই তার সারপ্রাইজ। বুঝলে কিছু?
রাহা খুশি হয়ে বলল,
–” আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ। উফফ আমি যে কি খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না। এর জন্য আমি দুই রাকাত নফল নামায আদায় করব ইনশা আল্লাহ।
_______

নজরাত চুল চিরনী করার সময় রাহা বলল,
–” তোমার চুল গুলো আমার অনেক ভালো লাগে। মা শা আল্লাহ কি সুন্দর দেখতে। এরকম আঁকাবাঁকা কোঁকড়ানো চুল ভালো লাগে। অথচ তুমি কিনা এগুলো লুকিয়ে রেখে দাও। আমি হলে খুব সুন্দর করে স্ট্র্যাইল করে ছেড়ে দিয়ে কলেজে যেতাম। শাড়ির সাথে তো আরো জোস লাগবে।

রাহার এমন কথায় মন খারাপ হয় নজরাত এর। রাহা কে টেনে নিয়ে বেডে বসিয়ে পাশে নিজেও বসে। তারপর রাহার হাতটা ধরে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,
–” আমরা নারী আমাদের পরপুরুষ কে জানতে দেওয়া যাবে না। তারা ফেতনায় পড়ে যাবে, আমরা একজনের জন্য নির্ধারিত এবং তার জন্যই রহমত,বাকি সবার জন্য গজব!!
❝নিঃসন্দেহে নারীদের ছলনা
খুবই মারাত্মক❞ [১]

রাহা চোখ জোড়া বড় বড় করে করুন চোখে চেয়ে থাকে। নজরাত আরো বলে,
–” নারীদের চুলে বেণি বা ঝুঁটি গেঁথে মাথা বাঁধা উত্তম। চুল বেশি বা লম্বার আন্দাজ যেন পরপুরুষ না করতে পারে, সেদিকে লক্ষ রাখা নারীর কর্তব্য। কারণ নারীর সুকেশ এক সৌন্দর্য, যা পরপুরুষের সামনে প্রকাশ করা হারাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘শেষ জমানার আমার উম্মতের মধ্যে কিছু এমন লোক হবে, যাদের নারীরা হবে অর্ধনগ্ন। তাদের মাথা কৃশ (খোঁপা) উটের কুঁজের মতো হবে। তোমরা তাদের অভিশাপ করো, কারণ তারা অভিশপ্ত।’

চুল বেশি দেখানোর উদ্দেশ্যে কৃত্রিম চুল বা পরচুলা ব্যবহার করা হারাম। স্বামী চাইলেও তা মাথায় লাগানো যাবে না। হজরত ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
অভিসম্পাত করেছেন ওই সব নারীর ওপর, যারা পরচুলা লাগিয়ে দেয় এবং যে পরচুলা লাগাতে বলে। [২]

খেজাবের বিধান সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নারীরা কালো খেজাব ছাড়া অন্যান্য খেজাব দিয়ে চুল রাঙাতে পারে। ফ্যাশনের জন্য চুল ছোট ছোট করে কাটা বৈধ নয়। তবে চুলের অগ্রভাগ এলোমেলো হলে সামান্য কাটতে পারে। কিন্তু না কাটাই উত্তম। কেননা বেশি চুল নারীর সৌন্দর্য।

ভ্রু প্লাক ও নকশা আঁকা স্বামী চাইলেও কপালের পশম চাঁছা ও ভ্রু প্লাক করা জায়েজ নেই। কেননা এর দ্বারা আল্লাহর সৃষ্টিতে পরিবর্তন করা হয়, যার অনুমতি ইসলামে নেই। এভাবে মুখে বা হাতে সুই ফুটিয়ে নকশা আঁকা বা ট্যাটু করা বৈধ নয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক ওই নারীদের ওপর, যারা দেহাঙ্গে উল্কি উত্কীর্ণ করে এবং যারা করায়, যারা ভ্রু চেঁছে সরু (প্লাক) করে ও যারা সৌন্দর্য বৃদ্ধির মানসে দাঁতের মধ্যে ফাঁক সৃষ্টি করে এবং যারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে পরিবর্তন আনে। [৩]

তবে পুরুষের দাড়ি-গোঁফের মতো নারীর গালে বা ঠোঁটের ওপর পশম থাকলে তা তুলতে দোষ নেই।

এমন অনেক কিছুই আছে যেগুলো ছোট মনে করে আমরা করে যাই। কিন্তু আমরা ভেবে দেখি না এই ছোট ছোট গুনাহ গুলো একসময় আমাদের জাহান্নামের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা আমাদের সেই বুঝ বোঝার তৌফিক দান করুন আমীন, সুম্মা আমীন!

রাহার চোখে পানি টলটল করে। নজরাত কে জরিয়ে ধরে ইস্তেগফার পাঠ করে। ক্ষমা চায় মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে। নিশ্চয়ই তিনি (আল্লাহ) ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। “আলহামদুলিল্লাহ”।
________

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে রাহা আর রূপক চলে যায় তাদের বাসায়।

রাদ আর নজরাত তাদের এগিয়ে দিয়ে গার্ডেনের একটি গাছের নিচে বেঞ্চে বসে। তখন রাদ ইতস্তত বোধ করে বলে,
–” রূপকথার ব্যাপারে তোমাকে কিছু জানানোর আছে!…..
________
রেফারেন্স:-
[১](সূরা : ইউসুফ -১২ঃ২৮)
[২](বুখারি, হাদিস : ৫৯৩৭)
[৩](বুখারি, হাদিস : ৪৮৮৬)
________

#চলবে… ইনশা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here