তোমার পরিনীতা পর্ব ১৯+২০

তোমার পরিনীতা – ১৯

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

সমীরের চেহারা দেখে কাজ ফেলে দ্রুত উঠে এলো মঞ্জু।

“বলি হলোটা কী? মুখের দিকে তো একেবারে তাকানো যাচ্ছে না… চাকুরীটা খোয়াওনিতো?”

সমীর একবার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ মুখে মাথা নাড়লো, তারপর ধীরে ধীরে খাটের কিনারায় গিয়ে বসে পড়লো। মঞ্জু এমনিতে যথেষ্ট মুখরা আর তর্কবাগীশ হলেও সমীরকে ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের কথা কোনদিন ভাবেনি। চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে ঝড় ঝাপটাও কম সহ্য করেনি দুজনে মিলে কিন্তু আজ কেমন যেন ছন্দপতন ঠেকলো মঞ্জুর সেই পথচলায়। সমীর লোকটা বড্ড ঠান্ডা ধরনের আর শান্তিপ্রিয়। কোন ধরনের প্যাঁচঘোচ সে জানেনা।

“কিছু যদি নাই হবে তাহলে মুখটা এমন হয়ে আছে কেন? ” মঞ্জু চিন্তিত ভঙ্গীতে সমীরের কপালে হাত দিয়ে দেখলো। ” নাহ.. জ্বর জ্বর তো লাগছে না। ”

“জ্বর আসেনি মঞ্জু, আমার মনটা এমনি ভাল লাগছে না।”

“এমনিই ভালো লাগছে না! বললেই হলো নাকি… কি হয়েছে আমায় বলো নাগো। ” মঞ্জু উৎকন্ঠার সাথে জানতে চাইলো।

“বাহ মানুষের মন খারাপ হতে পারেনা?” সমীরের কন্ঠেও এবার কিছুটা বিরক্তি ঝরে পড়লো। কিন্তু তারপর আবার নিজেই নিজের আচরনে ক্ষুব্ধ হলো। আসলে দোষ মঞ্জুর নয়, দোষ হলো সমীরের কপালের। পরিবারে যথার্থ পয়সা দিতে না পারলে বউকেই খালি দোষারোপ করে কি হবে… তবুতো মঞ্জু এভাবেই তার সাথে সংসার করে এলো এতোটা বছর, ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা তো কোনদিন বলেনি।

“হতে পারে অবশ্যই হতে পারে… কিন্তু তোমাকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি তাই কারনটা জানতে চাইছি, বলো এবার।”

মঞ্জু, সমীরের একটা হাত নিয়ে নিজের মাথার উপর দিয়ে বললো,” আমার দিব্যি দিয়ে বলো কি হয়েছে? মিথ্যে বললে আমার মরা মুখ দেখবে তুমি।”

“আহ কি যন্ত্রনা শুরু করলে তুমি অনুজের মা.. এমনিতে আসার সময় রামনাথদা একগাদা কথা শুনিয়ে দিলেন রাস্তার উপর তার উপর তুমি আবার এসব নাটক শুরু করোনা, আমার ভালো লাগছে না। ”

রামনাথের নাম শুনতেই মামার মন খারাপের কারনটা স্পষ্ট বুঝতে পারলো সুমন। মামা অফিস থেকে ফিরতেই চা বানিয়ে খাবার টেবিলে আসার জন্য ডাকতে আসছিল সুমন। মামীর দিব্যি দেয়ার কথা শুনে আর ঘরে ঢোকাটা ঠিক মনে হয়নি ওর.. তাই দরজায় দাড়িয়ে সব শুনছিল। রামনাথ চৌধুরী যে কেমন ভাবে ওর মামাকে কথা শোনাতে পারে সেটা ধারনা করা সুমনের পক্ষে খুব বেশি কঠিন নয়।বড়মার একদম উল্টো কাকাবাবু। এতো এতো টাকা তবু…

“সুমনদি…. ”

“কি রে প্রীতি? ”

“আদিত্য বাবু এসেছে.. ঠাকুরদার সাথে দেখা করতে এসেছে ”

“আদিত্যর নাম শুনেই সুমন দ্রুত উপরের কামরায় ছুটলো। আদিত্য যখন দোতলার ঘরে ঢুকলো, ঘরটা তখন একদম ফিটফাট।

“কিহে দাদাভাই কেমন আছো?” বীরেন বাবুর চোখে মুখে আনন্দের ছটা। বৃদ্ধ বয়সে দুটো কথা বলার লোক পেয়ে আসলেই খুশি তিনি।

“একদম ভালো না, তাই তো আপনাকে দেখতে চলে এলাম, অবশ্য আমি মরে গেলেই বা কার কি আসে যায়, ” কথাটা হাসতে হাসতে বললেও সুমনের মনে হলো আদিত্যের চোখদুটোতে আজ অনেক অভিযোগ ছিল আর কথাগুলো যে ওকেই কেন্দ্র করে বলা সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি এখন ওর হয়েছে। সুমনের নিজেরও আসলে ভীষন লজ্জা লাগছিল আদিত্যকে দেখে। সেদিন কথা দিয়েও সুমন যেতে পারেনি অথচ আদিত্য বেশ কয়বার করে ওকে যেতে অনুরোধ করেছিলো।

“আপনারা বসুন আমি চা নিয়ে আসি,” সুমন চায়ের ছুতোয় আদিত্যকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে আসলো। আদিত্যকে বলার মতো যথার্থ উত্তর আসলে সুমনের র কাছে নেই। কি বলবে? ও যা করলে শ্রাবণদার মন খারাপ হয়, সেই কাজ মরে গেলেও সুমন করতে পারবেনা। কিন্তু যদি উত্তর শুনে আদিত্য প্রশ্ন করে বসে যে কেন? তখন।

………………………………..

“কি করছিস ব্রো…..? ”

“আরে এ আমি কি দেখছি? কাকে দেখছি? গরীবের বাড়িতে হাতীর পারা… হাউ ইজ ইট পসিবল! ”

“তেল মারিস না ব্রো… আই অ্যাম ফেডআপ ” ধপাস করে বিছানার পাশের রকিং চেয়ারে বসে পড়লো সুজয়।

“ফেডআপ ফর হোয়াট? ” শ্রাবণ কোলের উপর রাখা ভারী বইটা সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। গত চার পাঁচদিন ধরে ও এই বইটার সাথে যুদ্ধ করছে কিন্তু ফলাফল শূন্য। মাথায় আজকাল শুধু অন্যকিছু ঘোরে, যা স্বস্তি দেয়না মোটেও।

“লাবণ্যটা চায় কি? আমার জুতার সুতো ছিড়ে যাবে কিন্তু এই মেয়েটা একটা হার্ডনাট। একটাবারের জন্যও সে আমার সাথে কোন ডিসকাশনে আসেনা। কোথাকার কোন এক ফালতু ছেলের পিছনে লেগে আছে, আমাকে তার নামও বলবেনা,” সুজয় দাঁত কিড়মিড় করে বললো।

খুক খুক করে কয়বার কাশল শ্রাবণ। ফালতু ছেলে!

“লাবণ্য কি এখোনো ওই ছেলেকে বিয়ে করতে চায়? ” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ। এই মেয়ে তো ওর সাড়ে সর্বনাশ করে ছাড়বে।

“শুধু বিয়ে না ওই ছেলের পোলাপানের মাও হইতে চায়। ব্রো প্লিজ আমাকে একটা হেল্প কর তুই প্লিজ, ওই ছেলেটার এড্রেসটা আমাকে একটু জোগাড় করে দে। একটু হিন্টস পেলে আমি নিজেই ছেলেটাকে খুঁজে নিতে পারতাম কিন্তু এখন বাবার বিজনেসে ঢুকে মাসের মধ্যে চৌদ্দবার আমাকে দেশের বাইরে যেতে হয়, ব্যবসা সামলাবো না বউ ? ” দীর্ঘ করে একটা শ্বাস টানলো সুজয়। কিন্তু তাতে ওর ব্যাথা কমলো না বাড়লো শ্রাবণের বোধগম্য হলোনা।

শ্রাবণ হেসে ফেললো, “বাপরে… ডাইরেক্ট বউ?”

“কি করবো বল, এই মেয়ে মহা ধান্দাল বাট ওকে আমার চাই। প্রেম করার বয়স এখন আর নাই তাই ভাবছি সামনের মাসে বাবাকে দিয়ে সোজা ওর ফ্যামিলির কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিব। রাজী হলে ভালো নাহলে সোজা কিডন্যাপ করবো।”

“তুই তো দেখছি মহা সিরিয়াস? অবশ্য তুই ওর ব্যাপারে বরাবরই সিরিয়াস ছিলি।”

“আমার লাবন্যকে চাই শ্রাবণ, অনেক আগে থেকে ভালোবাসি। তুই শুধু ওই ছেলেটার ঠিকানাটা আমাকে জোগাড় করে দে দোস্ত, বাকিটা আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোর ঝামেলা করা লাগবে না। ”

“আমি বুঝতেছিনা তোর ওই ছেলের ঠিকানা জানার এতো কী দরকার। তুই বিয়ে করতে চাস লাবন্যকে, তাইতো? এতে ওই ছেলেকে ইনভলভ করার কি আছে? ওই ছেলে তো আর লাবণ্যকে পছন্দ করেনা,বিয়েও করতে চায়না। তাহলে তোর ওকে দরকারটা কী?” শ্রাবণের বুকটা ততক্ষণে ঢিপ ঢিপ করছে, কি এক ফালতু ঝামেলা পাকিয়েছে মৌমির বাচ্চা। আচ্ছা করে একটা রাম ধোলাই দিতে পারলে শান্তি হতো ওটাকে। জানে সুজয়ের পছন্দ লাবন্য তারপরও খামোখা ওর পিছনে লাগলো।

শ্রাবণের কথায় সুজয় কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে রইলো। বেচারার চোখমুখ বলে দিচ্ছে সুজয় আসলে ভীষন হতাশ।

শ্রাবণ, সুজয়ের টেনশনটা ফিল করছিলো… আসলে ও আর সুজয় এখন একই অবস্থায় আছে। ভালোবাসার মানুষটা অন্য কারো ভালোবাসা হতে পারে মনে হলেই দম বন্ধ হয়ে আসে। শ্রাবনের ইচ্ছে হলো লাবন্য আর ওর ব্যাপারটা সুজয়কে খোলাখুলি বলে দেয় কিন্তু শ্রাবণ কিছুতেই সংকোচ কাটাতে পারছেনা। সুজয়, লাবণ্যকে ভালোবাসে এটা শ্রাবণ অনেক আগে থেকে জানে। তাহলে কেন ও অযথাই লাবণ্যকে একটু বাজিয়ে দেখতে গেল?

নিজের সপক্ষে বলতে চাইলে অবশ্য অজুহাত একটা না একটা দাড় করানোই যায়, যে মৌমিতার ঠেলাঠেলিতেই ও সেদিন যেতে বাধ্য হয়েছিল লাবন্যর সাথে দেখা করতে অথচ তখনও লাবণ্যর প্রতি মনের ভিতরে কোন ভালোবাসা ও অনুভব করেনি, না কোন রকম টান। যেটা অনুভব করেছে সেটা হলো লাবণ্যর প্রতি ওর একরাশ কৌতুহল। মেয়েটা একদম ঝকঝকে তলোয়ারের মতো, মনে হয় ছুঁলেই কেটে যাবে।

কিন্তু তাহলে এতো কৌতুহল কেন? প্রশ্নটা এ’কদিন শ্রাবণকে বেশ জ্বালিয়েছে। শেষে ভেবে ভেবে ওর এটাই মনে হয়েছে যে, লাবণ্য বিশেষ সুন্দরী এটা ওর জন্য কখনোই লাবন্যর প্রতি ওর আগ্রহের মুখ্য বিষয় ছিল না। কিন্তু ওদের পুরো ব্যাচটা যে মেয়েটাকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যাতিব্যাস্ত থাকতো সেই মেয়েটা হঠাৎ ওর প্রতি কেন এতোদিন পরে আগ্রহী হয়ে উঠলো এটা ওকে মনে মনে বেশ কৌতুহলী করে তুলেছিলো। তা না হলে এই যে সুজয় এসে ওর সামনে লাবন্যকে বিয়ে করার কথা বলছে এটা শুনে মনে মনে ওর স্বস্তি লাগার কথা না, কোথাও তো একটু হলেও ওর হিংসা লাগা উচিত অথচ বিন্দু মাত্রও হচ্ছেনা। সবচেয়ে বড় কথা এই কথাটা কেউ সুমোকে নিয়ে বললে শ্রাবণের ভিতরটা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠতো। পারলে তার নাক-মুখ মেরে রাস্তার মতো সমান করে দিতো বুলডোজার দিয়ে।

একঅর্থে সুমনের উপর মাতব্বরি করার মতো এরকম অপরিসীম অধিকারবোধ আর সুযোগ… শ্রাবন যেমন আর কারও উপর পায়নি তেমনি যে কেউ চাইলেই যে শ্রাবণের দখলকৃত দ্বীপ হতে পারবেনা এটাও বোধহয় উপর থেকেই নির্দেশিত ছিল। তা না হলে লাবণ্যর মতো গুনে গুণান্বিতা মেয়েকে কখনোই এরকম ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে ফিরে যেতে হতো না।

“তুই কি শিওর যে ওই ছেলে লাবণ্যকে পছন্দ করে না? আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে বিয়ের পরে ওই ছেলে লাবণ্যর সাথে কোন রকম আনফেয়ার রিলেশন রাখবেনা।” সুজয়ের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। এই প্রথম সুজয়ের জন্য প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগলো শ্রাবণের। ওর আসলেই ভীষন কষ্ট হচ্ছে। ভালোবাসার আরেক নাম বোধহয় কেবল সেধে সেধে কষ্ট পাওয়া অথচ এই জিনিস নিয়ন্ত্রণহীন, চোখে দেখা যায়না, অদৃশ্য অথচ ভীষন শক্তিশালী।

“আমি শিওর ওই ছেলে লাবণ্যকে পছন্দ করে না, এটলিষ্ট দে আর নট লাভার। তুই আঙ্কেলকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠা, লাবণ্য রাজী হয়ে যেতেও পারে।”

“তুই বলছিস ”

“হমম ”

“কিন্তু ছেলেটা যদি বিট্রে করে?” সুজয়ের চোখদুটো ছলছল করছে। ” শ্রাবণ তুই পার্সোনসলি ছেলেটাকে চিনলে আমাকে বল,আমি প্রয়োজনে ওর কাছ থেকে ভিক্ষা করে নিব লাবন্যকে।”

” সুজয় তুই আমার উপর বিশ্বাস রাখ, ছেলেটা লাবণ্যর প্রতি আগ্রহী না। লাবন্যর ভালোলাগাটা একতরফা। ”

“তাহলে তুই অভয় দিচ্ছিস।”

“দিচ্ছি, কিন্তু এখন অন্য কোন পাত্র এসে তোমার বউকে উড়িয়ে নিয়ে গেলে আমার সাথে ঝামেলা করতে এসো না। যতো তাড়াতাড়ি পারো বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও।”

শ্রাবণের মনে হলো সুজয় যদি কালই লাবন্যকে বিয়ে করতো তাহলে ও বেঁচে যেতো।

…………………………………………..

“আপনি কিছু মনে না করলে আমি একটা প্রস্তাব রাখতে চাই মামাবাবু।”

“বলো আদিত্য, তুমি তো এখন আমাদের কাছের লোক… বাবা খুবই পছন্দ করে তোমাকে, তারপরও এতো সংকোচ কেন? ”

সমীর বিছানায় শুয়েই কথাটা বললো। শরীরটা আজ তার বেশ খারাপ, সাথে মনখারাপও কিন্তু আদিত্য ছেলেটা নিজে থেকে এসে সমীরের ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করছে, সেক্ষেত্রে ভালোমুখে দু, একটা কথা না বললে তো রীতিমতো অভদ্রতা হয়।

“বলছিলাম কি… বিদেশে যাব বলে বাবার অনেকগুলো জমি আমি বিক্রি করেছিলাম। তার সবটাকা আমার এখনি লাগাবেনা। যদি আপনি কিছু মনে না করেন তাহলে আমার বাকি টাকাগুলো দিয়ে আপনি রামনাথ চৌধুরীর ধারটা আপাতত শোধ করে দিন। পরে আপনি আপনার সুযোগ সুবিধামতো সেগুলো আস্তে আস্তে আমাকে শোধ করে দিবেন। আমার দিক থেকে কোন প্রকার চাপ থাকবে না টাকাটা পরিশোধের জন্য… এটুকু কথা দিতে পারি।”

আদিত্যর কথায় সমীর ফ্যালফ্যাল করে আদিত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটা কি পাগল! চেনে না জানে না অথচ নিজে থেকে যেচে ওদের দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। তাহলে কী পৃথিবীর আনাচে কানাচেতে অসংখ্য ভালো মানুষ এখনও রয়ে গেছে….. যাদের মাধ্যমে বিধাতা মাঝে মাঝে নিজের প্রকট অস্তিত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন সকলকে।

সুমন দরজায় দাড়িয়ে আদিত্য আর সমীরের আলোচনার বিষয়বস্তু মনযোগ দিয়ে শুনছিল। বলতে নেই আদিত্যকে, সুমন প্রথম থেকেই প্রচন্ড সম্মান করে কিন্তু আজ এইটুকু সময়ের মধ্যে সেই সম্মান যেন আকাশে যেয়ে ঠেকলো। আদিত্যকে মনে হতে লাগলো সাক্ষাত দেবদূত।

সুমনের স্মৃতিতে বাবা বলে আলাদা কোন শব্দ নেই। ওর কাছে সমীরই ওর মামাবাবু আবার সমীরই ওর বাবা। মনে আছে ছোটবেলায় দোকান থেকে লজেন্স কিনতে গেলে মামাবাবুর কাঁধটাই ছিল ওর এক দোক্কা গাড়ি। সেই একমুঠ লজেন্স নিয়ে মঞ্জু মামীর কটুকথাগুলোও এখনো তেমনি তাজা। তারপরও সমীর দমেননি, তেমনিভাবে সুমনকে স্নেহের ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছেন। সুমন জানে ওর মামার আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো নয়। কিন্তু ইদানিং অর্থাভাবের সেই রূক্ষ চেহারাটা যেন দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। অনুজদাকে আমেরিকায় পাঠানোর টাকাগুলো দ্রুত শোধ না করতে পারলে ওদের হয়তো রাস্তায় নেমে যেতে হবে এই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে। কথাগুলো ভাবলেই ভয়ে শরীর কাঁটা দেয় সুমনের। না খেয়ে ঘরের কোনে পড়ে থাকা এক কথা কিন্তু এই মাথা গোঁজার ঠাই বাড়িটাও যদি না থাকে তবে পুরো পরিবারটা যে একদম শেষ হয়ে যাবে ওর।

“সুমনদি… ”

“বল… ”

“শ্রাবণদা ডাকছে… ”

“যাচ্ছি… ”

“আহা কি এতো বড়দের কথা গিলছো… তাড়াতাড়ি ওবাড়ি যাও, শ্রাবনদা মনে হয় আমাদের আজ কোথাও ঘোরাতে নিয়ে যাবে,” প্রীতির কথার সুরে খুশির আমেজ। নিশ্চই সেদিন ওর কাছে শুনে শ্রাবনদারও আজ নদীতে ঘুরতে ইচ্ছে হয়েছে। ভাগ্যিস ও সেদিন ভালো করে ওদের ঘোরার বর্ননাটা শ্রাবনদাকে বলেছিলো।

বেড়াতে যাবার কথা শুনে সুমনের মুখটা একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও, পরক্ষনেই আবার তার দ্বিগুন বেগে অন্ধকার হয়ে এলো। শ্রাবণদা বেড়াতে যাবে? তো যাক না, যেখানে খুশি সেখানে যাক… তাতে সুমনের কী?

আধাঘন্টা ধরে একই জায়গায় পায়চারি করে করে ভীষন বিরক্ত লাগতে লাগলো শ্রাবণের। প্রীতি এতোটা সময় নিশ্চই লাগাবেনা সুমোকে কথাটা বলতে। কিন্তু তাহলে এখোনে সুমো আসছে না কেন? নাকি সুমো যেতে চায়না? নাকি কেবল ওর সাথেই যেতে চায়না? আদিত্য হলে যেতো? সবগুলো সম্ভাবনাই যখন একসাথে হয়ে শ্রাবণের মাথার ভিতরে উলের বলের মতো জট পাকিয়ে দিচ্ছিলো, ঠিক তখনই সম্রাজ্ঞীর মতো হেলতে দুলতে দুলতে ওর ঘরের দরজায় এসে দাড়ালো সুমন।

শ্রাবণের চোখদুটো যেন হঠাৎই সদ্যআঁকা একটা ক্যানভাসে আটকে গেল। ছবিটার বুনন স্বপ্নের মতোই, যেন কি ভীষন আদুরে একটা দিন। তার সাথে পাল্লা দিয়ে সুমনের চোখদুটো বর্ষার মেঘের মতোই ভারী… কেবল একটু ঝড়ো হাওয়ার অপেক্ষা। তার সাথে তাল মিলিয়ে সাদা খোলের লাল পেড়ে শাড়ি, বেনী করা একটা খোপা, রূপার ছোট্ট দুটো ঝুমকা, চোখের কোনে আলতো কাজলের টান আর সর সরু হাত দুটিতে দু,একটা কাঁচের চুড়ি। শিল্পী নয় তবুও আজ প্রথম বারের মতো তুলি দিয়ে কিছু একটা আঁকিবুকি কাটতে ভীষন ইচ্ছে হলো শ্রাবণের।

“আমায় ডাকছিলে? ” শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল চুইয়ে আসা ঘামের ফোঁটাগুলো মুছলো সুমন।

না করতে যাচ্ছিল শ্রাবন কিন্তু ততক্ষণে মনেমনে খেই হারিয়ে ফেলেছে সে। বুকের ভিতরের চাওয়াগুলো দামাল হাওয়ার মতো ওকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, কানদুটো দিয়ে শব্দ ঢুকছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু মাথায় তার অনুভব খুবই ক্ষীন।

“শ্রাবনদা… ”

“অ্যা…”

“কোথায় নিয়ে যাবে বলছিলো প্রীতি ”

“উহহ.. উহহ.. হ্যাঁ, ওই আরকি। ” গলা অযথাই দু’একবার খাকড়ি দিয়ে নিজের বেসামাল ভাবটা কাটালো শ্রাবণ। নাহ, সুমোকে দেখলে আজ কাল যখন তখন ঝড় উঠে পদ্মার বুকে। দ্রুতই ওকে কিছু একটা করতে হবে।

“কোথায় যাবে? ”

“নদীতে। সবাই অনেক মজা করে শুনলাম ওখানে গিয়ে তাই আজ মাকে নিয়ে ঘুরবো ভাবলাম। ”

শ্রাবণের চোখদুটো ততক্ষনে সুমনের জুতোর রঙটা পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলেছে।

“এটা ভালো করেছো, বড়মার অনেকদিন কোথাও ঘোরা হয়না তুমি নিয়ে না গেলে।”

“হমম.. তুই খুশিতো? ”

“আমি… ” সুমন অনিশ্চিত ভাবে প্রশ্ন করলো। ওর খুশিতে শ্রাবনদার কি?

“হ্যাঁ,তোর ভালো লাগাটাও তো সমান গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন আমার জন্য তোর যাওয়া হয়নি। আজ তার শোধবোধ হয়ে যাবে, ” শ্রাবনের ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসির আভাস।

সুমন এতোক্ষণে শ্রাবণের এই অকারন ঘুরতে যাওয়ার কারনটা খুঁজে পেল। সুমন সেদিন চারুদের সাথে ঘুরতে যায়নি, তবুও শ্রাবনদা ওর সাথে কি খারাপ ব্যবহারটাই না করেছিল। কথাই বলেনি ভালো করে। অভিমানে চোখ দু’টো ছাপিয়ে আবার জল এলো সুমনের বানের পানির মতো…. নিষ্ঠুর একটা লোক, যেন ওকে কাঁদিয়ে মহা সুখ পায়। সেটাই গড়িয়ে গড়িয়ে সুমনের গাল বেয়ে ঝরে পড়তে লাগলো টুপ টুপ করে।

শ্রাবণের ভিতরে তখন নতুন করে তুফান শুরু হয়েছে, যুদ্ধের ডামাডোলে সমস্ত বিশ্বচরাচর গর্জে উঠেছে, নিজের অনুভূতির সাথে নিজের অস্তিত্বের এই প্রলঙ্কারী যুদ্ধে টিকে থাকাটা এতো কঠিন জানা ছিলনা শ্রাবণের। সামনে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটা প্রতিদিন একটু একটু করে ওর সামনে প্রজাপতির মতো খোলস পাল্টে কিশোরী থেকে নারীতে রূপান্তরিত হচ্ছে। সঙ্গে পাল্টাচ্ছে তার রঙ,রূপ আর সীমারেখা। শ্রাবণ চাইলেও এখন আর এই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতে পারেনা।

পাশে থাকা চেয়ারটাকে আকড়ে ধরে কোনমতে নিজেকে সামলে নিলো শ্রাবণ, “আমি নিচে যাচ্ছি, তুই সবাইকে নিয়ে নিচে আয় তাড়াতাড়ি। ”

চলবে……
তোমার পরিনীতা – ২০

( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিনীতার ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

নৌকায় বসে নদী আর নারী দুটোর মধ্যেই অদ্ভুত ধরনের একটা মিল খুঁজে পাচ্ছিল শ্রাবণ। দুটোই সাধারন চোখে খুব শান্ত আর সুন্দর অথচ খুব সঙ্গোপনে এরাই আবার নিজের গভীরে অনেক ক্ষত লুকিয়ে রাখতে জানে। শ্রাবণ তার মা নির্মলা চৌধুরীর দিকে বড্ডো মমতা নিয়ে দেখছিলো। হাজার কাজের ভীড়ে তার মা নামের মানুষটি নিজের জন্য কখনই তেমন একটা অবসর খোঁজেন না অথচ এখন এই উন্মুক্ত পরিবেশে কি অদ্ভুত ভাবে ছোট কিশোরীর মতোই আনন্দে খিল খিল করে হাসছেন। এই আনন্দ বিহ্বল মুখটা দেখে দু’চোখের কোন জলে ভরে আসতে চাইলো শ্রাবণের। মাকে এরপর থেকে জোর করে বাইরে নিয়ে আসবে ও আর সুমো। ওর বাবা রামনাথ চৌধুরী সারাজীবন শুধু টাকা আয় করেই গেল কিন্তু এই উপার্জনের সত্যিকারের মানে তিনি কোনদিন জানতে পারলেন না। ওর মা মনে মনে অনেক সৌখিন একটা মানুষ, আর তার আশেপাশের প্রতিটা মানুষের প্রতি তার ভালোবাসার কোন কমতি নেই। তাই সংসারের কাজগুলো তিনি সবসময় নিজের হাতেই করার চেষ্টা করেন। শুধু বাবার পছন্দ বলেই হয়তো নানা ছুতোয় রান্নার ভারটা তিনি কিছুতেই কাজের লোকের হাতে ছাড়তে চাননা আর বন্দনা বৌদি নিজেই তেমন রান্না করতে পছন্দ করে না। তার আগ্রহের বিষয় সেলাই করা। এরমধ্যে বাসার কাজের ছেলে রাজুরই কেবল একটু যা চা বানানোর অনুমতি আছে।

অথচ ওর বাবা নিজের ইচ্ছার একচুল এদিক ওদিক হলে খেপে যান, মার মন খারাপের ধার ধারেন না। কখনও মাকে নিয়ে এদিক ওদিক বেড়াতেও যাননা। এমনকি দাদাকেও দায়িত্ব থেকে ছাড়েন না, কিছু না কিছু কাজ দিয়ে তাকে আটকে রাখেন সবসময় । শ্রাবণকেই তাই মাকে নিয়ে বের হতে হয়। প্রতিবছর একবার ছুটি নিয়ে শ্রাবণ মাকে সঙ্গে নিয়ে বেড়িয়েও পরে এদিক ওদিক, কখনও কখনও সুমোও ওদের সাথে থাকে। ওই সময়টা ওর মা নির্মলা চৌধুরী বড় শান্তিতে কাটান নিজের মতো করে আর সুমোও।

সুমনের নামটা মনে আসতেই এতক্ষণের স্বস্তির চৌদ্দটা বাজল শ্রাবণের। মন আবার ভিন্ন এক দিশায় চলতে শুরু করলো, মেয়েদের রাগ বোধহয় নদীর তুফানের মতোই, ভীষন ভয়ঙ্কর। এদের ভালোবাসা আর রাগ দুটোর কোনটাই বোধহয় তেমন যুক্তির ধার ধারেনা। তাই যখন কাউকে ভালেবাসে তখন যেমন নিজের পুরোটা তার জন্য ঢেলে দিয়ে দেয় তেমনি আবার যখন মুখ ফিরিয়ে নেয় তখন তার প্রতিশোধটাও হয় খুব মারাত্মক। কথাটা মনে হতেই নিজের জন্য ভীষন করুনা হলো শ্রাবণের। চারপাশে এতো আনন্দের ছড়াছড়ি অথচ সুমোর অন্ধকার মুখটা ওর নিজের মন খারাপের কারন হচ্ছে বারবার অথচ এই অন্ধকারটা সরাতেই না এতো আয়োজন ছিলো ওর।

কিন্তু শুধু শ্রাবণের বকাতেই সুমোর মুড এতো খারাপ হবার কথা না, অন্যায় হলেও ওতে সুমো অভ্যস্ত। মনে হচ্ছে অন্য কোন একটা কারনে সুমোর মুডটা ভীষন ভাবে অফ হয়ে আছে, কিন্তু কেন? শ্রাবণ সেটা কিছুতেই ধরতে পারছেনা অথচ জানাটা জরুরি।

আকাশের রঙটা ততক্ষণে একটু একটু করে পাল্টাতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশে লালিমার ছড়াছড়ি। সুমন মনেমনে মাথার উপরের বিশাল আকাশটাকেই মায়ের কোল মনে করে জড়িয়ে ধরলো। মামার মন খারাপের কারনটা জানার পর থেকে আজব এক অস্থিরতা চেপে ধরেছে ওকে, আদিত্যর কথা গুলোও মাথার মধ্যে থেকে থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে। আদিত্য ওদের কেউ লাগেনা, তার কাছ থেকে এভাবে টাকা নেওয়া কি ঠিক হবে মামার? কিন্তু কাকাবাবুও যে ভীষন রকম অপমান করেছেন মামাকে কিন্তু কাকাবাবুকেও যে একভাবে দোষ দিতে বাঁধছে সুমনের। ধারের টাকাগুলো ফিরিয়ে দেয়ার সময় পার হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই, সাথে শ্রাবনদার বিয়ে আছে সামনে, তাতেও তো অনেক খরচ আছে। কিন্তু আদিত্যবাবুর টাকা গুলোও তো শোধ দিতে হবে.. কি করে কি হবে যদি অনুজদা ঠিকমতো চাকরি জোগাড় করতে না পারে। সুমনকি একটা, দুটো টিউশনি নিবে বাড়ির আশেপাশে?

“কিরে সুমন, তোর কি শরীর খারাপ করছে মা ?” নির্মলা উদ্বিগ্ন জানতে চাইলেন। তার মনে হচ্ছে মেয়েটা যতোই বড় হচ্ছে ততই কেমন যেন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে।

“না বড়মা, এমনি বসে থাকতে ভালো লাগছে তাই,” সুমন জোর করে হাসলো। বড়মা ওকে কি করে এতো বোঝে…. একটু কিছু হলেই ধরে ফেলে।

“বাহ, নদী দেখতে এসে কেউ বুঝি অমন মুখ নিচু করে বসে থাকে? সেদিন আমরা যখন এলাম তখন তো আদিত্য বাবুর গল্প শুনে হাসতে হাসতে আমার পেট ফেটে যাওয়ার দশা হয়েছিল… সুমনদি সেদিন না এসে বড্ডো ভুল করে ফেলেছে,” প্রীতি বিজ্ঞের মতো মতামত দিল।

“আহ প্রীতি, থামতো ” প্রীতির কথায় এবার সত্যি খুব রাগ হলো সুমনের।

ওদিকে সুমনের মুখ ঝামটা খেয়ে প্রীতি চুপ করে গেলো একদম। নাহ.. আজ মনে হচ্ছে সত্যি মন খারাপ সুমনদির, নইলে শ্রাবনদা বেড়াতে নিয়ে আসলে কথার ফুলঝুরি ছোটে তার।

শ্রাবণ ঠিক আন্দাজ করতে পারছিলনা সুমনের এতো মন খারাপের কারনটা কি? সেদিন ঘুরতে পারেনি বলেই তো আজ কাজ ফেলে ওকে নিয়ে বেড়াতে এলো, অথচ সুমন আগের চেয়েও আরো জুবুথুবু হয়ে বসে আছে… কিছু একটা তো আছে এর পিছনে।

হালকা আলোর ছিটে চোখে এসে লাগতেই মুখ ফেরালো সুমন। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে বলে শ্রাবণদা ফ্ল্যাশ ব্যাবহার করে সবার ছবি তুলছে ক্যামেরা দিয়ে। ওরও বোধহয় তুলছে তাই কিছুটা আলো চোখে এসে পড়েছে।

” কিরে পেঁচীমুখি, তুই তুলবি নাকি একটা আধটা?”

“শ্রাবণদা…..”

“কিরে পেঁচী? ”

“এটা একদম ঠিক না ”

“কোনটা একদম ঠিক না গোমড়ামুখী? ”

“ধুরর… আমি কোন কথাই বলবোনা,” সুমন আবার মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে অনেক দূরের গ্রামগুলো দেখার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু অন্ধকার জাকিয়ে আসছে তাই তেমন করে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।

শ্রাবণও আর টিপ্পনী না কেটে নিঃশব্দে নদী ও নারীর সহবস্থানের চমৎকার কিছু মুহুর্তকে নিজের ক্যামেরায় বন্দী করে ফেলতে লাগলো। নৌকার অন্য যাত্রীরা ততক্ষনে আবার নিজেদের গল্পে মশগুল হয়ে গিয়েছে। এছাড়া শ্রাবণের বেশিরভাগ কাজের এক্সপেরিমেন্ট সবসময় সুমনের উপর দিয়েই হয় বলে এগুলো তাদের কাছে খুব সাধারণ বলে মনে হলো। প্রেমিক হৃদয়ের অতি আতিশয্য কোনটাই তাদের কাছে বিশেষ কোন বার্তা হিসেবে চোখে পড়লো না।

ভরা বর্ষায় নতুন পানি পেয়ে নদীটি কিছুদিন হলো নিজের শ্রী খুঁজে পেয়েছে তার মধ্যে তরতর করে বয়ে চলা নৌকাটা কেমন ময়ূরবাহনের মতো ছুটে চলতে লাগলো আরও সামনে, যেখানে নদী আর আকাশ কখনো মিলে না তবু হাত ধরাধরি করে ছুটে চলে।

…………………………………………..

“প্রীতি সব একাই খাস না… আমার জন্য একটু রাখ পেটুক কোথাকার।”

সুমনের বকা খেয়ে হাতের ফুচকাটা তাড়াতাড়ি প্লেটেই রেখে দিলো প্রীতি, মুখের ভিতরের ফুচকাটা তখনও ওর অমনি রয়েছে। আজ ওর বোধহয় সুমনদির কাছ থেকে বকা খাওয়ার দিন।

প্রীতির দিকে তাকিয়ে এতক্ষনে সত্যি হাসি আসলো শ্রাবণের। মেয়েটা ফুচকা খাওয়াতে সুমোকে হার মানিয়েছে, পেটুক দি গ্রেট।

“শ্রাবনদা হেসো না বলে দিলাম, নইলে কিন্তু আর কোনদিন সুমনদিকে ডেকে দিবনা। ”

“তাহলে কি করবো… তোর পেঁচীদির মতো মুখ অমন থোবড়া বানিয়ে রেখে দিব ?”

শ্রাবণের কথা শুনে প্রীতি হি হি করে হেসে উঠতেই
সুমন ভ্রুদুটো কুঁচকে ওদের দিকে একটু তাকালো, তারপর আবার ফুচকা খাওয়ায় মন দিলো।

কিন্তু সুমোর এমন আচরনে শ্রাবণের কেন যেন শান্তি হচ্ছিল না। সুমোটা কেন অত অভিমান করে আছে? ওরকম মুখ ফুলিয়ে থাকলে শ্রাবণের যে আজকাল শুধু ওর গাল দুটো ধরে টানতে ইচ্ছে করে… অথচ সুমোটা ভারী এক মুরুব্বি চালে চলা শুরু করেছে। আজকাল কথাও বলে বড্ডো হিসেব করে।

“কি? ” সুমন খাওয়া ফেলে ঘুরে দাড়ালো।

“কিসের কি? ” শ্রাবণ বুঝতে না পেরে জানতে চাইলো।

“বলছি তুমি আর প্রীতি মিলে কি এতো বুদ্ধি পাকাচ্ছো বলতো? ”

“কই… কি বুদ্ধি পাকাচ্ছি?”

“তাহলে তোমরা ফিসফিস করে অত কি কথা বলছো সেই কখন থেকে?” সুমনের গলাটা এবার সত্যি ধরে এলো। ওর সেই দুপুর থেকে কি মন খারাপ অথচ শ্রাবনদা দেখো একবারও ওর কাছে সেটা জানতেও চাইলো না। উল্টো শুধু ওকে নিয়ে মজা করছে।

“ওহ…. ওতো নদীতে এতো বাতাস ছিল যে কোন কথাই ভালো করে শোনা যাচ্ছিল না, তাই কানের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এখানকার কোন ফুচকাওয়ালার ফুচকাটা ভালো।”

“ওহ… ফুচকা ” সুমন আর প্রশ্ন করলো না তবে শ্রাবণের উত্তর ওর বিশ্বাসও হলোনা। যাকগে… শ্রাবনদা বলতে না চাইলে জোর করার অধিকার
ওর নেই, তাই চুপ করে যাওয়াই ঠিক।

শ্রাবণ মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রীতিকে সাথে নিয়ে আসলেই একটা বুদ্ধি পাকিয়েছে ও। সুমোকে নিয়ে শ্রাবন আধাঘন্টার জন্য একটু হাওয়া হবে। এইটুকু সময় প্রীতির দায়িত্ব হলো মা আর মঞ্জুমামীকে আগলে রাখা আর ওদের খোঁজ করলে বলা যে, সুমন আরও একবাটি ফুচকা খাবে তারপর আইসক্রিম খাবে তাই দেরী হচ্ছে। এইটুকু সময় প্রীতিরা নৌকায় অপেক্ষা করবে, বিনিময়ে প্রীতিকে চারটা বড় বড় চকলেট আর একবক্স আইসক্রিম কিনে দিতে হবে।

” শ্রাবনদা…! ”

“কী? ”

” বড়মা, মামী, প্রীতি কোথায় গেলো?” সুমন ভয় পাওয়া স্বরে জানতে চাইলো। আশেপাশে কোথাও ওদের দেখতে পাচ্ছে না সুমন।

“আছে.. ওরা নৌকায় গিয়ে বসেছে। ”

” হায় হায়, আমাদের ফেলে রেখেই চলে গেলো ! চলো… এক্ষুনি যাই, নইলে ওরা আমাদের নৌকা ঠিকমতো চিনতে না পারলে সর্বনাশ হবে।”

“যাচ্ছি তার আগে তুই এদিকে আমার সাথে একটু আয়।”

“ওদিকে কোথায়? ”

“আহ… এতো প্রশ্ন করিস কেন ? যেতে বলছি চল।”

শ্রাবণ, সুমনকে প্রায় একরকম টেনে নিয়ে একটা রিকশায় উঠে বসলো। সুমনের তখন ভয়ে বুক শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। শ্রাবনদা এই অন্ধকার অচেনা জায়গায় ওকে কোথায় নিয়ে যায়? অবশ্য অন্ধকার বলে ওর ভয় হচ্ছে না,এরকম অনেক দূরে যাওয়ার ওর অভ্যাস আছে শ্রাবনদার সাথে। কিন্তু এরকম রিক্সায় করে তো ওরা যায়না, গাড়িতে অনেকটা দূরত্ব থাকে সবসময়, কিন্তু এখন ওকে প্রায় জাপটে ধরে রেখেছে শ্রাবনদা। সুমনের মনে হলো ও ঠিক রিক্সাতেই কাঁপতে কাঁপতে মরে যাবে।

“কি হলো ওরকম শক্ত কাঠ হয়ে বসে আছিস কেন? মাটি খাবার শখ হয়েছে? কাঁচা রাস্তা একটু বাঁধলেই হোঁচট খেয়ে সোজা নিচে পড়বি, ঠিক হয়ে বোস। ”

শ্রাবণের ধমক খেয়ে স্বাভাবিক হওয়ার খুব চেষ্টা করলো সুমন কিন্তু কোন লাভ হলো না। আর কিছুক্ষণ এরকম থাকলে সুমন নিশ্চিত যে ও জ্ঞান হারাবে, আর তখন শ্রাবনদা রাগ করে ওকে রাস্তাতেই ফেলে চলে যাবে।

“শ্রাবনদা আমরা কোথায় যাচ্ছি? অন্ধকার হয়ে আসছে, আমার খুব ভয় করছে,” সুমন কথা বলে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।

“অন্ধকারে তুই ভয় পাস সুমো ? আমি তো মনে করতাম তুই হুতুমপেঁচার মতোই নিশাচর। যেভাবে তুই রাতের অন্ধকারে সিড়ি বাইতিস,” শ্রাবণ মৃদু হাসলো।

“ভালো হবেনা বলছি শ্রাবনদা, তুমি সেই কখন থেকে আমায় পেঁচী পেঁচী বলে পচিয়ে যাচ্ছো। অথচ আমি কি কখনও তোমায় বলি যে তুমি শ্রাবণ মাসের মতো পচা একটা মাস, সারাক্ষণ টিপ টিপ করে বৃষ্টি খালি পড়তেই থাকে, সারা জায়গা কাদাজলে মাখামাখি, পঁচা কাদার গন্ধ… মাগো কি যে অসহ্য।”

“মাগো কি যে অসহ্য… অথচ বৃষ্টি নামলে যে এই তুই পেখম তুলতে তুলতে ওই ঠান্ডা জলে স্নান করতে ছুটিস তার বেলায় কি হ্যাঁ? তখন পচা কাদা খুব ভালে লাগে না?”

“মোটেই না। আমি তো কেবল ড্রামের তোলা জলগুলো খরচ করতে চাইনা বলে ছাদে চলে যাই। পচা কাদা আমার একেবারে অসহ্য লাগে। বৃষ্টি আমার একটুও ভালো লাগেনা। ”

“বাজে বকিস না সুমো… সব মানুষ উল্টো বৃষ্টির জন্য তপস্যা করে বসে থাকে পুরো গরমকালটা জুড়ে যে কখন আষাঢ় – শ্রাবণ মাস আসবে। কিন্তু তোর সেটা জানা নেই এটা অবশ্য আলাদ কথা, এ ব্যাপারে তুই বরাবরই একটা গবেট।”

সুমন মুখ ফুলিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ওদের রিকশাটা একটা জমজমাট জায়গায় এসে থামলো। জায়গাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে মেলার মতো কিছু একটা হচ্ছে। বড় একটা আলোকিত তোরন, ভিতরে নানারকম বাহারী আলো ঝলমল করছে দোকানগুলোর গায়ে, লোকজনের প্রচন্ড ভীড় আর নানা রকম গান- বাজনার সুর ভেসে আসছে। দলে দলে লোকজন সেখানে যাচ্ছে আর আসছে।

“আমরা এখানে কেন এলাম?”

সুমনের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, শ্রাবনদা ওকে এখানে কেন নিয়ে এলো?

“তোকে বেঁচতে নিয়ে এলাম। এবার চল দেখি কেউ কিনে কিনা।”

“যাও… খালি দুষ্টামি ”

“কিসের দুষ্টামি, আমি সিরিয়াস… নে চল।”

শ্রাবণদা… আমার কিন্তু এখন সত্যি সত্যি খুব কান্না পাচ্ছে, তু… তুমি আমায় কেন এখানে নিয়ে এলে?প্রীতি, বড়মা, মঞ্জু মামী ওরা কেন এলোনা?”

‘উহ… চুপ করতো, খালি প্রশ্ন। আর একটা প্রশ্ন করলে সত্যি সত্যি এবার বেঁচে দিয়ে চলে যাব কিন্তু। ”

মনেমনে বললো ওদের কাউকে তো বকিনি সুমো, তোর মনমরা মুখটা আর সহ্য হচ্ছে না। তাই এটুকু আনন্দ শুধুই তোর জন্য।

সুমনের এতো কান্না জীবনে পায়নি। কিন্তু একেতো অচেনা জায়গা, তার উপর রাত… সুমন শক্ত করে শ্রাবণের হাত আকড়ে ধরে রইলো।

মেলাটা তেমন বড় নয় তবে হারিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট, অল্প একটু জায়গাতেই অনেক মানুষের আনাগোনা। সুমন বড় বড় চোখ করে দোকানের বিভিন্ন রকম জিনিসগুলো দেখছিলো।

“এই দোকানের চুড়িগুলো অনেক সুন্দর। যেটা যেটা পছন্দ হয় নিয়ে নে। এই অফারটা কেবল আজকের জন্য প্রযোজ্য।”

“যেটা যেটা পছন্দ হয় সব নিয়ে নিব?” সুমনের এমন অফার শুনে যে কি আনন্দ হচ্ছিল বলার মতো না। নাহ, শ্রাবনদা আসলে অনেক ভালই শুধু ঐ মহিষের মতো রাগটাই একটু বাজে আরকি।

“হমম.. সেদিন বকেছিলাম তার ভর্তুকি। নে এখন সময় নষ্ট না করে চটপট করে নিয়ে নে, বেশি দেরী হলে মা আবার চিন্তা করবে। ”

সুমনে তখন চোখে সর্ষেফুল দেখছে.. এতো এতো রঙের চুড়ি, ও কোনটা রেখে কোনটা নিবে। শেষ পর্যন্ত যখন সুমনকে নিয়ে শ্রাবণ রিক্সায় উঠলো তখনও সুমনের আফসোস যাচ্ছে না। ওই রঙেরটা না কিনে ওটা কিনলে বোধহয় বেশি ভালো হতো – এই আক্ষেপেই ও মরে যাচ্ছে।

“এখন অফারের টাইম লিমিট শেষ। এরপর আর হিসেব করলে তোকে উল্টো বেচে দিবো কিন্তু আমি সুমো।”

“আরে, আমি কি আর কিনছি নাকি? বাব্বা কত্তগুলো চুড়ি কিনলাম। আচ্ছা শ্রাবনদা ওই যে নীল চুড়িটা কিনলাম ওটা আমার জামার সাথে মিলবে তো না বলো? ”

“মিলবে.. তুই এখন থাম সুমো, আমার মাথা ঘুরোচ্ছে,”শ্রাবণ আড়চোখে দেখলো সুমনের চোখদুটো আনন্দে চকচক করছে। পাগল একটা…

“আচ্ছা, “সুমন লক্ষী মেয়ের মাথা কাত করলো। কাল সকালেই ও চারুকে চুড়িগুলো দেখাবে। ইশশ.. সেদিন ও আসেনি আর ওরা কত্তো মজা করেছিলো। আজ বাড়ি যেয়ে ও নিজেও চারুকে দেখাবে যে শ্রাবনদা ওকে কতগুলো চুড়ি কিনে দিয়েছে। ভাগ্যিস সুমন সেদিন চারুদের সাথে আসেনি। আসলে কি আর শ্রাবনদা ওকে চুড়ি কিনে দিতো?

ওদের রিক্সাটা যখন নদীর ঘাটের দিকে ছুটতে লাগলো , পুরো মাঠ জুড়ে তখন বাতাসের কোলাহল। রাতের আকাশটা সোনালী আলোয় ভেসে যাচ্ছে। খুনসুটি তারার দল একে অন্যের সাথে পাল্লা দিয়ে আকাশটাকে সাজাচ্ছে, হীরের মালা দিয়ে।সেই সঙ্গে থেমে থেমে ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ ডাক। শ্রাবণের মনে হলো জীবনটা ঠিক এমন হলে মন্দ হতোনা, গুটিসুটি হয়ে প্রিয় মানুষটা বুকের সাথে মিশে থাকার আনন্দটা আলাদা।

সুমনের একটা হাত তখন চুড়ির ব্যাগে আরেক হাতে সে শ্রাবনকে আকড়ে ধরে আছে নির্ভয়ে।

চলবে………

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here