তোমার পরিনীতা পর্ব ১

তোমার পরিনীতা – পর্ব ১ ( শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিনীতা গল্পের ছায়া অবলম্বনে)

লেখিকা- ফায়জা করিম

( ১৮+ কনটেন্ট বিদ্যমান, কোন অবস্থায় গল্প কপি না করার অনুরোধ রইলো)

(একটা কথা গল্পটি হুবুহু পরিনীতার কপি না হলেও এর মূল ঘটনাবলি প্রায় একই, সময়কাল আমি পাল্টেছি কিন্তু এটা সেই গল্পেরই ছায়া, যার গল্পটি পড়েছেন বা ভালোবাসেন তারা তো বাসেনই কিন্তু তারা ছাড়াও যারা নতুন পড়বেন তাদের বলছি এটি বিখ্যাত লেখকের বিখ্যাত রচনা, কেউ কোন কটুক্তি করবেন না, চরিত্র নিয়ে, আমার লেখা নিয়ে অবশ্যই বলবেন কিন্তু মাথায় একটা জিনিস রাখবেন সেটা হলো ফেসবুকে সম্পূর্ণ গল্প আপনারা একসাথে পান না সুতরাং চরিত্র গুলো আসলেই কেমন বোঝা মুশকিল দ্বিতীয়ত গল্পের নায়ক নায়িকা বলেই তারা ভুলের উর্ধ্বে না, এগুলো সাধারন মানুষেরই কাহিনী, আর মানুষ মাত্রই ভুল করে আর সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়।)

ঢং করে জোরের সাথে শব্দটা শুনে সাথে সাথে দৌড়ে নিচে নামলো সুমন। ঠিক যা ভেবেছিল তাই। প্রীতি ওদের শ্যাওলা ধরা বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রীতির কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো পানিতে মাখামাখি হয়ে ভিজে সপ সপ করছে।

বালতির বেগতিক অবস্থা দেখে সুমনের বুঝতে বাকি রইলো না, প্রীতি কি করছিল। ওদের কলের পানিতে প্রচুর আয়রন, চুলে দিলে এমন বিশ্রী অবস্থা তৈরী হয় যে, চুলে চিরুনি ঢোকানো দায়। তাই ওরা সবাই বাসি পানি ব্যবহার করে চুল ধোয়ার সময়। সেটা বাথরুমের একটা বড় ড্রামে প্রতিদিন জমা করা হয় সবার গোসল শেষ হবার পরে।

প্রীতি বালতিতে করে সেই পানি নিয়ে চুল ধুতে যাচ্ছিল সম্ভবত। কিন্তু কোনভাবে বালতি হাত থেকে ছুটে গিয়ে পানি সব কাত হয়ে পড়ে গিয়েছে, লাভের মধ্যে প্রীতির পায়ের কাছে বালতির কোনায় কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে গলগল করে, সুমন দৌড়ে গিয়ে আগে বড় মামার গামছাটা হাতে নিলো, তারপর একটা চিৎকার দিয়ে মঞ্জু মামীকে নিচে আসতে বলেই বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো ।

সুমনকে ঢুকতে দেখেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো প্রীতি, ” সুমন দি।”

“সশশ… একদম কাঁদবি না, ভালো করে চেপে না বাঁধলে রক্ত বন্ধ হবেনা, অনেকটা কেটে গেছে,” সুমন তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে বসলো প্রীতির পাশে।

খানিক পরে দুম দাম করে কটা কিল পড়লো প্রীতির পিঠের উপর।

“হাজার বার করে মানা করি শয়তান মেয়েটাকে,কিন্তু কে শোনে কার কথা,” মঞ্জুর ভীষন রাগ হচ্ছে মেয়ের উপর। ভারী বালতি তুলতে প্রীতিকে কতবার করে মানা করেছে মঞ্জু কিন্তু কে শোনে কার কথা, সব মাতব্বরি করে নিজে নিজে করা চাই এই মেয়ের।

“মামী আর মেরো না দোহাই লাগে, এমনিতে পা কেটেছে,” সুমন, মঞ্জুর হাত থেকে অনেক কষ্টে প্রীতিকে ছাড়ালো। মঞ্জু মামী রাগ হলে একদম উল্টোপাল্টা মারতে থাকে, রাগ হয় সুমনের।

“তুই হলি সব নষ্টের গোড়া.. সবসময় আস্কারা দিয়ে দিয়ে ওটাকে বাঁদর বানাচ্ছিস। যখনই মারতে যাবো তখনই এসে বাঁধা দিস, আর এই জন্যই মেয়েটা একটা কথাও শোনে না।”

প্রীতিকে বাঁচাতে গিয়ে দুই একটা কিল সুমনের গায়েও লাগলো।

“এই তো এতো মারলে… আর কত মারবে? ” সুমন, প্রীতিকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নিলো। না হলে মামী মারতেই থাকবে।

প্রীতির বয়স এখন তের বছর। সে এবার অষ্টম শ্রেনীতে উঠেছে। সুন্দর গান করে। দেখতেও পুতুলের মতো সুন্দর। সমস্যা হলো পাড়ার ছেলেরা এক্ষুনি ওকে খুব যন্ত্রনা করে আর সেই রাগ মামী প্রীতির উপর ঝাড়ছেন সকাল থেকে। কে যেন মামীর নাম্বারে আই লাভ ইউ লিখে মেসেজ পাঠিয়েছে, আর এই নাম্বারটাই প্রীতির কোচিং থেকে শুরু করে সব বান্ধবীদের কাছে দেওয়া। কিন্তু এতে প্রীতির দোষটা কোথায় সুমন বুঝতে পারে না। মোবাইলের নাম্বারে যে কেউ মেসেজ দিতেই পারে, প্রীতি সেটা কেমন করে আটকাবে। আর ওটা যে প্রীতিকেই দিয়েছে তারই বা কি গ্যারান্টি… দিয়েছে তো মামীর নাম্বারে।

সুমন আর কথা না বাড়িয়ে টানতে টানতে প্রীতিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে লাগলো। বড় মামা অফিস থেকে আসলে আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে, রোজ রোজ এই যন্ত্রনা সুমনের আর সহ্য হচ্ছে না।

“সুমোদি… পায়ে খুব ব্যথা হচ্ছে,”প্রীতি, সুমনের বুকের মধ্যেই কেঁদে উঠলো। বেচারির মুখটা দেখে সুমনের নিজেরই কাঁদতে মন চাচ্ছে, উল্টো গোদের উপর বিষ ফোড়ার মতো মামীর হাতের মারটুকু খেলো বিনা দোষে। সুমন, প্রীতির জন্য ব্যাথার ওষুধ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু বিছানার পাশের দেরাজে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন ব্যাথার ওষুধ খুঁজে পেলনা সুমন।

” প্রীতি তুই একটুখানি বোস , আমি আলমারি থেকে ওষুধ নিয়ে আসি কেমন, ” সুমনের কথায় প্রীতি ঘাড় নেড়ে চুপ করে বসে রইলো।

সুমন একদৌড়ে নিচে নেমে পিছনের গেট দিয়ে সোজা পাশের সাদা রঙের বাড়িটার দোতলায় গিয়ে উঠলো। টানা ঝুল বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গিয়ে সবচেয়ে শেষের ঘরটায় ঢুকতেই বিশাল এক ঘর। তাতে সব হাল আমলের দামী দামী ফার্নিচার শোভা পাচ্ছে। সুমন সোজা বড় দেয়াল আলমারিটার দিকে এগিয়ে গেল। মেহগনি কাঠের আলমারিটায় তিনটা দরজা। মাঝের দরজায় চাবি ঢুকিয়ে হ্যান্ডেলে টান দিতেই আলমারির পাল্লাটা হা করে খুলে গেল, চট করে একটা ব্যাথার ওষুধ নিয়েই আবার নিজের ঘরে ছুটলো সুমন।

“সুমন ” নির্মলার ডাক শুনে থমকে দাড়ালো সুমন, বড়মার হাতে অনেকগুলো থান শাড়ি।

“বড়মা আমি এক্ষুনি আসছি, প্রীতিকে ট্যাবলেটটা দিয়ে আসি? ”

“ট্যাবলেট! এই তুই আন্দাজে কাকে কি ট্যাবলেট দিস…. শেষে উল্টোপাল্টা কিছু আবার না হয়।”

“হবে না বড়মা .. আমি তোমার ছেলেকে ভালো করে দেখিয়ে নিয়েছি।”

….……………………………………..

“মা সুমো কোথায়? ”

ছোট ছেলের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন নির্মলা দেবী।

“কি হল? এই সাত সকালে ষাড়ের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?”

দুই ছেলের মা তিনি, বড় ছেলে শান্তনু এম বিএ শেষ তাদের পারিবারিক ব্যাবসাটা দেখাশুনা করছে আর ছোট ছেলে শ্রাবণ আইন পাশ করে বাবা রামানাথ চৌধুরীর সাথে ওকালতি করছে।

ছেলেদের নিয়ে রামনাথ চৌধুরী বেশ গর্ব বোধ করেন। এটা নির্মলাকে খুব আনন্দ দেয় কিন্তু এর পাশাপাশি নির্মলার বেশ একটা দুঃখ আছে। তার নিজের কোন মেয়ে নেই। তাই পাশের বাড়ির বীরেন বাবুর নাতনি সুমনকেই তিনি নিজের মেয়ের মতো মনে করে আদর করেন৷ কাল সম্ভবত সুমন, শ্রাবণের জিনিসপত্র গুছিয়েছে। ছেলের ঈষত কোঁচকানো ভ্রূর দিকে তাকিয়ে নির্মলার তাই মনে হলো।

“সুমন কে খুঁজছিস কেন?”

“মা আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কেসের ফাইল খুঁজে পাচ্ছিনা,এখানে টেবিলের উপরেই রেখেছিলাম গতকাল কোর্ট থেকে ফিরে ” শ্রাবণ টেবিলের আশপাশটা ভালো করে দেখলো, নেই। চোখ বন্ধ করে আর কোথাও রাখলো কিনা ভাবলো,মনে পড়লো না। কাল গাড়ি লক করার আগে ফাইলটা ও হাতে নিয়ে ছিলো মনে আছে ওর।

তুড়তুড়িটা কোথাও উঠিয়ে রেখেছে গোছাতে গিয়ে, ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শ্রাবণ,” মা সুমোকে আমার সাথে কথা বলতে বলো দশ মিনিটের মধ্যে। ফাইলটা আমার আজকে লাগবে।”

” ওকে একটা ফোন দে, সারা দিনই তো কোন না কোন কাজে ব্যাস্ত থাকে। ”

“তিনবার দিছি একবারও রিসিভ হয়নি। মহারানী কার বাড়ি গিয়ে দাদাগীরি করতেছে কে জানে,”শ্রাবণ কব্জি উল্টে নিজের পেনেরাই ঘড়িটা দেখলো, আটটা পয়তাল্লিশ বাজে।

” কাওকে দিয়ে ওকে এখুনি খবর পাঠাও, দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে ফোন না দিলে আজকে তিনঘন্টা নীলডাউন করায় রাখবো তোমার মেয়েকে আমি শিওর,” বলেই সিড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেল শ্রাবন। আজ সত্যি ওর অনেক কাজ সাথে বাবার পুরানো একজন বন্ধুর সাথে তার জায়গা দেখতে যেতে হবে। তার জায়গায় অবৈধ ভাবে ঘর উঠিয়ে মার্কেট করছে তার এক আত্মীয়, সরজমিনে দেখার পর তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

গাড়িতে ওঠার আগেও আবার ফোন করলো শ্রাবণ, কিন্তু সুমনের কোন আভাস পাওয়া গেল না।

নির্মলা দ্রুত লোক পাঠালেন ও বাড়ি। তিনঘন্টা কেন তিন মিনিটও যে ছেলে সুমনকে নীল ডাউন করাবেনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত তিনি। যে ছেলে সুমনের গায়ে একটু আঁচড় পড়লে ওর মামীকে যেয়ে ধমকায় সে ছেলে আর যাই হোক সুমনেের কান্নার কারন কখনো হবেনা। কিন্তু ফাইলটা শ্রাবণের খুব দরকার বোঝাই যাচ্ছে আর সুমন না আসলে সেটা এখন খুঁজে পাওয়াও কঠিন।

“হ্যালো… ”

“হুমম…”

“আমায় খুঁজছিলে? ”

“না ফাইল খুঁজছিলাম”

“কোন ফাইল?”

“লাগবেনা পেয়ে গেছি.. গাড়িতেই ছিল।”

“আচ্ছা তাহলে রাখবো? ”

“আগে বল টো টো কোথায় ঘুরছিলি পড়া ফেলে”

“কোথাও না… বাড়ি ছিলাম”

“মোট পাঁচবার ফোন দিসি সুমি”

” ফোন বিছানায় ছিল বিশ্বাস করো শ্রাবনদা . বালিশের নিচে চলে গিয়েছিলো বলে টের পাইনি।”

” বিছানায় ফেলে রাখার জন্য তো ফোনটা কিনে দেওয়া হয়নি, প্রয়োজনে কাজে না লাগিয়ে কেবল ফেসবুকিং আর গান- বাজনা শোনার মতো ফালতু কাজে লাগালে নেক্সট কোন ফোন তুই পাবিনা আর নইলে একদম বাটন ফোন। ”

“আরে আমি মশলা করছিলাম… আর ফোন নিয়ে রান্নাঘরে গেলে মামী রাগ করে। ”

“অত খুসুর ফুসুর করলে তো রাগ করবেই, তোর ওই বান্ধবী কি যেন নাম কেয়া ওকে একটু কম ফোন দিতে বল তাহলে মামী আর রাগ করবে না।”

সুমন চুপ রইলো। কথা সত্যি কেয়া দিনে ওকে অন্তত পাঁচবার ফোন দিবে আর দিলে পনের মিনিট নূন্যতম কথা বলবে, সুমন ওকে বললেও কেয়া সেটা কোনভাবেই কানে তুলে না। একটা কানের দুল কিনবে তো সেই খবর সুমনকে না দেয়া পর্যন্ত ওর পেটের ভাত হজম হবে না আর শ্রাবণকে সেটা না বলা পর্যন্ত সুমনের পেটের ভাত হজম হবে না। তাই শ্রাবণদা খোঁচাটা মারতে পারলো 😐

“কিরে বোবা হয়ে গেলি নাকি? ”

“না শুনছি… তুমি বলো।”

“হুম.. আচ্ছা শোন, আজ তোর কলেজ খোলা আছে?”

“আছে… কি করতে হবে বলো।”

“যাবার পথে আমার টেইলার্সের কাছে যেতে পারবি? দুটো কোট বানাতে দেওয়া ছিলো, নিয়ে আসতে হবে, টাকা আমার ড্রয়ারে আছে মোট সাড়ে আটহাজার টাকা বিল। আমি ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি অফিসে গিয়ে ।”

“আচ্ছা। ”

“আরও একটা কাজ করবি।”

“কি? ”

“কোটের সাথে ম্যাচ করে দুইটা শার্ট বানাতে দিয়ে আসবি কাপড় পছন্দ করে, পারবিনা? টাকা ওখানে বাড়তি আছে। ”

“পারবো, কাপড় কি প্লেইন হবে না কোন প্রিন্ট থাকবে?”

“যেটা ভালো ম্যাচ করে তবে প্রিন্ট থাকলে খুব ছোট হয় যেন ”

“আচ্ছা ”

“হুম.. এখন ফোন রাখ, আমি গিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

সুমন বাড়ি গিয়ে দৌড়ে আগে গোসল সাড়লো। যাবার পথে শ্রাবণদার কাজ করতে গেলে আজ ওর বেশ অনেকটা সময় চলে যাবে, তাই আগে আগে না বের হলে প্রথম ক্লাসটা মিস হয়ে যাবে। সাথে টেইলার্সের মালিক বিমলদা , ওকে পেলেই রাজ্যের গপ্পো জুড়ে দেন। লোকটা খারাপ না কিন্তু উনার স্ত্রীর নানা রকম রোগ আছে। সুমন ওর নানুকে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, বিমলদাও বৌকে সেই ডাক্তারই দেখায়, সেই নিয়ে নানা আলোচনা চলে।

সুমন নিজে পরের বাড়ির আশ্রিতা,এটা ও সবসময় মাথায় রাখে। কোন কারনে বাসায় ফিরতে একটু দেরী হলে মঞ্জু মামী বাসায় ঢোকার সাথে সাথে মেজাজ খারাপ করতে থাকে। মামীর বাঁকা কথায় নানু খুব দুঃখ পায়। সুমন চায় না ওর নানু এই বয়সে কোন কারনে মন খারাপ করে। টুকটাক কিছু কেনাকাটা আছে ওর, সুমন সেটা শার্টের কাপড় কেনার সাথে একই সময়ে করবে ভাবলো তবে এজন্য ওকে একটু আগে আগে বের হতে হবে বাসা থেকে।

সুমনের মা প্রিয়া অসময়ে সুমনকে রেখে চলে যাওয়ার পর, সুমন মামা – মামীর গলগ্রহ হয়েই বেঁচে ছিলো। কিন্তু পাশের চৌধুরী বাড়ির সকলেই ওকে অনেক আদর করে, হয়তো ও অনাথ বলে, হয়তো ও প্রকৃত অর্থে কারো দায়িত্ব নয় বলেই সকলে ওকে স্নেহ করে। তবে ওকে সবার চেয়ে বেশি আদর করে বড়মা আর শাসনটা শ্রাবণদা। অনেকে তো বোঝেই না যে সুমন এ বাড়ির মেয়ে না। এই তো সেদিন বড়মা আর কাকাবাবুর সাথে শ্রাবণদার জন্য মেয়ে দেখে এলো ও, মেয়ের বাড়ির সকলে মনে করেছে ও পাত্রের ছোট বোন।

সবচেয়ে বড় কথা ওর পড়ালেখার সব দায়িত্ব শ্রাবনদার। সুমনের জন্য পেন্সিল থেকে শুরু করে স্কুল- কলেজ, প্রাইভেটের সমস্ত খরচ শ্রাবনদা দেয়।তাই রেজাল্ট খারাপ হলে স্কেলের বারি আর কানমলাও সেই দেয়, মোট কথা শ্রাবণ চৌধুরী ওর অলিখিত অভিভাবক। তবে সাজার মেয়াদ শেষ হলে সব সময়ই ভাল কিছু পুরস্কার পায় সুমন, শ্রাবনের কাছ থেকে। তাই ওসব শাস্তি ওর গা সওয়া।

“সুমন যাবার সময় এই টিফিন বাটিটা একটু বৌদির কাছে দিয়ে যা। বৌদি সেদিন বলছি বন্দনার নাকি আলু পোস্ত খুব খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি বলেছিলাম এর পরে যেদিন করবো সেদিন বন্দনার জন্য পাঠাবো, নে তুই দৌড়ে একটু দিয়ে আয়। ” মঞ্জু বাটিটা সুমনের হাতে তুলে দিলেন। নির্মলা বৌদি খুশি থাকা মানে রামনাথ চৌধুরীও খুশি থাকা। বড় ছেলে অনুকে আমেরিকা পাঠাতে গিয়ে ওদের বাড়ির কাগজ রামনাথের কাছে গচ্ছিত রাখা তিন বছরের বেশি। অথচ টাকাটা দুই বছরের মাথায় শোধ করবে বলেছিল সমীর। মাসে মাসে বেতন পেয়ে সমীর কিছু কিছু করে শোধ করছে, কিন্তু সংসারের টানাটানিতে সেই টাকাও খরচ হয়ে যায়, ফলে দেনা পরিশোধের জন্য জমান টাকার পরিমান প্রতিমাসে কেবল কমেই চলেছে। মঞ্জু তাই ও বাড়ির সকলের কথা হাসি মুখে মেনে নেন, যদিও শ্রাবণ ছেলেটাকে তার বেশ বেয়াদব মনে হয়। তবে সুমনের সব খরচ ওই শ্রাবণ দেয়। মঞ্জু খুব আশা করে আছে যে নির্মলা বৌদিকে বলে প্রীতির জন্যও যদি ওরকম কোন ব্যাবস্থা করা যায়।

…………………

বন্দনা বৌদিকে ভারী ভালো লাগে সুমনের। কি সুন্দর যে দেখতে। বৌদির এখন সাতমাস চলছে, কিছুই তেমন খেতে পারেনা। বড়মা তাই প্রতিদিন অনেক পদের তরকারি করে, কিন্তু তাও ঠিকমতো কিছু খায়না বৌদি।

খাতাগুলো ব্যাগে পুরে তরকারির বাটিটা নিয়ে সোজা চৌধুরী বাড়ির রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো সুমন,” বড়মা, মামী বৌদির জন্য আলু পোস্ত দিলো।”

“ওটা মিট সেলফে তুলে রেখে তুই টেবিলে আয় এক্ষুনি, সকালে পরোটা করেছিলাম সাথে সুজির হালুয়া আর সব্জি, একটা অন্তত মুখে দিয়ে তারপর কলেজে যা,” নির্মলা তাড়া দিলেন। জানেন সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে তিনি না বললে প্রায়দিনই হাসিমুখে না খেয়ে কাটিয়ে দেয় মেয়েটা। সুমনের মামী মঞ্জু বেশ সুবিধাবাদী মানুষ। নিজের মেয়ে প্রীতির বেলায় তার দায়িত্ববোধ ষোলআনা কিন্তু সুমন ছোটবেলা থেকে ওদের কাছে মানুষ হয়েও মঞ্জুর মনে স্থান পেলনা। সুযোগ পেলেই তাই ছোটখাট কিপটেমি চলতেই থাকে মঞ্জুর। সুমনের মামা সমীর অবশ্য ভাগ্নীকে যথেষ্ট আদর করে, তাতে আবার সুমন অনাথ। সব মিলিয়ে নির্মলাকে তাই সুমনের দিকে খুব খেয়াল রাখতে হয়।

“আমি হালুয়া খাবনা,” নাক কোঁচকালো সুমন। সকাল সকাল মিষ্টির নাম শুনলেই ওর গা গোলায়।

“তাহলে সব্জি দিয়ে খা,” জোর করে দেড়টা পরোটা সুমনের থালায় তুলে দিলেন নির্মলা।

“বড়মা জলপাইয়ের আচাড়টা কই? আমি এক চামচ আচার নেব।”

নির্মলা হাতের ইশারায় কোনার দিকের কাঠের আলমারিটা দেখিয়ে দিলেন,” আচার গুলো সামনে শুক্রবার রোদে দিবি মনে করে।”

সুমন মাথা নেড়ে খেতে লাগলো।

“বড়মা শ্রাবণদার জন্য যে মেয়ে দেখতে গেলাম আমরা তারা কিছু বললো? ”

“বলেছে, তোর দাদাকে দেখতে চায়। তা না হলে এতোদিনে বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে যেত।”

” তাই! তাহলে তো সামনে বিয়ে খাব। বড়মা আমি শ্রাবনদার বিয়েতে কিন্তু একটা লাল পাথর বসান কানের দুল নিব, ওটা আমার পূজোর জামার সাথে একদম মিলে যাবে,” আনন্দে সুমনের চোখমুখ জ্বল জ্বল করতে লাগলো। তাই বোধহয় শ্রাবনদা দু দুটো কোট বানাতে দিয়েছে।

“আচ্ছা নিস, আগে তোর দাদা দেখে আসুক। রাজি হলে দুলের সাথে হার আর লাল একটা সুন্দর শাড়িও কিনে দিব।”

“তুমি দেখো বড়মা শ্রাবণদার অনেক পছন্দ হবে, মেয়েটা কিন্তু অনেক সুন্দরী, ডালিমের মতো দুটো গাল।”

“হ্যা, আমার তো ভালই লাগলো, তোর কাকাবাবুরও অনেক পছন্দ হয়েছে। মামা – চাচারা সব বিদেশে থাকে, এখন শ্রাবণ হ্যা বললেই তোর কাকাবাবু বিয়ের তোরজোর শুরু করবে।”

“আচ্ছা বড়মা আমি গেলাম, যাবার পথে আবার টেইলার্সে দাড়াতে হবে কোট নিতে। দাদা বললো কোটের সাথে মিলিয়ে শার্টের কাপড় নিতে, এখন না পারলে ফেরার সময় কিনবো, যদি দেরী হয়… মামীকে তুমি একটু বলে রেখনা বড়মা যেন রাগ না করে।”

“ঠিক আছে মঞ্জুকে আমি বলে রাখবো,কিন্তু সেই সুযোগে আবার এখানে ওখানে যাবিনা।”

“না.. আজ টেইলার্সেই অনেক সময় বেরিয়ে যাবে। তারপর মামাবাবু আসলে প্রীতিকে নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাবো বিকেলে ,” সুমন ব্যাগ নিয়ে উঠে পরলো। শ্রাবণের আলমারি থেকে গুনে গুনে ছাব্বিশটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে নিলো। শ্রাবনের শার্টের কাপড় কিনে টাকা বাঁচলে এক জনকে কিছু টাকা সাহায্য করবে ও।

নির্মলা, সুমনের খাবার থালিটা উঠাতে গিয়ে দেখলেন সুমন মোবাইল অমনি ফেলে রেখে চলে গেছে, শ্রাবনের ঘরেই গেছে জানেন তাই জোরে বলে উঠলেন, ” সুমন তোর মোবাইল এখানে পড়ে আছে আর খাবার পর জলটুকুও গিলিসনি মেয়ে, এখুনি এখানে এসে খেয়ে যা।”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here