#তোমার_প্রেমের_ছোঁয়ায়💜
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি💜
#পার্টঃ১৬
প্রিয়জনকে হারানোর ব্যাথা যে কতোটা যন্ত্রনা কাতর তা শুধু যে এই ব্যাথায় ব্যাথিত সেই বুজতে পারে।তীব্র একটা ভোঁতা যন্ত্রনা হৃদয়টাকে ক্রমাগত ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়।মনে হয় ইসস,মরে কেন যাচ্ছি না।এতো কষ্ট তো সইবার নয়।
ওপারেশন থিয়াটারের সামনে বসে আছে আদিয়াত।বিধস্ত্ব দেখাচ্ছে তাকে।ভীতরে আহি’র চিকিৎসা চলছে।সোহেবই চিকিৎসা করছে আহি’র।সোহেব বলেছে অবস্থা অনেক খারাপ।
এরই মাঝে উপস্থিত হলো এশা,রোজা,জিহাদ। সোহেবই তাদের ফোন করে আসতে বলেছে।কারন আদিয়াতের অবস্থা ভালো না ওকে সামলানোর জন্যে কাউকে প্রয়োজন।এশা আবার ফোন করে সেহরা জাহান,হাসান আহমেদ আর সিয়াকেও জানিয়ে দিয়েছেন তারাও আসছেন।এশা এসেই আদিয়াতের কাধে হাত রাখলো।ধীর গলায় বলে,
” আদি টেন্সন করিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আদিয়াত কিছুই বললো না।একধ্যানে শুধু ও.টির দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।
সবাই এটা ওটা বলছে আদিয়াতকে কিন্তু তার কোন নড়াচড়া নেই।এরই মাঝে উপস্থিত হলো সেহরা জাহান,হাসান আহমেদ,আর সিয়া।সেহরা জাহান এসেই কান্না জড়িত গলায় বলেন,
” আমার ছেলে কোথায়?ও ঠিক আছে তো?”
সিয়া কান্নাচোখেও বিরক্তি নিয়ে তাকায় মায়ের দিক।শুনেছে আহি আপু’র চিকিৎসা চলছে।তার কথাটা অন্তত আগে জিজ্ঞেস করার দরকার ছিলো।আহি মাঝে মাঝে নিজের মা’কে দেখে প্রচন্ড অবাক হয়।
আদিয়াতের পাশে রাখা বেঞ্চে আহি’র ব্যাগ থেকে ক্রমাগত ফোনের রিংটোনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।কিন্তু আদিয়াতের তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই।
সিয়া নিজেই এগিয়ে গিয়ে ব্যাগ খুলে ফোন বের করে দেখে নিহান নামের কারো কাছ থেকে ছাব্বিশটা কল এসেছে।মুহূর্তেই আবারো ফোন বেজে উঠলো।সিয়া কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলো।ফোন রিসিভ করতেই নিহানের অস্থির গলা শোনা গেলো,
” আহি! বোন আমার! তুই ঠিক আছিস? এতো করে কল দিলাম।তুই রিসিভ করছিস না কেন?”
সিয়া এক ঢোক গিললো।কাঁপা গলায় বললো,
” আমি আহি আপু না।”
নিহান বললো,
” তাহলে তুমি কে?”
সিয়া নিজেকে শান্ত করলো।নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে উত্তর দিলো,
” আমি আহি আপুর মামাতো বোন।”
মুহূর্তেই কথাটা শুনে নিহান থমকে গেলো।আহি’র মামাতো বোন মানে?মানে আদিয়াতের বোন?কিন্তু তার কাছে আহি’র ফোন কি করছে?আবার! আবারও তারা আহি’র সাথে কিছু উলটা পালটা করবে না তো?নিহানের রাগে চোখ লাল হয়ে এলো।শক্ত কন্ঠে বললো,
” তোমার কাছে আহি’র ফোন কি করে এলো?আর! আর আমার বোন কোথায়?”
সিয়া এইবার আর কান্না আটকাতে পারলো না শুধু বললো,
” আহি আপুর অবস্থা ভালো না।আপনি জলদি ****** হাস্পাতালে এসে পরেন।”
সিয়া তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলো।
তারপর ভাইয়ের দিকে তাকালো।আদিয়াতকে এরকম সে কখনো দেখেনি।কেমন শান্ত হয়ে আছে।কিন্তু চোখ মুখ লাল তার।সেহরা জাহান ছেলেকে নানান কথা জিজ্ঞেস করছেন,
” বাবা! তোর কি হয়েছে?কথা বল বাবা।তুই ঠিক আছিস বলছিস না কেন?”
হাসান আহমেদ স্ত্রী’র কান্ডে বিরক্ত।যেখানে একটা মেয়ে বাঁচা মরা নিয়ে লড়াই করছে।সেখানে তিনি দেখছেন আদিয়াত সুস্থ্য আছে তাও এরকম শুরু করেছেন।হাসান আহমেদ ধমকে উঠেন,
” সেহরা! কি শুরু করলে তুমি?যে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে তার খোঁজ না নিয়ে।তুমি দেখছো আদিয়াত ঠিক আছে।তাও এই কথা জিজ্ঞেস করছো?একটু তো দয়া মায়া রাখো। এতোটা স্বার্থপর কি করে হয়ে গেলে তুমি?”
সেহরা জাহান আর হাসান আহমেদের কথার পরিপেক্ষিতে কিছু বলতে পারলেন না।মাথা নিচু করে বসে আছেন।
কিছুক্ষনের মাঝে এসে হাজির হয় আদিয়াত।এসেই পাগলের মতো জিজ্ঞেস করে,
” আমার বোন কোথায়?কেমন আছে ও?”
সিয়া তাকাতেই থমকে গেলো এটা তো সেদিনের সেই লোকটা।তবে এটাই কি আহি আপুর ভাই।সিয়া এগিয়ে গেলো নিহানের দিকে।বললো,
” আহি আপুর চিকিৎসা চলছে আপনি প্লিজ শান্ত হয়ে বসুন।কিচ্ছু হবে না আহি আপুর।সে একদম ঠিক হয়ে ফিরে আসবে।”
নিহান চোখ তুলে তাকালো।আরে এটা তো সেদিনের সেই মেয়েটা।যে দিনরাত নিহানকে ঘুমোতে দেয় না।দেখা হওয়ার পর থেকে নিহানের সর্বস্ব জুড়ে বিচরণ করছে।
নিহান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো সিয়ার দিকে।তারপর নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে,
” আহি কোথায়?ওর কি হয়েছে?ডাক্তার কি বলেছে?”
সিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
” ডাক্তার এখনো বের হয়নি।কিন্তু বলেছেন আহি আপুর অবস্থা বেশি ভালো না।”
দেখা গেলো ও.টি থেকে সোহেব বের হয়েছে।আদিয়াত দ্রুত উঠে দাড়ালো।সোহেবের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আহিয়ানা?আহিয়ানা ক..কেমন আছে? আ..আমার আ..আহিয়ানা?”
সোহেব মাথা নিচু করে নিলো।তা দেখে আদিয়াত এইবার রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললো,
” বলছিস না কেন?আমার আহি কেমন আছে?”
নিহানও এগিয়ে আসলো।আদিয়াতের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিহান নিজেই সোহেবকে জিজ্ঞেস করে,
” আহি’র কি হয়েছে?আমার বোনটা ঠিক আছে তো?”
সোহেব শ্বাস নিলো লম্বা করে। তারপর বলে,
” আহি’র অবস্থা খুব একটা ভালো না।ওর মাথায় অতিরিক্ত প্রেসার পরার কারনে এই অবস্থা।আর ও মনে হয় খালি পেটে ওভার ডোজের মেডিসিন খেয়ে নিয়েছিলো।যার কারনে তা উলটো একশন করে। হয়েছে কি?আহি মাত্রা অতিরিক্ত মানসিক চাপের মাঝে ছিলো।মানসিক চাপের কারণে মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক বস্তু বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্য নষ্ট হয়, অন্তঃক্ষরা বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোনের ঘাটতি-বাড়তি হয় এবং এসবের প্রভাবে হৃদ্যন্ত্রের সংকোচন-প্রসারণের হার পরিবর্তিত হয়, নিশ্বাস-প্রশ্বাস হয় অস্বাভাবিক।আর ভুলভাবে মেডিসিন নেওয়ার কারনে ওর নাক মুখ দিয়ে রক্তও বের হয়েছে।”
আদিয়াত সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়।নিজের কানকে সে এইসব কথাগুলো কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছে না সে।তার আহিটা এতোটা কষ্ট কেন পাচ্ছে?কি দোষ তার ভালোবাসার?আদিয়াত তো এইসব চায়নি।আদিয়াত কাঁপা গলায় বললো,
” আমার আহিয়ানা ঠিক হয়ে যাবে তো সোহেব?”
সোহেব কি বলবে।কি বলে নিজের বন্ধুকে শান্তনা দিবে তা জানা নেই ওর।আরো একটা কথা বলার আছে কিন্তু কিভাবে বলবে ভেবে পাচ্ছে না ও।এদিকে আদিয়াত পাগলের মতো ছটফট করছে।বার বার জিজ্ঞেস করছে তার আহিয়ানা ঠিক হয়ে যাবে তো?নিহানের চোখ দিয়ে পানি পরছে।নিজের ছোট্ট বোনটার এতো কষ্ট ও কিছুতেই সয্য করতে পারছে না।এদিকে এশা শুধু দেখে চলেছে আদিয়াতকে। আদিয়াত ঠিক কতোটা ভালোবাসে আহি’কে।যার কারনে সে এমন পাগলামি করছে।এশা ধুকড়ে কেঁদে উঠে।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে অন্য একজনকে ভালোবেসে এতোটা ছটফট করতে দেখা যে বড্ড যন্ত্রনার।এশা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।সে সরে যাবে আদিয়াত আর আহি’র মাঝ থেকে।তার অব্যক্ত কথাগুলো নাহয় লুকিয়েই থাকুক।তার ভালোবাসাটা আদিয়াতের অজানাই থাকুক।সে নাহয় দূর থেকেই আদিয়াতকে ভালোবেসে যাবে চিরকাল।
নিহান চিৎকার করে বললো,
” আমার বোনকে যে করেই হোক ঠিক করে দিতে হবে ডাক্তার।নাহলে সব শেষ করে দিবো।”
সোহেব বিষন্ন গলায় বলে,
” দেখুন। আহি’র অবস্থা অনেকটা ক্রিটিকাল।আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি।
আর আহি’র সমস্যা মারাত্মক হওয়ার কারন আহি প্রচুর পরিমানে মদ্যপান করতো।যার কারনে সমস্যাটা এতোটা জটিল।
এ্যালকোহল পান করলে মানুষের রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে যে রক্তনালী – সেগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে যার ফলে স্মৃতি লোপ পেতে পারে।
এতে ডেমেনশিয়ার ঝুঁকি তিন গুণ বেড়ে যায় বলে ফ্রান্সের একটি সাম্প্রতিক জরিপে বলা হয়। আরেকটি জরিপে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে ১৮ ইউনিটের বেশি যারা পান করেন তাদের আয়ু চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
আহি’র সমস্যাটা এই কারনেই এতোটা কঠিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ”
আদিয়াত সবটা শুনে উঠে দাড়ালো।সোহেবের দুহাত আকড়ে ধরে বলে,
” ভাই। আমার আহিকে ঠিক করে দে না।আমি বাঁচবো না ওকে ছাড়া।পাঁচটা বছর ওকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি।যাতে ও ভালো থাকে।কিন্তু আমার আহিয়ানা যে ভালো ছিলো না।এইসব জানলে আমি কখনই ওকে রেখে যেতাম না।প্লিজ আমার হৃদয়টাকে ঠিক করে দে।
দেখনা আমার না কষ্ট হচ্ছে। ভীষন কষ্ট।এই বুকটায় জ্বালা পোড়া করছে।দেখ আমি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছি না।ঠিক করে দে না আমার আহিয়ানাকে।ফিরিয়ে দে ওকে।”
সোহেব নিজের বন্ধুর এমন করূন দশা দেখে ওর কান্না পাচ্ছে।তাও নিজেকে সামলে নিলো।এখন ওকে ভেংগে পড়লে চলবে না।আহিকে সুস্থ্য করতে হবে। যে করেই হোক।সোহেব নিহানকে জিজ্ঞেস করলো,
” আহি’র কি আগে কোন বড় ধরনের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো?”
নিহান ধরা গলায় জবাব দিলো,
” হ্যা! পাঁচবছর আগে ওর অনেক বড় একটা রোড এক্সিডেন্ট হয়।এতে ও মাথায় প্রচুর আঘাত পায়।ডাক্তার এর পর থেকে বার বার সতর্ক করে দেয় যাতে ওকে বেশি প্রেসার না দেওয়া হয়।এতে ওর মাথায় রক্তজমাট বেধে ও মারা যেতে পারে।”
আদিয়াত একের পর এক ঘটনা শুনে যাচ্ছে।ওর আগোচড়ে কতো কি হলো। অথচ আদিয়াত কিছু জানে না৷ কিচ্ছুটি না।আদিয়াত ভেবে নিলো।আজকেই নিহানের মুখ থেকে সব সত্য জানবে সে।ঠিক কি কি হয়েছিলো পাঁচ বছর আগে।আদিয়াত কান্না করতে করতে দেয়াল ঘেসে বসে পড়লো।ওর মন বলছে,
” আগে যদি জানতাম কোন একদিন তোর পথের কাটা হবো,, আমার জন্য তোর অনেক ক্ষতি হবে,, আসতাম না কখনও তোর জীবনে.. ভালবাসতাম না কখনও তোকে,, জড়াতাম না তোর জীবনে নিজেকে.. কি করবো..?? ভূল যখন করেছি মাশূল তো দিতে হবে,, চলে যাবো নীরবে তোর জীবন থেকে,, ভালো থাকিস তুই অন্য কাউকে নিয়ে।”
#চলবে______